Friday, 21 February 2025

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ১৯ - ২০

 -----------------------------------

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫

___________________________________

১৯

 

চারপাশে পাখির জেগে ওঠার কিচিমিচি শব্দ, বাড়ির ঘরের খোপের মোরগ পাখা ঝাপটে ডেকে উঠল কুককুরত কু কিছুক্ষণের মধ্যে আযান দেবে সাবেরা খাটের উপর উঠে বসল আড়মোড়া ভাঙল শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছে চোখ দুটো জ্বালা করছে সারারাত ঘুম হয়নি বড় আশা করেছিল মায়ের মৃত্যু তিনভাইকে কাছে টানবে অনেক বছর পর হয়তো ভাইয়ে ভাইয়ে মিলবে কিন্তু সব অসার মায়ের লাশ সামনে রেখেও ওদের মনটা নরম হল না

          সাবেরা বুঝতে পারে না সম্পর্কের চেয়ে সম্পদ এত বড় হয় কী করে মানুষের কাছে অরিনের বাবাটাও বুঝল না একটা মাত্র জমি ঢাকা শহরের বুকের মাঝখানে ওটার দাম কোটি কোটি টাকা হলেও মায়ের পেটের ভাইবোনের চেয়ে কি বেশি! আর ভাইগুলোও তেমন এত আছে তাদের। ম্যানপাওয়ার বিজনেস করে সবাই টাকা গাড়ি বাড়ি মিল ফ্যাক্টরি কি না করেছে, তবু জমিটুকুর লোভ ছাড়তে পারে না যেটা সবার হতে পারত সেটা কেন বড়ভাই একা দখল করল এই খেদে পারলে শরীফ আর তারিক অনবরত জহিরকে হেনস্থা করার রাস্তা খোঁজে পারলে জেল খাটায়             এরশাদের সময়ে এক মন্ত্রীর কাছে ধরনা দিয়ে তারা ভাইয়ের বিরুদ্ধে বেনামে জায়গা দখলের নালিশ করেছিল সেই বিবাদে শেষ পর্যন্ত শাশুড়ী আম্মাকেও হাজিরা দিতে হয়েছিল মন্ত্রীর দরবারে তিনি বড়ছেলের পক্ষ নিয়েছিলেন তারপর থেকে আর মায়ের সাথেও সম্পর্ক রাখেনি সাবেরা নিজের মা-বাবাকে দিয়ে জহিরকে বোঝাতে চেষ্টা করে বিফল হয়েছে তার এক কথা, "আমি রাজনীতি করতাম বলে তদবির করে জমি পেয়েছি ব্যবসা এক ছিল, আর রাজউকের নিয়ম মানতে গিয়ে ভাইদের নাম দিয়েছি ওদের পক্ষে কখনও সম্ভব হত এরকম জায়গায় জমি ম্যানেজ করা?"

          "কিন্তু টাকাটাতো কমন ফান্ড থেকে দিয়েছ এটাতো সত্যি"

          "হ্যাঁ দিয়েছি, ওরা চাইলে টাকা দেব কিন্তু জমি আমি দেব না জীবনে অনেক গলিঘুঁজি ঘুরে, অনেক মানুষের সাথে চলে ফিরে আমি আজ এই অবস্থানে এসেছি এখনও আমার যেসব কানেকশান আছে ওরা সেসবের ধারে কাছে যেতে পারবে না তাহলে কেন দেব?"

          "ওরাতো তোমার ভাই মিলেমিশে থাকার জন্য, শান্তির জন্য দেবে এই যে আমাদের ছেলেমেয়েরা চাচা-চাচী আর ভাইবোনদের না চিনে না দেখে বড় হচ্ছে এটা কি খুব ভাল হচ্ছে?"

          জহির বিরক্ত হয়ে বলেছিল, "টাকা থাকলে আত্মীয় বন্ধুর অভাব হয় না তুমি অকারণে ছোট বিষয়কে বড় করে তুলছ বিষয়ে আর কোন কথা আমি শুনতে চাই না"

          এটা সাবেরাও বুঝে জমি হীরক খন্ড এখন ওখানে যে বাণিজ্যিক ভবন উঠেছে পুরো ব্যবসা লাটে উঠলেও ওই এক জায়গার আয়েই জীবন আরাম আয়েশে কেটে যাবে তাছাড়া নামের একটা ব্যাপারও আছে ঢাকা শহরের বুকের মাঝখানে জহির টাওয়ার আজ একনামে পরিচিত ওর ভাইয়েরা হলেও কি ছেড়ে দিত? ওদের যেমন স্বার্থপর স্বভাব ওদের কেউই শুধু সম্পর্কের টানে সম্পত্তির লোভ ছাড়তে পারত না           এখন আর সাবেরা একা জহিরকে দোষ দেয় না প্রত্যেকটা ভাই এমনকি বড়বোনের ছেলেমেয়েরাও প্রত্যেকে স্বার্থপর অথচ বিয়ের পর এদের আপন ভেবে এদের জন্য সে নিজে কীই না করেছে সাবেরার বুক চিরে একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে এদেরইতো রক্ত "একদিন আমার ছেলেমেয়েরাও কি এমন করবে? এখন যেমন ওরা ভাই-বোন পরস্পরের জন্য ব্যস্ত তার মৃত্যুর পর তারাও কী এমন নিষ্ঠুরভাবে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখবে?"

          উহ কী যা তা ভাবছে আযানের সুর কানে আসতে সাবেরা সব ভাবনা দূর করে বারান্দায় যাওয়ার জন্য স্যান্ডেল জোড়া পায়ে গলাল দরজার বাইরে পা দিতেই দেখল অরিন নেমে আসছে ছাদের সিঁড়ি দিয়ে অবাক হয়ে ডাক দিলেন, "অরিন"

          অরিন থমকে দাঁড়িয়ে গেল হঠাৎ করে কী বলবে বুঝতে পারল না পেছন থেকে অভী সিঁড়ি টপকে ছাদে চলে যাচ্ছে কিন্তু অরিনের যে বিপদ হল

          "অরিন-কথা বলছ না কেন? ছাদে গিয়েছিলে?"

          "হ্যাঁ মা" অরিন নিজেকে সামলে নিয়েছে "ঘুম ভেঙে মনটা খুব খারাপ লাগছিল ঢাকা ফিরে গেলে আর কদিন পরেই তো আমি চলে যাব এটা ভেবে খুব কষ্ট হচ্ছিল তাই ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটলাম এত ভোরেও কেমন চাঁদের আলো আবার সামনে তাকাও ওটা বোধহয় ইস্টসাইড কেমন ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ছে দাদু মারা গেল দুদিন হয়ে গেল না মা কেমন করে দিন চলে যায় আমিও চলে যাব তোমাদের ছেড়ে একা একা I will be alone. Simply alone.

          সাবেরার বুকটা হু হু করে উঠল আসলেইতো কতদূরে চলে যাবে মেয়েটা চেয়েছিল এখানে পড়তে কিন্তু লেভেল কমপ্লিট করার আগেই তার বাবা সবকিছু ঠিক করে রেখেছে মেয়ে বা স্ত্রীর মতামতের গুরুত্ব নেই এদের কাছে তিনভাইকেই তো দেখা হল তারা তিন জা চাইলেও স্বামীদের উপর কোন সিদ্ধান্ত চলে না অথচ তারই ভাইয়ের বৌ নিজের ছেলেকে দেশে রেখে পড়াবার ডিসিশান নিল, কই ভাই ভাইয়ের ছেলে কেউতো অমত করল না

            "মা, কী ভাবছ?"

            "নাহ কিছু না তুই চলে যাবি ভাবতে খারাপ লাগছে এদিকে আয়"

            অরিন এসে মাকে জড়িয়ে ধরল কিছুক্ষণ মায়ের বুকে মুখ গুঁজে আজন্মের পরিচিত গন্ধটা টেনে নিল বুক ভরে মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে

          "আচ্ছা মা আমি যদি না যাই, এখানে পড়াশোনা করি?"

          "ছিঃ মা একথা বলে না সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে আর তোমার বাবাকে তো জানো"

          "আমারতো আঠারো বছর হয়ে গেছে I am quite adult now. আমি না যেতে চাইলে বাবা জোর করে কেন পাঠাবে?"

          "অরিন, এসব কথা কেন বলছ?"

          মা অরিনের মুখটা তুলে ধরে দেখতে চেষ্টা করে আবার কোন্‌ বিপদ আসছে! বাপেরইতো মেয়ে যদি সত্যিই বেঁকে বসে তাহলে কেলেঙ্কারী ঘটে যাবে অশান্তি ভাল লাগে না সাবেরার জহির জানলে সাবেরাকেই দুষবে বলবে, তোমাকে নরম পেয়ে মেয়ে পটাল আর অমনি পটে গেলে বোকা বুদ্ধু বলতেও দ্বিধা করবে না কাউকে কথা বলতে ওরা কখনও ভাবে না যাকে বলছে তার কোথায় গিয়ে বিঁধছে শাশুড়িমাও এরকমই ছিলেন মানুষকে খুব শক্তকথা শোনাতে পারতেন কিন্তু নিজের ছেলেদের বিষয়ে মুখে কুলুপ

          "মা, ভয় পেয়ো না আমি যাব এমনি তোমাকে কষ্টের কথাটা বললাম বাবাতো আমার ভালর জন্যই পাঠাচ্ছে তুমি টেনশান করো না তোমার অরিন এমন কিছু করবে না যা তোমাকে হার্ট করে"

          অনেকেই ঘুম থেকে উঠে বাথরুমের দিকে যাচ্ছে যেতে যেতে মা-মেয়েকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক চোখে তাকাচ্ছে

          সাবেরা মেয়েকে বলল, "যাও কিছুক্ষণ ঘুমাও"

          মনের ভেতর আনন্দ-বিষাদের মাখামাখি অনুভব নিয়ে অরিন ঘরের দিকে পা বাড়ালো রাতের ঘটনাটা কি তাকে ঘুমাতে দেবে? অরিনের মনে হল- Not in dream, not in show. Sometime its happened in real life and life becomes happy and lovely. Thanks God.

 

****

২০

 

রান্নাঘরে হুলুস্থুল পড়ে গেছে সাত-আটজন মহিলা সকালের নাস্তার আয়োজনে ব্যস্ত কাঠের চুলায় বড় বড় দুই ডেকচিতে খিচুড়ি বসানো হয়েছে একজন বড় গামলায় চালের গুঁড়ো মাখিয়ে কাই বানাচ্ছে ভাইসাব আর বাচ্চাদের জন্য পিঠা বানানো হবে এই অঞ্চলের খোলাজালি পিঠা তাদের সবার খুব প্রিয় কেউ নারকেল গুড় দিয়ে খায় আবার কেউ গরুর মাংস দিয়ে আর গরুর পায়ার ঝোল থাকলে তো কথাই নেই ভাইসাবদের সবাই রুটি আর পায়ার ঝোল পছন্দ অন্যদিকে পাতিলভর্তি কালরাতের ভাত তরকারি এগুলো কাজের মানুষরা খাবে কিন্তু এসব কাজে যার উপস্থিতি অনিবার্য ছিল সে আজ আসেনি

          হ্যাঁ, মনা আসেনি মনার দাদী কাল রাতে মাচা থেকে পড়ে মারা গেছে মনা বিলাপ করে কাঁদছে দাদীকে বড় ভালবাসত মনা কাজ করতে করতে একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করে, "তুই গেছিলি দেখতে?"

          ""

          "আহারে আমি আগে শুনি নাই বাড়িত থাইকা তাড়াতাড়ি চইলা আইছি সাবগোরে নাস্তা দিবার লাইগা"

          ", মনারা হগগলেতো এইখানে আছিল বুড়ি কোন ফাঁকে পইড়া মইরা রইছে কেউ জানে না রাইতে মনায় ঘরে গিয়া বাত্তি জ্বালাইয়া দেইখা দিল চিৎকার মুখটা হা হইয়া রইছে হাত-ঠ্যাংগুলি কোনরকমে টাইন্যা-টুইন্যা সোজা করছে"

          "আহারে জেডিমার খাসবান্দী আছিল আল্লায় একলগে দুইজনরে নিল" সবচেয়ে প্রবীণ মহিলাটির কন্ঠে বিষাদের সুর

          "কাইল কী বার আছিল বুজি?"

          "ক্যান শনিবার, তুই জানস না?"

          "এর লাইগাই তো হুনছি শনি মঙ্গলবারে কেউ মরলে হে জোড়া খুঁজে, আরেকজনরে টানে আমার মায় কইত"

          "চুপ, চুপ এইসব কতা এইখানে কইবি না তুই একটা বলদা মাইয়া তোর থাইকা আমরা কি কম জানি?"

          দোতলার সিঁড়ি দিয়ে সাবেরাকে নেমে আসতে দেখে ওরা সবাই আচমকা এমন চুপ হয়ে গেল যে উঠান পেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতে গিয়ে সে নিজেই অস্বস্তিতে পড়ে গেল সবাইকে চিনেও না মনাটা থাকলে ভাল হত কিন্তু মনার দাদী নাকি মারা গেছে কাল রাতে কাঠের চুলার পাশে ঘোমটা টেনে বসে থাকা মোমিনের মাকে চোখে পড়তে তার কাছে জানতে চাইল, "নাস্তার কদ্দূর?"

          " ভাবীজান হইয়া আইছে আপনেরা হগগলে উইঠা পড়লে গরম গরম খোলাজালি পিডা বানাইব কাই কইরা রাখছে"

          "ঠিক আছে, বানানো শুরু করো সবাই উঠে গেছে" সাবেরা ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতে দেখল আন্না নেমে আসছে

          সাবেরা ডাকল, "আন্না আসো"

আন্না এসে সাবেরার পাশে দাঁড়িয়ে রান্নাঘরের ভিতরে উঁকি দিল সবাই নিঃশব্দে যার যার কাজ করে যাচ্ছে

              "আমি যাওয়ার সময় এবার দুটো মাটির খোলা নিয়ে যাব মালিহারাও এই পিঠা খেতে পছন্দ করে কিন্তু শহরের খোলাগুলো চুলায় দিলেই ফটফট করে চলকা উঠতে থাকে একদম টিকে না"

          "গ্যাসের চুলায় এই পিঠা তত ভাল হয় না তবু মাঝে মাঝে বানাই তোমার ভাইয়া খুব খেতে চায় বুয়াকে দিয়ে পাটায় পিষে চালের গুঁড়ো করি মেশিনে ভাঙানো গুঁড়ো দিয়ে এই পিঠা ভাল হয় না"

          সাবেরার কথা শুনে অল্পবয়সী একটি মেয়ে বললে উঠল, "এখনতো দ্যাশেও ঢেঁকি উইঠা গেছে চাচী আম্মা গেরামের হগগলে পিডা-পুলি খাইতে কলের থেইকা চাইল গুঁড়া কইরা আনে"

          "তাই বুঝি?"আন্না কিছুটা বিস্মিত হয়ে মন্তব্য করে

          "জী চাচী আম্মা আপনেতো বহুত দিন পরে আইলেন গেরাম অনেক বদলাইয়া গেছে"

          এমন সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেজভাই তারিক হাঁক দেয়, "কিরে তোরা নাস্তাটাস্তা দিবি না? বাড়িত আইসা কি পোলাপাইন না খাইয়া থাকব?"

          শহরে থেকে লেখাপড়া শিখে পরিবারের অন্যদের ভাষা বদলালেও তারিকের বদলায়নি সে এভাবেই কথা বলে এমনকি নিজের ছেলেমেয়ের সাথেও বিষয়ে তার স্ত্রী আয়না অনেকবার আপত্তি করলেও তারিক মানে না তার এক কথা, "আমার যেভাবে কথা কইয়া শান্তি হেইভাবে কমু অন্য কেউ আমারে বাধা দিবার কে?"

          সাবেরা এবং আন্না যেন মানুষ না, বস্তুজাতীয় কিছু তাদের দিকে একবারও তাকায় না তারিক রান্নাঘরে সন্ত্রস্ত আবহাওয়া তৈরি হয় সবচেয়ে পুরণো মানুষ সিদ্দিকের মা তাড়াতাড়ি আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দাঁড়িয়ে বলল, "ভাইছাব আপনে ঘরে যান আমি অহনি পাঠাইয়া দিতাছি"

          "হ্যাঁ, পাডাও কাইল রাতে বাচ্চারা ভাল কইরা খাইতে পারে নাই"

          আন্না আর সাবেরা পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করল তারা দুজন মানুষ এখানে দাঁড়িয়ে মেজভাউ একটু ভদ্রতাও দেখাল না

 

****


Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ১৯ - ২০

 ----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ _________________________...

Popular Posts