Tuesday, 26 June 2018

জাহানারা ইমাম




১৯৯৪ সালের ২৬শে জুন ভোরবেলা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন জাহানারা ইমাম। আমেরিকার ভোরবেলা - বাংলাদেশে তখন রাত। আমি খবরটি পাই ২৭শে জুন কলেজের কমনরুমে। ক্লাস করে এসে কমনরুমে ঢুকতেই একজন সিনিয়র কলিগ হাসতে হাসতে খবর দিলেন, "তোমার জাহান্নামের ইমাম তো জাহান্নামে গেছে।" কষ্ট লাগে যতটা আম্মার মৃত্যুর খবরে, তার চেয়েও বেশি তাঁর অসম্মানে। কলেজে যোগ দিয়েছি বেশিদিন হয়নি। যে মানুষটি আমার কাছে এভাবে সংবাদটি পরিবেশন করলেন তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ, কলেজে প্রায় সবাই সম্মান করেন তাঁকে। রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই হোক, জ্যেষ্ঠতার সম্মান আমি তাঁকে দিতাম। কিন্তু অনেক মানুষই তো অন্যকে অসম্মান করে নিজের সম্মান হারান। বাংলাদেশের যারা সেদিন জাহানারা ইমামকে সম্মান দেননি তাদের সবাই আমাদের স্বাধীনতাবিরোধী তাতে কারো কোন সন্দেহ আমার সেদিন ছিল না, এখনো নেই।

গণ-আদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের পর খালেদা জিয়ার সরকার জাহানারা ইমাম ও তাঁর সহযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা করেন। দেশদ্রোহিতার অভিযোগ মাথায় নিয়েই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে জাহানারা ইমামকে। এর চেয়ে বড় অপমান আর কী হতে পারে।

জাহানারা ইমামকে আমি একবারই দেখেছিলাম - ১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় গিয়েছিলাম শুধুমাত্র সেই সমাবেশে যোগে দেয়ার জন্য। না, আমি কোন নেতা নই, রাজনৈতিক কর্মীও নই, শুধুমাত্র সাধারণ একজন সেদিন জনতার আদালতের রায় শুনতে গিয়েছিলাম। আমার মতো আরো লক্ষ মানুষ সেদিন যোগ দিয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে। সমাবেশে মঞ্চে জাহানারা ইমামের পাশে ছিলেন শেখ হাসিনা ও সুফিয়া কামাল।


সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শেখ হাসিনা, সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম



সেদিন গণতদন্ত কমিশন অভিযুক্ত (১) আব্বাস আলী খান, (২) মতিউর রহমান নিজামী, (৩) মো. কামরুজ্জামান, (৪) আবদুল আলী, (৫) দেলোয়ার হোসেন সাইদী, (৬) মওলানা আবদুল মান্নান, (৭) আনোয়ার জাহিদ, ও (৮) আবদুল কাদের মোল্লা কে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে।

ততদিনে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর সমস্ত মুখগহ্বরে। চিকিৎসার জন্য আবার তাঁকে ফিরে যেতে হয়েছে আমেরিকায়। মৃত্যুর কিছুদিন আগে জাহানারা ইমাম আমেরিকায় ড. নূরুন নবীকে বলেছিলেন, "সুস্থ হলে অবশ্য দেশে ফিরব। কিন্তু যদি মরে যাই, তবে আমার মরদেহ বাংলাদেশে পাঠাবে না।" ......"এবার আমি ঢাকা ত্যাগ করেছি মনে অনেক কষ্ট নিয়ে। অনেক দুঃখ নিয়ে। যাদের নিয়ে এতদিন আন্দোলন করলাম, যাদেরকে জনগণ নেতা মানে, আদর্শিক এবং অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব মনে করে তাদের আসল চেহারা আমি দেখে এসেছি। এরা আমার সাথে বিশ্বাসভঙ্গ করেছে। বেইমানী করেছে, জনগণকে ধোকা দিয়েছে। আমার মরদেহ তোমরা ঢাকা পাঠাবে, আর এই সব দুমুখো নেতারা বিমানবন্দরে, জানাযায় আমার লাশ বহন করবে আর কাঁদবে। দেখাবে যে তারা আমাকে কত ভালোবাসে। টেলিভিশনে ও পত্রিকাতে ছবি উঠবে। আর বাহবা কুড়াবে। এদের এ দ্বৈতনীতি আমার আত্মাকে পীড়া দেবে। তুমি আমাকে কথা দাও, আমার মরদেহ যেভাবেই পার এখানে কবর দেবে।" ["আমেরিকায় জাহানারা ইমামের শেষ দিনগুলি, ড. নূরুন নবী, সময় প্রকাশন, ২০১৫। পৃষ্ঠা: ১১১-১১২]। এই দুমুখো নেতারা কি এখন সব সাধু হয়ে গেছেন?




সেই বছর ২২শে জুন খালেদা জিয়ার সরকার যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়। এই সংবাদ শোনার পর জাহানারা ইমাম জ্ঞান হারিয়েছিলেন। তার তিনদিন পরেই ২৬শে জুন ভোরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জাহানারা ইমাম। যে কাজ জাহানারা ইমাম শুরু করেছিলেন - যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের মাটিতে সম্পন্ন হচ্ছে। গণ-আদালতে যাদের বিচার হয়েছিল তাদের অনেকের বিচার হয়েছে দেশের আদালতে। শাস্তি হয়েছে তাদের অনেকের।

কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে শাস্তি দেয়া যেমন প্রয়োজনীয় - তেমনি দরকার এমন ব্যবস্থা করা যেন যুদ্ধাপরাধের মতো ঘৃণ্য অপরাধ করার সুযোগ যেন আর কেউ না পায়। আমরা যেন সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ পাই তার জন্য সমাজ গড়ার সংগ্রাম যে আরো অনেক কঠিন। তার দায়িত্ব তো আমাদের সবাইকে নিতে হবে। তবেই তো সত্যিকারের সম্মান জানানো হবে জাহানারা ইমামকে। 



No comments:

Post a Comment

Latest Post

Doesn't Rachi's death make us guilty?

  Afsana Karim Rachi began her university life with a heart full of dreams after passing a rigorous entrance exam. She was a student of the ...

Popular Posts