কনফারেন্স: দ্বিতীয় দিন
প্লেনারি সেশানের
তিনটি বক্তৃতাই শুনলাম মুগ্ধ হয়ে। ‘Cosmological Constant and Fundamental Physics’ বিষয়ে বললেন জন হপকিন্স
ইউনিভার্সিটির ডক্টর রমণ সুন্দরম। জ্যোর্তিবিজ্ঞানে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অবদান সর্বজনস্বীকৃত। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী সুব্রাহ্মণিয়াম চন্দ্রশেখর (Subrahmanyan Chandrasekhar, জন্ম: লাহোর, ১৯ অক্টোবর ১৯১০, মৃত্যু: ২১ আগস্ট
১৯৯৫, পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার: ১৯৮৫।) এই বিষয়ে একজন পথিকৃৎ। ডক্টর সুন্দরম নিঃসন্দেহে ভারতীয় বংশোদ্ভূত। কিন্তু এই আন্তর্জাতিক
পরিমন্ডলে তিনি প্রচন্ড
আন্তর্জাতিক। জ্ঞান যে ভৌগোলিক
সীমারেখা মানে না,
জ্ঞানের চর্চায়ও তেমনি কোন ধরনের
বর্ণান্ধতা কাজ করে
না। আমার অন্তঃত
তাই মনে হচ্ছে
এখানে। এখানে সাদা কালো
বাদামী সবাই সমান।
High resolution x-ray studies of Gloubular Clusters বিষয়ে বললেন সানফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর অ্যাড্রিয়েন কুল। অনেকগুলো মহাকাশ অবজারভেটরির নাম সুবাহ্মণিয়াম চন্দ্রশেখরের নামে রাখা হয়েছে। প্রফেসর কুল বললেন চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরি থেকে প্রাপ্ত ডাটা সম্পর্কে। আমেরিকানরা যদি ‘চন্দ্র’কে ‘ছানড্রা’ না বলে সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারতো বেশ ভালো লাগতো। কিন্তু তারা যে ‘দ’ উচ্চারণই করতে পারে না।
লস আলামোস ন্যাশনাল ল্যাবের প্রফেসর জেফরি ওয়েস্ট-এর বক্তৃতাও বেশ উপভোগ্য। তিনি বললেন বায়োলজি কীভাবে ইউনিভার্সাল স্কেলিং মেনে চলে সে বিষয়ে। অতি সূক্ষ্ণ ডি-এন-এ থেকে শুরু করে সব বায়োলজিক্যাল এলিমেন্টই নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। অবশ্য নিয়ম মেনে না চললে বা নিয়মটা ধরতে না পারলে শুরু হয়ে যায় আরো নতুন নিয়মের অনুসন্ধান। একবার জানা হয়ে গেলেই তো তা পুরনো হয়ে যায়।
পৌনে এগারোটায় ‘ব্রাজোস’ (Brazos) রুমে শুরু হলো ইউজিন উইগনার (Eugene Wigner, জন্ম: বুদাপেস্ট, ১৭ নভেম্বর ১৯০২, মৃত্যু: ১ জানুয়ারি ১৯৯৫, পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার: ১৯৬৩) সেন্টেনিয়াল। এবছর ইউজিন উইগনারের জন্মশতবার্ষিকী। উইগনারের সাথে কাজ করেছেন এরকম চার জন বক্তা এই অধিবেশনে। স্বাভাবিক ভাবেই বক্তাদের বয়স সত্তরেরও বেশি।
বেশ বড় হল এই ব্রাজোস; কানায় কানায় ভরে গেছে এর মধ্যেই। অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন পেছনে, পাশে দেয়াল ঘেঁষে। ইউজিন উইগনারের জন্ম হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে। একশ' বছর আগে, ১৯০২ সালের ১৭ নভেম্বর। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তিনি কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যায় হাতেগোনা যে ক'জন বিজ্ঞানী নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন উইগনার তাঁদের একজন। উইগনার আক্ষরিক অর্থেই স্বশিক্ষিত। বিংশ শতাব্দীর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি আছেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সঙ্গে। সিমেট্রি প্রিন্সিপলের ওপর গবেষণার জন্য তিনি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৬৩ সালে।
আজকের আলোচনার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ প্রফেসর জন হুইলার (John Archibald Wheeler)। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির এই প্রফেসর একজন জীবন্ত কিংবদন্তী। একানব্বই বছর বয়স তাঁর। আইনস্টাইন, ভন নিউম্যান, ওপেনহাইমার, নিলস বোর, এনরিকো ফারমি, হ্যান্স ব্যথে প্রমুখ উজ্জ্বল তারকা বিজ্ঞানীর সহকর্মী তিনি। যে ব্ল্যাক হোল থিওরি নিয়ে এত আলোড়ন- সেই ‘ব্ল্যাক হোল’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন জন হুইলার। রিচার্ড ফাইনম্যানকে বলা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষক। আর জন হুইলার হলেন ফাইনম্যানের শিক্ষক- রিসার্চ অ্যাডভাইজার।
জন হুইলার |
জন হুইলারের নাম ঘোষণার সাথে সাথে সারা হলে পিনপতন নিঃস্তব্ধতা। উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর হুইলার। একানব্বই বছরের ভারী অশক্ত শরীর। কিন্তু এখনো কত ঋজু। কথা সামান্য জড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বুঝতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। জন হুইলার বলছেন উইগনারের এলিমেন্টারি কোয়ান্টাম ফেনোমেনা সম্পর্কে।
জন হুইলার বলে যাচ্ছেন। আর আমার মনে হচ্ছে আমি দেখতে পাচ্ছি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে কীভাবে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে বিংশ শতাব্দির জটিল গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান, জটিল জটিল তত্ত্ব, যার প্রয়োগ মানবিক বা অমানবিক যে কোনটাই হতে পারে।
জন হুইলার সম্পর্কে রিচার্ড ফাইনম্যান লিখেছেন, "আমরা অনেক চেষ্টায় কোন কিছু বুঝতে পারি। আর প্রফেসর হুইলার একনজর তাকিয়েই দেখতে পান ভেতরের সবকিছু। তাঁকে বুঝতে হয়না।"
‘স্মৃতি সতত সুখের’ কথাটি হয়তো ঠিক। কিন্তু জন হুইলার কাঁদছেন। যুদ্ধ, বোমা এগুলো সম্পর্কে অনুশোচনা করছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাঁর ভাইকে হারিয়েছেন তিনি। তার শোকে আক্রান্ত হচ্ছেন এখন। প্রশ্ন তুলছেন- কেন যুদ্ধ যা শুধু মৃত্যুই ডেকে আনে! অথচ এই হুইলার ছিলেন প্রথম হাইড্রোজেন বোমা প্রস্তুতির গবেষণা কমিটির আমেরিকান টিম লিডার। বোমার ভয়াবহতা বুঝতে এতদিন লাগলো তাঁর! তিনি না সবকিছু দেখতে পান!
হুইলারের ছেলে উঠে বাপকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। হাত ধরে বসিয়ে দিলেন চেয়ারে। হুইলার বিড়বিড় করে কথা বলছেন এখনো। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমেরিকা মূকং করোতি বাচালং’। কিন্তু দায়িত্ববান কেউ সত্য কথা বলতে শুরু করলে এবং এই সত্য কথা আমেরিকান স্বার্থবিরোধী হলে আমেরিকা মুহূর্তেই ‘বাচালং করোতি মূকং’ ভূমিকা নেয়। জন হুইলারের আজকের সত্যভাষণকে তারা বলবে বৃদ্ধের প্রলাপ। তাদের রক্তপিপাসু বোমাপ্রকল্পের কাজ করার জন্য মেধাবী মুখের অভাব হবে না কখনোই। কবি সুবোধ সরকার ঠিকই লিখেছেন, “ছেলে খারাপ হলে সারা পাড়া অভিশাপ দেবে, আর ভালো হলে আমেরিকা কেড়ে নেবে।”
হায়াত রিজেন্সির লবিতে বসে কথা হচ্ছিলো প্রফেসর ম্যাককারনান ও তাঁর স্ত্রীর সাথে। জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির প্রফেসর বেরি ম্যাককারনান। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী আজ অন্য হোটেলে চলে যাচ্ছেন।
"কোথায়?"
"শেরাটনে। এখানে ভাড়া খুব
বেশি।"
তার মানে হায়াত রিজেন্সির তুলনায় শেরাটন অনেক সস্তা হোটেল! আমার তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হলো না এই তথ্যে। আমি তো আরব্য রজনীর আবুহোসেন। আজ এখানে- কাল হয়তো ফুটপাতে।
ম্যাককারনান দম্পতি চলে গেলেন। স্টিভেন আর ডেবির মদের তেষ্টা পেয়েছে। হোটেলের বারে গিয়ে বসলাম। আমার জন্য কমলার রস আর তাদের জন্য বিদ্ঘুটে নামের একটি পানীয়ের অর্ডার দিলো স্টিভেন। কড়া মদ। খেতে হয় নুন মিশিয়ে। নুনে মদের গুণ বাড়ে নাকি কমে? এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর পেলাম না তাদের কারো কাছ থেকে।
স্টিভেন খুব মেধাবী ইয়ং সায়েন্টিস্ট। এই বয়সেই তার অভিজ্ঞতা অনেক। মেলবোর্নে থাকতে রেডিওতে সায়েন্স টকশো করতো। তাকে প্রশ্ন করলাম, "একজন সাধারণ মানুষকে তুমি কীভাবে অল্পকথায় তোমার গবেষণাকর্ম বোঝাবে?"
প্রশ্নটা গত সন্ধ্যায় আমাকে করেছিলো স্কটিশ লুই। স্টিভেন তার মতো করে বলে গেলো অনেককিছুই। যার অংশবিশেষ আমি নিজেই বুঝতে পারলাম না। কেবল বুঝলাম এই যে, সরল জিনিস জটিল করে ফেলা যায় সহজে, কিন্তু জটিল বিষয় সহজ ভাবে বলা বেশ কঠিন।
স্টিভেন আর ডেবিকে বারে বসিয়ে রেখে বেরিয়ে এলাম। পড়ন্ত বিকেলের আলবুকার্কি। অল্প একটু রোদ আছে এখনো। বেশ ভালো লাগছে ফাঁকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে।
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে ‘নিউ মেক্সিকান হলোকাস্ট এন্ড ইনটলারেন্স মিউজিয়াম।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের ওপর নাৎসি বাহিনীর অত্যাচারের ইতিহাস ও দলিল-পত্রের জাদুঘর। মানবতার ওপর জঘন্য অত্যাচার এখনো কি চলছে না? নতুন নতুন ছোটবড় হিটলার এখন পৃথিবীর সব জায়গাতেই তো ছড়িয়ে আছে।
আলবুকারকির ঐতিহাসিক স্থাপত্য অনেক। কিমো (Kimo) থিয়েটার বিল্ডিংটা দেখার মতো। কপার স্ট্রিটের পাবলিক লাইব্রেরি দেখতেও খুব ভালো লাগলো। হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট, নিউ মেক্সিকোর প্রথম গির্জা সব দেখে বেড়ালাম।
পাবলিক লাইব্রেরি |
৬৬ নম্বর রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকেও ইতিহাসের অংশ বলে মনে হচ্ছে। আমরা তো সবাই ইতিহাসেরই অংশ। এই ইতিহাসের কেউ কেউ রাজা বাদশা, আর আমার মত অনেকেই হতদরিদ্র প্রজা।
৬৬ নম্বর রোড থেকে যে রাস্তাটা চলে গেছে সান্টা ফে’র দিকে সেখানে একটা ব্রিজ আছে। দু'পাশে রেলিং। রেলিং-এর ধারে পা ঝুলিয়ে বসা যায়। গোধূলির আলোয় রাঙা চারদিক। ব্রিজের লাল পিলারগুলো এখন আরো লাল। রাস্তাভর্তি গাড়ি এখন। কাল সোমবার। তাই ঘরে ফিরছে মানুষ। কর্মসমুদ্রে ঝাঁপ দেবে আবার কাল সকালে। এর নামই কি কর্মযজ্ঞ? মানুষ কি সুখী তাদের এই নৈমিত্তিক কর্মে? হয়তো বা, হয়তো না।
আমার চিন্তায় জুড়ে বসছে দর্শন। বিজ্ঞান আর দর্শন হাত ধরাধরি করে চলে। চলে পাশাপাশি। কিন্তু কোন কোন সরু পথে হাত তো ছাড়তেই হয়। স্বাধীনভাবে চলতে হয় একা। বিজ্ঞানীরা কি স্বাধীন? তারা কি সবসময় সত্য বলে? না সত্য চেনে? এই যে এখানে এখন সম্মিলিত হয়েছে হাজারখানেক পদার্থবিজ্ঞানী, আগামী বছরগুলোতে এদের মধ্য থেকেই কেউ কেউ পাবে নোবেল পুরষ্কার, আইনস্টাইন পুরষ্কার কিংবা জুটবে আরো আরো অনেক জয়টীকা। অনেক বছর পরে তারাই আবার অনুশোচনা করবে তাদেরই কোন কাজের জন্য- যেমন করছেন জন হুইলার।
বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আজকের মানুষ সবকিছুতেই হয়ে উঠছে যুদ্ধং দেহি। এই আমেরিকাতেই এখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে নানারকম অপবিজ্ঞান। কুসংস্কারকে এখানে প্রচার করা হচ্ছে ইন্টারনেটে। ইউনিভার্সিটির রিসার্চ গ্রান্ট কমিয়ে বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সামরিক বাজেট। একজন আইনস্টাইনের চেয়েও একজন ব্রিগেডিয়ার এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির কর্মকর্তারা সবার হাত ধরছেন সিনেট মেম্বারের কাছে বাজেট বাড়ানোর জন্য লেখা আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করতে। আমিও সাইন করেছি সকালে। শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জনের জন্য গবেষণায় এখন কোন অর্থবরাদ্দ দেয়া হচ্ছে না। যে কোন রিসার্চ-প্রপোজালেই দেখাতে হচ্ছে প্রজেক্ট থেকে কী পরিমাণ অর্থ উপার্জন সম্ভব।
মুক্তির গান গাই আমরা নিজেরা মুক্ত নই বলেই। ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, এই আকাশে’- রবীন্দ্রনাথ তুমি তো জানো না- এই আলো আকাশ আজ আর মুক্ত নেই। এই আলোয় এখন মানবতার ক্ষতবিক্ষত লাশ, আর হিংস্র মারণাস্ত্র পেটে নিয়ে আকাশে ভেসে বেড়ায় হরেক রকমের যুদ্ধ-বিমান।
_______
No comments:
Post a Comment