ব্রিসবেন নদীটা খুব বেশি বড় নয়। শান্ত। খুব কাছেই যে ব্রিজটি পাওয়া গেলো তার নাম ভিক্টোরিয়া ব্রিজ। ব্রিজের প্রশস্ত ফুটপাতে অসংখ্য মানুষ। বেশির ভাগই আমাদের মতো ট্যুরিস্ট। ব্রিসবেন যে কেন বছর বছর ট্যুরিজমে পুরস্কার পায় তা বোঝা যাচ্ছে ট্যুরিস্টের স্রোত দেখে। অস্ট্রেলিয়া দেখতে আসা ট্যুরিস্টদের শতকরা ৬৪ ভাগের প্রথম পছন্দ ব্রিসবেন।
সূর্য পশ্চিমে সামান্য হেলেছে। ব্রিসবেন নদীর পানিতে ঝলমল করছে রোদ্দুর। ভিক্টোরিয়া ব্রিজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রেলিং-এ হাত রেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি নিচের পানির দিকে। পরিস্কার নীল পানিতে ব্রিসবেন সিটির প্রতিচ্ছবি। মেঘহীন নীল আকাশ দেখার জন্য আকাশের দিকে তাকানোর দরকার নেই। পানিতে পড়েছে আকাশের ছায়া। মনে হচ্ছে আকাশের গা বেয়ে বেয়ে চলেছে অন্তহীন নদী।
ভিক্টোরিয়া ব্রিজের দক্ষিণ অংশ মিশেছে মেলবোর্ন স্ট্রিটের সাথে। নদীর এপারে বিশাল পারফর্মিং আর্ট সেন্টার, মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারি, স্টেট লাইব্রেরি। সব মিলিয়ে কালচারাল ব্রিসবেন। ব্রিজের ওপর থেকেই সরাসরি পারফর্মিং আর্ট সেন্টারের দোতলায় ঢুকে পড়লাম।
মানুষের ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। সিঁড়ি দিয়ে উঠে তিনতলার লবিতে ঢুকতেই মনে হলো নাটকের সাজঘরে ঢুকে পড়েছি। বিশাল ঘরের মাঝে মাঝে নাটকের কস্টিউম সাজিয়ে রাখা হয়েছে কাচঘেরা বাক্সে। নতুন নাটক বা ব্যালে দেখতে এসে দর্শকেরা পুরোনো নাটকের পোশাক দেখতে পান। পাঁচতলাব্যাপী বিশাল অডিটোরিয়াম। বিরাট মঞ্চ।
আজ চলছে বিখ্যাত মিউজিক্যাল ‘অ্যানি’। ‘অ্যানি’ সিনেমাটি আমার দেখা আছে। একজন এতিম মেয়ের করুণ এবং মজার কাহিনীসমৃদ্ধ নাচেগানে ভরপুর প্রযোজনা। নিচের তলায় রয়েছে বিভিন্ন নাটকের দলের জন্য রিহার্সাল রুম বা ওয়ার্কশপ হাউজ। একটু দূরে আলাদা একটি বড় টিনশেডে দেখলাম নাটকের সেট তৈরির কারখানা। সংস্কৃতির চর্চা এখানে পুরোপুরি পেশাদার। মানুষ ৭০ ডলার খরচ করে এক একটা নাটক দেখে। আমাদের দেশে নাকি মঞ্চনাটক টিকতে পারছে না ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কারণে। এদেশে কি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আমাদের দেশের মিডিয়ার চেয়ে দুর্বল? আমার মনে হয় আমাদের সমস্যাটা অন্য কোথাও।
ব্রিসবেন নদীর একদম তীর ঘেঁষে অনেকটা পানির ওপর দিয়েই পায়ে চলার কাঠের ব্রিজ চলে গেছে মাইলের পর মাইল। আমরা সেই পথ ধরে কিছুদূর হেঁটে উঠে গেলাম কুইন্সল্যান্ড মিউজিয়ামে।
মিউজিয়ামে ঢুকতে কোন টিকেট লাগে না। কেবল সাথে কোন বড় ব্যাগ বা জ্যাকেট থাকলে তা প্রবেশমুখের কাউন্টারে জমা রাখতে হয়। মিউজিয়ামের গেটেই বিশাল দুটি তিমি মাছের মডেল। ঝুলে আছে ছাদের ওপর থেকে। চারতলা এই মিউজিয়ামের নিচের তলায় কুইন্সল্যান্ডের ইতিহাস সংগ্রহশালা। বইয়ের পাতা থেকে মুখস্ত করতে গেলে যে ইতিহাস মনে হয় বিরাট যন্ত্রণা, সেই একই ইতিহাস এখানে জানা যায় কত সহজে। অবশ্য পরীক্ষা দিতে না হলে সব বিষয়কেই সহজ মনে হয়।
ব্রিসবেন শহরের গোড়াপত্তন হয় ১৮২২ থেকে ১৮২৬ সালের ভেতর। অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য এলাকার মতো এখানেও নিয়ে আসা হয়েছিলো ব্রিটেনের দাগি কয়েদিদের। তখন নিউ সাউথ ওয়েলস-এর গভর্নর ছিলেন স্যার থমাস ব্রিসবেন। তাঁর নাম অনুসারেই এই শহরের নাম।
শুরুতে ১৮২৪ সালে শহরের স্থান নির্বাচন করা হয়েছিলো এখান থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে রেডক্লিফ নামে একটি জায়গায়। কিন্তু দেখা গেলো সেখানে পর্যাপ্ত খাবার পানি নেই, মাটি অনুর্বর, তদুপরি ঘরবাড়ি বানাবার জন্য কাঠও নেই তেমন। ফলে এক বছরের মধ্যেই রেডক্লিফ ছেড়ে নতুন স্থাপনা গড়া হলো বর্তমানের এই ব্রিসবেনে।
১৮২৬ থেকে ১৮৩১ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে প্রায় এক হাজার কয়েদিকে এনে রাখা হলো এখানে। তাতে ব্রিটিশ সরকারের খরচ পড়লো প্রায় এক হাজার হাতি পোষার মতো। ফলে পরবর্তী পাঁচ বছরে কয়েদির সংখ্যা এক হাজার থেকে কমে তিনশ’তে নেমে এলো। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা গেলো ব্রিসবেন একটি পরিত্যক্ত জায়গা।
আদিবাসি হত্যাকান্ড শুরু হয়েছিলো অনেক আগে থেকেই। এ অঞ্চলে আদিবাসীদের সংখ্যা ছিলো সবচেয়ে বেশি। তাই ব্রিটিশ কমান্ডারদের ক্ষোভও ছিলো এখানেই বেশি। ১৮৪২ সালে খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে দিয়ে একসাথে আশি জন আদিবাসিকে মেরে ফেলা হলো। যখন যেখানে দেখে গুলি করে মারা তো আছেই। আদিবাসিরাও প্রতি-আক্রমণ শুরু করলো। কিন্তু তীর ধনুক দিয়ে যুদ্ধ করে কি আর জেতা যায়? আদিবাসিদের সংখ্যা কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় নেমে এলো। আদিবাসিদের কাছ থেকে এভাবে দখল করা ভূমি হয়ে গেলো রানির ভূমি- ‘কুইন্সল্যান্ড’। ১৮৫৯ সালে কুইন্সল্যান্ড আলাদা স্টেট হবার পরে আস্তে আস্তে গড়ে উঠেছে এই ব্রিসবেন সিটি।
২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেশনের একশ বছর পূর্ণ হলো। সে উপলক্ষে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশেষ শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে মিউজিয়ামে। একেক দিন একেক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এসে এসব অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে।
নিচের তলার শেষ প্রান্তে আছে যান্ত্রিক বিবর্তনের ধারা -মোটরগাড়ির ইঞ্জিনের বিবর্তন। ঘোড়ায় টানা প্রথম দিকের গাড়ি থেকে শুরু করে বর্তমানের কম্পিউটার চালিত গাড়ির মডেলও আছে এখানে। উঁচু ছাঁদ থেকে ঝুলছে রাইট ভাইদের উড়োজাহাজের মডেল।
মিউজিয়ামের দোতলায় উঠে এলাম। এখানে চলছে বিশেষ প্রদর্শনী ‘বডি আর্ট’। পনের বছরের কম বয়স্কদের ঢোকা নিষেধ এই প্রদর্শনীতে। প্রবেশ পথে টিকেট কাটতে হয়। স্টুডেন্ট কনসেশান বাদ দিয়ে আমার লাগলো সাত ডলার আর মিকির লাগলো নয় ডলার।
বডি আর্ট বা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় উল্কি আঁকাটা এখানে খুব প্রচলিত। এই প্রদর্শনীতে দেখানো হচ্ছে মানুষ কীভাবে স্থায়ী বা অস্থায়ী উল্কি আঁকে বা আঁকায়। শরীর-অঙ্কন শিল্পীরা ক্রেতাদের ইচ্ছেমতো চিত্র ফুটিয়ে তুলছে শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। মনে হচ্ছে কোন শিল্পীর স্টুডিওতে এসেছি যেখানে শিল্পীরা কাজ করছে অনেকগুলি ন্যুড মডেল নিয়ে।
বাহুতে চিত্র আঁকাটা খুব কমন। তবে আনকমন চিত্রই দেখা গেলো এখানে বেশি। নাভির কাছে, উরুতে, পুরো পিঠ জুড়ে আঁকা হচ্ছে আলপনা। কোমর পেঁচিয়ে আঁকা হচ্ছে ড্রাগন। একজনের শরীরে এমনভাবে চিত্র আঁকা হয়েছে যে তার আলাদা কোন পোশাক না পরলেও চলবে। এই চিত্র আঁকা হচ্ছে এসিড জাতীয় কিছু দিয়ে, যা শরীরে স্থায়ীভাবে বসে যাচ্ছে।
মানুষের এই ধরনের ইচ্ছাটাকে আমার শিল্পকলা বলে মনে হচ্ছে না একটুও। মনে হচ্ছে এক ধরনের বিকৃতি। মিকি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছে এসব। তার নিজেরও উল্কি আঁকতে ইচ্ছে করছে কিনা কে জানে।
শরীরের ত্বকে আঁকার পরেই মানুষ থেমে যাচ্ছে না। শরীরের নানা স্থানে ছিদ্রও করছে। নাক কান ছিদ্র করাটাকে আমাদের দেশেও খুব স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়া হয়। এখানে দেখা যাচ্ছে চোখের ভ্রু, গাল, ঠোঁট, জিহবাতেও ছিদ্র করে সেখানে অলংকার ব্যবহার করছে। একজন মেয়েকে দেখলাম নাভি আর স্তনের বোঁটায় ছিদ্র করে তাতে বড় বড় রিং লাগিয়ে রেখেছে।
বডি-আর্টের শেষ ভাগে রয়েছে শরীর বন্ধন। চায়নিজ মেয়েদের পা ছোট রাখার জন্য শক্ত করে বেঁধে রাখা হয় পা। এখানে সেই প্রদর্শনীর পাশাপাশি দেখানো হচ্ছে ফ্রান্স, জায়ার সহ আরো কয়েকটি অঞ্চলের মানুষের মাথার আয়তন ছোট রাখার জন্য মোটা মোটা দড়িতে মাথা বেঁধে রাখার ব্যবস্থা। মেয়েদের কোমর সরু রাখার জন্য শক্তভাবে কাপড় পেঁচিয়ে রাখা ইউরোপের আদি সংস্কৃতি। জাদুঘরের এই ‘বডি আর্ট’ প্রদর্শনীটা যতটা শিক্ষামূলক তার চেয়েও বেশি ব্যবসায়িক বলে মনে হলো আমার।
মিউজিয়ামের তিনতলা আর চারতলায় যা আছে তা অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সবগুলো মিউজিয়ামেই মোটামুটি একই রকম। মানুষের বিবর্তন, পশুপাখির নমুনা, সরীসৃপ থেকে শুরু করে ডায়নোসর পর্যন্ত। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের আদিবাসিদের ইতিহাস, প্রত্নতাত্ত্বিক শিলা ইত্যাদি।
একবার ঘুরে দেখার পরেই আমাদের কৌতুহল মিটে গেলো। বেরোবার মুখে গিফট শপের ভেতর কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ হাঁটলাম। সুন্দর একটা ঝর্ণার পাড়ে কালো পাথরের তৈরি একটা শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মিউজিয়ামের পাশেই কুইন্সল্যান্ড আর্ট সেন্টার। এখন পাঁচটা বেজে গেছে বলে ভেতরে ঢোকা গেলো না আজ। নদীর পাড়ঘেঁষে পানির ওপরে সরু কাঠের ব্রিজটার ওপর দিয়ে কিছুদূর হাঁটার পরেই পারর্ফমিং আর্ট সেন্টারের পাশে কনভেনশান এন্ড এক্সিবিশন সেন্টার, প্রিফিথ ইউনিভার্সিটির সিটি ক্যাম্পাস। তার পাশেই সাউথব্যাঙ্ক পার্কল্যান্ড। আধুনিক শহর, নদী। আর তার পাশেই হঠাৎ গভীর অরণ্য। মনে হচ্ছে যেন সিনেমার শুটিং স্পটে এসে পড়েছি, যেখানে সবকিছুই কৃত্রিম সুন্দর। আসল নকল এখানে একাকার।
শহরের কাছে কোন সৈকত না থাকাতে ব্রিসবেন সিটি-বিচটা তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিমভাবে। শিশুতোষ সমুদ্র সৈকত। বড় আয়তনের একটা পুকুরের মতো কৃত্রিম লেক। মিকির দেখি জায়গাটা খুব পছন্দের। নাকি পানি আর বালি দেখলেই সে চঞ্চল হয়ে ওঠে।
বললো, "হাউ নাইস!"
"কি, সাঁতার কাটবে?"
"সুইমিং স্যুট আনিনি তো।"
তার মানে সাঁতারের পোশাক নিয়ে এলে সে ঠিকই নেমে যেতো পানিতে।
নদীর পাড় ধরে হাঁটছি তো হাঁটছি। যত হাঁটছি তত ভালো লাগছে। নদীর পাড়ে স্বাভাবিক ক্লান্তি দূর করা বাতাস। অনেকে সাইকেলে চড়ে বেড়াচ্ছে। কিশোর কিশোরীরা রোলার স্কেটিং করছে। অফিস ফেরত চাকরিজীবীরা ফেরির জন্য অপেক্ষা করছে লাইন ধরে।
আঁকাবাঁকা নদীর পাড়ে স্থানে স্থানে বিভিন্ন ধরনের মেটালিক শিল্পকর্ম। শিল্পীর পরিচিতিও দেয়া আছে সাথে। এখানে আর্ট কলেজের নবীন শিল্পীদের বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা হয়। রাষ্ট্রসহ নানারকম প্রতিষ্ঠান পৃষ্ঠপোষকতা করে তাদের।
মিকির সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে বলতে চলেছি। সব কিছুতে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি। চোখ তো পড়ে অনেক কিছুতেই, কিন্তু দেখি আর কয়টা জিনিস? পা ধরে এসেছে একটু একটু। দুপুরের পর থেকে এ পর্যন্ত বসা হয়নি একটুও। ইচ্ছা করছে ঘাসের ওপর বসে পড়ি। কিন্তু মিকির যেন কোন ক্লান্তিই নেই। নাকি সেও মনে মনে বলছে আমি বসলে সেও একটু বসতে পারতো। আমরা কি নিজেদের অজান্তেই কোন না কোন প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ি?
ক্যাপ্টেন কুক ব্রিজের কাছে এসে থামলাম একটু। এখানে কুইন্স ল্যান্ড মেরিটাইম মিউজিয়াম। নৌবাহিনীর নানারকম জাহাজ আর সরঞ্জামের জাদুঘর। খুব বেশি মানুষজন দেখা যাচ্ছে না। জাদুঘর খোলা আছে তা বুঝতে পারছি। এই জাদুঘরের প্রতি মিকির কোন আগ্রহ নেই, আমারও নেই।
ক্যাপ্টেন কুক ব্রিজটা দারুণ সুন্দর। তবে ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে পার হওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। ব্রিজটা হাইওয়ে। সেখানে হাঁটতে গেলে জরিমানা দিতে হবে। ব্রিজের নিচ দিয়ে সাইকেল ট্র্যাক আর পায়ে চলা পথ। কিছুদূর যেতেই দেখা গেলো ডান পাশে খাড়া পাহাড় ভূমির সাথে প্রায় সমকোণে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের গায়ে কোন গাছপালা নেই। পাহাড়ের গোড়া থেকে প্রায় পাঁচ মিটার দূরে লোহার রেলিং দেয়া। দেখলাম অনেকে দড়ি ধরে খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে চেষ্টা করছে।
মিকি আগ্রহ ভরে দাঁড়িয়ে দেখছে। আমাদের দুজনকে একসাথে দাঁড়াতে দেখে দড়ি হাতে একজন এগিয়ে এলো আমাদের দিকে। মাথায় সেফটি হ্যাট, কোমরের মোটা বেল্ট থেকে ঝুলছে নানারকম যন্ত্রপাতি। বুঝলাম সে পেশাদার পর্বতারোহী। আমাদের প্রতি তার প্রশ্ন, "দেখবে নাকি চেষ্টা করে?"
আমার পাহাড়ে উঠার চেষ্টা করার তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। বিশেষ করে দড়ি বেয়ে। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই মিকি জ্ঞিজ্ঞেস করলো, "কত?"
"সিঙ্গেল পাঁচ ডলার, আর ডাবল ছয় ডলার।"
মিকি আমার দিকে তাকিয়ে বললো, "লেট্স ট্রাই।"
পর্বতারোহী এই উত্তরটাই আশা করছিলো। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে ছুটে গেলো খাড়া পাহাড়ের কাছে। চিৎকার করে দুর্বোধ্য কিছু শব্দ উচ্চারণ করলো। আমার মনে হলো আলিবাবার মতো চিচিং ফাঁক টাইপের কিছু বলছে। চিৎকারের ফলে পাহাড়ের গায়ে কোন গুপ্ত দরজা খুলে না গেলেও পাহাড়ের উপরে একটা মানুষের মুখ দেখা গেলো। পরক্ষণেই একটা লম্বা দড়ি নেমে এলো উপর থেকে।
পর্বতারোহীর নাম সম্ভবত জন। রেলিং-এ ছোট্ট একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে, ‘জন’স মাউন্টেন ক্লাইম্বিং’। জন আবার একটা উর্ধ্বমুখী চিৎকার দিলো। উপর থেকে আরো একটা দড়ি নেমে এলো নিচে। এবার জন এগিয়ে এলো আমাদের দিকে। বললো জুতো খুলে ফেলতে। তার বিশাল ব্যাগ থেকে দু’জোড়া জুতো বের করলো। আর দুটো প্লাস্টিকের সাদা হ্যাট। এখানে নির্মাণ শ্রমিকদের মাথায় এ ধরনের শক্ত হ্যাট দেখা যায়। পাহাড়ের উপর থেকে পাথর টাথর পড়ে মাথা ভেঙে যেতে পারে এই ভয়ে এই টুপি পরতে হয়।
আমাদের দিকে জুতো আর হ্যাট এগিয়ে দিয়ে বললো জন, "এগুলো পরে নাও।"
জুতোগুলো ফুটবল খেলার বুটের মতো, হালকা আর দাঁত বসানো। পর্বতারোহীদের এরকম জুতো সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিলো না আমার। কোমরে বেশ মোটা একটা বেল্ট পরিয়ে দিলো। বেল্টে নানারকম আঙটা লাগানো। একটু ভয় ভয় করলেও মোটামুটি আগ্রহ জন্মাচ্ছে, দেখা যাক না কী হয় টাইপের। মিকিতো উৎসাহে লাফাচ্ছে বাচ্চারা যেরকম নতুন জুতো পেলে তা পায়ে দিয়ে লাফায়।
এবার জন একটা দড়ি টেনে এনে মিকির কোমরের আঙটার সাথে বাঁধলো নানা কসরৎ করে। বললো, "বেল্টের পেছনে এই যে থলে দেখতে পাচ্ছো, এখানে পাউডার আছে। হাত পিচ্ছিল হয়ে গেলে এই পাউডার মাখবে। আর দুটো হাত কখনো একসাথে ছেড়ে দেবে না।"
এরকম উপদেশ দেবার সময় জনের গলাটা স্কুলের ড্রিল টিচারের মতো কর্কশ হয়ে যায়। আমার কোমরেও মিকির মতো করে অন্য দড়িটা বাঁধলো। মিকিকে পাহাড়ের দিকে এগোতে বলে আমার সামনে হাত পাতলো জন, "ছয় ডলার দাও।"
এতো দেখি কোমরে দড়ি দিয়ে টাকা আদায় করার মতো অবস্থা। মানিব্যাগ থেকে একটা দশ ডলারের নোট বের করে দিলাম জনের হাতে।
"চার ডলার যাবার সময় দেবো। এখন দিলে তোমার পকেট থেকে পড়ে যেতে পারে।"
মনে হচ্ছে বেঁধে মারার সব ব্যবস্থাই রেডি। পাহাড়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার উৎসাহটা ক্রমশ জমে যাচ্ছে। জন আমাদের দুজনের দড়ির অন্য মাথাদুটো একসাথে টেনে নিয়ে রেলিং এ ঠেস দিয়ে বসে বললো- "স্টার্ট"।
পাহাড়ের উপরে কোন আংটার সাথে দড়ির এক মাথা ঘুরে আমাদের কোমরে এসেছে। অন্য মাথা জনের কাছে। তার মানে আমরা এখন কপিকলে। পাহাড় বেয়ে উঠতে চেষ্টা করবো। পড়ে গেলে দড়িই ভরসা। প্রক্রিয়াটা বুঝতে পারার পরে বুকে একটু বল এলো। দড়ি যদি না ছিঁড়ে, পড়ে যাবার সম্ভাবনা নেই বললেও চলে। আর দড়ির স্পর্শেই বুঝতে পারছি সহজে ছিঁড়ে যাবার জিনিস এটা নয়।
মিকি তরতর করে উঠে গেলো কয়েক ফুট। আমিও চেষ্টা করলাম। প্রথম কয়েক ফুট উচ্চতায় পা রাখার আর হাতে ধরার বেশ ভালোই ব্যবস্থা আছে পাহাড়ের গায়ে। দেখলেই বোঝা যায় এটুকু উচ্চতা অনেকেই বা সবাই উঠতে পারে। হাত দিয়ে ধরে অনেক কষ্টে আরো কয়েক ফুট উঠলাম। তারপরেই শুরু হলো আমার হৃদকম্পন। হৃদয়ে ড্রাম পেটাচ্ছে। সাথে তাল মেলাচ্ছে আমার পা দুটো। দেশীয় বাজারে যারা তাবিজের খেলা দেখায় তাদের ভাড়া করা লোকও এভাবে কাঁপে না। মিকির দিকে তাকাতে পারছি না। মনে হচ্ছে কোনদিকে তাকানোর চেষ্টা করলেই পড়ে যাবো। বুঝতে পারছি মিকি আমার চেয়ে কয়েক ফুট উপরে উঠে থমকে আছে। সেও আর উঠতে পারছে না। নিচের দিকে চোখ পড়তে মনে হলো এখান থেকে সহজেই লাফ দেয়া যায়। কিন্তু দৃষ্টিভ্রমও হতে পারে আমার। কতদূর উঠেছি ঠিক বুঝতে পারছি না। মিকি আরো উপরে উঠার জন্য অবলম্বন খুঁজছে। এক পায়ে হাতড়াচ্ছে। সে কি আমার কাঁধে পা রাখতে চাচ্ছে নাকি? উপরের দিকে তাকিয়ে মনে হলো এই পাহাড় আকাশে গিয়ে মিশেছে। মাথা এখনো কার্যক্ষমতা হারায়নি। নিজেকে বোঝালাম এটা আসলে আইনস্টাইনের স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি। নিচ থেকে দেখলে আসলের চেয়ে লম্বা দেখায়।
আমি যে হারে ঘামছি মনে হচ্ছে শরীরের সব পানি বেরিয়ে আসছে রোমকূপ দিয়ে। কোমরের বেল্টে লাগানো খসখসে পাউডার এর মধ্যেই শেষ করে ফেলেছি। আর নড়তে পারছি না এক সেন্টিমিটারও। জনকে ডাক দিলেই হয়। কিন্তু কোন এক দুর্বোধ্য কারণে এখনো অপেক্ষা করছি মিকি কখন রণেভঙ্গ দেবে। মনে মনে রেগে যাচ্ছি মিকির ওপর। তার জন্যই আমার এই ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। কিন্তু পরক্ষণে নিজের ওপরই এসে পড়ছে সেই রাগ। কেন যে মেয়েটার সাথে মরতে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। আর পারছি না। কাঁপা গলায় ডাকলাম, "জন-"
মিকিও সাথে সাথে ডাক দিলো, "জন, আর পারছি না। নেমে যাবো।"
আমার আর তর সইছে না। কিন্তু জনের চোখে আমার চেয়েও মিকির গুরুত্ব বেশি। সে আমার দড়িটা রেলিং এর সাথে বেঁধে মিকিকে নামানোর ব্যবস্থা করছে। এসময় আমি লাফ দিলাম নাকি পড়ে গেলাম ঠিক বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম আমি শূন্যে ঝুলে আছি। ঝুলন্ত অবস্থাতেই দেখলাম মিকি হাসতে হাসতে দড়ি বেয়ে নেমে এলো।
জন আমার দিকে এখনো কোন মনোযোগ দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। সে ধীরেসুস্থে মিকির কোমর থেকে দড়ি খুলছে। জনের ব্যাটা জনকে খাঁটি বাংলায় কিছু গালাগালি করতে পারলে শান্তি পেতাম। কিন্তু ভদ্রলোকেরা ভদ্রতার দোহাই দিয়ে ইচ্ছেমতো কোন কাজই করতে পারে না। শূন্যে ঝুলন্ত অবস্থায় বিজ্ঞানীদের মতো ভাবতে চেষ্টা করলাম আমার দড়িটির টেনশান এখন কত হবে? আমার শরীরের ভরকে অভিকর্ষজ ত্বরণ দিয়ে গুণ করতে হবে তারপর ইত্যাদি।
অবশেষে জন সাহেবের সময় হলো। দড়ির অন্যমাথা খুলে দিতেই আমি নেমে গেলাম। মিকি ততক্ষণে তার জুতো পরে রেডি হয়ে গেছে। জন আমার কোমরের বেল্ট খুলে নিতেই মিকি ছুটে এলো আমার কাছে। জ্ঞিজ্ঞেস করলো, "হাউ ওয়াজ ইট?"
"ফ্যাবুলাস!"
কেন বললাম আমি নিজেও জানি না। জন আমাকে চার ডলার ফেরৎ দিয়ে বললো, "প্লিজ কাম এগেইন"।
জনকে ‘বাই’ বলে রেলিং গলে বেরিয়ে এলাম। দুই পা হাঁটার পরে মনে হলো হাঁটুর নিচের অংশ গলে যাচ্ছে আমার। আর এক পা ফেলার শক্তি আমার নেই। শুয়ে পড়লাম ঘাসের ওপর। আমার চোখের ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। কানে ঝি ঝি পোকার ডাক। মিকিও শুয়ে পড়লো আমার পাশে একেবারে গা ছোঁয়া দূরত্বে। তার শক্তিও যে আপাতত আর নেই তা বোঝা যাচ্ছে।
আকাশের দিকে তাকিয়েই সে বললো, "আমার খুব মজা লেগেছে জানো। তবে খুব টায়ার্ড হয়ে গেছি।"
"আমি তো এখান থেকে আর উঠতে পারবো বলে মনে হয় না মিকি।"
"মানুষ এভারেস্টে কীভাবে উঠে ভেবে দেখেছো?"
"না, আমি ছবিতে দেখেছি তারা কীভাবে উঠে। কিন্তু ভেবে দেখিনি।"
উত্তরে মিকি কী কী বলেছিলো আমার কিছু মনে নেই। আমি সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মিকির ডাকে চোখ খুলে দেখি অন্ধকার হয়ে গেছে। পাহাড়ের গোড়ায় উর্ধ্বমুখী লাইট জ্বলছে। বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমলে ব্রিসবেন শহরের ছায়া পড়েছে নদীর জলে। আর আমার পাশে ঘাসের ওপর বসে আমার মুখের দিকে ঝুঁকে আছে মিকি।
বেশ ঝরঝরে লাগছে আমার। ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে। উঠতে উঠতে বললাম, "সরি মিকি। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চলো যাওয়া যাক।"
ক্যাঙারু পয়েন্ট ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্টোরি ব্রিজে এসে পড়লাম। স্টোরি ব্রিজটা সিডনির হারবার ব্রিজের মতো পুরোটাই স্টিল ক্যান্টিলিভারের তৈরি। ব্রিজের দুপাশে প্রশস্ত ফুটপাত। একটা নোটিশ দেখলাম ২৫ জুন থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত ফুটপাথ বন্ধ থাকবে নির্মাণ কাজের জন্য। মিকি এটা দেখেও খুশি হয়ে গেলো, কারণ কয়েকদিন পর এলে আমরা এই ব্রিজের ওপর দিয়ে হাঁটতে পারতাম না।
স্টোরি ব্রিজ পার হয়ে সোজা একটু হাঁটলেই অ্যান স্ট্রিট। ব্রিসবেন সিটির আরেকটি প্রধান সড়ক। অ্যান স্ট্রিট ধরে সোজা হেঁটে জর্জ স্ট্রিট। শহর মোটামুটি চুপচাপ। রবিবারের রাতে যা হয়ে থাকে। পরদিন সকালেই কাজে যাবার তাড়া থাকে বলে রবিবার সন্ধ্যায় হৈচৈ খুব একটা থাকে না।
হোস্টেলে ফেরার পথে দুপুরের চায়নিজ রেস্তোরাটায় গেলাম আবার। এবার কিছুটা আয়ত্ত্বে এসে গেছে কোন্ খাবারটা কেমন এবং কীভাবে কতটা নিতে হয়।
হোস্টেলে ফিরে এসে দেখলাম বেশ জমজমাট অবস্থা এখন। টিভি রুমে অনেকে বসে অনুষ্ঠান দেখছে। কিচেনে রান্না করছে কেউ কেউ। আমি আর মিকি এখানে সময় না কাটিয়ে দোতলায় উঠে এলাম। পরস্পর ‘গুড নাইট’ বলে যে যার রুমে ঢুকে গেলাম।
সারাদিন প্রচুর ঘোরাঘুরি হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়তে দেরি হলো না। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো ফায়ার অ্যালার্মের শব্দে। কুইন্সল্যান্ডে যখন তখন আগুন লেগে যায়। আতঙ্কে ছটফট করতে করতে আমার ছোট্ট ব্যাগটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে। ব্যাগে আমার পাসপোর্ট আর ওয়ালেট আছে।
রুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম মিকির রুমের দরজা খোলা। নিচে কারো কোন সাড়া শব্দ নেই। অ্যালার্ম বেজেই চলেছে। ফায়ার এক্সিট দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে দেখি ঝাপসা অন্ধকারে সিঁড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে মিকি। আমাকে দেখতে পেয়ে বললো, "হাই!"
মিকির কথা জড়ানো। ভাবলাম কাঁচাঘুম থেকে উঠেছে বলেই হয়তো।
"হোয়াট হ্যাপেন?" নামতে নামতে জ্ঞিজ্ঞেস করলাম।
"সিগারেট ধরিয়েছিলাম রুমের মধ্যে। সাথে সাথে এলার্ম বেজে উঠেছে। ওটা যে এত সেন্সেটিভ আমার জানা ছিলো না।"
মিকির মুখে তীব্র এলকোহলের গন্ধ। শুধু সিগারেট নয়, মদও টেনেছে সে প্রচুর। ঘরের ভেতর সিগারেট খাওয়া নিষেধ জেনেও সিগারেট ধরিয়ে এখন অ্যালার্মের দোষ দিচ্ছে। সামান্য একটি ভুল থেকে এখানে যেরকম আগুন লাগে তা যদি মিকি জানতো।
মিকি আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে টলছে এখনো। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে আমার মুখের ওপর। মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার। ইচ্ছে করছে ঠাস করে একটা চড় কষাই তার গালে। কিন্তু সেরকম প্রতিক্রিয়া দেখানোর আমি কে? অ্যালার্ম থেমে গেছে। মিকির সাথে একটা কথাও না বলে ফিরে এলাম নিজের রুমে। আসার পথে দেখলাম টর্চলাইট হাতে সিকিউরিটি গার্ড ধোঁয়া বা আগুনের উৎস সন্ধান করছে।
বললাম, "কিছু পেলে?"
"কেউ হয়তো রান্না করতে গিয়ে পুড়িয়েছে কিছু। এ বাড়ির অ্যালার্ম বড় বেশি সেন্সেটিভ।"
বাংলাদেশে কিছু কিছু মানুষ রেগে গেলে কিছু কিছু ইংরেজি বলে। আর এই ইংরেজি বলা দেশে আমার মুখ থেকে বাংলা বেরিয়ে এলো-"তোমার মাথা, তোমার মুন্ডু!"
No comments:
Post a Comment