Wednesday, 25 April 2018

চিকিৎসাবিজ্ঞানে পদার্থবিজ্ঞান: এম-আর-আই


চিকিৎসাবিজ্ঞানে পদার্থবিজ্ঞানের প্রয়োগ অপরিহার্য। মানুষের চিকিৎসায় যেসব যন্ত্রপাতি না হলে একদম চলে না তার সবগুলোই পদার্থবিজ্ঞানের প্রয়োগে তৈরি। রোগনির্ণয়ের একেবারে নিত্যব্যবহার্য যন্ত্র থার্মোমিটার, স্টেথেস্কোপ থেকে শুরু করে এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাফি, ই-সি-জি, কম্পিউটেড টমোগ্রাফি বা সি-টি, ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং বা এম-আর-আই সবকিছুই পদার্থবিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ। আবার ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের চিকিৎসায় যে রেডিওথেরাপি দেয়া হয় তার মূলে আছে পদার্থবিজ্ঞান। আজ চিকিৎসাবিজ্ঞানে ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং বা এম-আর-আই সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।






শারীরিক চিকিৎসার জন্য শরীরের ভেতরের কলকব্জাগুলোকে দেখার দরকার হয়। কিন্তু যখন-তখন কেটেকুটে শরীরের ভেতরটা দেখা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে এমন যদি কোন ব্যবস্থা থাকে যাতে শরীরের ভেতর কী হচ্ছে, কোথায় গন্ডগোল তা শরীর না কেটেই কম্পিউটারের পর্দায় দেখা যায়, ভিডিও করে রাখা যায় যাতে প্রয়োজনমত বারবার দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় রোগ এবং তার চিকিৎসার ব্যাপারে তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এক্স-রে ও সি-টি স্ক্যানিং করেও এ সমস্যার সমাধান অনেকটাই করা যায়। তবে এক্স-রে ও সি-টি স্ক্যানিং-এ রোগীর শরীরে রেডিয়েশান ঢুকে যায়। যা বেশ ক্ষতিকর। ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং বা এম-আর-আই হলো সি-টি স্ক্যানিং-এর মতোই শরীরের ভেতরের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের প্রয়োজনমতো ছবি তোলার জন্য ব্যবহৃত একটি অত্যাধুনিক পদ্ধতি। এম-আর-আই প্রযুক্তি এতটাই উপকারী যে ২০০৩ সালের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারসহ এপর্যন্ত চারবার নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে।

ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং-এর মূল ভিত্তি হলো নিউক্লিয়াসের ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স বা চুম্বকীয় অনুরণন। বস্তুর ক্ষুদ্রতম অংশ পরমাণু। পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসের ভেতর থাকে প্রোটন ও নিউট্রন। এই নিউক্লিয়াসের আকার খুবই ছোট। দশ লক্ষ নিউক্লিয়াস পাশাপাশি রাখলে দৈর্ঘ্য হবে মাত্র একসেন্টিমিটার। নিউক্লিয়াসের চেয়ে আরো অনেক ছোট প্রোটন ও নিউট্রন। প্রোটনের ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স আবিষ্কৃত হয় ১৯৪৬ সালে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ফেলিক্স ব্লক এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এডওয়ার্ড মিল্‌স পারসেল সর্বপ্রথম নিউক্লিয়াসের প্রোটনের ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ব্যাখ্যা করেন। এজন্য ১৯৫২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান তাঁরা। তারপরের দুই দশক ধরে চেষ্টা চলে কীভাবে নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোনেন্সকে কাজে লাগানো যায়।

মানুষের শরীরের উপাদানের বেশিরভাগই চর্বি আর পানি। চর্বি ও পানির প্রধান উপাদান হাইড্রোজেন। আমাদের শরীরের উপাদানের শতকরা ৬৩ ভাগই হলো হাইড্রোজেন পরমাণু। হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে কোন নিউট্রন নেই। ফলে হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস হলো একটি প্রোটন। প্রোটন ধনাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জের অধিকারী। কোন ধরনের চৌম্বকক্ষেত্রের সংস্পর্শে আসার সাথে সাথে এই প্রোটন কাঁপতে শুরু করে এবং একটা নির্দিষ্ট কম্পাংকে ঘুরতে শুরু করে। চৌম্বকক্ষেত্রের তীব্রতার উপর নির্ভর করে এই প্রোটনের ঘূর্ণনের বেগ। আবার চৌম্বকক্ষেত্রের শক্তি স্থির থাকার পরেও ঘূর্ণনের বেগ বেড়ে যেতে পারে অনেকগুণ যদি অন্য কোন ধরনের বিদ্যুত-চৌম্বকীয় তরঙ্গ কোন কারণে এই চৌম্বকক্ষেত্রের কাছাকাছি চলে আসে। যদি সমান কম্পাঙ্কের কোন বেতারতরঙ্গ বা রেডিও-ওয়েভ এই প্রোটনের কাছাকাছি চলে আসে, তাহলে প্রোটনের কম্পাঙ্ক আর বেতারতরঙ্গের কম্পাঙ্ক মিলে একটা রেজোনেন্স বা অনুরণন তৈরি হয়। বেতারতরঙ্গ শরীরের কোন ক্ষতি করে না। তবে বেতারতরঙ্গের চেয়ে উচ্চ-কম্পাঙ্কের তরঙ্গ, যেমন এক্স-রে শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

যখন যে প্রত্যঙ্গের ভেতরটা দেখা দরকার শরীরের সেই অংশের প্রোটনের কম্পন মেপে দেখা হয়। তারপর সেই কম্পাঙ্কের সাথে মিলবে এরকম কম্পাঙ্কের বেতারতরঙ্গ সরবরাহ করে রেজোনেন্স বা অনুরণন সৃষ্টি করা হয়। সরবরাহকৃত বেতারতরঙ্গ সরিয়ে নিলেই দেহের হাইড্রোজেন পরমাণু বা প্রোটন তার নিজস্ব কম্পাঙ্কে ফিরে যায়। রেজোনেন্স অবস্থা থেকে নন-রেজোনেন্স বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে যে সময় লাগে তাকে বলা হয় রিলাক্সেশান টাইম। ১৯৭১ সালে প্রফেসর র‍্যামন্ড ডেমাডিয়ান শরীরের টিউমারের ওপর গবেষণা করে দেখেন যে স্বাভাবিক কোষ আর টিউমারের কোষের ক্ষেত্রে এই রিল্যাক্সেশান টাইমের পার্থক্য আছে। তার মানে শরীরের স্বাভাবিক কোষ ও রোগাক্রান্ত কোষ শনাক্ত করা যাবে এই রিল্যাক্সেশান টাইম ব্যবহার করতে পারলে। ধরতে গেলে তখন থেকেই রোগনির্ণয়ে এম-আর-আই এর সূচনা।

১৯৭৩ সালে এক্স-রে ভিত্তিক কম্পিউটেড টমোগ্রাফি বা সি-টি স্ক্যানিং-এর সূচনা করেন প্রফেসর হাউন্সফিল্ড। সেই একই বছর এম-আর-আইর সফল প্রয়োগ করে দেখান ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের স্টোনিব্রুক ক্যাম্পাসের রেডিওলজি ডিপার্টমেন্টের রসায়নের প্রফেসর পল লটারবার। এম-আর-আইর সাহায্যে কীভাবে দেহের কোষের ছবি তোলা যায় তার ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখিয়েছেন তিনি। এদিকে ইংল্যান্ডের নটিং-হাম ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পিটার ম্যান্‌সফিল্ড এম-আর-আই থেকে পাওয়া সিগনালগুলোকে দ্রুত ছবি বা ইমেজে রূপান্তরিত করার একটা ব্যবহারিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। প্রফেসর লটারবার আর প্রফেসর ম্যান্‌সফিল্ড তাঁদের গবেষণার জন্য ২০০৩ সালের নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে। এর আগে ১৯৯১ সালে সুইজারল্যান্ডের রিচার্ড আর্নস্টকে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স স্পেক্ট্রোস্কপির জন্য। ২০০২ সালে ম্যাগনেটিক রেজোনেন্সকে দ্বিমাত্রিক থেকে ত্রিমাত্রিক পর্যায়ে উন্নিত করার জন্য রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন সুইজারল্যান্ডের কুট উইরিখ।

রোগনির্ণয়ের জন্য বর্তমানে এম-আর-আই তুলনামূলকভাবে একটি নিরাপদ পদ্ধতি। পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় সাত কোটি রোগীর চিকিৎসার কাজে এম-আর-আই ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৯৮০ সাল থেকে উন্নত হাসপাতালগুলোতে এম-আর-আইর ব্যবহার শুরু হয়েছে। এখন বিশ্বজুড়ে প্রায় চল্লিশ হাজার এম-আর-আই মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে রোগনির্ণয়ে। শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের রোগ নির্ণয়ে এম-আর-আই ব্যবহার করা যায়। কিন্তু যেখানে এক্স-রে বা আলট্রাসাউন্ড রোগনির্ণয়ে সক্ষম, সেখানে এম-আর-আই ব্যবহার করার দরকার নেই। মানুষের মস্তিষ্কের রোগনির্ণয়ে এম-আর-আই এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ফাংশানাল এম-আর-আই এখন আলঝেইমারস, অটিজম ইত্যাদি দুরারোগ্য এবং দুর্বোধ্য রোগের কারণ ও গতিপ্রকৃতি বোঝার গবেষণায় ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।






এম-আর-আই মেশিনের অনেক দাম। এবং এই মেশিনের সঠিক ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষনের জন্য দক্ষ জনবল দরকার হয়। এম-আর-আই স্ক্যানিং-এর খরচ পড়ে অনেক। তাই যেখানে এক্স-রে করলেই যথেষ্ট সেখানে এম-আর-আই করার দরকার নেই। উন্নতদেশে মেডিকেল স্ক্যানিং-এর অপব্যবহার রোধ করার জন্য আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে। অস্ট্রেলিয়ায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া অন্য কেউ মেডিকেল এম-আর-আই করার পরামর্শ দিতে পারেন না।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts