বিবর্তন: প্রেক্ষিত অস্ট্রেলিয়া
প্রদীপ দেব
চার্লস ডারউইন তাঁর বিখ্যাত বিগল সমুদ্র-যাত্রার পথে থেমেছিলেন
অস্ট্রেলিয়াতেও। ১৮৩৬ সালের জানুয়ারিতে নিউ সাউথ ওয়েল্স এর ব্লু-মাউন্টেনের জীব ও
উদ্ভিদ বৈচিত্র্য দেখেছিলেন ডারউইন। তাঁর সম্মানে অস্ট্রেলিয়ার নর্দান টেরিটরির
রাজধানী শহরের নামকরণ করা হয়েছে - ডারউইন। ১৮৬৯ সালে ২৩৩ বর্গ-কিলোমিটারের এই
শহরটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত এর নাম ছিল পামারস্টন। ডারউইন শহরের
সমুদ্র-বন্দরের নাম ‘পোর্ট ডারউইন’। ক’বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি’।
ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের হাজারো প্রমাণ ছড়িয়ে আছে অস্ট্রেলিয়ার আনাচে
কানাচে। মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন প্রকান্ড একটা দ্বীপ হওয়ার কারণে পুরু দ্বীপটাই
হয়ে ওঠেছে বিবর্তনের পরীক্ষাগার। এতবড় দ্বীপটার আবহাওয়া বিচিত্র। পৃথিবীর দ্বিতীয়
বৃহত্তম মরুভূমি এখানে। নানারকম আবহাওয়ার সাথে টিকে থাকার জন্য এখানে উদ্ভিদ ও
প্রাণীর বিবর্তন ঘটেছে অনেক। মাত্র কয়েক প্রজাতির ইউক্যালিপ্টাস থেকে বিবর্তিত হতে হতে এখন প্রায় আটশ’ প্রজাতির ইউক্যালিপ্টাস বা গামট্রি পাওয়া
যায় অস্ট্রেলিয়ায়। এদের মধ্যে আছে নিচু এলাকায় নদীর পানিতে টিকে থাকা ‘রেড রিভার গাম’, একদম শুকনো বালিতে টিকে থাকা ‘হোয়াইট গাম’, বরফের মধ্যে টিকে থাকা ‘স্নো গাম’। গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড উত্তাপে প্রায়ই আগুন লেগে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় মাইলের
পর মাইল ইউক্যালিপ্টাসের বন। কিছুদিন পর দেখা যায় সেই পোড়া গাছ থেকেই জন্ম নিচ্ছে
নতুন গাছ। প্রতিকূল পরিবেশের সাথে টিকে থাকার জন্য জিন-গত পরিবর্তন ঘটে চলেছে এ
গাছগুলোর মধ্যে।
অস্ট্রেলিয়ায় বিবর্তন তত্ত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো অস্ট্রেলিয়ান খরগোশের
উৎপত্তি। ইউরোপিয়ানরা এসে ঘাঁটি করার আগপর্যন্ত কোন ধরনের খরগোশ ছিল না
অস্ট্রেলিয়ায়। মাত্র বারোটি খরগোশ নিয়ে ইংল্যান্ড থেকে ভিক্টোরিয়ায় এসেছিলেন এক
ইংরেজ পরিবার ১৮৫৯ সালে। কয়েক বছরের মধ্যেই Oryctolagus cuniculus প্রজাতির এই বারোটি খরগোশ দ্রুত
বংশবিস্তার করতে থাকে। বছরে প্রায় একশ’ কিলোমিটার হারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে ১৮৮৬ সালের মধ্যেই ভিক্টোরিয়া
থেকে সাউথ অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গেলো হাজার হাজার খরগোশ। ১৯০৭ সালের মধ্যে
অস্ট্রেলিয়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লো কয়েক কোটি খরগোশ।
গাছ-পালা ফলমূল শাকসব্জি সব চলে যেতে শুরু করলো খরগোশের পেটে। মেরে, কেটে, বিষ
দিয়ে- যত ধরণের পদ্ধতি জানা ছিলো সব প্রয়োগ করেও কিছুতেই কিছু করা গেলো না।
খরগোশের সংখ্যা বেড়েই চললো। Rabbit-proof fence এর প্রচলন ঘটে এ সময়। কিন্তু কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না খরগোশের
বংশবৃদ্ধি। অস্ট্রেলিয়ার গরু আর ভেড়ার ফার্ম মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়ে গেলো, কারণ
গরু-ভেড়ার সব ঘাস চলে যাচ্ছে খরগোশের পেটে [1]।
অস্ট্রেলিয়ায় ইওরোপিয়ান খরগোস
সব অস্ত্র ব্যর্থ হবার পর বিজ্ঞানীরা জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত
নিলেন। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর অস্ত্র তৈরি হলো- মশা বাহিত ভাইরাস
মাইজোম্যাটোসিস। এই ভাইরাস কেবল ইউরোপিয়ান খরগোশ মেরে ফেলবে, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার
অন্য কোন প্রাণীর ক্ষতি করবে না। ১৯৫০ সালে এ ভাইরাস ছাড়া হলো। দু’বছরের মধ্যেই খরগোশের মড়ক লেগে গেল।
খরগোশের মৃত্যুর হার দাঁড়ালো প্রায় ৯৯.৯%। কিন্তু জীববৈজ্ঞানিক বিবর্তন শুরু হলো। শতকরা শুন্য দশমিক এক ভাগ
খরগোশের জিনের মিউটেশানের ফলে ক্রমশ এক নতুন ধরনের খরগোশের উৎপত্তি হলো যা
ইউরোপিয়ান খরগোশ থেকে আলাদা- অস্ট্রেলিয়ান খরগোশ যারা মাইজোম্যাটোসিস ভাইরাসের
বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারে। যে প্রজাতির খরগোশ ইউরোপ থেকে আনা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়
- সে প্রজাতির সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটেছে। বর্তমান প্রজাতির অস্ট্রেলিয়ান খরগোশের
মাইজোম্যাটোসিস ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকে থাকার ক্ষমতা প্রায় ৬০%।
১৮৬০ সালে অস্ট্রেলিয়ায় খরগোস শিকারের দৃশ্য
চোখের সামনে ঘটা বিবর্তন দেখেও বাইবেল-অন্ধ পাদ্রীর অভাব নেই অস্ট্রেলিয়ায়।
বিশেষ করে চার্চ থেকে যখন প্রচুর টাকা-পয়সা সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। তাই তো দেখা
যায় ২০০৫-০৬ সালে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের পালে হাওয়া দিয়েছে অনেকগুলো অস্ট্রেলিয়ান
চার্চ ও খ্রিস্টান স্কুল [2]। আমেরিকার
স্কুলিং সিস্টেম ফেডারেল গভমেন্টের অধীন। সেখানে ধর্মীয় স্কুলে রাষ্ট্রীয় সাহায্য
দান আইনের পরিপন্থী। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় স্কুল শিক্ষা রাজ্য সরকারের অধীন। রাজ্য
সরকার ইচ্ছে করলে যে কোন ধর্মীয় স্কুলেও সরকারী সাহায্য দিতে পারে। ইন্টেলিজেন্ট
ডিজাইনওয়ালারা সে সময় অনেক ক্যাথলিক স্কুলের বিজ্ঞানের সিলেবাসে আই-ডি অন্তর্ভুক্ত
করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু প্রচন্ড সমালোচনা শুরু হয় মিডিয়ায়। এগিয়ে আসে দেশের
প্রায় সত্তর হাজার বিজ্ঞানী এবং তাদের প্রতিনিধি ‘অস্ট্রেলিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স’।সৃষ্টিবাদ ও ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন
সম্পর্কে এক কড়া বিবৃতিতে অস্ট্রেলিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে
দেয় যে ‘Intelligent design is not science’ (www.science.org.au/policy/creation.html)।
ন্যাশনাল একাডেমিক প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘সায়েন্স এন্ড ক্রিয়েশানিজম’ বইটার [3] কথাও এখানে উল্লেখযোগ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সুবাদে অনেক মতবাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সাথে
আলোচনা করার সুযোগ হয় আমার। তাদের মধ্যে বিবর্তন তত্ত্বে বিশ্বাসীর সংখ্যা অনেক
বেশি। হতে পারে পদার্থ-বিজ্ঞানের মানুষ বলে এ ধরনের মানুষের সাথেই আমার আলাপ হয়
বেশি। তবুও এটা বলা যায় যে এদেশে গায়ের জোরের চেয়েও যুক্তির জোর প্রবল। সুস্থ
সমাজে এটাই তো কাম্য। ক্রমশ যুক্তিবাদী হয়ে উঠবে সারা পৃথিবীর মানুষ - এটাই আমার কামনা।
তথ্যসূত্র:
[1] Alice Alstone. Book of
Australian Facts. Sydney: Reader's Digest, 1992.
[2] Robyn Willams.
Unintelligent Design why god isn't as smart as she thinks she is,. Sydney:
Allen & Unwin, 2006.
[3] National Academy of
Sciences. Science and Creationism A view from the National Academy of
Sciences,. Washington DC,: National Academy Press, 1999.
No comments:
Post a Comment