একদিন বাগানে বসে গভীর মনযোগে ক্যালকুলাস করছে মারিয়া - হঠাৎ টেবিলে কার ছায়া পড়তে চমকে ওঠে। তাকিয়ে দেখে ভীষণ হ্যান্ডসাম এক তরুণ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। চোখের পলক পড়ে না মারিয়ার। মানুষ এত সুন্দর হয়!
তরুণ - জোরাভস্কি পরিবারের বড় ছেলে কাজিমির - ওয়ার্শ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের ছাত্র। জোরাভস্কিদের তিন ছেলের মধ্যে দু’জন ওয়ার্শ ইউনিভার্সিটিতে অন্যজন বোর্ডিং স্কুলে। ছুটিতে বাড়িতে এসে মারিয়ার সাথে পরিচয় হলো কাজিমিরের।
কয়েক দিনের মধ্যেই মারিয়াকে ভালো লেগে গেলো কাজিমিরের। মারিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে, ঘোড়ায় চড়তে চড়তে, সাইকেল চালাতে চালাতে, পারিবারিক বলড্যান্সে নাচতে নাচতে মারিয়ার প্রেমে পড়ে যায় কাজিমির। আর অষ্টাদশী মারিয়ার হৃদয়েও কাজিমিরের জন্য ঝড় উঠেছে। কাজিমিরের প্রেমে সাড়া দিলো মারিয়া। স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো মারিয়া - জোরাভস্কি পরিবারের একজন হয়ে উঠবে সে অচিরেই।
কাজিমির জোরাভস্কি |
জোরাভস্কি পরিবারের সবার সাথে মারিয়ার সম্পর্ক আরো আন্তরিক হয়ে উঠলো। অনেক চেষ্টা করে কাজিমিরের মায়ের মনও জয় করে ফেললো সে। ঘরের কাজ শেষ করে অবসর সময়ে চিনির কলের শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের পড়াতে শুরু করলো মারিয়া। পোল্যান্ডে এ ধরনের স্কুল চালানো নিষেধ। রাশিয়ান জার সরকার জানতে পারলে অনেক ক্ষতি হবে জেনেও মিস্টার ও মিসেস জোরাভস্কি বাধা দেননি মারিয়াকে। এই বাড়িতে মারিয়াকে দেখতে এসেছিলেন তার বাবা ও হেলা। মিস্টার ও মিসেস জোরোভস্কি খুবই সমাদর করলেন মিস্টার স্ক্লোদভস্কি ও হেলাকে। মারিয়া ভাবলো কাজিমিরের সাথে তার সম্পর্কে আর কোন বাধা নেই।
কিন্তু এক বছর প্রেমের পর কাজিমির যখন তার মা-বাবাকে বললো মারিয়ার সঙ্গে তার বিয়ের পরিকল্পনার কথা, যেন ভূমিকম্প হয়ে গেলো জোরাভস্কি পরিবারে। রেগে আগুন হয়ে গেলেন মিস্টার ও মিসেস জোরাভস্কি। গরীব গভর্নেসের প্রতি ভাল ব্যবহার করা এক কথা, আর তার সাথে ছেলের বিয়ে দেয়া অন্য কথা। ছেলেকে ডেকে মারিয়ার সামনেই পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন জোরাভস্কি - এ বিয়ে কিছুতেই হতে পারে না।
বাধ্য ছেলের মত ওয়ার্শ ফিরে গেলো কাজিমির। মা-বাবার কথার সামান্য প্রতিবাদ পর্যন্ত করলো না। যাবার আগে মারিয়াকে জানিয়ে দিলো - বাবা-মা’র অবাধ্য সে হতে পারবে না।
লজ্জায় অপমানে এতটুকু হয়ে গেলো মারিয়া। ভাবলো চাকরি ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু ব্রোনিয়াকে সে কথা দিয়েছে নিয়মিত টাকা পাঠাবে। ব্রোনিয়ার পড়াশোনা শেষ হতে আরো তিন বছর বাকি। নিজেও যে প্যারিসে গিয়ে পড়াশোনা করবে ভেবেছিলো তা প্রায় ভুলে যেতে বসেছিল মারিয়া কাজিমিরের সাথে ঘরবাঁধার স্বপ্নে বিভোর হয়ে।
ঘরবাঁধার স্বপ্ন ভেঙে যাবার পর প্যারিসের স্বপ্ন আবার ফিরে এসেছে। যন্ত্রের মত কাজ করে চললো মারিয়া জোরাভস্কিদের বাড়িতে। একটা ক্ষীণ আশা হয়তো তখনো ছিল - কাজিমির হয়তো মা-বাবার অমতেই তাকে বিয়ে করতে চাইবে। কিন্তু কাজিমির সেরকম কিছুই করলো না। অবশেষে ১৮৯০ সালে জোরাভস্কিদের চাকরি ছাড়লো মারিয়া।
ইতোমধ্যে প্যারিসে ব্রোনিয়ার মেডিকেলের পড়াশোনা প্রায় শেষের পথে। ব্রোনিয়া প্রেমে পড়েছেন তার চেয়ে বয়সে দশ বছরের বড় সহপাঠী এক পোলিশ যুবক কাজিমির ডিলুস্কির। পড়াশোনা শেষ হলেই তারা বিয়ে করবেন ঠিক করেছেন। ব্রোনিয়া লিখেছেন - মারিয়া যদি সরবোনের টিউশন ফি জোগাড় করতে পারে - তাহলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা তাদের সাথেই হয়ে যাবে।
মারিয়া বুঝতে পারছে না কী করবে। বাবাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না - আবার নিজের পড়াশোনার স্বপ্নকে এভাবে বিনাচেষ্টায় ছেড়ে দিতেও ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া কাজিমিরকে সে এখনো ভুলতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে - যদি কাজিমির তার মা-বাবার সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে। পরবর্তী এক বছর ধরে দোটানায় ভুগেছে মারিয়া।
১৮৯১ সালে ব্রোনিয়া ও কাজিমির ডিলুস্কির বিয়ে হলো। প্যারিসে নতুন সংসার শুরু করেছে তারা। কাজিমির জোরাভস্কির জন্য মারিয়ার অস্থিরতা টের পান মারিয়ার বাবা। তাঁরও মনে হয় ব্রোনিয়ার মত মারিয়াও যদি তার কাজিমিরকে পেতো - কতই সুখি হতো মেয়েটা। কিন্তু তা তো হবার নয়। কাজিমিরের সাথে দেখা করার শেষ চেষ্টা করেছে মারিয়া। কিন্তু কাজিমির দেখা করেনি মারিয়ার সাথে। মারিয়া সব ভুলে প্যারিসে যাবার জন্য তৈরি হয়।
১৮৯১ সালের নভেম্বরের এক শীতের সকালে প্যারিসে পা রাখলেন চব্বিশ বছর বয়সী মারিয়া স্ক্লোদভস্কা। ফরাসি নিয়মে মারিয়া হয়ে গেলেন মেরি। ব্রোনিয়া ও তার স্বামী কাজিমিরের বাসায় উঠলেন মেরি।
সরবোনের ক্লাস শুরু হলো দু’দিন পরেই। ১৮৯১ সালের ৩রা নভেম্বর প্রথমদিন ক্লাস করতে এসে মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। মুগ্ধ হয়ে ভাবছিলেন- স্বপ্ন, নাকি সত্যি। ইউরোপের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় সরবোন - মেরির স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮২৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র তেইশ জন মেয়ে। মেরি সেই তেইশ জনের একজন। প্রতিদিন সকালে ঘোড়ায় টানা বাসে চড়ে ইউনিভার্সিটিতে আসেন মেরি। তারপর ক্লাসে অখন্ড মনযোগে লেকচার শোনেন। কিন্তু প্রথম দিনই বুঝে গেলেন তাঁর যে ফরাসি ভাষাজ্ঞান তাতে প্রফেসরদের লেকচার তিনি পুরোপুরি বুঝতে পারছেন না। তাছাড়া পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিতে তার যে দখল তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। পড়াশোনায় ভালো করতে হলে তাকে আরো অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে।
ব্রোনিয়া ও কাজিমির ডাক্তারি প্র্যাকটিস শুরু করার জন্য একটা দোতলা বড় বাসা ভাড়া নিলেন। নিচের তলায় পাশাপাশি দুটো চেম্বার - ব্রোনিয়া ও কাজিমিরের। কিন্তু নতুন বাসাটি সরবোন থেকে অনেক দূরে। আসা যাওয়ায় অনেক সময় নষ্ট হয় মেরির। তিনি তাই ইউনিভার্সিটির কাছে ল্যাটিন কোয়ার্টারের ফ্ল্যাটার্স রোডে একটা সস্তা বাসা ভাড়া করলেন।
বাসা বলতে ছয়তলা পুরনো বিল্ডিং এর চিলেকোঠায় একটা রুম। বিল্ডিং-এর বাইরে একটা ঝরঝরে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠানামা করতে হয় তার রুমে। বাসা থেকে বিশ মিনিট পায়ে হেঁটে ইউনিভার্সিটিতে যান মেরি।
সারাদিন ক্লাস করে লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করেন যতক্ষণ লাইব্রেরি খোলা থাকে। তারপর আবার পায়ে হেঁটে বাসায় ফেরা। সারাদিন তেমন কিছু খাওয়াও হয় না। অনেকদিন বাসায় ফিরেই শুয়ে পড়েন বিছানায়। রুমে একটা বিছানা ছাড়া আর কোন আসবাব নেই। রুমহিটিং-এর ব্যবস্থাও নেই। কয়লার খরচ কমানোর জন্য শীতকালে বরফের মত ঠান্ডা ঘরেই রাত কাটান মেরি।
একদিন মেরির খবর নিতে এসে কাজিমির দেখেন প্রচন্ড ঠান্ডায় মেরি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন ঘরে। রক্তচাপ মারাত্মক রকমের কম। তাড়াতাড়ি প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে নিজেদের বাসায় নিয়ে আসেন মেরিকে।
সপ্তাহখানেক পরে কিছুটা সুস্থ হয়ে নিজের বাসায় ফিরে আবার কষ্ট, কষ্ট, আর কষ্ট। কিন্তু কষ্ট হলেও তাঁর তৃপ্তিও অনেক - জানার তৃপ্তি, কাজের তৃপ্তি, জ্ঞানের তৃপ্তি। প্রচন্ড ঠান্ডায় জ্বালানি কিনলে খাদ্য কেনার টাকা থাকতো না। সারাদিনে হয়তো এক টুকরো রুটি আর এক কাপ চায়ের বেশি কিছু জুটতো না। এ যেন অসাধ্য সাধন করার সাধনা।
শুরুতে কিছুদিন পোলিশ জাতীয়তাবাদী একটা স্টুডেন্ট গ্রুপের সাথে মিশেছিলেন মেরি। পরে সময় নষ্ট হচ্ছে দেখে রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করে দেন। তিনি বুঝতে পারেন পোল্যান্ডের জন্য কিছু করতে হলে আগে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে যেন দেশের জন্য সত্যিকারের কিছু করা যায়। বিজ্ঞান বিভাগের অনেক ছেলেমেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হলো মেরির। তাঁর ব্যক্তিত্ব সৌন্দর্য আর অসাধারণ সাধারণত্বে অনেক ছাত্রই আকৃষ্ট হয়েছেন মেরির প্রতি। মেরিই তখন সরবোনে একমাত্র ছাত্রী যার গায়ে একটুকরো গয়নাও নেই, যার পোশাকে একটুও চাকচিক্য নেই।
ল্যামোটি নামে এক ফরাসি ছাত্র মেরির প্রেমে পড়ে গেলেন। মেরিকে অনেকবার চিঠি লিখেও কোন উত্তর না পেয়ে সরাসরি প্রেমের প্রস্তাব দেন ল্যামোটি। কাজিমিরের কাপুরুষতা মেরিকে অনেকটাই পুরুষবিদ্বেষী করে তুলেছে। কিন্তু তিনি সেটা প্রকাশ করতে চান না। ল্যামোটিকে বললেন, “আমি তো ফ্রান্সে থাকবো না। লেখাপড়া শেষ করেই পোল্যান্ডে ফিরে যাবো। সেখানে গিয়ে স্কুলে মাস্টারি করবো। আমার পক্ষে তোমাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। কিন্তু তুমি চাইলে আমরা বন্ধু হয়ে থাকতে পারি।”
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। ১৮৯৩ সালের জুলাই মাসে রেজাল্ট বের হলে দেখা গেলো সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবারের মত একজন মেয়ে কোন পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে। মেরি স্ক্লোদভস্কা পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন।
খুশির খবর নিয়ে পোল্যান্ডে বাবার কাছে ফিরলেন মেরি। বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ তৈরি হয়েছে মেরির। সরবোনে পড়াশোনা করতে করতে বুঝেছেন গণিতে শক্ত ভিত্তি ছাড়া পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা সম্ভব নয়। গণিতে মাস্টার্স ডিগ্রি নিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আবার পড়াশোনার খরচ আসবে কোত্থেকে? বাবা এতদিন অনেক করেছেন। প্রচন্ড হতাশ হয়ে পড়েছেন মেরি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ছয়শ’ রুবলের একটা স্কলারশিপ পেয়ে যান মেরি।
সরবোনে মেরির পোলিশ বান্ধবী ডায়ডিনস্কা আলেক্সান্ড্রোভিচ স্কলারশিপ কমিটিকে মেরি স্ক্লোদভস্কার ব্যাপারে দরখাস্ত করে স্কলারশিপটার ব্যবস্থা করেছেন। [চার বছর পর মেরি স্কলারশিপের টাকাটা কমিটির কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন তাঁর মতো অন্য কোন শিক্ষার্থীর কাজে লাগবে।]
সেপ্টেম্বর মাসে আবার প্যারিসে ফিরে এলেন মেরি। বাসা নিলেন ইউনিভার্সিটির কাছে। এবারো ছয়তলায় একটা রুম। আবার নতুন করে সংগ্রাম। ১৮৯৪ সালে ফাইনাল পরীক্ষার আগে মেরি একটা খন্ডকালীন গবেষণার চাকরিও পেয়ে গেলেন।
মেরি স্ক্লোদভস্কা |
সোসাইটি ফর দি এনকারেজমেন্ট অব ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিজ ইস্পাতের চৌম্বকধর্ম পরীক্ষা করার জন্য মেরিকে নিয়োগপত্র দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো সরবোনের পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের গবেষণাগার খুবই ছোট আর যন্ত্রপাতি ধরতে গেলে কিছুই নেই। মেরি পরামর্শ চাইলেন সরবোনের প্রফেসর জোসেফ কাওয়ালস্কির কাছে। কাওয়ালস্কি মেরিকে বললেন, “কাল আমার বাসায় এসো। তোমার সমস্যার সমাধান যে করতে পারবে তার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেবো।”
পরদিন সন্ধ্যাবেলা প্রফেসর কাওয়ালস্কির বাসায় গেলেন মেরি। ঘরে ঢুকতেই দেখলেন জানালার কাছে উদাস চোখে দাঁড়িয়ে আছেন ত্রিশ বত্রিশ বছর বয়সী দাড়িওয়ালা এক যুবক। মেরি নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। চোখাচোখি হলো দু’জনের। কাওয়ালস্কি এগিয়ে এসে বললেন, “এসো মেরি, তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি ইপিসিআই’র ফিজিক্স ল্যাবের ডিরেক্টর পিয়ের কুরি। আর পিয়ের, এ হলো মেরি স্ক্লোদভস্কা যার কথা তোমাকে বলেছিলাম।”
“বুঁজো মঁসিয়ে”- গলা কাঁপছে মেরির।
[৪র্থ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে]
________________
________________
এ কাহিনি আমার "রেডিয়াম ভালোবাসা" বইতে প্রকাশিত হয়েছে।
No comments:
Post a Comment