আমি তখন ক্লাস থ্রি। এসএসসি পাস করার পর দিদি কলেজে পড়ার
জন্য শহরে চলে গেল। আমার আনন্দ এবং বিপদ একসাথে হাজির হলো। সে বাড়ি থেকে চলে যাওয়া
মানে আমার মুক্তির আনন্দ। সারাক্ষণ তার খবরদারি থেকে মুক্তি। ইচ্ছেমতো পুকুরে দাপাদাপি করার স্বাধীনতা, স্কুল
ছুটির পর সোজা বাড়িতে না এসে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলে ধুলোকাদায় মাখামাখি
হবার স্বাধীনতা। প্রতিবেশীদের নালিশ শুনে যার দোষই হোক, আমার পিঠেই দমাদম কিল মারতো
সে। সেইসব নালিশকারী প্রতিবেশীদের লাউগাছ-সীমগাছ এবার কীভাবে আস্ত থাকে দেখবো। কিন্তু
বিপদ দেখা দিল অন্যদিকে। দিদি চলে যাবার দুদিনের মধ্যেই আমার পাঁচ বছরের বড় দাদা যে
আমার দন্ডমুন্ডের মালিক হয়ে উঠবে সেটা জানা ছিল না। আগে দুইভাই দিদির শাসনে অতিষ্ঠ
হয়ে একজোট হতাম। এখন দিদি চলে যাবার পর দাদাই আমাকে শাসন করার ক্ষমতা দখল করল। আগে
দাদার অগোচরে দিদির কাছে তার নামে নালিশ করে তাকেও কত মার যে খাইয়েছিলাম। ভেবেছিলাম
দাদা আমার ষড়যন্ত্রের কথা জানতো না বা জানলেও মনে রাখেনি। কিন্তু আমার ভুল ভাঙতে দুদিনও
লাগলো না। দিদির অনুপস্থিতিতে বুঝতে পারলাম এতদিন সে শাসন করলেও দাদার অপশাসন থেকে
রক্ষাও করতো। এখন বাবা বাজার করে দিলে বাজারের ব্যাগ আমাকেই বয়ে নিয়ে আসতে হয় বাড়িতে।
আর দাদা হাফপ্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে হেলেদুলে হাঁটে। বড় ভাইবোনদের অত্যাচারে বাড়ির
ছোটদের যে কী যন্ত্রণা হয় তা তো বড়রা বুঝতেই চাইবে না। বাবা বেশিরভাগ সময়েই বাড়িতে
থাকে না, ফলে দিদির অনুপস্থিতিতে দাদার শাসন দুঃশাসনের মতো লাগতে শুরু করলো। দিদিকে
মিস করতে শুরু করলাম।
বার্ষিক পরীক্ষার পর বাবার সাথে শহরে চললাম দুই ভাই। দিদির
হোস্টেলে গিয়ে দিদির কাছে দাদার নামে কী কী নালিশ করবো তার একটি তালিকা মনে মনে করে
নিয়েছি। অবশ্য পরে দাদার হাত থেকে কে রক্ষা করবে সে ব্যাপারে তখনও কিছু ভাবিনি। সেটা
পরে ভাবা যাবে। আপাতত লঞ্চের ভীড়ে যত কান্ড ঘটছে সবকিছুই চোখ দিয়ে গিলতে শুরু করলাম।
নাপোড়া থেকে শহরে যাবার সবচেয়ে সহজ পথ ছিল নদীপথ। সড়ক পথে
যেতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো। নাপোড়া থেকে গুনাগরি পর্যন্ত হেঁটে বা রিকশায় যেতে হতো। তাও সরাসরি যাবার উপায় ছিল না।
শিল্কুপের পর একটা পাকা ব্রিজ একাত্তরে পাকিস্তানি মিলিটারিদের জিপ নিয়ে ভেঙে পড়েছিল
বলে একাত্তরে আমাদের গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারিরা যেতে পেরেছিল যুদ্ধ শুরু হবার অনেক
পরে। এই ব্রিজটির পাশ দিয়ে জমির উপর হাঁটা পথ ছিল। সেটা পার হয়ে আবার রিকশা নিতে হতো।
গুনাগরি থেকে লক্কর ঝক্কর জিপ যেতো পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সাতকানিয়ায়। সেখান থেকে আরাকান
সড়ক ধরে বাস অথবা সেই জিপ নিয়ে কালুরঘাট ব্রিজ হয়ে শহরে যেতে যেতে সকাল থেকে সন্ধ্যা
হয়ে যেতো। নদীপথ তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল বলে বাবা আমাদের নিয়ে নদীপথেই রওনা হলেন।
নাপোড়া থেকে রিকশা নিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই চাম্বল বাজার। সেখান
থেকে পশ্চিম দিকে ছোট একটি পায়ে চলা পথে বাংলাবাজার ঘাট। আমার বাবার একটি দুই ব্যাটারির
টর্সলাইট ছিল। আমি খুব আহ্লাদ করে টর্সটি বাবার হাত থেকে নিয়ে কয়েক কদম যাবার সাথে
সাথেই অন্ধকারে আমার হাত থেকে টর্সটি কেড়ে নিয়েছিল দাদা। অন্ধকারে আলো দেখানোর দায়িত্ব
নাকি ছোটদের হাতে থাকতে নেই। বারো বছর বয়সেই সে বিরাট জ্ঞানী হয়ে বসে আছে – ক্ষমতালোভী
শয়তান। তালিকায় আরো একটি অভিযোগ যোগ করে নিলাম।
কত্তোবড় নৌকা – বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেই আমার সবজান্তা
দাদা কোটের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো, ‘এটা নৌকা নয়, লঞ্চ। আর এটা তেমন কোন বড় লঞ্চ
নয়। এর চেয়েও বড় লঞ্চ আছে।‘ এর আগে আর একবার মাত্র আমরা লঞ্চে চড়েছিলাম – তাও একসাথে।
তবে সে কীভাবে এর চেয়েও বড় লঞ্চ দেখলো জানি না। কিন্তু প্রশ্ন করে জুলপির চুলে টান
খাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। তাই তার জ্ঞান নিরবে মেনে নিয়ে লঞ্চের টুলে বাবার পাশে বোচকাটা
রেখে আমার কোটের গলার কাছের বড় বোতামটাও লাগিয়ে নিলাম। নাপোড়া বাজারে বুধবার ও শনিবার
বাজার বসে। ঠেলাগাড়িতে করে অনেক শীতের জামাকাপড় বিক্রি করতে এসেছিল গত বুধবার। সেখান
থেকে আমাদের দুজনের জন্য দুটো কোট কেনা হয়েছে শহরে যাওয়া উপলক্ষে। কোটে বুকের শীত মানলেও
হাফপ্যান্ট পরা থাকার কারণে পায়ে ঠান্ডা লাগছে। বোচকার মধ্যে একটা কাঁথা আছে। সেটা
বের করবো কি করবো না বুঝতে পারছিলাম না।
লঞ্চে খুব ভীড়। লম্বা বেঞ্চে ঠেলাঠেলি করে বসে আছে সবাই।
মাঝখানে বিশাল কালো রঙের তেল আলকাতরা মাখা ইঞ্জিন গমগম করে প্রচন্ড শব্দে চলছে। কথা
বলতে হচ্ছে জোরে জোরে। লঞ্চের খোলা জানালা দিয়ে হুহু করে ঠান্ডা বাতাস আসছে। দাদা ইতোমধ্যেই
তার কোটের আভিজাত্য ভুলে গিয়ে বোঁচকা থেকে কাঁথা বের করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে
ফেলেছে। আমাকেও কোন রকমে সেই কাঁথার ভেতর ঢুকতে হবে।
লঞ্চের অনেক যাত্রীই বাবাকে চেনে। বাবার সাথে কথাবার্তা বলছে।
লঞ্চ ছেড়ে দেয়ার পরও অনেকে বাবার কাছে এসে “বদ্দা, আইবান কত্তে?” “পোয়া অলরে লই যন
দে নে শহর দেখাইবার লাই?” “মাইয়ারে ত গভমেন কলেজত দিয়ন হুন্নি। মাইয়া পোয়া পরাই এরে
কন লাভ নাই। আঁরইবারে বিয়া দি ফেলাইয়ি।“ বাবা কোন কথা বলছেন না দেখে বুঝতে পারছি এই
লোকের কথাবার্তা তাঁর পছন্দ হয়নি।
দিদিকে আর পড়াশোনা না করানোর জন্য গ্রামের অনেকেই নিজে থেকে
এসে বাবাকে উপদেশ দিয়েছিলেন। আমি দোকানে দাঁড়িয়ে অনেক কথাবার্তা শুনেছি। গন্যমান্য
একজন শিক্ষক এসে বাবাকে বলেছিলেন, “মেয়েদের বেশি লেখাপড়া করালে তাদের পাখা গজাবে। তুমি
শহরের কলেজে মেয়েকে পড়তে দিলে সেই মেয়ে আর ঘরে আসবে না।“ বাবা মিনমিন করে বলেছিলেন,
“মেয়ে আমার ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করেছে। আমাদের এই স্কুল থেকে তার আগে আর কোন মেয়ে ফার্স্ট
ডিভিশনে পাস করেনি। মেয়ের আগ্রহ আছে আরো পড়াশোনা করার। ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেয়ে সরকারি
কলেজে চান্স পেয়েছে। হোস্টেলে সিট পেয়েছে। আমি তাকে পড়াবো না? আমার মেয়ে যতদূর পড়তে
চাইবে, আমি যেভাবেই হোক পড়াবো।“ মাস্টারমশাই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছিলেন, “পরে
পস্তাবে।“ আমার বাবা আর কিছু বলেননি। গ্রামের জমিদারমশাই এসেও বাবাকে বলেছিলেন, “তুমি
দোকান চালাচ্ছো এর ওর কাছ থেকে টাকা ধার করে। দুদিন পরে যে মেয়ে শ্বশুরবাড়ির ভাত রাঁধবে তাকে
পড়াচ্ছো শহরের কলেজে। “পোঁদত নাই ত্যানা, মিঢা দি ভাত খানা!”” বাবা জমিদারমশাইর কথার
কোনো জবাব দেননি। শুধু নিরবে তাকিয়ে ছিলেন তার মুখের দিকে।
চাঁদের আলোয় সাগরের পানি চিকচিক করছে। ঘাড় ফিরিয়ে কিছুক্ষণ
তাকালাম। কিন্তু ঘুমে তলিয়ে গেলাম একটু পরেই। ঘুম ভাঙলো ভোরবেলায়। লঞ্চ তখন সদরঘাটের
লঞ্চঘাটায় ভিড়ছে। যাত্রীরা জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করেছে। মনে আছে গতবার লঞ্চ থেকে আবার
ছোট নৌকায় উঠতে হয়েছিল। এবার লঞ্চ সরাসরি লম্বা কাঠের এক সেতুর পাশে ভিড়েছে। কাঠের
লম্বা সিঁড়ি দিয়ে সেখানে উঠে যাচ্ছে যাত্রীরা। বাবা উঠে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়েই ভীষণ
চঞ্চল হয়ে আশেপাশে বেঞ্চের নিচে দ্রুত কী যেন খোঁজ করতে শুরু করলেন। বোঁচকার ভেতর,
আমাদের কাঁথা যা একটু আগেই ভাঁজ করেছি তার ভেতর – কী যেন খুঁজছেন। এই শীতেও তাঁর কপালে
বিন্দু বিন্দু ঘাম। ফর্সা মুখ থমথম করছে। আমি ঘাটের সিঁড়ি সম্বন্ধে কিছু একটা বলতে
যাচ্ছিলাম, দাদা আমার হাত ধরে টান দিলো। অর্থাৎ কোন কথা বলবি না।
লঞ্চের সবাই নেমে গেছে। ড্রাইভার আর সহকারিরা বাবার কাছে
এসে দাঁড়িয়েছে। কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল বাবার পকেটমার হয়েছে। তাঁর সব টাকা তিনি একটি
লম্বা কাপড়ের ব্যাগের ভেতর রেখে কোমরের সাথে বেঁধে রেখেছিলেন। ঘুম আর ভীড়ের সুযোগে
পকেটমার তাঁর সব টাকা নিয়ে গেছে। লঞ্চের ড্রাইভার বা হেলপারদের কারো কিছু করার নেই।
কাপড়ের থলে কাঁধে আর বোঁচকা হাতে নিয়ে লঞ্চের সিঁড়ি দিয়ে ঘাটের সিঁড়িতে ওঠার সময় বাবাকে
কেমন যেন সর্বস্বান্ত মনে হচ্ছিলো। ঘটনার গুরুত্ব আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তবে দাদা
সম্ভবত বুঝতে পারছিল। অন্য সময় হলে সে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে কীভাবে পা টিপে টিপে হাঁটতে
হবে সে সম্পর্কে অনেক উপদেশ দিতো। কিন্তু এখন একটাও শব্দ করছে না।
ঘাটের কাঠের সেতুর উপরেই কয়েকটা ছোট ছোট চায়ের দোকান। লম্বা
একটি টুলে বসে পড়লেন আমাদের সদ্য সর্বস্ব হারানো বাবা। আমার ভীষণ বাথরুম পেয়েছে। চেপে
বসে রইলাম।
“বদ্দা, কী অইয়ে দে?” – বলে বাবার পাশে এসে যিনি বসলেন তাঁকে
আমরা চিনি। লঞ্চে তিনিও ছিলেন। বাবার সাথে অনেকক্ষণ কথাও বলেছেন। আমরা তাঁকে চাচা ডাকি।
“এভাবে কেন বসে আছেন? আমার ভাইপোদের নিয়ে শহরে এসেছেন, মন খারাপ করে থাকলে চলবে?”
বাবা হঠাৎ তাঁর হাত দুটো ধরে কেমন যেন কাঁদো কাঁদো স্বরে
বললেন, “অ ভাই!”
চাচা তাঁর লুঙ্গির কোঁচড় থেকে বের করে দ্রুত বাবার হাতে তুলে
দিলেন তাঁর হারানো টাকার থলে। বাবার মুখে আলো জ্বলে উঠলো। চাচাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কত
আছে জানো?”
“জানি। দশ হাজার এক শ। দুইটা নোট ছেঁড়া আছে। সতীশ বহদ্দারের
কাছ থেকে ধার করেছেন, তাই না?”
“জানার পরেও ফেরত দিচ্ছো?”
“বদ্দা। লোভ সামলাতে পারিনি প্রথমে। পরে আপনাকে দেখে কেমন
যেন খারাপ লাগলো। নিজেকে নেমক হারাম বলে মনে হলো। আপনার মনে আছে কি না জানি না, যুদ্ধের
আগে প্রচন্ড তুফানের সময় আমার বাড়িতে এক দানাও চাল ছিল না, হাতে একটা টাকাও ছিল না।
গভীর রাতে আপনার কাছে আমি গিয়েছিলাম। আপনি সেই ঝড়তুফানের মধ্যে দরজা খুলে আমাকে চাল
দিয়েছিলেন। সেই চালের ভাত খেয়েছি আমি, ভাত খেয়েছে আমার ছেলেমেয়েরা। আর আমি আপনাকে সর্বস্বান্ত
করে দিয়েছিলাম।“ “আঁরে মাফ গরি দিয়ন বদ্দা।“
চাচা চলে গেলেন। বাবার মুখে হাসি ফিরে এলো। আমরা নদীর দিকে তাকালাম। সকালের কুয়াশা ভেদ করে সূর্য উঠছে।