ইউনিভার্সাল স্টুডিও
ইউনিভার্সাল সিটি হলো পৃথিবীর একমাত্র শহর যেখানে কোন মানুষ বাস করে না। হাজার হাজার মানুষের কর্মক্ষেত্র এই শহর। প্রতিদিন লক্ষ মানুষ বেড়াতে আসে এখানে। হোটেলে রাতও কাটায়। কিন্তু অফিসিয়ালি এখানে কোন আবাসিক এলাকা নেই, কারো বাসা নেই। ইউনিভার্সাল সিটি কারো বাড়ির ঠিকানা নয়।
আকাশ আজ মেঘলা। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। সকাল সোয়া আটটার মতো বাজে। মেট্রোরেলের ভূগর্ভস্থ স্টেশন থেকে ভূপৃষ্টে বেরিয়ে এসেছি একটু আগে। হলিউড অ্যান্ড হাইল্যান্ড স্টেশনের পরের স্টেশনই ইউনিভার্সাল সিটি। আজ আমি একাই এসেছি এখানে। ডেফিনরা সানফ্রান্সিসকো চলে যাবে আজ রাতে। পুরো একটি দিন ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে কাটানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সকালে যখন বেরোচ্ছি তখনও ঘুম ভাঙেনি তাদের।
হাটঁতে শুরু করলাম। একটাই রাস্তা চলে গেছে ইউনিভার্সাল স্টুডিওর দিকে। পাহাড়ি রাস্তা। কাছে দূরে বেশ কিছু পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে গায়ে বেশ কিছু বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। আরো কিছুদূর যাবার পরে ‘শেরাটন ইউনিভার্সাল’ হোটেলের কম্পাউন্ড। ফুটপাত ঘেঁষেই তাদের সাজানো বাগান। এখানকার সবকিছুই যেন সিনেমার দৃশ্য। আনকোরা নতুন মনে হচ্ছে না কোনকিছুই। যা দেখছি তাই মনে হচ্ছে আগে কোথাও দেখেছি, কোন সিনেমার দৃশ্যে বা টিভি সিরিয়ালে।
শেরাটন ইউনিভার্সালের পরে পায়ে চলা পথ শেষ হয়ে গেছে। একটি ওভারব্রিজ আছে এখানে। ব্রিজের গায়ে লেখা ‘ওয়েলকাম টু ইউনিভার্সাল সিটি।’ রাস্তার বামপাশে বহুতল কারপার্কিং ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কার পার্ক।’ ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে সবকিছুর নামই হয়তো সিনেম্যাটিক।
ওভারব্রিজ পেরিয়ে উঠে গেলাম ইউনিভার্সাল হিলে। এখানেই বিশ্ববিখ্যাত ইউনিভার্সাল স্টুডিও। গেটের কাছে বিশাল গ্লোব আস্তে আস্তে ঘুরছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। ইউনিভার্সাল স্টুডিওর লোগো এই গ্লোব।
ইউনিভার্সাল স্টুডিও- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফিল্ম স্টুডিও। এখনো ন’টা বাজেনি। এরমধ্যেই বেশ ভীড় হয়ে গেছে। আজ শনিবার। প্রচন্ড ভীড় হবে বোঝাই যাচ্ছে। গ্রীষ্মকালে সকাল আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে এই স্টুডিও। এখন গ্রীষ্মকাল নয়, সকাল নটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত প্রদর্শনী চলে। খ্রিস্টমাস ডে ও থ্যাংকসগিভিং ডে ছাড়া বছরে বাকী সবদিন খোলা থাকে এই স্টুডিও।
অনেকগুলো টিকেটঘরের সবগুলোর সামনেই এখন লম্বা লাইন। টিকেটের মূল্য বাড়াবাড়ি রকমের বেশি বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য ভেতরের সমস্ত প্রদর্শনীর প্রবেশ মূল্য টিকেটের দামের অন্তর্ভূক্ত। এখন একটি বিশেষ সুযোগ দেয়া হচ্ছে- একদিনের টিকেটের দাম দিয়ে সারাবছরের একটি ‘ইয়ারলি পাস’ দেয়া হচ্ছে। আবার আসি বা না আসি, সারাবছরের একটা টিকেট থাকলে মন্দ কী! একটি ফরম পূরণ করতে হলো তার জন্য।
আজকের টিকেট সাথে সাথে পেয়ে গেলাম। অন্য যে কোন দিন এসে বছরমেয়াদী টিকেটটি সংগ্রহ করতে হবে অন্য একটি কাউন্টার থেকে।
স্টুডিওর মূল গেট খুলবে ন’টায়। এখনো হাতে সময় আছে কিছুক্ষণ। গেটের বাইরে বিশাল এলাকা জুড়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সারি- ইউনিভার্সাল সিটি ওয়াক। অনেক দোকান, রেস্টুরেন্ট, সিনেমা হল, স্যুভেনির শপ। আঠারো হাত উঁচু এক গরিলা দাঁড়িয়ে আছে হাতে ইলেকট্রিক গিটার নিয়ে। থ্রি ডাইমেনশানাল সিনেমা হল আইম্যাক্সে দেখানো হচ্ছে ডায়নোসর যুগের ছবি। এদিকের গাড়ি পার্কের নাম ‘জুরাসিক কার পার্ক।’
দলে দলে মানুষ আসতে শুরু করেছে এখন। টিকেট হাতে লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে প্রবেশ পথে। নিরাপত্তা প্রহরীদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। সবগুলো ব্যাগ তন্নতন্ন করে চেক করা হচ্ছে। এই চেকিং এয়ারপোর্টের চেকিং এর চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এগারোই সেপ্টেম্বরের ঢেউ এখানেও লেগেছে। কোন খাবার বা পানীয় নিয়ে যেতে দিচ্ছে না ভেতরে। ব্যবসায়িক জ্ঞান এদের টনটনে। বাইরের দুই ডলারের খাবার ভেতরে দশ ডলার দিয়ে কিনতে বাধ্য করবে।
প্রবেশ পথে কম্পিউটারাইজড টিকেট চেকিং। মেশিনে টিকেট ঢোকালেই খুলে যাচ্ছে ছোট্ট অটোম্যাটিক গেট। সামনে এগোতেই খোলা জায়গায় মাইক্রোফোন হাতে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে স্টুডিওর অভ্যর্থনা-কর্মী। তাদের সাথে এসে দাঁড়িয়েছে নকল মেরিলিন মনরো, চার্লি চ্যাপলিন।
বিদ্যুৎ চমকানোর মত চমকাচ্ছে শত শত ক্যামেরার ফ্লাশ। প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যান ক্যামেরা হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ডামি স্টারদের আশে পাশে। সবার ভেতরেই আশ্চর্য উচ্ছলতা। খুশিতে টগবগ করছে সবাই।
চারশো পনেরো একর জায়গা জুড়ে এই স্টুডিও। ভাবতেও অবাক লাগে এই স্টুডিওটার গোড়াপত্তন করেছিলেন একজন মুরগি ব্যবসায়ী। ১৯১২ সালে।
ছোটখাট একটি চিকেন ফার্মের মালিক কার্ল লেইমস তাঁর মুরগির খামারের পাশেই গড়ে তুলেছিলেন ছোট্ট ফিল্ম স্টুডিও। স্টুডিও ভাড়া দিয়ে যা পেতেন তাতে তাঁর চলতো না। মুরগির ডিম বিক্রির পাশাপাশি তিনি ডিমক্রেতাদের উৎসাহিত করতেন সিনেমার শ্যুটিং দেখার জন্য। তখনো সিনেমা তৈরির টেকনিক খুব একটা উন্নত হয়নি। সাইলেন্ট ছবির যুগ তখনো। তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। ১৯৬৪ সাল থেকে চালু হয়েছে দর্শনীর বিনিময়ে স্টুডিও ট্যুরের। তখন থেকে এ পর্যন্ত দশ কোটিরও বেশি মানুষ এসে দেখে গেছেন এই স্টুডিও।
স্রোতের মত এগোচ্ছে হাজার হাজার মানুষ স্টুডিও ট্যুরবাস ধরতে। অ্যাস্কেলেটর থেকে নেমেই একটি লাইনে দাঁড়াতে হয়। লাইনটি এঁকেবেঁকে চলে গেছে বাস এরিয়ায়। আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে শাটল বাসে ওঠার ব্যবস্থা।
ট্যুরবাসগুলো অনেকটা মিনি ট্রেনের মতো। দুটো বগি একটির সাথে অন্যটি লাগানো। গাড়িতেই চারটি টিভি মনিটর। অডিও ভিজ্যুয়াল সিস্টেম ব্যবহার করে দেখানো হচ্ছে সিনেমা তৈরির বিভিন্ন কলাকৌশল। যখন যা দরকার হয়। ড্রাইভার ছাড়াও গাড়িতে আছেন একজন দক্ষ গাইড। তিনি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন প্রতিটি সেট, প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি শ্যুটিং স্টুডিও।
ধীরে ধীরে এগোচ্ছে শাটল বাস। আশেপাশে নানারকম সেট তৈরির ওয়ার্কশপ। অনেক সেট ইতোমধ্যে তৈরি করা আছে, কোন কোনটা তৈরি হচ্ছে নতুন সিনেমার জন্য। শহরের দৃশ্য তৈরির করার জন্য কিছু কমন সেট তৈরি করা আছে। সামান্য পরিবর্তন করেই এই সেট হয়ে যাচ্ছে কখনো প্রাচীন রোমান শহর, কখনো বর্তমানের নিউইয়র্ক সিটি।
ইউ এস ফেডারেল কোর্ট হাউজের সেট দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা আসল কোর্ট বিল্ডিং নয়। ‘আংকেল টমস কেবিন’ আর ‘হান্সব্যাক অব নটরড্যাম’ সিনেমায় ব্যবহৃত বাড়ি দেখা গেলো। সাসপেন্স কিং আলফ্রেড হিচককের বিখ্যাত ছবি ‘সাইকো’র বেইটস মোটেল ও দুর্গের মত বাড়িটি দেখা গেলো। এই বাড়িতেই বেইটস তার মায়ের মৃতদেহ স্টাফড করে রেখে দিয়েছিলো জানালার পাশে। বাড়িটির জানালায় এখনো মাঝে মাঝে উঁকি মারে ভূতুড়ে করোটি।
গাড়ি এগোচ্ছে স্টুডিওর অ্যাগ্রিকালচারাল ডিপার্টমেন্টের ভেতর দিয়ে। সিনেমার প্রয়োজনে যত গাছপালা লাগে তার প্রায় সবকিছুই সাপ্লাই করা হয় এখান থেকে। ছবিতে আউটডোর শ্যুটিং খুব বেশি করা সম্ভব হয় না। জুরাসিক পার্ক টাইপের সিনেমারও বেশিরভাগ দৃশ্যই ধারণ করা হয়েছে স্টুডিওর ভেতর। অ্যাগ্রিকালচারাল ডিপার্টমেন্টে গাছের ডাল ও পাতার স্টক আছে প্রচুর যা কৃত্রিম প্লাস্টিকের তৈরি। দেখে বোঝার উপায় নেই যে সেগুলো আসল পাতা নয়। শ্যুটিং এর সময় ব্যবহৃত হাজার হাজার ওয়াটের বৈদ্যুতিক আলোয় সত্যিকারের পাতা গুটিয়ে যায়। তাই বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিকের পাতা গাছের ডালে স্ট্যাপল করে লাগিয়ে নেয়া হয়। মনে পড়লো সত্যজিৎ রায়ের গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবিতে জোনাকির আলো দেখানোর জন্য ছোট ছোট বৈদ্যুতিক বাল্ব ব্যবহার করা হয়েছিলো।
এবার একটা ঢালু মেঠো পথ ধরে গাড়ি থামলো একটি পুকুর পাড়ে। দেখে মনে হচ্ছে বহুশত বছর আগের কোন অজপাড়া গাঁ, ভাঙা রাস্তা, একটু আগেই বৃষ্টি হয়েছে এখানে। অথচ প্রাকৃতিক বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ আগে। গাইড জানালেন এখুনি বৃষ্টি হবে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মেঘের চিহ্নও নেই কোথাও। চারদিকে ঝকঝক করছে রোদ। কিন্তু গাইডের কথা শেষ হবার আগেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। বিজলি চমকাচ্ছে। বাজ পড়ার শব্দে কানপাতা দায়। দু'মিনিটের ভেতর ঢালুপথ বেয়ে প্রচন্ড বেগে ছুটে এলো পাহাড়ী ঢল।
বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট হয় যে এগুলো সবই কৃত্রিম। দু'মিনিটের ভেতর আবার সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলো। রাস্তার পানি শুকিয়ে গেলো। বৃষ্টি বা বজ্রপাতের কোন চিহ্নও নেই আর। সিনেমার ঝড়বৃষ্টির শ্যুটিং করা হয় এখানে। প্রতিবারের এক মিনিটের কৃত্রিম বন্যায় দশ হাজার গ্যালন পানি ব্যবহার করা হয় এখানে। এই পানি রিসাইকেলড হয়ে যাচ্ছে প্রতি দশ মিনিটে।
এখান থেকে কিছুদূর যাবার পর দেখা গেলো রাস্তা ডুবে গেছে বন্যার পানিতে। ফিরে যাবার কোন উপায় নেই, কারণ আমাদের বাসের পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছে আরেকটি বাস। শুরুতে মনে ছিলো না যে এখানে চোখের সামনে যা ঘটতে দেখছি তার সবকিছুই উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে ঘটানো হচ্ছে।
গাড়ি পানির ভেতর নামতে শুরু করলো। দেখা গেলো পানি সরে যাচ্ছে শুধুমাত্র রাস্তা থেকে, অথচ গাড়ির জানালার সমান উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে গাড়ির পাশ দিয়ে। গাড়ির খোলা জানালায় পানি ঢুকছে না একটুও। কীভাবে হচ্ছে জানার পরেও খুব অবাক লাগে এসব হচ্ছে দেখে।
স্টুডিওর বিভিন্ন অংশের নাম রাখা হয়েছে হলিউডের বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে। স্টিভেন স্পিলবার্গ ড্রাইভে স্পিলবার্গের সিনেমাগুলোর শ্যুটিং হয়। জুরাসিক পার্ক, ই-টি’র শ্যুটিং হয়েছিলো যে সমস্ত সেটে সেগুলো এখন প্রদর্শন করা হচ্ছে।
হাঙর নিয়ে স্পিলবার্গের বিখ্যাত ছবি ‘JAWS’ এর শ্যুটিং করা হয়েছে স্টুডিওর ভেতরের একটি লেকে। লেকের পাড়ে কিছু অংশে বালি ফেলে বিচ তৈরি করা হয়েছে। ছবির হাঙরটিকে দেখা গেলো লেকের পানিতে সাঁতার কাটছে। গাড়ি লেকের পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ জানালায় ভেসে উঠলো হাঙরের মুখ। মস্ত বড় হা। ভয়ে চিৎকার বেরিয়ে আসে এমনিতেই। কে বলবে এই হাঙর রাবারের তৈরি এবং পুরোটাই যন্ত্র নিয়ন্ত্রিত। গাড়ির ভিডিও মনিটরে ভেসে উঠলো স্টিভেন স্পিলবার্গের মুখ। তিনি বললেন ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে তাঁর ছবি তৈরির অভিজ্ঞতার কথা।
স্পিলবার্গের পরে হলিউডের আরেকজন বিখ্যাত পরিচালক রন হাওয়ার্ড। ‘এ বিউটিফুল মাইন্ড’ ছবির জন্য তিনি শ্রেষ্ট পরিচালকের অস্কার পুরষ্কার পেয়েছেন। ‘অ্যাপোলো-১৩’ ছবিটি তাঁর আরেকটি বিখ্যাত ছবি। টম হ্যাংকস অভিনীত এই ছবির সেট কীভাবে তৈরি করা হয়েছে তার বর্ণনা দিচ্ছেন রন হাওয়ার্ড। কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে স্টুডিওর একটি ঘরকেই বানানো হয়েছিলো হিউস্টনের নাসা স্পেস সেন্টারের কন্ট্রোল রুম।
কম্পিউটার প্রযুক্তির কল্যাণে এখন সিনেমা তৈরির বেশির ভাগ কাজ ভার্চুয়্যালি করে ফেলা সম্ভব। এখন কম্পিউটারই তৈরি করে দিচ্ছে নানারকম স্পেশাল অ্যাফেক্ট। কম্পিউটার প্রযুক্তি এখন অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলছে মুহূর্তেই।
গাড়ি এবার ঢুকে পড়লো একটি স্টেজের ভেতর। ভেতরে একটি রেলস্টেশন দেখা যাচ্ছে। গাড়ি এসে থামলো স্টেশনের প্লাটফরমে। টিকেট ঘর দেখা যাচ্ছে প্লাটফরমের ওপর, ভিডিও মনিটরে পরবর্তী ট্রেনের সময়সূচি। প্লাটফরমের টিভিতে খবর পড়ছে কেউ। সব মিলিয়ে নিঁখুত একটি রেলস্টেশন।
হঠাৎ প্রচন্ড দোলায় কেঁপে উঠলো সবকিছু। ভূমিকম্প হচ্ছে। ঝাঁকুনি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। প্লাটফরম ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো চোখের সামনেই। ছাঁদ ভেঙে পড়ছে মাথার ওপর। সামনের পিলার ভেঙে ছুটে আসছে গাড়ির দিকে। এসময় গ্যাস লাইন ফেটে আগুন লেগে গেলো স্টেশনে। দাউ দাউ করে জ্বলে যাচ্ছে অফিসঘর। পানির পাইপলাইন ফেটে হু হু করে ঢুকে পড়ছে পানি। রিখটার স্কেলে এই ভূমিকম্পের স্কেল আট দশমিক তিন। গোদের ওপর বিষফোড়ার মত এই ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে দেখা গেলো কিংকং এর মুখ। বিরাট হা করে আমাদের গাড়ি ধরে ঝাঁকাচ্ছে এই গরিলা। ‘কিংকং ভার্সাস গর্জিলা’ সিনেমার লাইভ শো। পাঁচ মিনিটের ভেতর একটা ধ্বংসযজ্ঞ সম্পন্ন। এমন নিখুঁত টাইমিং- এমন ডিটেলস দেখার সময় মনে থাকে না যে এসব কৃত্রিম।
স্টুডিওর অন্য দরজা দিয়ে গাড়ি বেরোবার সাথে সাথেই সবকিছু আবার আগের অবস্থায় ফিরে গিয়ে স্টেজ তৈরি হয়ে থাকবে আমাদের পরের গাড়ির দর্শকদের জন্য। মানসিক হাসপাতালে যেমন ডাক্তারদের দেখেও মানসিক রোগী বলে সন্দেহ জাগে- এখানেও এখন সেরকম লাগছে। যা কিছু দেখছি সবকিছুই সাজানো। সত্যিকারের ভূমিকম্প ঘটলেও সম্ভবত মনে হবে কৃত্রিম।
স্টুডিওর ভেতর পেট্রোল পাম্প, পোস্ট অফিস, ফায়ার ব্রিগেড দেখে সবাই ভাবলাম কোন সিনেমার সেট। কিন্তু না, এগুলো সব সত্যিকারের। স্টুডিওর জন্যই আলাদা দমকল বাহিনী আছে এখানে। আছে আলাদা পোস্টকোড সহ পোস্ট অফিস। পুরো ইউনিভার্সাল সিটিটাই যেখানে গড়ে উঠেছে এই ইউনিভার্সাল স্টুডিওকে ঘিরে- সেখানে এই স্টুডিওর জন্যই একটি সিটি কাউন্সিল থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক।
গাড়ি ফিরে আসছে এখন। পথের মাঝে জরাজীর্ণ এক কাঠের সেতু। দেখে মনে হচ্ছে শত বছরের পুরনো। সেতুর কাঠ ভেঙে গেছে, মাঝে মাঝে বিরাট ফাঁক। এর ওপর দিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায়ও নেই।
সিনেমাতে এরকম দৃশ্য দেখা যায় মাঝে মাঝে। সবকিছু সাজানো তা বুঝতে পারছি, কিন্তু কৃত্রিমতা বাস্তবের এত কাছাকাছি যে সবকিছু জানার পরেও গা ছমছম করছে। গাড়ি ব্রিজ পার হচ্ছে। হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে ব্রিজ ভেঙে গাড়িসহ পড়ে গেলো তিন চার ফুট নিচে। গাড়ির ভেতর তাৎক্ষণিক প্যানিক। সাজানো জানার পরেও ইমপ্যাক্টটা বাস্তব।
ফিরে আসার সময় দেখা গেলো ব্রিজের ভাঙা অংশটি আস্তে আস্তে জোড়া লেগে যাচ্ছে।
পঞ্চাশ মিনিটের মতো লাগলো স্টুডিও ট্যুর শেষ হতে। একটার পর একটা ট্যুর বাস এসে থামছে স্টেশনে। একদল নামছে, অন্যদল উঠছে। বিরামহীন এই প্রক্রিয়া চলবে সারাদিন।
স্টুডিও ট্যুর শেষ করে উপরে উঠে গেলাম অ্যাস্কেলেটর বেয়ে। চোখের সামনে ‘ব্যাক টু দ্যা ফিউচার’ রাইড। ঢুকে পড়লাম সেখানে। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে একটি ল্যাবোরেটরির সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। লাইনের শুরু থেকে ছয় জন করে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে ভেতরে। আমাদের ছয় জনের মধ্যে একজোড়া ভারতীয় ছেলেমেয়েও আছে। তারা হিন্দিতে কথা বলছে।
একটি উন্নত মানের গবেষণাগার আদলে সাজানো হয়েছে এখানে সবকিছু। স্টিভেন স্পিলবার্গ প্রযোজিত তিন পর্বের সায়েন্স ফিকশান ‘ব্যাক টু দ্যা ফিউচার’ দেখেছিলাম অনেক বছর আগে। ছবিতে বৈজ্ঞানিক ডক্টর ব্রাউন যে গাড়িটাতে করে নায়ক রিপকে অতীত আর ভবিষ্যতে পাঠিয়েছিলেন- সেই গাড়িটাতে চড়ার অভিজ্ঞতা হবে এখন।
মূল ভবনে ঢুকে মনে হচ্ছে আসলেই কোন ল্যাবোরেটরিতে ঢুকে পড়েছি। করিডোরের দু'পাশে ছোটছোট ঘর। বৈজ্ঞানিকদের নাম লেখা। স্পেস-টাইম-রিলেটিভিটি নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন সবার নামেই অফিস আছে এখানে। আমাদের ছয় জনকে নিয়ে যাওয়া হলো প্রফেসর আইনস্টাইনের অফিসে।
“প্রফেসর আইনস্টাইন উইল সি ইউ ইন আ মিনিট” বলেই ছটফট করে চলে গেলো আমাদের গাইড।
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে আইনস্টাইনের অফিসটি কেমন ছিলো দেখিনি। কিন্তু এই হলিউডে বেশ যত্ন করেই সাজানো হয়েছে আইনস্টাইনের অফিস। দেয়ালে আইনস্টাইনের ছবি- সাইকেল চালাচ্ছেন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে।
বেশকিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি রাখা আছে একপাশে। এগুলো এখানে কেন রাখা হয়েছে জানি না। আইনস্টাইন তো তাঁর তত্ত্ব প্রমাণের জন্য যন্ত্রপাতির ধার ধারেননি কখনো। তাঁর মস্তিষ্কই ছিলো তাঁর ল্যাবোরেটরি আর পেনসিল ছিলো তাঁর সবচেয়ে বড় যন্ত্র।
‘ব্যাক টু দ্যা ফিউচার’-এর ডক্টর ব্রাউনের গলা ভেসে আসছে রুমের বাইরের কোন জায়গা থেকে। খুব ব্যাস্তভাবে তিনি বলছেন সব বিজ্ঞানীরা এখন একটি জরুরী বৈজ্ঞানিক মিটিং করছেন বলে আসতে পারছেন না আমাদের কাছে। তাঁদের জন্য অপেক্ষা না করেই যেন আমরা স্পেস শাটলে চড়ে বসি।
এসময় রুমের একপাশের দরজা খুলে গেলো। একটি লাল আলো জ্বলছে দরজার বাইরে। সেখানে দেখা গেলো ‘ব্যাক টু দ্যা ফিউচার’ সিনেমার সেই গাড়িটি। এই সেই টাইম ট্রাভেল কার- টাইম মেশিন।
গাড়িতে উঠে বসতে সাহায্য করলেন একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট। কিছুক্ষণ পর লাল আলো নিভে গেলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। কয়েক সেকেন্ড পরে দেখা গেলো অসংখ্য তারা মিটমিট করছে মাথার ওপর, চোখের সামনে, পেছনে, সবখানে।
মনে হচ্ছে রাতের আকাশের মাঝখানে বসে আছি। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। হঠাৎ প্রচন্ড আলো। আমরা এখন মহাকাশে। উল্কাপাত হচ্ছে, চোখের সামনে দিয়েই ছুটে যাচ্ছে ধূমকেতু।
অভিকর্ষজ ত্বরণের বিপরীতে কাজ হচ্ছে এখন। চলে যাচ্ছি সময়ের রথে চড়ে অতীতের দিকে। শত শত ডায়নোসর ঘুরে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে। তাদের পাশ কাটিয়ে এঁকে বেঁকে চলে যাচ্ছে আমাদের বাহন।
গাড়ির বেগ বাড়ছে তো বাড়ছেই, বেশ দ্রুতই বাড়ছে। মনে হচ্ছে আলোর বেগের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছি। যদিও ব্যাপারটি অসম্ভব। কারণ বেগ সেরকম ভাবে বাড়ার সাথে সাথে আমাদের ভর বেড়ে যাওয়ার কথা, সেরকম কিছু অনুভব করছি না।
হঠাৎ শুরু হলো মহাজাগতিক ধ্বংসযজ্ঞ। প্রকৃতি ফুঁসে উঠেছে। আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোত প্রচন্ড বেগে ধেয়ে আসছে সোজা আমাদের দিকে। উপর থেকে ছুটে আসছে প্রচন্ড এক আগুনের গোলা। গাড়ি কখনো সামনে, কখনো বাঁয়ে ডানে মোড় নিচ্ছে ভয়ানক গতিতে। মৃত্যু হাতের মুঠোয় নিয়ে ছুটছে।
হঠাৎ সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি পড়তে শুরু করলো নিচে। একেবারে শূন্য অভিকর্ষণের মুক্তপতন। কোথাও কোন আকর্ষণ শক্তি কাজ করছে না আর। নিজেকে একেবারে ওজনহীন মনে হচ্ছে। একটু পরেই মনে হচ্ছে কোন এক প্রচন্ড শক্তি আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোন এক অদৃশ্য গহ্বরের দিকে। মনে হচ্ছে ব্ল্যাকহোলে ঢুকে পড়েছি। অবিশ্বাস্য গতিতে চলে যাচ্ছি নিচের দিকে। কোথায় যাচ্ছি জানি না। মনে হচ্ছে শরীরের সমস্ত তরল পদার্থ নাকমুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে এখুনি।
অবশেষে গতি কমলো গাড়ির। মনে হচ্ছে অনেক বছর মহাশূন্যে কাটিয়ে নেমে এলাম পৃথিবীর বুকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সব মিলিয়ে দশ মিনিটের বেশি চলেনি গাড়ি। অথচ হৃৎপিন্ড লাফাচ্ছে এখনো। দুর্বল হৃৎপিন্ড নিয়ে এখানে প্রবেশ করতে মানা এ কারণেই।
আলো জ্বলে উঠলো। দেখা যাচ্ছে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানেই এসে পৌঁছেছি। এখন মনে হচ্ছে এই গাড়িটি এখান থেকে যায়নি কোথাও। কেবল চারপাশের পরিবেশই বদলে দেয়া হয়েছিলো পদার্থবিজ্ঞানের কিছু মৌলিক সূত্র ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে। মনে হচ্ছে আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটিকে আক্ষরিক অর্থেই কাজে লাগানো হয়েছে। রাস্তার ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নেয়ার বদলে গাড়ির নিচ দিয়ে রাস্তাকেই চালিয়ে নেয়া হয়েছে। প্রয়োগটা এত বাস্তব যে স্বয়ং আইনস্টাইনেরও মনে হবে অতীত ঘুরে এসেছেন।
স্বাভাবিক আলোর সাথে অভিযোজিত হতে সময় লাগলো কিছুক্ষণ। ইউনিভার্সাল স্টুডিওর ম্যাপ হাতে ছুটতে হচ্ছে এখন। চিটাগাং কলেজে প্রথম দিন ক্লাশ করার মত অনুভূতি হচ্ছে আমার। একেকটি ক্লাস একেক ভবনে, ক্যাম্পাসও অচেনা আর সবগুলো ক্লাসই গুরুত্বপূর্ণ।
‘অ্যানিমেল প্লানেট’ লাইভ শো শুরু হচ্ছে একটি খোলা স্টেজে। টেলিভিশনে এই লাইভ শো বেশ জনপ্রিয়। স্টেজের সামনে গ্যালারিতে বসতে বসতে মনে হলো মানুষ বড়ো আধিপত্যবাদী। প্রকৃতি, গাছপালা, পশুপাখি, সবকিছুর ওপরই তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তা লোক ডেকে দেখাতে হবে। পশুপাখিদের নিয়ে এরকম প্রদর্শনীও মানুষের আধিপত্যবাদিতার নিদর্শন। পশুপাখি মানুষের কথা মেনে চলছে এটা দেখানোই আসল কথা এখানে।
স্টেজে ইঁদুর ছুটে বেড়াচ্ছে হাজার মানুষের সামনে। আমেরিকায় নাকি অনেকের পোষা ইঁদুরও থাকে। পেট-শপ (Pet Shop) থেকে অনেকে ইঁদুর কিনে নিয়ে যায় পোষার জন্য। পাশের বাড়িতে যদি পোষা বেড়াল থাকে এবং সে যদি ইঁদুরটিকে দিয়ে লাঞ্চ সারে- সেটা নিয়ে মামলা মোকদ্দমাও হয়।
একটি প্রায়-বাঘ সাইজের কুকুর এসে স্টেজের ওপর লাফাচ্ছে। তার সামনে একটি বড় রিং দোলাচ্ছে কুকুরের প্রভু। কুকুরটি রিং এর ভেতর দিয়ে লাফিয়ে যাবার সাথে সাথে দর্শকরা প্রচন্ড হাততালি দিচ্ছে- যেন এরকম ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম ঘটলো।
একটি তোতাপাখি নিয়ে স্টেজে এলেন একজন তোতা বিশেষজ্ঞ। তিনি বাঁহাতের তালুতে তোতাকে বসিয়ে ডান হাতের মধ্যমা আর বৃদ্ধাঙ্গুলির ঘর্ষণে একটি বিশেষ শব্দ তৈরি করতেই তোতাপাখি উড়ে গেলো গ্যালারির দর্শকদের দিকে। সেখানে হাতে ডলার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন দর্শক। তার হাত থেকে ডলারটি নিয়ে তোতাপাখি উড়ে চলে গেলো তার প্রভুর হাতে। একটু পরে প্রভুর আদেশে এই ডলার আবার ফিরিয়ে দিয়ে এলো তোতা।
বানর নাচছে ব্যান্ডের তালে তালে আর সাথে সাথে কিছু স্বাভাবিক বাঁদরামিও করছে। এবার একটি অজগর সাপ নিয়ে আসা হলো মঞ্চের ওপর। দর্শকদের মধ্য থেকে দশ বারো বছরের একটি মেয়েকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে সাপটিকে তার গলায় পেঁচিয়ে দিলো। মেয়েটিকে জ্ঞিজ্ঞেস করা হলো, কেমন লাগছে? সাহসী মেয়েটি জবাব দিলো, ‘সাপের মত লাগছে।’
সবাই ভীষণ আমোদিত হলো মেয়েটির তাৎক্ষণিক সপ্রতিভ উত্তরে। সব মিলিয়ে মনে হলো আমাদের দেশীয় সার্কাসের হলিউডিয় সংস্করণ।
এখান থেকে বেরিয়ে ঢুকলাম ‘রুট র্যাগস ম্যাজিক শো’ দেখতে। এই হলটি বিশাল। মূলত শিশুদের জন্যই এই লাইভ কার্টুন শো। নাচ, গান, ম্যাজিক শো আর ডেভিড কপারফিল্ডের জাদুর কার্টুন সংস্করণ। শব্দ, আলো আর আধুনিক প্রযুক্তির অপূর্ব সমন্বয়ে লাইভ প্রোগ্রামও মাঝে মাঝে ভার্চুয়াল মনে হয়।
হলিউড হিলের নিচের দিকে আলাদা একটি জগৎ। সেখানে যেতে হয় সিকি মাইল লম্বা একটি অ্যাস্কেলেটরে চেপে। অ্যাস্কেলেটরের পাশাপাশি সিঁড়িও আছে। স্বাস্থ্যসচেতন কারো হঠাৎ ব্যায়াম করার ইচ্ছে হলে সিঁড়ি বেয়েই নেমে যেতে পারে। অ্যাস্কেলেটরে নিচের দিকে নামার সময় চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য অদ্ভুত সুন্দর। অবশ্য নিয়মিত পরিচর্যার মাধ্যমেই এরকম দৃষ্টিনন্দন করে রাখা হয়েছে সবকিছু।
মাঝামাঝি জায়গায় বেশ বড় একটি গোলাকার চত্বর। দুটো বড় বড় কমার্শিয়াল টেলিস্কোপ রাখা আছে এখানে। পঁচিশ সেন্টের চারটি মুদ্রা দিলেই এই টেলিস্কোপ দিয়ে হলিউড শহরের চারদিক দেখা যায়।
পাহাড়ের নিচের অংশে জুরাসিক পার্ক, এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়্যাল- ই-টি’র জগৎ। সাথে আরো কিছু অ্যাডভেঞ্চার শো’র স্টেজ। স্টিভেন স্পিলবার্গ ই-টি ছবিটি বানিয়েছেন বিশ বছর আগে। ছবিটির বিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্টিভেন স্পিলবার্গের ভিডিও সাক্ষাৎকার প্রচারিত হচ্ছে ই-টি কম্পাউন্ড জুড়ে। ই-টি কম্পাউন্ডের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই সম্পূর্ণ অন্যরকম একটি জগৎ।
পরাবাস্তব আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে বিশাল বিশাল গাছের গভীর অরণ্য। মনে হচ্ছে গাছপালা সব কৃত্রিম। কারণ ঘরের ভেতর কৃত্রিম আলোয় এত বড় বড় গাছ বাঁচার প্রশ্নই ওঠে না। অরণ্যের মাঝে মাঝে সাদা ঘন ধোঁয়া বেরোচ্ছে। অ্যালিয়েনদের দেখা যাচ্ছে গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে। ভিন গ্রহের মানুষ।
মানুষ কল্পনায় যে সমস্ত ক্ষমতা অর্জন করতে চায় তা অবাস্তব ঠেকলেই কাল্পনিক ভিনগ্রহের মানুষের আশ্রয় নেয়। যেহেতু সেই গ্রহ সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই নেই, দেখা যায় সে গ্রহের প্রাণীরা প্রায় সময়েই আমাদের গ্রহের প্রাণীদের চেয়ে উন্নত হয়ে থাকে; প্রযুক্তি, ক্ষমতা ও বুদ্ধিতে। কারণ কী? পৃথিবীর মানুষ হিসেবে আমরা কি তবে মাঝে মাঝে হীনমন্যতায় ভুগি?
ছোটবড় অনেকগুলো ই-টি দেখা যাচ্ছে এখানে। ই-টি সিনেমায় দেখা যায় ই-টিকে নিয়ে বাচ্চারা শূন্যে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। এখানে সেই উড়ন্ত সাইকেলে চড়ার ব্যবস্থা আছে।
লাইন ধরে এগোচ্ছি। আবছা লাল আলো সবখানে। ই-টি’র পৃথিবীর আলো আমাদের পৃথিবীর আলোর চেয়ে ভিন্ন, কারণ তাদের গ্রহ আমাদের সৌরজগতের বাইরে। তাই তাদের আলোর উৎস আমাদের সূর্যের চেয়ে আলাদা।
প্লাটফরমে উঠে দাঁড়াতেই একটি তারের ওপর দিয়ে সাইকেল এসে দাঁড়ায় পায়ের কাছে। সাইকেলে চেপে বসতেই সাইকেল নিজে নিজেই চলতে শুরু করে। বাস্তবে সাইকেল চালানোর জন্য শরীরের ভারসাম্যটা অ্যাডজাস্ট করে নিতে হয়। সেজন্য জীবনে কমপক্ষে একবার সাইকেল চালানো শিখতে হয়। তবে একবার শেখার পরে সাইকেল চালানো ভোলে না কেউ। শরীরের প্রোগ্রামে ব্যালেন্স-সিস্টেমটা থেকেই যায়। কিন্তু ই-টি’র সাইকেল চালানোর জন্য কোন পূর্ব-অভিজ্ঞতার দরকার হয় না। এখানে একটি মোটা লোহার তার সাইকেল টেনে নিয়ে যায় আরোহীসমেত। আলো আঁধারীতে মাথার ওপরের তারটিকে দেখা যায় না। তাই মনে হয় শূন্যে উড়ে চলেছে সাইকেল।
সাইকেলে চেপে শূন্যে উড়তে উড়তেই দেখলাম নিচে ই-টি’র জগৎ। অদ্ভুত আকৃতির গাছপালা এখানে। শিশু বুড়ো নানা বয়সের নানা রকম নানা আকৃতির ই-টি তর্জনী উঁচিয়ে বলছে, “আমরা তোমাদের বন্ধু।” তাদের তর্জনী তুলনামূলকভাবে অনেক লম্বা, আঙ্গুলের মাথায় আলো জ্বলছে। স্পিলবার্গের ভাষায়, “এ আলো বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার আলো।” বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যও আমরা আশা করছি অন্য কোন গ্রহ থেকে এখানে আসবে ই-টি, তর্জনী উঁচিয়ে বলবে, “শান্তি! শান্তি!!” আর সাথে সাথেই সবকিছু শান্তিময় হয়ে যাবে!!!
ই-টি’র জগৎ থেকে বেরিয়ে জুরাসিক পার্কে ঢুকলাম। আক্ষরিক অর্থেই একটি পার্ক বানানো হয়েছে এখানে জুরাসিক যুগের আদলে।
জুরাসিক যুগের পরিবেশ এখানে সর্বত্র। ভীষণ ভীড়, লাইন ধরে অপেক্ষা করছে শত শত মানুষ। রেইনকোটে শরীর ঢেকে প্রস্তুত সবাই জুরাসিক বোটে চড়ার জন্য। এখানে মূল শোটা দেখতে হয় নৌকায় চড়তে চড়তে।
হলুদ রঙের জুরাসিক নৌযান। নৌকায় পঁচিশজনের বসার ব্যবস্থা। পানির স্রোত নিয়ন্ত্রিত চালকবিহীন ইঞ্জিনবিহীন নৌকা হেলে দুলে চলতে শুরু করলো। সাড়ে ছয় কোটি বছর আগের জুরাসিক যুগের ডায়নোসররা চড়ে বেড়াচ্ছে নদীর পাড়ে। নৌকা তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় মাথা তুলে দেখছে বিশাল ভয়ংকর টাইনারোসরাস।
ডায়নোসরের যতগুলো প্রজাতির খবর এ পর্যন্ত জানা গেছে তাদের সবগুলোরই নমুনা আছে এখানে। খোলা আকাশের নিচে বলে প্রাথমিক অংশে আলোর নিয়ন্ত্রণ ঠিকমত বোঝা যায় না। দিনের স্বাভাবিক আলোয় এই ভয়ংকর ডায়নোসর গুলোকে খুব বেশি বাস্তব মনে হয় না।
একটু পরেই নৌকা ঢুকে গেলো একটি সুড়ঙ্গ পথে। নিয়ন্ত্রিত আলো ও শব্দের অন্যরকম ভয়ংকর একটি জগৎ এখানে সুড়ঙ্গের ভেতর।
শুরু হলো প্রতি মুহূর্তের সাস্পেন্স, ‘জুরাসিক পার্ক’ সিনেমার চেয়েও শ্বাসরুদ্ধকর। নানারকম রেপ্টাইল, উড়ন্ত ডায়নোসর এমন ভাবে হা করে উড়ে আসছে যেন নৌকা থেকে তুলে নিয়ে যাবে। নৌকার গতি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। স্রোতের বেগও বাড়ছে। স্রোতে ভাটির টান। দু'পাশে ছুটছে ডায়নোসরের দল। স্রোতের টানে ভেসে চলেছি কোন গভীর খাদের দিকে। পেছনে লম্বা লম্বা পা ফেলে উৎকট চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে ভয়ংকর ডায়নোসর। মুখ দিয়ে আগুনের হলকা বের হচ্ছে। শক্ত করে ধরে আছি নৌকার সেফটি রড। কয়েক সেকেন্ডের ভেতরই পতন। পাহাড়ের ওপর থেকে খাড়া ঢাল বেয়ে পঁচাশি ফুট নিচের পানিতে। পতনটা সম্পূর্ণ বাস্তব। শারীরিক ভাবে আহত হবার কোন সম্ভাবনা না থাকলেও একটা মানসিক ইম্প্যাক্ট থাকে। সেজন্য এখানেও দরকার একটু শক্তিশালী হৃৎপিন্ড ও স্নায়ুর ওপর কড়া দখল।
রেইনকোটের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে নৌকা থেকে নামার সময় হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিলো একজন কর্মী। কোডাক ফিল্ম কোম্পানির কাগজ। এখান থেকে বেরোতে হয় কোডাক ফিল্ম স্যুভেনির শপের ভেতর দিয়ে। কাগজটি নিয়ে কাউন্টারে যেতেই দেয়ালে লাগানো কম্পিউটারের পর্দায় দেখলাম নিজেকে। পঁচাশি ফুট নিচে পড়ার মুহূর্তের দৃশ্য। পড়ার সময় ডিজিটাল ক্যামেরা ছবি তুলে রাখে সবগুলো নৌকার। নৌকা থেকে নামার সময় যাত্রীদের হাতে নৌকার নম্বর লেখা কাগজ ধরিয়ে দেয়। যাত্রীরা কাউন্টারে আসার আগেই তাদের ছবি এসে যায়। সেই ছবির প্রিন্ট এখানে কিনতে পাওয়া যায়। জীবনের এরকম দুর্লভ মুহূর্তের ছবি প্রত্যেকেই রাখতে চাইবে নিজের কাছে। এরকম জিনিসের দাম তো একটু হবেই। এক কপি ছবির দাম পড়লো পনেরো ডলার, বাংলাদেশী মুদ্রায় মাত্র নয়শ' টাকা।
এবার চললাম ‘ব্যাকড্রাফট’ স্টেজের দিকে। আগুন নিয়ে খেলা চলছে এখানে। আগুনের অনেক গুন আছে জানি, কিন্তু এই আগুন যে কত ভয়ংকর হতে পারে তা খুব কাছ থেকে দেখানো হচ্ছে ‘ব্যাকড্রাফট’ স্টেজে।
চোখের সামনেই আগুন লেগে গেলো একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে। ভয়াবহ রকমের আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলছে কারখানা, বিরাট বিরাট তেলের ড্রাম ফেটে যাচ্ছে প্রচন্ড শব্দে, উড়ে যাচ্ছে আগুনের গোলার মত। আগুনের তাপ সরাসরি গায়ে এসে লাগছে আমাদেরও। ভয়ংকর এই আগুনের নাম বিস্ট (Beast)। সত্যিই পশুর মত আচরণ এই আগুনের। দমকল বাহিনী এ আগুন আয়ত্বে আনতে কী যে পরিশ্রম করে, মৃত্যুর কত কাছে চলে যেতে হয় তাদের- দেখে ফায়ার ফাইটারদের প্রতি অন্যরকম এক শ্রদ্ধাবোধ জেগে ওঠে।
‘ব্যাকড্রাফট’ দেখে বের হয়ে এগোলাম সিনেমার স্পেশাল ইফেক্ট দেখতে। তিনটি স্টেজ জুড়ে দেখানো হচ্ছে আলো আর শব্দের নানারকম বিশেষ প্রয়োগে কীভাবে সিনেমার অবিশ্বাস্য সব দৃশ্য তৈরি হয়। কীভাবে সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্য বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে শ্যুটিং করার পরে জোড়া লাগানো হয়।
এখানে প্রথম স্টেজে দেখানো হলে ‘মমি রিটার্নস’ ছবির সেট। কম্পিউটার প্রোগ্রাম ব্যবহার করে খোলা স্টেজেই ফুটিয়ে তোলা হলো প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা। দর্শকদের মধ্য থেকে একজন স্টেজে গিয়ে দাঁড়ালেন আর প্রজেক্টরের সাহায্যে দেখানো হলো ঐ দর্শক-অভিনেতা হেঁটে যাচ্ছেন পিরামিডের ভেতর, মুখোমুখি হচ্ছেন গা থেকে মাংস খসে পড়া কঙ্কালের।
পরবর্তী স্টেজেও এরকম কিছু দৃশ্য দেখানো হলো। সবশেষে দেখানো হলো সাউন্ড রেকর্ডিং। জনপ্রিয় রেসলার রক সম্প্রতি ‘স্করপিয়ন কিং’ ছবির নায়ক হয়েছেন। ‘স্করপিয়ন কিং’ ছবির একটি দৃশ্যের শব্দগ্রহণ করে দেখানো হলো এখানে। দর্শকদের মাঝখান থেকে উঠে আসা নব্য শব্দগ্রাহকদের গৃহীত ‘স্করপিয়ন কিং’ সিনেমার জগাখিচুড়ি শব্দ শুনে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলাম।
লাঞ্চ টাইম। খাবারের দোকানগুলোতে প্রচন্ড ভীড় এখন। একটি স্যান্ডুইচ আর একবোতল কোকাকোলা কিনতে লাগলো সাড়ে আটডলার। বাইরে এ খাবারের দাম বড়জোর তিন ডলার।
অ্যাস্কেলেটরে চেপে উঠে গেলাম উপরের অংশে। গিজগিজ করছে মানুষ। উৎসব উৎসব ভাব চারদিকে। বছরে ৩৬৩ দিন মেলা বসে এখানে। সবদিনই নতুন নতুন মুখ, নতুন নতুন মানুষ।।
ইউনিভার্সাল স্টুডিওর এ সিজনের নতুন থিম- মিশরীয় সভ্যতা। মমি রিটার্নস- চেম্বার অব ডুম। বাইরে থেকে মনে হচ্ছে মরুভূমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটি পোড়ো মাটির ঘর। ভেতরে আলো আঁধারীর গোলকধাঁধা। আবছা অন্ধকারে মানুষের ভিড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে মৃতদেহ।
চারদিকে একটি স্যাঁতস্যাঁতে ভাব, মাটির সোঁদা গন্ধ। মনে হচ্ছে সত্যিই কোন কবরে ঢুকে হাঁটাহাঁটি করছি। হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে দেখলাম আমাকে জড়িয়ে ধরেছে মাংসহীন দুটি হাত। ভয়ে চিৎকার বেরিয়ে আসে নিজের অজান্তেই। একটু পরপরই চিৎকার শোনা যাচ্ছে মানুষের। ভয় পাওয়া মানুষের চিৎকার। খুব সাহসী মানুষেরও গা ছমছম করে ওঠে এখানে। সবকিছু নকল, সাজানো জেনেও। ভয় পেলে মানুষের যুক্তিবোধ কাজ করে না। আবার পরিবেশের কারণেও আমরা নিজেদের যুক্তিবোধকে সরিয়ে রাখি কিছুক্ষণের জন্য, তাতে আনন্দটা পুরো পাওয়া যায়।
এখানে যারা এসেছে সবাই জানে মৃতদেহ সেজে যারা ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা নিয়মিত বেতন পাচ্ছে ঐ মড়া সাজার জন্য। পরিবেশের কারণে তাদের অভিনয়টা এতটাই প্রাণবন্ত যে সে নিজেও হয়তো ভাবছে সে মরে গিয়ে মমি হয়ে গেছে। মাটির দেয়ালে যে কালো পোকাগুলো জড়সড় হয়ে আছে- দেখে মনে হচ্ছে হাত দিলেই গায়ে ঢুকে পড়বে আর হেঁটে বেড়াবে চামড়ার নিচে- সারা শরীরে, যেমন দেখা গেছে ‘মমি’ ছবিতে।
মমির গুহা থেকে বেরিয়ে সামনে এগোলে ‘ওয়াটার ওয়ার্ল্ড’- ইউনিভার্সাল স্টুডিও’র সবচেয়ে জনপ্রিয় লাইভ স্টান্ট শো। বেশ বড় একটি লেক ঘিরে ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের সেট। লেকের পাড়ে জরাজীর্ণ টাইপের ঘরবাড়ি, একটি জেটি, কিছু কলকারখানা, নৌবন্দরের অংশবিশেষ।
অর্ধবৃত্তাকার গ্যালারিতে দর্শকদের বসার ব্যবস্থা। সামনে বসলে ভিজে যাবার সম্ভাবনা প্রবল, তাই পেছনদিকের আসনগুলো ভরে যাচ্ছে আগে।
‘ওয়াটার ওয়ার্ল্ড’ পুরোটাই স্টান্ট শো। ভয়াবহ রকমের বন্দুকযুদ্ধ, স্পিডবোট নিয়ে পরস্পর তাড়া করে ফেরা, তার বেয়ে লেকের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে যাওয়া, টাওয়ারের উপর থেকে গুলি খেয়ে ঝপাৎ করে অনেক নিচের পানিতে পড়া যাওয়া- সবকিছুই ঘটছে চোখের সামনে।
আগুন লেগে যাচ্ছে ঘরবাড়িতে, মুহূর্তেই বোমা বিস্ফোরণ। নায়ক-নায়িকা ধরা পড়ে যাচ্ছে ভিলেনের হাতে, মৃত্যু অনিবার্য। মারদাঙ্গা ছবিতে শেষের দৃশ্যে যা হয়- সেরকম। হটাৎ উড়ে গেলো একটি হেলিকপ্টার। শত্রুপক্ষ মিশাইল ছুড়লো হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে। আগুন ধরে গেলো হেলিকপ্টারে। প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে পানিতে পড়ে গেলো জ্বলন্ত হেলিকপ্টার। চোখের সামনে যা ঘটছে তা ভিডিওতে ধারণ করে নিলে কোন প্রকার এডিটিং ছাড়াই হয়ে যাবে একটি বিশ মিনিটের অ্যাকশন সিনেমা।
এখানে যারা সরাসরি অ্যাকশানে অংশ নিলো, সিনেমার শ্যুটিং এর সময়েও রিস্কগুলো তারাই নেয়। কিন্তু পর্দায় সব কৃতিত্ব যায় অভিনেতা-অভিনেত্রীর ঘরে। অবশ্য আজকাল নায়ক-নায়িকারাও অনেকরকম ঝুঁকি নিয়ে অভিনয় করছেন চরিত্রের প্রয়োজনে।
সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। আর্নল্ড সোয়ার্জনেগারের ‘টার্মিনেটর-২’ এর অংশবিশেষ থ্রি-ডাইমেনশানে দেখানো হচ্ছে। টার্মিনেটর-২ সিনেমাটি দেখেছিলাম আগে, একজন মানুষকে খুনি রোবটের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য অন্য রোবটের লড়াই। এবার চরিত্রগুলোকে ত্রিমাত্রিক ছবিতে দেখতে খুব ভালো লাগলো। অ্যাকশানগুলো ঘটছে চোখের সামনে, মনে হচ্ছে একদম জীবন্ত। আরো বাস্তবতা আনতে দুজন অভিনেতা-অভিনেত্রী সরাসরি অংশ নিচ্ছে অভিনয়ে। তারা বন্দুক হাতে ছুটে বেড়াচ্ছে সারা হল জুড়ে। ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি যখন ভিলেন রোবটের হাত থেকে ছুটে আসছে উত্তপ্ত সীসা- একদম চোখের সামনে। মনে হচ্ছে একটু নড়াচড়া করলেই চোখ বিঁধে যাবে। অ্যাকশান, সাসপেন্স আর থ্রিলে ভরা এই বিশ মিনিটের প্রতিটি সেকেন্ডই উপভোগ্য। অবাস্তবকে বাস্তব করে তুলতে হলিউডের জুড়ি নেই। আবার বাস্তবকেও হয়তো তারা অবাস্তব করে ছেড়ে দেয়।
সন্ধ্যা নেমে আসছে হলিউডের পাহাড়ে। আস্তে আস্তে ঘরমুখো হচ্ছে মানুষ। এবার ফেরার পালা। স্টুডিও’র শাটল বাসে চেপে চলে এলাম ইউনিভার্সাল সিটি বাসস্টপে। তারপর রাস্তা পেরিয়েই পাতাল রেল।
হলিউড-হাইল্যান্ড স্টেশনে নেমে পাতাল থেকে বেরিয়ে আসতেই জমজমাট হলিউড বুলেভার্ড। ট্যুরিস্টে ভর্তি শনিবারের সন্ধ্যা। কৃষ্ণ-ভাবনা কেন্দ্র ইস্কনের আমেরিকান ভক্তরা ‘হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ’ গাইতে গাইতে নেচে বেড়াচ্ছে ফুটপাতে। গেরুয়া রঙের ধূতি আর ফতুয়াতে বেশ দেখাচ্ছে এই আমেরিকান শ্বেতাঙ্গদের। মৃদঙ্গ আর করতালের শব্দে লোকজন হা করে তাকাচ্ছে।
রাস্তা পেরিয়ে ম্যাকডোনাল্ডসের সামনে এসে দেখলাম একজন লোক রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বিচিত্রভঙ্গিতে হাত-পা ছুঁড়ছে। কানে লাগানো ইয়ারফোন দেখে বোঝা যাচ্ছে ‘রক মিউজিক’ শুনে তালে তালে নাচার চেষ্টা করছে। গায়ের বাদামী রঙ দেখে কৌতূহলী হয়ে তার দিকে তাকাতেই সে কানের তালা খুলে বললো, "জেসাস লাভ ইউ ম্যান।"
"সো হোয়াট?"
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো সে। আমার এরকম উত্তরের জন্য হয়তো প্রস্তুত ছিলো না। বললো, "হোয়ার ইউ ফ্রম?"
"ইউনিভার্সাল স্টুডিও।"
"নো ম্যান, আই মিন, হোয়ার ইজ ইওর কান্ট্রি? ইন্ডিয়া? বাংলাদেশ?"
কথা বলার সময়ও তার নাচানাচি থামছে না। সমানে কাঁধ ঝাঁকাচ্ছে আর পা ছুঁড়ছে। মনে হচ্ছে এই অঙ্গভঙ্গি তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, ইচ্ছে করলেও এই শরীরকম্প থামাতে পারবে না সে। তার মুখে ‘বাংলাদেশ’ উচ্চারণ শুনে মনে হলো লোকটা বাংলাদেশি। আমি বাংলাতেই প্রশ্ন করলাম, "আপনি বাংলাদেশি?"
মুহূর্তেই নাচানাচির বেগ বেড়ে গেলো তার। গলার স্বরও সপ্তমে উঠে গেলো। সে ইংরেজিতেই চিৎকার করে ওঠলো, "নো, নেভার। আই অ্যাম অ্যান অ্যামেরিকান। অ্যামেরিকা ইজ মাই কান্ট্রি। গড ব্লেস অ্যামেরিকা।"
আসন্ন সন্ধ্যার এই হলিউডের রাস্তায় নৃত্যপাগল লোকটিকে আর নিরাপদ মনে হচ্ছে না। চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই একলাফে আমার সামনে চলে এলো লোকটা। চিৎকার করে বললো, "জেসাস লাভ ইউ ম্যান।"
"আই নো দ্যাট। আই নো জেসাস মোর দ্যান ইউ নো। হি ইজ মাই ফ্রেন্ড।"
হাঁটতে শুরু করলাম। একদিকের ফুটপাতে সাদা আমেরিকানদের গলায় হরেকৃষ্ণ গান, অন্যদিকের ফুটপাতে বাদামী বাঙালির গলায় যীশুর প্রেম, জায়গাটিও হলিউড। এখানে হয়তো সবকিছুই মানিয়ে যায়।
No comments:
Post a Comment