চমকে উঠলেন মাদাম কুরি - “হোয়াট?”
“আমি এন্গেজড। আমার বয়স এই সেপ্টেম্বরে আটাশ হবে। আমার এখন বিয়ে করা উচিত। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আমি এন্গেজড হয়েছি।”
“কার সাথে?”“মঁসিয়ে জুলিও”
“ফ্রেডেরিক জুলিও? কিন্তু তার তো কোন ডিগ্রি নেই। একজন ল্যাব-অ্যাসিস্ট্যান্টের বউ হয়ে জীবন কাটাবি?”
“আমি তো তার ডিগ্রিকে বিয়ে করবো না মি। তাছাড়া এখন তার ডিগ্রি নেই, ডিগ্রি হবে। সে তার গ্র্যাজুয়েশানের প্রস্তুতি নিচ্ছে।”
“ভালো” - বলে চুপ করে গেলেন মাদাম। তাঁর চোখেমুখে হতাশার চিহ্ন খেয়াল করলেন না আইরিন।
মাদাম কুরি কাউকে কিছু না বললেও ফ্রেড আর আইরিনের সম্পর্ক নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে। ফ্রেডের চেয়ে শিক্ষায় পদমর্যাদায় সিনিয়র অনেকেই আছেন সেখানে। তাঁরা ফ্রেডের ভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে বলাবলি করতে লাগলো - ফ্রেড রাজকন্যা আর রাজত্ব দুটোই দখল করার জন্য ইনস্টিটিউটে এসেছেন। আইরিনের এসবে কিছু এসে যায় না। কিন্তু ফ্রেড কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েন যখন সহকর্মীরা তাঁর পিঠ চাপড়ে দেন।
ফ্রেড নিজেকে সবদিক দিয়েই আইরিনের যোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকেন। ১৯২৫ সালের জুলাই মাসে সরবোন ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ফ্রেড।
গবেষণাগারে আইরিন ও ফ্রেড |
১৯২৬ সালে বিয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন ফ্রেড ও আইরিন। জুন মাসের পাঁচ তারিখ ফ্রেডের মা মাদাম কুরির সাথে দেখা করলেন। মাদাম খুবই আন্তরিক ব্যবহার করলেন মাদাম জুলিওর সাথে। জুনের বিশ তারিখ আইরিন গেলেন ফ্রেডদের বাসায় সবার সাথে লাঞ্চ করতে। ফ্রেডের বাড়ির সবাই খুব পছন্দ করলেন আইরিনকে। আইরিন কারো সাথে তেমন কোন কথা না বললেও তাঁর আন্তরিক সোজাসাপ্টা আচরণে সবাই বেশ খুশি হলেন।
২৪শে জুন কুরি পরিবার আর জুলিও পরিবার একসাথে ডিনারে গেলো। ফ্রেডকে খুবই পছন্দ হলো ইভের। তার মনে হলো আইরিনের শুষ্ক নীরস সাদাকালো জীবনের ক্যানভাস রঙে রঙে ভরিয়ে দিতে পারবেন ফ্রেড। কিন্তু মাদামের গাম্ভীর্য আইরিনের চোখে না পড়লেও ইভের চোখ এড়ালো না।
লা’কোয়েস্টে প্রতিবছর সামারে ছুটি কাটাতে যান আইরিন ও ইভ। এ’বছর ইভের বদলে ফ্রেডকে সাথে নিয়ে গেলেন আইরিন। লা’কোয়েস্টের ফিশিং বোটে ইচ্ছেমতো মাছ ধরলেন ফ্রেড। লা’কোয়েস্টের প্রায় প্রত্যেকের সাথেই পরিচয় হয়ে গেলো ফ্রেডের। জেলেদের সাথে তো রীতিমত বন্ধুত্ব হয়ে গেলো তাঁর।
আইরিন তাঁর বিয়ের তারিখের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। লা’কোয়েস্ট থেকে প্যারিসে মাকে চিঠি লিখলেন আইরিন, “মি, আমাদের বিয়ের তারিখ এখনো তুমি ঠিক করে দাওনি। তোমার কোপেনহ্যাগেনে যাবার আগে বিয়েটা হয়ে গেলে ভালো হয়। কোপেনহ্যাগেন থেকে তোমার ফিরে আসার পরে হলে হয়তো আরো ভালো হতো, কিন্তু তখন ইনস্টিটিউটে পরীক্ষা চলবে। আমার মনে হয় অক্টোবরের নয় তারিখে বিয়ে হলে সবদিক দিয়ে ভালো হয়। তুমি তাড়াতাড়ি তোমার মত জানাও। আমি সেই মত টাউন হল বুকিং দেবো।”
আইরিনের কথামতোই সবকিছু ঠিক হলো। ১৯২৬ সালের ৯ই অক্টোবর দুপুরে বিয়ে হয়ে গেলো আইরিন কুরি ও ফ্রেডেরিক জুলিওর। খুবই অনানুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হবার কথা থাকলেও দেখতে দেখতে বেশ বড় অনুষ্ঠান হয়ে গেলো। জুলিও পরিবারের সবাই, কুরি পরিবারের সবাই, সহকর্মী বিজ্ঞানীরা, সিটি মেয়র সহ বড় বড় সরকারি অফিসারের অনেকেই বিয়েতে এসেছিলেন। লাঞ্চের পর ফ্রেড আইরিনের সাথে আইরিনদের বাসায় গেলেন। তারপর সব অতিথিরা চলে গেলে নিজেও চলে গেলেন তাঁর নিজের বাসায়। আইরিন রয়ে গেলেন তাঁর মি’র সাথে।
পরদিন সকালে ইভকে নিয়ে মাদাম কুরি চলে গেলেন কোপেনহ্যাগেনে। ফ্রেড চলে এলেন আইরিনের বাড়িতে। সেখানেই শুরু হলো তাঁদের দাম্পত্য জীবন। বিয়ের প্রথম কয়েক মাস ফ্রেড ও আইরিন মাদাম কুরির বাসাতেই ছিলেন।
ফ্রেড ও আইরিন |
আইরিনের বিয়ের পর মাদাম বেশ গম্ভীর হয়ে গেছেন। ফ্রেডকে তিনি সহজে মেনে নিতে পারছেন না। আইরিনকে মাদাম বলেছেন ম্যারেজ অ্যাগ্রিমেন্ট করিয়ে নিতে - কারণ তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না ফ্রেডের সাথে আইরিনের বিয়ে টিকবে।
পুরুষ-শাসিত ফ্রান্সের আইন অনুযায়ী স্ত্রীর সমস্ত সম্পদ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকে স্বামীর হাতে। মেরির ধারণা ফ্রেড আইরিনকে ছিনিয়ে নিয়েছেন তাঁর নিজের কাছ থেকে। স্বামীর মৃত্যুর পর ক্রমে ক্রমে আইরিন হয়ে উঠেছিলেন তাঁর অবলম্বন। কিন্তু মাদামের মনে হচ্ছে ফ্রেডের সাথে পরিচয়ের পর থেকে আইরিন ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। অভিমানে মাদাম কতগুলো ছেলেমানুষী কাজ করতে শুরু করলেন।
যেমন একদিন আমেরিকা থেকে কয়েকজন বিজ্ঞানী এসেছেন রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে। মাদাম তাঁদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ইনস্টিটিউটের গবেষক ও অ্যাসিস্ট্যান্টদের সবাইকে মিটিং রুমে ডাকলেন। সবাই এসে পাশাপাশি দাঁড়ালেন। মাদাম একে একে পরিচয় দিচ্ছিলেন - “ইনি ডক্টর লুইস - আমাদের ল্যাব টু’র ডিরেক্টর, ইনি ডক্টর সল্সবেরি - মাস্টার্স প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর, ইনি ডক্টর কুরি - রিসার্চ ইনচার্জ, ইনি মঁসিয়ে টেপার, ….” এভাবে যখন ফ্রেডের নাম বলার পালা এলো তখন এমন ভাব করলেন যেন ফ্রেডকে দেখতেও পাননি। ফ্রেডকে বাদ দিয়ে পরের জনের পরিচয় দিতে শুরু করলেন। কিন্তু ফ্রেডের উজ্জ্বল উপস্থিতি ভিজিটরদের চোখ এড়ায় না। যখন তাঁরা মাদামকে ফ্রেড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন - মাদাম দায়সারা ভাবে জবাব দেন - “ওই লোকটা? আইরিন ওই লোকটাকে বিয়ে করেছে”।
কিন্তু মাদামের অভিমান চোখেই পড়ছে না আইরিনের। তিনি তাঁর স্বামীর সাথে নতুন জীবন নিয়ে ব্যস্ত। স্বামীর জন্য রান্না করতে গিয়ে আইরিন আবিষ্কার করলেন তিনি এত কিছু শিখেছেন জীবনে - কিন্তু রান্না শিখতে ভুলে গেছেন। তবে কোন সমস্যা নেই। দেখা গেলো ফ্রেড চমৎকার রান্না করেন। অবশ্য রান্না করার সময় রান্নাঘর এত অগোছালো করে ফেলেন যে অস্বস্তি লাগে। রান্না শেষে ফ্রেড ভয়ে ভয়ে গোছানোর চেষ্টা করেন। আইরিনের খুব মজা লাগে এসব দেখে। রান্নাঘর থেকে মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে হাসির শব্দ শোনা যেতে লাগলো যা এই বাসায় আগে কখনো শোনা যায়নি। ইভ বাসায় থাকলে সেও যোগ দেয় তাদের সাথে। কিন্তু মাদাম একেবারেই একা হয়ে গেলেন।
কয়েক মাস পর মাদাম আইরিনের হাতে একটা অ্যাপার্টমেন্টের চাবি তুলে দিলেন বিয়ের উপহার হিসেবে। তাঁদের বর্তমান বাসা থেকে কাছেই সরবোন অ্যানেক্সে একটা ছয়তলা ভবন কিনেছিলেন মাদাম কুরি, জাঁ পেরি আর ফ্রান্সিস বোরেল - এই তিন বন্ধু মিলে। প্রতি তলায় একটা করে অ্যাপার্টমেন্ট। তিন তলায় পাঁচ রুমের বিশাল অ্যাপার্টমেন্টে উঠে গেলেন আইরিন ও ফ্রেড। ছয় তলায় আইরিনের ছোটবেলার বন্ধু আলিনও থাকেন তাঁর স্বামী ও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে। বেশ ভালোভাবেই শুরু হলো আইরিন ও ফ্রেডের সংসার।
কিন্তু বিজ্ঞান-সমাজে ফ্রেডের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সমস্যা দেখা দিলো। আইরিন ইতোমধ্যেই বিজ্ঞানী হিসেবে অনেকদূর এগিয়ে গেছেন। অনেকগুলো গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়ে গেছে তাঁর। কিন্তু ফ্রেড এখনো মাস্টার্সও পাস করেননি। অনেকেই প্রকাশ্যে বলাবলি করতে লাগলো এই বিয়ে ফ্রেডের ওপরে উঠার সিঁড়ি, ক্যারিয়ার বাগানোর জন্য আইরিনকে বিয়ে করেছেন ফ্রেড।
ফ্রেড রেগে যান এসব শুনে। বিয়ের পরেও আইরিন ‘কুরি’ নামে তাঁর পেপার প্রকাশ করতে থাকেন। মিডিয়াতে এই জুটি জুলিও-কুরি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আইরিনের সাথে কথা বলে ফ্রেড নিজের পদবীর সাথে স্ত্রীর পদবী লাগিয়ে ‘জুলিও-কুরি’ হয়ে যান।
মায়ের কাছ থেকে আলাদা থাকতে শুরু করার পর মাদাম কুরির মনের অবস্থা বুঝতে পারেন ফ্রেড। তিনি আইরিনকে বোঝান - “আমাদের কিন্তু প্রতিদিনই একবার মাদামের বাসায় যাওয়া উচিত, তাঁর সাথে ডিনার করা উচিত।”
“মি কি সেটা পছন্দ করবেন?”
“তুমি কি মি’র পছন্দ অপছন্দ বুঝতে পারো? তুমি কি বুঝতে পারছো যে তিনি এখন কতটা একা হয়ে গেছেন? তিনি ভাবছেন আমি তোমাকে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে এসেছি। তোমার উচিত তাঁকে বুঝিয়ে দেয়া যে এখনো তুমি তাঁরই আছো। তাঁর মেয়ে পর হয়ে যায়নি বরং মেয়ের মাধ্যমে তিনি একটা ছেলে পেয়েছেন।”
“সেটা তো ঠিকই, কিন্তু তাঁকে বোঝাতে হবে কেন? মি পৃথিবীর এত কঠিন কঠিন জিনিস বোঝেন, আর এই ব্যাপারটা বোঝেন না?”
“স্নেহ ভালোবাসার ব্যাপারটা হলো অনেকটা সঙ্গীতের মতো। শুধু মনে মনে গুনগুন করলে হয় না, মাঝে মাঝে গলা ছেড়ে গাইতে হয়।”
আইরিনও ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। ফ্রেডের কাছ থেকে অনেক মানবিক ব্যাপার শিখছেন আইরিন যা আগে তাঁর চোখেও পড়তো না। সপ্তাহের মধ্যে বেশ কয়েকদিনই মেরির সাথে ডিনার করেন ফ্রেড ও আইরিন। আস্তে আস্তে মেরি সহজ হতে থাকেন ফ্রেডের সাথে।
১৯২৭ সালে ফ্রেড সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বছর তাঁদের প্রথম সন্তান হেলেনের জন্ম হয়। নাতনির মুখ দেখার পর মাদাম কুরির সব অভিমান জল হয়ে যায়। তিনি নাতনিকে একদিন না দেখলে ছটফট করতে থাকেন।
মা হবার পর আইরিন যক্ষায় আক্রান্ত হলেন। ডাক্তার বললেন ‘কমপ্লিট রেস্ট’ নিতে হবে। এটাও বললেন যে ভবিষ্যতে আর মা হওয়া চলবে না। কয়েক সপ্তাহ রেস্ট নিয়ে শিশু হেলেনকে নার্সের হাতে দিয়ে ল্যাবে ফিরলেন আইরিন। ল্যাবে ডক্টরেটের জন্য পূর্ণোদ্যমে গবেষণা করছেন ফ্রেড। আইরিন সুপারভাইজ করছেন তাঁকে।
১৯৩০ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করলেন ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি। তাঁর থিসিসের শিরোনাম ছিল, “ইলেকট্রোকেমিক্যাল প্রপার্টিজ অব রেডিওঅ্যাক্টিভ কম্পাউন্ডস অব পোলোনিয়াম”।
রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে ফ্রেড ও আইরিন যে বেতন পান তাতে ঠিকমত সংসার চলে না তাঁদের। মায়ের দেয়া অ্যাপার্টমেন্টটা না থাকলে তাঁদের অবস্থা যে কী হতো বলা যায় না। এতদিন ফ্রেডের একাডেমিক ডিগ্রি ছিল না। এখন ডক্টরেট হবার পর ফ্রেড ইন্ডাস্ট্রিতে চলে চাকরি নিয়ে চলে যাবেন ঠিক করলেন। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে গবেষণা করার তেমন সুযোগ নেই।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে ফ্রেডের। জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট নাৎসিদের উত্থান ঘটছে। ফ্রেড সরকারি চ্যানেলে বোঝাতে সক্ষম হন যে বিজ্ঞান গবেষণায় প্রচুর বাজেট না দিলে ভবিষ্যতে ফ্যাসিস্টদের ঠেকানো যাবে না। সরকার একটা বড় অংকের রিসার্চ গ্রান্ট দেয় ফ্রেডকে। ইন্ডাস্ট্রিতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত বাতিল করে ফ্রেড আইরিনের সাথে পূর্ণকালীন গবেষণা শুরু করেন।
ফ্রেড আর আইরিনের টিম-ওয়ার্ক খুবই ভালো চলছিল। ফ্রেড ফিজিসিস্ট হলেও তাঁর ডক্টরাল থিসিস ছিল কেমিস্ট্রিতে। আর আইরিন কেমিস্ট, কিন্তু তাঁর থিসিস ছিল পিওর ফিজিক্সের ওপর। ফ্রেড যেকোন ব্যাপারেই দ্রুত চিন্তা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, আবার ঘনঘন সিদ্ধান্ত বদলানও। কিন্তু আইরিন সেরকম নন। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেন বলে সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর অনেক দেরি হয়। গবেষণায় সাফল্য এলে সকলের প্রশংসা পেতে পছন্দ করেন ফ্রেড, কিন্তু বিরাট সাফল্যেও কোন ভাবান্তর হয় না আইরিনের।
তুমি বলবে ,এ যে তত্ত্বকথা
ReplyDeleteএ কবির বাণী নয় ।
আমি বলব, এ সত্য ,
তাই এ কাব্য ।