ব্রিসবেনে এসে যদি মুভি-ওয়ার্ল্ড, সি-ওয়ার্ল্ড বা ড্রিম-ওয়ার্ল্ডের কোন একটাও না দেখে ফিরে যাই তা হবে শতাব্দীর সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা। সুতরাং সকাল আটটা বাজতেই বেরিয়ে পড়লাম। মুভি ওয়ার্ল্ড দেখে দুঃখজনক ঘটনা ঘটার হাত থেকে শতাব্দীকে রক্ষা করতে হবে।
ট্রানজিট সেন্টারের তিনতলায় গোল্ডকোস্ট যাবার বাস। সরাসরি মুভিওয়ার্ল্ড যাওয়া যায় এখান থেকে। সম্প্রতি ব্রিসবেন এয়ারপোর্ট থেকে গোল্ডকোস্ট পর্যন্ত একটা নতুন ট্রেন চালু হয়েছে। স্কাই ট্রেন। এই ট্রেনটি চলে মাটি থেকে অনেক উপর দিয়ে। না, উড়ে চলে না, একটা আলাদা ব্রিজের ওপর দিয়ে যায়। ব্রিসবেন এয়ারপোর্ট থেকে গোলকোস্ট পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটার লম্বা একটা রেলব্রিজ তৈরি করে ফেলেছে এরা। তবে শুধুমাত্র এই ব্রিজটা দেখার জন্য এয়ারপোর্টে যেতে ইচ্ছে করলো না।
গোল্ডকোস্টের বাসে চেপে বসলাম। এখান থেকে মুভিওয়ার্ল্ড পর্যন্ত ভাড়া ১২ ডলার। এই পথ দিয়ে এসেছি কয়েকদিন আগে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে বাস এসে থামলো ড্রিমওয়ার্ল্ডের গেটে। গোল্ডকোস্টের তিনটি বিখ্যাত থিম-পার্কের একটি এই ড্রিমওয়ার্ল্ড- স্বপ্নজগৎ।
বাস থেকেই দেখা যাচ্ছে প্রায় চল্লিশ মিটার উঁচু একটা স্তম্ভে তীব্রবেগে খাড়া উপরে উঠে যাচ্ছে একটি বড় অ্যালিভেটর। অনেক মানুষের মাথা দেখা যাচ্ছে সেখানে। স্তম্ভের মাথায় উঠে অ্যালিভেটর থামলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর ধাম করে নিচে পড়ে গেলো। পড়ে গেলো মানে তীব্রবেগে নিচে নেমে এলো। পতনের সময় অভিকর্ষজ ত্বরণের কারণে শরীরে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হবে। এরকম তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী খেলায় অংশ নিতে মানুষ আসে এখানে।
বাসের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে অ্যালিভেটরের মানুষগুলোর হা করা মুখ। চিৎকার করছে সবাই। এই চিৎকারে ভয়ের চেয়েও মজা বেশি নিশ্চয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের বাস এসে পৌঁছালো মুভিওয়ার্ল্ডের প্রবেশ পথে। হলিউডের ইউনিভার্সাল স্টুডিওর আদলে নির্মিত এই মুভিওয়ার্ল্ডকে বলা হয় হলিউড ইন অস্ট্রেলিয়া।
গোল্ডকোস্টের মূল সড়ক থেকে পশ্চিম দিকে অনেকটুকু ভেতরে এই বিশাল স্বর্গরাজ্য। সামনে পার্কিং এলাকায় কমপক্ষে পাঁচ হাজার গাড়ি একসাথে পার্ক করা যায়। বাস থেকে নামলেই সামনে পড়ে টিকেট কাউন্টার। মুভিওয়ার্ল্ডের মূল গেটের সমান্তরালে মোট চৌদ্দটি কাউন্টার এখানে।
প্রবেশ মুল্য ৫২ ডলার। ৬৫ বছরের বেশি ও ১৫ বছরের কম বয়সীদের জন্য ৩৩ ডলার। আর কোন ধরনের কনসেশান নেই। একটি মাত্র টিকেটেই ভেতরের সব শো’র প্রবেশাধিকার পাওয়া যাবে। ভেতরে আর কোন কিছুর জন্যই টিকেট কাটতে হবে না। ভেতরে যত আকর্ষণ আছে সব কিছুর জন্য পয়সা দিয়ে ঢুকে ভেতরে গিয়ে তা যদি দেখতে ইচ্ছা না করে বা দেখার সময় না থাকে, তাহলেও কিছু করার নেই। এখানে আমার একার পক্ষে ৫২ ডলার হয়তো তবুও সহনীয়, কিন্তু যাদের ছেলেমেয়েসহ চার পাঁচজনের পরিবার, তাদের জন্য এ ধরনের একটা বাজেট করতে গায়ে লাগে। আমাদের মতো দরিদ্র দেশের মানুষ এখানে তাই দেখা যায় না বললেই চলে। তাছাড়া এ ধরনের পার্কে যারা আসে, তারাও হয়তো কয়েক বছরে একবার আসে।
মুভিওয়ার্ল্ড এ বছর তার দশ বছরপূর্তি উৎসব করছে। তাই সাজগোজের আড়ম্বর একটু বেশি। গেট চেকিং পার হয়ে ঢুকলাম ভেতরে। টিকেটের সাথে গাইড ম্যাপ দেয়া আছে। ছোটবড় সব মিলিয়ে ৬০টি দর্শনীয় আইটেম। তাছাড়া আরো অনেক বিশেষ বিশেষ প্রদর্শনী। সুতরাং বেশ একটা তাড়াহুড়োর ভাব এসে গেলো মনে। যদিও সকাল মাত্র দশটা এখন।
ভেতরে কোথাও অস্ট্রেলিয়ার চিহ্ন পর্যন্ত নেই এখানে। সব ভবনে উড়ছে আমেরিকার পতাকা, রাস্তার নামগুলো পর্যন্ত আমেরিকার বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের নামে। দোকানগুলোর সাজসজ্জাও যেন সরাসরি আমেরিকা থেকে তুলে আনা হয়েছে।
ওয়ার্নার ব্রাদার্সের লোগো আঁকা মুভিওয়ার্ল্ডের সুদৃশ্য গেটটা পেরোঁলে সামনের গোলাকার চত্বরে সুদৃশ্য ঝর্ণা। ঝর্ণা থেকে একটু দূরে গাঁদা ফুলের হলুদ বাগান।
ডানদিকের রাস্তা ধরে কিছুদূর যাবার পর রাস্তায় একটি ১৯৩০ মডেলের হলুদ কার। তারপাশে রক্সি থিয়েটার। এখানে থ্রি-ডাইমেনশানাল সিনেমা দেখানো হচ্ছে। রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন সুভেনির শপ। কার্টুন আঁকা নানারকমের খেলনা আর পোশাকের সমারোহ। একটু পরপর ফিল্ম আর ক্যামেরার দোকান। আর আছে বিচিত্র সব খাবারের দোকান।
এখানের খাবার আর পানীয়ের মূল্য সম্পর্কে কোন মন্তব্য না করাই ভালো। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ৬৬০ মিলিলিটারের এক বোতল কোকের দাম বাইরে এক ডলার আশি সেন্ট। সেই একই পরিমাণ কোক একটি কার্টুন আঁকা মুভিওয়ার্ল্ড ছাপ মারা বোতলে নয় ডলার। অন্যান্য সবকিছুই এই অনুপাতে অনুমেয়। তাই বলে বিক্রি কিন্তু কম নয় এখানে। কারণ কোন ধরনের খাবার বা পানীয় নিয়ে ঢুকতে দেয়া হয় না এখানে। সুতরাং খাবার বা পানীয় এখান থেকে কিনতে অনেকটা বাধ্য করা হচ্ছে। তাছাড়া এ সমস্ত জায়গায় মানুষ প্রতিদিন আসে না। বছরে হঠাৎ এসে হঠাৎ খুব উদার হয়ে যায়। অনেক মা বাবা দেখা যাচ্ছে নিজেরা না খেলেও ছেলেমেয়েদের কিনে দিচ্ছেন।
রাস্তায় নানা রকমের কার্টুন চরিত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। মিকিমাউস, লুনি টুনস প্রভৃতি সব বিখ্যাত কার্টুনের সাথে ছবি তোলার জন্য শিশুকিশোররা ঘিরে ধরছে। এই চরিত্রগুলোর পোশাকের নিচে যারা আছে তাদের চাকরিই হলো এটা। তারা দর্শকের কাঁধে বা হাতে হাত রেখে ছবির জন্য পোজ দিচ্ছে।
আর একটু সামনে গিয়ে দেখলাম শুধু কার্টুন নয়, সিনেমার মানুষ চরিত্রগুলোও ছবি তোলার জন্য পোজ দিচ্ছে এখানে। সিনেমার চরিত্রের মতো পোশাক, মেক আপ, গেট আপ নেয়া মানুষ। বিশেষ বিশেষ পোশাকের কারণে তাদের চেহারার খুব একটা প্রাধান্য পায় না এখানে, যেমন ব্যাটম্যান, সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান।
পার্কের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে হলিউডের ওয়েস্টার্ন ছবির অংশ। এই অংশের নাম ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট। পুরো এলাকাটা যেন ওয়েস্টার্ন ছবি থেকে সরাসরি তুলে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে এখানে। একটা জায়গায় হারিকেন ঝুলছে। ঘোড়ার আস্তাবল দেখা যাচ্ছে। রাস্তায় পুরনো ইট বসানো। কাঠের তৈরি ঘরবাড়ি। হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে গুলি ছুড়বে কোন কাউবয়।
এই অংশের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট অ্যাডভেঞ্চার রাইড। এই রাইডে অংশ নেয়ার জন্য ওয়েস্টার্ন সিনেমার নায়ক বা ভিলেনের মতো হিম্মত থাকা চাই। দেখতে ভাঙাচোরা একটি নৌকায় চড়ে রওনা হয়ে একটা পাহাড়ে ঢুকতে দেখা যায় বাইরে থেকে। তারপর কিছুক্ষণ পরে সেই নৌকাকে বেরিয়ে আছড়ে পড়তে দেখি পাহাড়ের চূড়ো থেকে সোজা পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে নিচের পানিতে। আরোহীরা ভিজে যায়। গেটে ঢোকার সময় সবকিছুর জন্য পয়সা না নিয়ে নিলে এখানে এই অংশটার টিকেট খুব একটা বিক্রি হতো বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু যেহেতু পয়সা দিয়েই ঢুকেছি সবকিছু না দেখে গেলে ঠকে যাবো না? কেউ যদি ভিজতে না চায়, তিন ডলার নিয়ে একটা প্লাস্টিক কোট কিনে নিতে পারে এখানে।
একটা স্যাঁতস্যাঁতে দেখতে কয়লার গুদামের ভেতর দিয়ে ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট অ্যাডভেঞ্চারের প্রবেশ পথ। একজন দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে পিঠে এক নলা এক জং ধরা বন্দুক ঝুলিয়ে। হলিউডের সিনেমা থেকে সে সোজা চলে এসেছে এই স্যাঁতস্যাঁতে কয়লার গুদাম পাহারা দেবার জন্য। এরা কি সকালে মেক আপ নেয়, নাকি চাকরির প্রয়োজনে স্থায়ীভাবেই এরকম হয়ে গেছে জানার উপায় নেই। অভিনেতা টাইপের এই মানুষগুলো মূর্তি না হলেও মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতেই পছন্দ করে বেশি।
ছোট ছোট নৌকাগুলোতে ছ'জনের বসার ব্যবস্থা। পানির গভীরতা দু’হাতের বেশি হবে না এখানে। পানির নিচে একটা পুরু বেল্ট যে পানির স্রোত নিয়ন্ত্রণ করছে তা বোঝা যাচ্ছে। নৌকায় উঠার মুখে হৃদপিন্ডের অবস্থা ও রক্তচাপ সম্পর্কে কিছু সতর্কবাণী দেয়া আছে। দুর্বল হৃদপিন্ড আর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে এখানে প্রবেশ নিষেধ।
নৌকায় কোন ইঞ্জিন বা দাঁড় নেই। বেল্টের টানেই ভেসে চলছে নৌকা। আস্তে আস্তে পাহাড়ের নিচে প্রবেশপথ দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো নৌকা। বিচিত্র শব্দ চারদিকে। ভূত-প্রেতের যে সমস্ত সংস্করণ সিনেমা বা বইতে পাওয়া যায় এবং চট্টগ্রামের শিশুপার্কের ট্রেনে চড়ার সময়েও যেরকম কিছু গুহাভূত দেখা যায় সেরকম কিছু চরিত্র এখানেও ভয় দেখানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলো। কয়েকটা ড্রাকুলাও দেখা গেলো লম্বা লম্বা দাঁত ও নখ দেখিয়ে গেলো।
আমার সহযাত্রীদের চিৎকার ড্রাকুলার চিৎকারকেও হার মানাচ্ছে। আমার পাশে বসা কিশোরী চায়নিজ মেয়েটা যে কিনা নৌকায় উঠার সময় তার মায়ের ভয় পাওয়া দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিলো- এখন আধো অন্ধকারে আমাকেই জাপটে ধরে আমার পিঠে মুখ গুঁজে আছে।
ভূত-প্রেত পেরিয়ে নৌকা হেলতে দুলতে এগোচ্ছে একটা ট্রেন স্টেশনের পাশ দিয়ে। স্টেশনের ওয়াগন ভ্যানে ডাকাতি হচ্ছে। গোলাগুলির প্রচন্ড শব্দ ধোঁয়া চারদিকে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে গুলি এসে লাগতে পারে। আমি বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে বাস্তব গোলাগুলির মাঝখানে ছুটে পালিয়ে বেঁচেছি অনেকবার। সুতরাং এখানে ভয় পাবার কথা নয়। কিন্তু এদের নিখুঁত কারিগরি দক্ষতার প্রশংসা করতেই হয়।
হঠাৎ প্রবল বিস্ফোরণের শব্দ। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারদিক। পানির প্রবল টানে এগোচ্ছে নৌকা। একটা দরজা খুলে গেলো সশব্দে। কী হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই নৌকা সহ ছিটকে পড়েছি প্রায় বিশ ফুট নিচের পানিতে। জামা-কাপড় ভিজে একাকার।
ঝকঝকে রোদ আর আর্দ্রতাবিহীন বাতাসে বেশিক্ষণ লাগলো না জামাকাপড় শুকোতে। আস্তে আস্ত গিয়ে বসলাম পুলিশ অ্যাকাডেমির স্টান্ট শো দেখতে।
আমেরিকার অ্যাকশান সিনেমায় পুলিশের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাফ এন্ড টাফ পুলিশ অফিসার হিসেবে ডার্টি হ্যারি একটা বিখ্যাত চরিত্র। বদরাগী এই পুলিশ অফিসারটির হাত থেকে কোন অপরাধীরই রেহাই নেই। এখানে ডার্টি হ্যারির নামে একটা মদের দোকানও আছে।
ছোটখাটো একটা স্টেডিয়ামের গ্যালারির সাইজের গ্যালারিতে দর্শকের বসার ব্যবস্থা। সামনে দেখা যাচ্ছে আমেরিকার পুলিশ একাডেমি বিল্ডিং। মনে হচ্ছে আমরা সত্যি সত্যি বসে আছি লস অ্যাঞ্জেলেসের কোন পুলিশ একাডেমির সামনে। ডান পাশে গাড়ির মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ। এল-এ-পি-ডি লেখা পুলিশের কয়েকটি গাড়ি আর মোটর সাইকেল সেখানে। বাম পাশে পুলিশের নতুন সদস্যদের উদ্দেশ্যে কিছু উপদেশবাণী ইত্যাদি যা যা থাকে পুলিশ একাডেমিতে তার বাস্তব সম্মত স্থায়ী সেট।
আমেরিকান পুলিশের পোশাকে একজন মেয়ে দর্শকদের বসতে সাহায্য করছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নানা রকম কৌতুকও করছে সে। যে দর্শক সামনের সারিতে বসতে চাচ্ছে তাকে সে পাঠিয়ে দিচ্ছে একদম পিছনের সারিতে। কোন কোন যুগলকে করে দিচ্ছে আলাদা। দর্শকরা হো হো করে হাসছে। বিশেষ করে যখন ট্যুরিস্টরা এই পুলিশের আচরণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাচ্ছে শুরুতে, তখন হাসিতে ফেটে পড়ছে অন্য দর্শকরা। এখানকার দর্শক মনে হচ্ছে হাসি আর হাততালি দেয়ার ব্যাপারে ভীষণ উদার। এ দুটো ব্যাপারে তাদের কোন কার্পণ্য নেই।
এগারোটায় শো শুরু হবার কথা। দেখা গেলো তার আগেই আরেকজন মেয়ে পুলিশ একাডেমির প্রধান দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে দর্শকদের গ্যালারিতে উঠে এলো। সেখানে দেখা গেলো অন্য একজন পুরুষ পুলিশ দাঁড়িয়ে। এই পুরুষ পুলিশের মেক আপ, বাচনভঙ্গি সবকিছু ডার্টি হ্যারি চরিত্রের স্রষ্টা ক্লিন্ট ইস্টউডের সরাসরি অনুকরণ।
এই নকল হ্যারি দর্শকদের মাঝ থেকে পাঁচজন নতুন পুলিশ নিয়োগ করলো আজকের এই শো’র জন্য। দু’জন ছেলে আর দু’জন মেয়ে সদস্য নেয়া হলো গ্যালারির চার কোণা থেকে। গ্যালারির একদম সামনের সারিতে নিয়ে তাদের বসানো হলো। পঞ্চম জন হিসেবে যাকে নির্বাচন করা হলো সে ছেলেটা কিছুতেই রাজি হয় না পুলিশ হতে। কিন্তু হ্যারি তাকে রাজি করাবেই। ছেলেটার পোশাক আর হাবভাব দেখে মনে হয় খুব হাবাগোবা ধরনের। বাংলাদেশের পুরোনো সিনেমাতে হাসমতকে দেখতে যেরকম লাগতো এই ছেলেটাকেও অনেকটাও সেরকম লাগছে। কিন্তু তার বুদ্ধি আর তাৎক্ষণিক প্রত্যুত্তর দেখে কেমন যেন খটকা লাগে। মনে হয় এগুলোও নিশ্চয় শো-এর স্ক্রিপ্টের অংশ আর ছেলেটা তাদেরই লোক। শেষ পর্যন্ত ছেলেটা বাধ্য হলো বাকি চারজনের শামিল হতে। পুলিশের টুপি আর সাদা দস্তানা পরিয়ে তাদের মূল মঞ্চে অর্থাৎ বিশাল একাডেমির সামনের খালি জায়গায় বিচ্ছিন্ন স্থানে বসিয়ে দেয়া হলো।
ঠিক এগারোটায় মূল শো শুরু হলো। অ্যাকশান আর কৌতুক হলো শো’র মূল আকর্ষণ। সিনেমাতে যেসব লোমহর্ষক দৃশ্য দেখা যায় তা চোখের সামনে ঘটিয়ে দেখানো হলো। গোলাগুলি, বোমাবাজি, গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট, হেলিকপ্টার ধ্বংস সব। ছোট্ট একটা জায়গায় প্রচন্ড বেগে গাড়ি চালানো, মোটরসাইকেল বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া, কামানের গোলা মেরে মানুষসহ একটা পুলিশবক্স উড়িয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা।
একাডেমির ছাদে বিধ্বস্ত হয় একটা হেলিকপ্টার। আগুন আর ধোঁয়ায় ভরে যায় চারদিক। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নিয়ন্ত্রিত অথচ ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটতে থাকে একের পর এক এবং অনেক সময় অনেক ঘটনা একসাথে। চোখের সামনে পুরো ১৮০ ডিগ্রি কোণে অনেকগুলো অ্যাকশান একসাথে চলার ফলে সবগুলোকে সমান মনোযোগ দেয়াও যায় না। এটাও বাস্তব দিকের একটা প্রতিফলন। বাস্তব জগতে আমাদের চোখের সামনে ঘটা ঘটনারও সবটুকু অংশ আমরা সমান মনোযোগ দিয়ে দেখতে পারি না।
দর্শকদের মধ্য থেকে নেয়া হাবাগোবা ছেলেটি পুরো শো’তে যে ভূমিকা রাখলো তাতে আর সন্দেহ থাকে না যে এই লোক তাদেরই একজন। যে সমস্ত অ্যাকশান দেখানো হয়েছে সবগুলোই বিপজ্জনক। একটু এদিকে ওদিকে হলেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আছে। সে কারণেই হয়তো মুভিওয়ার্ল্ডে রয়েছে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা। শক্তিশালী মেডিকেল টিম। দুটো হেলিকপ্টার অ্যাম্বুলেন্স সবসময় রেডি।
পঁচিশ মিনিটের পুলিশ অ্যাকশান শেষে ১১টা ৩৫ মিনিটে মূল রাস্তায় স্টার প্যারেড। মুভিওয়ার্ল্ডে যত স্টার আছে সবাইকে নিয়ে প্যারেড। কার্টুন চরিত্রগুলোর পেছনে ব্যাটম্যানের কালো রঙের বিশেষ গাড়িতে ব্যাটম্যান ও তার সঙ্গিনী। তাদের পেছনে সুপারম্যান, সুপার ওম্যান, ১৯৬০ মডেলের একটি মার্সিডিজ ও মেরিলিন মনরোর সাজে একটি মেয়ে এবং আরো অনেকে। মোটর সাইকেলে পুলিশ সদস্যদেরও দেখা গেলো এই প্যারেডে।
প্যারেড শেষে স্টারদের সাথে লাঞ্চের ব্যবস্থা। লাঞ্চের খরচ অবশ্য যারটা তার। মুভি ওয়ার্ল্ডের নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্টে স্টাররা ঘুরে ঘুরে এসে বসবে লাঞ্চ টেবিলে। ছবিতে হাসিমুখে পোজ দেবে। অভিনেতা অভিনেত্রীদের সাথে নিজের থাকাটা অনেকের কাছেই চাট্টিখানি কথা নয়। মেরিলিন মনরোর মতো করে সাজগোছ করে নিজেকে মেরিলিন মনরো ভাবছে যে মেয়েটি তার সাথে ছবি তোলার জন্য মানুষের ব্যস্ততা দেখলে আশ্চর্য লাগে। এখানে আসলে উদার হবার সাথে সাথে মানুষ কি একটু পাগলও হয়ে যায়? অবশ্য পর্দার মানুষের প্রতি মানুষের একটা উন্মাদনা কাজ করে সব দেশেই।
এবার চললাম ম্যাভারিক শো দেখতে। ম্যাজিক অব দি ওয়েস্ট। ওয়েস্টার্ন ম্যাজিক। বিশাল হলে এই লাইভ ম্যাজিক শো। হলের ভেতরটাও রাফ এন্ড টাফ স্টাইলে তৈরি। বিরাট মঞ্চে ওয়েস্টার্ন স্টাইলের ঘরবাড়ি, একপাশে বিশাল নোঙর সহ একটি খেয়াঘাট দেখা যাচ্ছে। একটি গোডাউনের বিশাল গেট। তার পাশে বিরাট এক কাঠের পিঁপে। এগুলো সাধারণত মদের পিপে হিসেবে ব্যবহৃত হতো আগের দিনে।
শো শুরুর আগপর্যন্ত দর্শকদের জন্য বোনাস বিনোদন ক্লাউন শো। এই ক্লাউনটা ভালো মুকাভিনয় করে। নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে দর্শকদের হাসালো কিছুক্ষণ। নাক উঁচু কিছু দর্শক বিরক্তও হলেন ক্লাউনের ভাঁড়ামিতে।
এই শো’কে বলা চলে ২৫ মিনিটের একটা হলিউডি মারদাঙ্গা মার্কা ওয়েস্টার্ন সিনেমার মঞ্চ রূপায়ন। কারিগরি দক্ষতা এতটাই নিপুণ যে চোখের সামনে ঘটলেও ঘটনাগুলো কিভাবে ঘটছে ঠিক বোঝা যায় না। ম্যাজিকে যা ঘটে আর কি।
মদের পিঁপেতে গুলি লেগে পিঁপে থেকে পানি হোক আর মদই হোক তীব্রবেগে বেরিয়ে এসে মঞ্চের উপর একটা গর্তে পড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। মঞ্চের মাটি ভেদ করে উঠে আসছে রেড ইন্ডিয়ান। আবার ছোট্ট একটা টিনের ভেতর ঢুকে অদৃশ্যও হয়ে যাচ্ছে। স্পেশাল ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়েছে প্রতি পদে পদে। কিন্তু শো-এর কোথাও তা ব্যাখ্যা করা হয়নি। ব্যাখার জন্য আলাদা শো’র ব্যবস্থা আছে অন্য জায়গায়।
এখান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাঁটলাম কিছুক্ষণ। দু’পাশেই রঙ বেরঙের জমকালো সব দোকানপাট। দু’হাতে নিজের পকেট আগলে ঢুঁ মারলাম কয়েকটাতে। পকেটমার নেই এখানে। কিন্তু বাহারী সামগ্রীগুলোর আবেদন উপেক্ষা করার মতো বুকের পাটা পকেটে পয়সা থাকলে থাকে না।
মুভিওয়ার্ল্ডের অভ্যন্তরীণ হিসাব দপ্তরের নাম এখানে আমেরিকান চেম্বার হাউজ। হঠাৎ মনে হয় যেন নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটের কোন বিল্ডিং।
দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে মুভি ম্যাজিক স্পেশাল ইফেক্ট। শো দেখতে গেলাম। পাশাপাশি তিনটি ইনডোর স্টুডিওতে দেখানো হচ্ছে সিনেমায় বিভিন্ন কারিগরী কৌশল কীভাবে ব্যবহার করা হয়। দর্শকদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে বাছাই করা হলো বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করার জন্য। একজন সুপারম্যান, একজন নায়িকা, একজন ছোট বিমান পাইলট এবং তিনজন শব্দ গ্রাহক বাছাই করা হলো। যিনি দর্শকদের মধ্য থেকে এদের নির্বাচন করলেন তিনি নিজেকে বললেন পরিচালক। ব্যাখ্যা করলেন সিনেমায় কীভাবে লোক নির্বাচন করা হয়, নেপথ্য শিল্পীদের কার কী ভূমিকা।
প্রথম স্টুডিওতে দেখানো হলো বিশেষ দৃশ্যগুলো কীভাবে চিত্রায়িত হয়। সিনেমাতে ব্লু স্ক্রিন ইফেক্টের প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি। পর্দায় এ সম্পর্কে ছোট্ট একটা ভূমিকা দিলেন র্যা ম্বো নায়ক সিলভারস্টন স্ট্যালোন। তিনি দেখালেন স্টুডিওতে মোটর সাইকেলের উপর বসে থেকেই পেছনে পাহাড় পর্বত ট্রেনে ইত্যাদির প্রতিফলনের মাধ্যমে দেখানো হয়- মোটরসাইকেল উঠে যাচ্ছে পাহাড়ে, লাফ দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে ছোট নদী বা ছুটছে ট্রেনের ছাদের ওপর দিয়ে।
সিনেমার পর্দায় মাঝে মাঝে দেখা যায় উঁচু বিল্ডিং-এর ছাদের কার্নিশ ধরে হাঁটছে নায়িকা, হয়তো তাকে কেউ তাড়া করেছে বা মনের দুঃখে আত্মহত্যা করতে চাচ্ছে সে। যে কোন মুহূর্তে নিচে পড়ে যেতে পারে সে। রাস্তায় অনেক মানুষ জমে গেছে। রুদ্ধশ্বাসে দেখছে এই দৃশ্য।
এরকম একটা দৃশ্য আমাদের সামনে গ্রহণ করা হলো স্টুডিওর ভেতরেই। দর্শকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত নায়িকাকে মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। ছোট মঞ্চটির পেছনের দুদিকে দেয়াল। বাম পাশের দেয়ালে একটি সিঁড়ি লাগানো। মঞ্চের উপরে বড় একটা পর্দায় ছবি প্রতিফলিত হচ্ছে।
ক্যামেরা চালু করতেই পর্দায় দেখা গেলো আমাদের নায়িকা আটতলা একটি বিল্ডিং-এর ছাদের কার্নিশে লোহার সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। নিচে হাজারো মানুষ, পুলিশ দমকলের গাড়ি ইত্যাদি। পরিচালক নায়িকাকে নির্দেশ দিলেন লোহার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে। নায়িকা কয়েক ধাপ উঠার পরেই সিঁড়িটির উপরের দিকটা দেয়াল থেকে আলগা হয়ে গেলো একটুখানি। এই ব্যাপারটাই পর্দায় দেখা গেলো সিঁড়িটির একমাথা ধরে শূন্যে ঝুলে আছে আমাদের নায়িকা। সিনেমার দৃশ্যের সাথে এখানকার দৃশ্যের পার্থক্য হলো আমাদের নায়িকাটির চোখে মুখে ভয় আর উৎকন্ঠার পরিবর্তে এক গাল হাসি।
এবার সুপারম্যান পর্ব। সদ্য নির্বাচিত সুপারম্যানকে পর্দার সুপারম্যানের লাল হলুদ পোশাকটা পরিয়ে দেয়া হয়েছে। মঞ্চের মাঝখানে একটা দাগ দেয়া স্থানে তাকে দাঁড় করানো হলো। একদিকের একটা স্ট্যান্ড ফ্যানের বাতাসে সুপারম্যানের পোশাক উড়ছে পত পত করে। পর্দায় দেখা গেলো আমাদের সুপারম্যান ব্রিসবেন শহরের উপরে উড়ে বেড়াচ্ছে। পরিচালকের নির্দেশে হাত দুটো সাঁতারের ভঙ্গিতে নাড়াতেই দেখা গেলো সুপারম্যান উড়ে আসছে মুভিওয়ার্ল্ডের দিকে।
এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো সাউন্ড রেকর্ডিং স্টুডিওতে। সিনেমাতে কুশীলবরা শুটিং-এর সময় সংলাপ বলেন ঠিকই। কিন্তু সেই শব্দ রেকর্ড করা হয় না সেসময়। পরে এক সময় স্টুডিওতে বসে শব্দ গ্রহণ করা হয়।
সংলাপ ছাড়াও ছবিতে হাজার হাজার অন্যান্য শব্দ থাকে-যা শুটিং-এর পরে স্টুডিওতে বসে যোগ করা হয়। আজ দেখানো হলো মেল গিবসনের বিখ্যাত অ্যাকশান সিনেমা লিথ্যাল ওয়েপনের একটা দৃশ্য। শুরুতে মেল গিবসন মুভিওয়ার্ল্ডের পক্ষ থেকে আমাদের স্বাগতম জানালেন। শব্দগ্রহণ সম্পর্কে কয়েকটি কথা বললেন তিনি। তারপরে ছবির দু’মিনিটের একটা দৃশ্য দেখানো হলো।
দু’মিনিটের এই দৃশ্যে সংলাপ ছাড়াও দরজা নক করা, দরজা খোলা, খাবারের ট্রে উল্টানো, জানালার কাচভাঙ্গা এবং অনেক উপর থেকে দু’জন মানুষের সুইমিং পুলে ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দসহ মোট চব্বিশ রকমের শব্দ ধারণ করা হয়েছে।
দর্শকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত শব্দগ্রাহক তিনজনকে এবার দায়িত্ব দেয়া হলো দু'মিনিটের এই অংশটার শব্দগুলো আবার ধারণ করতে। প্রত্যেককে আটটি করে শব্দের সিকোয়েন্স দেখিয়ে দেয়া হলো। পর্দায় দু’মিনিটের দৃশ্যটি আবার দেখানো হলো। এবার শব্দহীন। শব্দগ্রাহকদের টেবিলের সামনে রক্ষিত টিভি পর্দায় সিকোয়েন্সগুলি দেখা গেলো, এক, দুই, তিন করে ২৪ পর্যন্ত। নম্বার অনুযায়ী শব্দ তৈরি করতে হবে।
শব্দ তৈরির উপাদানগুলো অতি সাধারণ। একটা দুই ফুট বাই দুই ফুট কাঠের উপর লাগানো আছে দরজার লক, দরজার হুক। এই কাঠে টোকা দিয়ে তৈরি করতে হবে দরজার লকিং, হুক ঘুরিয়ে এবং লকে চাবি ঢুকিয়ে শব্দ তৈরি করতে হবে। একটা ছোট কাঠ লাগানো আছে টেবিলের সাথে কব্জা দিকে। এদিক ওদিক নাড়ালে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হয়। যেন দরজা খোলার শব্দ। একটি টিনের বাক্সের ভেতর রাখা আছে ভাঙা কাচের টুকরো। বাক্সের ঝাঁকুনি দিলে অবিকল কাচ ভাঙার শব্দ। বড় একটি পাত্রে কিছু পানি। তাতে প্লাস্টিকের একটা বড় খাঁচা ফেললেই তৈরি হবে পানিতে ঝাঁপ দেয়ার শব্দ।
নবীন শব্দগ্রাহকরা তৈরি। পর্দায় শব্দহীন ছবিটি চালানোর সাথে সাথে সিকোয়েন্স অনুযায়ী শব্দ তৈরি করতে লাগলো তারা এবং তাদের তৈরি শব্দগুলো সাথে সাথে রেকর্ড করা হচ্ছে রেকর্ডারে। শব্দগ্রহণ শেষ হলো।
এবার সবচেয়ে মজার অংশ। নতুন শব্দ সম্বলিত দৃশ্যটা দেখানো হলো। দেখা গেলো দরজা খোলার পরে দরজায় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। নায়ক জানালার দিকে এগিয়ে যাবার আগেই জানালা ভাঙার শব্দ। আর পানিতে ঝপাস শব্দ হলো যখন ততোক্ষণে সুইমিং পুলের পানি শান্ত হয়ে গেছে, নায়ক হাঁপাচ্ছে।
_________________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ছবিগুলো আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি।
No comments:
Post a Comment