আলবুকার্কি: প্রথম রাত
ব্যাগেজ ক্লেইম
এরিয়া নিচের তলায়। সিঁড়ি
দিয়ে নামতে নামতে স্টিভেন জানালো লাগেজ না আসার
সম্ভাবনাও রয়েছে। ডেনভার থেকে নাকি
প্রায় সময়েই লাগেজ ঠিকমত আসে না। ডেনভার এয়ারপোর্টের লাগেজ হ্যান্ডেলিং সিস্টেম এখন পুরোটাই
কম্পিউটারাইজড। ফলে লাগেজ
বাছাই করতে নাকি
অনেক বেশি সময়
লাগছে ইদানিং। তাই ঠিক সময়ে
প্লেনে লাগেজ লোড করা
না গেলে প্লেন
চলে আসে লাগেজ
ছাড়াই।
স্টিভেন ব্যাগেজ সিস্টেম সম্পর্কে লেকচার শুরু করে
দিয়েছে অলরেডি। লাগেজ আসতে অনেকক্ষণ
সময় নিচ্ছে। এটা হয়তো
স্বাভাবিক। কিন্তু কানের কাছে স্টিভেনের
নন-স্টপ লাগেজ-লেকচারের কারণে মনে হচ্ছে
অনন্তকাল অপেক্ষা করে আছি
লাগেজ বেল্টের কাছে।
অবশেষে স্টিভেনের ভবিষ্যতবাণী ভুল প্রমাণিত
করে ব্যাগেজ এলো। আমার
লাগেজ বলতে ছোট্ট
একটা সুটকেস। চাকা লাগানো
আছে বলে সুটকেসের
ভর গায়ে লাগে
না।
স্টিভেন গাড়ি পার্ক
করেছে এয়ারপোর্টের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং লটে। সুতরাং
আরো এক ধাপ নামতে
হলো ভূ-গর্ভে।
অস্ট্রেলিয়ার অভ্যাসমতো গাড়ির বাম পাশে
বসতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু এখানে গাড়ির সিস্টেম আলাদা। সবগাড়ি এখানে লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ, গাড়ির স্টিয়ারিং গাড়ির বামপাশে, গাড়ি চলে
রাস্তার ডান পাশে।
নিউমেক্সিকো শুষ্ক এলাকা। আলবুকারকি সমুদ্র সমতল থেকে
প্রায় পাঁচ মাইল উঁচুতে। স্টিভেন থাকে সান্টা
ফে সিটিতে। সান্টা ফে নিউ মেক্সিকোর
রাজধানী। আলবুকার্কি থেকে প্রায়
এক ঘন্টার ড্রাইভ। কোন জায়গার
দূরত্ব জ্ঞিজ্ঞেস করলে এখানে
সবাই উত্তর দেয় সময়ের
হিসেবে। অর্থাৎ গাড়িতে করে সেখানে
যেতে কতক্ষণ লাগবে।
সারা দুনিয়ায়
এম-কে-এস সিস্টেম
বা এস-আই সিস্টেম
চললেও আমেরিকায় এখনো জগাখিচুড়ি
অবস্থা। দূরত্ব মাপা হচ্ছে
বৃটিশ পদ্ধতিতে- মাইল, গজ, ফুট, ইঞ্চিতে। তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে
ফারেনহাইট স্কেলে। আমি সেলসিয়াস
স্কেলে অভ্যস্ত। এখানকার তাপমাত্রা আটষট্টি ডিগ্রি শুনে আৎকে
ওঠলাম। ভর মাপা
হচ্ছে পাউন্ড, আউন্স ইত্যাদিতে। রাস্তার পাশে সতর্কীকরণ
সাইনে গাড়ির সর্বোচ্চ গতিবেগ লেখা আছে
তিরিশ। কিলোমিটারে অভ্যস্ত আমার চোখ। স্টিভেন বুঝতে পেরে শুধরে
দেয়, “তিরিশ মাইল”। পেট্রোল
পাম্প শব্দটা এখানে কেউ উচ্চারণও
করে না। সবাই
বলে গ্যাস-স্টেশান। পেট্রোলের নাম ‘গ্যাস’ – বিক্রি হয় লিটারের
বদলে গ্যালন দরে।
আমেরিকা সবকিছুতেই প্রমাণ করতে চায়
যে তারা আলাদা। তারা আমেরিকান। সারা দুনিয়ায়
ফাইনেন্সিয়াল ইয়ার শুরু
হয় জুলাই মাসে- আর আমেরিকায়
তা হয় জানুয়ারি
মাসে। কারণ কী?
না, তারা আলাদা। অন্যরা যেভাবে করে- সেভাবে করলে যেন
তাদের আমেরিকানত্ব নষ্ট হয়ে
যাবে! ইংরেজি উচ্চারণতো বটেই- এমনকি অনেক শব্দের
বানানও বদলে দিয়েছে
আমেরিকানরা। কালার (colour) শব্দের ‘ইউ’ তুলে দিয়ে
কালার বানান করে color। তাদের হাতে সেন্টার (Centre)
হয়ে গেছে center।
এ জাতীয় সাদৃশ্য আর বৈসাদৃশ্য
নিয়ে টুকটাক কথা বলতে
বলতে চলে এলাম
আলবুকারকি সিটিতে। চোখে পড়লো
আমেরিকার ঐতিহাসিক ৬৬ নং রোড। রিচার্ড ফাইনম্যানের লেখার পড়েছি এই ৬৬ নং রোডের কথা। এখন
আমি এই ৬৬ নং রোডে একটা আমেরিকান
গাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বিষয়টা বুঝতে পেরেই কেমন রোমাঞ্চিত
হয়ে যাচ্ছি।
হোটেল হায়াত রিজেন্সি- আলবুকারকি। আমার হোটেলের
নাম। ঠিকানা ৩৩০ নম্বর
টিজেরাস (TIJERAS)
রোড। ‘টিজেরাস’ উচ্চারণ করতেই আমার ভুল
ধরিয়ে দিলো স্টিভেন। টিজেরাস নয় সঠিক
উচ্চারণ হবে টিহেরাস। ইংরেজি বানান ঠিকমত ফলো করলে
‘টিজেরাস'ই হবার কথা। কিন্তু শব্দটি যেহেতু স্প্যানিশ, সেহেতু ইংরেজি- J’র উচ্চারণ হবে ‘এইচ’ এর মতো। নিউ মেক্সিকোতে মনে হচ্ছে
ইংরেজির চেয়েও স্প্যানিশের চল বেশি।
ড্রাইভওয়েতে গাড়ি থামতেই
দু'জন উর্দিপরা বেয়ারা ছুটে এলো। হোটেল বেয়ারাদের আলাদা কোন আমেরিকান
নাম আছে কিনা
জানি না। স্টিভেন তাদের একজনের হাতে গাড়ির
চাবি দিয়ে গাড়ি
থেকে নেমে এলো। বেয়ারা গাড়ি নিয়ে
চলে গেলো পার্ক
করতে। অন্যজন আমার ব্যাগ
নিতে চাইলে স্টিভেন মানা করলো। ব্যাগ না নিয়ে
চলে গেলো বেয়ারাটি। এখানে সবকিছুতেই টিপস দিতে হয়। যে কোন সেবা
নিলেই টিপসটা ন্যায্য পাওনা হয়ে যায়। আমার ব্যাগটা ধরে এক ফুট
দূরে নিয়ে গিয়ে
রাখলেও বেয়ারাটাকে টিপস দিতে হতো। এখানে নিজের কাজ নিজে
করাটাই নাকি বুদ্ধিমানের কাজ।
সুইংডোর পেরিয়ে ভেতরে পা দিতেই
মনে হলো কোন
এক রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়েছি। রিসেপশানে গিয়ে নাম
বলতেই ডেস্কের তরুণীর মুখে অনাবিল
হাসি- কৃত্রিম হলেও বেশ
ভালো লাগলো। কম্পিউটারের কী-বোর্ডে ঝড় বয়ে
গেলো কয়েক সেকেন্ড। তারপরই- "ওয়েলকাম ডক্টর ডেব। ইওর
রুম ইজ রেডি। ইওর ক্রেডিট কার্ড প্লিজ।"
মনে হচ্ছে
ক্রেডিট কার্ডটা এখানে পাসপোর্টের মতোই জরুরী।
বারোতলায় আমার রুম। রুম নম্বর ১২১৫। স্টিভেন আমাকে পথ দেখিয়ে
নিয়ে যাচ্ছে। সেও আসেনি
এর আগে কখনো
এখানে। পুরো আলবুকারকি
সিটিতে এই হোটেল
বিল্ডিংটাই সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং।
এত বড় হোটেলে
থাকার সুযোগ আমার এই প্রথম। যা দেখছি
সবকিছুই রাজকীয় মনে হচ্ছে। হোটেল রুমে চাবির
বদলে ম্যাগনেটিক কার্ড ব্যবহার করা হচ্ছে। দরজায় কম্পিউটারাইজড সিস্টেম কার্ড। স্লটে কার্ড ঢোকাতেই দরজা খুলে
গেলো।
ভেতরে ঢুকে দেখি
ঘর অন্ধকার। স্টিভেন বললো দরজার
পাশেই সুইচ আছে। কিন্তু সুইচতো অন করাই
আছে। বাতি জ্বলে
না কেন? এবার স্টিভেন
সুইচে হাত দিতেই আলো জ্বলে উঠলো। ইলেকট্রিক
সুইচেও আমেরিকানরা আমরা যা করি তার উল্টো
ব্যবস্থা করে রেখেছে। আমরা সুইচ অন করি নিচের দিকে নামিয়ে,
এরা করে উপরের
দিকে উঠিয়ে।
রুমের ভেতর তাকিয়ে হকচকিয়ে গেলাম। এত বড় রুম- একজনের জন্য!! একা আমার জন্য!!!
ভালো করে কিছু
দেখার আগেই স্টিভেন
তাগাদা দিতে শুরু
করলো। ডিনারে যেতে হবে। একটা গ্রিক রেস্তোঁরায় দু'জনের জন্য টেবিল বুক করে
রেখেছে সে।
ব্যাগ খুলে তার জন্য আনা সিডি দুটো
বের করে স্টিভেনের
হাতে দিয়ে বেরিয়ে
পড়লাম দু'জনে।
আলবুকারকি সিটিতে এখন পড়ন্ত
বিকেলের আলো। চারদিক
শান্ত নিরিবিলি। গাড়ি চলাচলও
খুব বেশি নেই। সিটিতে জনবসতি নেই বললেই চলে। যারা
কাজে আসে তারাও
কাজ শেষ করে
চলে যায় যার
যার বাড়ি। ধনী
দেশের ধনী লোকেরা
শহরের চেয়ে শহরতলীতে
বাস করতেই পছন্দ করে।
সেন্ট্রাল এভিনিউ ধরে গাড়ি
চালাচ্ছে স্টিভেন। ইউনিভার্সিটি অব নিউ
মেক্সিকোর ক্যাম্পাস বামে রেখে
একটা মোড় ঘুরেই
কর্নেল ড্রাইভে গাড়ি থামলো। ইউনিভার্সিটি ড্রাইভের সমান্তরাল ড্রাইভগুলোর নাম আমেরিকার
কিছু বিখ্যাত ইউনিভার্সিটির নামে রাখা
হয়েছে। যেমন কর্নেল (Cornell) ইউনিভার্সিটির নামে
কর্নেল ড্রাইভ। এর আগেরটার
নাম হার্ভার্ড (Harvard) ড্রাইভ,
পরের ড্রাইভের নাম প্রিন্সটন (Princeton)। রেষ্টুরেন্টের নাম
Gyros। জাইরোস
না গাইরোজ? স্টিভেন বললো, ‘জিরোস’। গ্রিক
অক্ষরেও লেখা আছে। গ্রিক অক্ষরগুলো ফিজিক্সে খুব ব্যবহার
করা হয় বলে
পরিচিত। কিন্তু গ্রিক খাবার আমার কাছে
একেবারেই অপরিচিত। মেলবোর্নের রাসেল স্ট্রিটকে ‘মিনি গ্রিস’
বলা হয়ে থাকে। ওদিকে অনেকবার গিয়েছি, কিন্তু গ্রিক রেস্তোরায় খাওয়া হয়নি কখনো।
স্টিভেন জন্মসূত্রে গ্রিক। কিন্তু সে বড় বেশি আন্তর্জাতিক বলে তার
গ্রিকত্ব প্রকাশিত হয় না সহজে। এখানে এই রেস্তোরায়
তার পরিচিতি আছে বোঝা
যাচ্ছে। টেবিল আগে থেকেই
বুক করা ছিলো। ওয়েটার ছুটে এলো
মেনু নিয়ে। স্টিভেন
তার সাথে গ্রিক
ভাষায় কথা বললো।
খাবারের আগে পানীয়ের
অর্ডার দিতে হয়। আমি অ্যালকোহল পছন্দ করি না শুনে
স্টিভেন চোখ কপালে
তুলে ফেললো।
"চার বছর ধরে
কেনের সাথে কাজ
করার পরেও তুমি
এখনো নন-অ্যালকোহলিক আছো কীভাবে?"
"তুমি যেরকম
পিউরিটান আমাকে ভাবছো, আসলে সেরকম
নই আমি। তোমাদের
ঐ মদ খেয়ে
আমি কোন মজা
পাই না। আমার মজা
অন্য কিছুতে।"
আমার জন্য
কমলার রস আর স্টিভেনের জন্য খটমটে
নামের একটা ককটেল
এলো। গ্রিক খাবার যেহেতু আমি চিনি না,
সেহেতু স্টিভেনই খাবার বাছাই করলো আমার
জন্য। মাংসের শিক বা শিক কাবাব জাতীয় কিছু। আর নিজের জন্য প্রচুর
চিজ দেয়া নিরামিষ। নিরামিষে সামান্য শুকরের মাংস দেয়া
আছে, কিন্তু শুকরের মাংস নাকি
নিরামিষের পর্যায়ে পড়ে।
একটা স্যুপ এলো
দু'জনের জন্য। ল্যানটিল
স্যুপ। ভালো করে
দেখে বুঝলাম এই গ্রিক স্যুপ আমাদের দেশে প্রতি
ঘরেই তৈরি হয়। আমরা এই বস্তুকে
‘ডাল’ বলে থাকি। স্টিভেন তৃপ্তি সহকারে স্যুপের চামচে চুমুক দিচ্ছে। মনে হচ্ছে স্যুপের
স্বাদে তৃপ্তিতে চোখ বুজে আসছে
তার। ডাল খেয়ে
এত তৃপ্তি পেতে আর দেখিনি কাউকে। ‘ল্যানটিল স্যুপ’ নামধারী ডাল আর মহার্ঘ মাংস এখানে
সমান দামী।
খাওয়ার সময় ন্যাপকিন
খুলে কোলের ওপর বিছিয়ে
নিতে হয়। এটাই
নাকি
নিয়ম। নইলে নাকি আমেরিকানরা
খুব অফেন্ডেড মনে করে। আমেরিকানরা অফেন্ডেড মনে করে
না কিসে? যে কোন
কিছু তাদের মনের মত না হলেই তো তারা অফেন্ডেড মনে করে। খাওয়ার সময় আমার
কোলে যদি ঝোল
পড়ে তাতে আমি
নিজে যদি কিছু
মনে না করি-
তোমার কেন এত মাথাব্যাথা? কিন্তু যস্মিন দেশে যদাচার।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, হিন্দুদের ধর্ম ঢুকেছে
ভাতের হাঁড়িতে। এখন পাশ্চাত্যেও
দেখছি বড় বেশি নিয়মকানুন
এই খাবার বা খাবারের
জায়গা নিয়ে। জিন্স
পরে তুমি হোয়াইট
হাউজে গিয়ে আমেরিকান
প্রেসিডেন্টের হাতও ঝাঁকিয়ে
আসতে পারবে, কিন্তু জিন্স পরে তুমি
কিছু কিছু রেস্তোরায়
ঢুকতে পারবে না।
খাবারের বিল শেয়ার
করা আমেরিকান পদ্ধতি। বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটি জীবনের পুরোটাই খাবারের ব্যাপারে আমরা সব বন্ধুরা আমেরিকান পদ্ধতি মেনে চলেছি। যার বিল তার। কিন্তু আমেরিকায় এসে প্রথম
বেলার খাবারের দাম আমেরিকান
পদ্ধতিতে দেয়া হলো
না। স্টিভেন যেহেতু আগে থেকেই
এবেলার হোস্ট হয়ে বসে
আছে, সেহেতু আমার ওয়ালেট
ব্যবহার না করেই
আবার পকেটে ঢোকাতে হলো।
স্টিভেন দাম পরিশোধ
করলো ক্রেডিট কার্ডে। অস্ট্রেলিয়ায় টিপস প্রথা একেবারে নেই বললেই
চলে। সেখানে হোটেলে ক্রেডিট কার্ডে বিল পরিশোধ
করলে টিপস দেয়ার কথা ভুলে
গেলেও কেউ কিছু
মনে করে না। বরং সেটাই স্বাভাবিক সেখানে। কিন্তু এখানে তা হবার
নয়। বিলের নিচে টিপস এর ঘর আছে। কমপক্ষে টেন পার্সেন্ট
টিপস দেয়া নিয়ম। হোটেলের চাকরিতে এই টিপসের
ওপর নির্ভর করেই চলতে
হয় ওয়েটারদের। কারণ ঘন্টা
প্রতি তাদের পারিশ্রমিক পাঁচ ডলারেরও
কম। ট্যাক্স অফিস হোটেল
রেস্তোরার ওয়েটারদের টিপসকে তাদের নিয়মিত আয় হিসেবে
ধরে ট্যাক্স আদায় করে
নেয়।
"এখন আমি
যদি রেস্তোরায় খেয়ে মজা
না পাই বা তাদের আতিথেয়তায় সন্তুষ্ট হতে না পারি তাহলেও টিপস দিতে
হবে?"
"ইয়েস, তখনো দিতে
হবে। খাদ্য বা পরিবেশনা
যদি জঘন্য হয় তা জানানোর উপায় হলো
টেবিলে একটা পেনি
রেখে দেওয়া টিপ্স হিসেবে। প্রচন্ড ব্যস্ত রেস্তোঁরায় অনেকক্ষণ বসে থাকার
পরেও যদি খাবার
না আসে- রেগেমেগে চলে যাবার
সময় এরকম একটা
করে পেনি রেখে
যায় অনেকে।"
"অর্থাৎ খাবার না খেয়েও
টিপস দিতে হয়!"
‘জিরোস’
থেকে যখন বেরোলাম
তখন চারদিক অন্ধকার। স্টিভেন আমাকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে চলে
যাবে সান্টা ফে- তার নিজের
সিটিতে। ইউনিভার্সিটি অব নিউ
মেক্সিকোর ক্যাম্পাসের কাছে আসতেই
দেখি বেশ কয়েকটা
পুলিশের গাড়ি। স্টেট বা ফেডারেল
পুলিশ নয়, ইউনিভার্সিটির নিজস্ব ক্যাম্পাস-পুলিশ। বাংলাদেশের সরকারী পুলিশ বাহিনী ইউনিভার্সিটি গুলোর ক্যাম্পাসে মোটামুটি স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে। ক্যাম্পাসে বন্দুকযুদ্ধের তারা নিয়মিত
দর্শক। কিন্তু তারপরও তারা সরকারী
খরচে চলা রাষ্ট্রীয়
পুলিশ। কিন্তু এই আমেরিকার
ক্যাম্পাসে স্থায়ী পুলিশ বাহিনী লাগবে কেন? উত্তরে স্টিভেন যা বললো
তাতে আঁৎকে উঠলাম।
এখানকার ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনৈতিক
সংঘাত নেই, কিন্তু ড্রাগ আর ধর্ষণ
অতি নিয়মিত ঘটনা। শুধু
মেয়েরা নয়, ছেলেরাও ধর্ষিত হয় এখানে। এগুলো ঠেকাতেই পুলিশী ব্যবস্থা। প্রত্যেকটা ইউনিভার্সিটিরই নিজস্ব পুলিশবাহিনী আছে এদেশে। ক্যাম্পাস পুলিশের ক্ষমতা রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর ক্ষমতার সমান। পার্থক্য
হলো এরা বেতন
পায় ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। আর ইউনিভার্সিটি পুলিশের বেতনও আদায় করে
নেয় স্টুডেন্টদের কাছ থেকে।
ইউনিভার্সিটি পর্যায়ে পড়াশোনা এই দেশে ভীষণ ব্যয়বহুল। অতি উচ্চস্তরের মেধাবী না হলে
স্কলারশিপ পাবার তো প্রশ্নই
ওঠে না। আর স্কলারশিপ
না পেলে বছরে
টিউশন ফি গুণতে হবে কমপক্ষে পনের হাজার
আমেরিকান ডলার। আমেরিকান নামী
ইউনিভার্সিটির কোন কোনটাতে বার্ষিক বেতন পঞ্চাশ হাজার ডলারেরও বেশি। বাংলাদেশে ছাত্রছাত্রীরা পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে বেতন দেয়
বছরে মাত্র তিন ডলার।
আমাকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে স্টিভেন
চলে গেলো। হোটেল
গেটে উর্দিপরা গার্ডদের স্যালুটের জবাবে স্মিত হেসে হোটেলে
ঢুকলাম। ক্ষমতার চেয়ারে বসলে যেমন
নিজের অজান্তেই নিজের আচরণে একটা পরিবর্তন
চলে আসে, এই হায়াত
রিজেন্সি হোটেলে এসেও আমার
কেমন যেন একটা
গুরুত্ব
এসে গেছে মনে
হচ্ছে। আর্কিমিডিসের সুত্র অনুযায়ী তরল বা বায়বীয় পদার্থে কোন কিছু
ডোবালে সেটা কিছু
ওজন হারায় বলে মনে
হয়। আর এখানে
আমার মনে হচ্ছে
আমি কিছুটা ওজন প্রাপ্ত
হয়েছি। তারই লব্ধফল
স্বরূপ হোটেল লবি পার
হবার সময় মেরুদন্ড
একটু বেশি সোজা
করে ফেলেছি মনে হলো। আত্মবিশ্বাসের পরিমাণও মনে হচ্ছে
একটু বেশি হয়ে
গেছে।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেক আগে। এখন ‘ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া’। গত তিরিশ ঘন্টা যাবত ছোটাছুটির
পরে এখন স্থিতির সময়। রুমের কোথায় কী আছে
তা দেখার শক্তি নেই এখন।
বিছানার সাইজ আমার
মেলবোর্নের পুরো বেডরুমের
সাইজের সমান। দক্ষিণ
দিকের দেয়াল পুরোটাই কাচের। শুয়ে পড়লাম। বেডসাইড ল্যাম্পটা নেভাতেই ভেতরটা অন্ধকার হয়ে গেলো। কিন্তু সাথে সাথে
আলোকিত হয়ে উঠলো
বাইরের আলবুকারকি। সেদিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে
একটা আলো ঝলমলে
শহরের অনেক উপরে শূন্যে ঝুলে আছি আমি- আরব্য রজনীর আবু হোসেন।
No comments:
Post a Comment