বাড়িটা নিস্তব্ধ এখন। মনে হচ্ছে সবাই বাইরে। কেই মিকি আর আমাকে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখালো। আমাদের রুমের পাশেই ছোট্ট বসার জায়গা। দুটো টেবিল আর চারটে চেয়ার পাতা আছে সেখানে। তার পাশে বাথরুম। ছেলে আর মেয়েদের জন্য পাশাপাশি আলাদা ব্যবস্থা। ধূমপায়ীদের জন্য ঘরের বাইরে ছোট্ট একটা জায়গা করে দেয়া আছে। নিচের তলার ছাদে একটা সুইমিংপুল। আকারে খুবই ছোট। সেখানে দাপাদাপি করা যাবে, কিন্তু সাঁতার কাটা যাবে না। একদম নিচেরতলায় কম্যুনিটি কিচেন। যার যা খুশি রান্না করতে পারে এখানে। ফ্রিজ আছে দুটো। খাবার রাখলে প্যাকেটের গায়ে নাম লিখে রাখতে হয়। প্রশস্ত টিভিরুম, টেলিফোন বুথ। হোস্টেলের সব সুযোগ-সুবিধা আছে, ঘর থেকে দূরে ঘরের আরাম। মনে হচ্ছে এটা বাড়িতে থাকার মতোই, কিন্তু বাড়ির সদস্যরা সবাই অপরিচিত বা হঠাৎ পরিচিত।
কেই-এর অফিস ঘরটা মূল ঘরের বাইরে, পেছনের দিকে। অফিসের পাশের ঘরে একটা বিলিয়ার্ড টেবিল। স্নুকার বা পুল খেলার ব্যবস্থা সেখানে। মিকি খুব আগ্রহ দেখালো পুল খেলার প্রতি।
বেসমেন্টে ওয়াশিং মেশিন আর ড্রয়ার। বাড়ির পেছন দিক থেকে সরাসরি দোতলায় উঠার সিঁড়ি আছে। এটা আসলে ফায়ার এক্সিট- জরুরি প্রস্থান পথ। অস্ট্রেলিয়ার ছোটবড় সব ভবনেই সেফটি সিস্টেম মেনে চলতে হয়। আগুন নেভানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকলে মোটা অংকের ফাইন গুণতে হয়।
লোহার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে গিয়ে আকাশের দিকে চোখ গেলো। এমন নীল আকাশ সত্যিই আর কোথাও দেখিনি। মেঘের সামান্য সুতোটিও নেই কোথাও। সূর্যটা ঠিক কোথায় আছে দেখতে পাচ্ছি না এখান থেকে, কিন্তু তার উজ্জ্বল উপস্থিতিতে চারদিক ঝলমল করছে। চ্যানেল সেভেনের বিজ্ঞাপনে মানুষটা একবিন্দুও মিথ্যা বলেনি। এমন সূর্য আর কোথায় পাওয়া যাবে! তাই তো ব্রিসবেনকে বলা হয় সান সিটি; সূর্যনগর।
কেই চলে গেলো তার কাজে, আমরা যে যার রুমে। আমার রুমটি ছোট্ট। একটা ছোট্ট বিছানা, বিছানার সমান দৈর্ঘ্যের জানালা, দেয়ালে লাগানো বড় আয়না, একটা ছোট্ট নিচু কাচের টেবিল আর ছাদে ঝুলানো চার ব্লেডের সিলিং ফ্যান। এই হলো ঘরের আসবাব। তাছাড়া আরো একটা জিনিস আছে। কোণায় লাগানো একটা ছোট্ট ফ্রিজ। প্রথমে খুব খুশি হয়ে গেলেও ফ্রিজ খুলে দেখলাম এটা অচল। মেশিন নেই, শুধু ফ্রিজের খোলটা আছে। টেবিলের কাজ হচ্ছে ওটা দিয়ে। চব্বিশ ঘন্টায় ত্রিশ ডলার ভাড়ায় ব্রিসবেন শহরের হৃদপিন্ডের কাছাকাছি জায়গায় এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর কী হতে পারে!
আমাদের হোস্টেলের রাস্তার নাম ক্রিকেট স্ট্রিট। খুব কাছেই একটা স্টেডিয়াম দেখা যাচ্ছে। রাস্তার নাম আর স্টেডিয়াম একসাথে মিলিয়ে মনে হচ্ছে ওটা ক্রিকেট স্টেডিয়াম। মধ্য দুপুরের রোদে চারপাশে একটা সুনশান ভাব। ব্যস্ত রাস্তাটার ওপারে পার্কটা ধরে নামলেই ব্রিসবেন ট্রানজিট সেন্টারে যাবার রাস্তা। হেঁটে যেতে সময় লাগবে বড় জোর দশ মিনিট।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবছি কোন দিকে যাবো আগে। এসময় পাশে এসে দাঁড়ালো মিকি। পোশাক বদলেছে। ছোট্ট একটা ব্যাগ গলায় ঝুলছে তার। সকালে যে ব্যাগটা দেখেছিলাম তার কাঁধে সেটার তুলনায় এখনকার ব্যাগ নগণ্য। উচ্চতর গণিতে এরকম নগণ্যকে হিসাব থেকে বাদ দেয়া হয়।
"কোনদিকে যাচ্ছো?" মিকির প্রশ্ন।
"ওই দিকে।" আঙুল তুলে দেখালাম ট্রানজিট সেন্টার।
"লেটস গো" বলেই মিকি আমার শার্টে একটা টান দিয়ে দৌড়ে চলে গেলো রাস্তার ওপারে। সাথে আমিও।
হেঁটে চলার পথটা পাহাড়ি। সামান্য উঁচু-নিচু অংশটা পার হবার পর ক্রমশ নিচের দিকে নেমে গেছে। ব্রিসবেন সিটিটা যে পাহাড় আর নদী ঘেরা তা বুঝতে পারছি। একটু সামনে গেলেই রোমা স্ট্রিট রেলওয়ে স্টেশন। স্টেশনটির উপরে চারতলায় সেন্ট্রাল বাস স্টেশন।
"ক’দিন থাকবে ব্রিসবেন?" মিকির প্রশ্ন।
"আছি তিন চারদিন। ভালো লাগলে আরো বেশি। তুমি?"
"আমি কালকেই চলে যাচ্ছি কেইনস।"
কেইনস ব্রিসবেন থেকে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে কুইন্সল্যান্ডের তথা অস্ট্রেলিয়ারও একটি সীমান্ত শহর। মিকি বলছে, "এখন যাচ্ছি টিকেট বদলাতে। ভেবেছিলাম আজকে রাতেই চলে যাবো। কিন্তু এখন মত পাল্টেছি। কাল যাবো।"
"মত কি আবারো বদলাতে পারে?"
"তা পারে। আমার মত ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। এই দেখো না- গত দশ দিন কাটিয়ে এসেছি সারফার্স প্যারাডাইসে।"
"দশদিন! ঐ ছোট্ট জায়গায়?"
"আশ্চর্য হচ্ছো তো? আমিও ভাবলে অবাক হই। জায়গাটা ঘুরে দেখতে দু’ঘন্টাও লাগবে না। কিন্তু আমার কেন জানি ভালো লেগে গেলো সেখানে।"
"কী কী করলে?"
"স্রেফ সার্ফিং। জানো তো আমাদের ভিয়েনাতে কোন সাগর নেই, বিচ নেই।"
মিকির ইংরেজি উচ্চারণে কেমন অন্যরকম একটা সুর আছে। এটা হয়তো অস্ট্রিয়ান টান। তবে বেশ ভালো ইংরেজি বলে সে। কথা বলার সময় শব্দ হাতড়াতে হয় না। ভিয়েনাতে থাকলেও হয়তো তাকে প্রচুর ইংরেজি বলতে হয়.
"অস্ট্রেলিয়াতে কখন এসেছো তুমি?" মিকিকে জ্ঞিজ্ঞাসা করি।
"মাসখানেক হলো। থাকবো আরো দু'মাস। তিন মাসের ছুটি এখন আমার। আমি একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করি। তুমি কী করছো?"
"আমি মেলবোর্নে পড়াশোনা করছি। পিএইচডি থিসিস লিখছি এখন।"
"ওরে বাপরে, পিএইচডি! এত্তো পড়াশোনা ভালো লাগে তোমার?"
"সব সময় লাগে না। তাই তো এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি।"
ট্রানজিট সেন্টারের নিচের তলা থেকে একটি চলমান সিঁড়ি সোজা দোতলার ফুডকোর্টে উঠে পড়েছে। ফুডকোর্টে ঢুকে মিকিকে বললাম, "আমি লাঞ্চ করবো এখন। তোমার কাউন্টার তো উপরে।"
"হ্যাঁ, আমার বেশিক্ষণ লাগবে না।" হাত নেড়ে তিনতলায় উঠে গেলো সে।
এখন লাঞ্চ আওয়ার। ফুডকোর্টে লোক গিজগিজ করছে। ম্যাকডোনালডস, হাংরি জ্যাকস, কে-এফ-সি’র কাউন্টারে বেশ ভিড়। ম্যাক্সিকান দোকানের কাউন্টারে সাজানো খাবারে চোখ বুলিয়ে দেখলাম। খুব একটা আকর্ষণ অনুভব করলাম না কোন খাবারের প্রতিই। তার পাশের দোকানটা চায়নিজ। এখানে অন্তত চৌদ্দ রকমের খাবার কাউন্টারে রাখা আছে। সেলফ সার্ভিস।
খাবারগুলোর নাম লেখা থাকলেও দাম লেখা নেই। কেবল দেয়ালে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে ছোট: ৫.৫০ ডলার, মাঝারি: ৬.৫০ ডলার, বড়: ৭.৫০ ডলার। এরকম পরিস্থিতি আমার জন্য নতুন। বড়, ছোট, মাঝারির মানে কী?
কাউন্টারের ওদিকে চায়নিজ মহিলা আমার প্রশ্নের উত্তরে মুখে কিছু না বলে দেয়ালে লাগানো একটি বোর্ডের দিকে আঙুল তুলে দেখালো। সেখানেও একই কথা লেখা আছে, তবে একটু অন্যভাবে। একটা বড় প্লাস্টিকের প্লেটের ওপর লেখা আছে, বড়: ৭.৫০ ডলার। মাঝারি আর ছোট পাত্রও দেখা যাচ্ছে বড়টার পাশে। এবার বিষয়টা বুঝতে পারলাম।
লোকজন কাউন্টার থেকে পছন্দমতো সাইজের পাত্র হাতে নিয়ে টপাটপ খাবার তুলে নিচ্ছে। পাত্র বোঝাই খাবার হাতে নিয়ে রেজিস্ট্রারের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। খাদ্য সামগ্রী নয়, পাত্র অনুযায়ী দাম- সাড়ে সাত, সাড়ে ছয় বা সাড়ে পাঁচ ডলার। কেউ পানীয় কিছু নিলে তার দাম এক্সট্রা। রূপকথার সেই গল্পের মতো শাক আর ঘি এখানে একদামে বিক্রি হয়। অবশ্য অস্ট্রেলিয়ায় শাকের দাম অনেক সময় ঘিয়ের দামের চেয়ে বেশি। অনেকে দেখলাম আশ্চর্য দক্ষতায় পাত্র বোঝাই করছে। প্লেটের উপরে পিরামিডের আকৃতিতে খাবারের স্তূপ। আমি মাঝারিদের দলে। খাবার তুলে নিতে গিয়ে বুঝলাম এ বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে না পারলে হাতের প্লেট দু'চামচেই ভর্তি হয়ে যাবে।
হানি-চিকেন, কলিফ্লাওয়ার-চিকেন, অ্যারাবিয়ান-ল্যাম্ব, মরক্কো-বিফ ইত্যাদি সব গালভরা নাম দিয়ে রেখেছে বিভিন্ন আইটেমের। আমি ভোজন রসিক নই, ভোজন বিলাসীও নই। হাতের কাছে যা পেলাম নিলাম। ক্যাশ কাউন্টার পর্যন্ত হেঁটে যেতে গিয়ে বুঝলাম হাতের প্লেটের উপচে পড়া খাবারের ব্যালেন্স রক্ষা করাটাও বেশ আয়াসসাধ্য ব্যাপার। চায়নিজদের ব্যবসায়িক বুদ্ধি আসলেই ধারালো।
দু’জনের ছোট্ট একটা টেবিলে বসে মোরগের হাড় চিবুচ্ছি, এ সময়- "এই যে তুমি এখানে।" মিকির গলা। এই মেয়ে এখনো চলে যায়নি দেখছি।
"কী খাচ্ছো?"
মিকিকে চায়নিজ দোকানটার বর্ণনা দিতেই খুব আগ্রহ নিয়ে ছুটলো সে সেদিকে। একটু পরে ফিরে এলো একটি ছোট প্লেট হাতে। তাতে খাবারের পরিমাণ দেখে আমি কিছুতেই মেলাতে পারছি না- এত্তো কম খেয়ে ঐ বিশাল ব্যাগ বইবার শক্তি পায় কোত্থেকে এই ছিপছিপে মেয়েটা? কথাটা তাকে জ্ঞিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেলাম। মেয়েদের বয়স, ওজন ইত্যাদির মতো এনার্জি বিষয়ক প্রশ্ন করাটাও যদি নিষিদ্ধ হয়ে থাকে! অবশ্য মিকির আচরণে এ পর্যন্ত কোন ধরনের লৈঙ্গিক বিভাজন চোখে পড়েনি আমার।
মিকি বসলো আমার মুখোমুখি চেয়ারে। খেতে খেতে হঠাৎ প্রশ্ন করলো, "তুমি কি হিন্দু?"
হঠাৎ এ ধরনের প্রশ্নে আমি অবাক। মিকি ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। ব্যাখ্যা করে বললো, "তোমার নাম শুনে মনে হচ্ছে ওটা সংস্কৃত শব্দ। সংস্কৃত নাম তো হয় হিন্দুদের, আর আরবি নাম হয় মুসলিমদের। তাই তো?"
"তোমাকে এসব কে বলেছে?"
"আমি কয়েকজন নেপালি হিন্দুকে চিনি। আমার সাথে কাজ করে ভিয়েনাতে।"
"তারা তোমাকে আংশিক তথ্য দিয়েছে মিকি। নেপালের ভাষা নেপালি। ওটা ঠিক সংস্কৃত কিনা আমি জানি না। হিন্দি ভাষাটারও উৎপত্তি সংস্কৃত থেকে তা বলে থাকেন অনেকে। বাংলা ভাষাতেও অনেক শব্দ সংস্কৃত থেকে এসেছে। ভাষাবিদরা ভালো বলতে পারবেন এ বিষয়ে। আর নামের ব্যাপারে আমাদের বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ আর খ্রিস্টানরা সাধারণত বাংলা নাম পছন্দ করেন। মুসলিমরাও তাদের আসল নাম না হলেও ডাকনামটা অন্তত বাংলায় রাখেন। ভাষাটা ধর্মের চেয়েও সংস্কৃতির ওপর বেশি নির্ভর করে। ভাষা দিয়ে তাই মানুষের ধর্ম নির্ণয় করা যায় না। তা হঠাৎ তুমি আমার ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করছো কেন?"
"না, তুমি এই যে বাইরের খাবার খাচ্ছো, দেখে মনে হচ্ছে কী খাচ্ছো দেখছোও না। আমার সেই নেপালিরা জানো দোকানের স্যান্ডুইচ পর্যন্ত খায় না। শুধু নিজেদের তৈরি খাবার খায় তারা। খাঁটি হিন্দুরা নাকি এরকমই হয়!"
"তাহলে আমি মোটেও হিন্দু নই। হিন্দু পরিবারে আমার জন্ম ঠিকই। কিন্তু আমার নিজের ধর্ম মানবতা। হিউমিনিটি। আমার কাছে মানুষের ধর্মীয় পরিচয়টা বড় নয়। আমি মনে করি ধর্ম জিনিসটা মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। বাইরের খাবার খাওয়া না খাওয়ার ওপর ধর্মের খাঁটিত্ব বা ভেজালত্ব নির্ভর করে না। আমার মনে হয় তোমার নেপালি বন্ধুরা দোকান থেকে খাবার কিনে খায় না প্রধানত খরচ বাঁচানোর জন্য। তুমি জানোই তো ইউরোপে সবকিছুর দাম কেমন বেশি। হিন্দু ধর্মের খাঁটি উপাসক হলে তো তাদের ভিয়েনার বদলে হিমালয়েই থাকা উচিত ছিলো, না কি?"
তারপর ব্যক্তিগত, সমাজতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় প্রসঙ্গে কিছুক্ষণ আলোচনা হলো। মিকি ফিলোসফির ছাত্রী। আমার কিছু কিছু ব্যাখ্যা তার ভালো লেগেছে বললো। ধর্ম সম্পর্কে আমার ব্যাখ্যা শুনে সে বললো, "ধর্মকে তুমি যুক্তির পাল্লায় দাঁড় করাতে চাচ্ছো। তাতে ধর্ম তো একটা কাঠামোতে থাকবে না।"
"তুমিই বলো মিকি, কোনটা অধিকতর গ্রহণযোগ্য, যুক্তি না আরোপিত কাঠামো?"
এ প্রসঙ্গে আলোচনা বা বিতর্ক সারাদিন চললেও শেষ হবে না। তাই প্রসঙ্গ বদলালাম।
"আজকের দিনের বাকিটা সময় কি করবে তুমি?" মিকিকে জ্ঞিজ্ঞেস করলাম।
"ঘুরে বেড়াবো। তুমি?"
"আমিও। ঘুরতেই তো এসেছি এখানে।"
"আমরাতো একসঙ্গেই ঘুরতে পারি। অবশ্য তোমার যদি আপত্তি না থাকে।"
"আপত্তি থাকার প্রশ্নই ওঠে না। আমার ভালোই লাগতে শুরু করেছে মিকির সঙ্গ।"
ট্রানজিট সেন্টার থেকে বেরিয়েই বাঁ দিকের আকাশছোঁয়া বিল্ডিংটার গায়ে চোখ পড়ল- কুইন্সল্যান্ডের এনার্জি বিল্ডিং। তার গায়ে লাগানো এনার্জি থার্মোমিটার বলছে ব্রিসবেনের এখনকার তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাস্তার ওপারে কুইনসল্যান্ড সেন্ট্রাল পুলিশ সদর দফতরের বিশাল পাঁচতলা ভবন। তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জর্জ স্ট্রিটের মুখেই বিশাল এক পোস্টার।
ব্রিসবেন সিটি কাউন্সিলের এই পোস্টারটিতে দেখা যাচ্ছে একটি বড় সাদা বক ঠোঁটে পলিথিন জড়িয়ে মরে পড়ে আছে। নিচে লেখা রয়েছে, 'আপনার ফেলে দেওয়া আবর্জনা অন্য কারো মৃত্যুর কারণ হতে পারে। সুতরাং ময়লা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলুন।'
বিজ্ঞাপনটির আবেদনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমি। যখন অনুরোধের সাথে অনুরোধের কারণও দেয়া থাকে তা মানতে খুব ভালো লাগে। যেমন লাইব্রেরিতে খাবার বা পানীয় নিয়ে ঢুকতে নিষেধ করা হয়। কারণ তাতে লাইব্রেরির ভেতর পোকা তৈরি হয়ে বই নষ্ট করবে। কোন গ্রহণযোগ্য কারণ না বলে কেবল চোখ পাকিয়ে নিষেধ করলে সেই নিষেধ মানার চেয়ে না মানার প্রতিই আগ্রহ জন্মে বারবার।
এই পোস্টারটার প্রশংসা করতেই মিকি বললো, "তারপরও তো এখানে রাস্তায় রাজ্যের ময়লা!"
আমি অবাক। আমার এ পর্যন্ত দেখা অস্ট্রেলিয়ার শহরগুলোর মধ্যে ব্রিসবেনকেই মনে হচ্ছে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন। বিশেষ করে এই ছুটির দিনে যখন সুইপাররা কাজ করেন না তখনো এত্তো পরিষ্কার। আর এই মেয়ে বলে কিনা ময়লা! বিষয়টা মিকিই খোলাসা করলো।
"ভিয়েনাতে তুমি রাস্তায় এক টুকরো কাগজ বা কাচ দেখবে না।"
এখানে রাস্তায় মাঝে মাঝে ছড়ানো মদের বোতল আর ভাঙা কাঁচ দেখেই মিকির এই মন্তব্য। কোথায় যেন পড়েছিলাম, ইউরোপের কোন কোন শহরে ময়লা ফেলার সময়েই কাচ, কাগজ বা প্লাস্টিক আলাদা আলাদা বিনে ফেলতে হয়। নইলে ধরা পড়লে জরিমানা। এখানে অবশ্য আলাদা করতে শুধু অনুরোধ করা হয়। না করলে জরিমানার পর্যায়ে আসেনি এখনো।
সিডনির মতো ব্রিসবেন সিটিরও একটি প্রধান রাস্তা জর্জস্ট্রিট। জর্জস্ট্রিট থেকে এডেলেইড স্ট্রিট ধরে নর্থক্যুয়েতে এসে পড়লাম। সামনেই ব্রিসবেন নদী ব্রিসবেন সিটিকে তিন পাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। নদীর দক্ষিণ পাড়ে সাউথ ব্রিসবেন। পাঁচটি বিশাল ব্রিজ আর অসংখ্য ফেরি উত্তর ও দক্ষিণ ব্রিসবেনের সংযোগ রক্ষা করছে।
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে। তবে ছবিগুলো আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি।
No comments:
Post a Comment