২০১৫ সালের
১২ মে - অনন্তকে খুন করা হয়েছে।
তারপর সময়
চলে যায়
কিছুই বদলায়
না
এই লেখাটি
লিখেছিলাম ২০১৫ সালে।
_________________________
আজ
দু'সপ্তাহ হয়ে গেলো অনন্তকে তারা চারজনে মিলে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে। চার জন
মুখোশধারী জল্লাদ। এই চারজনের পেছনে আরো কতজন আছে, কারা এদের পাঠিয়েছে, কাদের অর্থ
ও নিরাপত্তায় এরা পুষ্ট হচ্ছে আমরা জানি না। শুধু এটুকু জানি - এরা চায় না
বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চা হোক। অনন্তর আগে তারা একই কায়দায় মেরেছে আশিকুর
রহমান বাবুকে, তার আগে বইমেলার গেটে হাজারো লোকের সামনে খুন করেছে মুক্তমনার
অগ্রদূত ডক্টর অভিজিৎ রায়কে। সব ক্ষেত্রেই অনলাইনে খুনের দায়িত্ব স্বীকার করে একটা
গোষ্ঠী পৈশাচিক আনন্দোল্লাস করলেও তাদের নাগাল পায় না বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয়
দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তা বাহিনী। শুধু বাংলাদেশ কেন - অভিজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফ-বি-আইও এসেছিলো। আই ওয়াশ ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি তারাও। পরের দু'মাসে
আমরা দেখলাম আরো দু'জন মুক্তবুদ্ধির মগজ ও শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো খুনিদের
চাপাতির কোপে। বুদ্ধির মুক্তির সংগ্রামের সাম্প্রতিক শহীদ অনন্ত বিজয় দাস - আমাদের
অনন্ত।
অনন্তের লেখার
সাথে আমার পরিচয় ২০০৬ সালে। নিয়মিত মুক্তমনা পড়তে শুরু করেছি সেই সময়। তার
বিশ্লেষণী লেখা আর জোরালো যুক্তি পড়ে ভাবতেই পারিনি যে অনন্ত তখন সবেমাত্র কৈশোর
পেরিয়ে তারুণ্যে পা রেখেছেন। ২০০৭ সালের
বইমেলায় অনন্ত প্রকাশ করলেন 'যুক্তি'র প্রথম সংখ্যা। বাংলাদেশে এত ভালো যুক্তিবাদী
পত্রিকা এর আগে দেখিনি। আজ এত বছর পরে আবার সেই 'যুক্তি'র পাতা উল্টাতে গিয়ে চমকে
উঠলাম। যুক্তির ভূমিকায় ডক্টর অভিজিৎ রায় লিখেছিলেন, “অনন্ত বিষবৃক্ষের পাতায় পাতায়
কাঁচি চালায়নি, বরং কুঠারের কোপ বসিয়েছে একদম গভীরে, বিষবৃক্ষের গোড়াতেই”। বিষবৃক্ষ যে আমরা কাটতে পারিনি তার
প্রমাণ তো প্রতিনিয়তই পাচ্ছি। অভিজিৎ রায় আর অনন্ত বিজয় দু'জনই আজ তাদের চাপাতির
শিকার।
বইমেলায় অনন্ত অটোগ্রাফ দিচ্ছেন অভিজিৎ রায়কে। ছবি: রণদীপম বসু |
অনন্তের যুক্তির
প্রথম সংখ্যায় প্রফেসর অজয় রায় তাঁর “ব্রুনো থেকে আরজ আলী মাতুব্বর”-এ প্রশ্ন করেছিলেন, “ডঃ হুমায়ূন আজাদের খুনিরা কিংবা সাংবাদিক ও বিচারকদের হত্যাকারীরা যদি
বলে যে আমাদের ইচ্ছে শক্তি নেই - আমরা তো কলের পুতুল আল্লাহ্র ইচ্ছেতেই চলি, কাজ
করি, আল্লাহ্ই আমাদেরকে দিয়ে হুমায়ূন আজাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছেন, সাংবাদিক ও
বিচারকদের হত্যা করিয়েছেন। সাক্ষ্য হিসেবে আদালতে যদি কোরানের এসব বাণী উপস্থাপন
করা হয়, তাহলে মাননীয় আদালত কী করে কোরানের বাণীর বিপরীতে কাজ করবেন!” মাত্র আট বছরের মাথায় প্রফেসর অজয়
রায়কে তাঁর নিজের কথার বাস্তব প্রতিফলন দেখতে হচ্ছে।
২০০৮ সালে যুক্তির দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হবার
প্রায় সাথে সাথেই অনন্ত আমাকে একটা কপি পোস্ট করে পাঠিয়েছিলেন। প্রবন্ধ নির্বাচনে আর
সম্পাদনায় কী যে যত্ন আর দূরদৃষ্টি ছিল তাঁর। প্রায় একশ' বছর আগে লেখা আবুল
হোসেনের "আদেশের নিগ্রহ" প্রবন্ধটি অনন্ত আমাদের নতুন করে পড়ার সুযোগ
দিয়েছিলেন যুক্তির দ্বিতীয় সংখ্যায়। সেই আপাত অনাধুনিক যুগেও আবুল হোসেন লিখতে
পেরেছিলেন, "“কোরান-হাদিস বাঙলার সাধারণ মুসলমানের নিকট বন্ধ-করা
(sealed)একখানি পুস্তক ব্যতীত আর কিছুই নয়, যে পুস্তক হতে তারা কিছুই গ্রহণ করতে
পারে না বা যার কথা শুনেও তারা তাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারে না অর্থাৎ পারছে না।
তবে অনুষ্ঠান পালনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে তারা এখনও মুসলমান। তাই মাত্র টুপি,
লুঙ্গি, দাড়ি, এই বাহ্যিক নিদর্শন দ্বারাই তারা তাদের মুসলমানত্ব প্রমাণ করছে।
কোরান-হাদিসের সমস্ত বিধি-নিষেধের ফল মুসলমানের জীবনে শুধু টুপি, লুঙ্গি, দাড়িতেই
প্রকাশ পেয়েছে; তার বাইরে মুসলমানের আর কী-কী নিদর্শন চাই মানুষের দিক থেকে, তার
প্রতি লক্ষ্য আমাদের সমাজপতিদের আছে বলে মনে হয় না। তা যদি থাকত তা হলে মসজিদের
সামনে বাজনা এই অতি সামান্য ব্যাপার নিয়ে নরহত্যায় আমরা প্রবৃত্ত হতাম না। এ কথা
আরো মনে হয় যখন দেখি মসজিদের উপাসকগণের অনেকেই গুন্ডামি জিনিসটা একটা আমোদজনক ও
কতকটা প্রয়োজনীয় ব্যাপার বলে মনে করে”। “ইসলামের বিধি-নিষেধ পালন করতে গিয়ে মুসলমান আজ কতকগুলি ভন্ড, প্রাণহীন,
গর্হিতরুচি, বুদ্ধি-বিবেকহীন জীবে পরিণত হয়েছে। মুসলমান নেতৃবৃন্দ এদিকে দৃক্পাতও
করছেন না; বরং সমস্তই ধামাচাপা দিয়ে তাঁরা সমাজে সাচচা বনে বসেছেন”। না,
এই সত্যি কথাগুলো এমন খোলাখুলিভাবে লেখার জন্য আবুল হোসেনকে প্রাণ দিতে হয়নি।
কিন্তু এই আধুনিক যুগে - প্রগতিশীলতার যুগে প্রাণ দিতে হলো অনন্তকে।
২০১১ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হলো অনন্ত ও সৈকতের প্রবন্ধের বই
"পার্থিব"। বইটি পড়ে এমন অবাক আর খুশি হয়েছিলাম, আর আশায় বুক বেঁধেছিলাম
যে- বাংলাদেশে যুক্তির প্লাবন ঘটতে শুরু করেছে। পার্থিব-এ অনন্ত দ্বিধাহীনভাবে লিখেছেন, "ধর্মগ্রন্থগুলো
পড়তে হবে যার যার নিজের ভাষায়। যুক্তি
প্রয়োগ করে বুঝতে হবে ধর্মগ্রন্থের বাণীর মর্মার্থ। শুধু পুণ্যলাভের আশায় না বুঝে
পবিত্র ভাষায় পাঠ করা থেকে বিরত থাকা ভালো। না বুঝে পাঠ করলে শুধু অজ্ঞতাই বৃদ্ধি
পায়, জ্ঞান বৃদ্ধি পায় না। আর এই অজ্ঞতা নামক দুর্বলতার সুযোগ নেয় আমাদের চারপাশের
কিছু মোল্লা-মৌলভি, পীর-ফকির, ঠাকুর প্রমুখেরা। তাই সমাজকে বিজ্ঞানমনস্ক,
যুক্তিবাদী, প্রগতিশীল করে তুলতে হলে যুক্তিবোধের বিকাশ ঘটানোর কোন বিকল্প নেই।" (পার্থিব - পৃঃ ১৩৪)।
নিজে
সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হলেও বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান-মানসের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকে অনন্ত
বিজ্ঞান নিয়ে লিখেছেন, বিবর্তন নিয়ে লিখেছেন, বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে লিখেছেন। শুধু
লেখা নিয়ে থাকেননি, বিজ্ঞান সংগঠন করেছেন, শিক্ষা-আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছেন।
সিলেটে গণ জাগরণ মঞ্চের সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলেন অনন্ত। নিজের পরিবারের অর্থনৈতিক
টানাটানি, অসুস্থ মা-বাবার দায়িত্ব সব হাসিমুখে পালন করেও সময় বের করে নিতেন
যুক্তিবাদের প্রসার ঘটাতে, মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটানোর পক্ষে কাজ করতে।
বাংলাদেশে
প্রফেসর জাফর ইকবাল জীবন্ত কিংবদন্তী। তাঁকে সিলেটের একজন সংসদ সদস্য প্রকাশ্যে
চাবুক মারার কথা বলেছেন। আশা করেছিলাম এর প্রতিবাদে ফেটে পড়বে বাংলাদেশ। কিন্তু
ফেসবুকে কিছু প্রতিবাদের বুদবুদ ওঠা ছাড়া আর তেমন কিছুই হয়নি। আশ্চর্য আমাদের
নিরবতা। অনন্ত তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। খুন হয়ে যাবার কয়েক ঘন্টা
আগেও ডক্টর জাফর ইকবালকে অপমান করার প্রতিবাদে লম্বা পোস্ট দিয়েছেন অনন্ত।
অনন্তরা
তাই করেন চিরদিন। নিজের ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপার নিয়ে কখনোই চিন্তা
করেন না। অনেকের ভাষায় ঘরের খেয়ে বনের মোষ
তাড়ান। আশ্চর্যজনক ভাবে এটাই সত্য যে এই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ছেলেমেয়েরাই
পারে মুক্তির পথ দেখাতে। এরা ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা ভাবতে পারে না, নিজের
সুখদুঃখ পাওয়া না-পাওয়ার তোয়াক্কা না করে সত্যানুসন্ধানের জন্য, চিন্তার
স্বাধীনতার জন্য, সবার বাসযোগ্য একটা পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য সংগ্রামে সামিল হয়ে
যায়। মুক্তিযুদ্ধের কথা ভেবে দেখুন। স্বাধীনতার সবগুলো কঠিন ধাপেই যারা মৃত্যুভয় তুচ্ছ
করে এগিয়ে গেছে তারা সবাই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো মানুষ। আর রাজাকারদের দেখুন -
লুটপাট করার জন্য, 'গণিমতের মাল'-এর ভাগ পাওয়ার জন্য কী না করেছে।
কিন্তু
দুঃখজনক সত্য এই যে আমরা স্বাধীনতার এত বছর পরেও কেমন যেন ক্রমশ পেছনের দিকে চলে
যাচ্ছি। ১৯৭১-এ বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করে ফেলার যে কাজ শুরু করেছিল পাকিস্তানের
দোসররা- সে কাজ তারা কখনোই থামায়নি। অথচ আমরা স্বাধীনতা অর্জন করার পর কেমন যেন
থেমে গেছি। এই যে একের পর এক মুক্তমনা মানুষ খুন হয়ে যাচ্ছে - আমরা নিরব প্রতিবাদ
করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছি না। অভিজিৎ রায়ের হত্যার পর বিচার চেয়েছিলাম। কিন্তু
এখন অনেকটাই হাল ছেড়ে দিয়েছি। এখন অনন্ত বিজয়ের হত্যার বিচারও চাচ্ছি না আর। কারণ
কার কাছে বিচার চাইবো এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে?
তবুও এটুকু
সান্তনা যে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে দেয়ার ব্যবস্থা
করেছিল যারা তারা কোনদিন ভাবতেও পারেনি যে একদিন বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধু
হত্যার বিচার হবে। একাত্তরের যে রাজাকার-সর্দার বাংলাদেশে মন্ত্রী হয়েছিল - সে কি
কখনো ভাবতে পেরেছিল যে বাংলাদেশে তার বিচার হবে একদিন? অভিজিৎ, বাবু, অনন্ত - কারো
রক্তই বৃথা যাবে না। কারণ এদের শরীরের মৃত্যু ঘটেছে ঠিক - কিন্তু এদের রেখে যাওয়া
লেখাগুলোকে কি মেরে ফেলা সম্ভব?
অনেকেরই
মনে হতে পারে বাংলাদেশে এখন মুক্তমনাদের দুঃসময়। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না
যে 'দুঃসময়' কবিতাতেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
"যদিও
সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে
সব সংগীত
গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া
যদিও সঙ্গী
নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও
ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা আশঙ্কা
জপিছে মৌন মন্তরে,
দিকদিগন্ত
অবগুন্ঠনে ঢাকা
তবু
বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি,
অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।।"
অনন্ত,
তোমাদের রক্তের ঋণ, ভালোবাসার ঋণ আমরা শুধবোই, লাগে লাগুক অনন্তকাল।।
তোমার এরকম লিখা পড়লে সত্যি আমার ভিতর থেকে শক্তি জাগে। যুক্তি দিয়ে বিচার করা শিখি। এজন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, মামা।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ অনন্যা। যুক্তি হোক আমাদের মগজের প্রধান শক্তি।
Delete