ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া তো দূরের কথা, অনেকের সময় বা ইচ্ছে কোনটাই হয় না ইতিহাস পড়ে দেখার। কিন্তু ভালো সিনেমা দেখেন অনেকেই। অস্কার পাওয়া 'গান্ধী' সিনেমাটি যারা দেখেছেন - তাদের একটা দৃশ্যের কথা মনে আছে নিশ্চয়। কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা থামানো যাচ্ছে না কিছুতেই, মহাত্মা গান্ধী কলকাতায় এসে অনশন শুরু করেছেন। দাঙ্গা বন্ধ না হলে তিনি অনশন ভাঙবেন না। সারা ভারতের কংগ্রেস নেতারা তাঁকে অনুরোধ করছেন অনশন ভাঙার। গান্ধীকে ভালোবাসে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ। যারা দাঙ্গা করছে তারাও। একজন হিন্দু দাঙ্গাবাজ গান্ধীর কাছে এসে স্বীকার করে যে তার সন্তানের হত্যার বদলা নিতে একটি মুসলমান ছেলেকে হত্যা করেছে। গান্ধী তাকে পরামর্শ দেন একটা মুসলমান ছেলে খুঁজে বের করতে যার মা-বাবাকে হিন্দু দাঙ্গাবাজরা খুন করেছে। তারপর সেই ছেলেকে দত্তক নিয়ে যেন নিজের সন্তানের মত মানুষ করে।
গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসী মহাত্মা গান্ধী মানবিকতার পরম আদর্শ হতে পেরেছিলেন। সিনেমার সেই দাঙ্গাবাজ হিন্দুটি একটি মুসলমান ছেলেকে নিজের ছেলের মত মানুষ করেছিলেন কি না আমরা জানি না। কিন্তু আমরা সম্প্রতি জানলাম ভারতের হায়দরাবাদে হিন্দু দম্পতি পাপালাল রবিকান্ত ও জয়শ্রী দেবী একটি অনাথ মুসলমান মেয়েকে নিজেদের সন্তানের মত মানুষ করছেন গত বারো বছর ধরে।
২০০৭ সালে হায়দরাবাদের গোকুল চাট ভান্ডার রেস্টুরেন্টে এবং লুম্বিনি পার্কে পরপর দুটো বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উগ্রবাদী ধর্মীয় জঙ্গিরা ৪২জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে সদ্য মা-বাবা হারা দু'বছরের ছোট্ট মেয়েটি আকুল হয়ে কাঁদছিল। হয়তো সে ছিল তার মা-বাবার প্রথম সন্তান, আদরের ধন। মেয়েকে সাথে নিয়ে এসেছিল রেস্টুরেন্টে। মেয়েটি জানেই না তার মা-বাবার কী হয়েছে, কেন হয়েছে। কাঁদা ছাড়া আর কিছু তো সে করতে পারে না। এই মেয়েটিকে হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিয়েছিলেন পাপালাল ও জয়শ্রী দম্পতি। তারপর অনেক খুঁজেছেন শিশুটির মা-বাবাকে পাওয়া যায় কি না। পাওয়া যায়নি। নিঃসন্তান পাপালাল ও জয়শ্রী হয়ে ওঠেন শিশুটির বাবা-মা। দত্তক নেন তাকে। নাম রাখেন সোনিয়া। সোনিয়া জন্মসূত্রে হিন্দু কি মুসলিম তাতে কিছুই যায় আসেনি কারো। বুকে পিঠে মানুষ করছেন সোনিয়াকে। পড়াচ্ছেন ভালো প্রাইভেট স্কুলে। কিন্তু এত সুখ কি সহ্য করা যায়? উগ্র হিন্দুত্ববাদ জেগে ওঠে প্রতিবেশীর মনে।
হায়দরাবাদ শহর -যেটা ভারতের আধুনিক শহরগুলোর মধ্যে একটি, সেখানে সঙ্গবদ্ধ হয়ে হিন্দুবাদীরা একজন মুসলমানের মেয়েকে দত্তক নিয়ে মানুষ করার অপরাধে পরপর ১৬বার ছুরি মারে পাপালাল রবিকান্তকে। ধর্ম কি মানুষকে অন্ধ করে দেয়? এ কেমন ধর্ম - যেটা মানুষের মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দেয় এমন ঘৃণার বিষ? এই ঘৃণা থেকেই তারা হত্যা করেছিল মহাত্মা গান্ধীকে - সেই ১৯৪৮ সালে। সেই ঘৃণার ধারা এখনো বয়ে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম - ধর্মের নামে। এ কেমন ধর্ম তোমরা পালন করছো - হে মানুষ? সোনিয়ার মা এত আঘাতের পরেও যখন প্রশ্ন করেন, "আমরা সকলেই মানুষ। একই রক্ত বইছে সকলের শরীরে। আমাদের যদি কোন সমস্যা না থাকে, তাহলে সমাজ প্রশ্ন তোলার কে?"
এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?
No comments:
Post a Comment