বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতি যে ভালো
নয় সে ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক পরিস্থিতি
বিবেচনা করলে একটা ব্যাপার খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে - তা হলো এরকম জগাখিঁচুড়ি একটা
ব্যবস্থা গত ৪৬ বছর ধরে একটু একটু করে যারা তৈরি করেছেন - তাঁরা সবাই উচ্চশিক্ষিত
মানুষ। এই মানুষগুলো শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করছেন এবং শিক্ষাকে দ্রুত একটি লাভজনক
পণ্যে পরিণত করেছেন। ফলে আমাদের দেশের প্রধান শহরগুলোতে এখন ব্যাঙের ছাতার মত কয়েক
হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যে জেলায় ৩৫টি কলেজ থাকলেই চলে সেখানে কলেজ আছে ১৬৫টি। ছোট
ছোট শহরেই আছে ৩০-৩৫টি কলেজ। রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে দেখা যায় পাশাপাশি গ্রামে কয়েক
বর্গকিলোমিটারের মধ্যে গড়ে উঠেছে পাঁচ-ছয়টি কলেজ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এরকম চিত্র
দেখা যায়। এখানে মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীর সংখ্যা শিক্ষকের সংখার চেয়ে কমে যায়, ফলে
অনেক শিক্ষককে বাড়ি বাড়ি ঘুরে নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে হয়।
আবার বিপরীত চিত্রও আছে। দেশের প্রায় পনের হাজার গ্রামে
কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। এমন অনেক গ্রাম আছে যেখানে বেসরকারি পর্যায়েরও কোন
শিক্ষা উদ্যোগ পৌঁছোয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী
বাংলাদেশে মোট শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১,৬৭,৪৫৪। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় তিন
কোটি আর শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় আট লক্ষ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১:৩৮। এই অনুপাত
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি গ্রহণযোগ্য অনুপাত। কিন্তু দেখা যায় অনেক স্কুলে চারশ’ জন শিক্ষার্থীর জন্য
শিক্ষক আছেন মাত্র একজন, কোন কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় চালান মাত্র একজন বা দু’জন শিক্ষক। বিভিন্ন
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যাচ্ছে "দেশে স্কুল-কলেজের সংখ্যা
প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হয়ে গেছে”। কিন্তু আমাদের শিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।
আমরা সবাই চাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন।
সবাই প্রত্যাশা করছি বিশ্বমানের না হলেও একটা উন্নত মানের প্রগতিশীল
শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে আমাদের দেশে। এখন প্রশ্ন হলো - বর্তমান শিক্ষানীতি কার্যকর
হলে কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটবে? এটা নিয়ে অনেকেই অনেক রকম মত
দিচ্ছেন। ব্যক্তিস্বার্থ, দলীয় স্বার্থ, ব্যবসায়িক স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে বিবেচনা
করলে স্বীকার করতেই হয় যে শিক্ষানীতি
পুরোপুরি চালু করা গেলে এবং সবার সহযোগিতা থাকলে আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থায় সত্যিই
একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে, বর্তমান শিক্ষা-ব্যবস্থার অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে
যাবে। কোন ব্যবস্থাই নিচ্ছিদ্র নয়। বর্তমান শিক্ষানীতিতেও হয়তো কিছু কিছু সমস্যা
রয়ে যাবে, বা নতুন করে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হবে। কিন্তু সে সমস্যাগুলো মূল-সমস্যা
নয়। ক্যান্সারের চিকিৎসা করার সময় ক্যান্সার কোষের সাথে কিছুটা স্বাভাবিক কোষও
মারা যায়। কিন্তু সেগুলো বাঁচাতে গেলে রোগী বাঁচানো সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে শিক্ষানীতি ২০০৯-ই একমাত্র
শিক্ষানীতি যা সবার জন্য প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রণালয়কে অসংখ্য ধন্যবাদ
শিক্ষানীতির চূড়ান্ত খসড়া অনলাইনে প্রকাশ করার জন্য। এই কমিটিতে যাঁরা ছিলেন
তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ এরকম বিশাল একটা কাজ এত কম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার জন্য।
তাঁদের দায়িত্বের বাইরেও বিরাট দায়িত্ব পালন করেছেন প্রফেসর কবীর চৌধুরী, প্রফেসর
জাফর ইকবালসহ কমিটির সদস্যরা। তাঁরা তাঁদের লেখার মধ্য দিয়ে, মিডিয়ায় সাক্ষাৎকারের
মধ্য দিয়ে শিক্ষানীতির বিশ্লেষণ করেছেন। শিক্ষায় দুর্নীতি বন্ধ করার ব্যাপারে বিভিন্ন
পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে - কিন্তু পদক্ষেপের ফলে দুর্নীতি কমছে কি না - তা আমাদের জানা
নেই। কারণ উচ্চশিক্ষিত মানুষ যখন দুর্নীতি করে - তখন তাদের সামলাতে যথেষ্ট বেগ
পেতে হয়। দুর্নীতি করার সুযোগ থাকলে - সুবচন কাজ করে না সেখানে।
প্রফেসর মুহম্মদ জাফর ইকবাল শিক্ষানীতির সবচেয়ে
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো সহজভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন “শিক্ষানীতির সহজ পাঠ” প্রবন্ধে (প্রথম আলো,
২৬/১১/২০০৯)। ৯৬ পৃষ্ঠার মূল খসড়াটি পড়ে দেখার সময় যাদের হাতে নেই তারা জাফর
ইকবালের লেখাটি পড়লেই শিক্ষানীতির মূল ধারণা ও পদক্ষেপগুলো বুঝতে পারবেন। শিক্ষানীতির
পুরোটা বাস্তবায়িত হতে সময় লাগার কথা ছিল ২০১৮ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ আমাদের এ বছর
থেকেই শিক্ষানীতির সুফল পাওয়ার কথা। কিন্তু কোথায় যেন আটকে গেছে শিক্ষার সাফল্য।
শিক্ষানীতির দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে প্রাক-প্রাথমিক
শিক্ষা শুরু হবে ৫+ বছর থেকে। কোন ভর্তি পরীক্ষা থাকবে না। আনন্দময় পরিবেশে
পড়াশোনা হবে। খুবই ভালো কথা। কিন্তু বর্তমানে ৩+ বয়সী শিশুদের নিয়ে কিন্ডার
গার্টেন নামক নানারকম ইংরেজি স্কুলের যে কার্যক্রম তা কি বন্ধ হবে? সে ব্যাপারে
শিক্ষানীতিতে পরিষ্কার করে কিছু বলা হয়নি। প্রফেসর কবীর চৌধুরী বলেছিলেন, “প্রাথমিক পর্যায়ে সব
ক্ষেত্রে শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা”। সে ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে - অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণী
পর্যন্ত পড়ানোর জন্য কোন ধরণের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থাকার কথা নয়। বর্তমানে যে
কয়েক হাজার ইংরেজি মাধ্যম স্কুল আছে সেগুলো কবে নাগাদ বন্ধ হয়ে যাবে বা আসলেই কী
হবে তার কোন স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই শিক্ষানীতিতে। বরং এখন অনেক স্কুলে নতুন করে
ইংরেজি মাধ্যম বা ইংলিশ ভার্সান চালু হচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে - “প্রাথমিক শিক্ষা হবে
সার্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক, এবং সকলের জন্য একই মানের”। এটা বাস্তবায়িত হতে
হলে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলো অথবা বিরাট অংকের টাকার বিনিময়ে শিক্ষা বিক্রি হয়
যেসব প্রতিষ্ঠানে- সেগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। আমাদের দেশের শিশুরা ভালো করে কথা
বলতে শুরু করার আগে থেকেই শিক্ষা নামক যাঁতাকলে পড়ে এ, বি, সি, ডি, ওয়ান টু থ্রি
ফোর - - শিখতে শুরু করে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীকে ভর্তি
পরীক্ষা দিতে হবে না। এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু ঠিক কী পদ্ধতিতে ভর্তি সম্পন্ন
করা হবে সে সম্পর্কে পরিষ্কার করে কিছুই বলা হয়নি শিক্ষানীতিতে। প্রাথমিক শিক্ষায়
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অননুপাত ১:৩০ এবং এই লক্ষ্য পাঁচ বছরের মধ্যে অর্জন করা হবে। তা
যদি করতে হয় - তাহলে এলাকাভিত্তিক স্কুলে ভর্তি বাধ্যতামূলক করা দরকার। আমেরিকায়
প্রচলিত স্কুল-ডিস্ট্রিক্টের আদলে আমাদের দেশেও বিশেষ করে শহর অঞ্চলে স্কুল-এলাকা
ঠিক করে দেয়া দরকার। এটা করা হলে জনসংখ্যা অনুপাতে এলাকাভিত্তিক স্কুলে ভর্তির
ব্যবস্থা থাকবে। একই মানের অনেকগুলো সরকারি স্কুল থাকা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে
কয়েকটি বিশেষ স্কুলেই ছেলে-মেয়েদের ভর্তি করাতে চান বাবা-মায়েরা। বৈষম্য এভাবেই
শুরু হয়। এটা বন্ধ না হলে ভর্তি সমস্যা এবং ভর্তি কোচিং কোনটাই বন্ধ হবে না। টাকার
বিনিময়ে ভর্তি করানোর ব্যাপারটাও থেকেই যাবে।
বিদ্যালয়ে দুপুরে খাবার দেয়ার মত ভালো উদ্যোগের কথা বলা
হয়েছে। কিন্তু একটা বিরাট সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি। শিক্ষার্থীদের
স্কুলে যাতায়াতের ব্যবস্থা না থাকার কারণে অনেক রকম সমস্যার সৃষ্টি হয়। ঢাকা শহরের
কথাই ধরা যাক। শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র স্কুলে নিয়ে যাওয়া আর স্কুল থেকে নিয়ে আসার
জন্যই কী পরিমাণ সংকট পোহাতে হয় মা-বাবাকে। যানজট থেকে শুরু করে কত কিছুই জড়িত এর
সাথে। মা-বাবার উদ্বেগ আর শ্রম-ঘন্টার অপচয়ের কথা বাদই দিলাম। শিক্ষানীতিতে এই
ব্যাপারটা সমাধানের ব্যাপারে পরামর্শ থাকা
দরকার। আমেরিকার সবগুলো স্টেটে হলুদ রঙের স্কুল-বাস আছে। আমাদের দেশে হয়তো এতটা
সম্ভব নয়। কিন্তু স্কুল টাইমে ভাড়া করা বাস দিয়েও স্কুল-বাসের ব্যবস্থা চালু করা
যায়। নির্দিষ্ট লাইনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বাস ভাড়া করে এক ঘন্টার মধ্যে একটা শহরের
সবগুলো স্কুলে শিক্ষার্থীদের পৌঁছে দেয়া যায়। আবার ছুটির শেষে ফিরিয়ে আনাও যায়।
স্কুল টাইমিং আর অফিস টাইমিং আলাদা হলে এর ফলে যানজটও কমে যাবে।
প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ হবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। সেটা
বাস্তবায়ন করার জন্য বলা হয়েছে বর্তমান প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আরো তিনটি শ্রেণি
চালু করা হবে। আর উচ্চ-বিদ্যালয় গুলোতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর ব্যবস্থা করা
হবে। এ ব্যবস্থাগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেয়া হয়েছে শিক্ষানীতিতে। কিন্তু
একটা ব্যাপার অস্পষ্ট রয়ে গেছে। তা হলো বর্তমানে যে সকল কলেজে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি
পড়ানো হয় - সেগুলো থেকে কি একাদশ ও দ্বাদশ উঠিয়ে নেয়া হবে? বিসিএস পাস করে যারা
কলেজ শিক্ষক হবেন - তাঁরা কি শুধু স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াবেন?
শিক্ষানীতিতে এ ব্যাপারটার আরেকটু ব্যাখ্যা থাকা দরকার ছিল। ক্যাডেট কলেজের
শিক্ষা-ব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন কিছুই বলা হয়নি শিক্ষানীতিতে। বর্তমানে সেখানে
সপ্তম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। নতুন পদ্ধতিতে এ ব্যবস্থার কী
কী পরিবর্তন হবে, কীভাবে হবে?
সপ্তম অধ্যায়ে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে ভালো ভালো কথা
বলা হয়েছে। ইসলাম ধর্ম, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও খ্রিস্টান ধর্ম শেখানোর ব্যবস্থা
করা হবে বলা হচ্ছে। আদিবাসী সহ আরো সব সম্প্রদায়ের জন্য নিজ নিজ ধর্মসহ নৈতিক শিক্ষা
পাবে। কিন্তু যারা কোন নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস করে না তাদের কী হবে?
যে শিক্ষার্থীর মা-বাবা নাস্তিক তাদের কী হবে? একটা স্বাধীন দেশের স্বাধীন
নাগরিকের উপাসনা-ধর্ম পালন করার অধিকার
যেমন আছে - উপাসনা-ধর্ম পালন না করার স্বাধীনতাও আছে।
শিক্ষানীতির সংযোজনী-১ এ উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের
সংবিধানের শিক্ষাসংশিষ্ট কতিপয় বিধান। সংবিধানের ৪১(২) অনুচ্ছেদে ধর্মীয় স্বাধীনতা
প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: “কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোন ব্যক্তির নিজস্ব
ধর্ম-সংক্রান্ত না হইলে তাহাকে কোন ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোন ধর্মীয়
অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করিতে হইবে না”। সুতরাং ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কেউ না করতে চাইলে
তাকে বাধ্য করা যাবে না। শিক্ষানীতিতে এর প্রতিফলন থাকা দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার
প্রবর্তন, পরীক্ষা শুরু ও রেজাল্ট দেয়ার তারিখ মেনে চলার মত দরকারি ব্যাপারগুলো
উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু একটা অতি জরুরি ব্যাপার বাদ পড়েছে। আমাদের
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশান শুরুর নির্দিষ্ট কোন সময় নেই। পৃথিবীর সব দেশেই
ইউনিভার্সিটির সেমিস্টার শুরুর নির্দিষ্ট সময় থাকে। ফল, স্প্রিং, উইন্টার, সামার -
অথবা ফার্স্ট সেমিস্টার - সেকেন্ড সেমিস্টার। আমাদের দেশের ইউনিভার্সিটিগুলোতে সেমিস্টার
সিস্টেম চালু করা দরকার। অবাক হবার মত সত্যি কথা হলো এই - অনির্দিষ্ট কারণে
অনির্দিষ্টকাল বন্ধ না থাকলে আমাদের দেশের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে একটা
কোর্সে যত ঘন্টা পড়ানো হয় - তার পরিমাণ আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার যে কোন
ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো কোর্সের চেয়ে বেশি। এত বেশি সময় ধরে পড়াশোনা করার পরও আমরা
কেন যে এখনো পিছিয়ে আছি জানি না। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ফার্স্ট সেমিস্টার
আর জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সেকেন্ড সেমিস্টার চালু হলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা
সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় রূপ নিতে পারবে। ডিসেম্বরের মধ্যেই ইউনিভার্সিটি
ভর্তি প্রক্রিয়া বর্তমানেও সম্পন্ন হচ্ছে। সুতরাং ইউনিভার্সিটিগুলোতে সেমিস্টার
সিস্টেম এখনই চালু করা যায়। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানকে দলীয় রাজনীতি থেকে আলাদা করতে
পারলেই অনেক বিরাট বিরাট সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার ব্যাপারে চমৎকার সব
পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে শিক্ষানীতিতে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষার
প্রসার ঘটবে নিঃসন্দেহে। তবে কয়েকটি ব্যাপারে আরেকটু বিবেচনার দরকার আছে মনে হয়।
যেমন - একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীর জন্য উচ্চতর গণিত
বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আবশ্যিক বিষয় হিসেবে ১০০ নম্বরের সাধারণ গণিতও আছে। আমার
মনে হচ্ছে ২০০ নম্বরের উচ্চতর গণিত বাধ্যতামূলক করার দরকার নেই। কারণ মাধ্যমিক পাস
করার পর যারা মেডিকেল বা বায়ো-মেডিকেল বা বায়োলজিক্যাল সায়েন্স নিয়ে পড়বে তাদের
জন্য উচ্চতর গণিতের খুব বেশি দরকার কি আছে? উচ্চতর গণিত বাধ্যতামূলক হলে
জীববিজ্ঞান নয় কেন? এখন আসলে আমাদের আরো একটু আধুনিক হবার সময় এসেছে।
পদার্থবিজ্ঞানসহ সব কিছুই এখন আরো নানারকম ভাগে বিভক্ত হচ্ছে। প্রি-মেডিকেল
স্টুডেন্টদের জন্য নন-ক্যালকুলাস বেইজড ফিজিক্স আবার প্রি-ইঞ্জিনিয়ারিং এর জন্য
ক্যালকুলাস বেইজড। উচ্চতর গণিতকে এখন যেমন আছে সেরকম বিষয় হিসেবেই রাখা উচিত বলে
মনে করছি। যার খুশি সে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে নেবে, যার খুশি সে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে
নেবে। কারণ বাধ্যতামূলক করলেই যে গণিতের প্রতি ভালবাসা জন্মাবে তা কিন্তু নয়। গণিত
না বুঝে তো আর গণিতকে ভালবাসা যায় না। আর গণিত না বুঝলেই যে বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার
দরজা বন্ধ হয়ে যাবে তা ঠিক নয়। বরং গণিতকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে জীববিজ্ঞান,
মনোবিজ্ঞান এসব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সকে কিছুটা খর্ব করা হচ্ছে। শিক্ষানীতি অনুসারে
একজন শিক্ষার্থী জীববিজ্ঞান আর মনোবিজ্ঞান বা পরিসংখ্যান একসাথে পড়তে পারবে না। এই
দিকটা ভেবে দেখা দরকার।
২১তম অধ্যায়ে পরীক্ষা ও মূল্যায়ন সম্পর্কে যে
সুপারিশগুলো করা হয়েছে তার সবগুলোই খুব সময়োপযোগী। ১ম ও ২য় শ্রেণীতে কোন পরীক্ষা
না থাকার সুপারিশটা খুবই ভালো। ৩য় থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত অর্ধ-বার্ষিক ও বার্ষিক
পরীক্ষা থাকাটাও সঠিক। কিন্তু বাংলাদেশের অনেক তথাকথিত নামী-দামী স্কুলে ধরতে গেলে
প্রতি সপ্তাহেই পরীক্ষা থাকে - ক্লাস টেস্ট, মান্থলি টেস্ট, কোয়ার্টারলি টেস্ট,
মডেল টেস্ট ইত্যাদি হাজার রকমের নাম। কার্যত দেখা যায় বছরের শুরু থেকেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের
একটাই কাজ তা হলো প্রশ্ন ও উত্তর তৈরি করা। এই পরীক্ষাগুলো কি শিক্ষার্থীর
লেখাপড়ার মান বাড়ার ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা রাখে? যদি না রাখে, এতগুলো পরীক্ষা না
রাখাই উচিত। শিক্ষানীতিতে এ সংক্রান্ত নির্দেশ থাকা দরকার।
পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষার ব্যবস্থা শিক্ষানীতি
কার্যকর হবার আগে থেকেই চালু হয়ে গেছে। ফলে ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের উপর মারাত্মক
চাপ পড়ছে। এই পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পরেও তা কার্যকর করার কোন
উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। কিছু কিছু স্কুলে
সারাবছর ধরেই তাদের মডেল টেস্টের পর মডেল টেস্ট নেয়া হয়েছে। কোচিং করানোর নামে আলাদা
করে মোটা টাকা আদায় করা হয়েছে।
মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের
পরীক্ষাতেও যে পদ্ধতিতে ব্যবহারিক পরীক্ষা নেয়া হয় - তা মোটেও কার্যকর নয়।
শুধুমাত্র একটি পরীক্ষণের উপর ভিত্তি করে নম্বর দেয়ার ব্যবস্থা থাকে। ফলে অনেক
কলেজেই সারাবছর ব্যবহারিক ক্লাস হয় না, পরীক্ষার আগে একটা দুটো পরীক্ষণ করানোর ব্যবস্থা
করা হয়। বড় বড় কলেজে অবস্থা আরো ভয়াবহ। সেখানে ল্যাবোরেটরি সহকারীদের টাকা না দিলে
কোন যন্ত্রপাতিই পাওয়া যায় না পরীক্ষার সময়। এমন ঘটনাও বাংলাদেশে ঘটতে দেখা যায় -
তত্ত্বীয় পরীক্ষায় ১৫০ এর মধ্যে ৫০ এর কম পেয়ে ফেল করেছে - অথচ ব্যবহারিক এ ৫০ এর
মধ্যে পেয়েছে ৫০। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার। ব্যবহারিক পরীক্ষা
সারা বছর জুড়ে যে পরীক্ষণ ক্লাসগুলো হবে তার মূল্যায়নের ভিত্তিতেই হওয়া উচিত।
গাইড বই, নোট বই, প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং বন্ধ করার
ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। বন্ধ করা গেলে খুবই ভাল হয়। কিন্তু এই কাজটা করা খুব
সহজ হবে না। কারণ অনেক। শিক্ষকদের বেতন বাড়ালেই যে তাঁরা প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করে
দেবেন - এটা আশা করাও ঠিক নয়। কারণ যারা প্রাইভেট পড়ান - তাদের মাত্র কয়েক শতাংশ
তা করেন বাধ্য হয়ে - দুটো বেশি রোজগারের আশায়। কিন্তু বেশির ভাগই করেন টাকার
নেশায়। তাঁদের যুক্তিও আছে। ডাক্তাররা যদি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারেন,
শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না কেন? এটা একটা লম্বা সমস্যা। যে শিক্ষক ক্লাসে
ঠিকমত বোঝাতে পারেন না তিনি প্রাইভেটে কীভাবে বোঝান? আসলে সেখানেও একই পদ্ধতি।
প্রশ্ন ও উত্তর। মূল লক্ষ্য পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে পাস করা। সৃজনশীল পরীক্ষা
পদ্ধতিতেও এ ব্যবস্থার উন্নতি হবে মনে হচ্ছে না। কারণ সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্ন-উত্তরের
বইও তৈরি হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাগুলো এখন শিক্ষার পাতা ছাপায়।
সেখানে চোখ বুলোলেই দেখা যায় - বিভিন্ন ক্লাসের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নোত্তর,
সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির প্রশ্নোত্তর, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নোত্তর ইত্যাদি। এগুলো
কি বন্ধ হবে? তা ছাড়া প্রশ্ন-উত্তর বা বই লেখার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকা উচিত নয়।
শিক্ষক যদি তাঁর নিজের দায়িত্ব পালন করার পর প্রাইভেট পড়ানোর সময় পান, শক্তি থাকে
- করবেন না কেন? কিন্তু এই অতিরিক্ত আয় কেন আয়করমুক্ত হবে? সরকারের উচিত সব
উপার্জনকেই আয়করের আওতায় নিয়ে আসা। আর পরীক্ষা পদ্ধতির ব্যাপক পরিবর্তন হলে, গাইড
বই পড়ে কাজ না হলে, স্যার-ম্যাডামদের তৈরি করে দেয়া নোট পড়ে পরীক্ষায় সুবিধে করতে
না পারলে প্রাইভেট এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। কোচিং সেন্টারগুলোর কী অবস্থা করা হবে?
এগুলো যেহেতু একেকটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান - এদের নিশ্চয় ট্রেড লাইসেন্স থাকা উচিত,
রেজিস্ট্রেশন থাকা উচিত, যারা শিক্ষা দেবেন তাদের উপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা
উচিত। মেডিকেল রেজিস্ট্রেশন ছাড়া যেমন চিকিৎসা করা যায় না - সেরকম টিচিং
রেজিস্ট্রেশান ছাড়া কারোরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেয়ার অধিকার থাকা উচিত নয়।
মাদ্রাসা শিক্ষা সংকোচনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে
উস্কানি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু একটু ফ্যাক্ট্স এন্ড ফিগার দেখলেই বোঝা যায় যে এই
শিক্ষানীতিতে মাদ্রাসা শিক্ষাকে অনেক বেশি পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে। বাংলাদেশে
বর্তমানে কলেজের সংখ্যা ৩,২৫৫, অথচ মাদ্রাসার সংখ্যা তার প্রায় তিনগুণ - ৯,৩৭৬।
কলেজে শিক্ষার্থীর মোট সংখ্যা ১৯,৪৮,৪১৮, অথচ মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর মোট সংখ্যা
১৯,৮৪,৬২৬। কলেজে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:২২, অথচ মাদ্রাসায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর
অনুপাত ১:১৬। দেখা যাচ্ছে সব দিক দিয়েই মাদ্রাসা এগিয়ে আছে কলেজের তুলনায়। বর্তমান
শিক্ষানীতিতে এর সংকোচনের কোন কথা তো বলাই হয় নি - বরং মাদ্রাসা শিক্ষাকে অনেক
বেশি আধুনিক করে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে। মাদ্রাসা আর স্কুল-কলেজের পড়ানোর
বিষয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হচ্ছে। অভিযোগ তোলা হচ্ছে যে ধর্মশিক্ষা সংকোচন
করা হচ্ছে। অথচ এই শিক্ষানীতিতে ক্লাস থ্রি থেকেই ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক। সুতরাং
জামায়াত এবং তাদের বন্ধুরা এই শিক্ষানীতির বিরোধিতা করছেন - শুধুমাত্র ব্যক্তিগত
স্বার্থে বা ব্যক্তিগত আক্রোশে।
যতই ভালো হোক - যে কোন নীতির বাস্তবায়নে দরকার
নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছা ও সবার সহযোগিতা। সহযোগিতা না করে যদি কেউ জেনেশুনে নীতির
ফাঁক দিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার করে তাহলে কোন নীতিই কার্যত সফলতা লাভ করবে
না। একটা উদাহরণ দেয়া যায়- নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও ভুক্তির ব্যাপারে নীতিমালা
আছে। সেখানে বলা হয়েছে “দশ হাজার জনসংখ্যার জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে”। এটার মধ্য থেকেও ফাঁক
বের করে নিজেদের স্বার্থে লাগিয়েছেন অনেকে। মাধ্যমিক পর্যায়ে তিন ধরনের শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান হতে পারে। তাই দেখা গেছে দশ হাজার জনসংখ্যার জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ের
একটি স্কুল, একটি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও একটি দাখিল মাদ্রাসা স্থাপিত হয়ে
গেছে। এরকম করতে করতে গত ৩৭ বছরে সরকারের অপচয় হয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা।
শিক্ষার জন্য সরকারের বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ হচ্ছে।
সরকারি বেসরকারি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন সরকার দিচ্ছে। অভিভাবকরা তাঁদের
ছেলেমেয়েদের জন্য অন্ধের মত শিক্ষা কিনছেন বিভিন্ন কোচিং সেন্টার থেকে। আসলে
শিক্ষা কিনছেন কি? নাকি পরীক্ষায় ভালো পাস করার নিশ্চয়তা কিনছেন? বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর
শৈশব কৈশোর হারিয়ে যাচ্ছে পরীক্ষা দিতে দিতে। শিক্ষা আনন্দময় করতে হলে, শিক্ষার সুফল
পেতে হলে এই অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার চাপ
কমাতেই হবে।
No comments:
Post a Comment