এত ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁরা একটা নিয়মিত সামাজিক আড্ডা দেবার সময় বের করে নিয়েছেন। নিজেদের বাড়ির বাগানে বসে রবিবার বিকেলে সবাই মিলে আড্ডা দেন। সেই আড্ডায় ছেলে-মেয়েদের নিয়ে যোগ দেন প্রতিবেশী বন্ধু ও অধ্যাপকেরা। আইরিনের বয়স এখন আট, ইভ মাত্র একবছর। অধ্যাপক জাঁ পেরি কুরিদের পাশেই থাকেন। [জাঁ পেরি ১৯২৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।] পেরির স্ত্রী হেনরিয়েট মেরির বন্ধু। হেনরিয়েটের মেয়ে আলিন আইরিনের বন্ধু। আড্ডায় আরো একজন নিয়মিত যোগ দেন - তিনি হলেন ইপিসিআই এর পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক পল লাঁজেভি।
শুরুতে সামাজিক হালকা কথাবার্তা হলেও কিছুক্ষণ পরেই দেখা যায় আলাপ আলোচনা সব বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড সংক্রান্ত হয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানচর্চা যে কখনোই মানবতাবর্জিত হয়ে পারে না সে ব্যাপারে সবাই একমত। বিজ্ঞানকে টাকা উপার্জনের অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করার ঘোর বিপক্ষে সবাই। তাই তো দেখা যায় ডাক্তারি করে যেখানে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করতে পারতেন - সেখানে মানুষকে ভালোবেসে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই অর্জন করেননি পিয়েরের বাবা ইউজিন কুরি।
তাঁর ছেলেরাও হয়েছেন তেমনি। নোবেল পুরষ্কার পাবার পরেও দুটো চাকরি করতে হচ্ছে মেরি কুরিকে। রেডিয়াম ও পোলোনিয়াম আবিষ্কারের প্যাটেন্ট নিলে কোটি কোটি ফ্রাঙ্ক উপার্জন করা কোন ব্যাপারই ছিল না মেরি ও পিয়েরের জন্য।
দুর্দান্ত বিজ্ঞানী পল লাঁজেভি। স্বয়ং আইনস্টাইন বলেছেন লাঁজেভি সম্পর্কে - “আমি যদি আপেক্ষিক তত্ত্ব আবিষ্কার না করতাম তাহলে লাঁজেভি তা আবিষ্কার করতেন।” লাঁজেভি স্ত্রী ও চার সন্তানের ভরণ-পোষণ মেটাতে ইপিসিআই’র অধ্যাপনা ছাড়াও মেরির স্কুলেও পার্ট-টাইম পড়ান।
১৯০৬ সাল এসে গেলো। সরবোনে পিয়েরের ল্যাব এখনো তৈরি হয়নি। সরকারের নানা টালবাহানা চলছে তো চলছেই। পিয়ের ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন ধনীলোকের কাছে আবেদনও করেছেন। কিন্তু তেমন কোন সাড়া মেলেনি। বিজ্ঞানের সুফল ভোগ করে সবাই, প্রশংসা করে কেউ কেউ, কিন্তু বিজ্ঞানের উন্নয়নে গাঁটের পয়সা খরচ করতে রাজি নয় কেউ। নানা কাজে প্রচন্ড ব্যস্ত পিয়ের। মেরিও সমানে ব্যস্ত। বাড়িতে আইরিন ও ইভকে দেখার জন্য একজন সার্বক্ষণিক আয়া রাখা হয়েছে। পিয়ের দিন দিন ভুলোমনা হয়ে যাচ্ছেন। গবেষণা, ল্যাব, ইউনিভার্সিটির কাজ ছাড়া ব্যক্তিগত সুখদুঃখের কোন ব্যাপারই যেন তাঁর নেই। এক সাথে খেতে বসলেও দেখা যাচ্ছে কেবল কাজের কথাই হচ্ছে। মেরি বিশেষ দিনে হয়তো পিয়েরের জন্য ভালো কোন খাবার তৈরি করলেন। পিয়ের খেতে বসে ঠিকমত খেয়ালই করলেন না কী খেলেন।
ইস্টারের ছুটিতে সবাই মিলে প্যারিস থেকে এক ঘন্টার দূরত্বে একটা ফার্ম হাউজে কাটিয়ে এলেন কয়েকদিন। মেরি বিশ্বাস করেন খোলামেলা পরিবেশেই ছেলেমেয়েদের মেধার বিকাশ ঘটে। ওখান থেকে প্যারিসে ফিরলেন ১৮ এপ্রিল। এসেই সন্ধ্যাবেলা ছুটলেন ফিজিক্যাল সোসাইটির অ্যানুয়েল ডিনারে। সেখানে গণিতবিদ হেন্রি পয়েনকেয়ারের সাথে অনেক কথা হলো কুরিদের। ফেরার পথে ঝুম বৃষ্টি। প্রায় আধভেজা হয়ে ঘরে ফিরলেন মেরি ও পিয়ের। সারা রাত ধরে অঝোরে বৃষ্টি হলো প্যারিসে।
পরদিন সকালেও বৃষ্টি থামেনি। ইউনিভার্সিটিতে যাবার জন্য ছাতা হাতে রেডি হলেন পিয়ের। মেরি তখন দোতলায় আইরিনকে রেডি করাচ্ছেন। নিচে বেরোবার মুখে পিয়ের ডাকলেন মেরিকে,
“তুমি কি দুপুরে ইউনিভার্সিটিতে যাবে? আমার সাথে কি দেখা হবে?”“না, তুমি যাও। আমি কোথায় ব্যস্ত থাকি জানি না। আমার জন্য অপেক্ষা করো না” - দোতলা থেকে জবাব দেন মেরি। ছাতা মাথায় বেরিয়ে যান পিয়ের।
ইউনিভার্সিটিতে অনেক কাজ ছিল তাঁর। লাঞ্চটাইমে প্রফেসর্স অ্যাসোসিয়েশনের মিটিং। পিয়ের অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট। প্রফেসরদের অনেকের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুত্বও আছে। তাঁদের অনেকের সেই রাতে পিয়ের-মেরির বাসায় ডিনারের নিমন্ত্রণ।
বেলা আড়াইটার দিকে মিটিং শেষ করে বন্ধুদের ডিনারের নিমন্ত্রণের কথা মনে করিয়ে দিয়ে পিয়ের জাঁ পেরিকে সাথে নিয়ে ছুটলেন গ্রান্ড অগাস্টিনের উদ্দেশ্যে। সেখানে একটি বই প্রকাশকের সাথে তাঁর প্রুফ দেখার কথা। গিয়ে দেখলেন প্রকাশকের অফিস বন্ধ। জাঁ পেরি সেখান থেকে নিজের বাসায় চলে গেলেন। পিয়ের ‘সন্ধ্যায় দেখা হবে’ বলে বিদায় দিলেন পেরিকে। বাসায় ফেরার পথে লাইব্রেরি হয়ে যাবার জন্য ইউনিভার্সিটির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।
রাস্তায় প্রচন্ড ভীড়। বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে আছে রাস্তা। ঘোড়ায় টানা গাড়ি ছুটে চলেছে দু’দিক থেকেই। বড় বড় ওয়াগন টেনে নিয়ে যাচ্ছে অনেকগুলো ঘোড়া। প্রচন্ড ভীড়ে ঘোড়াগুলোকে সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে চালক। এমন সময় সেনাবাহিনীর পোশাক-ভর্তি বড় একটা ওয়াগন আসতে দেখা গেল।
দ্রুত রাস্তা পার হতে গিয়ে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেলেন পিয়ের। লোকজন হৈ চৈ করে ঘোড়ার গাড়িটাকে থামতে বললো। চালক ঘোড়াদের থামানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। ঘোড়াগুলো চলতেই থাকলো। চালক কোনরকমে গাড়ির সামনের চাকা থেকে পিয়েরকে বাঁচালেন। কিন্তু পিয়ের উঠে বসার আগেই পেছনের চাকা তাঁর ঠিক মাথার খুলির উপর দিয়ে গড়িয়ে গেল। রাস্তায় ছিটকে পড়লো পিয়েরের মগজ। সাথে সাথেই মৃত্যু হলো তাঁর। কপালের উপর থেকে মাথার খুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল শরীর থেকে। অথচ চোখ নাক মুখ সহ শরীরের বাকি অংশ অক্ষত।
পিয়েরের পকেট থেকে ইউনিভার্সিটির পরিচয়পত্র দেখে তাঁকে শনাক্ত করলেন স্থানীয় পুলিশ। দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়লো প্যারিসের একাডেমিক জগতে। ইউনিভার্সিটি থেকে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই ছুটে এলেন ঘটনাস্থলে।
এদিকে পিয়েরের বাড়িতে একের পর এক অফিসার এসে মেরির খোঁজ করছেন। মেরি আর আইরিন তখনো স্কুলে। ষোল মাস বয়সী ইভকে নিয়ে বাসায় আছেন পিয়েরের বাবা। কেউ তাঁকে কিছু বলছেন না। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন কিছু একটা হয়েছে। শেষে জাঁ পেরিকে দেখে বুঝলেন পিয়েরের মারাত্মক কিছু হয়েছে। পিয়ের আর নেই। মাত্র ৪৭ বছর বয়সেই তাঁর ছেলে মরে গেলো! এভাবেই শেষ হয়ে গেল বিপুল সম্ভাবনাময় এক বিজ্ঞানীর জীবন। শোকে বুক ভেঙে যাচ্ছে ডাক্তার ইউজিনের। অবুঝ নাতনিকে বুকে ধরে নিজেকে শক্ত করে রেখে অপেক্ষা করছেন মেরির জন্য।
সেদিন অন্যান্য দিনের তুলনায় কিছুটা আগেই শেষ হয়ে গেলো মেরির কাজ। আইরিনকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরলেন একটু তাড়াতাড়ি। সন্ধ্যায় প্রফেসরদের ডিনারের ব্যবস্থা করতে হবে বাসায়। কিন্তু বাসার কাছে আসতেই লোকজনের ভীড় দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেলেন তিনি।
শুরুতে মনে হলো পিয়েরের বাবার কিছু হলো না তো? কিন্তু ঘরে ঢুকতেই দেখলেন ইভকে কোলে নিয়ে ম্লানমুখে বসে আছেন ইউজিন। তবে কি পিয়ের? বুকটা ধক্ করে উঠলো মেরির।
সরবোন ইউনিভার্সিটির সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন পল আপ্পেল মেরিকে জানালেন পিয়েরের দুর্ঘটনার কথা। স্তব্ধ হয়ে সব শুনলেন মেরি। জাঁ পেরির স্ত্রী হেনরিয়েটকে অনুরোধ করলেন আইরিন আর ইভকে নিয়ে যেন তাঁদের বাসায় চলে যান এবং কয়েকদিন তাদের দেখাশোনা করেন। হেনরিয়েট আইরিন আর ইভকে নিয়ে চলে গেলেন নিজের বাসায়। এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না ইউজিন। উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলেন তিনি। মেরি শোকে পাথর হয়ে গেছেন।
থানা থেকে এক অফিসার এসে পিয়েরের জিনিসপত্র দিয়ে গেলেন। পিয়েরের কলম, চাবি, ওয়ালেট। চশমাটাও অক্ষত আছে। কেবল পিয়েরই নেই।
রাত আটটায় পিয়েরের মৃতদেহ বাসায় আনা হলো। পিয়েরের শরীর ধরে শক্ত হয়ে বসে রইলেন মেরি। তাঁকে কিছুতেই ছাড়ানো যাচ্ছিল না। শেষে জোর করে সরিয়ে নেয়া হলো মেরিকে। পরদিন সমস্ত আত্মীয়স্বজন শুভাকাঙ্খী সহকর্মী সাংবাদিক রাষ্ট্রনেতাদের উপস্থিতিতে পিয়েরের শেষকৃত্য সম্পন্ন হলো। পিয়েরের বাড়ির কাছে স্সো’র কবরস্থানে কবর দেয়া হলো পিয়েরকে।
একাকী মেরি
পৃথিবীর সবকিছু শূন্য মনে হচ্ছে মেরির। স্তব্ধ হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি সারাক্ষণ। ইভ ও আইরিনকে সামলাচ্ছেন জাঁ পেরির স্ত্রী। ইভ কিছুই বুঝতে না পারলেও সাড়ে আট বছর বয়সী আইরিন বুঝতে পারছে তার বাবা আর নেই। মায়ের কাছে আসার জন্য কাঁদছে সে। মেরির বুক ভেঙে যাচ্ছে কষ্টে। পিয়েরকে ছাড়া বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না তাঁর। কিন্তু তাঁর মেয়েদের কী হবে? পিয়েরের স্বপ্ন ছিল আইরিন তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। মেয়েটা হয়েছেও পিয়েরের মত ধীর স্থির অথচ ভীষণ জেদি। মেরি নিজেকে বোঝান - ভেঙে পড়লে চলবে না। মেয়েদের জন্য তাঁকে বেঁচে থাকতে হবে। বাবার অভাবে মেয়েদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা যেন একটুও নষ্ট না হয়।
ফরাসি সরকার মেরির জন্য একটা বিধবা-ভাতার ব্যবস্থা করলো। কিন্তু মেরি তা প্রত্যাখ্যান করলেন। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিয়েরের পদে মেরিকে নিয়োগ দেয়ার দাবি তুলছেন অনেকেই। প্রফেসর হবার সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মহিলা হবার কারণে নোবেল বিজয়ী মেরি কুরিকে প্রফেসর পদ দিতে রাজী নয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কারণ সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন মহিলা শিক্ষক নেই। মেরিকে পিয়েরের জায়গায় নিয়োগ করা হলো ঠিকই কিন্তু পিয়েরের ‘প্রফেসর’ পদ দেয়া হলো না। মেরি হলেন পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার প্রধান।
পিয়েরের ল্যাবে অধিষ্ঠিত হলেন মেরি। ল্যাবে যেদিকেই তাকান পিয়েরের স্মৃতি এসে ঝাঁপটা মারে তাঁকে। সরবোনে মেরির গবেষণার শুরুই হয়েছিল পিয়েরের সহযোগিতায়। পিয়ের জোর না করলে মেরির তো ফ্রান্সেই থাকা হতো না। পিয়েরের কত স্বপ্ন ছিল তাঁর ল্যাবকে ঘিরে। সরবোনে একটা আধুনিক ল্যাব পিয়ের দেখে যেতে পারলেন না। মেরি শপথ নিলেন পিয়েরের স্বপ্ন সফল করে তোলার। কায়মনোবাক্যে গবেষণা শুরু করলেন মেরি।
মেরির কর্মদক্ষতা সরবোন ইউনিভার্সিটির কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য করলো। ১৯০৬ সালের নভেম্বরে ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবারের মত কোন মহিলা প্রফেসর পদে নিয়োগ পেলেন - এবং তিনি হলেন মেরি কুরি। পিয়েরের পদে পূর্ণমর্যাদায় নিয়োগ পেলেন মেরি। পুরো ইউরোপের একাডেমিক জগতে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। পিয়েরের ফিজিক্স কোর্স পড়ানোর দায়িত্ব পেলেন মেরি।
পিতৃহারা দুটো কন্যার মা মেরি |
প্রথমদিনের ক্লাসে লেকচার থিয়েটার কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেলো। সিনিয়র প্রফেসররা সবাই, ডিন, মেরির স্কুলের সিনিয়র ক্লাসের ছাত্রীরাও চলে এসেছে তাদের প্রিয় মাদামের লেকচার শুনতে। সাংবাদিকরা ভিড় করেছে প্রফেসর হিসেবে মাদাম কুরিকে নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করার জন্য।
কাঁটায় কাঁটায় দুপুর একটায় ক্লাসে প্রবেশ করলেন মেরি। কালো গাউন, প্রশস্ত কপাল, উজ্জ্বল দুটো চোখ, আর উন্নত শিরে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালেন মেরি। প্রচন্ড করতালিতে ফেটে পড়লো লেকচার থিয়েটার।
মেরি চুপচাপ অপেক্ষা করছেন কখন করতালি থামবে। প্রায় পাঁচ মিনিট পর করতালি থামলো। মেরি আগেই ডিনকে অনুরোধ করেছিলেন যেন পরিচিতির আনুষ্ঠানিকতা বাদ দেয়া হয়। ডিন পল আপ্পেল খুবই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় মেরিকে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রফেসর হিসেবে স্বাগতম জানালেন। তারপর হলভর্তি দর্শক-শ্রোতা পিনপতন নিস্তব্ধতায় রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছেন - মেরির কথা শোনার জন্য। কী বলে শুরু করবেন মেরি? পিয়েরের স্মৃতিচারণ করতে করতে কি কেঁদে ফেলবেন সদ্য স্বামীহারা এই ৩৮ বছর বয়স্কা নতুন প্রফেসর? সবাই অপেক্ষা করছেন মেরির দুঃখে কাতর হওয়ার জন্য।
কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সবাই হতবাক হয়ে গেলেন - যখন দেখলেন মেরি তাঁর বক্তৃতা শুরু করেছেন ঠিক সেইখান থেকে - যেখানে পিয়ের তাঁর লেকচার শেষ করেছিলেন। ব্যক্তিগত শোকের একটা শব্দও উচ্চারণ না করে মেরি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের লেকচার দিয়ে গেলেন অপূর্ব দক্ষতায়।
ব্যক্তিগত দুঃখ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে মেরিকে কেউ দেখেনি কখনো। নিজের মেয়েদের সামনেও কখনো কাঁদেননি মেরি। মেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে কষ্টের কথাগুলো পিয়েরের সাথে শেয়ার করেছেন ডায়েরির পাতায়। সরবোনে প্রথম ক্লাস নেয়ার পর মেরি পিয়েরকে লিখলেন, “আমাকে সরবোনের প্রফেসর হিসেবে দেখলে তুমি আজ খুবই খুশি হতে। আমি তোমার জন্যই তোমার কাজ করতে রাজি হয়েছি। কিন্তু তোমার জায়গায় নিজেকে দেখতে আমার ভালো লাগছে না একটুও। প্রতি মুহূর্তে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পারছি না শুধু আমাদের মেয়েদের জন্য। তাদেরকে আমার মানুষ করতে হবে। যে বিজ্ঞানের পথে তুমি আমাকে রেখে গেছো সেই পথে আমাকে সফল হতে হবে। যদি সফল হই তা হবো তোমার জন্য।”
পিয়েরের কবরের কাছাকাছি থাকার জন্য মেরি স্সু’র কাছে বাসা নিলেন। নতুন বাসা থেকে কবরস্থান খুব কাছে - কিন্তু সরবোন ইউনিভার্সিটি অনেক দূরে। মেরি প্রতিদিন সকাল বেলা ট্রেনের সেকেন্ড ক্লাস কামরায় উঠে বসেন। আধঘন্টা পর সরবোনের কাছের স্টেশনে নেমে হেঁটে হেঁটে নিজের অফিসে যান। কতদিন রাস্তায় হাঁটার সময় ঘোড়ার গাড়ি দেখলে মনে মনে কামনা করেছেন কোন একটা গাড়ির চাকা যেন তাঁর মাথাটা থেঁতলে দিয়ে যায় - যেমন ঘটেছিল পিয়েরের বেলায়। কিন্তু দিনে দিনে দিন চলে যায়, সেরকম কিছুই ঘটে না।
আইরিন আর ইভকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন মেরি। তাদের জন্য বিশেষ স্কুলের ব্যবস্থা করেছেন মেরি সহ আরো অনেক বিখ্যাত প্রফেসররা মিলে। ছুটির দিনে একেক জন একেক বিষয়ে ক্লাস নেন। মেয়েদের যথেষ্ট খেলাধূলা ও শরীরচর্চা করার বিশেষ দরকার আছে বলে মনে করেন মেরি। আইরিন ইতোমধ্যেই সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা শিখে ফেলেছে। তাদের সারাক্ষণের সাথী হিসেবে আছেন তাদের দাদু।
কিন্তু শরীর ভেঙে পড়েছে ৮২ বছর বয়সী ডাক্তার ইউজিন কুরির। বয়সের কারণে যতটুকু - তারচেয়েও বেশি হলো পুত্রশোকে। পুরো এক বছর রোগে ভুগে ১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মারা যান ইউজিন কুরি। স্সো কবরস্থান থেকে পিয়েরের কফিন তোলা হলো। সেই জায়গায় ইউজিনের কফিন রেখে তার উপরে পিয়েরের কফিন রাখা হলো। তারপর মাটিচাপা দেয়া হলো। মৃত্যুর পর ছেলেকে এভাবে বুকে ধরে রাখার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন ডাক্তার ইউজিন।
_________
এ কাহিনি আমার "রেডিয়াম ভালোবাসা" বইতে প্রকাশিত হয়েছে।
No comments:
Post a Comment