গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড
কার্যকর করা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ সালে। সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল
যে সক্রেটিস যুবকদের বিপথগামী করে তুলছেন। সক্রেটিসের বয়স তখন ৭০। সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ
এনেছিলেন তিনজন। একজন মধ্যম মানের কবি - মেলাটাস, একজন বুদ্ধিজীবী - লাইকন, আর
তৃতীয়জন ছিলেন একজন রাজনৈতিক নেতা - আনিটাস।
বোঝাই
যাচ্ছে যে কবি, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা - অর্থাৎ যারা সমাজের গণ্যমান্য লোক
তাদের সবার রাগ ছিল সক্রেটিসের ওপর। কিন্তু সক্রেটিসের অপরাধ কী ছিল? কী করেছিলেন
তিনি?
সক্রেটিসের
সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল তিনি সত্যি কথা বলেছিলেন।
রাজনৈতিক
নেতা আনিটাসের তরুণ ছেলে সক্রেটিসের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জ্ঞানবিজ্ঞান নিয়ে
থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু তার বাবা তাকে জোর করে মিলিটারিতে পাঠানোর পরিকল্পনা করলে সক্রেটিস
রাজনৈতিক নেতাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ছেলেটিকে যেন আরো লেখাপড়া করায়, মিলিটারিতে না
পাঠায়। কিন্তু আনিটাস তা না মেনে ছেলেকে জোর করে পাঠিয়ে দেন সৈনিক দলে। কিন্তু ছেলেটি
সৈনিক দলে গিয়ে ভীষণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। পরে মাতাল হয়ে সম্পূর্ণ বখে যায়। আনিটাসের সমস্ত রাগ
গিয়ে পড়ে সক্রেটিসের উপর। রাজনৈতিক নেতা তো - তাই নিজেরা কখনো কোন ভুল স্বীকার করেন না,
দায়িত্বও নেন না। আনিটাস তাঁর ছেলের বখে যাওয়ার জন্য দায়ী করলেন সক্রেটিসকে - সক্রেটিস
চিন্তার স্বাধীনতার কথা বলে তাঁর ছেলের মাথা খেয়েছেন।
কবির
কেন রাগ? রাগের যথেষ্ট কারণ ছিল - কারণ সক্রেটিস প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে কবিরা
কোন কিছু জানেন বলে লেখেন না - জানাতে হবে বলে লেখেন। তাঁদের বোধ বুদ্ধি আবেগ
সবকিছু আসে খ্যাতির মোহ থেকে। কবিরা
নিজেদের কবিতার অর্থ নিজেরাই করতে পারেন না। যারা যত বেশি খ্যাতিমান, তাঁরা তত অল্প
জানেন। মুখের ওপর এরকম কথা শুনতে কোন্ কবির ভালো লাগে?
বুদ্ধিজীবীর
রাগ কেন? বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী বক্তৃতা দেন কিছু না জেনেই। সারাক্ষণই জাহির করেন
আমি এই জানি, সেই জানি, আমার সব জানা আছে, ইত্যাদি। সক্রেটিস তাদেরকে বুঝিয়ে
দিয়েছিলেন যে তারা কিছুই জানেন না। জ্ঞানের লড়াইয়ে হেরে গেলে লোকে রেগে যায়। বুদ্ধিজীবীদের
রাগ তো আরো বেশি।
সেই
সময় সক্রেটিসের বিচার হয়েছিল অদ্ভুতভাবে। পাঁচ শ জন জুরি। সক্রেটিস আত্মপক্ষ
সমর্থনে শুধু এটুকু বলেছিলেন যে তিনি কখনোই কোন কিছু জানেন বলে দাবি করেননি। তিনি
শুধু এটুকু জানেন যে তিনি কিছুই জানেন না। আমরা কি তাদের বুদ্ধিজীবী বলতে পারি যারা বুদ্ধি
বেচে জীবন চালায়? জ্ঞানী আমরা কাকে বলবো?
যারা জ্ঞানের বড়াই করেন তাদের? নাকি যারা যতই জানতে থাকেন - ততই বুঝতে পারেন যে কত
কম জানেন তিনি! সক্রেটিস বিচারককেও বলেছিলেন, "আমি শুধু এটুকু জানি যে আমি
কিছুই জানি না। আর আপনার সেই জ্ঞানটুকুও নেই।"
বিচারে
সক্রেটিসকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ৫০০ জন জুরির মধ্যে ২৮০ জন মনে করেছেন সক্রেটিস
দোষী, ২২০ জন মনে করেছেন নির্দোষ। সেই সময় দোষী সাব্যস্ত হবার পর শাস্তির ব্যাপারে
আসামীকে জিজ্ঞেস করা হতো - মৃত্যুদন্ড নাকি নির্বাসন? দোষী ব্যক্তি নিজেই ঠিক করতে
পারতেন তিনি এই দুটোর মধ্যে কোন্টা চান। সক্রেটিস নিজেকে দোষী ভাবেননি একবারও। তাঁকে
জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, "আমি তো নিজেকে দোষী ভাবি না। তাই মৃত্যুদন্ড বা
নির্বাসন কোনটাই আমি চাই না। আমি চাই আমাকে নাগরিক সম্বর্ধনা দেয়া হোক।"
সেন্স
অব হিউমার জুরিদের ছিলই না। তাঁরা ভাবলেন সক্রেটিস তাদের ব্যঙ্গ করেছেন। যে ২২০ জন
জুরি তাঁকে নির্দোষ বলে রায় দিয়েছিলেন, সেখান থেকেও ৫০ জন চলে গেলেন অন্য দলে।
এবার ৩৩০ জন জুরি একজোট হয়ে শাস্তি দিলেন মৃত্যুদন্ড।
মৃত্যুর
আগে হেমলক বিষ পান করানো হয়েছিল সক্রেটিসকে। নিজের ইচ্ছায় আগ্রহের সাথে বিষ পান
করেছিলেন সক্রেটিস। পালিয়ে যাবার সুযোগ ছিল। কিন্তু পালাননি। দেশের আইনের প্রতি
বিচারের প্রতি আনুগত্য ছিল তাঁর। হেমলক বিষ পান করার পর কয়েক ঘন্টা সময় লাগে
মৃত্যু হতে। সক্রেটিস মৃত্যুর জন্য শান্তভাবে অপেক্ষা করেছেন। কবরে শোয়ানোর জন্য নিজের
পোশাকপরিচ্ছদ ঠিক করে নিয়েছেন। আর মৃত্যু আসার ঠিক আগের মুহূর্তে মনে করে দেখেছেন
কোথাও কোন ঋণ আছে কিনা তার। ছেলেকে ডেকে বলেছেন প্রতিবেশীর কাছ থেকে একটা মুরগি
নিয়েছিলেন তা এখনো শোধ করা হয়নি। ছেলে যেন তা শোধ করে দেয়।
সক্রেটিস
বলেছিলেন, কোন মানুষকে হত্যা করা - ঘুম থেকে উঠে একটি মাছি মেরে আবার ঘুমিয়ে পড়া
নয়। কিন্তু সক্রেটিসের মৃত্যুর প্রায় ২৪০০ বছর পরেও সাধারণ মানুষকে মশা মাছির মতো
মনে করে অনেক ক্ষমতাশালী মানুষ। এ যুগের কবি, বুদ্ধিজীবী কিংবা রাজনৈতিক নেতারাও
কি হাসিমুখে বসে থাকবেন - যদি কোন সক্রেটিস তাঁদের মুখের উপর বলেন, 'আপনি যে কিছুই
জানেন না সেটাও আপনি জানেন না'?
স্যার আদাব, একটা জিনিষ এখনো বুঝে উঠতে পারিনি যে, 'Know thyself' অর্থাৎ নিজেকে জানো। এ জানাটা নিজেকে কিভাবে জানা? একটু জানাবেন কি? খুব উপকার হতো...
ReplyDeleteনিজেকে জানা বলতে আমি যেটুকু বুঝি সেটা হচ্ছে নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ধারণা থাকা। মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতা জানলে অন্যের সমালোচনা করার আগে নিজের দিকে তাকাবে।
Delete