চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দৈনিক পূর্বকোণে এই
লেখাটি পাঠিয়েছিলাম। চিঠিপত্র
কলামে প্রকাশিত হয়েছিল।
যৌতুক নামক সামাজিক অভিশাপের নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভের উপায়
যৌতুকের দাবিতে স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ কর্তৃক গৃহবধূ হত্যা, প্রহার, অ্যাসিড মেরে মুখ বা শরীর ঝলসে দেয়া, শরীরে কেরোসিন
ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া, সর্বশরীরে ধাতব বস্তুর গরম সেঁকা
দেয়া, দা দিয়ে কুপিয়ে গলা ফাঁক করে দেয়ার মত ঘটনা আজকাল অহরহ
ঘটছে। যৌতুকের
কারণে পিটিয়ে আধমরা করে তালাক দেয়ার মতো ঘটনা ঘটছে প্রচুর। শ্বশুর বাড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করছে
অনেক অসহায় গৃহবধূ। শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত সমাজেও ‘হাতেতে যদিও
না মারে তারে ... শতেক মারে ঠোঁটে’। আমাদের সমাজের চরম অভিশাপ যে যৌতুক এটা আজ সবাই স্বীকার
করে। যারা যৌতুকের শিকার তারা তো বটেই, যারা যৌতুক শিকারি তারাও স্বীকার করতে বাধ্য। যৌতুকের টাকা আদায় করার জন্য ছেলের বাপ কর্তৃক মেয়ের বাপের গোয়াল থেকে
হালের বলদ নিয়ে যাবার ঘটনাও নতুন নয়। আমরা
যত আধুনিক হচ্ছি যান্ত্রিক সভ্যতার চরম উন্নতির দিকে অগ্রসর হচ্ছি, যৌতুকের দাবিও সে হারে পরিবর্তিত হচ্ছে এবং বলাবাহুল্য বাড়ছে বৈ কমছে না।
যৌতুক নামক সামাজিক অভিশাপের নাগপাশ থেকে মুক্তিলাভের
জন্য আমি মনে করি:
১। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে শিক্ষিত করে
তুলতে হবে। শিক্ষার
হার বাড়াতে হবে এবং তার জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।
২। নারীশিক্ষা কর্মসূচি জোরদার করতে হবে।
৩। নারীকে অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত ক্করতে হবে। বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং
তার পসার বাড়াতে হবে। কুটির শিল্প, হাঁস-মুরগি পালন, শাক-সব্জি চাষ ইত্যাদি গ্রামীণ
প্রকল্পে মহিলাদের অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এর জন্য প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক
সহায়তা দিতে হবে। সরকারি, বেসরকারি, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এ দায়িত্ব পালন করতে পারে।
৪। রাষ্ট্রীয়, পেশাগত, সামাজিক, ধর্মীয়, ও
পারিবারিকভাবে নারীকে পুরুষের সমান অধিকার
দিতে হবে এবং তা প্রয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
৫। পৈত্রিক সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অংশীদারিত্ব
কার্যকর করতে হবে।
৬। রাষ্ট্রীয়ভাবে যৌতুকবিরোধী আইন, অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোর হস্তে প্রয়োগ করতে হবে। যৌতুকের
জন্য যদি কেউ স্ত্রীকে তালাক দেয় বা দিতে চায়, বা অত্যাচার করে তবে তার কঠোরতম শাস্তির বিধান করতে হবে। আইনগত জটিলতা সংশোধন করে বিচারকার্য দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে যৌতুক সংক্রান্ত নির্যাতন কমানো সম্ভব।
৭। বিবাহ রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করতে হবে। এর মাধ্যমে বহুবিবাহ রোধ সম্ভব।
৮। যৌতুকের বিরুদ্ধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচারমাধ্যমগুলোকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে হবে।
৯। ধর্মীয় কারণে নারী ও পুরুষের মধ্যে আইনগত যে বৈষম্য
আছে তা দূর করতে হবে।
১০। তালাক বিষয়ক যে ধর্মীয় গোঁড়ামী আছে তা আইন প্রয়োগ
করে বাতিল করতে হবে। এখনও মুসলমান নারী-পুরুষ মনে করেন যে, তালাক শব্দটা তিনবার পরপর উচ্চারণ করলেই
তালাক কার্যকর হয়ে যায় এবং একজন মুসলমান পুরুষ ইচ্ছামত তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো প্রয়োজন।
১১। বেকার সমস্যা দূরীকরণে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিতে
হবে। কারণ অনেক সময় বেকার ছেলেরা
যৌতুকের টাকাকে একটা way out মনে করে।
প্রদীপ কুমার
দেব
নাপোড়া, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম।
___________________
দৈনিক পূর্বকোণ।
২২/৬/১৯৯৩
________________________________
________________________________
No comments:
Post a Comment