Wednesday, 7 November 2018

মেরি কুরির কাহিনি - ২য় পর্ব


মারিয়া স্ক্লোদভস্কা

পোল্যান্ডের ওয়ার্‌শ শহরের ফ্রেটা স্ট্রিটের একটা বাড়িতে ১৮৬৭ সালের ৭ই নভেম্বর মারিয়ার জন্ম। মারিয়ার মা ব্রোনিস্লাভা স্ক্লোদভস্কি ছিলেন একটা প্রাইভেট স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। বাবা ভ্লাদিস্লাভ স্ক্লোদভস্কি ছিলেন পদার্থবিদ্যা ও গণিতের শিক্ষক। স্ক্লোদভস্কি পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান মারিয়া। সবাই আদর করে ডাকে মানিয়া। মানিয়ার জন্মের সময় তার বড় তিন বোন সোফি, ব্রোনিয়া ও হেলার বয়স যথাক্রমে ছয়, তিন ও দেড় বছর এবং ভাই জোসেফের বয়স ছিল চার বছর। সবার আদরে আদরে বড় হচ্ছিল মানিয়া। তাদের বাসাটা ছোট এবং নানারকমের প্রাত্যাহিক অভাব থাকলেও ভালোবাসার অভাব ছিল না কখনো। 
মানিয়াদের পারিবারিক পরিবেশ ছিল চমৎকার, প্রাণবন্ত। শিক্ষক বাবা-মা ছেলেমেয়েদের মনে শিক্ষার প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করতে সদাসচেষ্ট। বাড়ির আলমারিভর্তি বই আর যন্ত্রপাতি। ছোট্ট মানিয়া পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে আলমারি ধরে দাঁড়ায় আর অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে বই আর যন্ত্রপাতিগুলোর দিকে। বাবাকে জিজ্ঞেস করে এটা কী, ওটা কী। বাবা সস্নেহে সোৎসাহে বুঝিয়ে দেন। 


সোফি, হেলা, মানিয়া, জোসেফ ও ব্রোনিয়া

মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই মানিয়া পড়তে শিখে গেলো। গল্প কবিতা ইতিহাস পদার্থবিদ্যা গণিত হাতের কাছে যা পায় তাই পড়ে ফেলে। যদিও সে বেশিরভাগ জিনিসই বুঝতে পারে না, কিন্তু পড়াশোনার নেশায় পেয়ে বসে তাকে। 
মানিয়ার জন্মের পর থেকেই যক্ষায় আক্রান্ত হন তার মা। দিনের পর দিন শরীর খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে।  অসুস্থতার কারণে মা স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। সংসারের পুরো খরচের দায়িত্ব এসে পড়ে বাবার কাঁধে। কিন্তু সেখানেও সমস্যা দেখা দেয়। 
পোল্যান্ড তখন রাশিয়ান জারের অধীনে। পোল্যান্ডের কোন স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। রাশিয়ানরা যেভাবেই পারে পোলিশদের ওপর অত্যাচার চালায়। সরকারি কোন কাজে, স্কুল কলেজে পোলিশ ভাষা অচল। পোলিশদের বদলে রাশিয়ানদের চাকরি দেয়া হচ্ছে সব জায়গায়। পোলিশ হবার কারণে একদিন চাকরি চলে যায় মানিয়ার বাবার। সাংসারিক খরচ মেটাবার জন্য তিনি নিজের বাসাকে অনেকটা স্কুল-বোর্ডিংয়ের মতো করে ফেলেন। বাড়িতে বাইরের লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে আর মানিয়াদের থাকার জায়গা শোয়ার জায়গা কমতে থাকে। অপরিচিত মানুষের সামনে মানিয়ারা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে, নিম্নস্বরে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
মায়ের অসুস্থতার কারণে সংসারের কাজের বেশির ভাগই বড়বোন সোফির কাঁধে এসে পড়ে। তদুপরি অসুস্থ মায়ের সেবাযত্নের পুরোটাই সামলাচ্ছিলো সোফি। মানিয়ার বয়স যখন নয় বছর - তখন পনেরো বছরের সোফি টাইফাস রোগে আক্রান্ত হয়। কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায় সোফি। প্রাণবন্ত দিদিকে হারিয়ে কেমন যেন নিষ্প্রাণ হয়ে যায় মানিয়া। 
পরের বছর একটা প্রাইভেট বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয় মানিয়াকে। স্কুলের চব্বিশ জন ক্লাসমেটের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে ছোট কিন্তু সবচেয়ে মেধাবী মানিয়া। স্কুলে রাশিয়ান ভাষায় পড়াশোনা হয়, কিন্তু গোপনে তারা পোলিশ ভাষায় কথা বলে, পোলিশ ভাষায় লেখা বইপত্র পড়ে। পোল্যান্ডের প্রতি যে ভালোবাসা মানিয়ার মা-বাবা তাঁর মনে জাগিয়ে তুলেছেন তা কখনোই ভোলেননি মানিয়া। 
স্কুলের ছুটিতে বাসায় এসে মা-বাবা ও ভাই-বোনদের সাথে আনন্দে সময় কাটে মানিয়ার। কিন্তু সে আনন্দ বেশিদিন টিকলো না। বড়মেয়ে সোফির মৃত্যুশোক সামলাতে পারলেন না অসুস্থ ব্রোনিস্লাভা। মাত্র ৪২ বছর বয়সে তিনি মারা যান। 
মাকে হারিয়ে পাগলের মত হয়ে গেল মানিয়া। প্রচন্ড অবসাদ ঘিরে ধরলো তাকে। এদিকে স্ত্রীকে হারিয়ে চারটি ছেলেমেয়ে মানুষ করার দায়িত্ব একা নিজের ঘাড়ে তুলে নিলেন ভ্লাদিস্লাভ। স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ চালানোর জন্য এক আত্মীয়ের পরামর্শে সমস্ত সঞ্চয় একটা ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডে রেখেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর ঐ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড দেউলিয়া হয়ে যায়। ফলে সঞ্চয়ের পুরোটাই হারালেন তিনি। অভাব ঘিরে ধরলো চারদিক থেকে। 
অনেক কষ্টে আরেকটা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি খুঁজে নিলেন ভ্লাদিস্লাভ। সংসার খরচের সমস্যা কিছুটা মিটলো। এর মধ্যেও সব ছেলেমেয়েরা ভীষণ পরিশ্রমী। ছেলে জোসেফ গোল্ডমেডেল পেয়ে স্কুল ফাইনাল পাস করে ওয়ার্‌শ ইউনিভার্সিটিতে মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হয়েছে। মানিয়ার দিদি ব্রোনিয়াও গোল্ড মেডেল পেয়ে স্কুল ফাইনাল পাস করেছে। ভাইয়ের মত ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছে তারও। কিন্তু পোল্যান্ডে মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষা তখনো নিষিদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে যেতে হবে ফ্রান্সে। সেরকম অর্থনৈতিক সামর্থ্য তাদের নেই। সংসারের কাজকর্ম এবং বাড়িতে যেসব ছাত্ররা থাকে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলো ব্রোনিয়া। 


বাবা ভ্লাদিস্লভ স্ক্লোদভস্কির সাথে মানিয়া, ব্রোনিয়া ও হেলা


মানিয়া সবে কৈশোরে পা দিয়েছে। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মেই মনে ভালোলাগা ভালোবাসার জন্ম নেয়। তাদের বাড়িতে বোর্ডার হিসেবে আসে সুদর্শন তরুণ ছাত্র ভিটোল্ড রোমোকি। প্রথম দর্শনেই তার প্রেমে পড়ে যায় কিশোরী মানিয়া। পিঠাপিঠি বড়বোন হেলাকে জানাতেই জানতে পারে হেলাও মজে গেছে একই তরুণে। দু’বোনের মধ্যে প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় ভিটোল্ডকে নিয়ে - প্রেমের প্রতিযোগিতা। তাতে ব্রোনিয়ার কিছুটা সুবিধাই হলো, কারণ বোর্ডিং সংক্রান্ত অনেক কাজই তখন হেলা আর মানিয়া বলার আগেই করে ফেলতে শুরু করেছে। তবে এই মোহ বেশিদিন থাকেনি। ভিটোল্ড চলে যাবার পর হেলা আর মানিয়া দু’জনই দু’দিকে মন দিয়েছে। 
বাসার কাছাকাছি একটা রাশিয়ান স্কুলে ভর্তি হয়েছে মানিয়া। স্কুলে কেউ তাকে ‘মানিয়া’ বলে ডাকে না -  আসল নাম ‘মারিয়া’বলেই ডাকে। পাশের বাসার কাজিয়া প্রাইবোরোভস্কা তার বেস্ট ফ্রেন্ড। কাজিয়ার সাথে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যায় মারিয়া। একই সাথে নাচ শেখে, খেলাধূলা করে, দু’জনের সুখদুঃখের কথা শেয়ার করে। স্কুলের পোলিশ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভালোবাসে - একই সাথে রাশিয়ানদের ঘৃণা করে। 
১৮৮৩ সালের ১২ জুন স্কুল সার্টিফিকেট পাস করে মারিয়া। সেরা শিক্ষার্থী হিসেবে স্বর্ণপদক পায়। এখন কী করবে সে? ব্রোনিয়াও স্বর্ণপদক পেয়ে বাড়িতে বসে আছে। হেলাও স্কুল পাস করে বসে আছে। মেয়েদের জন্য পোল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার দরজা বন্ধ করে রেখেছে রাশিয়ান জার সরকার। ব্রোনিয়ার ইচ্ছা ফ্রান্সে গিয়ে ডাক্তারি পড়বে। মারিয়ার ডাক্তার হবার ইচ্ছে নেই - কিন্তু ফ্রান্সের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় সরবোনে পড়ার স্বপ্ন তার। 
ব্রোনিয়া প্রাইভেট টিউশনি শুরু করেছে ফ্রান্সে যাবার খরচ জমাবার উদ্দেশ্যে। হেলা উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বাদ দিয়েছে। সে ঠিক করেছে ব্রোনিয়া ও মারিয়া ফ্রান্সে চলে গেলে সে-ই পোল্যান্ডে থেকে তার বাবার দেখাশোনা করবে। 
ভবিষ্যৎ চিন্তার হতাশায় খুব অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে মারিয়া। তার অবসাদ কাটানোর জন্য তার বাবা তাকে কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। প্রায় এক বছর মারিয়া তার কাকাদের বাড়িতে থেকে ঘোড়ায় চড়ে, সাঁতার কেটে, হাসি আনন্দে কাটিয়ে ওয়ার্‌শ ফিরে আসে অবসাদমুক্ত হয়ে। 
ইতোমধ্যে তার বাবা অবসর গ্রহণ করেছেন। পেনশনের টাকায় সংসার চালানো সম্ভব নয়। বড় বাসা ছেড়ে দিয়ে একটা ছোট বাসায় চলে এলেন তারা। ব্রোনিয়া আগে থেকেই টিউশনি করছিল। জোসেফ ও মারিয়াও সংবাদপত্রে ‘পড়াইতে চাই’ বিজ্ঞাপন দিলো। 
বাসা থেকে মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়ে কয়েকটা টিউশনি করে মারিয়া। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বিরক্ত হয়ে গেলো সে। বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীই অলস, ফাঁকিবাজ। আবার অনেক সময় দেখা যায় যে মাসের শেষে তার বেতনটা দিতেও ভুলে যাচ্ছে তারা। বছর খানেক পর বিরক্ত হয়ে সে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করা ছেড়ে দিয়ে এক বিখ্যাত উকিলের বাড়িতে গভর্নেসের চাকরি নিলো। 
মারিয়া আশা করেছিলো উকিলের বাড়িতে উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ থাকবে, বাইরের চাকচিক্যের সাথে মিলিয়ে তাদের মনমানসিকতাও সেরকম উজ্জ্বল থাকবে। কিন্তু মারিয়ার আশাভঙ্গ হতে দেরি লাগলো না। দুটো ছেলেমেয়েকে সাত ঘন্টা পড়িয়ে অন্যান্য কাজ করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে যেতো মারিয়া। কিছুদিনের মধ্যেই উকিলের বাড়িটাকে তার জেলখানা মনে হতে লাগলো। মারিয়া দেখতে পেলো উচ্চবিত্ত সমাজের এই মানুষগুলোর বাইরের রূপ আর অন্তরের রূপে কত পার্থক্য। বাইরে এরা অভিজাত ফরাসি ভাষায় কথা বলে, জনগণের ওপর দরদ দেখায়, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে পার্টি দেয়, অথচ বাড়ির কাজের লোকের বেতন দেয় না মাসের পর মাস। মারিয়ার মনে হতে থাকে বাস্তব দুনিয়ার অনেক নোংরা দিকের সাথে তার পরিচয় ঘটছে। 


গভর্নেস মারিয়া

 ১৮৮৫ সালে ব্রোনিয়া টিউশনির টাকা জমিয়ে ফ্রান্সের সরবোন ইউনিভার্সিটির মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হয়েছে। থাকার জন্য সবচেয়ে সস্তায় বাসাভাড়া নিয়েছে প্যারিসের ল্যাটিন কোয়ার্টারে। কিন্তু তাতেই তার জমানো টাকা শেষ। এখন মেডিকেলে পড়াশোনার খরচ, থাকা-খাওয়ার খরচ কীভাবে চলবে বুঝতে পারছে না। মারিয়া ব্রোনিয়াকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলো। দু’বোনের মধ্যে চুক্তি হলো - মারিয়া গভর্নেসের চাকরি করে ব্রোনিয়ার লেখাপড়ার খরচ চালাবে, পরে ব্রোনিয়া পাস করার পর মারিয়ার পড়ার খরচ চালাবে। 
উকিলের বাড়ির চাকরি ছেড়ে ওয়ার্‌শ থেকে একশ’ মাইল দূরে একটা গ্রামে ভালো বেতনের গভর্নেসের চাকরি নিয়ে চলে গেলো মারিয়া। নতুন মনিব মিস্টার জোরাভস্কির বিশাল চিনির কল। মানুষ হিসেবেও তাঁকে বেশ ভালোই মনে হলো মারিয়ার। তবে মিসেস জোরাভস্কি মারিয়ার সাথে খুব একটা ভালো ব্যবহার করেন না। মারিয়া জানতে পারে - মিসেস জোরাভস্কিও প্রথম জীবনে গভর্নেসের কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

জোরাভস্কি পরিবারের চার মেয়ে ব্রঙ্কা, আঞ্জিয়া, স্টাস, আর ম্যাটিস্না বাড়িতেই থাকে। মারিয়ার কাজ হলো তাদের দেখাশোনা করা, পড়ানো, এবং সঙ্গ দেয়া। ব্রঙ্কা মারিয়ার সমবয়সী - মারিয়ার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো তার। অন্য তিনজন অনেক ছোট। বিশাল বাড়িতে মারিয়ার ঘরটিও বেশ বড়। ঘোড়ায় চড়ে, উন্মুক্ত প্রান্তর আর মাইলের পর মাইল ইক্ষুক্ষেতের পাশ দিয়ে বেড়াতে বেড়াতে ভালোভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিলো মারিয়ার। মেয়েদেরকে পড়িয়ে কিছুটা সময় থাকলে নিজের পড়াশোনা করার চেষ্টা করে। সে ভোলেনি যে একদিন তাকে সরবোন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যেতে হবে। সেজন্য তার ফরাসি ভাষা জানা দরকার, গাণিতিক দক্ষতা দরকার। 
একদিন বাগানে বসে গভীর মনযোগে ক্যালকুলাস করছে মারিয়া -  হঠাৎ টেবিলে কার ছায়া পড়তে চমকে ওঠে। তাকিয়ে দেখে ভীষণ হ্যান্ডসাম এক তরুণ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। চোখের পলক পড়ে না মারিয়ার। মানুষ এত সুন্দর হয়! 
__________________
এ কাহিনি আমার "রেডিয়াম ভালোবাসা" বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts