কমরেড জসীমউদ্দীন মন্ডলের
"সংগ্রামী স্মৃতিকথা" 'জীবনের রেলগাড়ি' প্রকাশিত হয়েছে ২০১২ সালে জাতীয়
সাহিত্য প্রকাশনী থেকে। একজন সংগ্রামী শ্রমিক নেতা যখন ৮৮ বছর বয়সে স্মৃতিকথা
লেখেন, তখন পাঠক সাধারণত আশা করেন যে ইতিহাসের একটা সময় সেখানে ধরা থাকবে
বিশ্বাসযোগ্যভাবে। সেই ইতিহাস যে লেখকের ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হবে সেটাও
পাঠক জানেন। তবুও পাঠক আগ্রহ নিয়ে সে লেখা পড়েন - লেখকের হাত ধরে সময়-ভ্রমণ করার
জন্য।
একজন
সাধারণ পাঠক হিসেবে আগ্রহ নিয়ে আমি বইটি পড়েছি কমরেড জসীমউদ্দীন মন্ডল তাঁর
সংগ্রামী স্মৃতিগুলোকে কীভাবে স্মরণ করেছেন, ব্যাখ্যা করেছেন এবং কী দৃষ্টিকোণ
থেকে তিনি জীবনকে দেখেছেন তা জানার জন্য। ১৯২৪ থেকে ২০১২ - ৮৮ বছরের দীর্ঘ জীবনে
তিনি সংগ্রাম করেছেন ব্রিটিশ সরকারের সময়, তারপর পাকিস্তান, তারপর বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের জন্ম থেকে বর্তমান পর্যন্ত তিনি রাজনৈতিক ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করেছেন
একজন অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। তাই তাঁর স্মৃতিকথা - শুধু স্মৃতিকথা নয়
কিছুতেই - এটা ইতিহাসের প্রতিফলক হবারও দাবিদার ছিল।
মাত্র
১৬ বছর বয়সে রেলগাড়িতে উঠেছেন জসীমউদ্দীন রেলইঞ্জিনে কয়লা ঢালার শ্রমিক হিসেবে। সেই সময় - ১৯৪০ সালে মাইকিং করে
রেলওয়ের শ্রমিক নিয়োগ করা হতো। কর্মসংস্থানের সুযোগ এখনকার তুলনায় অনেক সহজ ছিল
বলা চলে। শিয়ালদহ স্টেশনে গোরা সাহেবের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়ে কাজ পেয়ে গেলেন তিনি।
মাসিক বেতন ১৫ টাকা। আর বেতন পাবার দিন থেকেই 'লাল ঝান্ডা' পার্টি তাঁর কাছ থেকে
আদায় করে নিয়েছে এক টাকা চাঁদা। হিসেব করে দেখুন বেতনের শতকরা প্রায় সাড়ে ছয় ভাগ
পার্টির চাঁদা দিতে হয়েছে সেই ১৯৪০ সালে।
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থন করেছিল জার্মানি আর
জাপানকে। জাপান যখন এশিয়ায় আগ্রাসন চালাচ্ছিল - এমনকি বার্মা পর্যন্ত দখল করে
নিয়েছিল তখনো পার্টি সমর্থন করছে জাপানকে, জার্মানির হিটলারকে। সেটা শুধুমাত্র
তখনই বদলালো যখন হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করলো।
তারপর
১৯৪৭। দেশ ভাগের পর জসীমউদ্দীন পূর্ব-পাকিস্তানে চলে আসেন রেলওয়ের চাকরির অপশন
নিয়ে। ইংরেজ চলে গেলেও তখনো ইংরেজ কর্মকর্তা কাজ করছিলেন পাকিস্তানের অনেক জায়গায়।
রেলের অনেক ড্রাইভারও ছিলেন ইংরেজ। এই ইংরেজ ড্রাইভারদের বেতন দেয়া হতো ইওরোপিয়ান
গ্রেডে। সেই সময় ১৯৪৯ সালেই রেলওয়ে শ্রমিক থেকে শ্রমিকদের নেতা হয়ে ওঠেন
জসীমউদ্দীন। শুরুটা খুবই ব্যক্তিগত লাভক্ষতির হিসেব থেকে। ১৯৪৯ সাল। দুর্ভিক্ষের
আলামত দেখা দিয়েছে। পাকিস্তান সরকার এক জেলা থেকে অন্য জেলায় খাদ্য-চলাচল নিষিদ্ধ
করে দিয়েছে। ফলে চালের অভাব। ট্রেন-ইঞ্জিনের শ্রমিক হিসেবে জসীমউদ্দীন এক জেলা
থেকে অন্য জেলায় যান ট্রেন নিয়ে। আনমুরা থেকে তিনি চাল কিনে নিয়ে আসতেন ঈশ্বরদীতে।
কাজটা ছিল বেআইনী। একদিন এরকম তিন মণ চাল রেলের ইঞ্জিনে করে নিয়ে আসার সময় সরকারের
মিলিশিয়া বাহিনী সেই চাল জব্দ করে নিয়ে যায়। জসীমউদ্দীন মন্ডলের নেতৃত্বে রেলওয়ে
শ্রমিকেরা ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়। দাবি আদায় হয়। চাল ফেরত দেয়া হয়। শুধু তাই নয়
- রেলওয়ে শ্রমিকেরা এক জেলা থেকে অন্য জেলায় চাল নিয়ে যেতে পারবে সেই অনুমতিও দেয়া
হয়। জসীমউদ্দীন মন্ডল নেতা হয়ে যান।
তারপর
এই কাজের জন্য তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়। কিন্তু তাতে তাঁর কিছু সমস্যা হয়নি। তাঁর যে
চাল নিয়ে আসার পারমিট ছিল সেটা ব্যবহার করে তিনি চালের ব্যবসা শুরু করেন। ট্রেনে
করে চাল নিয়ে আসেন বিভিন্ন জেলা থেকে এবং
তা বেশি দামে বিক্রি করেন দুর্ভিক্ষের বাজারে। এবং তখনো তিনি শ্রমিক নেতা।
১৯৪৯
সালে তিনি খুদ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এই খুদ আন্দোলন হয়েছিল রেলওয়ে শ্রমিকদের
চালের বদলে খুদ দেয়াকে কেন্দ্র করে। রেলওয়ে শ্রমিকেরা মুরগি নয়, তারা খুদ খাবে না।
তাদের চাল দিতে হবে। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার অপরাধে তাঁর নামে হুলিয়া বের হয়।
তিনি পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন অনেকদিন। তাঁকে সহায়তা করেছেন পার্টির কর্মীরা।
একদিন ধরা পড়েন। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত পাঁচ বছর জেলে ছিলেন তিনি। ১৯৪৯ সালে তাঁর
চাকরি চলে যায়। তারপর থেকে ধরতে গেলে তিনি পার্টির মাসোহারাতেই চলেছেন। তিনি
শ্রমিক না হয়েও শ্রমিকনেতা ছিলেন এবং পার্টির নির্দেশে শ্রমিক সংগঠন করে গেছেন।
বাংলাদেশের
স্বাধীনতা আন্দোলন তিনি দেখেছেন খুব কাছ থেকে। এত বড় শ্রমিক নেতা - দেশের
স্বাধীনতার আন্দোলন চলছে - সেখানে সম্পৃক্ত হননি সেভাবে এটা খুবই আশ্চর্যের। আসলে
সেই সময় কমিউনিস্ট পার্টির মূল উদ্দেশ্য কী ছিল তা কোথাও তিনি পরিষ্কার করে
লেখেননি। সেই ১৯৫২ থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যে বর্ণনা কমরেড জসীমউদ্দীন
দিয়েছেন তা এতটাই বিক্ষিপ্ত আর এতটাই পার্টি নির্দেশিত যে তা পড়ে খুবই হতাশ হতে
হয়। জ্যোতিবসুর কথা তিনি লিখেছেন বার বার। মৌলানা ভাসানীর কথা লিখেছেন বার বার।
আক্ষরিক অর্থেই তিনি মৌলানা ভাসানীর পা টিপেছেন তাও লিখেছেন, আইয়ুব খানের কথা
লিখেছেন, ফাতেমা জিন্নাহ্র কথা লিখেছেন, অথচ একটি বারের জন্যও শেখ মুজিব বা
বঙ্গবন্ধু শব্দটি উচ্চারণ করেননি। যেন সেই মানুষটি কখনোই ছিল না তাঁর
"সংগ্রামী" সময়ে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় চলে
গিয়েছিলেন। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুদের আতিথ্যে বেশ আরামেই
ছিলেন। স্বাধীনতার পর যথাসময়ে ফিরেও এসেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে। কিন্তু একটি বারও
বঙ্গবন্ধুর নাম না নিয়ে, একটি বারের জন্যও মুক্তিযোদ্ধাদের কথা উচ্চারণ না করে
"সংগ্রামী স্মৃতিকথা" লেখা চাট্টিখানি কথা নয়। কমরেড জসীমউদ্দীন মন্ডল
আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের একবারের জন্যও মুক্তিযোদ্ধা না বলে বলেছেন "প্রতিরোধ
বাহিনী"। এটাই যদি তাঁর পার্টির আদেশ হয়ে থাকে - তাহলে বইতে
"মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো" অধ্যায়টি না থাকলেই মনে হয় ভালো হতো।
স্বাধীন বাংলাদেশে এসে তিনি একবার
মস্কোও গিয়েছিলেন। সেই বর্ণনাও আছে। তাঁর নিজের ছেলে যে বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়ে
চোরাচালানী হয়েছে এবং সে কারণে তিনি তার ছেলের সাথে কোন সম্পর্ক রাখেননি তাও আছে।
কমরেড জসীমউদ্দীন মন্ডল আজীবন পার্টির হুকুম তামিল করে গেছেন অন্ধ আনুগত্যে। বইয়ের
শেষের দিকে তিনি ঠিকই লিখেছেন, "সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের শেষ প্রান্তে এসে
জীবনের পাওয়া-না-পাওয়ার হিসেব মেলাতে গিয়ে দেখি, পাওয়ার পাল্লাটি শূন্য। বঞ্চনার
পাল্লাটি ভারি হয়ে আছে বেশি। তবুও হতাশ হতে মন চায় না। এ যেনো এক কঠিন নেশা,
সুতীব্র আকর্ষণ, যা উপেক্ষা করে থাকা কখনো সম্ভব নয়।" - এখানেই সমস্যা আমার
মতো সাধারণ পাঠকের। যারা মনে করে কঠিন নেশা মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে তোলে, বিপজ্জনক
করে তোলে। সেটা যদি রাজনৈতিক নেশা হয় -
তাহলে তো আরো বিপজ্জনক।
এই প্রতিবেদন টি ভুলেভরা
ReplyDeleteপড়ার জন্য ধন্যবাদ।
Delete