Sunday, 30 September 2018

আইরিন কুরি ।। সপ্তম পর্ব



 পরদিন সকালে নাস্তা করার সময় মাকে বললেন আইরিন, “মি, আমি এন্‌গেজড।”
চমকে উঠলেন মাদাম কুরি - “হোয়াট?”
“আমি এন্‌গেজড। আমার বয়স এই সেপ্টেম্বরে আটাশ হবে। আমার এখন বিয়ে করা উচিত। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আমি এন্‌গেজড হয়েছি।”
“কার সাথে?”
“মঁসিয়ে জুলিও”
“ফ্রেডেরিক জুলিও? কিন্তু তার তো কোন ডিগ্রি নেই। একজন ল্যাব-অ্যাসিস্ট্যান্টের বউ হয়ে জীবন কাটাবি?”
“আমি তো তার ডিগ্রিকে বিয়ে করবো না মি। তাছাড়া এখন তার ডিগ্রি নেই, ডিগ্রি হবে। সে তার গ্র্যাজুয়েশানের প্রস্তুতি নিচ্ছে।”
“ভালো” - বলে চুপ করে গেলেন মাদাম। তাঁর চোখেমুখে হতাশার চিহ্ন খেয়াল করলেন না আইরিন।

মাদাম কুরি কাউকে কিছু না বললেও ফ্রেড আর আইরিনের সম্পর্ক নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে। ফ্রেডের চেয়ে শিক্ষায় পদমর্যাদায় সিনিয়র অনেকেই আছেন সেখানে। তাঁরা ফ্রেডের ভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে বলাবলি করতে লাগলো - ফ্রেড রাজকন্যা আর রাজত্ব দুটোই দখল করার জন্য ইনস্টিটিউটে এসেছেন। আইরিনের এসবে কিছু এসে যায় না। কিন্তু ফ্রেড কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েন যখন সহকর্মীরা তাঁর পিঠ চাপড়ে দেন। 

ফ্রেড নিজেকে সবদিক দিয়েই আইরিনের যোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকেন। ১৯২৫ সালের জুলাই মাসে সরবোন ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ফ্রেড। 

গবেষণাগারে আইরিন ও ফ্রেড

১৯২৬ সালে বিয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন ফ্রেড ও আইরিন। জুন মাসের পাঁচ তারিখ ফ্রেডের মা মাদাম কুরির সাথে দেখা করলেন। মাদাম খুবই আন্তরিক ব্যবহার করলেন মাদাম জুলিওর সাথে। জুনের বিশ তারিখ আইরিন গেলেন ফ্রেডদের বাসায় সবার সাথে লাঞ্চ করতে। ফ্রেডের বাড়ির সবাই খুব পছন্দ করলেন আইরিনকে। আইরিন কারো সাথে তেমন কোন কথা না বললেও তাঁর আন্তরিক সোজাসাপ্টা আচরণে সবাই বেশ খুশি হলেন। 

২৪শে জুন কুরি পরিবার আর জুলিও পরিবার একসাথে ডিনারে গেলো। ফ্রেডকে খুবই পছন্দ হলো ইভের। তার মনে হলো আইরিনের শুষ্ক নীরস সাদাকালো জীবনের ক্যানভাস রঙে রঙে ভরিয়ে দিতে পারবেন ফ্রেড। কিন্তু মাদামের গাম্ভীর্য আইরিনের চোখে না পড়লেও ইভের চোখ এড়ালো না। 

লা’কোয়েস্টে প্রতিবছর সামারে ছুটি কাটাতে যান আইরিন ও ইভ। এ’বছর ইভের বদলে ফ্রেডকে সাথে নিয়ে গেলেন আইরিন। লা’কোয়েস্টের ফিশিং বোটে ইচ্ছেমতো মাছ ধরলেন ফ্রেড। লা’কোয়েস্টের প্রায় প্রত্যেকের সাথেই পরিচয় হয়ে গেলো ফ্রেডের। জেলেদের সাথে তো রীতিমত বন্ধুত্ব হয়ে গেলো তাঁর। 

আইরিন তাঁর বিয়ের তারিখের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। লা’কোয়েস্ট থেকে প্যারিসে মাকে চিঠি লিখলেন আইরিন, “মি, আমাদের বিয়ের তারিখ এখনো তুমি ঠিক করে দাওনি। তোমার কোপেনহ্যাগেনে যাবার আগে বিয়েটা হয়ে গেলে ভালো হয়। কোপেনহ্যাগেন থেকে তোমার ফিরে আসার পরে হলে হয়তো আরো ভালো হতো, কিন্তু তখন ইনস্টিটিউটে পরীক্ষা চলবে। আমার মনে হয় অক্টোবরের নয় তারিখে বিয়ে হলে সবদিক দিয়ে ভালো হয়। তুমি তাড়াতাড়ি তোমার মত জানাও। আমি সেই মত টাউন হল বুকিং দেবো।” 

আইরিনের কথামতোই সবকিছু ঠিক হলো। ১৯২৬ সালের ৯ই অক্টোবর দুপুরে বিয়ে হয়ে গেলো আইরিন কুরি ও ফ্রেডেরিক জুলিওর। খুবই অনানুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হবার কথা থাকলেও দেখতে দেখতে বেশ বড় অনুষ্ঠান হয়ে গেলো। জুলিও পরিবারের সবাই, কুরি পরিবারের সবাই, সহকর্মী বিজ্ঞানীরা, সিটি মেয়র সহ বড় বড় সরকারি অফিসারের অনেকেই বিয়েতে এসেছিলেন। লাঞ্চের পর ফ্রেড আইরিনের সাথে আইরিনদের বাসায় গেলেন। তারপর সব অতিথিরা চলে গেলে নিজেও চলে গেলেন তাঁর নিজের বাসায়। আইরিন রয়ে গেলেন তাঁর মি’র সাথে। 

পরদিন সকালে ইভকে নিয়ে মাদাম কুরি চলে গেলেন কোপেনহ্যাগেনে। ফ্রেড চলে এলেন আইরিনের বাড়িতে। সেখানেই শুরু হলো তাঁদের দাম্পত্য জীবন। বিয়ের প্রথম কয়েক মাস ফ্রেড ও আইরিন মাদাম কুরির বাসাতেই ছিলেন। 

ফ্রেড ও আইরিন

আইরিনের বিয়ের পর মাদাম বেশ গম্ভীর হয়ে গেছেন। ফ্রেডকে তিনি সহজে মেনে নিতে পারছেন না। আইরিনকে মাদাম বলেছেন ম্যারেজ অ্যাগ্রিমেন্ট করিয়ে নিতে - কারণ তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না ফ্রেডের সাথে আইরিনের বিয়ে টিকবে। 

পুরুষ-শাসিত ফ্রান্সের আইন অনুযায়ী স্ত্রীর সমস্ত সম্পদ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকে স্বামীর হাতে। মেরির ধারণা ফ্রেড আইরিনকে ছিনিয়ে নিয়েছেন তাঁর নিজের কাছ থেকে। স্বামীর মৃত্যুর পর ক্রমে ক্রমে আইরিন হয়ে উঠেছিলেন তাঁর অবলম্বন। কিন্তু মাদামের মনে হচ্ছে ফ্রেডের সাথে পরিচয়ের পর থেকে আইরিন ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। অভিমানে মাদাম কতগুলো ছেলেমানুষী কাজ করতে শুরু করলেন। 

যেমন একদিন আমেরিকা থেকে কয়েকজন বিজ্ঞানী এসেছেন রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে। মাদাম তাঁদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ইনস্টিটিউটের গবেষক ও অ্যাসিস্ট্যান্টদের সবাইকে মিটিং রুমে ডাকলেন। সবাই এসে পাশাপাশি দাঁড়ালেন। মাদাম একে একে পরিচয় দিচ্ছিলেন - “ইনি ডক্টর লুইস - আমাদের ল্যাব টু’র ডিরেক্টর, ইনি ডক্টর সল্‌সবেরি - মাস্টার্স প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর, ইনি ডক্টর কুরি - রিসার্চ ইনচার্জ, ইনি মঁসিয়ে টেপার, ….” এভাবে যখন ফ্রেডের নাম বলার পালা এলো তখন এমন ভাব করলেন যেন ফ্রেডকে দেখতেও পাননি। ফ্রেডকে বাদ দিয়ে পরের জনের পরিচয় দিতে শুরু করলেন। কিন্তু ফ্রেডের উজ্জ্বল উপস্থিতি ভিজিটরদের চোখ এড়ায় না। যখন তাঁরা মাদামকে ফ্রেড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন - মাদাম দায়সারা ভাবে জবাব দেন - “ওই লোকটা? আইরিন ওই লোকটাকে বিয়ে করেছে”। 

কিন্তু মাদামের অভিমান চোখেই পড়ছে না আইরিনের। তিনি তাঁর স্বামীর সাথে নতুন জীবন নিয়ে ব্যস্ত। স্বামীর জন্য রান্না করতে গিয়ে আইরিন আবিষ্কার করলেন তিনি এত কিছু শিখেছেন জীবনে - কিন্তু রান্না শিখতে ভুলে গেছেন। তবে কোন সমস্যা নেই। দেখা গেলো ফ্রেড চমৎকার রান্না করেন। অবশ্য রান্না করার সময় রান্নাঘর এত  অগোছালো করে ফেলেন যে অস্বস্তি লাগে। রান্না শেষে ফ্রেড ভয়ে ভয়ে গোছানোর চেষ্টা করেন। আইরিনের খুব মজা লাগে এসব দেখে। রান্নাঘর থেকে মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে হাসির শব্দ শোনা যেতে লাগলো যা এই বাসায় আগে কখনো শোনা যায়নি। ইভ বাসায় থাকলে সেও যোগ দেয় তাদের সাথে। কিন্তু মাদাম একেবারেই একা হয়ে গেলেন।   

কয়েক মাস পর মাদাম আইরিনের হাতে একটা অ্যাপার্টমেন্টের চাবি তুলে দিলেন বিয়ের উপহার হিসেবে। তাঁদের বর্তমান বাসা থেকে কাছেই সরবোন অ্যানেক্সে একটা ছয়তলা ভবন কিনেছিলেন মাদাম কুরি, জাঁ পেরি আর ফ্রান্সিস বোরেল - এই তিন বন্ধু মিলে। প্রতি তলায় একটা করে অ্যাপার্টমেন্ট। তিন তলায় পাঁচ রুমের বিশাল অ্যাপার্টমেন্টে উঠে গেলেন আইরিন ও ফ্রেড। ছয় তলায় আইরিনের ছোটবেলার বন্ধু আলিনও থাকেন তাঁর স্বামী ও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে। বেশ ভালোভাবেই শুরু হলো আইরিন ও ফ্রেডের সংসার। 

কিন্তু বিজ্ঞান-সমাজে ফ্রেডের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সমস্যা দেখা দিলো। আইরিন ইতোমধ্যেই বিজ্ঞানী হিসেবে অনেকদূর এগিয়ে গেছেন। অনেকগুলো গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়ে গেছে তাঁর। কিন্তু ফ্রেড এখনো মাস্টার্সও পাস করেননি। অনেকেই প্রকাশ্যে বলাবলি করতে লাগলো এই বিয়ে ফ্রেডের ওপরে উঠার সিঁড়ি,  ক্যারিয়ার বাগানোর জন্য আইরিনকে বিয়ে করেছেন ফ্রেড। 

ফ্রেড রেগে যান এসব শুনে। বিয়ের পরেও আইরিন ‘কুরি’ নামে তাঁর পেপার প্রকাশ করতে থাকেন। মিডিয়াতে এই জুটি জুলিও-কুরি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আইরিনের সাথে কথা বলে ফ্রেড নিজের পদবীর সাথে স্ত্রীর পদবী লাগিয়ে ‘জুলিও-কুরি’ হয়ে যান। 

মায়ের কাছ থেকে আলাদা থাকতে শুরু করার পর মাদাম কুরির মনের অবস্থা বুঝতে পারেন ফ্রেড। তিনি আইরিনকে বোঝান - “আমাদের কিন্তু প্রতিদিনই একবার মাদামের বাসায় যাওয়া উচিত, তাঁর সাথে ডিনার করা উচিত।”
“মি কি সেটা পছন্দ করবেন?”
“তুমি কি মি’র পছন্দ অপছন্দ বুঝতে পারো? তুমি কি বুঝতে পারছো যে তিনি এখন কতটা একা হয়ে গেছেন? তিনি ভাবছেন আমি তোমাকে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে এসেছি। তোমার উচিত তাঁকে বুঝিয়ে দেয়া যে এখনো তুমি তাঁরই আছো। তাঁর মেয়ে পর হয়ে যায়নি বরং মেয়ের মাধ্যমে তিনি একটা ছেলে পেয়েছেন।”
“সেটা তো ঠিকই, কিন্তু তাঁকে বোঝাতে হবে কেন? মি পৃথিবীর এত কঠিন কঠিন জিনিস বোঝেন, আর এই ব্যাপারটা বোঝেন না?”
“স্নেহ ভালোবাসার ব্যাপারটা হলো অনেকটা সঙ্গীতের মতো। শুধু মনে মনে গুনগুন করলে হয় না, মাঝে মাঝে গলা ছেড়ে গাইতে হয়।”

আইরিনও ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। ফ্রেডের কাছ থেকে অনেক মানবিক ব্যাপার শিখছেন আইরিন যা আগে তাঁর চোখেও পড়তো না। সপ্তাহের মধ্যে বেশ কয়েকদিনই মেরির সাথে ডিনার করেন ফ্রেড ও আইরিন। আস্তে আস্তে মেরি সহজ হতে থাকেন ফ্রেডের সাথে। 

১৯২৭ সালে ফ্রেড সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বছর তাঁদের প্রথম সন্তান হেলেনের জন্ম হয়। নাতনির মুখ দেখার পর মাদাম কুরির সব অভিমান জল হয়ে যায়। তিনি নাতনিকে একদিন না দেখলে ছটফট করতে থাকেন। 

মা হবার পর আইরিন যক্ষায় আক্রান্ত হলেন। ডাক্তার বললেন ‘কমপ্লিট রেস্ট’ নিতে হবে। এটাও বললেন যে ভবিষ্যতে আর মা হওয়া চলবে না। কয়েক সপ্তাহ রেস্ট নিয়ে শিশু হেলেনকে নার্সের হাতে দিয়ে ল্যাবে ফিরলেন আইরিন। ল্যাবে ডক্টরেটের জন্য পূর্ণোদ্যমে গবেষণা করছেন ফ্রেড। আইরিন সুপারভাইজ করছেন তাঁকে। 

১৯৩০ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করলেন ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি। তাঁর থিসিসের শিরোনাম ছিল, “ইলেকট্রোকেমিক্যাল প্রপার্টিজ অব রেডিওঅ্যাক্টিভ কম্পাউন্ডস অব পোলোনিয়াম”। 

রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে ফ্রেড ও আইরিন যে বেতন পান তাতে ঠিকমত সংসার চলে না তাঁদের। মায়ের দেয়া অ্যাপার্টমেন্টটা না থাকলে তাঁদের অবস্থা যে কী হতো বলা যায় না। এতদিন ফ্রেডের একাডেমিক ডিগ্রি ছিল না। এখন ডক্টরেট হবার পর ফ্রেড ইন্ডাস্ট্রিতে চলে চাকরি নিয়ে চলে যাবেন ঠিক করলেন। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে গবেষণা করার তেমন সুযোগ নেই।

সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে ফ্রেডের। জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট নাৎসিদের উত্থান ঘটছে। ফ্রেড সরকারি চ্যানেলে বোঝাতে সক্ষম হন যে বিজ্ঞান গবেষণায় প্রচুর বাজেট না দিলে ভবিষ্যতে ফ্যাসিস্টদের ঠেকানো যাবে না। সরকার একটা বড় অংকের রিসার্চ গ্রান্ট দেয় ফ্রেডকে। ইন্ডাস্ট্রিতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত বাতিল করে ফ্রেড আইরিনের সাথে পূর্ণকালীন গবেষণা শুরু করেন। 

ফ্রেড আর আইরিনের টিম-ওয়ার্ক খুবই ভালো চলছিল। ফ্রেড ফিজিসিস্ট হলেও তাঁর ডক্টরাল থিসিস ছিল কেমিস্ট্রিতে। আর আইরিন কেমিস্ট, কিন্তু তাঁর থিসিস ছিল পিওর ফিজিক্সের ওপর। ফ্রেড যেকোন ব্যাপারেই দ্রুত চিন্তা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, আবার ঘনঘন সিদ্ধান্ত বদলানও। কিন্তু আইরিন সেরকম নন। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেন বলে সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর অনেক দেরি হয়। গবেষণায় সাফল্য এলে সকলের প্রশংসা পেতে পছন্দ করেন ফ্রেড, কিন্তু বিরাট সাফল্যেও কোন ভাবান্তর হয় না আইরিনের। 

Tuesday, 25 September 2018

আইরিন কুরি ।। ষষ্ঠ পর্ব



রেডিয়াম ইনস্টিটিউট থেকে আইরিনদের বাসা খুব বেশি দূরে নয়। সরবোন ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের পেছনের রাস্তা দিয়ে ল্যাটিন কোয়ার্টারের পাশ দিয়ে লা ট্যুরনেল ব্রিজ পার হয়ে বিখ্যাত নটর ডেম ক্যাথিড্রালের সামনে দিয়ে হেঁটে প্রতিদিনই বাসায় ফেরেন আইরিন।

এই পথে হাঁটার সময় আইরিনের অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। মনে হয় মায়ের পথেই হাঁটছেন তিনি। তাঁর মা পোল্যান্ড থেকে এসে এই সরবোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় এই ল্যাটিন কোয়ার্টারের একটা চিলেকোঠায় থাকতেন।

ফ্রেড আজ সাথে চলেছেন। ফ্রেড শুধু কাজের কথাই বলে যাচ্ছেন আজ, ক্লাউড চেম্বারের কথা, পোলোনিয়ামের কথা, রেডিয়ামের কথা। বাড়ির দরজায় আসার পরেও কথা শেষ হলো না তাঁর। বাকিটা পরের দিন হবে বলে বিদায় নিয়ে চলে এলেন। তাঁকে আবার অনেকদূর ঘুরে যেতে হবে নিজের বাসায়।

পরের দিনও ঠিক সময়ে কাজ শেষ করে বাইরে এসে সিঁড়ির কাছে বসে রইলেন ফ্রেড। ঘন্টাখানেক পর আইরিনকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে এগিয়ে গেলেন। আবার একই পথে দু’জনের পাশাপাশি হাঁটা। নটর ডেম ক্যাথিড্রালের সামনে এসে ফ্রেড হঠাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন, “নটর ডেমের বাইরের চেয়ে ভেতরটাই বেশি সুন্দর লাগে আমার কাছে। আপনার কেমন লাগে?”
“আমি জানি না”
“বুঝলাম না”
“অর্থাৎ আমি কখনো নটর ডেমের ভেতরে ঢুকে দেখিনি।”
“কেন?”
“ইচ্ছে করেনি।”
“আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে আপনার অনিচ্ছার কারণ কী।”
“বারো বছর বয়স পর্যন্ত আমি আমার গ্র্যানপির কাছে মানুষ হয়েছি। তাঁর কাছেই আমি পেয়েছি আমার জীবন-দর্শন। রাষ্ট্রীয় দখলদারিত্ব উপনিবেশ এগুলোকে খুবই ঘৃণা করি আমি। চার্চ যে ধর্মের নামে মানুষকে প্রতিনিয়ত শোষণ করছে, রাষ্ট্রের সব কাজে হস্তক্ষেপ করছে তা আমি জানি। আমার মা আমাদের দু’বোনকে ধর্মহীনভাবে বড় করেছেন। বলেছেন, আমি তোমাদের ওপর কোন ধর্মের বোঝা চাপিয়ে দিতে চাই না। তোমরা বড় হয়ে যখন বুঝতে শিখবে তখন যার যা খুশি অনুসরণ করবে। আমি যখন থেকে নিজে নিজে বুঝতে শিখেছি আমার দাদুর শিক্ষা মানবতাকেই আমার ধর্ম হিসেবে মানি। পৃথিবীর সবগুলো ক্যাথিড্রালে লক্ষ লক্ষ ফ্রাঙ্ক খরচ করে নানারকম চিত্রকর্ম, শিল্পকর্ম স্থাপন করা হয়। মূল উদ্দেশ্য কিন্তু এক - অলৌকিক ঈশ্বর বা যিশুখ্রিস্টের মহিমা প্রচার করা। আমি কখনোই কোন ধর্মীয় স্থানে এ পর্যন্ত ঢুকিনি, ভবিষ্যতেও ঢোকার ইচ্ছে নেই।”
“আপনি যিশুখ্রিস্টকে বিশ্বাস করেন না?”
“না। সব মানুষ পাপী, যিশু তাদের উদ্ধারকর্তা জাতীয় কথাবার্তা বিশ্বাস করার মতো নির্বোধ আমি নই।”
 
প্রায় প্রতিদিনই একসাথে হাঁটতে বেরোচ্ছেন ফ্রেড ও আইরিন। চেনা পথ দিয়ে বাড়ি ফেরার বদলে প্যারিসের অপরিচিত গলি দিয়েও হাঁটতে শুরু করেছেন তাঁরা। বিজ্ঞান ছাড়াও ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, শ্রেণিসংগ্রাম এবং কবিতা নিয়েও আলোচনা শুরু হলো তাঁদের মধ্যে। ফ্রেড আবিষ্কার করলেন আইরিন কবিতা পছন্দ করেন। অনেকগুলো ফ্রেঞ্চ, জার্মান ও ইংরেজি কবিতা তাঁর মুখস্থ।

যে আইরিনকে সবাই বরফের মূর্তি মনে করেন, সেই আইরিনের ভেতর একটা নতুন আইরিনের সন্ধান পান ফ্রেড। এই নতুন আইরিনের সাথে পাহাড়ে বেড়াতে যান ফ্রেড, স্কি করেন, সাঁতার কাটেন, টেনিস খেলেন। আবার একই সাথে গবেষণাও করেন। যদিও আইরিন ফ্রেডকে সরাসরি বলেন, “আপনাকে দেখলে মোটেও বিজ্ঞানী বলে মনে হয় না। আপনার চেহারা বড় বেশি মিলিটারি টাইপ।”

১৯২৫ সালে আইরিন সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল থিসিস জমা দিয়েছেন - ‘আলফা রে অব পোলোনিয়াম’ শিরোনামে। থিসিস উৎসর্গ করেছেন তাঁর মাকে - ‘টু মাদাম কুরি বাই হার ডটার এন্ড পিউপিল’। আইরিন থিসিস ডিফেন্ড করতে গেলেন একটা ঢিলেঢালা ব্যাগি ড্রেসের ওপর কালো একাডেমিক গাউন পরে।

অডিটোরিয়ামে প্রায় হাজার দর্শক উপস্থিত রেডিয়াম-কন্যার বক্তৃতা শোনার জন্য। আইরিন যদিও সমাবেশ পছন্দ করেন না, কোন ধরনের টেনশান ছাড়াই তিনি বক্তৃতা করলেন। তিনি যা জানেন তা এত ভালো জানেন যে সেটা নিয়ে কোনদিনই কোন উৎকন্ঠায় ভোগেন না। আইরিনের পরীক্ষকদের ওপর মানসিক চাপ পড়বে ভেবে মাদাম কুরি যাননি সেই অনুষ্ঠানে।

পরীক্ষকদের সবার ভূয়সী প্রশংসার ভেতর দিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি পেলেন আইরিন কুরি। সরবোন থেকে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে ফিরেই চমকে উঠলেন আইরিন। সেখানে আইরিনের জন্য সংবর্ধনার আয়োজন করে ফেলেছেন ফ্রেড। ল্যাবরেটরির বিকারে করে শ্যাম্পেন পান করার মধ্য দিয়ে শেষ হলো সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।




এতদিন ধরে ফ্রেডের সাথে মেলামেশা করতে করতে আইরিনের ভেতর অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। জীবনে প্রেম-ভালোবাসার কোন স্থান ছিল না তাঁর। কিন্তু ফ্রেড যেন নতুন দরজা খুলে দিয়েছেন তাঁর জীবনে। তিনি ফ্রেডকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবছেন। ফ্রেড তো অনেক আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন বিয়ে যদি করেন তো আইরিনকেই করবেন।

ডক্টরেটের পর আইরিনকে নিয়ে মাদাম ব্রাজিলে গেছেন। ইনস্টিটিউটে গিয়ে আইরিনকে না দেখে কাজে মন বসাতে পারেন না ফ্রেড। তিনি আইরিনকে চিঠি লেখেন, “আমি এতদিন ভাবতাম গবেষণাকেই আমি বেশি ভালোবাসি। এখন তোমাকে না দেখতে পেয়ে বুঝতে পারছি আমি গবেষণার চেয়েও তোমাকেই বেশি ভালোবাসি। তুমি আছো বলেই আমার গবেষণা আছে। তুমি কাছে না থাকলে আমার সবকিছুই খালি খালি লাগে। তুমি যে আমার জীবনের সাথে মিশে গেছো তা কি তুমি জানো?”
চিঠি পেয়ে আইরিন ঠিক বুঝতে পারলেন না কী করবেন। তিনি সবসময় বস্তুনিষ্ঠ ব্যাপারে অভ্যস্ত। এরকম ভাবালুতার সাথে তাঁর পরিচয় নেই। ফ্রেড তাঁকে ভালোবাসে সেটা লিখেছে স্পষ্ট করে। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব তো এটা নয়। আইরিন বস্তুনিষ্ঠভাবে ভাবতে সাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন। তিনি ভেবে দেখলেন ভালোবাসা যখন হয়েছে তখন বিয়ে করে ফেলাই ভালো। তাঁর মা একই সাথে বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী আবার দুটো সন্তানের মা। মাদামের মেয়ে হয়ে আইরিনও নিশ্চয় বিজ্ঞান ও সংসার দুটোই সামলাতে পারবেন। তাছাড়া স্বামী হিসেবে খুব একটা খারাপ হবেন না ফ্রেড। 
কাজ শেষে বাসায় ফেরার সময় ফ্রেডের সাথে খোলাখুলি কথা বললেন আইরিন।
“তোমার চিঠি আমি পেয়েছি।”
“কিন্তু চিঠির জবাব আমি পাইনি।”
“চিঠিতে একটি প্রশ্ন তুমি করেছিলে - আমি যে তোমার জীবনের সাথে মিশে গেছি তা আমি জানি কিনা। সে প্রশ্নের উত্তরে কী লিখতে হয় আমি জানি না। ফ্রেড, এই ব্যাপারগুলো আমার কাছে ভীষণ জটিল বলে মনে হয়। সরাসরি বলো - তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে চাও?”
“হ্যাঁ চাই চাই চাই।”
“একটা শব্দ এতবার বলছো কেন?”
“আমার ইচ্ছের প্রাবল্য বোঝানোর জন্য বলছি মাদ্‌মাজেল। আমার মনে হচ্ছে আমি আজ চাঁদ হাতে পেয়েছি।”
“সবকিছুতে কেন যে তুমি চাঁদের উপমা দাও বুঝতে পারি না। আলফা পার্টিক্যলকে তুমি চাঁদে নিয়ে যাও। আজ বলছো তুমি চাঁদ হাতে পেয়েছো। চাঁদের আয়তন কত জানো?”
“তোমার বিজ্ঞান দিয়ে ভালোবাসা বোঝার চেষ্টা করো না মাদ্‌মাজেল। ওটা আমার হাতেই ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি চাঁদ হাতে পাওয়া বলতে কী বোঝায়” - বলতে বলতে গভীর আবেগে আইরিনকে জড়িয়ে ধরেন ফ্রেড। সময় থেমে যায়, চন্দ্রগ্রস্তের মত তিরতির করে কাঁপতে থাকেন আইরিন।

[সপ্তম পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন এখানে]

Saturday, 22 September 2018

আইরিন কুরি ।। পঞ্চম পর্ব



ঠিক সকাল ১১টাতেই মাদামের অফিসে ডাক পড়লো ফ্রেডের। রুমে ঢুকলেন ফ্রেড। খুবই সাধারণ অফিসে খুবই সাধারণ কালো পোশাকে বসে আছেন অসাধারণ মাদাম কুরি। মাথার চুল সব সাদা হয়ে গেছে, উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি। 
         “বসুন মঁসিয়ে”
“ধন্যবাদ মাদাম”
“মঁসিয়ে জুলিও, মঁসিয়ে লাঁজেভি আপনার কথা বলেছেন আমাকে। দেখি আপনার সার্টিফিকেটগুলো।”
“ইয়েস মাদাম”
“আপনি ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রি নিয়ে পাস করেছেন ইপিসিআই থেকে। কিন্তু আপনার কোন ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি নেই। ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি ছাড়া আপনি তো বেশি কিছু করতে পারবেন না। কমপক্ষে মাস্টার্স পাস না করলে তো শিক্ষক হতে পারবেন না। আপনার বর্তমান ডিগ্রি নিয়ে আমাদের ল্যাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট পদের বেশি কিছু আপনাকে অফার করতে পারছি না। বেতন কিন্তু খুবই কম। মাসে মাত্র ৫৪০ ফ্রাঙ্ক পাবেন। ইচ্ছে করলে কালকেই কাজে যোগ দিতে পারেন।”
“অনেক ধন্যবাদ মাদাম। মিলিটারি সার্ভিসে আমার এখনো কয়েক সপ্তাহ বাকি আছে। কমান্ডিং অফিসারের কাছ থেকে রিলিজ নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যোগ দেবো মাদাম।”
“ঠিক আছে মঁসিও। আপনি এখন যেতে পারেন।”
ফ্রেডের মনে হলো আকাশের চাঁদ হাতে নিয়ে বেরোলেন মাদামের অফিস থেকে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নিচে চলে এলেন তিনি। আসার পথে খেয়ালই করলেন না রেডিয়াম-আকাশের আরেকটি উজ্জ্বল নক্ষত্র আইরিন তখন করিডোর দিয়ে মাদামের অফিসের দিকে যাচ্ছিলেন। 
ফ্রেডের আর তর সইছিল না। কমান্ডিং অফিসারকে গিয়ে অনুরোধ করলেন তাঁকে আর্লি রিলিজ দিতে। কমান্ডিং অফিসার বললেন - মাদাম কুরির কাছ থেকে লিখিত অনুরোধ নিয়ে এলে রিলিজ দেবেন। 
ডিসেম্বরের ৫ তারিখ কমান্ডিং অফিসারের অনুমতি নিয়ে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল ফ্রেডের। ইনস্টিটিউটে তখন কেউ নেই। তথ্যকেন্দ্র থেকে ঠিকানা নিয়ে ছুটতে ছুটতে গেলেন মাদামের বাড়িতে। কলিংবেল বাজানোর কিছুক্ষণ পর যিনি দরজা খুললেন তাঁকে দেখে হতবাক হয়ে গেলেন চব্বিশ বছরের যুবক ফ্রেড - মানুষ এত সুন্দর হয়! 
মাদামের মেয়েদের কথা শুনেছেন ফ্রেড। আইরিন আর ইভের জন্য বুকের ভেতর ‘চিনচিন ব্যথা’ করে না এমন যুবক প্যারিসে একজনও নেই। কিন্তু সংবাদপত্রের খবর আর ছবি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলা এক কথা, আর চোখের সামনে এক হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেবী-দর্শন অন্য কথা। ফ্রেড কতক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে ছিলেন জানেন না, হঠাৎ খেয়াল হলো মাদ্‌মোজালও কিছুই না বলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছেন। নার্ভাসভাবে জিজ্ঞেস করেন ফ্রেড, “মাদাম কি বাসায় আছেন মাদ্‌মাজেল?”
“মাদাম কি জানেন যে আপনি আসবেন?” - নিরুত্তাপ কন্ঠ মাদ্‌মাজেলের। তারপর ফ্রেড যখন তার আসার কারণ বললেন কিছু না বলেই ভেতরে চলে গেলেন মাদ্‌মাজেল। ফ্রেড হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন খোলা দরজার বাইরে। আইরিন কুরি যে কাউকেই পাত্তা দেন না তা নিজের চোখেই দেখলেন ফ্রেড। 
একটু পর মাদাম নিজে এসে বললেন, “ভেতরে আসুন মঁসিয়ে। বলুন কী দরকারে এসেছেন।”
“আমি দুঃখিত মাদাম আপনাকে এই অসময়ে ডিস্টার্ব করতে হলো। আমি ইনস্টিটিউটে গিয়েছিলাম - ”
“আইরিনের কাছে ওসব আমি শুনেছি। তারপর থেকে বলুন।” 
আবারো অবাক হন ফ্রেড। এঁরা কি একবার শোনা কথা দু’বার শুনলেও সময় নষ্ট হয় মনে করেন? ফ্রেড যথাসম্ভব সংক্ষেপে বললেন তাঁর কমান্ডিং অফিসারের কাছ থেকে রিলিজ নেয়ার জন্য মাদামের চিঠি লাগবে।
       “আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি। কখন থেকে আপনি কাজে যোগ দিতে চান? খ্রিস্টমাসের পর নতুন বছরের প্রথম খোলার দিন থেকেই কাজ শুরু করতে পারেন।”
“ওকে মাদাম। তবে তার আগে রিলিজ পেলে আমি কি কয়েক সপ্তাহ আগেই যোগ দিতে পারবো?”
“ঠিক আছে।”
মাদাম চিঠি লিখে দিলেন। শুভ রাত্রি বলে বিদায় নিলে চলে এলেন ফ্রেড। 
তারপর কমান্ডিং অফিসারের কাছ থেকে রিলিজ নিয়ে সেনাবাহিনীর পাট চুকিয়ে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে যোগ দিয়েছেন ১৯২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর। সেদিনই আইরিন কুরির সাথে আবার দেখা হয়েছে ফ্রেডের। আইরিন তাঁর সুপারভাইজার। কর্মক্ষেত্রে প্রথম দিনেই আইরিনের ইস্পাত-দৃঢ় ব্যক্তিত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করে ফেলেছেন ফ্রেড। 




নতুন স্বপ্ন

কয়েক দিনের মধ্যেই রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের সবার সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল ফ্রেডের। এতদিন যারা সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকতেন তাঁদের মুখেও হাসির রেখা দেখা দেয় ফ্রেডের সংস্পর্শে। যন্ত্রপাতির ওপর ফ্রেডের দক্ষতায় যতটা মুগ্ধ সবাই - তার চেয়েও বেশি মুগ্ধ ফ্রেডের আচরণে। কয়েক মিনিটের আলাপেই মানুষের সাথে অন্তরঙ্গ হয়ে যেতে পারেন ফ্রেড। কিন্তু রেডিওএক্টিভিটি সম্পর্কে ধরতে গেলে কোন গভীর জ্ঞান নেই ফ্রেডের। 
একদিন আইরিন পোলোনিয়াম থেকে নির্গত আলফা পার্টিক্যলের ধর্ম ব্যাখ্যা করছিলেন,  “তেজষ্ক্রিয় মৌল থেকে তিন ধরনের বিকিরণ ঘটতে পারে। প্রথমত: গামা রশ্মি। গামা রশ্মি তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ - আলোর বেগে চলে। এদেরকে সহজে থামানো যায় না। দ্বিতীয়ত: বিটা পার্টিক্যল। এগুলো আসলে ইলেকট্রন। এগুলোর যেহেতু ভর আছে এরা আলোর চেয়ে সামান্য কম গতিতে চলে। বিটা পার্টিক্যলগুলো পদার্থের ভেতর কয়েক সেন্টিমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। আর তৃতীয়ত: আলফা পার্টিক্যল। এগুলো হলো সবচেয়ে ভারী। এরা আসলে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস - ইলেকট্রনের চেয়ে প্রায় চার হাজার গুণ ভারী। এত ভারী বলে আলফা পার্টিক্যল খুব ধীরে ধীরে চলে। তাদের গতি হলো আলোর গতির প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ।” [তখনো নিউট্রন আবিষ্কৃত হয়নি। নিউক্লিয়াসের মধ্যে শুধু প্রোটন আছে বলে মনে করা হতো। একটা প্রোটন ইলেকট্রনের চেয়ে প্রায় দু’হাজার গুণ ভারী। হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে দুটো প্রোটন আছে। আইরিন সেই হিসেবে চার হাজার গুণ ভারী বলেছিলেন। নিউট্রনের ভরসহ হিসেব করলে আলফা পার্টিক্যল ইলেকট্রনের চেয়ে প্রায় আটহাজার গুণ ভারী।] 
ফ্রেড দ্রুত হিসেব করে আইরিনকে ইমপ্রেস করার জন্য বললেন, “মাদ্‌মাজেল, এই ধীরে চলা আলফা পার্টিক্যলগুলো কিন্তু কোথাও বাধা না পেলে মাত্র পঁচিশ সেকেন্ডে চাঁদে পৌঁছে যেতো।”
আইরিন কড়া চোখে তাকালেন ফ্রেডের দিকে। এরকম প্রাত্যহিক অসম্ভব ঘটনার সাথে বৈজ্ঞানিক ঘটনার তুলনা তাঁর কাছে বিজ্ঞান-অবমাননার সমান। ঠান্ডা গলায় কঠিন ভাবে বললেন আইরিন, “মঁসিয়ে, আলফা পার্টিক্যল খুব সহজেই তাদের সব শক্তি হারিয়ে ফেলে। পদার্থের ভেতর দিয়ে তারা কয়েক মিলিমিটারও যেতে পারে না। শূন্য মাধ্যমেও তারা কয়েক সেন্টিমিটারের বেশি যেতে পারে না। আপনার চাঁদে পৌঁছে যাওয়ার তুলনা এখানে খাটে না।”
ফ্রেড আর কিছু বলার সাহস পান না। তিনি বুঝতে পারেন না মানুষ কীভাবে এরকম বরফের মত হতে পারে। আইরিন কখনো রাগেন না, বিরক্তি প্রকাশ করেন না, আবার কখনো হাসেনও না। দরকার না থাকলে কারো সাথে কথা বলা তো দূরের কথা - ‘হাই’ ‘গুড মর্নিং’ ‘গুড বাই’ জাতীয় সাধারণ ভদ্রতাও করেন না। ফ্রেডের মাঝে মাঝে মনে হয় আইরিন আসলে মানুষ নন, রোবট। 
এই চব্বিশ বছর বয়সে ফ্রেডের চারপাশে পতঙ্গের মত ঘুরছে অনেক ফরাসি মেয়ে। তাদের কেউই ফ্রেডের মনে রেখাপাত করতে পারেনি। কিন্তু আইরিনকে যতই দেখছেন মনের ভেতর এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ফ্রেডের। এর নাম কি ভালোবাসা? নিজের স্বভাবের সাথে কোন মিলই নেই আইরিনের। তাঁর চেয়ে বয়সে তিন বছরের বড় আইরিন। শিক্ষায় বড় আরো বেশি। আইরিন মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করে ডক্টরেটের জন্য থিসিস লিখছেন। আর ফ্রেডের এখনো ব্যাচেলর ডিগ্রিও নেই। কোন্‌ যোগ্যতায় তিনি এমন আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখেন? 
কিন্তু রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে কাজ করার সুযোগ পাওয়াটাও তো আকাশ-কুসুমই ছিল। সেটা সত্যি হতে পারলে অন্যটা নয় কেন? কিন্তু এখানে কাজ তো পেয়েছেন মঁসিয়ে লাঁজেভি’র সুপারিশে। আইরিনের মন তো কারো সুপারিশে পাওয়া যাবে না। আইরিনের মনের কাছাকাছি যেতে হলে আগে মনের ঠিকানা জানা দরকার। কিসে খুশি হন আইরিন? বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষ দেখাতে পারলে নিশ্চয় খুশি হবেন তিনি। রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের যত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আছে সবগুলো খুব মনযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করলেন ফ্রেড।
উইলসন ক্লাউড-চেম্বার আইরিনের প্রিয় যন্ত্র। আল্‌ফা ও বিটা কণার গতিপথ পরীক্ষা করে দেখা যায় এই ক্লাউড চেম্বারে। ক্যামেরা লাগিয়ে ছবিও তোলা যায় সেই গতিপথের। কিছুদিনের মধ্যেই ফ্রেড উইলসন ক্লাউড-চেম্বারের নকশায় কিছুটা পরিবর্তন করে যন্ত্রটার কাজের দক্ষতা ও সৌন্দর্য দুটোই বাড়িয়ে দিলেন। আইরিনের মুখে হাসি না ফুটলেও চোখের দৃষ্টিতে প্রশংসা দেখতে পেলেন ফ্রেড। ফ্রেড উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। নানারকম বৈজ্ঞানিক আইডিয়া ভর করতে লাগলো তাঁর মাথায়। বিজ্ঞানের মধ্য দিয়েই হয়তো আইরিনের মনের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবেন। 
কিন্তু একটু পরেই ঠান্ডা গলায় আইরিনের ধমক খেয়ে স্বপ্নভঙ্গ হলো ফ্রেডের।
  “ল্যাব এরকম অগোছালো করে রেখেছেন কেন? আপনার কাজের পদ্ধতি ঠিক নয় মঁসিয়ে।”
“কাজ করছিলাম তো মাদ্‌মাজেল, পরে সব গুছিয়ে রাখবো।”
“গোছাতে হবে কেন? অগোছালো না করলেই তো হয়। সব জিনিস জায়গামতো রাখাটাও কাজের অংশ।”
“কিন্তু মাদ্‌মাজেল যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে গেলে কিছুটা অগোছালো তো হবেই।”
“আসুন আমার সঙ্গে” - বলেই ক্লাউড-চেম্বারের ল্যাব থেকে বেরিয়ে নিজের ল্যাবের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন আইরিন।
আইরিনকে অনুসরণ করে তাঁর ল্যাবে ঢুকে অবাক হয়ে গেলেন ফ্রেড। কোন গবেষণাগার যে এত গোছালো হতে পারে ফ্রেডের ধারণা ছিল না। ফ্রেড বুঝতে পারলেন তাঁর চিরদিনের অগোছালো স্বভাব এবার বদলাতে হবে। ‘করতে হবে’র তালিকা ক্রমশ লম্বা হচ্ছে ফ্রেডের।
ফ্রেড খেয়াল করেছেন আইরিন প্রতিদিন সন্ধ্যায় কাজ শেষে ইনস্টিটিউট থেকে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফেরেন। ভাবলেন যদি তাঁর হাঁটার সঙ্গী হওয়া যায়। একদিন কাজ শেষে আইরিনের ল্যাবের দরজায় গিয়ে দেখে এলেন আইরিনের কাজ শেষ হয়েছে কিনা। দেখলেন আইরিন তখনো কাজে মগ্ন। ফ্রেড বেরিয়ে ইনস্টিটিউটের গেটের কাছে এসে গার্ডের সাথে গল্প করতে লাগলেন। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর আইরিন গেট দিয়ে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করেছেন বাড়ির দিকে। 
আইরিন যে হাঁটতে পছন্দ করেন তা দেখেই বুঝতে পারলেন তুখোড় খেলোয়াড় ফ্রেড জুলিও। হঠাৎ মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেলো তাঁর। আইরিনের সাথে তাঁর যে বিরাট মিল আছে - তা এতদিন চোখে পড়েনি। দু’জনই খেলাধূলা পছন্দ করেন। ফ্রেড প্রায় ছুটে গিয়ে আইরিনের সামনে দাঁড়ালেন। 

“মাদ্‌মাজেল, আমি আজ বিকেল থেকে আপনার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছি। আপনি এত ব্যস্ত, তাই এতক্ষণ এখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
এরকম পরিস্থিতিতে সাধারণ ভদ্রতা হচ্ছে আইরিন বলবেন - ‘আমি দুঃখিত আপনাকে এতক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো, ইত্যাদি ইত্যাদি’। কিন্তু আইরিন এসব করতে পারেন না। তিনি সারাদিন নিজের কাজ করছিলেন বলেই ব্যস্ত ছিলেন এবং সেজন্য দুঃখিত কেন হবেন? আইরিন কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেলেন। ফ্রেড এতদিনে আইরিনের স্বভাব বুঝে গেছেন কিছুটা। অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে বলে ফেললেন, “মাদ্‌মাজেল, আমি কি আপনার সাথে কিছুদূর হাঁটতে পারি?”
“কেন?”
“আলফা পার্টিক্যল সম্পর্কে আমার ধারণাগুলো আপনার কাছে ব্যাখ্যা করতাম, যদি আমার চিন্তায় কোথাও ভুল থাকে - আপনি ঠিক করে দেবেন।”
“ঠিক আছে, চলুন।”
ফ্রেড এটাই চাইছিলেন। আইরিন কোন কথা না বলুক - তাতে কী। নিজের ভাবনাগুলোকে তো বিজ্ঞানের মোড়কে হলেও আইরিনকে শোনাতে পারবেন। তাছাড়া প্রসঙ্গ ঠিকমত হলে আইরিন কথা বলবেন না কেন? 

Thursday, 20 September 2018

আইরিন কুরি ।। চতুর্থ পর্ব



১৯২৪ সালের নভেম্বরে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য থিসিস লিখছেন আইরিন। থিসিসে তিনি যেসব পরীক্ষালব্ধ ফলাফল বিশ্লেষণ করেছেন তার সবকিছুই নতুন। সেই সময় পোলোনিয়াম সম্পর্কে যত পরীক্ষা আইরিন করেছেন পৃথিবীর আর কোথাও কেউ ততটা করেননি। একদিন সকালবেলা ল্যাব থেকে করিডোর পেরিয়ে মায়ের অফিসের দিকে যাবার সময় আইরিন দেখলেন একজন আর্মি অফিসার মায়ের অফিস থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে নিচে চলে গেলো। আইরিন সাধারণত এসব খেয়াল করেন না, কিন্তু ইনস্টিটিউটে হঠাৎ মিলিটারি দেখে তাঁর দৃষ্টি চলে গেছে সেদিকে। মাকে জিজ্ঞেস করলেন, “মিলিটারি কেন এসেছিল মাদাম?”

            “মঁসিয়ে লাঁজেভি পাঠিয়েছেন। এখানে যোগ দেবে ল্যাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে।”

আইরিন আর কোন কৌতূহল দেখালেন না।

এর দু’সপ্তাহ পর একদিন সন্ধ্যাবেলা আইরিন বাসায় তাঁর রুমে বসে থিসিস লিখছেন। মা তাঁর পড়ার ঘরে। গভর্নেস রান্নাঘরে ডিনার রেডি করছেন। ইভ বন্ধুদের সাথে কনসার্টে গেছে। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে কলিংবেল বেজে উঠলো। কে এলো এই সন্ধ্যায়? ইভ কখনো কলিংবেল বাজায় না, বেরোনোর সময় সে চাবি নিয়ে বেরোয়।

আইরিন দরজা খুলে দেখলেন গাঢ় নীল ইউনিফর্ম পরা এক মিলিটারি অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন হাতে একটা ফাইল নিয়ে। আইরিনের মনে পড়লো সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখা অফিসারের কথা। সেদিন তার চেহারা দেখেননি। লম্বা স্বাস্থ্যবান সুদর্শন মিলিটারি অফিসার আইরিনকে দেখে বললেন, “মাদ্‌মাজেল, মাদাম কি বাসায় আছেন?”

            “মাদাম কি জানেন যে আপনি আসবেন?”

          “না। আমার নাম ফ্রেডেরিক জুলিও। ফ্রেড বললেই হবে। মাদামের ল্যাবে আমার যোগ দেয়ার ব্যাপারে কথা চলছে। আমি ইনস্টিটিউটে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওখানে কাউকে না পেয়ে বাসায় আসতে হলো। মাদামের সাথে বিশেষ দরকার।”

আইরিন কোন কিছু না বলে ভেতরে চলে গেলেন। খুব অবাক হয়ে গেলেন আর্মি অফিসার। এ কী ধরনের ব্যবহার? একটু বসতেও বললেন না! দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেই চলে গেলেন! একটু পরে মাদাম কুরি এসে ফ্রেডকে ডেকে নিয়ে বসালেন। আইরিন ফ্রেডেরিকের আসার খবরটা মাকে দিয়েই নিজের রুমে চলে গিয়েছিলেন। ফ্রেড কী দরকারে এসেছিলেন সে ব্যাপারে সামান্য কৌতূহলও হয়নি তাঁর।

ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে ফ্রেডেরিকের সাথে আবার দেখা হলো আইরিনের। মাদাম কুরি আইরিনকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর অফিসে। আইরিন ঢুকতেই মাদাম বললেন, “মঁসিয়ে জুলিও আজ থেকে ইনস্টিটিউটে কাজ শুরু করলেন। তাঁকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিন। আর তাঁকে ট্রেইন-আপ করার দায়িত্বও আপনার মাদ্‌মাজেল।”

মাদাম নিজের মেয়ের সাথেও এরকম ফরমালভাবে কথা বলছেন দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলেন ফ্রেড। আইরিন মাদামের রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফ্রেড তাঁকে অনুসরণ করলেন। আইরিন দ্রুত পায়ে করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “আমি এখন আপনাকে আমাদের অন্যান্য গবেষকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। তারপর আপনাকে কী কী করতে হবে দেখিয়ে দেবো। কোন প্রশ্ন থাকলে আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন মঁসিয়ে।”

            “আমাকে ফ্রেড বলে ডাকলেই খুশি হবো।”

            “তা সম্ভব নয়। ইনস্টিটিউটের নিয়ম হলো এখানে কাউকে নাম ধরে ডাকা যাবে না। এমন কি আমার মাও আমাকে নাম ধরে ডাকেন না এখানে। কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা কাজের সময় নষ্ট করে বলে বিশ্বাস করেন আমার মা।”

            “এখন বুঝতে পারলাম আপনার মা আপনার সাথে ওভাবে কথা বলছিলেন কেন।”

পরবর্তী আধঘন্টার মধ্যে আইরিন ঝড়ের বেগে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন ফ্রেডেরিক জুলিওর। তারপর আরো দ্রুত বলে গেলেন ফ্রেডকে কী কী করতে হবে। সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট ফ্রেডেরিক জুলিওর মনে হলো রিসার্চ সুপারভাইজার নয়, ফিল্ড মার্শাল আইরিন কুরির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। চঞ্চল হাসিখুশি টগবগে সৈনিক ফ্রেড বুঝতে পারছেন না কীভাবে টিকে থাকবেন বা আদৌ টিকতে পারবেন কিনা এই গুরুগম্ভীর পরিবেশে। তবে এটুকু বুঝতে পারছেন - পারতে তাঁকে হবেই। 




ফ্রেডেরিক

ফ্রেডের জন্ম ১৯০০ সালের ১৯শে মার্চ প্যারিসে। ফ্রেডের জন্মের সময় তার মা এমিলি জুলিওর বয়স ছিল ৪২ এবং বাবা হেনরি জুলিওর বয়স ৫৩। বেশি বয়সে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে এমিলির প্রাণ যায় যায় অবস্থা। তবে কিছুদিন পর তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। এমিলির ছয় সন্তানের মধ্যে সবার ছোট ফ্রেড। ছয় জন ছেলে-মেয়ের মধ্যে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে শৈশবেই। ফ্রেডের যখন জন্ম হয় তখন তার বড়দিদি জেনির বয়স ১৮, ছোটদিদি মার্গেরিটের বয়স ১৩, আর দাদা হেনরি জুনিয়রের বয়স ১১। মায়ের অসুস্থতার কারণে জেনি অনেকটা মায়ের মতই আগলে রাখে ফ্রেডকে। ফ্রেডদের পরিবারের সবাই খুব হাসিখুশি প্রাণবন্ত। বাবা হেনরির ছোট একটা ব্যবসা আছে - এবং যা আয় করেন তা দিয়ে বেশ সচ্ছলভাবেই সংসার চলে। তাঁর নেশা হলো শিকার করা, মাছ ধরা আর সংগীত রচনা। মায়ের শখ হলো নানারকম রান্না করা। জেনি নাট্যকলার ছাত্রী, মার্গেরিট চমৎকার ছবি আঁকেন। গান বাজনা নাটক খেলাধূলা ছবি-আঁকা সব মিলিয়ে প্রতিদিনই যেন তাদের বাড়িতে উৎসব চলছে। ফ্রেড সবার আদরের - ফলে সবার যা কিছু ভালো সবই সে আয়ত্ব করে ফেলে। বাবার কাছ থেকে শিকার আর মাছ ধরার নেশা পেয়ে যায়। সুযোগ পেলে পিয়ানো নিয়েও বসে যায় সুর সাধনায়। বোনদের সাথে নাটকের সংলাপ আওড়ায়, ছবি আঁকে, ভাইয়ের টিমে ফুটবল খেলে। 
স্কুলে পড়ার সময় পড়াশোনার চেয়েও খেলাধূলায় বেশি সময় দেয় ফ্রেড। ফলে মেধাবী ছাত্র বলতে যেরকম ছাত্রদের বোঝায় সেরকম ছাত্র ছিল না ফ্রেড। মাঝারি মানের রেজাল্ট নিয়ে ফ্রেড পাস করে যাচ্ছিলো স্কুলের পরীক্ষাগুলো। কিন্তু শারীরিক শক্তি ও ক্রীড়ানৈপুণ্যে ফ্রেড ছিল সবার সেরা। ফলে তার সাথে সবারই বন্ধুত্ব হয়ে যেতো খুব সহজেই। হাসি আনন্দে বড় হচ্ছিলো ফ্রেড। কিন্তু ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার পর তার বড়ভাই হেনরি জুনিয়রকে যুদ্ধে যেতে হয়। তার কিছুদিন পর আর কোন খবর পাওয়া যায়নি হেনরির, মৃতদেহও পাওয়া যায়নি। এই কষ্ট কাটিয়ে উঠতে অনেক বছর সময় লেগেছে তাদের সবার। 
কৈশোর বয়স থেকেই চৌকস খেলোয়াড় হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে ফ্রেড। এসময় নানারকম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার দিকেও ঝোঁক যায় ফ্রেডের। চৌদ্দ বছর বয়স থেকে বাড়িতেই নানারকম মেকানিক্যাল ইলেকট্রিক্যাল কলকব্জা নিয়ে কাজ শুরু করে দেয়। বাড়িতে কলকব্জার স্তুপ জমে উঠে। 
বাড়িতে ফ্রেড ভীষণ অগোছালো। সবার আদর পেতে পেতে এমন অবস্থা হয়েছে যে বাড়িতে নিজের জামা-কাপড়টাও গুছিয়ে রাখে না ফ্রেড। মা মুখে বিরক্তি প্রকাশ করলেও আরেক ছেলেকে হারিয়ে ফ্রেডকেই সমস্ত স্নেহ ঢেলে দিয়ে ফ্রেডের সব জঞ্জাল গুছিয়ে রাখেন। ফ্রেড নানারকম যন্ত্রাংশ কিনে বাড়িতে বসে রেডিও বানাবার চেষ্টা করছে। আইফেল টাওয়ার থেকে বেতার সম্প্রচার চালু হয়েছে তখন প্যারিসে। 
সতেরো বছর বয়সে উচ্চ-মাধ্যমিকের সমপর্যায়ের পড়াশোনা শেষ হলো ফ্রেডের। তারপর ভর্তি হলো ইকোল ল্যাভয়সিয়েতে। এখানে শিক্ষার্থীদের ইপিসিআই-তে ভর্তির পরীক্ষায় পাস করার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়। ফ্রেড স্কুলে পড়াশোনায় খুব বেশি সময় দেয়নি - ফলে ল্যাভয়সিয়েতে এসে এতোবেশি পড়ার চাপ নিতে পারছিলো না। ফলে পরীক্ষাগুলোতে মোটেও ভাল করছিল না সে। ১৯১৮ সালের জুলাই মাসে ইপিসিআই’র ভর্তি পরীক্ষা হলো। ফ্রেড ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারলো না। 
ফ্রান্সে ছেলেদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয় বিশ বছর বয়সে। ফ্রেড মাত্র আঠারো পেরিয়েছে। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের কারণে ফ্রান্সের প্রচুর সৈনিকের দরকার। সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ডাক পড়লো ফ্রেডের। ফ্রেডের মনে হলো ভালোই হলো। ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করে কী করবে বুঝতে পারছিল না সে। এখন মিলিটারি ট্রেনিং নিতে নিতে ঠিক করতে পারবে কী করবে। 
মনপ্রাণ দিয়ে ট্রেনিং করলো ফ্রেড। শারীরিক দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা ও ফ্রেন্ডলি স্বভাবের কারণে সবার প্রিয় হয়ে উঠলো ফ্রেড। ১৯১৮’র শেষে তার ফ্রন্টে যাবার কথা ছিল - কিন্তু তার আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। এক বছর ট্রেনিং-এর ছয় মাস বাকি থাকতেই ফ্রেডের ছুটি হয়ে গেলো। বাকি ছ’মাস ট্রেনিং বিশ বছর বয়স হবার পরে করতে হবে। ফ্রেড ইপিসিআইতে আবার ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। মিলিটারি ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে সে শিখে এসেছে - ঠিকমতো চেষ্টা করলে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। এবার দিনরাত পড়াশোনায় ডুবে গেলো ফ্রেড। 
১৯১৯ সালের ৩০ জুন থেকে পরীক্ষা শুরু হয়ে ১২ জুলাই পরীক্ষা শেষ হলো। অনেকগুলো বিষয়ে লিখিত, ব্যবহারিক আর মৌখিক পরীক্ষার সমন্বয়ে ভীষণ কঠিন এই পরীক্ষা। ২১ জুলাই পরীক্ষার ফল বের হলো। ফ্রেড পাস করেছে। শুধু তাই নয় - গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও উচ্চতর গণিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে ফ্রেড। ইপিসিআইতে ভর্তির মেধাতালিকার শীর্ষে স্থান করে নিলো ফ্রেড। 
কিন্তু ভর্তির ক’দিন আগেই হঠাৎ প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়লো ফ্রেড। শুরুতে মনে হলো ফ্লু হয়েছে। যুদ্ধের পর ফ্রান্সে মহামারির মত ফ্লু হচ্ছে ঘরে ঘরে। ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসা করা হলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। দিনের পর দিন অবস্থা খারাপ হচ্ছে ফ্রেডের। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ডাকা হলো। তিনি পরীক্ষা করে ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলেন। ফ্রেডের মাকে বললেন, “মন শক্ত করুন মাদাম জুলিও। আপনার এই ছেলেটিকেও তো আর ধরে রাখতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। তার অবস্থা খুবই খারাপ। তার ভুল চিকিৎসা করা হয়েছে। টাইফয়েডের জায়গায় ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসা করা হয়েছে। আমি জানি না কতটুকু কী করতে পারবো।” 
মন শক্তই আছে ফ্রেডের মায়ের। তিনি বুঝতে পারেন না বড় বড় ডাক্তাররা এরকম কথা কেন বলেন। তাঁর নিজের বেলাতেও এরকম কথা শুনতে হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিল আঠারো বছরের বেশি তিনি বাঁচবেন না। অথচ তিনি এই ৬১ বছর বয়সেও বেঁচে আছেন। সুতরাং তাঁর ছেলেও বাঁচবে। অনেক দিন রোগে ভোগার পর ফ্রেড সেরে উঠলো। 
ফ্রেডের ইপিসিআই’র ক্লাস শুরু হলো ১৯২০ সালের অক্টোবরে। পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের জন্য খুবই বিখ্যাত এই প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্স এবং কেমিস্ট্রি। ফ্রেড শুরুতে প্রধান বিষয় রসায়ন নিয়ে রসায়ন গবেষণাগারের প্রধান আলবিন হলারের অধীনে কাজ শুরু করলো। কিন্তু ক’দিন পরেই মত বদলালো। তার মনে হলো পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান পল লাঁজেভি’র অধীনে কাজ না করতে পারলে ইপিসিআইতে পড়ার কোন মানেই হয় না। পল লাঁজেভি এখানেই পিয়ের কুরির অধীনে পড়াশোনা করেছেন, আবার এখানেই শিক্ষকতা করছেন। পিয়ের কুরির মৃত্যুর পর ফিজিক্সের হেড হয়েছেন পল লাঁজেভি। 
পিয়ের আর মেরি কুরির ছবি ফ্রেমে বাঁধানো আছে ফ্রেডের বাড়িতে। ছোটবেলা থেকেই ফ্রেড দেখেছে তার দিদিরা দেবীর মত শ্রদ্ধা করে মাদাম কুরিকে। পিয়ের আর মেরি কুরি ফ্রান্সের সকল ছাত্রছাত্রীর আদর্শ। পিয়েরের ছাত্র ও বন্ধু পল লাঁজেভিও এখন জীবন্ত কিংবদন্তী। লাঁজেভির প্যারা ও ডায়া-ম্যাগনেটিক থিওরি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। 
পল লাঁজেভির ল্যাবে যোগ দিয়ে ফ্রেড দেখলো তার মতো আরো একজন রসায়ন থেকে পদার্থবিজ্ঞানে চলে এসেছে। তার নাম পিয়ের বিকার্ড। ফ্রেডের সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেলো পিয়েরের। ফ্রেড পিয়েরকে নিজের ভাইয়ের মতোই দেখতো। ফিজিক্স ল্যাবে ক্রমেই খুব দক্ষ হয়ে উঠছে ফ্রেড। যন্ত্রপাতির কর্ম-পদ্ধতি বুঝতে তার সময় লাগে না মোটেও। অনেক যন্ত্রপাতি সে নিজেও তৈরি করতে শুরু করলো বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য। অনেক যন্ত্রের নকশা বদলে সে যন্ত্রগুলোর কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে তুলতে পারে। বাড়িতে নিজের তৈরি রেডিওতে সে আইফেল টাওয়ার থেকে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান শোনে। ক্রমেই মঁসিয়ে লাঁজেভির প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠে ফ্রেড। 
ইপিসিআইতে পড়াকালীন সময়ে প্রগতিশীল রাজনীতির আদর্শে উদ্দীপ্ত হন ফ্রেড। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের মানুষের মধ্যে বৈষম্যগুলো তাঁর চোখে ধরা পড়তে শুরু করেছে। ১৯২২ সালের ২১শে আগস্ট থেকে ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি একটি ইস্পাত কারখানায় কাজ করেন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। কারখানার শ্রমিকদের দুঃখকষ্ট আনন্দ-বেদনা একেবারে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় তাঁর। শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে যে সবারই খুব উপকার হবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই তাঁর। রাশিয়ায় ইতোমধ্যে কমিউনিস্ট বিপ্লব সাফল্য লাভ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তার হাওয়া ফ্রান্সের গায়েও লাগতে শুরু করেছে। 
সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মঁসিয়ে লাঁজেভির সাথেও আলোচনা হয় ফ্রেডের। বাড়তে থাকে তাঁর বিভিন্ন শ্রেণির ও পেশার বন্ধুর সংখ্যা। 
১৯২৩ সালে ইপিসিআই থেকে ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি মেজর নিয়ে পাস করলেন ফ্রেড। ইপিসিআই’র ডিগ্রি অনেকটা পলি-টেকনিক্যাল ডিগ্রির মতো। এই ডিগ্রি নিয়ে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা যায়, ইউনিভার্সিটি বা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ল্যাবোরেটরি সহকারি বা প্রদর্শক হওয়া যায়, কিন্তু শিক্ষক হওয়া যায় না। ফ্রেড বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি খুঁজতে শুরু করেছেন। কিন্তু মনের গভীরে স্বপ্ন আছে মাদাম কুরি বা মঁসিয়ে লাঁজেভির মত গবেষক হবার। কিন্তু গবেষণা করা তো সহজ কথা নয়। আর সে যোগ্যতা তার আছে কিনা তাও জানেন না ফ্রেড। 
কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে মিলিটারি ট্রেনিং-এর বাকি ছয় মাস পূর্ণ করার জন্য তিনি আর্টিলারি রিজার্ভ ফোর্সে যোগ দিলেন। ১৯২৪ সালের মে মাসে ফ্রেড সেনাবাহিনীর কমিশন লাভ করে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হলেন। 
মিলিটারি ক্যাম্পে তাঁর সাথেই ট্রেনিং করেছেন তাঁর বেস্ট ফ্রেন্ড পিয়ের বিকার্ড। বিকার্ডের সাথে আলোচনা করেন ফ্রেড ভবিষ্যতে কী করবেন তা নিয়ে। দু’জনেরই ইচ্ছে গবেষণা করার। কিন্তু ফ্রেডের সাহস নেই মঁসিয়ে লাঁজেভির সামনে গিয়ে তাঁর ইচ্ছার কথা বলার। আর মাদাম কুরির সাথে দেখা করার কথা তো তিনি স্বপ্নেও ভাবতে সাহস পান না। ফ্রেডকে সাহায্য করলেন বিকার্ড। তিনি গিয়ে পল লাঁজেভির সাথে দেখা করলেন। বললেন ফ্রেড আর তাঁর নিজের কথা। মঁসিয়ে লাঁজেভি প্রশ্ন করলেন, “গবেষণা করতে গেলে তোমাদের সবটুকু সময় আর মনযোগ যে গবেষণায় দিতে হবে তা কি জানো? দিনরাত লেগে থাকতে হবে বৈজ্ঞানিক সমস্যা নিয়ে। পারবে?”

“আই আই স্যার!” মিলিটারি কায়দায় জবাব দিলেন বিকার্ড।
“ঠিক আছে, দেখি কী করতে পারি। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দেখা করো আমার সাথে।”
নভেম্বরের শুরুতে পল লাঁজেভির সাথে দেখা করলেন ফ্রেড ও বিকার্ড। 
“বিকার্ড, তুমি আমার ল্যাবে যোগ দাও। আর ফ্রেড, তোমার কথা আমি মাদাম কুরিকে বলে রেখেছি। তুমি নভেম্বরের ২১ তারিখ সকাল ১১টায় রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে গিয়ে মাদামের সাথে দেখা করবে। ইন্টারভিউতে পাস করলে তুমি সেখানেই যোগ দিতে পারবে।”
উৎসাহ উত্তেজনা উৎকন্ঠায় দুরুদুরু বুকে নির্দিষ্ট দিনে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে গেলেন ফ্রেড। মাদাম কুরি তাঁর আদর্শ। কিন্তু কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেননি যে তাঁকে সামনা-সামনি দেখতে পাবেন, কথা বলতে পারবেন।

Monday, 17 September 2018

আইরিন কুরি ।। তৃতীয় পর্ব




১৯১৪ সালের গ্রীষ্মকালে মাদাম কুরি লা’আরকোয়েস্টের সমুদ্রের তীরে একটি বাসা ভাড়া করেন। ঐ জায়গাটা সমুদ্রের তীরে ছোট্ট একটা জেলে-পল্লী। সরবোন ইউনিভার্সিটির প্রফেসররা জায়গাটা এত পছন্দ করতেন যে ওখানকার সৈকতের নামই হয়ে গেল সরবোন বিচ। ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকায় চড়ে মাছ ধরতে পছন্দ করতেন অনেকে। 
১ম বিশ্বযুদ্ধের পাঁয়তারা চলছে ইউরোপে। মাদাম মেয়েদের নিরাপত্তার খাতিরে আইরিন আর ইভকে গভর্নেসের সাথে লা’আরকোয়েস্টের বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। আইরিন ও ইভ সেখানে সমুদ্রের তীরে ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যাবেলা বসে গভীর মনযোগে পড়াশোনা করে। সরবোন ইউনিভার্সিটিতে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে সে। 
যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। মেরি কুরি প্যারিস থেকে আইরিনকে চিঠি লিখলেন, “মনে হচ্ছে অবস্থা আরো খারাপ হবে। আইরিন, আমাদের দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি থাকতে হবে।” 
সেপ্টেম্বরে জার্মানি বেলজিয়াম আক্রমণ করলো। সেখান থেকে প্যারিসের দিকে আসতে শুরু করলো। লা’আরকোয়েস্টে আইরিন ও ইভকে  পোলিশ ভাষায় কথা বলতে শোনার পর অনেকে তাদেরকে জার্মান স্পাই সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো। তাতে আইরিন খুবই মন খারাপ করে মাকে চিঠি লিখলো - “আমাকে যারা জার্মান স্পাই বলছে তারা ফ্রান্সকে যতটুকু ভালোবাসে তাদের চেয়ে কোন অংশে কম ভালোবাসি না আমি ফ্রান্সকে। ফ্রান্স আমার জন্মভূমি। সবকিছুর চেয়েও বেশি আমি ফ্রান্সকে ভালোবাসি। আর আমাকেই কিনা বলে জার্মান স্পাই! মা, আমি প্যারিসে ফিরতে চাই এখনই।”

উত্তরে মেরি লিখলেন - “আইরিন, তুই যদি এখন ফ্রান্সের জন্য কাজ করার সুযোগ না পাস - ভবিষ্যতের ফ্রান্সের জন্য কাজ করার প্রস্তুতি নিতে থাক। এই যুদ্ধে হয়তো ফ্রান্সের অনেককেই আমরা হারিয়ে ফেলবো। তখন তাদের জায়গায় তোদেরকেই কাজ করতে হবে। মন দিয়ে ফিজিক্স আর ম্যাথ্‌স পড়তে থাক।” 
তার দু’সপ্তাহ পর আইরিন আর ইভকে প্যারিসে নিয়ে এলেন মাদাম কুরি। যুদ্ধের সময় রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের তেজষ্ক্রিয় রেডিয়াম যদি জার্মান সৈন্যরা পায় তাহলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। মাদাম নবনির্মিত রেডিয়াম ইনস্টিটিউট রক্ষা করার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। আইরিন যথাসম্ভব সাহায্য করছিল মায়ের কাজে।
যুদ্ধের প্রথম দশ দিনের মধ্যেই প্রায় তিন লাখ ফরাসি সৈন্য নিহত হয়, আহত হয় আরো বেশি। যুদ্ধাহত সৈনিকদের শরীর থেকে বুলেট বের করে আনতে আর্মি-সার্জনদের অনেক সমস্যা হয়। শরীরের নানা জায়গায় অস্ত্রোপচার করতে হয় - ফলে অনেক সময় সৈন্যদের প্রাণ বাঁচানো যায় না। মাদাম কুরি একটা উপায় বের করলেন। শরীরে বুলেটের অবস্থান নির্ণয় করার জন্য এক্স-রে ব্যবহার করা যায় কিনা দেখলেন তিনি। 
এক্স-রে’র বয়স তখন মাত্র পনেরো বছর। এক্স-রে তৈরি ও রেডিওগ্রাফ প্রযুক্তির সূচনা হয়েছে মাত্র। মাদাম কুরি মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং ও হেল্‌থ ইউনিটকে কাজে লাগিয়ে বিশটি এক্স-রে ইউনিট তৈরি করালেন। দুর্গম যুদ্ধক্ষেত্রের অস্থায়ী হাসপাতালে বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকে না। মেরি কুরি বিশটি ছোট ট্রাকের মধ্যে জেনারেটর সহ এক্স-রে ইউনিট বসিয়ে এরকম হাসপাতালে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করলেন। 
যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য ফরাসি মেয়েরা নার্সিং ট্রেনিং নিচ্ছিলো। আইরিনও নার্সিং ট্রেনিং নিলো। ইতোমধ্যে মাদাম গাড়ি চালানো শিখে নিয়েছেন। আইরিনকে সাথে নিয়ে নিজে ভ্রাম্যমান এক্স-রে ইউনিট চালিয়ে দুর্গম হাসপাতালে পৌঁছে যান তিনি। এক্স-রে মেশিন সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞান তিনি আইরিনকে দেন গাড়ি চালাতে চালাতেই। আইরিন দ্রুত শিখে নেয় সব। 

এক্স-রে ইউনিট নিয়ে কাজ করছেন  মেরি ও আইরিন কুরি

জটিল সার্জিক্যাল কেস এলেই মাদাম কুরির ডাক পড়ে। একবার এরকম এক ব্যারাকের হাসপাতালে যাবার সময় চেকপোস্টে মিলিটারিরা মাদামের গাড়ি থামায়। একজন সার্জেন্ট গাড়ির কাছে এসেই মাদামকে চিনতে পারে। স্যালুট দিয়ে বলে, “এতো আমাদের মাদাম কুরি আর লিটল কুরি”। আইরিন ভাবলো সার্জেন্ট তাকেই ‘লিটল কুরি’ বলেছে। কিন্তু মাদাম বললেন, “আমার গাড়িগুলোকে তারা লিটল কুরি বলে ডাকে”।

১৯১৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আইরিনের বয়স আঠারো হবার পর মাদাম তাকে কয়েকটা এক্স-রে ইউনিটের দায়িত্ব দিয়ে দিলেন। এক্স-রে ইউনিট বসানো, সার্জনকে রোগীর এক্স-রে নিতে সাহায্য করা, সৈনিকদের এক্স-রে মেশিন চালানোর ট্রেনিং দেয়া সব করতে লাগলো আইরিন একা। যুদ্ধাহত সৈনিকেরা পরমা সুন্দরী আইরিনকে সত্যি সত্যিই গ্রিক শান্তির দেবী ‘আইরিন’ হিসেবেই দেখতে শুরু করলেন।

আমেরিকান সৈন্যরা ফ্রান্সে এসেছে যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য। তারাও যোগ দেয় আইরিনের ট্রেনিং ক্লাসে। তরুণ সৈন্যরা আইরিনকে দেখে চোখ ফেরাতে পারে না। তাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে যায় আইরিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। কিন্তু স্বভাব-গম্ভীর আইরিন ট্রেনিং দেবার সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা শব্দও উচ্চারণ করে না। 

যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ফরাসি সৈনিকেরা বুঝতে পেরেছেন মাদাম কুরি ও রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের গুরুত্ব কতখানি। তারা রেডিয়াম ইনস্টিটিউটকে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য চারপাশে বালির বস্তা দিয়ে বাংকার তৈরি করে ট্যাংক নিয়ে পাহারা বসালো। সুন্দর নতুন বিল্ডিং-এর চারপাশে এরকম বিশ্রী বালির বস্তা দেখে আইরিনের মন খারাপ হয়ে গেল। সে বালির বস্তার ওপর সুন্দর করে ফুলের টব বসিয়ে দিলো।

১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষ হবার পর আইরিনকে মিলিটারি মেডেল প্রদান করা হয় যুদ্ধে তার অবদানের জন্য। কিন্তু মাদাম কুরিকে কোন রাষ্ট্রীয় সম্মান দেয়া হলো না।

কিছুদিন পর সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে আইরিন। আরো দু’বছর পর পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন আইরিন।

আইরিন তেজষ্ক্রিয়তার ধর্ম সংক্রান্ত বিজ্ঞানকে ভালোবেসে ফেলেছেন। মা মাদাম কুরি আইরিনকে তাঁর সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে। গবেষণা বেশ ভালো লাগতে শুরু করেছে তাঁর। তেজষ্ক্রিয় বস্তুর আভা দেখে বাচ্চা মেয়ের মত খুশি হয়ে উঠেন আইরিন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের গুরুত্বের চেয়েও আবিষ্কারের আনন্দটা অনেক বেশি দরকারি তাঁর কাছে। প্রতিযোগিতা ও সাফল্যে কিছু যায় আসে না তাঁর। বাবার পর্যায়ের কাজ তিনি করতে পারবেন কিনা সে ব্যাপারে কোন মাথাব্যথা তাঁর কখনোই ছিল না। তবে বাবার মত আইরিন বিজ্ঞান পড়েন প্রকৃতিকে জানার আনন্দে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভালোভাবে উপভোগ করার জন্য।

সেই সময় রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে চল্লিশ জন গবেষক কাজ করছেন। রেডিয়াম ইনস্টিটিউট সারা পৃথিবীর সেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একটি। পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে গবেষকরা এসে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে কাজ শেখেন। পোল্যান্ড থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে একজন গবেষক আসেন এখানে। পোল্যান্ড সরকার যদি বৃত্তি না দেয় - তাহলে মাদাম কুরি নিজে বৃত্তির ব্যবস্থা করে নিয়ে আসেন পোল্যান্ডের গবেষক। মাদাম কুরি মাতৃভূমির ঋণ শোধ করছেন যেভাবে পারেন।

গবেষণাগারে আইরিন

সহকর্মীদের সাথে ল্যাবে কাজ করার সময় আইরিন ভীষণ কড়া। জ্ঞানে এবং শারীরিক দক্ষতায়ও তিনি সবার চেয়ে এগিয়ে। ২৫ বছর বয়সেই তিনি অনেক বেশি জানেন। কিন্তু সামাজিক মেলামেশায় অভ্যস্ত না হবার কারণে তাঁর কথাবার্তা ভীষণ চাঁছাছোলা। তিনি কোদালকে শুধু কোদালই বলেন না - কোদালের খুঁত থাকলে তাও বলেন। বাড়ির লোকের সাথে মাঝে মাঝে হাসলেও - বাইরের কারো সামনে কখনোই হাসেননি আইরিন। অনেকে আইরিনকে অহংকারী ভেবে ভুল বোঝেন। ঈর্ষাতুর অনেকে মনে করেন ডিরেক্টরের মেয়ে হবার কারণে আইরিন ডাঁট দেখান। আড়ালে অনেকে তাঁকে ‘প্রিন্সেস’ বলেও ডাকেন। কিন্তু আইরিনের কিছুতেই কিছু যায় আসে না। আইরিন জানেন তাঁর বৈজ্ঞানিক ক্ষমতা কতটুকু। কিন্তু সে নিয়ে কোন অহংকার তাঁর নেই।
 
আইরিনকে কখনো কোন বিষয় নিয়ে রাগতে দেখেনি কেউ। আইরিন জীবনে কোনদিন মিথ্যা কথা বলেননি, কোনদিন কাউকে ইম্প্রেস করতে চান নি। তিনি যা তিনি তাই। 

মায়ের সাথে ল্যাবরেটরিতে আইরিন

মেরি কুরির সাথে কাজ করতে গিয়ে আইরিন শুধুমাত্র কন্যা, সহকর্মী বা সহযোগী নন, তারচেয়েও অনেক বেশি। বাইরের পৃথিবী মাকে যে এত কষ্ট দিয়েছে তা ভোলেননি আইরিন। আস্তে আস্তে আইরিন দুটো আলাদা মানুষে পরিণত হয়ে গেছেন। প্রকাশ্যে তিনি রিজার্ভ, গম্ভীর এবং মোটেও বন্ধুত্বপূর্ণ নন। কিন্তু পরিবারের মধ্যে তিনি শান্ত, রিলাক্সড। এমন কি মাঝে মাঝে হাসেনও। নিজে নিজে কাঁদতেও পারেন কষ্ট হলে। কিন্তু সবার সামনে অদ্ভুত শান্ত আইরিন। নিজের যেসবে আগ্রহ নেই সেসব এড়িয়ে চলেন অবলীলায়। 
মেরি আইরিনের মাঝে পিয়েরকে খুঁজে পেয়েছেন। আইরিনের স্বভাব অনেকটাই তার বাবার মত। আইরিনের সাথে কাজ করতে গিয়ে মেরির প্রায়ই মনে হয় যেন পিয়েরের সাথেই কাজ করছেন যেমন করেছিলেন রেডিয়াম আবিষ্কারের সময়। ক্রমে ক্রমে আইরিন হয়ে ওঠেন মেরির অবলম্বন। মেরিকে সারাক্ষণ আগলে রাখেন তিনি। 
১৯২১ সালের মে মাসে মায়ের সাথে আমেরিকায় যান আইরিন কুরি। ১৯১৯ সাল থেকেই আমেরিকান সাংবাদিক ও নারী উন্নয়ন কর্মী মেসি মেলোনি মাদাম কুরিকে আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে সংবর্ধনা দেবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মেরি তাঁর মেয়েদের ছাড়া আমেরিকা যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে মেলোনি তিন কুরিকেই আমেরিকায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করলেন। মেলোনি নিজে প্যারিসে এসে মেরি, আইরিন আর ইভকে সাথে নিয়ে গেলেন। 
‘অলিম্পিক’ নামক বিলাসবহুল জাহাজে চড়ে তাঁরা আটলান্টিক পাড়ি দিলেন। নিউইয়র্কের ডকে শত শত মানুষ মাদাম কুরিকে অভ্যর্থনা জানাতে আসেন। আমেরিকান-পোলিশ সংগঠনের তিনশ’ মেয়ের একটি দল গোলাপ ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নেয় মেরি, আইরিন ও ইভকে। 

অলিম্পিক জাহাজে আইরিন, মেরি ও ইভ কুরি

আমেরিকান সাংবাদিকরা ছেঁকে ধরলো তাঁদের। মাদাম কুরি ও আইরিনের মিডিয়াভীতি আছে, কিন্তু সপ্তদশী প্যারিস-সুন্দরী ইভ সপ্রতিভভাবে সাংবাদিকদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমেরিকান মিডিয়াতে ‘রেডিয়াম গার্ল’ হয়ে গেলেন। 
হোয়াইট হাউজের সংবর্ধনায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন হার্ডিং আমেরিকান জনগণের পক্ষ থেকে উপহার স্বরূপ এক গ্রাম রেডিয়াম তুলে দেন মাদাম কুরির হাতে। আমেরিকার অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় মাদাম কুরিকে সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করলো। 
অশক্ত শরীরে ভ্রমণ ও নানারকম অনুষ্ঠানের ধকল সহ্য করতে পারছিলেন না মাদাম কুরি। আইরিন সারাক্ষণ মায়ের পাশে আছেন। ফিলাডেলফিয়াতে গিয়ে মাদাম অজ্ঞান হয়ে গেলেন। শরীর এতই খারাপ হয়ে গেলো যে পরের দিন পেনসিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটির অনুষ্ঠানে যেতে পারলেন না। সেখানে মাদাম কুরির পক্ষে ‘ডক্টর অব ল’ ডিগ্রি গ্রহণ করলেন আইরিন কুরি। ইউনিভার্সিটি অব পিট্‌সবার্গেও মাদাম কুরির বদলে আইরিন কুরি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন। মাস খানেক পর প্যারিসে ফিরে এলেন তাঁরা। 
রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে মায়ের তত্ত্বাবধানে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য গবেষণা শুরু করলেন আইরিন। মায়ের আবিষ্কৃত পোলোনিয়াম থেকে যে আলফা পার্টিক্যাল বের হয় তার ধর্ম বিশ্লেষণ শুরু করলেন তিনি। তাঁর গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য হলো পদার্থের ভেতর দিয়ে যাবার সময় আলফা পার্টিক্যল কেন গতি হারায় এবং কীভাবে গতি হারায় তা খুঁজে বের করা। ১৯২১ সালে আইরিন কুরির প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। ইনস্টিটিউটের চিফ অব স্টাফ ফারনান্দ হলউইকের সাথে একের পর এক পরীক্ষণ চলতে থাকে আইরিনের। 

Sunday, 16 September 2018

আইরিন কুরি ।। দ্বিতীয় পর্ব




সাড়ে আট বছর বয়সেই বাবাকে হারিয়ে আরো গম্ভীর হয়ে গেলো আইরিন। দাদু যথাসম্ভব শোক সামলে নাতনিদের দেখাশোনা করতে লাগলেন আগের মতোই। মা প্যারিসের বাসা বদলে সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন স্‌সোতে। সেখানে তাদের নতুন বাসায় বেশ বড় একটা বাগান আছে। মা আইরিনকে বাগানের একটা অংশ দিয়ে দিলেন ইচ্ছেমত বাগান করার জন্য। সাত বছরের আইরিন নিজের হাতে বাগান করা শুরু করে - তাকে সাহায্য করেন দাদু।
            
দাদুর শরীর ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। বারো বছরের কিশোরী আইরিন যখনই সময় পাচ্ছে দাদুর সেবা করার চেষ্টা করছে।
            
১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দাদু মারা যান। আইরিনের পৃথিবীটা শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। বাবার মৃত্যুর পর দাদু ছিল তার বন্ধু, শিক্ষক আর পথপ্রদর্শক। দাদুর কাছ থেকে যে ভালোবাসা, দেশপ্রেম, মানবতার শিক্ষা আইরিন পেয়েছে তার তুলনা নেই। দাদুকে হারিয়ে আইরিনের হঠাৎ ভয় করতে শুরু করলো - মাকেও যদি কোনদিন এমনি ভাবে হারাতে হয়! না, সে তার মা ও ছোট বোনকে দেখে রাখবে।

মেয়েদের শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি কড়া নজর মেরির। তিনি বিশ্বাস করেন ছেলেমেয়েদের শরীর সুগঠিত হলে কোন রোগজীবাণু তাদের আক্রমণ করতে পারবে না, মানসিক বিকাশও অনেক ভালোভাবে হবে। মেয়েদেরকে সাইকেল কিনে দিয়েছেন - তারা ইচ্ছেমতো সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়ায় উন্মুক্ত প্রান্তরে। সাঁতার কাটা, ঘোড়ায় চড়া, নৌকা চালানো, স্কেটিং, স্কিইং, জিমনেস্টিক্‌স সবকিছু শিখিয়েছেন মেয়েদের। আইরিন দেখেছে - যে সাইকেলে চড়া তার মায়ের এত প্রিয় ছিল, স্বামীর মৃত্যুর পর একটা দিনের জন্যেও আর সাইকেলে চড়েননি তার মা। 


মায়ের সাথে আইরিন ও ইভ

সারা বছর প্রচন্ড পরিশ্রমের পর গ্রীষ্মকালে তারা ছুটি কাটাতে যেতো কোন পাহাড়ি অঞ্চলে বা সৈকত শহরে। ইভ আর আইরিন - দু’বোন আচরণগত দিক থেকে সম্পূর্ণ দু’রকম। ইভ আর আইরিন দুজনই লম্বা, স্লিম, সুন্দর। আইরিনের চুল কিছুটা ধূসর সোনালী, ইভের চুল কুচকুচে কালো। দুজনেরই পরিষ্কার দৃষ্টি - কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা আলাদা। আইরিন তার বাবার মত ধীরস্থির গম্ভীর। কিন্তু ইভ চঞ্চল হাসিখুশি। আইরিন অপরিচিত কারো সাথে কথা বলে না। আর ইভ অপরিচিতের সাথে পরিচিত হতে মোটেও সময় নেয় না। কারো সাথে দেখা হলে - হাই হ্যালো ইত্যাদি বলার অভ্যাস নেই আইরিনের। এমনকি বিদায় নেবার সময় ‘বাই’ও বলে না আইরিন। 

মেরি এসব সামাজিক সহবতকে খুব একটা প্রয়োজনীয় মনে করেন না। তিনি জানেন মানুষ নিজের যোগ্যতায় বড় হতে পারলে এসব সামাজিক সহবতে কিছুই যায় আসে না। তাই তিনি আইরিনকে এসব শেখানোর দরকার আছে বলে মনে করেননি।

আইরিন খেলাধূলায় খুবই দক্ষ। ইভ চমৎকার পিয়ানো বাজায়। আইরিনের ভাবনা-চিন্তার ধরন সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক, ইভের ভাবনাচিন্তা শৈল্পিক। পোশাকের ব্যাপারে ইভ ফ্যাশন-সচেতন, আর আইরিন ফ্যাশনের ধার ধারে না। তার কাছে পোশাক যথাযথ কাজের উপযোগী আরামদায়ক হলেই হলো। 
ফ্রান্সের স্কুলের গতানুগতিক শিক্ষাপদ্ধতির ওপর কোন আস্থা ছিল না মেরি কুরির। তিনি দেখছেন ফ্রান্সের স্কুলের শিক্ষার্থীরা দিন-রাত গাধার মত পরিশ্রম করছে, মুখস্থ করছে, পরীক্ষা দিচ্ছে - কিন্তু শিখছে না কিছুই। তিনি এই সিস্টেমের অবসান করতে না পারলেও নিজের মেয়েদের এই শিক্ষার নামে ‘কলুর বলদ’ বানাবার বিপক্ষে। তাঁর কাছের বন্ধু ও সহকর্মীদের নিয়ে তিনি একটা অপ্রাতিষ্ঠানিক কো-অপারেটিভ স্কুল-ব্যবস্থার চালু করলেন। 
ছয় জন প্রফেসরের দশজন ছেলেমেয়েকে নিয়ে শুরু হলো তাঁদের প্রচেষ্টা। প্রতি সপ্তাহে একেক জন প্রফেসর একেক বিষয়ে ক্লাস নেন। পদার্থবিজ্ঞানী জাঁ পেরি এবং পল লাঁজেভি পড়াতেন ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি ও গণিত। মেরি কুরি পড়াতেন এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্স।  সাহিত্য, শিল্পকলা, সাধারণ বিজ্ঞান, ইংরেজি, জার্মান ইত্যাদি পড়ানোর জন্য সেসব বিষয়ের বিশেষজ্ঞকে নিয়ে আসা হতো। একেক সপ্তাহে একেক প্রফেসরের বাড়িতে ক্লাস বসতো। দশজন ছেলেমেয়ের প্রত্যেকে প্রত্যেকের বন্ধু হয়ে যায়। আইরিনও খুব সহজ ছিল তার এসব বন্ধুদের সাথে। এই দশজনের বাইরে আইরিনের সারাজীবনে আর কোন ফ্রেন্ডসার্কেল গড়ে ওঠেনি।
আড়াই বছর চলার পর কো-অপারেটিভ স্কুলটি আর চললো না। প্রফেসররা নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। স্কুল উঠে গেলেও মেরি কুরি তাঁর ফিজিক্স স্কুলের একটা রুমে প্রতি বৃহস্পতিবার ছেলে-মেয়েদের সারাদিন পড়াতেন। মেরি বিশ্বাস করেন মৌলিক বিজ্ঞানে ভালো করতে হলে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত বোঝার কোন বিকল্প নেই। 

আইরিন চিন্তায় ধীরস্থির - গভীর মনযোগ দিয়ে চিন্তা করতে হয় তাকে। সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগে তার, তবে নির্ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। একদিন তার মা গণিতের ক্লাস নিচ্ছেন - আইরিনের মনযোগ কিছুক্ষণের জন্য অন্যদিকে চলে গেলো। এ অবস্থায় চারপাশে কী হচ্ছে সে সম্পর্কে কোন ধারণাই থাকে না তার। এসময় মেরি একটা প্রশ্ন করলেন আইরিনকে। আইরিন তার উত্তর দিতে পারলো না। মেরি আইরিনের খাতা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। আইরিন দেখলো তার খাতা খোলা জানালা দিয়ে উড়ে চলে গেলো বাইরে। সে চুপচাপ উঠে গিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে খাতাটা নিয়ে ক্লাসে এসে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রশ্নটির সঠিক উত্তর দিলো। 

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-পদ্ধতিকে অপছন্দ করলেও প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। উচ্চ মাধ্যমিকের সমতুল্য পরীক্ষা দেয়ার জন্য আইরিনকে একটি প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হলো। দু’বছর সেই স্কুলে পড়ার পর উচ্চমাধ্যমিক পাস করে আইরিন। 

আইরিনের স্কুলে পড়ার সময়েই প্যারিসের প্রেস-মিডিয়া মেরি কুরির নামে কুৎসা রটানো শুরু করে। ১৯১১ সালে আইরিন যখন সবে চৌদ্দ পেরিয়ে পনেরোয় পা দিয়েছে - একদিন স্কুলে গিয়ে সহপাঠিনীর আনা সংবাদপত্রে মঁসিয়ে লাঁজেভির পাশে মায়ের ছবি এবং কুৎসায় ভরা প্রতিবেদনটি পড়ে হঠাৎ মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে যায় আইরিন। সংবাদপত্র যে এত আজেবাজে কথা ছাপাতে পারে তা ভাবতেও পারেনি আইরিন। 

একটু পরে মাদাম পেরি স্কুলে এসে আইরিনকে নিয়ে গাড়িতে উঠলে আইরিন দেখে মা ও ইভ ভয়ে অপমানে লজ্জায় থরথর করে কাঁপছে। তাদের বাড়িতে হামলা করেছে প্যারিসের কিছু গুন্ডাপান্ডা লোক। মানুষের এরকম কদর্য দিকের সাথে পরিচিত হয়ে আরো গম্ভীর হয়ে যায় আইরিন। কিন্তু বুঝতে পারে বাবার মৃত্যুর পর তার মায়ের ব্যক্তিগত জীবন কতটাই কঠিন হয়ে গেছে। 

মা যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যস্ত থাকেন তা কিছুটা আন্দাজ করতে পারে আইরিন। কিন্তু মা যে বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী তা বুঝতে পারে মায়ের সাথে স্টকহোমে গিয়ে। ১৯১১ সালে দ্বিতীয় বার নোবেল পুরষ্কার পেলেন মাদাম কুরি। প্রথমবার ১৯০৩ সালে যখন বাবার সাথে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন মা - তখন অসুস্থতার কারণে বাবা-মা কেউই স্টকহোমে আসতে পারেননি। এবার রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পাবার পর প্যারিসের প্রেসের শত কুৎসা অপবাদ আক্রমণের পরেও মা একটুও দমে যাননি। মাথা উঁচু করে সুইডেনে এসেছেন নিজের যোগ্যতার স্বীকৃতি - নোবেল পুরষ্কার নিতে। 

অডিটোরিয়ামের চোখ ঝলসানো আলোয় সঙ্গীত মূর্ছনায় এবং প্রচন্ড করতালির সাথে রাজা পঞ্চম গুস্তাভের কাছ থেকে মা যখন নোবেল মেডেল নিচ্ছিলেন - গর্বে বুক ভরে গেছে আইরিনের। কিন্তু সেদিন একবারের জন্যও সে ভাবেনি যে চব্বিশ বছর পর তার নিজের জীবনেই সেরকম কোন ঘটনা ঘটবে। 

১৯১২ সালে প্যারিসে ফিরে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন মাদাম কুরি। কিডনির ইনফেকশানের জন্য প্রায় এক বছর ধরে চিকিৎসা নিতে হয় তাঁকে। প্রেসের অপপ্রচার থেকে বাঁচার জন্য ছদ্মনামে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অনেকটা গোপনে চিকিৎসা করাতে হয় তাঁকে। আইরিন ও ইভ তখন পোল্যান্ডে তাদের মাসীর কাছে চলে গিয়েছিলো। 

১৯১৩ সালে কিছুটা সুস্থ হয়ে মেয়েদের প্যারিসে নিয়ে আসেন মেরি। সেই সামারে আইরিন ও ইভকে নিয়ে সুইজারল্যান্ডে যান মেরি। সেখানে আইনস্টাইনের সাথে দেখা হয় তাঁদের। আইরিন ও ইভের সৌন্দর্যে মুগ্ধ আইনস্টাইন। ইভের পিয়ানোর সাথে বেহালা বাজালেন আইনস্টাইন। ফ্রান্সে ফিরে রেডিয়াম ইনস্টিটিউট তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মাদাম কুরি। প্রশাসক ও ব্যবস্থাপক হিসেবে মায়ের আরেক রূপ দেখতে পেলো আইরিন। 

মা নিজের কাজে এতই ব্যস্ত থাকেন যে আইরিন ও ইভ পুরোপুরি স্বনির্ভর হয়ে গেলো। বাসার কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য একজন গভর্নেস আছেন - তিনি রান্নাবান্না ও অন্যান্য কাজ করেন। আইরিন ও ইভ দুজনই যে যার নিজের কাজ করে নেয়। দু’বোন দু’রকম, দুজনের ইন্টারেস্টও দু’রকম।

আইরিন তার বাবার মতোই খুব স্বল্পভাষী, ধীরস্থির এবং গভীর চিন্তাশীল। বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে সবকিছু বিবেচনা করে দেখে আইরিন। কোন ব্যাপারেই সময় নষ্ট করার পক্ষপাতী নয় আইরিন। ফ্যাশনেবল প্যারিসে যেখানে মেয়েরা নিত্যনতুন ড্রেস আর রূপচর্চার পেছনে টাকা আর সময় খরচ করতে দু’বার চিন্তা করে না - সেখানে আইরিন কোন ধরনের প্রসাধন তো দূরের কথা ভালো কোন ড্রেসও কিনেনি কখনো। ঢিলেঢালা আরামদায়ক ও কাজ করতে সুবিধাজনক পোশাকই আইরিনের পছন্দ। তার জামার হাতায় পকেট থাকতো রুমাল রাখার জন্য। সময় বাঁচাবার জন্য তার সুন্দর কোঁকড়া চুল সে নিজেই কেটে ছোট করে রাখতো। 

[তৃতীয় পর্ব পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন]

Wednesday, 12 September 2018

আইরিন কুরি ।। প্রথম পর্ব




পদার্থবিজ্ঞানের জগতে বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের সমসাময়িক সময়ে আইরিনের জন্ম। উইলহেল্‌ম রন্টগেনের এক্স-রে আবিষ্কারের দুবছর পর, হেনরি বেকোয়ারেলের তেজষ্ক্রিয়তা আবিষ্কারের পরের বছর ১৮৯৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পিয়ের ও মেরি কুরির প্রথম সন্তান আইরিন কুরির জন্ম। নির্ধারিত সময়ের প্রায় চার সপ্তাহ আগে জন্ম হয় আইরিনের। মেরি কুরি তখন প্যারিসের মেয়েদের স্কুলে ফিজিক্সের শিক্ষক এবং পিয়ের কুরি ইকোল মিউনিসিপেল দ্য ফিজিক অ্যাট কিমিয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়েল্‌স (ইপিসিআই) এর ফিজিক্স ল্যাবের প্রধান। আইরিনের জন্মের দুসপ্তাহ পর তার দিদিমা (পিয়েরের মা) মারা যান। কিছুদিন পর পিয়ের তাঁর বাবাকে নিজেদের কাছে নিয়ে আসেন। ডাক্তার ইউজিন কুরি বুকে তুলে নেন নাতনি আইরিনকে। দাদুর সাথে গভীর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে আইরিনের।
            
গবেষণা ও পড়ানোর কাজে খুব ব্যস্ত আইরিনের মা-বাবা। পিয়ের গবেষণা করছেন কৃস্টালের চৌম্বক-ধর্ম নিয়ে। মেরি তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রির গবেষণার জন্য কাজ শুরু করেছেন সদ্য আবিষ্কৃত তেজষ্ক্রিয়তার ধর্মের ওপর। দিনরাত পরিশ্রম করে নতুন ধরনের তেজষ্ক্রিয় পদার্থের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন মেরি। আইরিনের জন্মের পর সামান্য কয়েক সপ্তাহ বিশ্রামের পর দ্রুত কাজে ফিরে গেছেন তিনি। কাজের অগ্রগতির পাশাপাশি আইরিনের অগ্রগতির কথাও লিখে রাখেন আলাদা আলাদা নোটবুকে। ১৮৯৮ সালের জুন মাসে পাওয়া গেলো নতুন তেজষ্ক্রিয় মৌল - নিজের জন্মভূমির নামানুসারে মেরি যার নাম রেখেছেন পোলোনিয়াম। পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে পাওয়া গেলো আরো শক্তিশালী নতুন মৌল রেডিয়াম। আইরিনের মতো রেডিয়াম-পোলোনিয়ামও যেন মেরির সন্তান। আইরিনের মা-বাবা আইরিনের চেয়েও বেশি সময় দিতে লাগলেন রেডিয়ামকে।
            
দাদুর কোলে-পিঠেই বেড়ে উঠছে আইরিন। শুধুমাত্র ছুটির দিনে কিছুটা সময় মা-বাবাকে কাছে পায়। তার বয়স যখন পাঁচ-ছয় বছর মা-বাবা আরো ব্যস্ত হয়ে যান। দেখা যায় সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরে ডিনারের পর আবার গবেষণায় ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। আইরিন তখন কান্নাকাটি শুরু করে। মা তাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করেন। অভিমান হয় ছোট্ট আইরিনের। মা-বাবা কেন তার কাছ থেকে দূরে থাকে সব সময়? অনেক সময় ঘুমের ভান করে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে থাকে। মা তখন তাকে দাদুর কোলে দিয়ে বাবার সাথে বেরিয়ে যান কাজে। আইরিন চোখ খুলে দেখে দাদুর মুখ।
            
দাদু আইরিনকে বোঝান - মা-বাবার গবেষণার কাজ কত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা এমন কিছু আবিষ্কার করেছেন যা দিয়ে পৃথিবীর কোটি মানুষের উপকার হবে। নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে মানুষের উপকারের চেষ্টা করার নামই যে মানব-ধর্ম তা আইরিনের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেন তার দাদু। মা-বাবার কথা শুনতে শুনতে ল্যাবরেটরি, রেডিওএক্টিভিটি, রেডিয়াম, পোলোনিয়াম ইত্যাদি শব্দের সাথে খুবই পরিচিত হয়ে যায় ছোট্ট আইরিন।
            
১৯০৩ সালে আইরিনের বয়স যখন সাড়ে পাঁচ - একদিন ঘুম থেকে জেগে দেখে মা-বাবা নেই। আইরিন ভাবলো তারা ল্যাবরেটরিতে গেছে। কিন্তু সন্ধ্যাবেলায়ও তারা না ফেরাতে দাদুকে জিজ্ঞেস করে আইরিন -           মি আর পি কোথায় গেছে গ্র্যানপি? মাকে মি আর বাবাকে পি বলে ডাকে আইরিন।
            মি-পি লন্ডনে গেছে।
            কেন?
            রয়েল ইনস্টিটিউটে বক্তৃতা দিতে।
            কেন?
           তারা রেডিয়াম আবিষ্কার করেছে তো, এই রেডিয়াম সম্পর্কে এখন পি আর মি ছাড়া আর কেউ তেমন কিছু জানে না। তাই সবাই তাদের কাছ থেকে জানতে চাচ্ছে।
            কেন?
            
ক্লান্তিহীনভাবে আইরিনের সীমাহীন কেন?র উত্তর দিয়ে যান গ্র্যানপি ইউজিন কুরি। আইরিনের কোন প্রশ্নের উত্তরেই তিনি বিরক্ত হন না। আইরিন এই বয়সেই অনেক ধীর-স্থির, বুদ্ধিমতী।


বাবা পিয়ের কুরি, মা মেরি কুরি, আর দাদু ইউজিন কুরির সাথে ছোট্ট আইরিন



দুদিন পর মা-বাবা ফিরে এসে আইরিনের গলায় পরিয়ে দিলেন একটা সোনার মেডেল।
            এটা কী পি?
            এটা হলো ড্যাভি গোল্ড মেডেল।
            ড্যাভি কী?
           ড্যাভি কী নয়, কে। স্যার হ্যামফ্রি ড্যাভি ছিলেন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত রসায়নবিদ। তাঁর নামে রয়েল সোসাইটি এই মেডেল দেয় প্রতি বছর। এ বছর তোমার মি আর পি-কে দিয়েছে এই মেডেল। দেখো তো মেডেলে কার নাম লেখা আছে।
            
আইরিন ততদিনে বানান করে পড়তে শিখে গেছে। ফরাসির পাশাপাশি ইংরেজিও শিখছে। দেখলো মেডেলের গায়ে লেখা আছে পিয়ের কুরি এন্ড মেরি কুরি - তার পি আর মির নাম।
            
১৯০৩ সালেই আইরিন দেখলো মা-বাবা কত বিখ্যাত হয়ে গেছেন। জুন মাসে মা সরবোন ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পেলেন। দাদু যখন বললেন - মি এখন ডক্টর মেরি কুরি - আইরিন জিজ্ঞেস করে - তোমার মতো মিও কি ডাক্তার হয়েছে?
            আমার মতো না। মি হলো ডক্টরেট। সারা ইউরোপে তোমার মি-ই হলো প্রথম মহিলা ডক্টরেট।
            
কয়েক মাস পরেই মেরি ও পিয়ের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেন। আইরিন জানলো যে তার মি-ই সারা পৃথিবীতে প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী যিনি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। সংবাদপত্রে পির ছবি বের হয়েছে। সাংবাদিকরা বাড়িতেও আসতে শুরু করেছে।
            
একদিন সকালে মা-বাবা বেরিয়ে গেছেন। দাদু গেছেন দোকানে। কাজের লোক রান্না করছে। আর আইরিন ডিডির সাথে খেলছে। ডিডি হলো তার পোষা সাদা-কালো বেড়াল। খেলতে খেলতে আইরিন দেখলো দুজন লোক ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর সমানে ছবি তুলছে। মা-বাবার পড়ার টেবিল, বুক শেলফের বই, টেবিলে রাখা ফুলের তোড়া সবকিছুই খুটিয়ে দেখছে তারা। আইরিন কিছু না বলে চুপচাপ দেখছে তারা কী করে। এবার তারা আইরিনকে প্রশ্ন করা শুরু করলো - তোমার মা-বাবা কোথায়?
            ল্যাবরেটরিতে
            তুমি কি একা একা বাসায় থাকো?
            না
            আর কে থাকে?
            গ্র্যানপি
            তোমার মা কি রান্না করেন? কখন ঘুমাতে যান তারা? কখন ঘুম থেকে উঠেন? কখন অফিসে যান?
            
এরকম প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে লোকদুটো। ছয় বছরের শিশু আইরিনও বুঝতে পারছে এসব প্রশ্নের সাথে রেডিয়ামের কোন সম্পর্ক নেই, তাই এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কোন দরকার নেই। সে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে খাবার খেতে শুরু করলো। লোকদুটো ডাইনিং টেবিলে গিয়ে আইরিনের ছবি তুলে চলে গেলো।
            
পরদিন সংবাদপত্রে আইরিনের ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো মা নোবেল পায়, শিশু একা একা খাবার খায়। প্রতিবেদনে সংসার ও সন্তানের প্রতি অবহেলা করছেন বলে মেরির সমালোচনা করা হয়।
            
বিনা অনুমতিতে শিশু আইরিনের ছবি তুলে তা সংবাদপত্রে ছাপানোয় ভীষণ বিরক্ত পিয়ের ও মেরি কুরি। পিয়ের সংবাদপত্রের সম্পাদককে চিঠি লিখে জানান তাঁর ক্ষোভের কথা।
            
সাংবাদিকরা মা-বাবার সময় নষ্ট করেছে দেখেছে আইরিন। মা-বাবা বাসায় আসার সাথে সাথে তারাও এসে হাজির হয়। আগে মা-বাবাকে যতটুকু কাছে পেতো এখন তাও পায় না আইরিন। সাংবাদিকদের ওপর তার তাই ভীষণ রাগ। সেই ছোটবেলায় প্রেস-মিডিয়ার প্রতি যে বিরক্তি এসেছে আইরিনের - সারাজীবনেও সে বিরক্তি যায়নি। 
            
একদিন সন্ধ্যায় আইরিন দেখলো মা-বাবা কাজ থেকে ফিরে জামা-কাপড় বদলে আবার বেরোচ্ছেন। মা-কে আগে কখনো এরকম সুন্দর ইভনিং-গাউন পরতে দেখেনি আইরিন। কী যে সুন্দর লাগছে মাকে - একেবারে ছবির বইয়ের রানির মত লাগছে। বেরোনোর সময় আইরিনকে চুমু খেয়ে মা বললেন, লক্ষ্মী হয়ে থেকো সোনা। গ্র্যানপির সাথে খেয়ে ঘুমিয়ে যেয়ো। আমাদের আসতে দেরি হতে পারে।
            কেন যাচ্ছো মি? এখন তুমি আমার সাথে একটুও থাকো না।
            কী করবো সোনা, প্রেসিডেন্ট নিমন্ত্রণ করেছেন আমাদের। কীভাবে না বলি?
            প্রেসিডেন্ট তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে।
            
পিয়ের আইরিনের মাথায় হাত রেখে আদর করছিলেন। বললেন, মেয়ে ঠিকই বলছে মেরি। সবাই মিলে আমাদের সবটুকু সময় ছিনিয়ে নিচ্ছে। নোবেল পুরষ্কার পাবার পর গবেষণা তো দূরের কথা, মেয়েটাকেও ঠিকমত সময় দিতে পারছি না।

আইরিনকে তার দাদুর কাছে রেখে মা-বাবা চলে গেলেন প্রেসিডেন্টের বাসভবনে তাঁদের সম্মানে দেয়া ডিনারপার্টিতে। আইরিন দাদুকে জিজ্ঞেস করে, গ্র্যানপি, যারা ছিনিয়ে নেয় তারা কি ডাকাত?
            প্রচলিত অর্থে ছিনতাইকারি বা ডাকাত বলা যায়। কেন জিজ্ঞেস করছো?
            যারা মি-পির সময় ছিনিয়ে নিচ্ছে তারাও ডাকাত?
            হ্যাঁ, তা তুমি বলতে পারো, কিন্তু আইরিন ডাকাতরা তো শুধু জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। সময় কিন্তু জিনিস নয়।
            
তারপর দাদু নাতনিকে সময় সম্পর্কে ধারণা দিতে শুরু করলেন। আইরিন ঘড়িতে সময় দেখতে চিনে গেলো। সময় নষ্ট করা যে খারাপ তাও জেনে গেলো।
            
কিছুদিন পর মি-পির সাথে ছুটি বেড়াতে গেলো আইরিন। সেখানে সমুদ্রের পানিতে সাঁতার কাটলো আইরিন। তিন বছর বয়স হবার আগেই সাঁতার কাটতে শিখে গেছে আইরিন। পাঁচ বছর হবার আগেই সাইকেল চালাতে পারে। মি-পি গ্র্যানপি সবাই বাগান করতে পছন্দ করে। আইরিনও সেখানে হাত লাগায়।
            
১৯০৪ সালের ডিসেম্বরে আইরিনের ছোটবোন ইভের জন্ম হয়। আইরিনের একজন খেলার সাথি হলো। পাশের বাসার প্রফেসর জাঁ পেরির ছেলে-মেয়ে আলিন ও ফ্রান্সিস আইরিনের ভালো বন্ধু। আইরিন তাদের সাথেও খেলে। কিন্তু অপরিচিত কারো সাথে আইরিন কথাই বলতে চায় না। যতই বড় হচ্ছে তার এই সমস্যা বাড়ছে। মেরি কুরি মেয়ের এই সমস্যা কাটানোর জন্য বাড়িতে অনেক বন্ধুবান্ধব ডেকে পার্টি দিয়েছেন - যেন তাদের ছেলে-মেয়েদের সাথে আইরিনের বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু আইরিন তাদের কারো সাথেই কোন কথা বলে না। বাইরের কারো সামনে সে হাসেও না, গম্ভীর হয়ে থাকে।

১৯০৬ সালের এপ্রিলে আইরিনের বয়স যখন সাত - আইরিনের মনে আছে খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন ও তার আগের দিন। তারা ছুটি কাটিয়ে মাত্র ফিরেছে প্যারিসের বাড়িতে। সেদিন বাবা অফিসে যাওয়ার সময় আইরিন দোতলায় ছিল। মা তখন তাকে রেডি করাচ্ছিলেন স্কুলে নিয়ে যাবার জন্য। স্কুল মানে আইরিনের স্কুল নয়, মায়ের স্কুল অব ফিজিক্স, মা যেখানে পড়ান। ইভ হবার পর মা-বাবা বেরিয়ে গেলে গভর্নেস ইভের দেখাশোনা করেন। দাদুও বুড়ো হচ্ছেন। তাই মা আইরিনকে সাথে নিয়ে যান। সেদিনও আইরিন মায়ের সাথে থেকেছে। মায়ের ছাত্রীদের সাথে চুপচাপ বসে মায়ের পড়ানো দেখেছে। মায়ের ছাত্রী ইউজেনির সাথে খুব বন্ধুত্ব আইরিনের। ইউজেনি আইরিনের সাথে অনেক গল্পও করেছে। মা সেদিন তাড়াতাড়ি পড়ানো শেষ করে দ্রুত বাসায় ফিরেছেন। আসার সময় বলেছেন রাতে অনেক প্রফেসর আসবেন বাসায় ডিনার করতে।
            
কিন্তু বাসায় ফিরে দেখে অনেক মানুষ তাদের বাসায়। আইরিন ভাবলো এই প্রফেসরদের কথাই কি মি বলেছিলেন? কিন্তু মা ইভ আর তাকে হেনরিয়েট আন্টিদের বাসায় পাঠিয়ে দেন। আইরিন বুঝতে পারে না কী হয়েছে। সে আলিন আর ফ্রান্সিসের সাথে খেলা করেছে।
            
হেনরিয়েট আন্টির সাথে মায়ের কথাবার্তা শুনে আইরিন বুঝতে পারছে তার বাবার কিছু হয়েছে। ষোল মাস বয়সী ছোট্ট ইভ কিছু বোঝে না, কিন্তু আইরিন বুঝতে পারে। সে মায়ের কাছে যাবার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। মা আইরিনকে বোঝান যে বাবার মাথায় আঘাত লেগেছে, বাড়ি ফিরতে কয়েক দিন দেরি হবে। পরের দিনই আইরিন বুঝতে পারে বাবা আর কখনো বাড়ি ফিরবেন না, বাবা মারা গেছেন।

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে

Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩১-৩২

----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ __________________________...

Popular Posts