গুডবাই
লস অ্যাঞ্জেলেস
আজ ঊনত্রিশে এপ্রিল, লস অ্যাঞ্জেলেসের ইতিহাসে একটি কালো
দিন। ১৯৯২ সালের
এই দিনে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ দাঙ্গায় এখানে নিহত হয় অর্ধশতাধিক মানুষ। দু’শ জনেরও
বেশি মানুষ হয়ে যায়
সারাজীবনের মতো পঙ্গু।
দাঙ্গার সূত্রপাত হয় হাইকোর্টের একটি বৈষম্যমূলক রায়ের মধ্যদিয়ে। রডনি কিং নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানকে একদিন রাস্তায় আটক করে পুলিশ। রডনি কিং নাকি পুলিশের গাড়িকে সাইড দেয়নি। সাদা পুলিশের রাগ চড়ে যায়। পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙে দেয় রডনি কিং-এর। একজন সচেতন নাগরিক এই ঘটনা দেখে ফেলেন এবং ভিডিওতে রেকর্ড করে রাখেন পুরো ঘটনা। তিনি আদালতে জমা দেন তাঁর এই ভিডিও। মামলা হয় পুলিশের বিরুদ্ধে। মামলার রায় বের হয় ১৯৯২ সালের ২৯ এপ্রিল। আদালত রায় দেয়- সাদা পুলিশ নির্দোষ, সব দোষ রডনি কিং-এর।
মুহূর্তেই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে লস অ্যাঞ্জেলেসের রাস্তায় রাস্তায়। দাঙ্গার আগুন জ্বলে উঠতে সময় নেয় না। তিনদিন ধরে চলে খুনোখুনি, ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও আর লুটপাট। স্বয়ং রডনি কিং টেলিভিশনে আবেদন করেন দাঙ্গা থামাবার জন্য। দাঙ্গা তো কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে না।
সাধারণ মানুষ ভুলে যায় অনেককিছু। খুব তাড়াতাড়িই ভুলে যায়। কিন্তু যারা সেদিন হারিয়েছে আপনজন, ওই একটা দিনের উত্তাপে যাদের সারাজীবন কাটছে হুইল চেয়ারে- তাদের পক্ষে কি ভোলা সম্ভব? নোবেল বিজয়ী লেখিকা পার্ল বাক (Pearl Sydnestricker Buck, জন্ম: ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ২৬ জুন ১৮৯২, মৃত্যু: ৬ মার্চ ১৯৭৩, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার: ১৯৩৮) তাঁর ‘What America Means To Me’ বইতে লিখেছেন, ‘We can do what we will, we are Americans.’ কথাটি মনে হয় সম্পূর্ণ ঠিক নয় আর। আমেরিকানরা ইচ্ছা করলেও মুক্ত হতে পারছে না সাম্প্রদায়িকতার হাত থেকে, বর্ণবৈষম্যের হাত থেকে। নাকি তারা ইচ্ছা করছে না মুক্ত হবার? সবার জন্য সমান আইন থাকা সত্ত্বেও সাদা আমেরিকানরা অনেকেই বলেন, “You can change the law, but can not change the color of your skin.’ একই রকম কথা কি কালোরাও বলেন না, যেখানে তাঁরা ক্ষমতাবান?
আমা্র মেলবোর্নগামী ফ্লাইট রাত সাড়ে ন’টায়। পাঁচটার দিকে এয়ারপোর্টে পৌঁছালেই হয়। কিন্তু ভাবলাম একটু আগেভাগেই চলে যাই। প্রাইম শাটলে ফোন করে গাড়ি পাঠাতে বললাম দেড়টায়।
হোস্টেলের অফিসে চাবি জমা দিয়ে সিকিউরিটি মানি ফেরত নিতে গেলে ম্যানেজার বললেন লস অ্যাঞ্জেলেস এয়ারপোর্টে ভীষণ গোলাগুলী হয়েছে আজ সকালে। মহা ঝামেলার ব্যাপার হলো দেখছি। ফ্লাইট চালু আছে নাকি বন্ধ হয়ে গেছে জানা গেলো না।
ঠিক দেড়টায় প্রাইম শাটলের গাড়ি এলো আমাকে তুলে নিতে। ড্রাইভারের কাছে জানা গেলো এয়ারপোর্টের খবর। আসল খবর হলো এয়ারপোর্টের এক জায়গায় একটি পরিত্যক্ত বন্দুক পাওয়া গেছে। গোলাগুলী হয়নি কোথাও। সিকিরিউটি অফিসারে ভর্তি এখন এয়ারপোর্ট। এয়ারপোর্টের একটি অংশ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, অন্যান্য অংশে স্বাভাবিক কাজকর্ম চলছে।
ড্রাইভার হলিউড সিটির অলিতে গলিতে গাড়ি নিয়ে ঘুরছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে এয়ারপোর্ট যাত্রীদের তুলে নিচ্ছে। একটি হোটেলের সামনে এসে পনের মিনিটের মত অপেক্ষা করার পরেও যাত্রীর দেখা না পেয়ে তাকে না নিয়েই চলে এলো অন্য একটি হোটেলে। এখান থেকে একজনকে তুলে নিয়ে বেশ দ্রুতবেগে চলে এলো অন্য একটি সাবার্বে।
বেশ ভালো লাগছে গাড়িতে ঘুরে বেড়াতে। লস অ্যাঞ্জেলেসের আবাসিক এলাকাগুলো বেশ সাজানো গোছানো। মেলবোর্নের সাবার্বগুলোর সাথে এখানের সাবার্বের খুব একটা পার্থক্য নেই।
ড্রাইভার একটি বাড়ির ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছে না কিছুতেই। মানে ঠিকানা আছে তার হাতে, কিন্তু বাড়িটি খুঁজে পাচ্ছে না। আসলে সবগুলো সাবার্ব প্রায় একই রকম হওয়াতে এবং একই নামের রাস্তা কয়েকটি সাবার্বেই থাকাতে তার এই সমস্যা হচ্ছে।
একটি এলাকায় বেশ কয়েকবার ঘুরপাক খেলো ড্রাইভার। এবার তার অফিসে ফোন করে অফিস থেকে রাস্তার নির্দেশনা শুনতে শুনতে এগোচ্ছে সে। অবশেষে পাওয়া গেলো।
যাত্রীদম্পতি রেগে টং হয়ে আছেন। তাঁদের এয়ার ফ্রান্সের ফ্লাইটের আর বেশি দেরি নেই।
এরপর একঘন্টার
মধ্যেই পৌঁছে গেলাম লস অ্যাঞ্জেলেস এয়ারপোর্টের টম ব্র্যাডলি
(Tom Bradley) ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালে।
ফ্লাইট টাইমের অনেক আগেই এসে পড়েছি। কোয়ান্টাসের কাউন্টার খোলেনি এখনো। এই টার্মিনালের অ্যারাইভ্যাল লাউঞ্জে এসেছিলাম মেলবোর্ন থেকে আসার পথে। তখন কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার তাড়া থাকার কারণে ভালো করে দেখতে পারিনি কিছুই।
দারুণ সুন্দর এই ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল। মনে হচ্ছে নতুন তৈরি করা হয়েছে। টার্মিনালে ঢোকার মুখেই টম ব্র্যাডলি’র আবক্ষ মূর্তি। কে এই টম ব্র্যাডলি? মূর্তি দেখে মনে হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ। টম ব্র্যাডলি সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি। কৌতুহল হলো। এতবড় একটি এয়ারপোর্টের একটি টার্মিনালের নামকরণ করা হয়েছে যাঁর নামে তিনি নিশ্চয় অসাধারণ কেউ।
ইনফরমেশান সেন্টারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম কাউন্টারে বসে আছেন একজন অপূর্ব সুন্দরী শ্বেতাঙ্গিনী তরুণী। না, তিনি কিছু বলতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। আমি দেখেছি শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের খবর খুব একটা রাখেন না। টম ব্র্যাডলি সম্পর্কে জানার সহজ উপায় হচ্ছে ইন্টারনেট ব্রাউজ করা। টার্মিনালে কয়েকটি ইন্টারনেট ব্রাউজিং সেন্টার আছে। কিন্তু সেখানে একটি কম্পিউটারও খালি নেই। ইনফরমেশান সেন্টারেই গিয়ে দেখি- কী বলে মেয়েটি।
শ্বেতাঙ্গ তরুণ তরুণীদের সম্পর্কে আমার অনুমান মিথ্যে প্রমাণিত করে দিয়ে টম ব্র্যাডলি সম্পর্কে অনেক তথ্য দিলো এই সাদা চটপটে মেয়েটি। টম ব্র্যাডলি টার্মিনালের ইনফরমেশান ডেস্কে কাজ করেন, অথচ টম ব্র্যাডলি সম্পর্কেই কিছু জানেন না, তা তো হতে পারে না। তা ছাড়া এখন মনে হচ্ছে লস অ্যাঞ্জেলেসের সবাই চেনেন টম ব্র্যাডলিকে। মেয়েটি তার প্রিন্টার থেকে টম ব্র্যাডলির সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রিন্ট করে দিলো।
টম ব্র্যাডলি |
টম ব্র্যাডলি ছিলেন লস অ্যাঞ্জেলেস সিটির প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মেয়র। ১৯৭৩ সাল থেকে পরপর পাঁচবার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন টম ব্র্যাডলি।
টম ব্র্যাডলির ঠাকুরদা ছিলেন টেক্সাসের এক ক্রীতদাস। হতদরিদ্র বর্গাচাষী বাবা ক্রেনার ব্র্যাডলি (Cranner Bradley) ও মা লি ব্র্যাডলি (Lee Bradley)’র ঘরে ১৯১৭ সালে টম ব্র্যাডলির জন্ম। পুরনো ফেলে দেয়া কাঠের একটি গুদামঘরে গাদাগাদি করে কোনরকমে থাকেন তারা। টমের জন্মের কিছুদিন পর তারা চলে যান আরিজোনায়। সেখানে তুলাক্ষেত থেকে তুলা সংগ্রহ করার কাজ করেন কিছুদিন। কিন্তু তাতে যা পায় তা দিয়ে দিন চলে না। ১৯২৪ সালে তারা চলে আসেন লস অ্যাঞ্জেলেসে। সান্টা ফে রেলরোডের কাজ চলছে তখন। সেখানে দিনমজুরের কাজ নেন টমের বাবা। আর মা মানুষের বাড়িতে ঠিকে ঝি-এর কাজ করেন। আরো চারটি ভাইবোন হয় টমের।
সীমাহীন দারিদ্র্য আর বঞ্চনার মাঝে বড় হতে হতে টমের ভেতর একধরণের শারীরিক ও মানসিক জেদ চেপে বসে। নানারকম খেলাধূলায় দক্ষ হয়ে ওঠে সে। লস অ্যাঞ্জেলেস পলিটেকনিক স্কুলে পড়ার সময় আমেরিকান ফুটবলে দারুণ নৈপুণ্য দেখায় টম। খেলাধূলার রেকর্ডের কল্যাণে ইউ-সি-এল-এ’র অ্যাথলেটিক স্কলারশিপ পেয়ে যায় টম। কিন্তু টম জানে, খেলাধূলা কখনো সারাজীবনের ব্যাপার হতে পারে না।
ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে থাকার সময়েই সে লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশ ডিপার্টমেন্ট (LAPD)-এর নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেয় এবং প্রথম স্থান অধিকার করে। ১৯৪০ সালে অ্যাঞ্জেলেস পুলিশ ডিপার্টমেন্টে অফিসার হিসেবে যোগ দেন টম ব্র্যাডলি।
১৯৪০ সালে এল-এ-পি-ডি’র চার হাজার অফিসারের মধ্যে মাত্র একশ' জন ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ অফিসার। টম ব্র্যাডলি তাঁদের একজন। কালো অফিসারের ডিউটি দেয়া হতো শুধুমাত্র কালো অধ্যুষিত এলাকায় অথবা ডাউন টাউনে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে। কোন সাদা অফিসারের সাথে কাজ করার সুযোগ ছিলো না কালো অফিসারদের। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এই নিয়ম চালু ছিলো।
যাই হোক, ১৯৬১ সালে একুশ বছর পুলিশের চাকরি করার পর অবসর নেন টম ব্র্যাডলি। এই একুশ বছরে তিনি মাত্র ল্যাফট্যানেন্ট হতে পেরেছিলেন। সেই সময় ওই পদের ওপরে কোন কৃষ্ণাঙ্গকে প্রমোশন দেয়া হতো না।
পুলিশের চাকরির শেষের কয়েকবছরধরে রাতের স্কুলে আইন বিষয়ে পড়ালেখা করেন টম ব্র্যাডলি। এল-এ-পি-ডি থেকে অবসরের পর আইন অনুশীলন শুরু করেন টম, যোগ দেন সক্রিয় রাজনীতিতে।
১৯৬৩ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়নে সিটি কাউন্সিলের নির্বাচনে জেতেন। লস অ্যাঞ্জেলেসের ইতিহাসে তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ যিনি সিটি কাউন্সিলের কোন নির্বাচনে জিতলেন।
১৯৬৯ সালে তিনি প্রথমবারের মত লস অ্যাঞ্জেলেসের মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন কট্টর রক্ষণশীল মেয়র স্যাম ইয়র্টি (Sam Yorty)’র বিরুদ্ধে। প্রাথমিক নির্বাচনে টম ব্র্যাডলি জিতে যান। কিন্তু চূড়ান্ত নির্বাচনের আগে স্যাম ইয়র্টি প্রচার করতে থাকেন যে টম ব্র্যাডলি একজন ঘোরতর সাম্প্রদায়িক, কট্টর বামপন্থী ইত্যাদি।
আমেরিকানরা প্রকাশ্যে কোন ঘোরতর বামপন্থী বা কমিউনিস্টকে সমর্থন করে না। নির্বাচনে হেরে যান টম, কিন্তু থেমে যান না। তিনি গড়ে তোলেন অসাম্প্রদায়িক কোয়ালিশন ফ্রন্ট।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন টম ব্র্যাডলি। লস অ্যাঞ্জেলেসের ইতিহাসে প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান মেয়র।পরপর আরো চারবার মেয়র নির্বাচিত হন টম ব্র্যাডলি। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত মোট বিশ বছর তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসের মেয়র ছিলেন।
১৯৮২ ও ১৯৮৬ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, কিন্তু কোনবারই জিততে পারেননি। রাজ্যের প্রধান নির্বাহী হিসেবে কোন কালোমানুষকে মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না মেজরিটি আমেরিকান।
আমেরিকার ইতিহাসে সর্বপ্রথম একজন কৃষ্ণাঙ্গ স্টেট গভর্নর নির্বাচিত হয়েছেন ১৯৯০ সালে। ভার্জিনিয়া স্টেটের গভর্নর ডগলাস ওয়াইলডার (L.Douglas Wilder) হলেন আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ গভর্নর।
১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন মেয়র টম ব্র্যাডলি। তারপর বেঁচেছিলেন ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৮’র সেপ্টেম্বরে হার্ট-অ্যাটাকে মারা যান টম ব্র্যাডলি।
আধুনিক লস অ্যাঞ্জেলেসের অনেক কিছুই গড়ে উঠেছে টম ব্র্যাডলির নেতৃত্বে। তাঁর যোগ্যনেতৃত্বে ১৯৮৪ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছে লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক।
একজন ক্রীতদাসের নাতি, দিনমজুর বাবা ও চাকরানি মায়ের ছেলে আধুনিক লস অ্যাঞ্জেলেসের স্থপতি মেয়র টম ব্র্যাডলি’র মূর্তির সামনে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দারুণ ভালো লাগছিলো আমার।
ভেতরে ঢুকে লাউঞ্জে বসার জন্য চেয়ারের দিকে এগোচ্ছি- হঠাৎ পথ আগলে দাঁড়ালো একজন আমেরিকান সন্ন্যাসী। গেরুয়া রঙের ধুতি কোনরকমে তার হাঁটু পর্যন্ত নেমেছে। মনে হচ্ছে তারজন্য কমপক্ষে চারহাত বহরের ধুতি দরকার। মুন্ডিত মস্তকে একগুচ্ছ টিকি দেখা যাচ্ছে। নাকের ওপর থেকে কপাল পর্যন্ত তিলক কাটা। সাজটা জব্বর নিয়েছে এই সাড়ে ছ’ফুটি সাহেব। নেবেই তো, সাধু হওয়া যত কঠিন- সাধু সাজাতো তত কঠিন নয়।
"তোমার কি একমিনিট
সময় হবে?"
বুঝতে পারছি কী বলবে। শ্রীকৃষ্ণের গুণগান করবে, আর শেষ মুহূর্তে ডক্টর মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর বই হাতে দিয়ে বলবে, বইটা ফ্রি তবে অনাথ আশ্রমের জন্য কিছু দিলে ভালো হয়।
বললাম, 'যা বলার এক মিনিটে
বলো।"
"তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি ঈশ্বরে তোমার গভীর বিশ্বাস।"
আমেরিকায় এসে তো ভালো বিপদেই পড়েছি দেখছি। সবাই আমার ভেতর এত ঈশ্বর-বিশ্বাস দেখতে পাচ্ছে কীভাবে আমি বুঝতে পারছি না।
বিরক্ত হয়ে বললাম, "আসল কথা বলো।"
"প্লেনে পড়ার জন্য
এই বইটি নিয়ে
যাও সাথে। আর ভারতের অনাথ শিশুদের
জন্য কিছু দিয়ে
যাও আমাকে।"
বাংলাদেশে ভিখারিদের কাছে মাফ চাইলে তারা যত সহজে মাফ করে দেয়, এখানে এই মুন্ডিতমস্তক এত সহজে মাফ করবে না। কথা না বাড়াবার সহজ উপায় হলো কিছু পয়সা ধরিয়ে দেয়া। পকেটে কয়েন যা ছিলো সব দিয়ে দিলাম তার হাতে।
লোকটি চলে যাবার
আগে আমার হাতে
গুঁজে দিয়ে গেলো
একটি বই, ‘লাইটস অব ভাগবত’
(Lights Of Bhagavata)।
বইটি হাতে নিয়েই মনে হলো মস্ত ভুল হয়ে গেছে। এয়ারপোর্টে অপরিচিত কারো কাছ থেকে কিছু নেয়াটা সাংঘাতিক বিপজ্জনক। এই লোক বইয়ের নামে অন্যকিছু ধরিয়ে দিলো না তো? যত অনাচার ঘটছে চারদিকে, বেশির ভাগই তো ঘটছে ধর্মীয় মোড়কে। বইটা এখন কোথাও ফেলতেও পারবো না। ফেলতে গেলেই ছুটে আসবে প্রহরীর দল। তা ছাড়া আজকেই এখানে কোথাও পাওয়া গেছে পরিত্যক্ত বন্দুক।
ভয়ে ভয়ে খুলে দেখলাম বইটির প্রত্যেকটি পৃষ্ঠা, প্রচ্ছদ, বাঁধাই। না, বইটি বই-ই, অন্যকিছু নয়। দামী অফসেট পেপারে ছাপানো ঝকঝকে একটি বই।
এয়ারপোর্টে বেশ কিছু
বইয়ের দোকান আছে। ঘুরে
ঘুরে নতুন বই দেখতে দেখতে সময় কেটে
গেলো।
কোয়ান্টাস কাউন্টার খুলেছে। বোর্ডিং পাস নিয়ে নিলাম। সেই একই প্রক্রিয়া। পাসপোর্টে লাগানো আই-৯৪ (I-94) ফরমের বাকী অংশটি খুলে রেখে দিলো কোয়ান্টাসকর্মী। ফ্লাইট ছাড়বে ১২৩ নম্বর গেট থেকে।
এবার ইমিগ্রেশান। এয়ারপোর্ট চেকিং এখন খুব সহজ মনে হচ্ছে আমার। মেটাল ডিটেক্টরকে বেশ বন্ধুই মনে হচ্ছে। কোনরকম শব্দ করে না আমি পার হবার সময়।
পাসপোর্টে ডিপার্চার সিল তো দিলো না কোথাও। আমি যে এদেশ থেকে চলে গেলাম তার কী প্রমাণ থাকলো আমার হাতে? পাসপোর্ট দেখে তো বোঝার উপায় নেই- কখন আমেরিকা ত্যাগ করলাম। তারা কোন ভুল করলো না তো?
এদিক ওদিক তাকাচ্ছি দেখে উঁচু টুলে বসা কালো পোশাকপরা একজন কালো অফিসার জ্ঞিজ্ঞেস করলেন, "হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ স্যার?"
"আমার পাসপোর্টে
কোন ডিপার্চার সিল দেয়নি। কোন ইমিগ্রেশান অফিসারও তো দেখছি
না এদিকে।"
"সিল দেয়ার
দরকার নেই। এদেশ
থেকে বেরোবার সময় কোন
ইমিগ্রেশান অফিসার লাগে না। বোর্ডিং গেটে চলে
যান, প্লিজ।"
মনে হচ্ছে মাইলখানেক হাঁটতে হলো ১২৩ নম্বর গেটে আসতে। এত লম্বা কেন এয়ারপোর্ট টার্মিনাল? হাজার হাজার প্লেনের জায়গা করে দিতে হলে টার্মিনাল তো এরকম লম্বা হবেই।
১২৩ নাম্বার গেটে এসে একটি চেয়ার দখল করে আরাম করে বসলাম। এখান থেকে নড়ছি না আর। সামনে কাচের দেয়ালের ওপারে রানওয়ে। অনেক প্লেন দাঁড়ানো সেখানে। একটু পরপরই আকাশে উড়ছে কোন না কোন প্লেন। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামলো।
মেলবোর্নগামী কোয়ান্টাস ফ্লাইট নাইন্টি ফোর আর অকল্যান্ডগামী এয়ার নিউজিল্যান্ডের ফ্লাইট মার্জ করে দেয়া হয়েছে। প্লেন আগে মেলবোর্ন গিয়ে অকল্যান্ডে যাবে, নাকি আগে অকল্যান্ড গিয়ে মেলবোর্ন আসবে জানি না এখনো। যেখানে খুশি যাক, আমার কোন অসুবিধা নেই।
প্লেনে ওঠার সময় বোর্ডিংপাস ও পাসপোর্ট ছাড়া আর কিছুই চেক করলো না। যত চেক তাহলে আমেরিকার ভেতর বা আমেরিকায় আসার সময়।
সিট পেয়েছি মাঝখানে। উইন্ডো সিট দূরে থাকুক, আইলসিট পেলেও হতো। পেয়েছি মাঝখানের সারির মাঝখানের সিট। দৈত্যাকৃতি বোয়িং ৭৪৭ এর সবচেয়ে বাজে সিট এগুলো। গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া- আমার দুপাশের দুজন যাত্রীই ওভারসাইজ। নড়াচড়া করারও উপায় নেই।
এরকম দমবন্ধ অবস্থাতেই কাটাতে হবে চৌদ্দ ঘন্টা! ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস মনে হচ্ছে এমনিতেই হয়ে যাচ্ছে আমার।
প্লেন টেক-অফ করার কিছুক্ষণ পরেই ডিনার চলে এলো। খেয়েই চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। আজ ২৯ এপ্রিল। কাল যখন প্লেন থামবে, সে মেলবোর্নেই হোক বা নিউজিল্যান্ডেই হোক তারিখ হবে ১লা মে। মাঝখানের দিনটি শূন্যে মিলিয়ে যাবে।
*****
অকল্যান্ড এয়ারপোর্টের
ঘড়িতে এখন সকাল
ছ’টা। বাইরে
ঘন কুয়াশা। প্লেন থেকে একবার
নামতে হয়েছে এখানে। এখান থেকে
মেলবোর্নগামী অনেক যাত্রী
উঠছে আমাদের প্লেনে।
অকল্যান্ড এয়ারপোর্ট খুব একটা বড় নয়। আমেরিকায় এবার দেখা এয়ারপোর্ট গুলোর মধ্যে আলবুকারকি এয়ারপোর্ট হলো সবচেয়ে ছোট। অকল্যান্ড এয়ারপোর্ট আলবুকারকি এয়ারপোর্টের মতোই হবে।
পুরনো বোর্ডিং পাস বদলে নতুন বোর্ডিং পাস দেয়া হলো। সিট চেঞ্জ হলো এবার। তবুও ভালো, এবার জানালার পাশে সিট পেয়েছি। আর তিন ঘন্টা পরেই মেলবোর্নে পৌঁছে যাবো। আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবীর উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিণ প্রান্তে এই দীর্ঘ প্লেন যাত্রা। এয়ারপোর্ট থেকে এয়ারপোর্ট আর ভালো লাগছে না। সোমবার থেকে বুধবার পর্যন্ত হয় এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে, নয়তো প্লেনের পেটে বসে আছি।
পাইলট যখন বললেন আর বিশ মিনিটের মধ্যে আমরা মেলবোর্নে পৌঁছে যাচ্ছি খুব ভালো লাগলো। বাসায় গিয়েই একটা লম্বা ঘুম দেবো ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। কিন্তু এই ভালো লাগাটা বেশিক্ষণ থাকলো না। মিনিট দশেক পরে দেখা গেলো প্লেন মেলবোর্ন এয়ারপোর্টের অনেক উপরে চক্কর দিচ্ছে, কিন্তু এয়ারপোর্টের গ্রাউন্ডকন্ট্রোল থেকে কোন সিগনাল পাচ্ছে না।
মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো আমার। সবার ভেতরেই আতঙ্ক। এয়ারপোর্টে কোন সিগনাল নেই! কী হলো? এবার কি তবে মেলবোর্ন এয়ারপোর্ট আক্রান্ত হলো? নাকি ব্রুস উইলিসের সিনেমা ‘ডাইহার্ড-২’ (Diehard-2) এর মতো কোন সন্ত্রাসী গ্রুপ এয়ারপোর্ট দখল করে নিয়েছে? হলিউড থেকে ফিরছি বলেই কি এসময়েও হলিউডি সিনেমার কথা মাথায় আসছে?
না, কোন সন্ত্রাসী কার্যক্রম নয়। পাইলট আশ্বস্ত করলেন। ঘন মেঘ আর প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে মেলবোর্ন এয়ারপোর্টের রানওয়ে দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে প্লেনের জ্বালানী ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। আর চক্কর দেয়ার রসদ নেই। তাড়াতাড়ি নাক ঘুরিয়ে চলে গেলো এখান থেকে সবচেয়ে কাছের এয়ারপোর্ট এডেলেইডে।
এডেলেইড এয়ারপোর্টে গিয়ে আরেক বিপদ। রানওয়েতে ট্রাফিক জ্যাম লেগে গেছে। ডানার সাথে ডানা লাগানো অনেকগুলো বিমান। সকাল থেকে মেলবোর্নগামী প্লেনের অনেকগুলো চলে এসেছে এখানে। কিছু গেছে সিডনিতে। এখন এখানে প্লেনেই বসে থাকতে হবে। কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কেউ জানে না এখনো।
বিপদের ওপর বিপদ। প্লেন এখন জ্বালানি নিচ্ছে। ফলে টয়লেটেও যাওয়া যাচ্ছে না। জ্বালানি নেবার সময় যে টয়লেট ব্যবহার করা যায় না, তা জানতাম না আমি।
অনেকের কানেক্টিং ফ্লাইট ছিলো মেলবোর্ন থেকে এডেলেইড। তারা যখন এখন এডেলেইডে পৌঁছেই গেছে- তারা তো এখানেই নেমে যেতে পারে। কিন্তু এয়ার ট্রাফিক আইনে নাকি এরকম কোন নিয়ম নেই।
নিয়ম মেনে চলতে হলে এডেলেইডের এই মানুষগুলোকে বসে থাকতে হবে তাদেরই এয়ারপোর্টে। তারপর প্লেন চলে যাবে মেলবোর্ন, সেখান থেকে তারা কানেকটিং ফ্লাইট ধরবে। তারপর সেই ফ্লাইটে আবার আসবে এখানে।
আরে বাবা মানুষের জন্য আইন, নাকি আইনের জন্য মানুষ? তবুও ভালো এদেশের ক্ষমতাবান মানুষেরা মানুষের সুযোগ সুবিধাকে প্রাধান্য দেন।
সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টে ফোন করে ব্যাপারটা জানানো হলো। সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট জানিয়ে দিলো, কোন অসুবিধা নেই। এডেলেইডের যাত্রীরা এখানে নেমে যেতে পারেন. ভালো লাগলো ভেবে যে পুরো যাত্রাটাই বিফলে যায়নি, অন্তত কিছু মানুষতো সুফল পেলেন এই অনির্ধারিত ল্যান্ডিং থেকে।
প্লেনে এখন খাদ্য আর পানীয়ের সংকট দেখা দিয়েছে। কয়েকজন কোক চাইলেন, স্টুয়ার্ডরা দিতে পারলেন না। সব শেষ হয়ে গেছে।
হিসেবের চেয়ে কোন কিছুই তো খুব বেশি অতিরিক্ত থাকে না প্লেনে। যেমন থাকে না হিসেবের অতিরিক্ত স্ট্যামিনাও। প্লেনের সবচেয়ে সুন্দরী স্টুয়ার্ডেজকেও কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে এখন।
গতিহীন আবদ্ধ স্থানে বেশিক্ষণ সুস্থ থাকা যায় না। গতি ছিলো বলেই সবকিছু সাবলীল ছিলো এতক্ষণ। মানুষের মুখে হাসি ছিলো, হাসিতে লাবণ্য ছিলো। এখন সবকিছুই থেমে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। শুধুমাত্র বসে থাকতেই আমাদের এরকম লাগছে, আর যখন প্লেন হাইজ্যাক করে যাত্রীদের জিম্মি করে বসিয়ে রাখা হয়, তখন কেমন লাগে তাদের? ভাবতেই বসে থাকার যন্ত্রণাটা কমে গেলো হঠাৎ।
অবশেষে চারঘন্টা পরে খবর পাওয়া গেলো মেলবোর্নের মেঘ কেটে গেছে। একটি একটি করে প্লেন আকাশে উড়তে শুরু করলো এডেলেইড এয়ারপোর্টের রানওয়ে থেকে।
একটু পরে আমরাও উঠে গেলাম মেঘের আস্তরণ ভেদ করে আকাশে। সূর্য ঝলমল করছে। আমাদের মনের মেঘও কেটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।
ঘন্টাখানেক পরেই মেলবোর্নের ভূমি স্পর্শ করলো আমাদের ক্যাঙারু আঁকা কোয়ান্টাস।
______________