দক্ষিণ
গোলার্ধ থেকে উত্তরে
ফ্লাইট
QF93
মেলবোর্ন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে কোয়ান্টাস ফ্লাইটের সুবিধা হলো এর কাউন্টারগুলো সবসময় খোলা থাকে। ফলে যে কোন সময়ে চেক
ইন করে বোর্ডিং
পাস নেয়া যায়। আর অসুবিধা হলো কোয়ান্টাসের
সবগুলো ফ্লাইটেরই বোর্ডিং পাস একই
সময়ে দেয়া হচ্ছে
বলে লাইনের দৈর্ঘ্য খুব বেশি। কাউন্টারের সংখ্যা যদিও বিশটি,
কাউন্টারে প্রবেশ পথ মাত্র
একটি। আমার ফ্লাইট সোয়া দশটায়। এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছেছি
সাড়ে সাতটায়। এসেই লাইনে
দাঁড়িয়েছি। আরো কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ঠিক
বুঝতে পারছি না। সমস্ত
লাগেজ খুলে খুলে
দেখছে সিকিউরিটি
অফিসাররা।
আমেরিকা যাবার ঝক্কি কম নয়। লাইনের পাশে সিকিউরিটি
গার্ড টহল দিচ্ছে। কয়েকজন কুত্তাওয়ালী অফিসারকেও দেখা যাচ্ছে। লাগেজের ওপর আক্ষরিক
অর্থেই কুত্তা লেলিয়ে দিচ্ছে। একটি কুকুর
আমার ছোট্ট লাগেজটিতে নাক লাগিয়েই
সরিয়ে নিলো। পছন্দ
হয়নি। পছন্দ হলেই বিপদ। সবকিছু খুলে আবার
নতুন করে প্যাক
করতে হবে। কারো
লাগেজ সন্দেহজনক মনে হলেই
কাউন্টার থেকে পাঠিয়ে
দিচ্ছে এক্সক্লুসিভ চেকিং অ্যারিয়ায়। ওখানে ব্যাগ খুলে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখা হচ্ছে। কী খুঁজছে তারাও হয়তো জানে
না। এসমস্ত বিটকেলে আয়োজন দেখতে দেখতে কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে গেলেও
এখনো কেমন জানি
নার্ভাস লাগে।
"পাসপোর্ট অ্যান্ড টিকেট প্লিজ।"
কাউন্টারের ওপাশে
ঝলমলে অস্ট্রেলিয়ান তরুণী। পাসপোর্ট আর টিকেট
বাড়িয়ে দিতেই একগাল হাসি।
"গোয়িং এল-এ?"
এই এক জ্বালা এদের নিয়ে। সংক্ষেপে করবে সবকিছু। লস এঞ্জেলেস বলে এনার্জি
বা টাইম কোনটাই
লস করতে রাজি
নয়। আমি যাচ্ছি
আলবুকারকি। কিন্তু এদের দায়িত্ব
হলো আমাকে লস অ্যাঞ্জেলেস পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া। সেখান
থেকে আলবুকার্কি নিয়ে যাবে
আমেরিকান ফ্লাইট। কিন্তু আমার লাগেজে
শেষ গন্তব্যের সিল এখান
থেকেই লাগিয়ে নিতে হবে।
আমার পাসপোর্টটা
উল্টে-পাল্টে দেখলো
বেশ কয়েকবার। ছবি মিলিয়ে
দেখলো। পাসপোর্টে ছবিটা আট বছরের
পুরনো। আমার বর্তমান
চেহারার সাথে নাও
মিলতে পারে। কিন্তু
মানুষের চেহারার কিছু মৌলিক
বৈশিষ্ট্য সম্ভবত বদলায় না। তাই
ছবি নিয়ে কেউ
কিছু বলেনি কখনো। অবশ্য
আমেরিকান ভিসার ওপর আমার
সাম্প্রতিক ছবি প্রিন্ট
করা আছে। ছবি
নিয়ে সমস্যা হবার কথা
নয়। কিন্তু মেয়েটি খুঁজছে কি এদিক
ওদিক? কাউন্টারে কয়েকটা
ড্রয়ার খুলে দেখলো। তারপর পাশের কাউন্টারের মেয়েকে জ্ঞিজ্ঞেস করলো, “বাংলাদেশের কোড কী জানো?” ওদিক থেকে
স্বাভাবিক ভাবেই নেগেটিভ উত্তর পাওয়া গেলো। এই এয়ারপোর্টে বাংলাদেশের পাসপোর্ট হয়তো খুব
একটা আসে না। এলেও হয়তো এই কাউন্টারে নয়। তাই
বাংলাদেশের কোড মনে
রাখে না এরা। কোডটা জানা ছিলো। বললাম, "বি-জি-ডি"।
কোডের ব্যাপার মিটলো। এবার শুরু
হলো গৎ বাঁধা প্রশ্ন। ব্যাগে বন্দুক-পিস্তল, ছুরি-কাঁচি, আগুন-বোমা এ ধরনের কিছু আছে কিনা। আমি নিজে ব্যাগ
গুছিয়েছি কিনা, কেউ আমাকে
কিছু গছিয়েছে কিনা সাথে
নেবার জন্য ইত্যাদি। সবাইকে এই প্রশ্ন
করতে হয় বলেই
করা। কেউ কি এসবের উত্তরে বলবে- “হ্যাঁ, আমার ব্যাগে
রয়েছে শক্তিশালী বোমা। আমি
প্লেন হাইজ্যাক করার বদ উদ্দেশ্য নিয়ে প্লেন
ভ্রমণ করছি। হাঃ
হাঃ হাঃ!”
হাতের কেবিন-ব্যাগ নিয়েও সমস্যা। এখন সাথে
শেভিং রেজরও রাখতে দেয় না। শুধু কি রেজর?
চোখা পেনসিল পর্যন্ত বের করে
চেক-ইন ব্যাগে
চালান করতে হলো। লাগেজ বেশি হলেও
ঝামেলা। তখন হয়তো
বলবে, “এতদূরে যাবা অথচ
কোন লাগেজ নেই সাথে
(অথবা এত ছোট
লাগেজ!) তোমার মতলব তো ভালো না। তুমি
মিয়া নিশ্চয় মাঝ আকাশে
সন্ত্রাস শুরু করবা।”
এতসব দেখে
হাসিও পায়, আবার হাসতে
ভয়ও পাই। বোর্ডিং পাস নিয়ে
আর একটুও দাঁড়ালাম না এখানে। ইমিগ্রেশান পার হয়ে
সোজা এগারো নম্বর গেট। এয়ারপোর্টের
সিকিউরিটি খুব টাইট
এখন। এমনি দেখে
অবশ্য বোঝা যায়
না। কিন্তু নানারকম পোস্ট পার হয়ে
আসতে গেলে বোঝা
যায়।
১১নং গেইটে
হলুদ রঙের ডিজিটাল
সাইন জ্বলছে: কোয়ান্টাস
ফ্লাইট: কিউ এফ নাইনটি থ্রি। মেলবোর্ন
টু লস এঞ্জেলেস।
ফ্লাইট টাইম: ১০:১৫।
বোর্ডিং
শুরু হবে সাড়ে
ন'টায়। এখনো অনেক সময়
আছে। কিন্তু সিকিউরিটি চেক নামক
প্রক্রিয়াটির এখনো অনেক
কিছুই বাকি। ১১ নম্বর গেটের পুরো এলাকা ঘিরে রাখা হয়েছে অস্থায়ী দেয়াল দিয়ে। দৈত্যাকার
সব সিকিউরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধ
টেবিলের ওপাশে। এবার সাথে
যা কিছু আছে
সব চেক করে
দেখবে। ম্যানুয়েল চেক।
আমার ব্যাগ
খুলে সব জিনিস
দেখলো। দেখে অসন্তুষ্ট
হওয়ার মত কিছু
না পেয়ে নিজেরাই
ব্যাগ বন্ধ করে
হাতে না দিয়ে
পার করে দিলো
টেবিলের সীমানার ওপারে। সবার জন্যই
এই ব্যবস্থা। যাত্রীদের একে একে
যেতে হলো ছোট
একটা গলি পথ দিয়ে। গলির মুখে
স্ক্যানার হাতে দাঁড়িয়ে
আছে আরো কিছু
নিরাপত্তা কর্মী। সারা গায়ে
স্ক্যানার লাগিয়ে দেখলো। জুতার তলাও বাদ
গেলো না। অনেককে
জুতা খুলতেও বলা হলো। আমি অবশ্য জুতা খোলার
হাত থেকে বেঁচে
গেছি পাতলা সোলের জুতা পরাতে। কিছুদিন আগে একজন
যাত্রী জুতার ভেতর বিস্ফোরক
নিয়ে প্লেনে উঠেছিলো। সে ধরা
পড়ার পর থেকেই
সবার দৃষ্টি এখন জুতার
দিকে। এভাবে চলতে থাকলে
কিছুদিন পরে হয়তো
প্লেনের দরজায় লেখা থাকবে: ‘জুতা পায়ে প্রবেশ নিষেধ।”
বোয়িং ৭৪৭। যাত্রীবাহী
বিমানের মধ্যে কুলীন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। আমার সিট
জানালার পাশে। সবগুলো
সিটের সামনেই ন’ইঞ্চি
টেলিভিশন মনিটর। সিটের হাতলে লাগানো আছে তার
কন্ট্রোল। সিনেমা, ভিডিও গেম, রেডিও প্রোগ্রাম সব ধরনের আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা। একটা মোবাইল
টেলিফোন সেটও আছে। মাঝ আকাশ থেকে
টেলিফোনও করা যাবে
যেখানে খুশি। শুধু
একটি উঁচু মানের
ক্রেডিট কার্ড সাথে থাকলেই
হলো।
এয়ার হোস্টেজের
প্রচলিত এবং আকাঙ্ক্ষিত
মূর্তির সাথে কোন
মিল নেই এই ফ্লাইটের এয়ার হোস্টেজদের। এদের সবাই মনে হচ্ছে
চল্লিশ পেরিয়ে এসেছেন অনেক বছর আগে। “ওয়েলকাম অ্যাবোর্ড” “গুড মর্নিং”
এসব বলার সময়
নিজেদের সেরা হাসিটাই
উপহার দিচ্ছেন সবাই, কিন্তু মনে হচ্ছে
চোখে মুখে কেমন
শক্ত রকমের যান্ত্রিকতা। এতটা বিরক্ত
কেন এরা এদের
পেশার ওপর? নাকি আমেরিকা
যেতে ভয় পাচ্ছেন
ইদানিং?
ঠিক সোয়া
দশটায় প্লেনের চাকা ঘুরতে
শুরু করলো। বোর্ডিং
ব্রিজ থেকে পিছিয়ে
রান-ওয়ের দিকে
এগোচ্ছে বিশাল ডানার ক্যাঙারু আঁকা কোয়ান্টাস
বিমান। অনেকে বলেন, কোয়ান্টাস কখনোই ঠিক সময়ে
উড়তে পারে না। আমার নিজেরও অভিজ্ঞতা সেরকমই। কিন্তু আজ দেখছি
একদম ঘড়ির কাঁটা
মেনে চলছে।
মাইক্রোফোনে পাইলটের গলা শুনে
মনে হচ্ছে তিনি খুব
আনন্দে আছেন। হাসতে
হাসতে বলছেন, “আমরা এখন
কন্ট্রোল রুমের ক্লিয়ারেন্সের জন্য অপেক্ষা
করছি। কয়েক মিনিটের
মধ্যেই আপনাদের নিয়ে আকাশে
উঠে যাবো, আপনারা দয়া করে
সিট বেল্ট ..." ইত্যাদি ইত্যাদি।
জানালায় চোখ রেখে
তাকিয়ে আছি যতদূর
চোখ যায়। আকাশ
দেখা যাচ্ছে দূরের মাঠ পেরিয়ে
দিগন্তে গিয়ে মিশেছে। মেলবোর্নের আকাশ আর আমেরিকার আকাশে কি কোন
পার্থক্য আছে? মেলবোর্ন থেকে আমেরিকা-
আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবীর দক্ষিণ প্রান্ত থেকে উত্তর
প্রান্তে। এখনো নিশ্চিত
নই পৌঁছাবো কিনা। সম্ভাবনার
সূত্র অনুযায়ী পৌঁছানোর সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ।
নানারকম এলোমেলো চিন্তার মাঝখানেই শুনতে পেলাম যাত্রীদের মৃদুগুঞ্জন। প্লেন থেমে আছে
রানওয়ের মাঝখানে। আমার পাশের
সিটের টেকো অস্ট্রেলিয়ান (যার
কব্জিতে কিম্ভুতকিমাকার উল্কি দেখেই আমি চোখ
ফিরিয়ে নিয়েছি) হঠাৎ “ওহ নো” বলে চেঁচিয়ে উঠলো। দেখলাম প্লেন টেক অফ করার বদলে আস্তে
আস্তে পিছু হটতে
শুরু করেছে। ব্যাক টু দ্যা
প্যাভেলিয়ন। বোমা টোমা
নয়তো? না- যান্ত্রিক গোলযোগ। ইঞ্জিনে নয়, প্লেনের দরজায়। পেছনের একটি দরজা
নাকি খুলে যাচ্ছে
প্রেসারে। তার মানে
মাঝ আকাশে হঠাৎ দেখা
যাবে একটি দরজা
খুলে গেছে আর কেউ একজন দরজার
হাতল ধরে ঝুলছে। সিনেমাতেই সম্ভব ও'রকম।
কিছুদিন আগেও কোয়ান্টাসের
অন্য একটা ফ্লাইটে
এরকম সমস্যা হয়েছিলো। ক্রু ও যাত্রীরা দরজার হাতল টেনে
ধরে সে যাত্রায়
রক্ষা পেয়েছে বড় কোন
দুর্ঘটনার হাত থেকে। এবার হয়তো সেরকম
ভয় থেকেই বেশি সাবধানী
হয়েছে। এখন পাইলটের
গলা শুনে মনে
হচ্ছে তার হঠাৎ
ভীষণ ঠান্ডা লেগে গেছে।
প্লেন কতক্ষণে আকাশে উড়বে বলা
যাচ্ছে না। যাত্রীরা
হৈ চৈ শুরু
করে দিয়েছে। পেছনের সিটের মহিলা বলছেন, “আমার জিম
অস্থির হয়ে যাবে।”
জিম যেন আর জানে না যে প্লেনে দেরিও হতে পারে। জিমের সমস্যা কোন সমস্যাই
নয়। আসল সমস্যা
হবে আমার। লস অ্যাঞ্জেলেসে ঠিক সময়ে
পৌঁছাতে না পারলে
আমি মিস করবো
ডেনভারের ফ্লাইট। ওটা মিস
করলে আলবুকার্কির ফ্লাইটও মিস করবো। আর স্টিভেন এসে যখন
দেখবে আমি নেই-
তখন?
কোন সমস্যায়
পড়লে তার সমাধান
যদি আমার হাতে
না থাকে আমি
চেষ্টা করি সমস্যাটা
নিয়ে না ভেবে
অন্য কিছু নিয়ে
ভাবতে। মজার কিছু। এখন ভাবতে ইচ্ছে করছে আমি
ঠিক সময়ে আলবুকার্কি না পৌঁছালে স্টিভেন কী করবে?
স্টিভেন আমার সতীর্থ। কেনের পুরনো ছাত্র। এখন লস আলামোস ন্যাশনাল ল্যাবে কাজ করছে। আলবুকারকিতে সে আমাকে
সঙ্গ দেবে। তাছাড়া
আমাদের দুটো পেপারের
একটা উপস্থাপন
করবে স্টিভেন, অন্যটা আমি। তো স্টিভেন আমাকে রিসিভ করতে এসে
যদি দেখে প্লেন
এসেছে কিন্তু আমি আসিনি!
সে কি আমার
দিদির মতো ভাববে
যে আমি ঘুমিয়ে
পড়েছি ডেনভারে বা লস অ্যাঞ্জেলেস এয়ারপোর্টের বেঞ্চিতে? ভাবতেই হাসি পেলো।
গতবার মেলবোর্ন থেকে বাড়িতে
যাবার সময় শেষ
মুহূর্তে লাগেজের জন্য আটকে
যাই ঢাকা বিমানবন্দরে। লাগেজ-ট্রলি প্লেন থেকে ক্যারিয়ার
বেল্টে আসার মাঝখানে
চীনের প্রধানমন্ত্রী আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী
দু'জনই এয়ারপোর্টে চলে আসার
ফলে রান-ওয়ের সব কাজ থেমে যায়। আমাকেও বসে থাকতে
হয় কাস্টমস এরিয়ায় লাগেজ বেল্টের ওখানে। বেশিরভাগ যাত্রীই লাগেজ নিয়ে টার্মিনালের
বাইরে চলে গেছেন
এর মধ্যে। অনেকক্ষণ পরেও বেরোচ্ছি
না দেখে দিদি
ভেবেছে আমি ব্যাংককের
কানেক্টিং ফ্লাইট মিস করেছি। কারণ কী? আমি নাকি
ঘুমিয়ে পড়েছি এয়ারপোর্টে। আমি ঘুমকাতুরে
সেটা মানি। কিন্তু
তা বলে এতটা?
দিদির সাথে স্টিভেনের
যদি দেখা হতো
দিদি নিশ্চয় স্টিভেনকে সাবধান করে দিত
আমার ঘুমের ব্যাপারে।
“উড ইউ লাইক টু হ্যাভ আ ড্রিংক
স্যার?”
আমাকে আপন মনে
হাসতে দেখে এয়ারহোস্টেজও
হাসছিলেন। আমাদের জন্য কোমল
পানীয় আর প্লেনের
অসুস্থ দরজার জন্য বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার, যন্ত্রপাতি সব চলে
এসেছে এর মধ্যে। ভিডিওতে হাসির ছবি চালিয়ে
দেয়া হয়েছে- যেন আমরা
হাসতে হাসতে ভুলে থাকতে
পারি যে আমাদের
দেরি হয়ে যাচ্ছে।
অবশেষে পৌনে বারোটায়
প্লেন উড়লো আকাশে। চল্লিশ হাজার ফুট উপরে
ওঠার পরে বাইরে
তাকিয়ে দেখার মত বেশি
কিছু থাকে না। সবকিছু একই রকম
লাগে। ফলে মনে
হয় প্লেনের গতিবেগ শূন্য। চোখ রাখলাম
টিভি স্ক্রিনে। মিউজিক, ফিল্ম, কমেডি ইত্যাদি সব মিলিয়ে অনেকগুলো চ্যানেল। বেশি
চ্যানেল থাকলে যা হয়-
কোনটিতেই মন বসানো
যায় না ঠিকমতো। হ্যারিপটার সিনেমাটা সাম্প্রতিককালে খুব চলছে। কৌতুহলী হয়ে ছবিটা
দেখতে শুরু করলাম। একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তি ব্যবহার করে যা দেখানো হচ্ছে তা হলো
ঠাকুরমার ঝুলির গল্প, ডাইনি-চর্চা। ভূমি থেকে
চল্লিশহাজার ফুট উপরে
বোয়িং ৭৪৭ এর পেটে বসে দেখছি
মুড়ো ঝাঁটায় চড়ে উড়ে
যাচ্ছে বালক হ্যারি
পটার। ইদানিং পশ্চিমা টিভিতে প্রচুর আধাভৌতিক কাহিনি দেখানো হচ্ছে। সেসব ধারাবাহিক
কাহিনির নায়ক নায়িকারা
কম্পিউটার এবং অলৌকিক
শক্তি দুটোই ব্যবহার করে। ফলে
প্রচুর বিজ্ঞান পড়ুয়া পাওয়া যায় যারা
'অলৌকিক বলে কিছু
নেই' এ সত্যের ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত।
রুটম্যাপে দেখা যাচ্ছে
প্লেন ঘন্টায় প্রায় নয়শো কিলোমিটার
বেগে চলছে। আরো
দশ ঘন্টা লাগবে লস অ্যাঞ্জেলেসে পৌঁছাতে। একনাগাড়ে পাঁচ ছয় ঘন্টা বসে থাকলে
নাকি ডি-ভি-টি বা ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস
হতে পারে। পায়ে
রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে
রক্তজমাট বেঁধে গিয়ে হৃৎপিন্ডে
চাপ পড়ে। দুর্বল
হৃৎপিন্ডের মানুষ অনেক সময়
এই চাপ সহ্য
করতে পারে না। সুতরাং সাবধানে থাকা ভালো। সাবধানে থাকার সহজ উপায়
হলো বসে বসে
পা নাড়ানো। চেয়ারে বসে কাউকে
পা নাড়াতে দেখলে আমরা যে অনেক সময় মানুষটার
ভদ্রতাবোধ নিয়ে প্রশ্ন
করি, তা আর করা উচিত নয় বলে মনে হচ্ছে। টেলিভিশনে একটা চ্যানেলে
সারাক্ষণই দেখানো হচ্ছে বসে বসে
কীভাবে পায়ের ব্যায়াম করা উচিত। পা টেনে সোজা
করে আবার গুটিয়ে–
নানারকম কসরত। হাতের,
বাহুর, ঘাড়ের ব্যায়ামও আছে। তারপরেও
বলা হচ্ছে প্রচুর জলীয় পদার্থ গ্রহণ করতে। ফলে
লাভ- হেঁটে টয়লেটে যেতে হবে, পায়ে রক্ত
চলাচল বাড়বে।
অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে ইতোমধ্যে। বাইরের আলো এত তাড়াতাড়ি কমার কথা
নয়। আমার ঘড়িতে
এখনো মেলবোর্নের সময়। বিকেল
চারটা বাজে মাত্র। বাইরের আকাশ দেখে
মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। প্লেনের প্রায় সবগুলো জানালার পর্দা নামানো, ভেতরের বাতিও নেভানো। আমার পাশের
সিটের উল্কিওয়ালা হা করে
ঘুমাচ্ছে। চেষ্টা করলাম একটু ঘুমিয়ে
নিতে। কিন্তু খুব একটা
সুবিধা হলো না। জানালায় চোখ রাখলাম।
আকাশ কালো
হয়ে আসছে। ভূমিতে
এ বাক্যের প্রচলিত অর্থ হলো
আকাশে মেঘ। কিন্তু
এখানে এত উপরে
মেঘ নেই। সাদা
মেঘের আস্তরণ অনেক নিচে। চলেছে ভেসে ভেসে। তাদের সাথে আমার
মনও “মেঘের সঙ্গী, উড়ে চলে
দিকদিগন্তের পানে, নিঃসীম শূন্যে।”
একটু চোখ
লেগে এসেছিলো। এসময় সব লাইট জ্বলে উঠলো। ডিনার
টাইম। পশ্চিমা খাবার। ‘ভাতের বদলে আলু
খান’ আমাদের বেলায় এখনো স্লোগান
হলেও এদের বেলায়
তা আক্ষরিক ভাবেই সত্য। কাটলারির
প্যাকেটে কাটাঁচামচ দিয়েছে স্টিলের আর ছুরি
দিয়েছে প্লাস্টিকের। আমি এসব
ব্যাপারে মোটেই খুঁতখুঁতে নই। কিন্তু
আমার উল্কিমারা সহযাত্রী মুখ খুললো, “প্লেনের আভিজাত্যের সাথে এটা
কেমন বিসদৃশ্য লাগে না?
হয়তো বিজনেস ক্লাসের সাথে ইকোনমি
ক্লাসের পার্থক্য বোঝানোর জন্যই এটা করা
হয়েছে।”
তার সাথে
আলাপ চালিয়ে যাবার ব্যাপারে আমি কোন
উৎসাহ পাচ্ছি না। কোন রকমে
সামান্য মাথা নাড়ালাম। মনে করেছিলাম এতেই আমার
মুক্তি ঘটবে। কিন্তু
সবে তো শুরু। খাবার মুখে দিতে
না দিতেই এই লোক
তাজা হয়ে গেছে। এবার মহা উৎসাহে
অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা শুরু করলো।
“বিজনেস
ক্লাসের ভাড়া যত বাড়বে ততোই তাদের
মানে ওই ক্লাসে
যারা ভ্রমণ করে তাদের
লাভ। কারণ ঐ টিকেটের দাম তো দেবে কোম্পানি। নিজের টাকায় কেউ ভ্রমণ
করবে ওই ক্লাসে!
পাগল হয়েছো তুমি! আর ওই টাকার ট্যাক্সও দিতে হয় না।”
বুঝতে পারছি ভদ্রলোক কোন কারণে ব্যবসায়ীদের
প্রতি নাখোশ। যে কারণে
মধ্যবিত্তরা উচ্চবিত্তদের সাক্ষাতে তোয়াজ আর পশ্চাতে
বদনাম করে- এও ঠিক
সেরকমই।
আমার চোখ
মাঝে মাঝে তার
মুখের দিকে ফিরলেও
মন আর তার
লেকচারে নেই। মানুষ
যদি মানুষের মনের কথা
সব বুঝতে পারতো! তখন মানুষ
হয়ে পড়তো খুব
অসুখি। মানুষের অক্ষমতাই অনেক সময়
মানুষকে আনন্দে রাখে। যেমন
এ মুহূর্তে এই টেকো
অস্ট্রেলিয়ান ভাবছে একজন কালো
ইন্ডিয়ানকে অর্থনীতির জ্ঞান বিতরণ করছে। মনে
মনে নিজেকে অমর্ত্য সেন ভেবে
আনন্দই পাচ্ছে। আমার দেঁতো
হাসি সে দেখতে
পাচ্ছে, কিন্তু বুঝতে পারছে না- এই হাসির
অর্থ হচ্ছে- ঢাকের বাদ্যি থামলেই মিষ্টি লাগে।
ডিনারের পর রঙ বেরঙের কোমল কঠিন
পানীয় সরবরাহের পাশাপাশি দুটো অবশ্য
পূরণীয় ফরম হাতে
ধরিয়ে দিলো একজন
এয়ারহোস্টেজ। সামনের টিভি মনিটরে
ভেসে উঠেছে কীভাবে ফরম দুটো
পূরণ করতে হবে। সাদা রঙের আপাত
নিরীহ ফরমটি হচ্ছে কাস্টমস ডিক্লারেশান। বেশ কিছু
কমন প্রশ্ন আছে এখানে। খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যাচ্ছি
কিনা। শরীরে রোগ-জীবাণু আছে কিনা। আফ্রিকার জঙ্গলে ঘুরেছি কিনা কিংবা
পাগলা গরুর সংস্পর্শে
এসেছি কিনা ইত্যাদি। আরেকটা মজার প্রশ্ন
হলো কারো জন্য
কোন গিফট নিয়ে যাচ্ছি
কিনা। যদি নিয়ে
যাই তাহলে তার মুল্য
কত? একশ' ডলারের বেশি হলে
তার জন্য ট্যাক্স
দিতে হবে। কাউকে
কিছু গিফ্ট করার ঝামেলাও
তো কম নয় আমেরিকায়। আমার ব্যাগে
স্টিভেনের জন্য দুটো
অডিও সিডি আছে। ওদুটোর দাম নব্বই
ডলার। অল্পের জন্য ট্যাক্সের
হাত থেকে রেহাই
পাওয়া গেলো বলে
একটু হালকা লাগলো। অথচ ওগুলো
কেনার সময়ও টেন
পার্সেন্ট জি-এস-টি দিতে
হয়েছে।
অন্য ফরমটি
দৈর্ঘ্যে সামান্য লম্বা। নাম আই-নাইন্টিফোর (I-94)। আই-টুয়েন্টির সাথে অল্প
একটু পরিচয় ছিলো আগে। কিন্তু নাইন্টিফোর নম্বর ফরমটা দেখলাম এই প্রথম। আমেরিকার ভিসা পেলেই
যে আমেরিকায় ঢুকতে দেবে তার
কোন গ্যারান্টি নেই। আই-এন-এস নামক এক ধরনের
বদমেজাজী অফিসারের হাতে সর্বময়
ক্ষমতা দেয়া আছে
এ ব্যাপারে। আই-এন-এস হলো
ইমিগ্রেশান এন্ড ন্যাশানালাইজেশান সার্ভিস। আই-এন-এসকে সন্তুষ্ট
করতে না পারলে
এয়ারপোর্ট থেকেই বিদায় নিতে হবে। সুতরাং বলা হচ্ছে
আই-নাইন্টিফোর ফরমটা যেন অত্যন্ত
মনযোগ দিয়ে পূরণ
করা হয়।
বাংলাদেশের পাবলিক পরীক্ষার ফরম পূরণের
সময় ছাত্রছাত্রীরা যে রকম
সর্তকতা অবলম্বন করে সেরকম
সতর্কতার সাথে ফরম
পূরণ করতে শুরু
করলাম। বর্ণ বৈষম্য
এখানে ফরমেও আছে। যেন
রঙ দিয়ে চেনা
যায়। আমেরিকায় ভ্রমণের জন্য যাদের
ভিসা নিতে হয় না সেই নীল
রক্তের লোকজনের জন্য নীল
রঙের ফরম। আর আমাদের মত সাদামাটা
দেশের নাগরিক যাদের অনেক কাঠ-খড়-তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ পুড়িয়ে ভিসা নিতে
হয় তাদের জন্য সাদা
রঙের আই-নাইন্টিফোর ফরম। মোট
সতেরটা প্রশ্নের
উত্তর লিখতে হলো এই ফরমে। এক থেকে
চার আর চৌদ্দ থেকে সতের নম্বর প্রশ্নের উত্তর একই রকম
হতে হবে। কম্পিউটারের
জন্ম এই আমেরিকায়। অথচ আই-নাইন্টিফোর ফরমটি কম্পিউটারে চেক করার
জন্য তৈরি করা
হয়নি।
একে একে
সবগুলো বাতি নিভে
গেলো। যে যার
মত ঘুমিয়ে নিচ্ছে। পাশের উল্কিওয়ালার মুখ আবারো
হা হয়ে গেছে। এই হা-এর ব্যাসার্ধ হয়তো তার ঘুমের গভীরতার সমানুপাতিক।
আমার ঘুম
আসছে না। প্লেন
ছুটছে তার নিজস্ব
গতিতে। সামনের মনিটরে প্লেনের গতিপথ দেখে নিলাম। প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে
চলছে আমাদের প্লেন। আমেরিকার পূর্বদিকে আটলান্টিক আর পশ্চিমে
প্রশান্ত মহাসাগর। পুবের মানুষ আমি, দক্ষিণে সরে এসে
এখন চলেছি পশ্চিমে। একটু রোমাঞ্চতো
অন্তত লাগা উচিত। কিন্তু সেরকম কোন মানসিক
চাপ ছাড়াই বেশ ক্যাজুয়াল
ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ
করলাম।
অনেকক্ষণ পরে চোখ
খুলে জানালার পর্দা তুলতেই আমি বাক্যহারা। এমন অসম্ভব সুন্দর সকাল দেখার
জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। চল্লিশ
হাজার ফুট উপরে
একটি বায়ুযানে বসে আমি
প্রকৃতির সৌন্দর্যে অভিভূত। নিচে ঘন সাদা মেঘ। তরল
সোনারোদ যেন গড়িয়ে
যাচ্ছে বরফের চাদরের উপর দিয়ে। এমন অপরূপ সূর্যোদয় আমার জীবনে
এই প্রথম।
Hi,
ReplyDeletegreate article.Nice information thank you so much Flipkart Sbi Offer :10% Cashback Offer
Flipkart Cashback Offers
Thanks for reading.
Delete