মেলবোর্ন শহরের রাস্তায় রাস্তায় নানারকম বর্ণিল পতাকা আর লাইটপোস্টগুলোতে লাল-হলুদ তারার মেলা বসতে শুরু করেছে দেখেই বোঝা যায় ডিসেম্বর এসে গেছে। খ্রিস্টমাসের আর দেরি নেই।
প্রচন্ড গরম পড়েছে এই ডিসেম্বরে। যে রকম ডিসেম্বরের সাথে আমার আজন্ম পরিচয় সেই শীতের আমেজ মাখা বাংলাদেশের ডিসেম্বরের সাথে মেলবোর্নের এই ডিসেম্বরের কোন মিল নেই। এই নিয়ে দুটো ডিসেম্বর কাটছে আমার এই দক্ষিণ গোলার্ধে। ছোট্ট রাত আর ভোর চারটা থেকে রাত নয়টা ব্যাপী দীর্ঘ তপ্ত দিন।
সারা শহর জুড়ে এখন খ্রিস্টমাসের ব্যস্ততা, কেনাকাটার ধুম। অফিসে অফিসে বাসায় বাসায় খ্রিস্টমাসের আগেই খ্রিস্টমাস পার্টি।
কেনের বাসায় খ্রিস্টমাস পার্টি হচ্ছে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। কেন্ - মানে প্রফেসর ক্যানেথ আমোস। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের জাঁদরেল প্রফেসর, আমার পিএইচডি সুপারভাইজার। ডিপার্টমেন্টের সব পার্টি থেকে পালিয়ে বেড়ালেও এখানে আসতে হয়েছে। কেনের দয়ালু স্ত্রী জুলিয়ার কল্যাণে এ বাড়ির ফ্রিজে আমার মত মদিরাবিমুখদের জন্য কিছু সফ্টড্রিংক্স রাখা আছে। ফ্রিজ খুলে কোকাকোলার ক্যান বের করতে করতে শুনলাম ম্যান্ডির প্রশ্ন।
"এবারের খ্রিস্টমাসে কোথায় যাচ্ছো তুমি?" - বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে ম্যান্ডির প্রশ্ন। প্রশ্নটা এমন ভাবে করেছে মনে হচ্ছে যেন আমি প্রতি খ্রিস্টমাসেই কোথাও না কোথাও যাই।
ম্যান্ডি আমার সহপাঠিনী। কেনের অধীনে পিএইচডি গবেষণা শুরু করেছে আমার বেশ কয়েক বছর আগে। একই অফিসে আমাদের দু'জনের ডেস্ক। ফলে কিছুটা বন্ধুতা হয়েছে। গত বছর খ্রিস্টমাসের সময় সে ঘুরে এসেছে কোরিয়া থেকে। এবছরও হয়তো যাবে কোথাও। তাকিয়ে দেখি মদের গ্লাস হাতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার উত্তরের অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমি তার প্রশ্নের কী উত্তর দেবো? আমার তো কোথাও যাবার পরিকল্পনা নেই এখনো।
মেলবোর্নে এসেছি দেড়বছর হয়ে গেলো। কাজ আর পড়াশোনা মানে আর্নিং আর লার্নিং একসাথে করতে গিয়ে ঘাড় সোজা করে আকাশ দেখার অবসরটুকুও যেখানে জোটেনি এতদিন সেখানে কোথাও যাবার প্রশ্ন তো অবান্তর। গতবছরের খ্রিস্টমাস কেটেছে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরে থালাবাসন ধুতে ধুতে। এবছরও হয়তো সেরকমই কাটবে। কিন্তু ম্যান্ডিকে সেকথা বলা যাবে না। বললে হয়তো হাত ধরে টেনে নিয়ে যাবে কোথাও। ইদানীং হাত ধরার স্বভাব তৈরি হয়েছে তার।
"প্রাডিব, এবারের ক্রিস্টমাসে কোথাও যাচ্ছো তুমি?" প্রথমবার শুনতে পাইনি ভেবে দ্বিতীয়বার প্রশ্নটি করলো ম্যান্ডি। একটু ঘুরিয়ে করেছে এবার। প্রথমবার ছিলো - "হয়ার আর ইউ গোয়িং?" এবার হয়েছে "আর ইউ গোয়িং এনিহয়ার?"
"এখনো ঠিক করিনি। ভাবছি কোথায় যাওয়া যায়।" - বিরস উত্তর আমার।
এদেশে পার্টি শুরু হবার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সবার মধ্যে পার্টির একটা প্রভাব পড়ে যায়। নেশায় চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে ওঠার আগেই মুখ দিয়ে অনবরত কথা বেরুতে থাকে। আর সবাই হয়ে ওঠে এক একজন সবজান্তা পরামর্শদাতা। না চাইলে কাউকে উপদেশ দিতে নেই - এই স্বাভাবিক ভদ্রতাবোধও তখন আরো অনেক বোধের সাথে বিদায় নেয়। খ্রিস্টমাসে আমার গন্তব্য ঠিক করতে পারিনি জেনে সবাই লেগে গেলো আমাকে ভাবনার হাত থেকে উদ্ধার করতে। তাদের সিরিয়াস ভাব দেখে মনে হচ্ছে তারা অস্ট্রেলিয়ার ভয়াবহ কোন জাতীয় সমস্যার সমাধানে ব্রতী হয়েছে। আমি ম্যান্ডির পাশে বসে চুপচাপ শুনছিলাম তাদের কথা। অন্যসব আড্ডার মতোই কয়েক মিনিট পরেই প্রসঙ্গ অন্যদিকে চলে গেলো। ছোট ছোট গ্রুপে কথা চলছে, মদের পাত্র ভর্তি হচ্ছে, খালি হচ্ছে।
ম্যান্ডি একেবারে আমার কানের কাছে মুখ এনে কথা বলছে। খ্রিস্টমাসে সে যাচ্ছে ঝিলং - মেলবোর্ন থেকে সত্তর-আশি কিলোমিটার দূরে তার মায়ের সাথে খ্রিস্টমাস পালন করতে। হঠাৎ বললো, "প্রাডিব, তুমি যাবে আমার সাথে? চলো না!"
বড় মিষ্টি গলা ম্যান্ডির। গলার স্বরে আরো কিছু একটা আছে যাতে মনে হয় তার আন্তরিকতার কোন অভাব নেই। এই যান্ত্রিক দেশে এরকম আন্তরিকতায় আমি অভ্যস্ত হইনি এখনো।
চোখ তুলে তাকালাম। ম্যান্ডি তাকিয়ে আছে আমার দিকে। স্লিভলেস গোলাপি টপ আর কালো স্কার্টের এই অস্ট্রেলিয়ান যুবতীকে কি আমি চিনি? এতো অন্যরকম লাগছে কেন তাকে? এত সুন্দর! নেশাতো আমি করিনি, সে করেছে। মদ খেলে কি মানুষ সুন্দর হয়ে যায় এমন হঠাৎ? এমন অপরূপ এক মেয়ে আমার মতো একজনকে কেন নিয়ে যেতে চাচ্ছে তাদের বাড়িতে?
"চলো আমার সাথে। কয়েকদিন বেশ মজা করা যাবে। আমাদের একটা ফার্মহাউজ আছে। কেউ থাকে না সেখানে। আমি আর তুমি গিয়ে থেকে আসবো কয়েকদিন।"
বুঝতে পারছি ম্যান্ডি প্র্যাকটিক্যাল জোক করছে আমার সাথে। দেখতে চাচ্ছে আমি কেমন লাফিয়ে উঠি! আমার অবস্থান সম্পর্কে আমি সচেতন। এত তাড়াতাড়ি পথ হারানোর সাহস আমার নেই। ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন বন্ধুর দেয়া সতর্কবাণী মনে পড়লো - "ম্যান্ডি হইতে সাধধান, সে ম্যান-ইটার"। 'ম্যান-ইটার'-এর খাদ্য হবার কোন ইচ্ছে আমার নেই। মনে মনে নাকচ করে দিলাম ম্যান্ডির লোভনীয় প্রস্তাব।
আমাদের জার্মান বন্ধু ম্যাথিয়াস যাচ্ছে সিডনি। সেখানে তার গার্লফ্রেন্ড আসছে বার্লিন থেকে। আমাকে বললো আমি যদি সিডনি যাই ভুলেও যেন তার খোঁজ নেয়ার চেষ্টা না করি বা তার মোবাইলে যেন ফোন না করি। কারণ সে কিছুদিন 'ইনকমিউনিকাডো' হয়ে থাকতে চায়।
আমার বয়েই গেছে তার খোঁজ নিতে। আমি যেন আর জানি না যে এরকম অবস্থায় একটা ফোনকলও 'কাবাবমে হাড্ডি'র মত লাগে! তবে আমিও তো ঘুরে আসতে পারি সিডনি থেকে। অস্ট্রেলিয়ায় এসেও যদি মেলবোর্নের এক কোণায় নিজেকে গুটিয়ে রাখতে হয় তাহলে আর বিদেশে আসা কেন! এই 'রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধা' টাইপের জীবনতো চট্টগ্রামে বসে স্কুল-মাস্টারি করেও কাটাতে পারতাম।
সিডনি যাবো ঠিক করে ফেললাম। সাথে ক্যানবেরাও ঘুরে আসবো। সিডনিতে স্বপনদারা আছেন। মেলবোর্নে আসার ক'দিন পরেই স্বপনদা ফোন করে বলে দিয়েছিলেন সিডনি গেলে যেন অবশ্যই তাঁদের ওখানে উঠি। আর ক্যানবেরাতে উর্মিরা আছে।
খ্রিস্টমাসের ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা এবং সে অনুযায়ী সব ব্যবস্থা যে অনেক দিন আগে থেকেই করে রাখতে হয় তা বুঝলাম সিডনি যাবার টিকেট করতে গিয়ে। প্লেনের টিকেট নেই বা থাকলেও যা আছে তা ছোঁয়ার সামর্থ্য আমার নেই। ট্রেনের টিকেট সব অগ্রিম বিক্রি হয়ে গেছে। এমনকি খ্রিস্টমাসের ঠিক আগের দিন বা পরে দিনের বাসের টিকেটও নেই।
বাসের টিকেট পেলাম খ্রিস্টমাসের দু'দিন পরের। এই সময়টা অস্ট্রেলিয়ানদের জন্য ছুটির সিজন। হ্যাপি হলিডেজ। শীত এড়াতে এসময় ইউরোপ আমেরিকার অনেক ট্যুরিস্ট চলে আসে দক্ষিণ গোলার্ধের এই দেশে। রাজ্যের ভেতর ছুটি কাটাতে অস্ট্রেলিয়ানদের অনেকেই গাড়ি নিয়ে যায়। আর দূরের যাত্রা হলে প্লেন, ট্রেন বা বাস। যদিও বাসকে এরা নিম্নবিত্তের বাহন মনে করে।
আমার বাসযাত্রাই ভালো মনে হচ্ছে। অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও অন্য কারণটা হলো অস্ট্রেলিয়ার কান্ট্রি সাইড দেখার সুযোগ বাসভ্রমণেই বেশি পাওয়া যায়। আকাশের সীমানায় তো সব দেশ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।
০১
ফ্রাংকলিন স্ট্রিটে কোয়ান্টাস এয়ারলাইন্সের বহুতল ভবনের পাশের বিল্ডিংয়ে গ্রেহাউন্ড বাস টার্মিনাল। মেলবোর্নের সেন্ট্রাল বাস টার্মিনাল স্পেনসার স্ট্রিটে, বাস ট্রাম ট্রেন সব এক জায়গায়। এয়ারপোর্টে যাবার স্কাইবাসও ছাড়ে সেখান থেকে। এখানকার এই টার্মিনালটা শুধুমাত্র গ্রেহাউন্ড বাস কোম্পানির জন্য। উত্তর আমেরিকায় এই কোম্পানি দোর্দন্ড প্রতাপে যাত্রী পরিবহন ব্যবসা করছে। অস্ট্রেলিয়ায় হাতে গোনা আরো কয়েকটি ইন্টার-স্টেট বাস কোম্পানি থাকলেও গ্রেহাউন্ডের তুলনায় সেগুলো বড়জোর পুষি বিড়াল।
আমার বাস রাত পৌণে ন'টায়। এখন রাত আটটা। রাত না বলে বিকেল আটটা বলা উচিত। আকাশে এখনো ঝলমলে সূর্য। গ্রীষ্মকালে এখানে সূর্যাস্ত হয় সাড়ে ন'টার দিকে।
সোয়া আটটায় চেক ইন করে বোর্ডিং পাস নিয়ে বসে রইলাম। টিকেট কেনার সময় বাসের সিট নম্বর দেয়া হয় না। চেক ইন করার পর সিট নম্বর দেয়া হলো। এত আগে চেক ইন করার পরেও কেন যে বাসের একেবারে পেছনের দিকে সিট পেলাম জানি না। তবে কি চেক ইন করার আরো কোন ব্যবস্থা আছে? নাকি আমার চেহারা দেখেই আমাকে পেছনের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছে কে জানে।
সাড়ে আটিটায় বোর্ডিং শুরু হলো। আমাদের দেশের ঢাকা-চট্টগ্রামের মতোই ব্যবস্থা। তবে আমাদের মতো অত হৈ চৈ নেই, অপ্রয়োজনীয় অনেক মানুষের সমাবেশ নেই, একটা বাসে তিন-চারজন হেল্পার, কন্ডাক্টর বা ড্রাইভারের পাশে বসে অনবরত কথা বলা আর বিড়ি ফোঁকার অলস মানুষ নেই।
চেক ইন কাউন্টারের চটপটে তরুণী বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে যাত্রীদের বোর্ডিং পাস দেখে দেখে হাসিমুখে বাসে ওঠাচ্ছে।
আমার সিট জানালার ধারে। পাশে বসেছেন একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক। পাশের সারিতে বসা তাঁর স্ত্রী আর দুই শিশুপুত্রের সাথে তাঁর কথোপকথন শুনে মনে হচ্ছে তাঁরা জাপানি। মেলবোর্নে চৈনিকদের তুলনায় জাপানি অভিবাসীর সংখ্যা অনেক কম। শুনেছি কুইন্সল্যান্ডের দিকে প্রচুর জাপানি আছে। জাপানিরা মিশুক জাতি। একটু পরেই আলাপ জমে গেলো ভদ্রলোকের সাথে। তাঁর ইংরেজি উচ্চারণ অস্পষ্ট। আন্দাজে বুঝে নিতে হলেও এ ধরনের খেঁজুরে আলাপে কোন অসুবিধা হয় না। ভদ্রতা রক্ষার প্রচলিত পদ্ধতি - হাসিমুখে 'ইয়েস, ইয়েস' বললেই চলে।
ঠিক পৌনে ন'টায় বাস-ড্রাইভার তার হ্যান্ডমাইক নিয়ে একটা লেকচার দিলেন। এত বড় বাসের তিনি একাই ড্রাইভার। তার কোন হেল্পার বা কন্ডাক্টরও নেই। বাসের নিয়মকানুন সম্পর্কে হয়তো বলছেন তিনি, কিন্তু আমি কয়েকটি শব্দ ছাড়া আর কিছুই তেমন বুঝতে পারলাম না। অস্ট্রেলিয়ান উচ্চারণ বোঝার কান তৈরি হয়নি এখনো আমার, কিংবা হতে পারে ড্রাইভারের উচ্চারণই বাজে। সে যাই হোক। তার কথা কেউ মন দিয়ে শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। ড্রাইভার তার রুটিন ওয়ার্ক করছেন। বাসে সিটবেল্ট আছে, কিন্তু তা বেঁধে বসা বাধ্যতামূলক কিনা জানি না। গাড়িতে সিটবেল্ট না বাঁধলে ১৬৫ ডলার জরিমানা। এদেশে রাস্তাঘাটে অনিয়ম করলে জরিমানা দিতে হয় নানারকম। লাল বাতিতে গাড়ি থামাতে ব্যর্থ হলে তিনশ' ডলার জরিমানা ছাড়াও লাইসেন্স থেকে তিন পয়েন্ট কাটা যায়। শুধু ড্রাইভার নয়, পথচারীদের জন্যও নাকি জরিমানার ব্যবস্থা আছে। রাস্তা পারাপারের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া যেখানে সেখানে রাস্তা ক্রস করতে গিয়ে ধরা পড়লে পথচারীকেও চল্লিশ ডলার জরিমানা গুণতে হয়।
দিনের আলো আছে এখনো। থাকবে আরো মিনিট চল্লিশেক। মেলবোর্ন শহরের কয়েকটা বড় রাস্তা পেরিয়ে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির পার্কভিল ক্যাম্পাস ডানে রেখে বাস এগিয়ে চলেছে হিউম হাইওয়ে ধরে সিডনির পথে। রোডসাইড ডিরেকশান বোর্ডে দেখা গেলো সিডনি আরো ৯৯৫ কিলোমিটার দূরে। বাসের গত ক্রমশ বাড়ছে।
জানালায় চোখ রেখে তাকিয়ে আছি যতদূর দেখা যায়। শহরের মাঝখানে এতদিন কাটিয়ে ঠিক বুঝতে পারিনি যে এই দেশ এত সবুজ। অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভায় অদ্ভুত মায়াবী লাগছে চারদিক।
সূর্য ডোবার সাথে সাথেই বৃষ্টি নামলো। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়া দেখি না কতদিন হয়ে গেলো। এদেশের বৃষ্টি বড় বেশি ছন্দবিহীন। চারপাশ অন্ধকার। রাস্তায় গাড়ির হেডলাইট ছাড়া আর কোন আলো নেই অনেকদূর পর্যন্ত। মাঝে মাঝে ছোট ছোট টাউনশিপ চোখে পড়ছে। আলো ঝলমলে মফস্বলের বিপণীকেন্দ্র। বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না, তবু তাকিয়ে আছি বাইরে - অন্ধকারের দিকে। আকাশে অনেক তারা। এই আকাশের তারা কি বাংলাদেশ থেকেও দেখা যাচ্ছে? এতদিন পরে মনে হচ্ছে একটু অবসর পেয়েছি নিজের সাথে কথা বলার, ফেলে আসা স্মৃতির হাত ধরে মনের বারান্দায় একটু হাঁটার।
বাসে প্রায় সবাই ঘুমাচ্ছে। জাপানিদের ছোট বাচ্চাটি কেঁদে উঠলো একবার। একটু পরেই মায়ের আদর খেয়ে চুপ করে গেলো। আর কোন শব্দ নেই। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে বাসের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায়। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুম ভাঙলো প্রথম যাত্রাবিরতিতে। ড্রাইভার জানালেন - বাস পঁয়তাল্লিশ মিনিট থামবে এখানে। বাস থেকে নিচে নেমে এলাম।
জায়গাটার নাম কী ঠিক বুঝতে পারছি না। আশেপাশে খুব বেশি দোকানপাট নেই। পেট্রোল স্টেশনের সাথে লাগানো রেস্টুরেন্ট আর ছোট্ট শপিং সেন্টার। এরা বলে সার্ভিস সেন্টার, মোদ্দা কথায় সব পেয়েছির দোকান। বাতাস খুব ঠান্ডা। ডিসেম্বর মাসের প্রচন্ড গরমেও শীত কালের হাওয়া। বলা হয়ে থাকে মেলবোর্নের আবহাওয়ার মেজাজ ধনীলোকের একমাত্র সুন্দরী মেয়ের মেজাজের মতোই - ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। তবে কি এখনো মেলবোর্ন তথা ভিক্টোরিয়া রাজ্যের সীমানা পার হইনি?
সীমানা তো আর ছোট নয়। অস্ট্রেলিয়া বিশাল দেশ। ছয়টি রাজ্য আর দুটো টেরিটরি তার। রাজ্যগুলোর মধ্যে তাসমানিয়া আর ভিক্টোরিয়ার আয়তন অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক ছোট। তাসমানিয়ার আয়তন বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য কম, কিন্তু ভিক্টোরিয়ার আয়তন বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় দ্বিগুণ।
বাসের অন্যান্য যাত্রীরাও হাঁটছেন এদিক ওদিক। বাসে সিগারেট খাওয়া যায় না বলে ধূমপায়ীরা এখন আরাম করে সিগারেটে টান দিচ্ছে। রাত বাজে বারোটা। কেমন শুনশান চারদিক। মেইন রোড থেকে একটু ভেতরের রাস্তায় এই সার্ভিস স্টেশন। এখানে দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি মেইন রোড ধরে ছুটে যাচ্ছে ডাকবিভাগের গাড়ি - এক্সপ্রেস মেইল নিয়ে। বিশাল দৈর্ঘ্যের লরি যাচ্ছে একটার পর একটা। দিনের বেলায় সাধারণত এগুলোকে চলতে দেখা যায় না।
আস্তে আস্তে বাসে উঠতে শুরু করেছে যাত্রীরা। আমাদের বাসে যাত্রীর সংখ্যা চুয়াল্লিশ জন। তার প্রায় অর্ধেকই মেয়ে। অনেকেই ভ্রমণ করছে একা একা। বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা আমি মুগ্ধ হই মেয়েদের স্বাচ্ছন্দ্য আর সাবলীলতা দেখা। এদেশের মেয়েরা কি আমাদের দেশের মেয়েদের চেয়ে বেশি মেধাবী? তাদের গায়ে কি শক্তি আমাদের মেয়েদের চেয়ে বেশি? তবে তারা পারে আমরা পারি না কেন? কী যে ভাবছি! আমরা যে কেন পারি না সেটা তো আমরা জানি। আমরা পারি না, কারণ আমরা এখনো মেয়েদের মেয়ে হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। তবে হবে আস্তে আস্তে। আমাদের দেশের প্রেক্ষিত আর এদেশের প্রেক্ষিত তো এক নয়। এদেশের পরিবেশে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশি মেয়েরাও সমান সাবলীলতায় পা ফেলে চলছে এখানে।
বাস আবার চলতে শুরু করলো। ড্রাইভার জানিলে দিলেন ভোর পাঁচটায় আবার থামবেন। ঘুমানো ছাড়া আর কিছু করার নেই আপাতত। একটু অস্বস্তি লাগছে কাল সকালে একটা অচেনা বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করতে হবে ভেবে। ভোর পাঁচটায় আবার একটা সার্ভিস স্টেশনে গাড়ি থামার পর ঘুম ভাঙলো। কেউ কেউ নিচে নামলেও বেশির ভাগ যাত্রী ঘুমাচ্ছে। বাস থেকে একটু হাঁটতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু পাশের জাপানি ভদ্রলোকের ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করলো না।
আস্তে আস্তে আকাশ ফর্সা হয়ে উঠছে। এসময় রোদ উঠে যাবার কথা। কিন্তু আকাশ বেশ মেঘলা। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। বৃষ্টিতে বেড়াতে ভালো লাগে না। বৃষ্টি হলো ঘরের ভেতর জানালার পাশে বসে উপভোগ করার বিষয়। তাছাড়া এদেশের বৃষ্টির পানি যা ঠান্ডা!
সকাল সাতটায় বাস থামলো লিভারপুল স্টেশনে। জাপানি পরিবার নেমে গেলো এখানে। রাস্তায় গাড়ি চলাচলের হার বেড়ে গেছে। অনেক বড় এলাকা জুড়ে কেবল গাড়ি আর গাড়ি। পুরনো গাড়ির দোকান। শুনেছি অস্ট্রেলিয়ায় নাকি পুরনো গাড়ি আমদানি করা যায় না। তবে কি এগুলো সব এদেশে ব্যবহৃত গাড়ি?
সিডনির কাছে চলে এসেছি। দেখা যাচ্ছে সিডনি শহরের বিরাট বিরাট ইমারত। বিল্ডিংগুলোর আলাদা কোন বিশেষত্ব চোখে পড়ছে না, মেলবোর্নের বিল্ডিং-এর মতোই। বেশ জোরেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি। ভালো লাগছে না বৃষ্টির তোড় দেখে। এখানের বৃষ্টি মেলবোর্নের বৃষ্টির মতো মিনমিনে নয়, মনে হচ্ছে বাংলাদেশের বৃষ্টির মতোই জোর আছে পতনে। বৃষ্টিতে আর যাই হোক, সারাক্ষণ মাথায় ছাতা ধরে নতুন শহর দেখায় আনন্দ পাওয়া যায় না। কি জানি, দায়ে পড়লে হয়তো সব কিছুই সহ্য হয়ে যায়।
[দ্বিতীয় পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন এখানে]
_______________[দ্বিতীয় পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন এখানে]
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে।
No comments:
Post a Comment