সকালে বাসা
থেকে বেরোবার আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম যেভাবেই হোক আজ বিকেল চারটার আগেই ফিরে আসবো।
মেলবোর্নের বিকেল চারটা বাংলাদেশের সকাল এগারোটা। ঠিক এই সময়ে জাতীয় প্যারেড
গ্রাউন্ডে এক সাথে জাতীয় সঙ্গীত গাইবে কয়েক লক্ষ মানুষ। শুধু কি প্যারেড
গ্রাউন্ডে? সারা বাংলাদেশ জুড়ে কোটি কন্ঠে উচ্চারিত হবে 'আমার সোনার বাংলা, আমি
তোমায় ভালোবাসি'।
এরকম দিনে
আমার মনের ভেতর কেমন এক ধরনের কষ্ট দলা পাকিয়ে ওঠে। আমার ধারণা আমরা যারা দেশের
বাইরে আছি সবারই এরকম একটা অনুভূতি হয়। সত্যিকারের দেশ প্রেমিক বলতে যাদের বোঝায়
তাঁদের সারিতে নিজেকে দাঁড় করানোর মতো দুঃসাহস আমার নেই। সত্যি বলতে কি - যতই দিন
যাচ্ছে নিজেকে কেবলই পলাতক বলে মনে হচ্ছে। শুরুতে যখন পড়াশোনার জন্য, গবেষণার
সুযোগের জন্য, একটা চাকরির জন্য, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে তখন
মনে হতো - দেশে নিজের জায়গাটি অন্যজনকে ছেড়ে দিয়ে এসে দেশের জন্যই তো কিছু করেছি।
বিদেশের মাটিতে আমাদের যৎসামান্য যা কিছু অর্জন তা তো বাংলাদেশেরই প্রতিনিধিত্ব
করছে। কিন্তু এখানে একটু গুছিয়ে বসার পর মনে হচ্ছে নিজের দেশের সাফল্য-ব্যর্থতায়, আনন্দ-বেদনায়
কাছে থাকা পাশে থাকা বলতে যা বোঝায় তা তো আমি করছি না। বছরে একবার দেশে গেলে কিংবা
মাঝে মাঝে কিছু টাকা পাঠালেই কি দায়িত্ব পালন করা হয়ে গেলো? আবার নিজেকে
সান্ত্বনাও দিই - দেশ গড়ার কাজে প্রবাসী নাগরিকদের কি কোন ভূমিকাই নেই? এই
বিশ্বায়নের যুগে ভৌগোলিক সীমারেখা কি দেশের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে?
বিচ্ছিন্ন
ভাবনায় সময় চলে যায়। নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস নিই, গবেষণা শিক্ষার্থীদের সময় দিই, কর্তব্যে
ত্রুটি হয় না। ভুল করলে, কর্তব্যে অবহেলা করলে কেউ দেশ তুলে কথা বলবে এই ভয়ে আমরা
প্রবাসীরা কাজের ব্যাপারে খুবই যত্নবান। দেশে থাকলে হয়তো এভাবে ভাবতে হতো না।
ক্যাম্পাসেই বেজে গেলো সাড়ে তিনটা।
ক্যাম্পাস
থেকে আমার বাসা পনেরো মিনিটের ড্রাইভ। কিন্তু আজ যেন রাস্তায় গাড়ি উপচে পড়ছে। মনে
হচ্ছে সবগুলো লাল বাতিই আজ জ্বলে উঠছে একের পর এক। চারটার আগে পৌঁছাতে পারবো তো?
বাসায় গিয়ে কম্পিউটারে বাংলাদেশের টিভি দেখতে হবে। জাগো বিডি ডট কমের কল্যাণে
বাংলাদেশের সবগুলো টিভি চ্যানেলই সহজলভ্য। ইউনিভার্সিটি নেটওয়ার্কে লাইভ টিভি
স্ট্রিমিং ব্লক করে দেয়া আছে। নইলে এত তাড়াহুড়ো করে বাসায় আসতে হতো না। কয়েক বছর
আগে হিসেব করে দেখা গেছে আনলিমিটেড ইন্টারনেটের সুযোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থী শিক্ষক আর কর্মকর্তারা মিলে কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করে ফেলেছে শুধুমাত্র
লাইভ স্ট্রিমিং-এ খেলা দেখে বা অন্য কিছু করে। সময়-ঘন্টার অপচয়ের কথা বলাই
বাহুল্য। সুযোগের অপব্যবহার যে উন্নত(!) জাতি অস্ট্রেলিয়ানরাও করে - জেনে এত যে
আনন্দ হয়েছিল আমার।
বাসায়
ঢুকতে ঢুকতে চারটা বেজে গেলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শুরু হলো লক্ষ কন্ঠের সমবেত
জাতীয় সঙ্গীত। কম্পিউটার-টিভির সামনে দাঁড়িয়ে গলা খুলে গাইলাম - আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালোবাসি। আমার গলায় সুর নেই। বেসুরো গলায় অন্য কোন গান গাইতে গেলেই
চিরকাল মারতে এসেছে আমার বন্ধুরা - কিন্তু এই জাতীয় সঙ্গীত যেভাবেই গাই না কেন -
কখনোই অসহ্য লাগেনি কারো কাছে। 'আমি তোমায় ভালোবাসি' - তিন শব্দের এই বাক্যটি মনে
হয় পৃথিবীর সবভাষায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বাক্য। কিন্তু 'বহু ব্যবহারে জীর্ণ'
কথাগুলো কিছুতেই প্রযোজ্য নয় 'আমি তোমায় ভালোবাসি'র ক্ষেত্রে।
পৃথিবীর সব
দেশেরই জাতীয় সঙ্গীত আছে। নিজের দেশের জাতীয় সঙ্গীতকে ভালোবাসে না - এমন কাউকে
পাওয়া যাবে না। যার যার কাছে তার তার দেশ, দেশের মানুষ, দেশের জাতীয় সঙ্গীত সবচেয়ে
ভালো বলে মনে হবে - এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মত এমন করে
"আমি তোমায় ভালোবাসি" বাক্যটি অন্য কোন দেশের জাতীয় সঙ্গীতে আছে বলে
আমার জানা নেই।
নিজেকে
অনেকটাই আবেগমুক্ত বলে মনে করি আমি। কিন্তু জাতীয় সঙ্গীত যখনই গাই আমি আবেগ সামলাতে পারি না, আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। আমি
বুঝতে পারি যেখানেই থাকি যেভাবেই থাকি - আমার সোনার বাংলাকে আমি সত্যিই ভালোবাসি।
মেলবোর্ন ||
স্বাধীনতা দিবস ২০১৪ ||
No comments:
Post a Comment