Thursday, 31 January 2019

আমাদের নাসির ভাই




আমার কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল বি এ এফ শাহীন কলেজ চট্টগ্রামে। ১৯৯৩ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৯৮ সালের জুন পর্যন্ত চার বছর সাত মাস আমার কেটেছে শাহীন কলেজের শিক্ষার্থী ও সহকর্মী শিক্ষকদের সান্নিধ্যে। শাহীন কলেজে যোগ দিয়েছি যেদিন সেদিনই শিক্ষকদের কমনরুমে পরিচয় হলো সুদর্শন তরুণ নাসির সাহেবের সাথে। সহকর্মী হয়েছি বলে সহজেই নাসির ভাই বলে ডাকা যায়। আমরা যারা চট্টগ্রামের মানুষ - বিশেষ করে সেই সময়ে বড় হয়েছি - চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, ভালো লাগে। নাসিরভাইয়ের সাথে যখনই কথা বলার সুযোগ হতো - চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতাম। ছোটদের স্নেহ করার ব্যাপারে নাসিরভাইয়ের কোন কার্পণ্য ছিল না। আমরা সেই সময় অনেকেই এক সাথে যোগ দিয়েছিলাম - আমি আর আবুল হোসেন খান ফিজিক্সে, সুচরিতদা আর পূর্ণিমা কেমিস্ট্রিতে, ইভা আর ইন্দ্রাণী ইংরেজিতে। নাসির ভাই আমাদের সবাইকে খুবই স্নেহ করতেন।

খুবই ব্যস্ত থাকতেন তিনি। ক্লাস নেয়ার পরপরই ব্যস্ত হয়ে যেতেন কলেজের প্রশাসনিক কাজেতখন কলেজে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সেন্টার ছিল। তখন নাসিরভাইয়ের সীমাহীন ব্যস্ততা। দেখতাম পরীক্ষার দিন দু'বার শিক্ষাবোর্ডে যাওয়া-আসা, হলের শৃঙ্খলা রক্ষা, এত কাজ সব হাসিমুখেই সামলাচ্ছেন তিনি।

ক্লাসটিচার হিসেবে আমি ছিলাম একেবারেই অপদার্থনাসিরভাই বলতেন শিক্ষার্থীদের আদর দিয়ে আমি বাঁদর বানিয়ে ফেলেছি। স্নেহের পাশাপাশি শাসনেও কঠোর হতে দেখেছি তাঁকে - বিশেষ করে অ্যাসেম্বলি ক্লাসে কলেজের ছেলেদের ধরে ধরে চুল কেটে দিতেন। ক্রুয়েল টু বি কাইন্ড - তিনি হতে পারতেন যখনই দরকার হতো।

কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ভাইস প্রিন্সিপাল হলেন। শিক্ষক কমনরুম থেকে তাঁর আলাদা অফিসে চলে গেলেন। আমাদের পরেও নতুন অনেক শিক্ষক যোগ দিয়েছেন কলেজে। তাঁদের সামনে প্রিন্সিপালকে ভাই বলে ডাকা শোভন নয় বলে নাসির ভাইকে স্যার বলে ডাকতে শুরু করলে তিনি স্যার ডাকতে মানা করলেন।

আমার রাজনৈতিক দর্শন আর নাসিরভাইয়ের রাজনৈতিক দর্শন এক ছিল না। কিন্তু তিনি কখনোই রাজনৈতিক প্রসঙ্গে কোন মন্তব্য করেননি আমার সামনে। তিনি বাস্তবতা বুঝতেন এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করতেন না। কলেজে যোগ দেয়ার এক বছরের মধ্যেই শিক্ষা ক্যাডারে ১৬তম বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আমি পাস করবোই। ভাইভা দিয়ে আসার পর নাসিরভাই কথাপ্রসঙ্গে বলেই ফেললেন, বেশি আশা করো না প্রদীপ। তোমার না হবার সম্ভাবনাই বেশি। বিএনপি সরকার ১৪তম বিসিএস-এ যে ভুল করেছে এবার আর সে ভুল করবে না। নাসিরভাইয়ের কথা ঠিক হয়েছিল।

একবার বিজ্ঞান মেলার সময় আমি যথেষ্ট কাজ করিনি বলে নাসিরভাইয়ের কাছে অভিযোগ করলেন আমাদের এক সহকর্মী। আমার বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ ছিল এই যে আমি সবকিছু নিয়েই হাসিঠাট্টা করি, আমার ভেতর সিরিয়াসনেস নেই। বিজ্ঞানের মত সিরিয়াস একটি বিষয় নিয়েও আমি শিক্ষার্থীদের সাথে প্রয়োজনীয় গাম্ভীর্য রক্ষা করিনি। নেভি কলেজে গিয়ে আমাদের অনেক স্টুডেন্ট নিজেদের স্টল ছেড়ে আমার পিছে পিছে ঘুরেছে - ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাইস প্রিন্সিপাল নাসির স্যার আমাকে ক্লাস থেকে ডেকে পাঠালেন তাঁর অফিসে। যিনি অভিযোগ করেছেন তিনি সেখানে উপস্থিত। আরো কয়েকজন শিক্ষকও ছিলেন সেখানে। আমি ক্লাস ফেলে এলাম সেখানে। নাসিরভাই প্রায় ধমক দিলেন আমাকে - কেন আমি যথেষ্ট গম্ভীর হতে শিখিনি। দেখলাম আমার সহকর্মী শিক্ষক বেশ আনন্দ পেলেন তাতে। আমি কিছু না বলে ক্লাসে ফিরে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে চলে এলাম। মনটা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। যুক্তিহীন আনুগত্য বা গাম্ভীর্য বা কাজের ভান কোনটাই আমি করতে শিখিনি। আরো অনেক কিছুই শিখিনি। যাই হোক। শিক্ষার্থীদের সামনে এলে আমার ব্যক্তিগত দুঃখের কথা মনে থাকে না। ক্লাস শেষ করে বের হয়ে দেখি নাসিরভাই করিডোর দিয়ে হেঁটে আসছেন। আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, "তোমাকে বকা দিয়েছি বলে কিছু মনে করো না প্রদীপ। ...কে খুশি করার জন্যই। বড়ভাই হিসেবে আমি তোমাকে ...।" নাসিরভাইয়ের স্নেহের প্রশ্রয় আমি সবসময় পেয়েছি।

শাহীন কলেজ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসার পর যতবারই শাহীন কলেজে গিয়েছি ততবারই নাসিরভাইয়ের স্নেহের পরশ পেয়েছি। শাহজাহান সাহেব যখন প্রিন্সিপাল ছিলেন সেই সময় আর-টি-এস অডিটোরিয়ামে একটি সেমিনার বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেটা যেন নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হতে পারে সেজন্য নাসিরভাই সেদিন সারাক্ষণ আর-টি-এস-এ থেকে নিজে সবকিছু তদারক করেছিলেন। একজন ভাইস প্রিন্সিপাল এ দায়িত্ব আর কাউকে দিয়ে করাতে পারতেন অনায়াসে। কিন্তু তিনি নিজেই করেছেন। এমন আন্তরিকতা ক'জন দেখায় একজন প্রাক্তন সহকর্মীকে?

নাসিরভাই প্রিন্সিপাল হওয়ার পর একবার গিয়েছিলাম শাহীন কলেজেনতুন করে দেখলাম তাঁর কর্মতৎপরতা। কাজের পরিধি বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। দায়িত্ব বাড়লেও ভেতরের মানুষটার মধ্যে তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি সাধারণ মানুষকে বদলে দেয়। কিন্তু নাসিরভাই ব্যতিক্রমী মানুষ - সহজে বদলান না।

আমি শাহীন কলেজ থেকে বিদায় নিয়েছি বিশ বছর আগে। নাসির ভাই, নাসির স্যার, সবার প্রিয় অধ্যক্ষ মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বিদায় নিয়েছেন গতকাল। এই বিশ বছর পরেও আমি আমার দেখা সাড়ে চার বছরের প্রত্যেকটি কর্মদিবসে নাসিরভাইয়ের উপস্থিতি স্মরণ করতে পারি। এই মানুষটিকে একটি সেকেন্ডের জন্যও কাজছাড়া দেখিনি কখনো। আমার রুটিন-কাজগুলো করতে গিয়েই আমি বিরক্ত হয়ে যেতাম, আর নাসিরভাইকে দেখেছি ভালোবেসে কাজ করতে। এমন কর্মদ্যোগী কাজপাগল মানুষটি নতুন যে কাজ হাতে নেবেন সেখানেই সফল হবেন। শাহীন কলেজ থেকে আপনার প্রাতিষ্ঠানিক কাজ শেষ হলেও আপনি শাহীন পরিবারের একজন হয়েই থাকবেন। অনেক শুভকামনা নাসির ভাই।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Doesn't Rachi's death make us guilty?

  Afsana Karim Rachi began her university life with a heart full of dreams after passing a rigorous entrance exam. She was a student of the ...

Popular Posts