স্পেশাল ইফেক্টের শেষ অংশ হলো আকাশে প্লেন বিস্ফোরণের দৃশ্যগ্রহণ। যুদ্ধ সংক্রান্ত যে কোন ছবিতে বা ইদানীং যে কোন অ্যাকশান ছবিতেই প্লেন বিধ্বস্ত হয় কোন না কোন ভাবে।
মোটামুটি আয়তনের একটি সেট এখানে। দেয়াল জুড়ে যেভাবে ছবি আঁকা হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে বিশাল এক বিমানবন্দরের একটি অংশে আছি আমরা। সামনে অজস্র বিমান। একটা বিমানের ককপিটের অর্ধেক ছাদ থেকে ঝুলছে। নব নির্বাচিত পাইলটকে সিঁড়ি দিয়ে ককপিটের ভগ্নাংশে তুলে দেয়া হলো। সাথে মুভিওয়ার্ল্ডের কো-পাইলট। পর্দায় দেখা গেলো দর্শকদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছেন পাইলট। একটু পরে দেখা গেলো বিশাল বোয়িং নিয়ে আকাশে এক ঝাঁক প্লেনের মাঝখানে আমাদের পাইলট। কেবল মুখটা দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে।
একটু পরেই দেখা গেলো প্লেনের ইঞ্জিনে আগুন লেগে গেছে। সামনে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে একটা ছোট আলাদা মেশিন থেকে সাদা ধোঁয়া তৈরি করে দেয়া হচ্ছে শূন্যে ঝোলানো ককপিটে।
মানুষের মুগ্ধ হবার ক্ষমতা অসীম। আমরা পর্দায় যা দেখি তার সব কলাকৌশল জানার পরেও আমরা মুগ্ধ হই। সত্যি নয়- গল্প জেনেও আমরা কাঁদি-হাসি। আমরা যন্ত্র বানাই, কিন্তু নিজেরা যন্ত্র হয়ে যাই না বলেই তো আমরা মানুষ, অসীম ক্ষমতাশালী মানুষ।
সিনেমা তৈরির আরো একটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এডিটিং। এডিটিং সম্পর্কে দেখানো হচ্ছে ওয়ার্নার ব্রাদার্স ক্লাসিকস-এ। ছোট্ট একটা হলে বসিয়ে পর্দায় দেখানো হলো বিভিন্ন বিখ্যাত সিনেমার ফুটেজ যা মূল সিনেমাতে নেই। বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রীরা শুটিং-এর সময় পাঁচ সেকেন্ডের একটা শটও যে কতবার করে দিয়েছেন- কত হাস্যকর ঘটনা ঘটেছে ইত্যাদি। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার অবস্থা। এডিটিং সম্পর্কে কিছুটা প্রাথমিক কারিগরি জ্ঞান দেবার পর একটা মজার অ্যাডভেঞ্চার শো’তে নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের।
একটা ছোট্ট রেলগাড়ির মতো কম্পার্টমেন্টে আমাদের বসানো হলো। গাড়িটি এগোচ্ছে একটা ভুতূড়ে পোড়াবাড়ির মধ্য দিয়ে। চারপাশে রাখা সিনেমার ফিল্ম আর ফিল্ম। মাকড়শার জাল আর প্রচন্ড ধুলাবালি দেখা যাচ্ছে, যদিও আমাদের গালে বা নাকে লাগছে না কিছুই। একটু পরে দেখা গেলো ভাঙা রাস্তা, রাস্তার পাশে বিধ্বস্ত দোকান পাট, ভাঙা শো-কেস যেন এক মৃতপুরীর ভেতর দিয়ে চলেছি আমরা। এক সময় নিকষ কালো অন্ধকার। তারপরেই হঠাৎ আলোয় বেরিয়ে এলাম মুভিওয়ার্ল্ডের বাস্তবতায়। এই গোলমেলে মৃতপুরীটার সাথে সিনেমার এডিটিং এর কী সম্পর্ক তা বুঝতে পারলাম না।
এবার গেলাম ব্যাটম্যান শো দেখতে। একটি ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে মোমের আলোয় অপেক্ষা করতে হলো শুরুতে। শো শুরুর আগেই মনে হচ্ছে ঘরে বাদুড় উড়ে বেড়াচ্ছে। দেয়ালের গায়ে ছোট্ট একটা দরজা খুলে গেলো। মাথা নিচু করে ঢুকতে হয় এই দরজা দিয়ে। ঢুকতেই একটা গুহা। গুহায় একটি গাড়ির মতো কিছু আছে। তাতে চার সারিতে ষোলজনের বসার ব্যবস্থা। এই ষোলজনকে নিয়ে গাড়ি রওনা হলো বলে মনে হচ্ছে।
সামনের পর্দায় ছবি দেখানো হচ্ছে অনেক কিছুর। নানারকম দৃশ্যের সাথে গাড়ির দুলুনি ঝাঁকুনিতে দু’মিনিটের মধ্যেই বাস্তব পৃথিবী উধাও। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে ট্রেনের নিচে ঢুকে যাবো, পর মুহূর্তেই মনে হচ্ছে পাহাড়ে উঠে যাচ্ছি গাড়িসহ। সত্যি সত্যি দেখলাম পেছনের দিকে হেলে যাচ্ছে শরীর। একটু পরেই পাহাড় থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ার অনুভূতি। সবকিছু মিলিয়ে শরীর ও মনের ওপর এমন সূক্ষ্মচাপ পড়ে- মনে হয় যেন সত্যি আমরা ব্যাটম্যানের চেলা।
আরো অনেক কিছু দেখার বাকি এখনো। ৫২ ডলার নিয়ে যা দেখাচ্ছে তার আলাদা আলাদা মূল্য হিসেব করতে গেলে অনেক বেশি পড়বে। এবার রক্সি থিয়েটারে ঢুকলাম থ্রি ডাইমেনশানাল কার্টুন ছবি দেখতে। মারভিন দি মারসিয়ান। এটাই প্রথম ত্রিমাত্রিক কার্টুন ছবি। হলের ভেতর ত্রিমাত্রিক ছবির বাস্তবতাকে আরো বিশ্বাসযোগ্য করতে কিছু কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে এখানে। পর্দায় কার্টুনের একটা চরিত্র যখন পানি ছুঁড়তে থাকে তখন দর্শকদের গায়ের ওপরও কয়েক ফোঁটা পানি এসে পড়ে।
আলো কমে আসছে একটু একটু। মুভিওয়ার্ল্ডের রাস্তায় এখন নাচগান চলছে। পৃথিবীর বিখ্যাত পপ তারকাদের ডামিরা নেচে গেয়ে মানুষ জড়ো করেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম কিছুক্ষণ। চোখ গেলো মুভিওয়ার্ল্ডের লেটেস্ট আকর্ষণ লিথ্যাল ওয়েপন রাইডের দিকে। নানারকম অলিগলি পেরিয়ে গেলাম সেখানে। মনে মনে বললাম, দেখেই চলে আসবো। মুভিওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে দুঃসহ রাইড এটা। সামনেই বিশাল আকৃতির নোটিশ - উচ্চতা যাদের সাড়ে চার ফুটের কম বা ছ’ফুট দু’ইঞ্চির বেশি তারা এখানে চড়তে পারবে না। তারপর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দীর্ঘ বিবরণ। সিগারেটের গায়ে লেখা বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের মতো।
এক পা, দু’পা করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। ভাবছি চড়া উচিত- নাকি উচিত নয়, টু বি অর নট টু বি টাইপের প্রশ্ন। শেষে মনে হলো যখন দেখাই যাক না কী হয়।
চেয়ারের বসার আগে পকেট খালি করে নিতে হয় যেন কিছু পড়ে টড়ে না যায়। কাউন্টারে জিনিসপত্র জমা রাখার আলাদা আলাদা খোপ আছে। কোন কিছু হারানো বা চুরি হবার ভয় নেই। বেশ মোটা মোটা বেল্ট দিয়ে কাঁধের ওপর থেকে দুদিকে টেনে বাঁধা হলো চেয়ারের সাথে। পাশাপাশি দুটো করে চেয়ার। আমার পাশের জন আমার চেয়ে মোটাতাজা শক্ত মানুষ বলে মনে হচ্ছে। আমি আড়চোখে দেখছি তাকে মিস্টার বিনের ভঙ্গিতে।
শুরুতে আস্তে আস্তে এগোচ্ছে আমাদের আসন। ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যেই চেয়ার ঘুরছে লাটিমের মতো। এলোমেলো পথে কীসের টানে যেন ছুটে চলেছে। একটু পরেই দেখা গেলো আমাদের মাথা নিচের দিকে। পেটের ভেতরে যা আছে সব যেন দলা পাকিয়ে মুখের দিকে চলে যাচ্ছে। সব এক সাথে বেরুতে চাচ্ছে বলেই বেরুতে পারছে না। মনে হলো মুখেও একটা মোটা বেল্ট লাগানোর ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিলো। আমি চোখের সামনে সর্ষে ফুল দেখতে শুরু করেছি। চোখ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেছে আমার। চারপাশে মনে হচ্ছে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ব্ল্যাক হোলে ঢুকে পড়েছি। হৃদপিন্ড ঠিক জায়গায় আছে কিনা বুঝতে পারছি না। প্রচন্ড বেগে ডানে বামে উপরে নিচে ঝাঁকুনি চলছে। মহাভারতে ভীম কীচককে ধরে যেভাবে চটকেছিলো, আমাকেও যেন কোন অদৃশ্য ভীম সেভাবে চটকাচ্ছে। কীচকের তো সুনির্দিষ্ট অপরাধ ছিলো, কিন্তু আমার অপরাধ কী এখানে? শেষ পর্যন্ত কীচকের দেহ গিয়ে পড়েছিলো বিরাট রাজার দরবারে। এই মুহূর্তে ছিটকে পড়লে আমার দেহ হয়তো সোজা ব্রিসবেনে গিয়ে পড়বে।
অবশেষে ঝড় থামলো এক সময়। চোখ খুলে ঝাপসা দেখলাম। চোখের কী হলো? আসলে চশমা খুলে জমা দেয়ার কারণেই। বেল্ট খুলে প্লাটফরমে দাঁড়াতে গিয়ে মনে হলো পুরো প্লাটফর্ম দুলছে। শরৎ বাবুর সমুদ্রে সাইক্লোনের অভিজ্ঞতার চেয়ে আমার অভিজ্ঞতা কোন অংশে কম নয়। কয়েক মিনিট পরে স্বাভাবিক হয়ে মনে হলো নিজেকে মনে মনে যত গালাগালি করেছি ততোটা না করলেও চলতো।
মুভিওয়ার্ল্ড থেকে ব্রিসবেন ফিরতি বাস পৌঁছে পাঁচটায়। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে উঠতে গেলাম। ড্রাইভার ভদ্রমহিলা জানালেন ওটা ব্রিসবেনগামী গাড়ি নয়। ব্রিসবেনের পৌনে পাঁচটার বাসের কী হলো? তিনি বললেন ঐ লাইনের বাস নাকি সব সময়েই দেরি করে।
ভদ্রমহিলার কথা ঠিক। পৌনে পাঁচটার বাস এলো পাঁচটা বিশ মিনিটে। এ ধরনের অনিয়ম এখানে দেখলে আমার ভালোই লাগে। ক্লাসে ভালো স্টুডেন্টরা পড়া না পারলে বাজে স্টুডেন্টদের যেরকম ভালো লাগে, অনেকটা সেরকম। ব্রিসবেনে পৌঁছে হোস্টেলে ফেরার পথে টের পেলাম শরীরের সমস্ত কলকব্জা ঢিলে হয়ে গেছে। মস্তিষ্কের সব স্ক্রু ঠিক মতো আছে কিনা কে জানে।
*****
হোস্টেলের চেকিং আউট টাইম সকাল সাতটা থেকে দশটার মধ্যে। আমার বাস ছাড়বে রাত আটটায়। সকাল নটায় হোস্টেলের চাবি ফেরত দিয়ে বেরিয়ে এলাম হোস্টেল থেকে। আমার ব্যাগটা বড় নয়, আর ভারীও নয়। কাঁধে নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ানো যায়। কিন্তু রাত আটটা পর্যন্ত ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কোন অর্থ হয় না।
ট্রানজিট সেন্টারে বেশ কিছু অটোম্যাটিক লকার আছে। ২৪ ঘন্টার ভাড়া পাঁচ ডলার। মেশিনে পাঁচ ডলারের কয়েন ফেলে বোতাম টিপলেই একটা ম্যাগনেটিক কার্ড বেরিয়ে আসে। কার্ডটা নিয়ে কার্ডে লেখা নম্বর অনুযায়ী লকারে ব্যাগ রেখে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম। এখন মুক্ত হাত পা। শরীরের ব্যাথা ব্যাথা ভাবটা এখন আর নেই।
ব্রিসবেন সিটির ম্যাপটা ভালোভাবে দেখলাম। খুব কাছের অংশটা দেখা বাকি এখনো। প্রথমেই দেখতে হবে রোমা স্ট্রিট পার্কল্যান্ড। ব্রিসবেন ট্রানজিট সেন্টারের ঠিক পাশেই পার্কল্যান্ডে প্রবেশের প্রধান পথ। রেলওয়ে স্টেশনের দুনম্বর প্লাটফর্ম থেকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেই পার্কল্যান্ডের শুরু।
১৬ হেক্টর জায়গা জুড়ে বিশাল বাগান। আগে এখানে হাটবাজার বসতো মাঝে মাঝে আর বেশির ভাগ সময়েই জায়গাটা এমনিতে পড়ে থাকতো। ১৯৯৯ সালে কুইন্সল্যান্ড সরকার ৭২ মিলিয়ন ডলারের পার্কল্যান্ড প্রকল্প হাতে নেয়। মাত্র দু'মাস আগে এপ্রিল মাসে এই পার্ক অফিসিয়ালি চালু হয়েছে। এখনো সবকিছু ঝকঝকে নতুন।
প্রায় এক লক্ষ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে এই পার্কে। পৃথিবীর বিরল প্রজাতির ফার্ণ থেকে শুরু করে বড় বড় গাছ পর্যন্ত। বিশাল আকৃতির প্রাচীন গাছ আছে ষোল শত। রেলওয়ে স্টেশনের দোতলায় পার্কল্যান্ডের বিশাল অফিস। সূর্যোদয় থেক সূর্যাস্ত পর্যন্ত সপ্তাহের প্রত্যেকদিন খোলা থাকে এই পার্ক। অমূল্য এই পার্কে ঢুকতে কোন টিকেট লাগে না।
পার্কে ঢুকতেই দেখি সারিবদ্ধভাবে রাখা আছে পার্কের পরিচিতি মূলক বিভিন্ন পুস্তিকা। সেখানে ম্যাপ ছাড়াও আছে বিভিন্ন গাছের পরিচিতি। বাঁ পাশে বিস্তীর্ণ পার্কিং এলাকা। এর মধ্যেই প্রচুর গাড়ি এসে পৌঁছেছে। বেশির ভাগই স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফ্যামিলি পিকনিক করতে এসেছে। সামনেই বিশাল খোলা মাঠ সেলিব্রেশান লন।
মাঠের ওপাশে কৃত্রিম হ্রদ। হ্রদের পানিতে বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ। প্রত্যেক উদ্ভিদের পরিচিতিসহ নেমকার্ড দেয়া আছে। নানারকম শাপলা ফুটে আছে পানিতে। লেকের পাড় ঘেঁষে হাঁটা পথ মিশে গেছে লেক শেষের জঙ্গলে। সেখানে গহীন অরণ্যের শুরুতে ফার্ণ গ্যালারি। পৃথিবীর বৃহত্তম ফার্ণ এখন এখানে। রেইন ফরেস্ট দেখার জন্য পুরো বাগান জুড়ে আছে টানা ব্রিজ। ব্রিজ চলে গেছে বনের মাঝখান দিয়ে গাছের উপর দিয়ে। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে দেখতে দারুণ লাগে এই জঙ্গল।
জঙ্গলের আকর্ষণ নানা সময়ে নানা রকম। আবার বিভিন্ন স্থানেও বিভিন্ন রকম। ফার্ণগুচ্ছের পরেই জলা জায়গায় পদ্মবন। হাজারো প্রজাতির পদ্ম আর শাপলা এখানে। অনেকটুকু জায়গা নিয়ে সাজানো হয়েছে মৌসুমী ফুলের বাগান। প্রজাপতি রঙের বর্ণিল ফুল দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। রঙের এমন আশ্চর্য কম্বিনেশান হয় কীভাবে! জানা গেলো এখানে অনেক ফুলের রঙ কম্পিউটারে তৈরি করা হয়েছে প্রথমে। পরে সে অনুযায়ী জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফসল এই বর্ণিল ফুল।
চার ঘন্টা কীভাবে যেন কেটে গেলো এই বাগানে। তারপরও মনে হচ্ছে আরো দেখি। সিটি এলাকা এক চক্কর দিলেই মনে হয় সব দেখা শেষ। অথচ এই বাগানে একটা ফুল শতবার দেখেও তৃপ্তি হচ্ছে না। প্রাণের স্পন্দনেই হয়তো আনন্দ। শহরের পাথরে প্রাণ নেই বলেই আমাদের প্রাণ সেখানে হাঁপিয়ে ওঠে।
পার্কে গাছের ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে প্রচুর ধাতব শিল্পকর্ম। যাদের দ্রব্যমূল্য চৌদ্দ লাখ ডলার, আর শিল্পমূল্য অসীম।
পার্কের উত্তর দিকের অংশের নাম অ্যালবার্ট পার্ক। বেশ বড় আলাদা আরেকটি পার্ক। অ্যালবার্ট পার্কের শেষ ভাগে কলেজ রোড। কলেজ রোড ধরে একটু এগিয়ে স্প্রিং হিল। এখানে খুব সুন্দর একটা গির্জা আছে। সেন্ট পলস গির্জা। জায়গাটার নাম সেন্ট পলস ট্যারেস। খুব সুন্দর শান্ত আবাসিক এলাকা।
সেন্ট পলস থেকে ব্রাঞ্চ উইক স্ট্রিট পর্যন্ত হেঁটে এলে ব্রিসবেনের চায়না টাউন। চীনা স্থাপত্যে তৈরি সিংহের মুখওয়ালা লাল গেটও এখানে। চায়না টাউনগুলোতে হোটেল রেস্তোরা আর মুদি দোকান বেশি থাকে। এখানেও সেরকম। তবে এখানকার চায়না টাউনটা কেমন যেন নির্জীব। মার্কেট একটা হয়েছে তবে এখনো অনেক পজেশন খালি পড়ে আছে। চায়নিজদের বিরুদ্ধে ওয়ান নেশান পার্টির পলিন হ্যানসনের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কারণেই হয়তো এখানে চায়নিজরা মেলবোর্নের চায়নিজের মতো স্বচ্ছন্দ নয়।
কিছুক্ষণ ঘুরে আবার ফিরে এলাম রোমাস্ট্রিটের পার্কল্যান্ডে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে শুধু এই পার্কের আকর্ষণেও যদি কেউ ব্রিসবেনে আসে তাকে হতাশ হতে হবে না। আক্ষরিক অর্থেই পুরো একটা দিন কাটলো আমার এই পার্কে। হাত-পা ছড়িয়ে গাছের নিচে ঘাসের ওপর শুয়ে থাকার এমন স্বাধীনতা আবার কখন কোথায় পাবো তা তো জানি না।
পৌনে আটটার বাসে ওঠার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে জানা গেলো বাস ছাড়তে কমপক্ষে একঘন্টা দেরি হবে। অনেকে রেগে গেলো এই ঘোষণায়। আমার কোন অনুভূতিই নেই। আমার মনে হচ্ছে এই দুনিয়ার সবকিছুই ভালো। এখনো ভালো, এক ঘন্টা দেরিতেও ভালো।
*****
বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। ক’দিনেই এ জায়গাটার প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছে বুঝতে পারছি। গাড়ি ছুটছে প্রচন্ড বেগে। নির্দিষ্ট স্থানে থামছে, আবার চলছে। পেরিয়ে যাচ্ছি গোল্ডকোষ্টের বিশাল মোটেল, প্রশান্ত মহাসাগর। যাত্রীদের প্রায় সবাই ঘুমুচ্ছে। আমার ঘুম আসছে না। আকাশে অষ্টমীর চাঁদ। এখানে আসার সময় যে পথ পেরিয়েছি দিনের আলোয়, সে পথ এখন আধখানা চাঁদের আবছা আলোয় অদ্ভূত মায়াবী লাগছে। পেরিয়ে যাচ্ছি বায়রন বে’র সেই মন ভোলানো পথ। আমি ভুলে থাকতে চাচ্ছি কাল সিডনি, পরশু মেলবোর্ন, তারপরে আবার নিত্যদিনের দায়। জীবন জোছনার আলো দিয়ে তৈরি নয়, আমি তা জানি। কিন্তু তাই বলে ঘন বনের গাছের পাতায় ছিটকে পড়া জোছনা দেখতে তো আমার কোন বাধা নেই। আমি দেখছি। আমি আমার সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে দেখতে চাচ্ছি- হে অসম্ভব সুন্দর- তোমাকে।
___________