কিংস ক্রস ট্যুরিস্ট আর ব্যাকপ্যাকারদের স্বর্গরাজ্য। দিনের আলো কমার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় নাইট লাইফ। বোঝাই যাচ্ছে কিংস ক্রস সিডনির রেড লাইট এরিয়া। এখানে নাইট লাইফ মানে বড় বেশি উচ্ছৃঙ্খলতা। পলিশের গাড়ি ঘন ঘন টহল দিতে শুরু করেছে। রাস্তার দু’পাশেই অনেকগুলো নাইট ক্লাব। একটু পর অ্যাডাল্ট শপ। লাইভ অ্যাডাল্ট শো চলছে নানা রকম ছোট বড় থিয়েটারে। সংক্ষিপ্ত পোশাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে অনেক মানুষ, শরীর বিক্রি করা এদের পেশা। যথাসম্ভব দ্রুত পায়ে পার হয়ে এলাম এই এলাকা। সোজা সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই চোখের সামনে সাগর। একদম সাগর ঘেঁষে চলে গেছে পায়ে চলা পথ। হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গার নাম দেখলাম উলুমুলু বে। নামটা বেশ সুন্দর। আরেকটু সামনে যেতেই রয়েল বোটানিক্যাল গার্ডেন। সিডনি শহরের বেশ কয়েকটা পার্কের একটা। সেই ১৮১৬ সালে গোড়াপত্তন হয়েছে এই পার্কের। পার্কের মাঝখানে পিরামিড আকৃতির গ্রিন হাউজে আছে হাজার রকমের ট্রপিক্যাল প্ল্যান্ট। বৃষ্টি না হলে পার্কে ওপেন এয়ার সিনেমা দেখানো হয় গ্রীষ্মকালে। পার্কের একপাশ দিয়ে সাইকেল ট্র্যাক আর পায়ে চলার পথ। এই পথ গিয়ে মিশেছে সিডনি অপেরা হাউজে।
অপেরা হাউজের চত্বরে এসে চোখ জুড়িয়ে গেলো। আলো ঝলমলে সিডনি অপেরা হাউজ যে এত সুন্দর তা নিজের চোখে না দেখলে মনে হয় খুব একটা বিশ্বাস করতাম না।
সিডনি শুধুমাত্র এই অপেরা হাউজ নিয়েই গর্ব করে বলতে পারে ‘আমিই অনন্য’। পৃথিবীর সেরা কয়েকটি স্থাপত্যের একটি হলো এই সিডনি অপেরা হাউজ। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সাগর থেকে জেগে উঠেছে বিরাট বিরাট ছয়টি সাদা ঝিনুক।
এই অপেরা হাউজ সম্পর্কে পড়েছিলাম একটা ম্যাগাজিনে। সিডনি শহরে কনসার্ট আর অপেরা মঞ্চস্থ করার জন্য ভালো কোন অডিটোরিয়াম ছিলো না। ১৯৪৭ সালে স্যার ইউজিন গুজেনস নিউ সাউথ ওয়েলসের কনজারভেটোরিয়াম অব মিউজিকের ডিরেক্টর হয়ে আসার পর উদ্যোগ নিলেন একটা ভালো কনসার্ট হল তৈরি করার। কিন্তু পরবর্তী সাত বছরেও তিনি তেমন কিছু করতে পারলেন না এ ব্যাপারে। রাজ্যের মান তো আর থাকে না অবস্থা যখন হলো, তখন ১৯৫৪ সালে নিউ সাউথ ওয়েলস এর প্রিমিয়ার জোসেফ কেহিল একটা কমিটি করে কনসার্ট হল তৈরির ব্যাপারটা এগিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যোগী হলেন।
প্রাথমিক খরচ ধরা হয়েছিল সত্তর লাখ ডলার। এই টাকা সংগ্রহ করার জন্য নানারকম সাহায্য তহবিল করা হলো। কিন্তু সব মিলিয়ে নয় লাখ ডলারের বেশি সংগ্রহ করা গেলো না। তখন অপেরা হাউজের নামে লটারি ছাড়া হলো। হু হু করে বিক্রি হলো লটারি। অনেক বছর ধরে চললো এই লটারি বিক্রি আর উঠে এলো এক কোটি ডলারেরও বেশি। অপেরা হাউজের বাজেটও বেড়ে গেলো সেভাবে।
যেখানে অপেরা হাউজ তৈরি হয়েছে সেই জায়গার নাম ছিলো বেনেলাং পয়েন্ট। বেনেলাং নামে একজন আদিবাসি জন্মেছিলেন এখানে এবং তিনিই ছিলেন প্রথম আদিবাসি যিনি ইংরেজি ভাষাকে নিজের ভাষা করে নিয়েছিলেন।
ডিজাইনের জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সেরা সেরা স্থপতিরা ২৩৩টি ডিজাইন সাবমিট করলেন। ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করা হলো। ডেনমার্কের স্থপতি জোয়ের্ন উৎজোনের ডিজাইন সেরা ডিজাইন মনোনীত হলো। ধারণা করা হয়েছিল পরবর্তী চার বছরের মধ্যেই তৈরি হয়ে যাবে অপেরা হাউজ। কিন্তু তা হয়নি।
১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে নির্মাণ কাজ শুরু হলো। কিন্তু এতই ধীরে ধীরে কাজ চলতে লাগলো যে পরবর্তী চৌদ্দ বছরেও কাজ শেষ হলো না। এর কারণও ছিলো অনেক। নির্মাণ কাজ শুরু করার পর দেখা গেলো স্থপতি জোয়ের্ন উৎজোন তাঁর ডিজাইন কমপ্লিট করেননি তখনো। ডিজাইন আর কন্সট্রাকশন একই সাথে চলতে লাগলো।
এদিকে সরকারের মনোভাবও ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। প্রথমে বলা হয়েছলো সাড়ে তিন হাজার দর্শক বসতে পারে এরকম একটা বড় অপেরা হল হবে আর একটা বারোশ' লোক বসার মতো ড্রামা হল হবে। সে হিসেবে প্রাথমিক ডিজাইন করা হয়েছিলো। এখন সরকার হাতে বেশি কিছু টাকা পেয়ে মনে করলো দুটোর জায়গায় চারটা থিয়েটার হল করা যেতে পারে। সে হিসেবে ডিজাইন চেঞ্জ করতে গিয়ে জোয়ের্ন উৎজোনের মাথা খারাপ হবার জোগাড়।
সরকার অবশ্য আবারো তার মনোভাব চেঞ্জ করে চারটার জায়গায় পাঁচটা থিয়েটার বানিয়েছে এই অপেরা হাউজে। জোশের বশে প্রথমে যেভাবে ডিজাইন করা হয়েছিলো, কাজে হাত দিয়ে দেখা গেলো সেভাবে হাউজ তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। পরে ছাদের ডিজাইন বদলে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে আসতে আরো চার বছর গবেষণা করতে হয়েছে উৎজোনকে। কাজ কিছুদিন এগোয় কিছুদিন বন্ধ থাকে। বাজেটে কুলোয় না, নির্মাণ খরচ বেড়েই চলেছে। সব দোষ গিয়ে পড়েছে স্থপতি উৎজোনের ঘাড়ে। কর্তৃপক্ষ বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে উৎজোনের ওপর।
১৯৬৫ সালের নির্বাচনে এই অপেরা হাউজ নির্মাণ একটা বিরাট ইস্যুতে পরিণত হলো, সরকারই বদলে গেলো। নতুন সরকার ক্ষমতায় এলো অপেরা হাউজের নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করবে এরকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
ক্ষমতায় এসেই তারা স্থপতি জোয়ের্ন উৎজোনের বেতন বন্ধ করে দিলো, আর নানারকম দোষ ধরতে লাগলো উৎজোনের ডিজাইনের। একজন শিল্পীর পক্ষে এরকম অপমান সহ্য করা সম্ভব নয়। উৎজোন পদত্যাগ করলেন। এটাই চাইছিলো নতুন সরকার।
১৯৬৬ সালে নির্মাণ কাজের হাল ধরলো অস্ট্রেলিয়ান স্থপতিদের একটি টিম। তারাই কাজ শেষ করলো। ১৯৭৩ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হলো এই অপেরা হাউজ। অস্ট্রেলিয়ান অপেরা গোষ্ঠীর ‘ওয়ার এন্ড পিস’ ছিলো প্রথম অপেরা এই সিডনি অপেরা হাউজের। এর এক মাস পরে অক্টোবরের ২০ তারিখে অপেরা হাউজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন রানি এলিজাবেথ।
অপেরা হাউজের প্রশস্থ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম। সামনেই হারবার ব্রিজ। ব্রিজের রেলিং এ এখনো জ্বলজ্বল করছে ‘ইটারনিটি’। দু’দিন আগে এখানে লক্ষ মানুষ জড়ো হয়েছিলো, আজ সবকিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা। নীরবতা চারিদিকে। অনেক মানুষ অবাক চোখে দেখছে এই অপূর্ব সৃষ্টি।
প্রায় এক হাজার ছোট বড় রুম আছে এই অপেরা হাউজে। পাঁচটি অডিটোরিয়াম, বিরাট এক রিসেপশান হল, পাঁচটি রিহার্সাল স্টুডিও, চারটি রেস্টুরেন্ট, ছয়টি থিয়েটার বার, ষাটটি গ্রিনরুম। অপেরা হাউজের এরিয়া হলো মোট সাড়ে পাঁচ একর। সাড়ে চার একর জায়গা জুড়ে এই ভবন সমুদ্রতলের চেয়ে ৬৭ মিটার উঁচুতে মাথা তুলে বসে আছে।
কী পরিমাণ লোহা সিমেন্ট লেগেছে এই বিশাল ভবন তৈরিতে তা নিয়ে সাধারণ কেউ মাথা ঘামায় না। কিন্তু কেউ যদি জানতে চায় তাহলে খুব সহজেই জানা যায় এখানের অফিস থেকে। পুরো অপেরা হাউজের ওজন এক লাখ একষট্টি হাজার টন। ৫৮০টি বিশাল বিশাল কংক্রিট পিলার চলে গেছে সমুদ্রের নিচে ৮২ ফুট গভীরে। তার ওপর বসে আছে এই বিশাল আইকন। এই বিল্ডিংএর সব কাঁচ এসেছে ফ্রান্স থেকে। পরিমাণও কম নয়, ৬৭ হাজার বর্গফুট। বৈদ্যুতিক তার যা ব্যবহার করা হয়েছে তা একটার সাথে অন্যটা যোগ করলে দৈর্ঘ্য হবে প্রায় চারশ মাইল। একদিনে এখানে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ লাগে তা দিয়ে পঁচিশ হাজার লোক বাস করে এমন একটা শহর আলোকিত করা যাবে।
সিঁড়ি বেয়ে একদম উপরের তলায় উঠে বারান্দায় পাতা চেয়ারে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। সামনেই সমুদ্র। ঢেউ এসে লাগছে অপেরা হাউজের দেয়ালে। ছোট ছোট ইঞ্জিন চালিত নৌকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকে। অপেরা হাউজের তিনদিকে ঘুরে দেখা যায় নৌকায় বসে। মনে হচ্ছে সিডনি শহর পুরোটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। এরকম একটা পরিবেশে মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। ছোট ছোট দুঃখ কষ্ট যেন দূর হয়ে যায়। যে কোন বিশালত্বের এটাই হয়তো বিশেষত্ব। সিডনির সব মানুষ কি সময় পায় এখানে এসে কিছুক্ষণ বসে থাকার? কোন কিছু না করে শুধু সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকার! ইন্ডিয়ান কারি পয়েন্টের ছেলেটা কি কখনো এসেছে এখানে?
আস্তে আস্তে নেমে এলাম। হারবার ব্রিজের ‘ইটারনিটি’ আমাকে টানছে। বাম দিকের পায়ে চলার পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ব্রিজের কাছে। যতটা কাছে মনে হয়েছিল আসলে ততটা কাছে নয়। মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ হাঁটতে হলো। ব্রিজের কাছে এসে দেখি উঠতে হবে প্রায় একশো ধাপ উপরে। পায়ে শক্তি নেই তত। কাল আবার আসতে হবে ভেবে জর্জ স্ট্রিটে উঠে এলাম।
রাত এখন গভীর। কিন্তু মনে হচ্ছে না এই শহর ঘুমাবে কখনো। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম কিংস ক্রসে। এখানে এখন আরো ভিড়। ফুটপাতে হাঁটতে গেলে অন্যের গায়ে ধাক্কা দিয়ে বা অন্যের ধাক্কা খেয়ে হাঁটতে হচ্ছে। উচ্চস্বরে বাজনা বাজছে। তার উপরে মাতাল দেহজীবীদের উপদ্রব আছে। গায়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করে সঙ্গী লাগবে কিনা। আর সবচেয়ে বেশি আছে ড্রাগ ডিলিং। পুলিশ সব জানে। তারা পয়সা হয়তো খায় না, কিন্তু কঠিন হাতে দমনও করে না। জাস্ট রুটিন টহল দিয়েই খালাস। আর ঘুষ তারা খায় না এটাও বলি কিভাবে। একটা বোঝাপড়া না থাকলে এরকম প্রকাশ্যে ড্রাগের ব্যবসা চলে কীভাবে? কোন রকমে গা বাচিয়ে চলে এলাম আমার হোস্টেলে।
রুম অন্ধকার। বাতি জ্বালালাম। সারাহ ঘুমাচ্ছে। রুমে আর কেউ নেই। আমি জুতো খুলে বাথরুমে ঘুরে এসে আমার দোতলা বিছানায় উঠে বসতেই চোখ খুলল সেরাহ - "হাই!"
সেরাহর চোখ ফোলা ফোলা। অনেকক্ষণ থেকে কি ঘুমাচ্ছে সে?
জিজ্ঞেস করলাম, "বাইরে যাওনি আর?"
"গিয়েছিলাম, ফিরে এসেছি।"
"বন্ধুরা কোথায়?"
"তারা নাইট ক্লাবে গেছে। সেখানে আমাকে আর দরকার নেই তাদের। তাছাড়া নাইট ক্লাবে দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। তুমি কোথায় কোথায় ঘুরলে?"
গল্প করার মুডে আছে সেরাহ। আমারও খারাপ লাগছে না তার সাথে কথা বলতে। এরকম মিষ্টি গলা আমি অনেকদিন শুনিনি। সেরাহ তার বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়েছে। আমি আমার বিছানায়। মুখোমুখি কথা বলছি আমরা। মাঝখানে লোহার বিছানার ছয় ইঞ্চি উচ্চতার রেলিং।
সিডনি শহরের অনেক তথ্য জানে সেরাহ। মনে হচ্ছে কলেজে তার মেজর সাবজেক্ট সিডনির ইতিহাস। কিন্তু না, তার মেজর সাবজেক্ট হলো সাইকোলজি। সিডনি শহর সম্পর্কে অনেক জানা-অজানা তথ্য শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
________________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে
No comments:
Post a Comment