১৯২৪ সালের নভেম্বরে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য থিসিস লিখছেন আইরিন। থিসিসে তিনি যেসব পরীক্ষালব্ধ ফলাফল বিশ্লেষণ করেছেন তার সবকিছুই নতুন। সেই সময় পোলোনিয়াম সম্পর্কে যত পরীক্ষা আইরিন করেছেন পৃথিবীর আর কোথাও কেউ ততটা করেননি। একদিন সকালবেলা ল্যাব থেকে করিডোর পেরিয়ে মায়ের অফিসের দিকে যাবার সময় আইরিন দেখলেন একজন আর্মি অফিসার মায়ের অফিস থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে নিচে চলে গেলো। আইরিন সাধারণত এসব খেয়াল করেন না, কিন্তু ইনস্টিটিউটে হঠাৎ মিলিটারি দেখে তাঁর দৃষ্টি চলে গেছে সেদিকে। মাকে জিজ্ঞেস করলেন, “মিলিটারি কেন এসেছিল মাদাম?”
“মঁসিয়ে লাঁজেভি পাঠিয়েছেন। এখানে যোগ দেবে ল্যাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে।”
আইরিন আর কোন কৌতূহল দেখালেন না।
এর দু’সপ্তাহ পর একদিন সন্ধ্যাবেলা আইরিন বাসায় তাঁর রুমে বসে থিসিস লিখছেন। মা তাঁর পড়ার ঘরে। গভর্নেস রান্নাঘরে ডিনার রেডি করছেন। ইভ বন্ধুদের সাথে কনসার্টে গেছে। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে কলিংবেল বেজে উঠলো। কে এলো এই সন্ধ্যায়? ইভ কখনো কলিংবেল বাজায় না, বেরোনোর সময় সে চাবি নিয়ে বেরোয়।
আইরিন দরজা খুলে দেখলেন গাঢ় নীল ইউনিফর্ম পরা এক মিলিটারি অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন হাতে একটা ফাইল নিয়ে। আইরিনের মনে পড়লো সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখা অফিসারের কথা। সেদিন তার চেহারা দেখেননি। লম্বা স্বাস্থ্যবান সুদর্শন মিলিটারি অফিসার আইরিনকে দেখে বললেন, “মাদ্মাজেল, মাদাম কি বাসায় আছেন?”
“মাদাম কি জানেন যে আপনি আসবেন?”
“না। আমার নাম ফ্রেডেরিক জুলিও। ফ্রেড বললেই হবে। মাদামের ল্যাবে আমার যোগ দেয়ার ব্যাপারে কথা চলছে। আমি ইনস্টিটিউটে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওখানে কাউকে না পেয়ে বাসায় আসতে হলো। মাদামের সাথে বিশেষ দরকার।”
আইরিন কোন কিছু না বলে ভেতরে চলে গেলেন। খুব অবাক হয়ে গেলেন আর্মি অফিসার। এ কী ধরনের ব্যবহার? একটু বসতেও বললেন না! দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেই চলে গেলেন! একটু পরে মাদাম কুরি এসে ফ্রেডকে ডেকে নিয়ে বসালেন। আইরিন ফ্রেডেরিকের আসার খবরটা মাকে দিয়েই নিজের রুমে চলে গিয়েছিলেন। ফ্রেড কী দরকারে এসেছিলেন সে ব্যাপারে সামান্য কৌতূহলও হয়নি তাঁর।
ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে ফ্রেডেরিকের সাথে আবার দেখা হলো আইরিনের। মাদাম কুরি আইরিনকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর অফিসে। আইরিন ঢুকতেই মাদাম বললেন, “মঁসিয়ে জুলিও আজ থেকে ইনস্টিটিউটে কাজ শুরু করলেন। তাঁকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিন। আর তাঁকে ট্রেইন-আপ করার দায়িত্বও আপনার মাদ্মাজেল।”
মাদাম নিজের মেয়ের সাথেও এরকম ফরমালভাবে কথা বলছেন দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলেন ফ্রেড। আইরিন মাদামের রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফ্রেড তাঁকে অনুসরণ করলেন। আইরিন দ্রুত পায়ে করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “আমি এখন আপনাকে আমাদের অন্যান্য গবেষকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। তারপর আপনাকে কী কী করতে হবে দেখিয়ে দেবো। কোন প্রশ্ন থাকলে আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন মঁসিয়ে।”
“আমাকে ফ্রেড বলে ডাকলেই খুশি হবো।”
“তা সম্ভব নয়। ইনস্টিটিউটের নিয়ম হলো এখানে কাউকে নাম ধরে ডাকা যাবে না। এমন কি আমার মাও আমাকে নাম ধরে ডাকেন না এখানে। কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা কাজের সময় নষ্ট করে বলে বিশ্বাস করেন আমার মা।”
“এখন বুঝতে পারলাম আপনার মা আপনার সাথে ওভাবে কথা বলছিলেন কেন।”
পরবর্তী আধঘন্টার মধ্যে আইরিন ঝড়ের বেগে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন ফ্রেডেরিক জুলিওর। তারপর আরো দ্রুত বলে গেলেন ফ্রেডকে কী কী করতে হবে। সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট ফ্রেডেরিক জুলিওর মনে হলো রিসার্চ সুপারভাইজার নয়, ফিল্ড মার্শাল আইরিন কুরির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। চঞ্চল হাসিখুশি টগবগে সৈনিক ফ্রেড বুঝতে পারছেন না কীভাবে টিকে থাকবেন বা আদৌ টিকতে পারবেন কিনা এই গুরুগম্ভীর পরিবেশে। তবে এটুকু বুঝতে পারছেন - পারতে তাঁকে হবেই।
ফ্রেডেরিক
ফ্রেডের জন্ম ১৯০০ সালের ১৯শে মার্চ প্যারিসে। ফ্রেডের জন্মের সময় তার মা এমিলি জুলিওর বয়স ছিল ৪২ এবং বাবা হেনরি জুলিওর বয়স ৫৩। বেশি বয়সে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে এমিলির প্রাণ যায় যায় অবস্থা। তবে কিছুদিন পর তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। এমিলির ছয় সন্তানের মধ্যে সবার ছোট ফ্রেড। ছয় জন ছেলে-মেয়ের মধ্যে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে শৈশবেই। ফ্রেডের যখন জন্ম হয় তখন তার বড়দিদি জেনির বয়স ১৮, ছোটদিদি মার্গেরিটের বয়স ১৩, আর দাদা হেনরি জুনিয়রের বয়স ১১। মায়ের অসুস্থতার কারণে জেনি অনেকটা মায়ের মতই আগলে রাখে ফ্রেডকে। ফ্রেডদের পরিবারের সবাই খুব হাসিখুশি প্রাণবন্ত। বাবা হেনরির ছোট একটা ব্যবসা আছে - এবং যা আয় করেন তা দিয়ে বেশ সচ্ছলভাবেই সংসার চলে। তাঁর নেশা হলো শিকার করা, মাছ ধরা আর সংগীত রচনা। মায়ের শখ হলো নানারকম রান্না করা। জেনি নাট্যকলার ছাত্রী, মার্গেরিট চমৎকার ছবি আঁকেন। গান বাজনা নাটক খেলাধূলা ছবি-আঁকা সব মিলিয়ে প্রতিদিনই যেন তাদের বাড়িতে উৎসব চলছে। ফ্রেড সবার আদরের - ফলে সবার যা কিছু ভালো সবই সে আয়ত্ব করে ফেলে। বাবার কাছ থেকে শিকার আর মাছ ধরার নেশা পেয়ে যায়। সুযোগ পেলে পিয়ানো নিয়েও বসে যায় সুর সাধনায়। বোনদের সাথে নাটকের সংলাপ আওড়ায়, ছবি আঁকে, ভাইয়ের টিমে ফুটবল খেলে।
স্কুলে পড়ার সময় পড়াশোনার চেয়েও খেলাধূলায় বেশি সময় দেয় ফ্রেড। ফলে মেধাবী ছাত্র বলতে যেরকম ছাত্রদের বোঝায় সেরকম ছাত্র ছিল না ফ্রেড। মাঝারি মানের রেজাল্ট নিয়ে ফ্রেড পাস করে যাচ্ছিলো স্কুলের পরীক্ষাগুলো। কিন্তু শারীরিক শক্তি ও ক্রীড়ানৈপুণ্যে ফ্রেড ছিল সবার সেরা। ফলে তার সাথে সবারই বন্ধুত্ব হয়ে যেতো খুব সহজেই। হাসি আনন্দে বড় হচ্ছিলো ফ্রেড। কিন্তু ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার পর তার বড়ভাই হেনরি জুনিয়রকে যুদ্ধে যেতে হয়। তার কিছুদিন পর আর কোন খবর পাওয়া যায়নি হেনরির, মৃতদেহও পাওয়া যায়নি। এই কষ্ট কাটিয়ে উঠতে অনেক বছর সময় লেগেছে তাদের সবার।
কৈশোর বয়স থেকেই চৌকস খেলোয়াড় হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে ফ্রেড। এসময় নানারকম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার দিকেও ঝোঁক যায় ফ্রেডের। চৌদ্দ বছর বয়স থেকে বাড়িতেই নানারকম মেকানিক্যাল ইলেকট্রিক্যাল কলকব্জা নিয়ে কাজ শুরু করে দেয়। বাড়িতে কলকব্জার স্তুপ জমে উঠে।
বাড়িতে ফ্রেড ভীষণ অগোছালো। সবার আদর পেতে পেতে এমন অবস্থা হয়েছে যে বাড়িতে নিজের জামা-কাপড়টাও গুছিয়ে রাখে না ফ্রেড। মা মুখে বিরক্তি প্রকাশ করলেও আরেক ছেলেকে হারিয়ে ফ্রেডকেই সমস্ত স্নেহ ঢেলে দিয়ে ফ্রেডের সব জঞ্জাল গুছিয়ে রাখেন। ফ্রেড নানারকম যন্ত্রাংশ কিনে বাড়িতে বসে রেডিও বানাবার চেষ্টা করছে। আইফেল টাওয়ার থেকে বেতার সম্প্রচার চালু হয়েছে তখন প্যারিসে।
সতেরো বছর বয়সে উচ্চ-মাধ্যমিকের সমপর্যায়ের পড়াশোনা শেষ হলো ফ্রেডের। তারপর ভর্তি হলো ইকোল ল্যাভয়সিয়েতে। এখানে শিক্ষার্থীদের ইপিসিআই-তে ভর্তির পরীক্ষায় পাস করার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়। ফ্রেড স্কুলে পড়াশোনায় খুব বেশি সময় দেয়নি - ফলে ল্যাভয়সিয়েতে এসে এতোবেশি পড়ার চাপ নিতে পারছিলো না। ফলে পরীক্ষাগুলোতে মোটেও ভাল করছিল না সে। ১৯১৮ সালের জুলাই মাসে ইপিসিআই’র ভর্তি পরীক্ষা হলো। ফ্রেড ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারলো না।
ফ্রান্সে ছেলেদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয় বিশ বছর বয়সে। ফ্রেড মাত্র আঠারো পেরিয়েছে। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের কারণে ফ্রান্সের প্রচুর সৈনিকের দরকার। সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ডাক পড়লো ফ্রেডের। ফ্রেডের মনে হলো ভালোই হলো। ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করে কী করবে বুঝতে পারছিল না সে। এখন মিলিটারি ট্রেনিং নিতে নিতে ঠিক করতে পারবে কী করবে।
মনপ্রাণ দিয়ে ট্রেনিং করলো ফ্রেড। শারীরিক দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা ও ফ্রেন্ডলি স্বভাবের কারণে সবার প্রিয় হয়ে উঠলো ফ্রেড। ১৯১৮’র শেষে তার ফ্রন্টে যাবার কথা ছিল - কিন্তু তার আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। এক বছর ট্রেনিং-এর ছয় মাস বাকি থাকতেই ফ্রেডের ছুটি হয়ে গেলো। বাকি ছ’মাস ট্রেনিং বিশ বছর বয়স হবার পরে করতে হবে। ফ্রেড ইপিসিআইতে আবার ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। মিলিটারি ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে সে শিখে এসেছে - ঠিকমতো চেষ্টা করলে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। এবার দিনরাত পড়াশোনায় ডুবে গেলো ফ্রেড।
১৯১৯ সালের ৩০ জুন থেকে পরীক্ষা শুরু হয়ে ১২ জুলাই পরীক্ষা শেষ হলো। অনেকগুলো বিষয়ে লিখিত, ব্যবহারিক আর মৌখিক পরীক্ষার সমন্বয়ে ভীষণ কঠিন এই পরীক্ষা। ২১ জুলাই পরীক্ষার ফল বের হলো। ফ্রেড পাস করেছে। শুধু তাই নয় - গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও উচ্চতর গণিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে ফ্রেড। ইপিসিআইতে ভর্তির মেধাতালিকার শীর্ষে স্থান করে নিলো ফ্রেড।
কিন্তু ভর্তির ক’দিন আগেই হঠাৎ প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়লো ফ্রেড। শুরুতে মনে হলো ফ্লু হয়েছে। যুদ্ধের পর ফ্রান্সে মহামারির মত ফ্লু হচ্ছে ঘরে ঘরে। ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসা করা হলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। দিনের পর দিন অবস্থা খারাপ হচ্ছে ফ্রেডের। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ডাকা হলো। তিনি পরীক্ষা করে ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলেন। ফ্রেডের মাকে বললেন, “মন শক্ত করুন মাদাম জুলিও। আপনার এই ছেলেটিকেও তো আর ধরে রাখতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। তার অবস্থা খুবই খারাপ। তার ভুল চিকিৎসা করা হয়েছে। টাইফয়েডের জায়গায় ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসা করা হয়েছে। আমি জানি না কতটুকু কী করতে পারবো।”
মন শক্তই আছে ফ্রেডের মায়ের। তিনি বুঝতে পারেন না বড় বড় ডাক্তাররা এরকম কথা কেন বলেন। তাঁর নিজের বেলাতেও এরকম কথা শুনতে হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিল আঠারো বছরের বেশি তিনি বাঁচবেন না। অথচ তিনি এই ৬১ বছর বয়সেও বেঁচে আছেন। সুতরাং তাঁর ছেলেও বাঁচবে। অনেক দিন রোগে ভোগার পর ফ্রেড সেরে উঠলো।
ফ্রেডের ইপিসিআই’র ক্লাস শুরু হলো ১৯২০ সালের অক্টোবরে। পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের জন্য খুবই বিখ্যাত এই প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্স এবং কেমিস্ট্রি। ফ্রেড শুরুতে প্রধান বিষয় রসায়ন নিয়ে রসায়ন গবেষণাগারের প্রধান আলবিন হলারের অধীনে কাজ শুরু করলো। কিন্তু ক’দিন পরেই মত বদলালো। তার মনে হলো পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান পল লাঁজেভি’র অধীনে কাজ না করতে পারলে ইপিসিআইতে পড়ার কোন মানেই হয় না। পল লাঁজেভি এখানেই পিয়ের কুরির অধীনে পড়াশোনা করেছেন, আবার এখানেই শিক্ষকতা করছেন। পিয়ের কুরির মৃত্যুর পর ফিজিক্সের হেড হয়েছেন পল লাঁজেভি।
পিয়ের আর মেরি কুরির ছবি ফ্রেমে বাঁধানো আছে ফ্রেডের বাড়িতে। ছোটবেলা থেকেই ফ্রেড দেখেছে তার দিদিরা দেবীর মত শ্রদ্ধা করে মাদাম কুরিকে। পিয়ের আর মেরি কুরি ফ্রান্সের সকল ছাত্রছাত্রীর আদর্শ। পিয়েরের ছাত্র ও বন্ধু পল লাঁজেভিও এখন জীবন্ত কিংবদন্তী। লাঁজেভির প্যারা ও ডায়া-ম্যাগনেটিক থিওরি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
পল লাঁজেভির ল্যাবে যোগ দিয়ে ফ্রেড দেখলো তার মতো আরো একজন রসায়ন থেকে পদার্থবিজ্ঞানে চলে এসেছে। তার নাম পিয়ের বিকার্ড। ফ্রেডের সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেলো পিয়েরের। ফ্রেড পিয়েরকে নিজের ভাইয়ের মতোই দেখতো। ফিজিক্স ল্যাবে ক্রমেই খুব দক্ষ হয়ে উঠছে ফ্রেড। যন্ত্রপাতির কর্ম-পদ্ধতি বুঝতে তার সময় লাগে না মোটেও। অনেক যন্ত্রপাতি সে নিজেও তৈরি করতে শুরু করলো বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য। অনেক যন্ত্রের নকশা বদলে সে যন্ত্রগুলোর কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে তুলতে পারে। বাড়িতে নিজের তৈরি রেডিওতে সে আইফেল টাওয়ার থেকে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান শোনে। ক্রমেই মঁসিয়ে লাঁজেভির প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠে ফ্রেড।
ইপিসিআইতে পড়াকালীন সময়ে প্রগতিশীল রাজনীতির আদর্শে উদ্দীপ্ত হন ফ্রেড। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের মানুষের মধ্যে বৈষম্যগুলো তাঁর চোখে ধরা পড়তে শুরু করেছে। ১৯২২ সালের ২১শে আগস্ট থেকে ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি একটি ইস্পাত কারখানায় কাজ করেন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। কারখানার শ্রমিকদের দুঃখকষ্ট আনন্দ-বেদনা একেবারে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় তাঁর। শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে যে সবারই খুব উপকার হবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই তাঁর। রাশিয়ায় ইতোমধ্যে কমিউনিস্ট বিপ্লব সাফল্য লাভ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তার হাওয়া ফ্রান্সের গায়েও লাগতে শুরু করেছে।
সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মঁসিয়ে লাঁজেভির সাথেও আলোচনা হয় ফ্রেডের। বাড়তে থাকে তাঁর বিভিন্ন শ্রেণির ও পেশার বন্ধুর সংখ্যা।
১৯২৩ সালে ইপিসিআই থেকে ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি মেজর নিয়ে পাস করলেন ফ্রেড। ইপিসিআই’র ডিগ্রি অনেকটা পলি-টেকনিক্যাল ডিগ্রির মতো। এই ডিগ্রি নিয়ে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা যায়, ইউনিভার্সিটি বা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ল্যাবোরেটরি সহকারি বা প্রদর্শক হওয়া যায়, কিন্তু শিক্ষক হওয়া যায় না। ফ্রেড বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি খুঁজতে শুরু করেছেন। কিন্তু মনের গভীরে স্বপ্ন আছে মাদাম কুরি বা মঁসিয়ে লাঁজেভির মত গবেষক হবার। কিন্তু গবেষণা করা তো সহজ কথা নয়। আর সে যোগ্যতা তার আছে কিনা তাও জানেন না ফ্রেড।
কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে মিলিটারি ট্রেনিং-এর বাকি ছয় মাস পূর্ণ করার জন্য তিনি আর্টিলারি রিজার্ভ ফোর্সে যোগ দিলেন। ১৯২৪ সালের মে মাসে ফ্রেড সেনাবাহিনীর কমিশন লাভ করে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হলেন।
মিলিটারি ক্যাম্পে তাঁর সাথেই ট্রেনিং করেছেন তাঁর বেস্ট ফ্রেন্ড পিয়ের বিকার্ড। বিকার্ডের সাথে আলোচনা করেন ফ্রেড ভবিষ্যতে কী করবেন তা নিয়ে। দু’জনেরই ইচ্ছে গবেষণা করার। কিন্তু ফ্রেডের সাহস নেই মঁসিয়ে লাঁজেভির সামনে গিয়ে তাঁর ইচ্ছার কথা বলার। আর মাদাম কুরির সাথে দেখা করার কথা তো তিনি স্বপ্নেও ভাবতে সাহস পান না। ফ্রেডকে সাহায্য করলেন বিকার্ড। তিনি গিয়ে পল লাঁজেভির সাথে দেখা করলেন। বললেন ফ্রেড আর তাঁর নিজের কথা। মঁসিয়ে লাঁজেভি প্রশ্ন করলেন, “গবেষণা করতে গেলে তোমাদের সবটুকু সময় আর মনযোগ যে গবেষণায় দিতে হবে তা কি জানো? দিনরাত লেগে থাকতে হবে বৈজ্ঞানিক সমস্যা নিয়ে। পারবে?”
“আই আই স্যার!” মিলিটারি কায়দায় জবাব দিলেন বিকার্ড।
“ঠিক আছে, দেখি কী করতে পারি। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দেখা করো আমার সাথে।”
নভেম্বরের শুরুতে পল লাঁজেভির সাথে দেখা করলেন ফ্রেড ও বিকার্ড।
“বিকার্ড, তুমি আমার ল্যাবে যোগ দাও। আর ফ্রেড, তোমার কথা আমি মাদাম কুরিকে বলে রেখেছি। তুমি নভেম্বরের ২১ তারিখ সকাল ১১টায় রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে গিয়ে মাদামের সাথে দেখা করবে। ইন্টারভিউতে পাস করলে তুমি সেখানেই যোগ দিতে পারবে।”
উৎসাহ উত্তেজনা উৎকন্ঠায় দুরুদুরু বুকে নির্দিষ্ট দিনে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে গেলেন ফ্রেড। মাদাম কুরি তাঁর আদর্শ। কিন্তু কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেননি যে তাঁকে সামনা-সামনি দেখতে পাবেন, কথা বলতে পারবেন।
No comments:
Post a Comment