Wednesday, 14 November 2018

মেরি কুরির কাহিনি - ৯ম পর্ব



১৯১১ সালের ২৩ জানুয়ারি একাডেমির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ব্র্যানলি পেয়েছেন ২৯ ভোট, মেরি ২৮ ভোট আর ব্রিলোইন পেয়েছেন ১ ভোট। মাত্র এক ভোটে মেরি হেরে গেলেন। কিন্তু একাডেমির নিয়ম অনুযায়ী জিতলে হলে কমপক্ষে দুই ভোটের ব্যবধানে জিততে হয়। আবার ভোট হলো। এবার ব্র্যানলি ৩০ ভোট আর মেরি ২৮ ভোট। উল্লাসে নেচে উঠলো রক্ষণশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। কিন্তু তাদের ভয় মেরি যদি ভবিষ্যতে আরো শক্তিশালী হয়ে আবার নির্বাচন করেন? মেয়েদের একাডেমিতে প্রবেশের সুযোগ চিরতরে বন্ধ করার জন্য ভোটের ব্যবস্থা হলো। ৯০ জন বিজ্ঞানী ভোট দিলেন মেয়েদের একাডেমিতে প্রবেশাধিকার চিরতরে বন্ধ করার পক্ষে, ৫২ জন ভোট দিলেন বিপক্ষে। [পরবর্তী ৬৮ বছর ফ্রেন্স একাডেমি অব সায়েন্সে কোন মহিলা সদস্যপদ লাভ করতে পারেননি। ১৯৭৯ সালে এ প্রথা রহিত হয়।]

মেরি কুরি নীরবে তাঁর অধ্যাপনা ও  গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তেজষ্ক্রিয়তা সংক্রান্ত মেরির গবেষণার ফল ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহারের বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মেরি সেসব নিয়ে কাজ করছেন। 

সরবোনে রেডিয়াম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মেরি। পল লাঁজেভির অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়া তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। লাঁজেভির সাথে তাঁর একাডেমিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ঠিকই আছে, তবে দেখাশোনা হচ্ছে না। 

মেরির মনে হচ্ছে সামাজিক সংকট হয়তো কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। কিন্তু তাঁর ধারণা ভুল প্রমাণ করতে তাঁর অফিসে দেখা করতে এলেন লাঁজেভির স্ত্রীর ভগ্নিপতি সাংবাদিক হেনরি বোর্গেস। 

“মাদাম, আপনার সাথে কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে।”
“বলুন”
“আপনার আর মঁসিও লাঁজেভির কিছু একান্ত ব্যক্তিগত চিঠি আমাদের হাতে এসেছে।”
মেরির কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে দেখেই হেনরি বুঝতে পারলেন কাজ হয়ে গেছে।
“মসিও লাঁজেভির অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কেউ একজন আপনাদের চিঠিগুলো নিয়ে এসেছে আমাদের কাছে। এগুলো প্রকাশিত হলে আপনার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে। আপনাকে হয়তো দেশত্যাগ করতেও হতে পারে। সুতরাং একটু সাবধানে থাকবেন মাদাম।” 

হেনরি বোর্গেস যে মেরিকে ব্ল্যাকমেল করতে এসেছেন তা বুঝতে পারছেন মেরি। তিনি কোন ধরনের আলোচনা ছাড়াই হেনরিকে বিদায় করে দিলেন। কিন্তু খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছেন তিনি। পরামর্শ চাইতে গেলেন জাঁ পেরির কাছে। পেরি লাঁজেভির বাসায় গিয়ে সব জানতে পারলেন। 

লাঁজেভি অসুস্থ হয়ে যখন বাড়িতে ছিলেন তাঁর স্ত্রী জেনি লাঁজেভির চাবি নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে যান। সেখান থেকে লাঁজেভিকে লেখা মেরির চিঠিগুলো সব নিয়ে আসেন। চিঠিগুলো পড়ে ভীষণ রেগে যান জেনি। 
“ঐ শয়তানীকে আমি খুন করে ফেলবো।”
জেনির বোন ও মা জেনিকে কোন রকমে শান্ত করে পরামর্শ দেন চিঠিগুলো বোনের স্বামী হেনরির হাতে তুলে দিতে। হেনরি দেখলেন এই তো সুযোগ মেরিকে ব্ল্যাকমেইল করার।

সব শুনে জাঁ পেরিও বিচলিত হয়ে উঠলেন। জেনি একবার সরাসরি আক্রমণ করেছিল মেরিকে। তার পক্ষে সবকিছুই সম্ভব। মেরি যদি কিছুদিন প্যারিস থেকে দূরে কোথাও চলে যান ভালো হয়। 

একটা সুযোগ এসে গেলো ইতালিতে একটা বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যাবার। ফ্রান্সের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ইকোল নরমাল সুপেরিয়র’ - যেখানে ফ্রান্সের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষক হবার শিক্ষা নেয়। ইকোল নরমাল সুপেরিয়রের ভাইস প্রেসিডেন্ট এমিল বোরেল ও তাঁর স্ত্রী প্রতিভাবান লেখিকা মার্গারিট বোরেল মেরিকে খুব পছন্দ করেন। মার্গারিট সরবোন ইউনিভার্সিটির সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন পল আপ্পেলের মেয়ে। এমিল ও মার্গারিটের সাথে মেরিও আইরিন ও ইভকে নিয়ে চলে গেলেন ইতালি। 

ইতালিতে কনফারেন্স চলাকালীন একদিন সন্ধ্যায় মার্গারিটের সাথে একান্তে কথা বললেন মেরি। পল লাঁজেভির ব্যক্তিগত সুখ নিয়ে ভীষণ চিন্তিত মেরি।

“মার্গারিট, তুমি আমার বন্ধু। তোমাকে বলতে আমার দ্বিধা নেই - পলের মত এমন মেধাবী বিজ্ঞানী, এমন ভালো মনের মানুষ আর হয় না। অথচ তার স্ত্রী তাকে এত কষ্ট দেয়। পলের কষ্ট আমার সহ্য হয় না। পল খুব নরম মানুষ। কিন্তু তুমি আর আমি তো শক্ত। আমাদের কি উচিত নয় পলকে জেনির হাত থেকে রক্ষা করা?”

মার্গারিট মেরির চোখে দেখতে পান লাঁজেভির জন্য ভালোবাসা।
ইতালি থেকে প্যারিসে ফিরে মেরি শুনলেন লাঁজেভির সাথে জেনির সম্পর্ক আরো খারাপ হয়ে গেছে। লাঁজেভি নিজের বাসা ছেড়ে জাঁ পেরির বাসায় গিয়ে উঠেছেন। 

মেরি ভাবলেন এসময় প্যারিসে থাকলে আরো সমস্যা হতে পারে। তিনি মেয়েদের নিয়ে চলে গেলেন হল্যান্ডের লিডেনে। সেখানে গিয়ে তিনি অতি নিম্নমাত্রায় তেজস্ক্রিয় পদার্থের ধর্মের পরিবর্তন সংক্রান্ত গবেষণা করলেন ক্যামেলিন ওনিসের সাথে। [ওনিস দু’বছর পর (১৯১৩) পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান।]

বেশ কিছুদিন লিডেনে কাটানোর পরেও প্যারিসে ফেরার ইচ্ছে হলো না মেরির। তিনি তাঁর মেয়েদের নিয়ে চলে গেলেন পোল্যান্ডে। ইভ ও আইরিন প্রথমবারের মত তাদের মায়ের জন্মভূমিতে এলো। মেরির সব আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা হলো অনেক বছর পর। মেরির বড়বোন ডাক্তার ব্রোনিয়া ও তাঁর স্বামী ডাক্তার কাজিমির ইতোমধ্যে পোল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। একটা যক্ষ্মা হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন তাঁরা। মেরি তাঁর নোবেল পুরষ্কারের টাকা থেকে একটা অংশ দান করেছেন এই হাসপাতালের জন্য। মেরি ও তাঁর মেয়েদের কাছে পেয়ে সবাই খুব খুশি হলেন। আইরিন ও ইভের সময়ও বেশ আনন্দে কাটলো পোল্যান্ডে। 

১৯১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্যারিসে ফিরলেন মেরি। প্যারিসে লাঁজেভির পারিবারিক অশান্তি আরো ঘনীভূত হয়েছে। মেরি এসময় ব্রাসেল্‌সের সল্‌ভে কনফারেন্সে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পেলেন। অক্টোবরের ৩০ তারিখে শুরু হলো কনফারেন্স। সেই সম্মেলনে মেরি কুরি ছাড়াও বিশ্ববিখ্যাত সব পদার্থবিজ্ঞানী যোগ দিয়েছেন - আইনস্টাইন, ম্যাক্স প্ল্যাংক, রাদারফোর্ড, পয়েনকেয়ার প্রমুখ। প্যারিস থেকে পল লাঁজেভিও যোগ দিয়েছেন সম্মেলনে। মেরির সাথে পলের দেখা হলো অনেকদিন পর। 


১৯১১ সালের সল্‌ভে কনফারেন্সে মেরি কুরি। পেছনের সারিতে দাঁড়ানো আইনস্টাইনের ডান পাশে লাঁজেভি।

মেরি ও পল লাঁজেভি যখন ব্রাসেলসে জরুরি বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে ব্যস্ত প্যারিসে শুরু হয়েছে মেরি ও লাঁজেভিকে জড়িয়ে সংবাদপত্রের তান্ডব। নভেম্বরের ৪ তারিখ ‘লা জার্নাল’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্টায় দুই কলাম জুড়ে প্রকাশিত হলো ‘মাদাম কুরি ও প্রফেসর লাঁজেভির প্রেম কাহিনি’। লাঁজেভির শাশুড়ির সাক্ষাৎকার ভিত্তিক এ প্রতিবেদনে রগরগে ভাষায় মেরি ও লাঁজেভির সম্পর্ককে সস্তা অবৈধ প্রেম-কাহিনিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এমনও বলা হয়েছে যে মেরি লাঁজেভির সাথে প্যারিস থেকে পালিয়ে গেছেন। কোথায় গেছেন কেউ জানেন না।

ব্রাসেল্‌সে প্যারিসের সব পত্রিকা পৌঁছায়। সল্‌ভে কনফারেন্সের সব বিজ্ঞানীর চোখেই পড়েছে মেরি ও লাঁজেভি সংক্রান্ত প্রতিবেদন। তাঁদের কেউই বিশ্বাস করলেন না এসব। 

মেরি প্যারিসের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘লা টেম্প্‌স’-এ একটা প্রতিবাদলিপি পাঠালেন এই বলে যে তিনি ও লাঁজেভির প্যারিস থেকে পালিয়ে যাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। একটা গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তাঁরা এখন ব্রাসেল্‌সে আছেন। 

মেরির প্রতিবাদলিপি প্রকাশিত হলো। কিন্তু প্যারিসের বেশিরভাগ মানুষ রগরগে গল্পই পছন্দ করে। দু’দিন পরই তারা গোগ্রাসে পড়তে শুরু করলো ‘লা পেটিট’ পত্রিকায় প্রকাশিত জেনি লাঁজেভির সাক্ষাৎকার। বলাবাহুল্য এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জেনির ভগ্নিপতি হেনরি বোর্গেস।

সাক্ষাৎকারে জেনি ইনিয়ে বিনিয়ে বলছেন কীভাবে মেরি কুরি নামক এক বিদেশিনী তাঁর কাছ থেকে তাঁর স্বামী প্রফেসর লাঁজেভিকে ছিনিয়ে নিচ্ছেন। জেনি কাঁদতে কাঁদতে বর্ণনা করছেন কীভাবে পল লাঁজেভি তাঁকে যখন তখন মারধর করেন। ঘর ছেড়ে বাইরে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে মেরির সাথে সময় কাটান। এতদিন তবুও প্যারিসে ছিল। এখন মেরি কুরি তাঁর স্বামীকে নিয়ে উধাও হয়ে গেছেন। 

প্যারিসের তথাকথিত ভদ্র নারীসমাজ নিজ নিজ স্বামীকে মেরি কুরির মত মহিলার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য প্যারিস থেকে মেরি কুরিকে তাড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে প্রায় একমত হয়ে গেলো। 

ব্রাসেল্‌সে মেরির হোটেলে প্রতিদিন পৌঁছে যেতে লাগলো প্যারিসের পত্রিকা। আমেরিকার সংবাদপত্রেও ফলাও করে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে নোবেল বিজয়ী প্রথম নারী মেরি কুরির ‘প্রেম-কাহিনি’। মেরির মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে এরকম প্রতিবেদন পেতে পেতে। এসময় একদিন সকালে তাঁর হাতে এসে পৌঁছালো একটা টেলিগ্রাম, স্টকহোম থেকে। 

মেরি ভাবলেন সুইডেনেও হয়তো প্রকাশিত হয়েছে মেরিকে নিয়ে কোন কুৎসা। কিন্তু না, মেরি টেলিগ্রামটা পড়ে দেখলেন - এত দুর্নামের মাঝেও একটা সুখবর। মেরিকে ১৯১১ সালের রসায়নের নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে। মেরি কুরি আরো একটা ইতিহাস স্থাপন করলেন - তিনি হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি দু’বার নোবেল পুরষ্কার পেলেন। 

দ্বিতীয়বার নোবেল পুরষ্কার পাওয়াতে মেরি কুরিকে নিয়ে সারাপৃথিবীর বিজ্ঞান সমাজ ধন্য ধন্য করে উঠলো। অভিনন্দন ও প্রশংসার ঝড় বয়ে গেল ওয়ার্ল্ড মিডিয়ায়। কিন্তু প্যারিসের মিডিয়ায় তেমন কোন গুরুত্বই পেলো না মেরির দ্বিতীয়বার নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির খবর। তারা মেরির ‘প্রেম-কাহিনি’ নিয়ে মশগুল।

প্যারিসে ফিরে মেরি প্রেসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ঘোষণা দিলেন পল লাঁজেভির সাথে তাঁকে জড়িয়ে আর কোন প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তিনি আইনগত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন। তাঁদের ব্যক্তিগত চিঠি যদি কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তা হবে বে-আইনি এবং তার দায়ভার নিতে হবে সংশ্লিষ্ট সম্পাদকদের। 

মেরিকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এলেন পিয়েরের বড়ভাই জাকো কুরি। তাঁদের প্রভাবশালী বন্ধুরাও এগিয়ে এলেন। মেরিকে আইনগত সহযোগিতা দিতে এগিয়ে এলেন রেমন্ড পয়েনকেয়ার। রেমন্ড পয়েনকেয়ার রাজনৈতিকভাবে এতই প্রভাবশালী ছিলেন যে এক বছর পর তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। পয়েনকেয়ারের প্রভাবে প্যারিস প্রেস সিন্ডিকেট এই মর্মে সম্মত হলো যে মেরি ও লাঁজেভির ব্যক্তিগত চিঠি আর কোন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবে না। 

মেরির ব্যক্তিগত প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে কিছু না লিখলেও ‘লা লিব্‌রে প্রেস’-এর মতো কট্টর ডানপন্থি পত্রিকা প্রশ্ন তুললো “মাদাম কুরির কি সরবোনের প্রফেসর পদে থাকার নৈতিক অধিকার আছে?” তারা এটাও উল্লেখ করলো যে মাদাম কুরি ও প্রফেসর লাঁজেভির চিঠিগুলো প্রকাশিত হলে সরবোনের প্রফেসররা লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবেন না সমাজে। প্যারিসের সবচেয়ে সম্মানিত প্রতিষ্ঠানের প্রফেসরদেরও নিশ্চয় প্রতিষ্ঠানের সম্মান রক্ষা করে চলা উচিত - যা করতে মাদাম কুরি ব্যর্থ হয়েছেন। মাদাম কুরি যে দু’বার নোবেল পুরষ্কার পেয়ে সরবোন ইউনিভার্সিটির মর্যাদা আকাশে তুলে দিয়েছেন তা নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করে না এসব পত্রিকা।

সরবোন ইউনিভার্সিটির ডানপন্থি প্রফেসররা মাদাম কুরির ব্যাপারে অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছেন। এমনিতেই মাদামের বৈজ্ঞানিক সাফল্যে তাঁরা ঈর্ষান্বিত। এত কিছুর মধ্যেও মাদাম দু’বার নোবেল পুরষ্কার পেয়ে গেছেন। তাঁদের মধ্যেও অনেকের মনে হতে থাকে মাদাম কুরিকে সরবোন থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলে ভালো হয়। নভেম্বরের ২৩ তারিখ ডানপন্থিদের হাতে আরেকটি ব্রহ্মাস্ত্র তুলে দেয় ‘লা’উভ্‌র’ পত্রিকার সম্পাদক। 

‘লা’উভ্‌র’ পত্রিকাটি সংবাদপত্রের ন্যূনতম নিয়ম-নীতিও মেনে চলে না। এর সম্পাদক গুস্তাভ টেরি ভীষণ সাম্প্রদায়িক, উগ্র জাতীয়তাবাদী, ইহুদি-বিদ্বেষী। টেরি ছাত্রজীবনে লাঁজেভির সহপাঠী ছিলেন। মতাদর্শের কারণে এখন তিনি লাঁজেভিকে শত্রু  বলে মনে করেন। 

‘লাঁজেভি-কুরি ঘটনার প্রকৃত রহস্য’ শিরোনামে বারো পৃষ্ঠার এক রগরগে মিথ্যা অতিরঞ্জিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন টেরি। প্রতিবেদনে টেরি বিভিন্ন মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে ‘ধূর্ত’ মাদাম কুরি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে আস্তে আস্তে পল লাঁজেভিকে হাত করে ফেলেছেন। প্রেমের ফাঁদে ফেলে জেনির মত পতিব্রতা স্ত্রীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন তাঁর স্বামীকে, পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করেছেন তাদের চার ছেলে-মেয়েকে। 

টেরি তাঁর প্রতিবেদনে লাঁজেভিকেও ছেড়ে দেন না। টেরি বর্ণনা করেন - লাঁজেভি মেরির রূপে মুগ্ধ হয়ে ভেড়া বনে গেছেন এবং মেরির স্কার্টের নিচে ঢুকে বসে আছেন। প্রতিবেদনের শেষ পৃষ্ঠায় টেরি তাঁর ঘৃণ্যতম অভিযোগ তোলেন মেরির প্রতি - “মাদাম কুরি ‘কুরি’ পরিবারের মর্যাদা ধুলোয় মিটিয়ে দিয়েছেন। আমাদের সন্দেহ পিয়ের কুরির মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই মেরি ও লাঁজেভির ‘ঘর ভাঙানিয়া’ প্রেম চলছিল। নিজের স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে প্রেম করছেন এটা সহ্য করতে না পেরে পিয়ের কুরি ঘোড়ার গাড়ির নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে নিজের সম্মান বাঁচিয়েছেন। এখন সম্মানিত প্যারিসবাসীর উচিত মাদাম কুরির হাত থেকে প্যারিসের সম্মান বাঁচানো।”

গুস্তাভ টেরির বিষাক্ত প্রতিবেদন পড়ে প্যারিসের ‘বীর জনতা’ ক্ষেপে উঠলো। টেরি সমর্থক ধর্মান্ধ গোষ্ঠী স্‌সোতে মেরির বাসার সামনে জড়ো হয়ে অশ্লীল স্লোগান দিতে শুরু করলো। কেউ কেউ গালাগালি করতে করতে মেরির বাড়ির দিকে ইট পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করলো। বাড়ির ভেতর ভয়ে কাঁপছেন মেরি ও সাত বছর বয়সী ছোট্ট ইভ। আইরিন তখন স্কুলে। তাঁদের পোলিশ গৃহকর্মী বুঝতে পারছেন না তাঁর কী করা উচিত।
[১০ম পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন এখানে]
__________
এ কাহিনি আমার "রেডিয়াম ভালোবাসা" বইতে প্রকাশিত হয়েছে। 


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Doesn't Rachi's death make us guilty?

  Afsana Karim Rachi began her university life with a heart full of dreams after passing a rigorous entrance exam. She was a student of the ...

Popular Posts