১৯ জুন ২০০৯ ছিল বাংলাদেশের
জন্য একটি বিশেষ দিন। স্বাভাবিক নিয়মে ২৪ ঘন্টায় একদিন হয়। কিন্তু ১৯ জুনের
ব্যাপ্তিকাল ছিল ২৩ ঘন্টা। সেদিন স্বাভাবিক নিয়মে রাত বারোটা বাজেনি। রাত এগারোটা
বাজার সাথে সাথে ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা এগিয়ে বারোটায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এই
প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ ডে-লাইট সেভিং কান্ট্রির দলে যোগ দিয়েছিল।
ভাবতে আশ্চর্য লাগে কত সহজে
এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল এবং তা কত অল্প সময়ের মধ্যেই বাস্তবায়িত হয়ে
গিয়েছিল। পৃথিবীতে আরো যে ৭০টি দেশ দিনের আলো সংরক্ষণের জন্য বছরে দু’বার ঘড়ির সময় বদলায়-
সিদ্ধান্ত নিতে তাদের সবার সময় লেগেছিল বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। সে হিসেবে
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অন্য সব দেশের চেয়ে বেশি বলে
স্বীকার করতেই হয়।
আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায়
গণভোট ছাড়া এরকম সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা সরকারের হাতে নেই। অস্ট্রেলিয়ার ছয়টি
স্টেট আর দুটো টেরিটরির মধ্যে নিউ সাউথ ওয়েল্স, ভিক্টোরিয়া, সাউথ অস্ট্রেলিয়া আর তাসমানিয়া স্টেট আর অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটল
টেরিটরিতে ডে-লাইট সেভিং চালু আছে। গণভোটে“না” ভোটের আধিক্যের কারণে
কুইন্সল্যান্ড স্টেট ও নর্দান টেরিটরিতে ডে-লাইট সেভিং টাইম চালু করা যায়নি।
ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া স্টেটে ডে-লাইট সেভিং ইস্যুতে এ পর্যন্ত চারবার গণভোট
হয়েছে। ২০০৬ সালে পরীক্ষা মূলক ভাবে তিন বছরের জন্য ডে-লাইট সেভিং শুরু হয়। তিন
বছর দেখার পর গত মে মাসের ১৬ তারিখ আবার গণভোট হয় - ডে-লাইট সেভিং চালু থাকবে কি
না সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। শতকরা ৫৬ ভাগ ভোটার ডে-লাইট সেভিং এর বিপক্ষে ভোট দেন।
বলা হচ্ছে সেখানে অন্তঃত বিশ বছর আর ডে-লাইট সেভ করার চেষ্টা করা হবে না।
অস্ট্রেলিয়ার সরকারকে জনগণের বাধ্য থাকতে হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিকদের সেরকম
বাধ্য-বাধকতা নেই।
বাংলাদেশে যে উদ্দেশ্য নিয়ে
এ ব্যবস্থা চালু হয়েছিল তা প্রশ্নাতীত নয়। পুরো প্রক্রিয়াটির সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে
অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল, অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল, সময়ের
নানারকম গোলমালও হয়েছিল। বাংলাদেশের মত বিশাল জনসম্পদের একটি দেশে এরকম হওয়াটা খুব
স্বাভাবিক। যে উদ্দেশ্যে দিনের আলো কাজে লাগানোর এই পদ্ধতিটির প্রয়োগ করা হয়েছিল -
আশা করেছিলাম প্রয়োগ-পরবর্তী ফলাফল নিয়ে সব ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা হবে এবং
গবেষণার ফলাফল যথাসময়ে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু কোন গবেষণা হয়েছে কি না জানতে
পারিনি। আমাদের ডে-লাইট সেভিং নিয়ে “বাজনা” যত বেশি হয়েছিল - সে তুলনায় “খাজনা” অর্জিত হয়নি কিছুই। কারণ এ নিয়ে আমাদের হোম-ওয়ার্ক যথেষ্ট ছিল না।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে শীতকাল ও গরমকালের দিন-রাত্রির পার্থক্য খুব
বেশি নয়। চীন বা ভারতের মত বিশাল আয়তন ও জনগোষ্ঠীর দেশেও কিন্তু ডে-লাইট সেভিং
টাইম চালু করা হয়নি। জাপানের মত প্রযুক্তি-নির্ভর দেশেও ডে-লাইট সেভিং নেই।
ক্যালিফোর্নিয়ার ডে-লাইট সেভিং এর উপর অনেক গবেষণা করে দেখা গেছে যে - ডে-লাইট
সেভিং এর ফলে মোট শক্তি-সঞ্চয় কিন্তু তেমন একটা হয়নি। তারপরও বাংলাদেশে কী কারণে
ডে-লাইট সেভিং এর মতো একটি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল আমরা কেউ জানি না।
বাংলাদেশের সামগ্রিক
কর্মসংস্কৃতি এখনো তেমন সবল নয়। জাতি হিসেবে আমাদের নাগরিক-কর্তব্য সম্পর্কে আমরা
যথেষ্ট সচেতন নই। আলো বিদ্যুৎ গ্যাস এসব সঞ্চয়ে আমরা এখনো সচেষ্ট হতে শিখিনি।
গ্যাসের চুলায় মিটার না থাকার কারণে এখনো অনেকেই গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখেন।
বিদ্যুৎ চুরির কথাও বা বাদ দিই কীভাবে? সেখানে আমরা ঘড়ির
কাঁটা এগিয়ে পিছিয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে পারবো?
বাংলাদেশে দিনের আলো বাঁচানোর কর্মসূচি বা ডে লাইট সেভিং শেষ হয় ২০০৯ সালের
৩১ ডিসেম্বর। এরপর আর চেষ্টা করা হয়নি।
_______
১৯ জুন ২০১৮ || মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া ||
No comments:
Post a Comment