Saturday, 10 November 2018

মেরি কুরির কাহিনি - ৫ম পর্ব



বিকেলে সাইকেলে চেপে হানিমুনে বের হলেন কুরি দম্পতি। নতুন বিয়ের চিহ্ন হিসেবে মেরির সাইকেলে একগোছা বুনোফুল বেঁধে দেন পিয়ের। বাগান মাঠ-ঘাট বন-বাদাড়ে কয়েক মাইল সাইকেলে ভ্রমণ করলেন মেরি ও পিয়ের। পিয়ের সাইকেল চালাতে চালাতে বলছিলেন তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। বলাবাহুল্য সব পরিকল্পনাই গবেষণা সংক্রান্ত। মেরিও গভীর মনযোগে বৈজ্ঞানিক আলোচনায় মেতে উঠলেন তাঁদের বিয়ের প্রথম দিনেই। 


বিয়ের পর সাইকেলে চেপে হানিমুনে পিয়ের ও মেরি

পথে এক জায়গায় সাইকেলদুটো রেখে বুনো পথে পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন নবদম্পতি। পিয়ের বিভিন্ন গাছের নাম বলছেন মেরিকে। ছোটবেলায় এরকম বুনো জঙ্গলে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটতো তাঁর। 

একসময় বুনোফুলে ভর্তি এক হ্রদের পাড়ে বসলেন দু’জনে। পিয়ের মেরিকে বললেন, “তোমার হাতটা একটু দেবে?”

মেরি ভাবলেন এতক্ষণে হুঁশ হলো তাঁর স্বামীর। বিয়ের পর এতক্ষণ একবারের জন্যও স্ত্রীর হাত ধরার কথা মনে হয়নি পিয়েরের। মেরি অনুরাগে চোখ বন্ধ করে হাত বাড়িয়ে দিলেন স্বামীর দিকে। একটু পরে হাতে ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল মেরির। তাঁর হাতের তালুতে বসে আছে একটা ছোট্ট সোনালি  ব্যাঙ। ঘেন্নায় আতঙ্কে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল মেরির। হাত ঝেড়ে ব্যাঙটাকে যে ফেলে দেবেন তাও পারছেন না তিনি। 

“কী সুন্দর না? ব্যাঙটাকে একটু আদর করে দাও।”

এসব কী বলছেন পিয়ের! পিয়েরের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেন মেরি - প্র্যাকটিক্যাল জোক্‌ করছেন, নাকি আসলেই? পিয়েরের চোখেমুখে কৌতুকের লেশমাত্র নেই। তিনি সিরিয়াস। প্রকৃতির সাথে সাথে প্রকৃতির প্রাণীদের প্রতিও মায়া-মমতা পিয়েরের। 

একদিনের হানিমুন সেরে প্যারিসে ফিরলেন নবদম্পতি। ডি লা গ্লাসিয়ে রোডের একটা বহুতল ভবনের চারতলার সাদামাটা তিন রুমের অ্যাপার্টমেন্টে শুরু হলো পিয়ের-মেরির সংসার। 

আসবাবপত্র বলতে তেমন কিছু নেই। পড়ার ঘরটাতে একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার, শোবার ঘরে একটা পুরনো খাট আর কিচেনে একটা টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার। ঘরের সব কাজ মেরি নিজেই করেন। সকালে একজন ঠিকে ঝি আসেন এক ঘন্টার জন্য; ভারী কাজগুলো করে দিয়ে যান। মেরি তখন দোকানে গিয়ে রুটি চিজ কিনে নিয়ে আসেন। 

পিয়েরও হাত লাগান কিচেনে। দু’জনে ব্রেকফাস্ট সেরে লাঞ্চ-প্যাক সাথে নিয়ে বেরিয়ে যান ইপিসিআই’র উদ্দেশ্যে। পিয়ের সারাদিন ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। মেরি ইস্পাতের চৌম্বকধর্মের পরীক্ষা করেন পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষাগারে। বিকেলে দু’জন পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফেরেন। আসার পথে বাজার করে নিয়ে আসেন। 

মেরি খেয়াল করে দেখেছেন পিয়ের খাবার দাবারের ব্যাপারে ভীষণ উদাসীন। বাঁচার জন্য খেতে হয় বলেই খাওয়া। এতবছর ধরে নিজের খাবার নিজে রান্না করে খেয়েছেন - কিন্তু কী খেয়েছেন ঠিক জানেনও না। মেরিরও একই অবস্থা। চা আর রুটি খেয়েই তিনি সরবোনের ছাত্রীজীবন কাটিয়েছেন। 

কিন্তু এখন তাঁর ইচ্ছে হচ্ছে স্বামীর জন্য ভালো কিছু রান্না করতে। কিন্তু কিছুই তো রাঁধতে জানেন না তিনি। ব্রোনিয়ার শাশুড়ির কাছ থেকে বেশ কিছু রান্না শিখে নিলেন মেরি। বাড়িতে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি রান্নায় বেশ দক্ষ হয়ে উঠলেন। নিজস্ব কিছু রান্নার রেসিপিও আবিষ্কার করে ফেললেন যেগুলো খুব কম সময়ে করে ফেলা যায়। মেরির রান্না খেয়ে পিয়ের প্রশংসা করেন ঠিকই - কিন্তু মেরি বুঝতে পারেন পিয়ের রান্নার স্বাদের ভালোমন্দ কিছুই বোঝেন না বা বোঝার প্রয়োজন মনে করেন না। 

পিয়েরকে যতই দেখছেন অবাক হচ্ছেন মেরি - মানুষটা পারতপক্ষে একটা পিঁপড়াকেও কষ্ট দিতে চান না। কারো সাথে মতানৈক্য হলে খুবই ঠান্ডাভাবে নিজের মতামত জানান। কখনোই গলায় রাগ বা ক্ষোভ প্রকাশ পায় না। এমন ঠান্ডা মানুষটা আবার ভীষণ জেদি - কোন কিছুর ব্যাপারে মনস্থির করে ফেললে সেখান থেকে কিছুতেই সরানো যায় না তাঁকে।  

প্রতিরাতে ডিনারের পর পড়ার ঘরের টেবিলের দু’দিকে দু’জন বসে পড়াশোনা করেন। পিয়ের তাঁর নতুন কোর্স রেডি করেন। আর মেরি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হাসি আনন্দ ভালোবাসা আর ব্যস্ততায় সুখের স্রোতে ভাসতে ভাসতে দ্রুত বছর কেটে যায়। 

১৮৯৬ সালের আগস্ট মাসে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ফল বেরোয়। মেরি কুরি এখানেও প্রথম হয়েছেন। প্যারিসের মেয়েদের স্কুলে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন মেরি। 

আনন্দের কোন ঘটনা ঘটলে তা উদ্‌যাপনের জন্য মেরি আর পিয়ের সাইকেল ভ্রমণে বের হন। সাইকেলে চেপে কয়েক মাইল ঘুরে এসে আবার নিয়মিত পড়াশোনা। প্রতি সপ্তাহে সাইকেলে চেপে দু’জনে পিয়েরের মা-বাবাকে দেখে আসেন। 

পরের বছর কুরি পরিবারে নতুন সদস্য আসার সম্ভাবনা দেখা দিলো। মা-বাবা হবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন পিয়ের ও মেরি। কিন্তু তাতে তাদের প্রাত্যাহিক পড়াশোনা ও গবেষণার রুটিনে কোন পরিবর্তন হলো না। 

এত আনন্দের মধ্যেও কষ্টের ছায়া পড়লো - পিয়েরের মায়ের স্তন-ক্যান্সার ধরা পড়েছে। একেবারে শেষ সময়। ছোটবেলায় নিজের মাকে হারিয়ে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন মেরি। বিয়ের পর পিয়েরের মা নিজের মেয়ের মতই স্নেহ ভালোবাসা দিয়েছেন মেরিকে। পিয়ের যতটুকু সময় পাচ্ছেন মায়ের সেবা করছেন। ডাক্তার ইউজিন সারাক্ষণ লেগে আছেন স্ত্রীর সেবায়। কিন্তু ক্যান্সারের কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি তখনো। কুরি পরিবারের আবহাওয়ায় একটা দুঃখের ছায়া ঘিরে ধরলো।

আসন্ন সন্তানসম্ভবা মেরি জুলাই মাসে কিছুটা মুক্ত-হাওয়ায় বিশ্রাম নেয়ার জন্য তাঁর বাবার কাছে চলে গেলেন পোর্ট ব্লাঁতে। মেরির বাবা তখন সেখানে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাচ্ছিলেন। বিয়ের পর এতদিন একটা দিনের জন্যও পিয়েরকে ছেড়ে থাকেননি মেরি। এই প্রথম পিয়েরকে ছেড়ে একা কোথাও রাত কাটাচ্ছেন তিনি। পিয়েরকে খুব মিস করছিলেন তিনি। এদিকে মায়ের সেবার জন্য প্যারিসে রয়ে যাওয়া পিয়েরও মেরির জন্য ছটফট করছিলেন। মাসখানেক পর পিয়েরের দাদা জাকো ছুটি নিয়ে মায়ের সেবা করার জন্য বাড়িতে এলে পিয়ের চলে আসেন মেরির কাছে। 

পোর্ট ব্লাঁতে কোন নার্সিং হোম খুঁজে পেলেন না পিয়ের। তড়িঘড়ি প্যারিসে ফিরে এলেন তিনি মেরিকে নিয়ে। কিন্তু ততক্ষণে মেরির প্রসব বেদনা শুরু হয়ে গেছে। মেরিকে নিয়ে দ্রুত বাবার বাড়িতে চলে এলেন পিয়ের। ডাক্তার ইউজিনের হাতে ১৮৯৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জন্ম হলো পিয়ের ও মেরি কুরির প্রথম সন্তান। মা-বাবা মেয়ের নাম রাখলেন আইরিন। পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো। এর দু’সপ্তাহ পর পিয়েরের মা মারা যান। 

কয়েক সপ্তাহ বিশ্রাম নিয়েই কাজে ফিরতে চাইলেন মেরি। ব্যক্তিগত কারণে কাজ বন্ধ রাখার পক্ষপাতী তিনি নন। আবার কাজে গিয়েই তাঁর মনে হতে থাকে - আইরিন ঠিক আছে তো? আইরিনের দেখাশোনার জন্য একজন নার্স নিয়োগ দিয়েছেন তাঁরা। তবুও মায়ের মন মানে না। কাজের মাঝে মেয়ের কথা মনে হলে হঠাৎ কাজ থামিয়ে দৌড়ে বাসায় এসে হাজির হন মেরি। আইরিন ঠিক মত ঘুমাচ্ছে দেখে আবার কাজে ফেরেন। 

মেরির মনে হতে থাকে আইরিন তাঁর আরেকটি বিজ্ঞানিক প্রকল্প - যার ঠিকমত বেড়ে ওঠার সব দায়িত্ব তাঁদের। তিনি তাঁর গবেষণার ল্যাব-বই এর মত আইরিনের জন্যও একটা বড় খাতা তৈরি করলেন। সেখানে আইরিনের ক্রম-পরিবর্তনের বিস্তারিত বিবরণ লিখে রাখতে শুরু করলেন। দিনে ক’ঘন্টা ঘুমালো - ক’বার বাহ্যি করলো - কী খেলো - বমি করলো কিনা সবকিছু। 


পিয়ের, মেরি, ইউজিন ও আইরিন

স্ত্রীর মৃত্যুর পর একা হয়ে গেছেন ডাক্তার ইউজিন। এদিকে বাড়িতে শুধুমাত্র নার্সের হাতে মেয়েকে রেখে কাজে গিয়ে শান্তি পান না পিয়ের ও মেরি। তাঁরা গিয়ে বাবাকে বলতেই সানন্দে রাজী হয়ে গেলেন ডাক্তার ইউজিন কুরি। তিনি চলে এলেন পিয়ের ও মেরির বাসায়। দায়িত্ব নিলেন আইরিনের। আইরিনের জীবনে প্রথম ফ্রেন্ড, ফিলোসফার ও গাইড - তার দাদু ইউজিন কুরি। নিজের মা-বাবার চেয়েও দাদুর প্রভাব বেশি আইরিনের জীবনে। 

নিশ্চিন্ত মনে কাজ করছেন মেরি ও পিয়ের। পিয়ের কৃস্টালের গঠনের ওপর চৌম্বকত্বের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন। মেরি পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট করার জন্য উপযুক্ত বিষয় খুঁজছেন। মেরির আগে শুধু ফ্রান্সে নয় - পুরো ইউরোপেই কোন মেয়ে ডক্টরেট করেননি। পিয়ের সমানে উৎসাহ দিচ্ছেন মেরিকে। 

গবেষণা করার জন্য বিষয় নির্বাচন করতে গিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাপত্রগুলো পড়তে পড়তে একটা গবেষণার প্রতি মেরির গভীর আগ্রহ সৃষ্টি হলো। ফ্রান্সের বিজ্ঞানী হেনরি বেকোয়ারেলের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ১৮৯৬ সালে। এর আগের বছর ১৮৯৫ সালে জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেল্‌ম রন্টগেন এক্স-রে আবিষ্কার করে সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলেছেন। হেনরি বেকোয়ারেল চেষ্টা করছিলেন এক্স-রেকে কাজে লাগানোর। ফটোগ্রাফিক ফিল্ম এর উপর এক্স-রে নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে বেকোয়ারেল দেখলেন ইউরেনিয়াম থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে এক প্রকার রশ্মি নির্গত হয়, যা দৃশ্যমান আলোর চেয়ে শক্তিশালী। এই রশ্মি এক্স-রে’র মতোই শক্ত ধাতব পদার্থ ভেদ করে ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর ছাপ রাখতে পারে। কিন্তু এক্স-রে এবং এই অজানা রশ্মি এক নয়। 

বেকোয়ারেল এই সময় শুধু এইটুকু জানতেন যে অদৃশ্য শক্তিশালী রশ্মিগুলো বের হয়। কিন্তু রশ্মিগুলো কী বা কেন ওগুলো বের হয় তা নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামাননি। এমন কি বেকোয়ারেল নিজেও আর উৎসাহ দেখাননি। মেরি খুবই উৎসাহিত হয়ে উঠলেন এই রশ্মির উৎস সন্ধানে। সমস্ত অজানা প্রশ্ন যেন মেরির জন্যই অপেক্ষা করছিলো।

মেরি যে স্কুলে শিক্ষকতা করেন সেই স্কুলের স্টোর রুমটাকে গবেষণাগার হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি পেলেন। ছোট্ট সেই রুমটা এত স্যাঁতস্যাঁতে এবং ঠান্ডা যে অনেক যন্ত্রপাতি ঠিকমত কাজ করে না। তারপরও মেরি চেষ্টার ত্রুটি করেননি এতটুকু। 

পিয়ের ও জাকো অনেকদিন আগে একটা সুবেদি ইলেকট্রোমিটার বানিয়েছিলেন। মেরি সেটাকে কাজে লাগালেন। ঐ ইলেকট্রোমিটার দিয়ে তিনি বেকোয়ারেলের আবিষ্কৃত ইউরেনিয়ামের রশ্মিগুলোর শক্তিমাত্রা পরিমাপ করতে লাগলেন। 

দিনের পর দিন বিভিন্ন ধাতুর নমুনা নিয়ে পরীক্ষার পর পরীক্ষা করে মেরি দেখলেন যে রশ্মিগুলোর শক্তিমাত্রা নির্ভর করে নমুনায় ইউরেনিয়ামের পরিমাণের উপর। এই পরিমাণ যত বেশি হবে রশ্মিগুলোর শক্তিমাত্রাও তত বেশি হবে। ইউরেনিয়ামের সাথে কী মেশানো আছে, বা নমুনাটি শুষ্ক কিংবা ভেজা, শক্ত কিংবা দানাদার, ঠান্ডা বা গরম, এই সমস্ত অনুষঙ্গের উপর মোটেও তা নির্ভর করে না, শুধু নির্ভর করে নমুনায় কতটুকু ইউরেনিয়াম আছে তার উপর। 

ইউরেনিয়াম ছাড়া আর কোন মৌল তেজষ্ক্রিয় রশ্মি ছড়ায় কিনা জানার জন্য মেরি সেই সময় পর্যন্ত জানা সবগুলো ধাতুই পরীক্ষা করে দেখলেন। দেখলেন ইউরেনিয়ামের মত থোরিয়াম থেকেও তেজষ্ক্রিয় রশ্মি বের হয়। উৎসাহিত হয়ে মেরি আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন। এবার বিভিন্ন ধরনের যৌগ নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন যদি তেজষ্ক্রিয়তা পাওয়া যায়। বালি, পাথর, খনিজ কিছুই বাদ গেলো না। একদিন ঘটলো অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। 

পিচব্লেন্ড পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলেন ইউরেনিয়ামের চেয়ে চারগুণ শক্তিশালী তেজষ্ক্রিয় রশ্মি বের হচ্ছে। মাপতে ভুল করলেন না তো? আবার পরীক্ষা করলেন। বার বার, দশবার, বিশবার - প্রতিবারই একই ফল পাওয়া গেল। পরীক্ষা নির্ভুল। পিচব্লেন্ডে এমন কোন তেজষ্ক্রিয় মৌল আছে যা থোরিয়াম বা ইউরেনিয়ামের চেয়ে ভিন্ন এবং অধিক তেজষ্ক্রিয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যেসব মৌলের কথা জানেন সেসব মৌলের সবগুলোকেই তো তিনি পরীক্ষা করে দেখেছেন। তবে কি নতুন কোন মৌলের সন্ধান পেতে চলেছেন তিনি? উত্তেজিত হয়ে উঠলেন মেরি। 


পরীক্ষাগারে মেরি ও পিয়ের

উত্তেজনা ছড়িয়ে গেল পিয়েরের মধ্যেও। তিনি নিজের গবেষণা একপাশে সরিয়ে রেখে এগিয়ে এলেন মেরির গবেষণায় সাহায্য করতে। থোরিয়াম ও ইউরেনিয়ামের তেজষ্ক্রিয়তা সম্পর্কিত মেরির গবেষণাপত্র ফ্রেন্স একাডেমি অব সায়েন্সে পড়া হয়েছে এবং প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞান জগতে মেরির সার্থক প্রবেশ ঘটে গেছে। কিন্তু বিজ্ঞান জগতে নতুন কোন কিছুই তর্কাতীত নয়। কোন কোন বিজ্ঞানী সন্দেহ করলেন - মেরি হয়তো কোথাও ভুল করছেন। নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে হলে মেরিকে অবশ্যই অজানা মৌলটি আবিষ্কার করে দেখাতে হবে। পিচব্লেন্ডে যে অজানা মৌলটি আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাহলে পিচব্লেন্ড থেকে জানা মৌলগুলোকে আলাদা করে ফেললেই অজানা পদার্থটি পাওয়া যাবে। 


শুরু হলো দিনরাত্রি পরিশ্রম। ১৮৯৮ সালের ৬ই জুন পাওয়া গেল একটি তেজষ্ক্রিয় নতুন মৌল যার তেজষ্ক্রিয়তা ততটা শক্তিশালী নয়। তাহলে? আরো একটা মৌল নিশ্চয় আছে। আবার কাজ। কাজের অগ্রগতি ল্যাব-বইতে লিখে রাখেন। এদিকে আইরিনের বেড়ে ওঠাও লিখে রাখেন সমান গুরুত্বের সাথে। যেমন ১৮৯৮ সালের ২০ জুলাই মেরি লিখছেন - “দশ মাস বয়সী আইরিন চার হাত-পা দিয়ে বেশ দ্রুত হাঁটতে পারে। কথা বলতেও শিখছে। আজ বললো - ‘গুগলি, গুগলি, গু’।”

১৮৯৮ সালের ডিসেম্বরে পাওয়া গেল সেই অতিশক্তিশালী মৌল - মেরি যার নাম রাখলেন রেডিয়াম। আগে পাওয়া মৌলটির নাম রাখলেন জন্মভূমি পোল্যান্ডের নামানুসারে পোলোনিয়াম। 

মেরি ও পিয়েরের আগে আর কেউ দেখেননি রেডিয়াম। একতাল পিচব্লেন্ডের মধ্যে একটিমাত্র বালুকণার মত রেডিয়াম বর্তমান। তার শক্তিই এতো! কিন্তু বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দেখাতে গেলে তো মোটামুটি কিছু পরিমাণ রেডিয়াম আলাদা করা দরকার। তারজন্য তাদের দরকার প্রচুর পরিমাণ পিচব্লেন্ড। পিয়ের ও মেরি খুঁজতে লাগলেন কোথায় পাওয়া যাবে প্রচুর পিচব্লেন্ড।

জানা গেলো অস্ট্রিয়ার একটি কারখানায় বর্জ্য হিসেবে পিচব্লেন্ড পাওয়া যায় এবং তারা তা ফেলে দেয়। কিন্তু তা বলে অন্য একটা দেশে গিয়ে টন টন পিচব্লেন্ড নিয়ে আসা তো সম্ভব নয়। সরকারি দপ্তরে অনেক দেনদরবার করে পিয়ের হাঙ্গেরিয়ান সরকারের অনুমোদন পেলেন কয়েক টন পিচব্লেন্ড নিয়ে আসার। হাঙ্গেরিয়ান কর্মকর্তারা মনে করলেন পিয়ের ও মেরি পাগল হয়ে গেছেন - তাই পয়সা খরচ করে মাটি নিয়ে যাচ্ছেন ফ্রান্সে। 

এদিকে আরেক সমস্যা দেখা দিলো। মেরির স্কুলের যে ভাঙা শেডে এতদিন কাজ করেছেন - তা এত ছোট যে সেখানে কাজ করা তো দূরের কথা পিচব্লেন্ড রাখার জায়গাও হবে না। কাজের জায়গা দরকার মেরি ও পিয়েরের। সমস্ত যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে সরবোন ইউনিভার্সিটির কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলেন পিয়ের ও মেরি। 

সরবোনের এলিট কর্মকর্তারা পিয়ের ও মেরিকে পাগল-দম্পতি হিসেবে নামকরণ করে ফেলেছে। সবাই আড়ালে হাসি-তামাশা করে পিয়ের ও মেরিকে নিয়ে। তাঁরা কোন সাহায্য করলেন না। 

পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের নতুন পরিচালক প্রফেসর গ্যাব্রিয়েল আরো এককাঠি এগিয়ে গিয়ে ডিপার্টমেন্টে নোটিশ জারি করে দিয়েছেন - তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ যেন পিয়ের-মেরির সাথে কথা না বলেন। সরবোনের কোন ল্যাবে জায়গা হলো না মেরি ও পিয়েরের। 

শেষ পর্যন্ত উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মেরি ও পিয়েরকে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় যে জায়গাটি কাজ করার জন্য দিতে সম্মত হলো তা একটা পরিত্যক্ত শেড - যা মেডিকেল ফ্যাকাল্টির মর্গ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখন তার ছাদ ফুটো, মেঝে ভাঙা। গরমের দিনে উত্তপ্ত চুলা হয়ে ওঠে ঘরটি আর শীতে পানি জমে বরফ হয়ে হয়ে। অনন্যোপায় হয়ে সেখানেই কাজ শুরু করলেন মেরি ও পিয়ের।

[৬ষ্ঠ পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন এখানে]

_________
এই কাহিনি আমার "রেডিয়াম ভালোবাসা" বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Doesn't Rachi's death make us guilty?

  Afsana Karim Rachi began her university life with a heart full of dreams after passing a rigorous entrance exam. She was a student of the ...

Popular Posts