Saturday, 2 February 2019

প্রথম দেখা আমেরিকা - প্রথম পর্ব


আমেরিকান ভিসা
সোনার হরিণ?

মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে মিনিট খানেক হাঁটলেই সোয়ান্সটন স্ট্রিটের ট্রাম টার্মিনাল। ১১২ নম্বর ট্রাম এসে থামতেই উঠে পড়লাম। নতুন নতুন অনেক ট্রাম দেখা যাচ্ছে আজকাল, কিন্তু এই ট্রামটি বেশ পুরনো। মনে হচ্ছে মেলবোর্নের সবচেয়ে পুরনো যে কয়েকটা ট্রাম এখনো কর্মক্ষম আছে তাদের একটিতে উঠে পড়েছি। কেলভিন ক্লেইন সুগন্ধির ঢাউশ বিজ্ঞাপন দিয়ে ট্রামের দুইপাশ ঢাকা পড়লেও ট্রামের বয়স লুকানো যাচ্ছে না। সিটগুলো ময়লা না হলেও বেশ বিবর্ণ। ট্রামে এখনো তেমন লোকজন নেই। অনেকগুলো ট্রাম দাঁড়িয়ে আছে একটার পর একটা। সবগুলো ট্রামই এখান থেকে সিটি-সেন্টার হয়ে এঁকেবেঁকে চলে যাবে বিভিন্ন সাবার্বে। ট্রামের শহর মেলবোর্ন।
            
টিকেট মেশিন থেকে একটা দু'ঘন্টার টিকেট কিনে জানালার পাশের একটা সিটে বসে পড়লাম। এখন নয়টা পাঁচ। দুপুর বারোটা পর্যন্ত মেয়াদ আছে টিকেটের। এর মধ্যে ফিরে আসতে পারবো নিশ্চয়। বারোটা বেজে গেলে আবার টিকেট কাটতে হবে। সেন্ট-কিলদা রোড এখান থেকে আধ-ঘন্টার পথ। কিন্তু কাজ সারতে কতক্ষণ লাগে তো জানি না।
            
ট্রামের জানালা থেকে দেখতে পাচ্ছি দলে দলে ছেলে-মেয়ে ঢুকছে ক্যাম্পাসে। নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে কয়েক সপ্তাহ আগে। সবার মধ্যে প্রচন্ড চাঞ্চল্য। হবে নাই বা কেন? অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে তো বটেই পৃথিবীর সেরা পঞ্চাশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি এই মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি। এখানকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে এটাও তো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করার মতো একটা কারণ। সময় কত দ্রুত চলে যায়। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন কত ভয়ে ভয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পা রেখেছিলাম। এর মধ্যেই কেটে গেছে সাড়ে তিন বছর।
            
রাস্তার ডান পাশে ঝকঝকে নতুন মায়ার সেন্টারের দিকে চোখ গেলো। মাত্র কয়েক মাস আগে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছে এই ভবনের কার্যক্রম। সিডনি মায়ারের টাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই একাডেমিক সেন্টার। এদেশের বিত্তবান মানুষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অর্থসাহায্য করেন। তাঁরা বোঝেন যে দেশের শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়ন শুধুমাত্র সরকারের দায়িত্ব নয়। অস্ট্রেলিয়ার অভিজাত ডিপার্টমেন্ট স্টোর-চেইন মায়ারের প্রতিষ্ঠাতা তরুণ সিডনি মেয়ার হাঙ্গেরি থেকে মেলবোর্নে এসেছিলেন ১৮৯৯ সালে মাত্র একুশ বছর বয়সে প্রায় খালি হাতে। তখন তাঁর ইংরেজি-জ্ঞানও ছিল প্রায় শূন্য। শুরুতে আক্ষরিক অর্থেই কুলিগিরি করেছেন মেলবোর্নে। অন্যের দোকানে কাজ করেছেন। কাঁধে পুটলি নিয়ে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে হেঁটে হেঁটে কাপড় ফেরি করেছেন। মাত্র বারো বছরের মধ্যেই তিনি নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন। আর এখন অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ মায়ার গ্রুপ।
            
মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির এশিয়া বিষয়ক শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক গবেষণার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে এই সেন্টার। চারতলা এই মায়ার সেন্টারের দোতলার রেলিং-ঘেরা বেলকনিটা খুবই সুন্দর। আমার আজকের ট্রামে চড়ার সাথে এই বেলকনির একটা সম্পর্ক আছে। এই বেলকনিতে দাঁড়িয়েই কেন্‌ বলেছিলেন, "ইউ আর গোয়িং টু অ্যামেরিকা প্রাডিব"।
            
মেলবোর্ন সেন্ট্রালে আসার সাথে সাথেই ট্রামে ঠাসাঠাসি ভী অফিস আওয়ারে শহরের মাঝখানে ট্রামের এটাই স্বভাবিক রূপ অফিস যাত্রীদের স্মার্টনেস দেখতে ভালোই লাগে তবে আজ তাদের দিকে তাকানোর বদলে জানালায় চোখ রেখে তাকিয়ে আছি সেন্ট-কিলদা রোডের ৫৫৩ নম্বর বাড়িটা দেখবো বলে ওখানেই যাচ্ছি আমি আমেরিকান দূতাবাসে
            
আমেরিকা যাবার প্রসঙ্গটা এসেছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিভাবে ডিসেম্বরের আঠারো তারিখ ছিল আমাদের সমাবর্তনের দিন। সায়েন্স ফ্যাকাল্টি থেকে যারা পিএইচডি ডিগ্রি পাচ্ছে তাদের সম্বর্ধনা দেন সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন প্রফেসর ম্যাকেঞ্জি। মায়ার সেন্টারের দোতলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে শ্যাম্পেনের গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে খুবই ক্যাজুয়েল ভঙ্গিতে কেন্‌ বলেছিলেন, "আই হ্যাভ অ্যা রিওয়ার্ড ফর ইউ অন ইওর পিএইচডি। ইউ আর গোয়িং টু অ্যামেরিকা প্রাডিব।"
            
কেনের কথা শোনার সাথে সাথে আমার হঠাৎ সোনার হরিণের কথা মনে পড়েছিলো। বাংলাদেশি পাসপোর্টে আমেরিকার ভিসা পাওয়া অনেকটা সোনার হরিণ ধরতে পারার মতোই। সোনার হরিণের সাথে তুলনাটা আমার নয়। বাংলাদেশ থেকে যারা আমেরিকান ভিসা পেতে ব্যর্থ হয়েছে - তুলনাটা তাদের দেয়া। কিন্তু কেন্‌কে "সোনার হরিণ" ব্যাপারটা কীভাবে বুঝাই? আমার ইংরেজির দৌড় এখনো 'ইয়েস নো ভেরি গুড' থেকে বেশিদূর আগাতে পারেনি। বিড় বিড় করে "গোল্ডেন ডিয়ার" জাতীয় কিছু একটা বলার চেষ্টা করতে গিয়ে আরো সমস্যায় পড়লাম।
            "হোয়াট ইজ গোল্ডেন ডিয়ার?"
কেনের প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে রামায়ণের ইংরেজি অনুবাদ দরকার হবে যা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।
            
কেন্‌ - প্রফেসর কেনেথ অ্যামোস - আমার পিএইচডি সুপারভাইজার। অস্ট্রেলিয়ায় এসে এই বিশাল মানুষটার তত্ত্বাবধানে আমার গবেষণার হাতেখড়ি হয়েছে। হাসিখুশি খোলামেলা এই বিজ্ঞানীর কাছে যুক্তিহীনতার কোন দাম নেই। ভিসা না পাবার সম্ভাবনার কথা জানাতেই হো হো করে হেসে উঠলেন কেন্‌।
            শেষ পর্যন্ত চেষ্টা না করে তো তুমি বলতে পারো না যে ভিসা পাচ্ছো না ভিসার দরখাস্ত না করলে তো তারা তোমাকে বাসায় এসে ভিসা দিয়ে যাবে না
            
আমেরিকা যাবার ব্যাপারে আমার কখনোই কোন আগ্রহ ছিল না বললে মিথ্যা বলা হবে। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে চট্টগ্রামের ছেঁড়া কাঁথায় শুয়েও মাঝে মাঝে আমেরিকায় পড়তে যাবারলাখ টাকার স্বপ্নদেখতাম এজন্য TOEFL, GRE ইত্যাদি আনুষঙ্গিক অনেক কিছু করেওছিলাম তখন কিন্তু সোনার হরিণ ধরতে গিয়ে রামায়ণে রামচন্দ্রকেও অনেক নাকাল হতে হয়েছিলো, আমি তো কোন ছার ঢাকায় আমেরিকান দূতাবাসের সামনে ভোর পাঁচটায় গিয়েও লাইনের যে দৈর্ঘ্য দেখেছি তাতে আমেরিকান স্বপ্ন অনুশীলনের সাহস আর পাইনি বরং আমেরিকান ভিসা সম্পর্কে নানাজনের কাছে নানারকম ব্যর্থতার কাহিনি শুনে আমেরিকা সম্পর্কে এক ধরনের ভীতিমিশ্রিত বিতৃষ্ণাই জন্মে গিয়েছিল এই বিতৃষ্ণা সাড়ে তিনবছর যাবত অস্ট্রেলিয়ায় থাকার পরও কমেনি, বরং এগারোই সেপ্টেম্বরের পরে আমেরিকায় প্রবেশে ভয়াবহ কড়াকড়ি দেখে আরো বেড়ে গেছে।
            
আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির কনফারেন্স এপ্রিলে আমাদের দুটো পেপার সেখানে উপস্থাপনার জন্য মনোনীত হয়েছে কেন্‌ বলছেন একটি পেপার আমি উপস্থাপন করবো, অন্যটি করবে স্টিভেন। স্টিভেন আমেরিকার লস আলামোস ন্যাশনাল ল্যাবে কাজ করে। আমার জন্য এটা একটা বিরাট সুযোগ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে পেপার পড়ার সুযোগ পাওয়া হয়তো চাট্টিখানি কথা নয় তার ওপর আমেরিকার মত জায়গায় মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির রিপ্রেজেন্টেটিভ হওয়া আমার ভেতরটা উল্লাসে মেতে উঠলো তৎক্ষণাৎ কিন্তু তা মাত্র কয়েকটা সেকেন্ডের জন্য পর মুহূর্তেই আমি যেন দিব্যচক্ষু দিয়ে দেখতে পেলাম আমার পাসপোর্টে হাসিমুখেREJECTEDসিল বসাচ্ছে ইউএস অ্যাম্ব্যাসির কোন আগুন সুন্দরী কোন এক অজানা কারণে দূতাবাসের সুন্দরী তরুণী অফিসারদের আমি ভয়াবহ রকমের নৃশংস মনে করি
            
পরবর্তী দু'সপ্তাহ ব্যাপারে কিছুই না করে আমি বাংলাদেশে চলে গেলাম সাড়ে তিন বছর পরে দেশে ফিরে আবারো মনে হলো, “তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও, এই বাংলার পরে আমি রয়ে যাবো অবশ্য এইরয়েযাবার মেয়াদ আমার মাত্র দুমাস
            
দুমাস পরে অফিসে ফিরে এসে দেখলাম কেন্‌ অনেদূর এগিয়ে রেখেছেন আমার কাজ আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির মেম্বারশিপ দেয়া হয়েছে আমাকে কনফারেন্স রেজিস্ট্রেশ করা হয়ে গেছে এমনকি নিউ মেক্সিকোর আলবুকারকিতে আমার জন্য হোটেলও ঠিক করা হয়ে গেছে। এত বড় সুযোগকে বিনাচেষ্টায় ছেড়ে দেয়া হবে আমার এযাবৎ করা সবগুলো গাধামীর সেরা গাধামী
            
দু'দিনের ভেতর ভিসার দরখাস্ত করার জন্য তৈরি হলাম ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন তথ্য পেতে বা ফরম আনতে যেতে হয় না কোথাও ভিসা ফি জমা দিতে হয় পোস্ট অফিসে এখানকার পোস্ট অফিসগুলো হাজারো কাজ করে বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন ইত্যাদি যত বিল আছে সব পোস্ট অফিসে জমা দেয়া যায় পাসপোর্টের দরখাস্তও করা যায় পোস্ট অফিসে এবং তাতে নাকি দ্রুত পাওয়া যায় পাসপোর্ট
            
ফ্লাইট বুকিং হয়ে গেলো কেন্‌ চিঠি লিখে দিলেন ইউ-এস কনসুলেটকে আমার ভিসা না পাবার গ্রহণযোগ্য কোন কারণই আর থাকলো না তবুওশংকা যেথা করেনা কেউ, সেইখানে হয় জাহাজডুবি তাই খুব বেশি আশান্বিত হলাম না বন্ধুদের বললাম, ‘ভিসা পেলে ভালো, না পেলে আরো ভালো
            
সেন্ট কিলদা রোড ধরে অনেকগুলো ট্রাম যায় ১১২ নম্বর ট্রামে চড়ে একদম সেন্ট কিলদা বিচে যাওয়া যায় ট্রামের জানালা থেকেই চোখে পড়লো পাঁচশো তিপান্ন নম্বরের বিশাল ভবন সামনে উড়ছে আমেরিকার পতাকা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আমেরিকানদের সতর্কতার বিবরণ অনবরত শুনতে শুনতে আমি ভেবেছিলাম তারা হয়তো ট্যাংক বসিয়ে রেখেছে দূতাবাসের সামনে কিন্তু ট্যাংক তো দূরের কথা, কোন অস্ত্রধারী প্রহরীও চোখে পড়লো না
            
ফ্লোরে বিরাট বিরাট অক্ষরে 553 লেখা কাছে যেতেই কাচের অটোম্যাটিক দরজা খুলে গেলো কোথাও কোন ধরনে অস্বাভাবিকতা নেই কিন্তু কেমন যেন নিঃশব্দ নির্জন অফিস আওয়ারে আমেরিকান দূতাবাস এমন নির্জন নির্জীব কেন?
            
"গুড মর্নিং স্যার হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?" বিশালদেহী দারোয়ান (অফিসারও হতে পারেন) প্রশ্ন করলেন কাউন্টারের ওপাশ থেকে গোঁফ-দাড়ি-চুল কামানো সুঠাম ভদ্রলোক এদেশে চুল কামানো লোক প্রচুর টাক পড়তে শুরু করলে নিয়মিত মাথা কামানো শুরু করে ভিসার জন্য দরখাস্ত জমা দিতে এসেছি শুনে একটি খাতা এগিয়ে দিলেন। নাম ঠিকানা টেলিফোন নম্বর লিখতে হলো সেখানে কাউন্টারের বাম পাশে অনেকগুলো চেয়ার কেউ বসে নেই সেখানে
            "ওয়েট দেয়ার। সামবডি উইল কল ইউ।"
            
একটু পরে বেশ খাটো অস্বাভাবিক রকমের মোটা একজন মহিলা সিকিরিউটি অফিসার এসে আমার হাতের ব্যাগ চেক করলেন
            "ব্যাগ নিয়ে যাওয়া যাবে না ভেতরে। ব্যাগ এখানে রেখে যেতে হবে।"
            "কাগজপত্র?"
            "হাতে করে নিয়ে যান। পাসপোর্ট দেখান।"
পাসপোর্ট দেখে আবার একটা খাতায় নাম, পাসপোর্ট নম্বর লিখে ব্যাগটা রেখে দিলেন।
            
সেই শেখ সাদি সময় থেকেই ভালো পোশাকের কদর সবখানে আমি যদিও ফর্মাল ড্রেসটাকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি, কিন্তু মাঝে মাঝে বাধ্য হয়েই কোট পরতে হয় যেমন আজ মনে হলো এজন্যই শরীর তল্লাশীর হাত থেকে বেঁচে গেলাম কিন্তু আমেরিকান সিনেমাগুলোতে তো হরদম দেখা যায় কোটের ভেতরেই লুকিয়ে রাখে বিরাট বিরাট সব অস্ত্র যেমন রেখেছে কাউন্টারের পাশের বেল মাথাটি তিনি নিরস্ত্র বসে আছে একথা কোন বোকাও বিশ্বাস করবে না
            
এদেশের লিফ্‌টে কোন লিফ্‌টম্যান থাকে না। কিন্তু এখানে লিফটে আমাকে সাথে নিয়ে উপরে উঠছেন সিকিউরিটি গার্ড অনেকটা চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়ার মতোই মনে হচ্ছে গোপন আস্তানার দস্যু-সর্দারের সাথে দেখা করতে চলেছি কোন্‌ ফ্লোরে লিফ্‌ থামলো তাও দেখতে পেলাম না মহিলা লিফটের দরজায় দাঁড়িয়ে হাত তুলে বললেন, ‘হিয়ার ইউ আর
            
এখানে আরেকটি সিকিউরিটি এরিয়া ডেস্ক আলো করে হাসিমুখে বসে আছে একজন আগুন সুন্দরী নিচের তলার সুঠাম দৈত্যকে আমার ভয় লাগেনি, কিন্তু এই ছিপছিপে তরুণীকে দেখেই আমি ভয় পেয়ে গেলাম মনে হলো একটি বিষধর সাপ ঠান্ডা চোখে দেখছে আমাকে, একটু এদিক ওদিক হলেই ছোবল মারবে
            
এখানে ফর্মালিটি সামান্যই আবারো একটা খাতায় নাম ঠিকানা টেলিফোন নম্ব লিখতে হলো আমার হাতের সব কাগজপত্র রেখে একটা  স্লিপ ধরিয়ে দিলো আমাকে। কাউন্টারের পাশেই মেটাল ডিটেক্টর। আমাকে যেতে হলো মেটাল ডিটেক্টরের ভেতর দিয়ে সামান্য ট্যা ব্দ হলেই আটকে দেবে কোমরের বেল্টে জন্য শব্দ হতে পারে কিন্তু কোন শব্দ হলো না হয়তো এটা কোন বিশেষ ধরণের ডিটেক্টর, কেবল অস্ত্র থাকলেই ট্যাঁ করে নাকি মেশিন টেশিন কিছুই না, কেবল ভয় দেখানো?
            
অভ্যর্থনা কক্ষে গিয়ে দেখলাম মাত্র দু'জন মানুষ অপেক্ষা করছেন সারি সারি চেয়ার খালি আমেরিকায় যাওয়া কি লোকে একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে? আসলে তা নয় অস্ট্রেলিয়ানদের তো আর আমেরিকা ভ্রমণের জন্য ভিসা নিতে হয় না ভিসা নিতে হয় আমাদের মত গরীব দেশের মানুষদের তো আমরা আর জন এখানে!
            
দুমিনিটের ভেতরেই ডাক পড়লো আমার আমি যেন কাউন্টারে গিয়েই স্মার্ট হয়ে গেলাম কারণ? ওপাশের ভদ্রমহিলা তরুণী নন প্রৌঢ়ার হাসিমুখ দেখে মনে হলো খুব দয়ালু দয়ার প্রশ্নটা এখন সবচেয়ে বড় আমেরিকার ভিসা নাকি ভিসা অফিসারের মেজাজের উপর নির্ভর করে অনেকটা
            
আমার কাগজপত্র দেখে মনে হলো তিনি খুব সন্তুষ্ট অবশ্য এদের মুখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই তারা আণবিক বোমা ফেলার হুকুমও দিতে পারে হাসি হাসি মুখ করে
            
আমার পাসপোর্ট দেখে বললেন, "কিছু কিছু পাসপোর্টের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের কমপক্ষে তিন সপ্তাহ সময় লেগে যায় তাতে তোমার কোন অসুবিধা হবে?"
            
কিছু কিছু পাসপোর্টে ক্ষেত্রে! হায়রে আমার সবুজ রঙের পাসপোর্ট! গ্রিন হয়েও তুমি প্রায় সময়ই গ্রিন সিগনাল পাও না পাসপোর্ট নিয়ে এধরনের অপমান আমার গা-সহা হয়ে গেছে এতদিনে
            
বললাম, "না, তাতে কোন অসুবিধা নেই আমি যাবো আজ থেকে ঠিক এক মাস পরে সুতরাং তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করা যাবে।"
            চমৎকার একটা হাসি দিলেন ভদ্রমহিলা বললেন, "আমরা চিঠি দিয়ে জানাবো তোমাকে গুড বাই"
            
সব মিলিয়ে তিন চার মিনিটও লাগলো না অনেকের কাছে শুনেছি ভিসার ইন্টারভিউ চাকরির ইন্টারভিউর চেয়েও কঠিন কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এরকম হলো কেন? কোন কিছুই তো জ্ঞিজ্ঞাসা করলেন না আমাকে আমি কেমন ধনী? আমার চেহারা কেন সন্ত্রাসীদের মত? আমেরিকায় গিয়ে আমি যে ফিরে আসবো তার গ্যারান্টি কী? ইত্যাদি ইত্যাদি কোন প্রশ্নই তো করলেন না আমাকে
            
মনে পড়ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার পদের জন্য ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম যে স্যাররা আমাকে এতবছর ধরে পড়িয়েছেন, খুব ভালো করে চেনেন আমাকে, তাঁরাই প্রশ্ন করলেন, “মাস্টার্সে তোমার কোন্‌ কোন্‌ পেপার ছিলো?” এটাই ইন্টারভিউর একমাত্র প্রশ্ন! তখন থেকেই  আমি জানি নো কোয়েশ্চেন মানে হলো তুমি ফেল
            আমি ভিসা পাচ্ছি না গুড বাই চলে এলাম এবং চেষ্টা করলাম পুরো ব্যাপারটাই ভুলে যেতে
            
কিন্তু ভুলে যাওয়া সহজ হলো না দরখাস্ত জমা দিয়েছি শুক্রবার, সোমবার বিকেলেই দেখি দূতাবাসের চিঠি, সাথে পাসপোর্ট এত তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত হয়ে গেলো? চিঠিটা না পড়েই পাসপোর্ট খুলে দেখলাম রিজেক্টেড সিল কোথায় বসালো কোথাও না চিঠি পড়ে বোঝা গেলো- এটা একটা রুটিন ওয়ার্ক আমাকে অফিসিয়ালি জানানো হচ্ছে যে আমার ভিসার দরখাস্ত তারা গ্রহণ করেছে এবং তিন সপ্তাহ পরে আমার ফাইল দেখা হবে তিন সপ্তাহের ভেতর আমার পাসপোর্ট যদি লাগে তাই পাঠিয়ে দিয়েছে আমি যদি মনে করি তিন সপ্তাহ পরে ভিসা পেলেও আমার চলবে তাহলে যেন পাসপোর্ট তাদের কাছে পাঠিয়ে দিই চিঠি কোনভাবেই আমার ভিসা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেয় না আমার সাময়িক অসুবিধার জন্য তারা খুব দুঃখিত
            আহারে, কী দুঃখ! ভাষার আদিখ্যেতা দেখলে পিত্তি জ্বলে যায়!!
            
মানুষের আশার মৃত্যু হয় না সহজে যদিও মনে করছি ভিসা না পেলেও আমার কিছু যাবে আসবে না কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুব অস্থির লাগছে কেন্‌ ধরেই রেখেছেন আমি যাচ্ছি আমেরিকা
            
আমেরিকান কর্তৃপক্ষের সিকিরিউটি ক্লিয়ারেন্সের জন্য আমার বক্তৃতার কপি পাঠাতে হলো সেখানে বাকস্বাধীনতার অপূর্ব উদাহরণ বটে এখানে ডিপার্টমেন্টে বক্তৃতাটা দিলাম একবার
            
কেন্‌ বললেন, “এবার তুমি যেতে না পারলেও কোন ক্ষতি নেই বক্তৃতাতো হয়ে গেলো
            
শুনে খুব দমে গেলাম তবে কি আমার ভিসা না পাবার সম্ভাবনাই বেশি? উত্তরে কেন্‌ অম্লান বদনে বললেন, “ভিসা তোমার পাওয়া উচিত কিন্তু স্টুপিড আমেরিকানদের তো বিশ্বাস নেই তারা কামান দিয়ে মশা মারতে অভ্যস্ত
            
সাড়ে তিন সপ্তাহ পরে আমেরিকান দূতাবাসের খামটা এলো। চেয়েছিলাম এক সপ্তাহের ভিসা তারা এক বছরের মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা লাগিয়ে পাসপোর্ট ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম আমেরিকার প্রতি বিতৃষ্ণার ভাবটা আমার কমে গেছে তবে কি বিতৃষ্ণাটা একটা ভন্ডামি ছিলো? কিংবা আঙুরের স্বাদ যে কারণে টক মনে হয় সেই জাতীয় কিছু?



No comments:

Post a Comment

Latest Post

Doesn't Rachi's death make us guilty?

  Afsana Karim Rachi began her university life with a heart full of dreams after passing a rigorous entrance exam. She was a student of the ...

Popular Posts