ক্যালিফোর্নিয়া
টু নিউমেক্সিকো
লস অ্যাঞ্জেলেস -
ডেনভার - আল্বুকার্কি
লস অ্যাঞ্জেলেস
ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, সংক্ষেপে এল-এ-এক্স
(LAX) শিকাগো আর আটলান্টার
পরে আমেরিকার তৃতীয় ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট। ১৯২৮ সালের
আগে যেখানে হালচাষ হতো আজ সেখান থেকে গড়ে
প্রতি মিনিটে একটি বিমান
আকাশে ওড়ে। আমাদের
প্লেন ল্যান্ড করে টার্মিনালে
পৌঁছাতে অনেকক্ষণ সময় নিলো।
এয়ারপোর্টের আয়তন আর ব্যস্ততা দুটোই বুঝতে পারছি প্লেনে বসেই। শত শত ছোট-বড় বিমান সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে
আছে। কোনটা নামছে- কোনটা ওড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদেরই কোন একটাতে
চড়ে আমাকে ছুটতে হবে ডেনভারের
উদ্দেশ্যে আরেকটু পরেই। পাইলট
আর কেবিন ক্রুদের ‘গুডবাই’ ‘সি ইউ’
ইত্যাদি শুনতে শুনতে বেরিয়ে এলাম প্লেনের দরজা দিয়ে। এবার পেরুতে হবে আসল
গেট- আমেরিকান ইমিগ্রেশান।
পৃথিবীর সবদেশের এয়ারপোর্ট মূলত একই
ধরনের সিস্টেমে চলে। একই
ধরনের বোর্ডিং ব্রিজ, প্রায় একই ধরনের অ্যারাইভ্যাল
ও ডিপার্চার লাউঞ্জ। যে পার্থক্যটা
সবচেয়ে বেশি চোখ
পড়ে তা হলো
এয়ারপোর্টের আকৃতি বা স্থাপত্যে।
দিকনির্দেশনা দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি ইমিগ্রেশানের দিকে। পাসপোর্ট
আর ফরম দুটো
হাতে ধরে রেখেছি
শক্ত করে। মনে
হচ্ছে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি
হাতে প্রবেশপত্র আর রেজিস্ট্রেশন
কার্ড নিয়ে। কয়েক মিটার
পর পর দু'তিনজন
করে সিকিউরিটি গার্ড। তাদের পোশাক আগাগোড়া কালো এবং
সিংহভাগ সিকিউরিটি গার্ডের গায়ের রঙও কালো। বিশাল আকৃতির কালো কালো
দৈত্য সব, দেখেই গা ছমছম
করছে আমার।
ইমিগ্রেশান এলাকাটা বিশাল। কাউন্টারগুলো না থাকলে
সহজেই ফুটবল ম্যাচ খেলা যাবে
এখানে। সারি সারি
কাউন্টারের ওপারে শত শত ব্যস্ত অফিসার। সিংহাসনে বসলেই যেমন রাজা
হয়ে যায় অনেকে,
এই অফিসারেরাও হয়তো তাঁদের
চেয়ারে বসে অনেকটা
সেরমকই হয়ে যান। দূর থেকে যে কয়জনের চেহারা দেখছি সবাই কেমন
যেন রাগি রাগি
চোখে তাকাচ্ছেন। নন-আমেরিকান পাসপোর্টধারীদের কাউন্টার স্বাভাবিক ভাবেই আলাদা এবং সংখ্যাও
বেশি। কাউন্টারের সংখ্যা অনেক হওয়াতে
খুব বেশিক্ষণ লাগার কথা নয় ইমিগ্রেশানে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে
একেকজনকে অনেকক্ষণ ধরে জেরা
করছে।
আমার লাইন
থেকে কাউন্টারের দূরত্ব দু’মিটার। কাউন্টারের কাগজপত্র দেখা বা গেলেও কথাবার্তা মোটামুটি শোনা যাচ্ছে। বাম পাশের কাউন্টারের অফিসারটির আয়তন বিশাল। পাকানো লালচে গোঁফ ঝুলে আছে
ঠোঁটের উপর। সারাক্ষণই মুখ নড়ছে। চিবুচ্ছেন
কিছু। পান তো খাবার
কথা নয় এখানে,
হয়তো চুইংগাম। অনেকক্ষণ ধরে চিবিয়ে
চিবিয়ে প্রশ্ন জ্ঞিজ্ঞেস করছেন আমার আগেরজনকে। অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক ব্যাগ থেকে একটু
পর পর এই কাগজ সেই কাগজ
বের করে অফিসারকে
দেখাচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্টেরই এ অবস্থা!
আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে কে জানে।
"নেক্সট প্লিজ।"
চায়নিজ উচ্চারণ শুনে ডানদিকে
চোখ গেলো। আমার
ডাক পড়েছে সেদিকের কাউন্টারে। একজন চায়নিজ
অফিসার চশমা চোখে
তাকিয়ে আছেন আমার
দিকে। পাসপোর্ট আর ফরমগুলো
এগিয়ে দিলাম। পাসপোর্ট দেখে কোন
ভাবান্তর হলো না অফিসারের। হয়তো এক্সপ্রেশান
লুকিয়ে রাখতে জানেন তিনি। শুনেছি
এদেশের এয়ারপোর্টে গোপন ক্যামেরায়
সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা যায়। অফিসার যদি আমার
পাসপোর্ট দেখে কোন
রকমের অসম্মানজনক ভাব দেখান
তাহলে বিপদে পড়তে পারেন
বলেই হয়তো সব পাসপোর্টকেই সমান সম্মান
দেখানোর চেষ্টা করছেন।
সে যাই
হোক, আমার বেশ
ভালো লাগলো। পাসপোর্টের রঙ দেখেই
এঁরা আমাদের অপমান করতে শুরু
করেন জাতীয় যে সমস্ত
কথা শুনে থাকি,
আসলে তা ঠিক
নয় বলেই মনে
হচ্ছে। কম্পিউটারের স্ক্যানারে আমার ভিসা
স্ট্যাম্পটা স্ক্যান করতেই কম্পিউটারের মনিটরে ভেসে উঠলো
আমার ছবি সহ সব তথ্য। সবকিছু
ঠিক আছে। শুরু
হলো জেরা।
"কী করেন আপনি?"
"আমি একজন ফিজিসিস্ট। ইউনিভার্সিটিতে কাজ করি।"
"এখানে কেন এসেছেন?"
"কনফারেন্সে যোগ দেয়ার
জন্য।"
"কিসের কনফারেন্স?"
"আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির।"
"ও, তাই নাকি?
কোথায় হচ্ছে এই কনফারেন্স?"
"আলবুকারকি।"
"আলবুকারকি ইউনিভার্সিটিতে?"
আলবুকারকি ইউনিভার্সিটি নামে কোন
ইউনিভার্সিটি সেখানে আছে কিনা
আমি জানি না। যে ইউনিভার্সিটি আছে বলে জানি তার নাম
ইউনিভার্সিটি অব নিউ
মেক্সিকো। কিন্তু অন্যকে জ্ঞান বিতরণ করতে গেলে
বিপদের সম্ভাবনা অনেক। তার
ওপর ইমিগ্রেশান অফিসারকে শুধরাতে যাওয়া? অসম্ভব। উর্দিপরা লোক হুকুম
করা বা হুকুম
তামিল করা ছাড়া
আর কোন কিছু
পছন্দ করে বলে
আমার মনে হয় না। চুপ করে থাকলাম।
"আপনি তো আসছেন
মেলবোর্ন থেকে। ওখানেই
থাকেন?"
"হ্যাঁ। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতেই কাজ করি
আমি।"
"কতদিন আছেন মেলবোর্নে?"
"চার বছর।"
"ওকে।"
আই-নাইন্টিফোর ফরমে আলবুকারকি লিখতে গিয়ে জ্ঞিজ্ঞাসা
করলেন, "আলবুকারকি বানান করে কীভাবে?"
বুঝতে পারছি না আলবুকারকি বানান তিনি নিজে
জানেন না, নাকি আমি
জানি কিনা তা জানতে চাচ্ছেন। যে জায়গায়
যাবো সে জায়গার
নাম বানান করতে না পারলে মনে হয় যেতে দেবে না সেখানে। বিরক্তি লাগছে খুব। কিন্তু
বিরক্তি প্রকাশ করা যাবে
না এখানে। বিরক্তি প্রকাশের দায়ে পারমিট
না দেয়ার ক্ষমতাও হয়তো আছে
এঁদের। বানান করলাম আলবুকারকি (Albuquerque)।
"কতদিন থাকবেন আমেরিকায়?"
"দু’সপ্তাহ।"
"এক মাসের পারমিট দিচ্ছি আপনাকে। হ্যাভ এ গুড
টাইম অ্যান্ড ওয়েলকাম টু আমেরিকা।"
ধাম করে
একটা সিল বসিয়ে
দিলেন আমার পাসপোর্টে। আই-নাইন্টিফোর ফরমের একটা অংশ
ছিঁড়ে পাসপোর্টের পাতায় স্ট্যাপল করে পাসপোর্ট
আর কাস্টমস ফরমটা ফেরত দিলেন
আমাকে।
এবার ছুটতে
হচ্ছে। কাজ কম নয়। লাগেজ বেল্ট থেকে লাগেজ
নিয়ে কাস্টমস এরিয়া পার হতে তেমন
কোন অসুবিধা হলো না। কাস্টমস অফিসার শুধু একবার
জ্ঞিজ্ঞেস করলেন, "আপনার ব্যাগে এমন কিছু
কি আছে যা আমাদের জানা দরকার?"
নাই শুনেই
কাস্টমস ফরমটা নিয়ে বললেন,
“ওয়েলকাম টু আমেরিকা
স্যার।”
আমেরিকান অভ্যর্থনা সম্পর্কে আমার ধারণা
এতটা মোলায়েম ছিলো না। আমার ব্যাগেজ স্ক্যানারেও দিতে হলো
না। একটা ভারতীয়
পরিবারকে দেখলাম অ্যাগ্রিকালচারাল ডিপার্টমেন্ট আটকে দিয়েছে। কাঁচা শাকসব্জি নিয়ে এসেছেন
তাঁরা।
কাস্টমস এরিয়া পার হতেই
দু'জন মহিলা পুলিশ ছুটে এলো
আমার দিকে। আমি
তো ভয়ে কাঠ
হয়ে গেছি। আবার
কী হলো? তেমন কিছু
না। তারা পুলিশ
নয়, এয়ারপোর্টের কর্মী। আমার লাগেজট্যাগ
দেখে বলে দিলো
কোন পথে যেতে
হবে, কোথায় কোন্ বেল্টে আমার লাগেজ
তুলে দিতে হবে। নির্দিষ্ট বেল্টে ব্যাগ তুলে দিলেই
আমার দায়িত্ব শেষ।
তাদের কথা মতো এগিয়ে
গেলাম। কনভেয়র বেল্টে ব্যাগ তুলে দিতেই
ব্যাগ চলে গেল
আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে। কোথায় গেলো সে সম্পর্কে আপাতত কোন ধারণাই
নেই আমার।
এবার কোনদিকে
যাবো? ডেনভারগামী প্লেনের কাউন্টার কোথায়? কোথায় ইউনাইটেড এয়ারলাইনস?
একজন অফিসারকে
জ্ঞিজ্ঞেস করলাম। সোজা দরজা
দেখিয়ে দিলেন তিনি। এটাতো
টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে
যাবার পথ। ইতস্তত
করে আবার জ্ঞিজ্ঞেস
করলাম। এবার একটু
বিরক্ত হয়েই তিনি
বললেন, “যেখানেই যাও, ওটাই একমাত্র
পথ। সো, গেট আউট
নাউ।” এটা কেমন
ধরনের
অভ্যর্থনার ভাষা?
গেট দিয়ে
বেরোতেই রাস্তায় এসে পড়লাম। এই তাহলে আমেরিকা! হকচকিয়ে যাবার মতো না হলেও কিছুটা অপ্রস্তুত আমি। কারণ
দ্রুত যেতে হবে
গন্তব্যে। মাথার ওপর দিয়ে
চলে গেছে অনেকগুলো
ফ্লাইওভার। গাড়ি ছুটছে
অনবরত তাদের ওপর দিয়ে। বড় বড় পিলারে
টার্মিনাল নম্বর লেখা।
থ্রি থ্রি থ্রি ... যতদূর চোখ যায়
কেবল তিন নম্বর টার্মিনালই দেখতে পাচ্ছি। সাত নম্বর টার্মিনাল কত দূরে?
কাউকে জ্ঞিজ্ঞেস করবো কিনা
ভাবছি- এসময় গলায়
কার্ড ঝোলানো একজন কৃষ্ণাঙ্গ
ছুটে এলো আমাকে
সাহায্য করার জন্য। ম্যাপ বের করে
দেখিয়ে দিলো কোথায়
সাত নম্বর টার্মিনাল। বললো,
"টেক দ্য বাস ফ্রম হিয়ার।"
খুশি হয়ে
গেলাম আমি এরকম
স্বতঃস্ফুর্ত সহযোগিতা পেয়ে। কৃষ্ণাঙ্গকে
ধন্যবাদ জানিয়ে শাটল বাসের
দিকে পা বাড়াতেই
পেছন থেকে ডাক
দিলো।
"হ্যাই ব্রাদার"
ফিরতেই গলা নিচু
করে যা বললো
তার সহজ বাংলা
অনুবাদ এরকম:
"কিছু দিয়ে যান ভাই। আপনার উপকার করলাম, বিনিময়ে কিছু দেবেন
না?"
আমেরিকায় পা দিয়েই
এরকম কিছুর সামনে পড়তে হবে
ভাবিনি। কিন্তু আমিও বাংলাদেশের
পোলা। আমার কাছ
থেকে এত সহজে
ডলার বের করে
নিতে পারবে এই লোক?
আমি একটাও শব্দ উচ্চারণ
না করে হাঁটতে
শুরু করলাম। পেছনে লোকটা ডেকেই চলেছে- ‘হাই ম্যান,
কাম অন ম্যান ...।"
আমি তখন
ঠাকুরমার ঝুলির
অরুণ-বরুণ-কিরণমালা গল্পের কিরণমালার মতো পেছনের
সব ডাক উপেক্ষা
করে এগিয়ে চলেছি সাত নম্বর টার্মিনালের দিকে। হাঁটতে
হাঁটতে একবার মনে হলো
একটা ‘সরি’ অন্তত বলা উচিত
ছিলো আমার। কিন্তু
আমার তো একটুও দুঃখ হচ্ছে না। দুঃখিত বলবো কোন
দুঃখে? আমার হচ্ছে
রাগ। সত্যি কথা বললে
বলতে হবে, ‘আই অ্যাম
অ্যাংরি’। কিন্তু
ভদ্রতার খাতিরে সবসময় মিথ্যে বলতে হবে। বলতে হবে, 'আই অ্যাম
সরি।’
শাটল বাসে
না ওঠাটা বোকামি হয়েছে। তিন নম্বর টার্মিনাল
থেকে সাত নম্বর টার্মিনালের দূরত্ব মনে হচ্ছে
এক কিলোমিটার হবে। সাত নম্বর টার্মিনালের
সামনে এসে ছোট্ট
একটা অ্যাস্কেলেটরে চেপে দোতলায়
উঠতে হলো। এখানেই
ডিপার্চার লাউঞ্জ। ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের সারি সারি
কাউন্টার।
বিশাল আয়োজন আর প্রচন্ড
ভীড়। এতোটা ভীড়ের জন্য প্রস্তুত
ছিলাম না মোটেও। হাতে সময় আছে
মাত্র এক ঘন্টা। লাইনের যে দৈর্ঘ্য
দেখছি তাতে খুব
একটা ভরসা পাচ্ছি না।
কয়েকজন সিকিউরিটি অফিসার ঘুরছে এদিক ওদিক। একজনকে আমার হাতের
টিকেট দেখাতেই বললো ডান
দিকের গেট পেরিয়ে
সোজা ভেতরে চলে যেতে। কিন্তু সোজা যেতে
বললেই তো যাওয়া
যায় না এখানে। গেট পেরিয়ে একটু ভেতরের দিকে যেতেই আরেকটি সিকিরিউটি চেকিং
এরিয়া। ইন্টারন্যাশনাল অংশটুকু সহজে পেরিয়ে
এসে এখানকার সিকিউরিটির ওপর একটা
তাচ্ছিল্যের ভাব চলে
এসেছিলো। কিন্তু এখানে সিকিরিউটির আড়ম্বর দেখে বুঝলাম
এর নাম আমেরিকা। এগারোই সেপ্টেম্বর ডোমেস্টিক ফ্লাইটই হাইজ্যাক করা হয়েছিলো। সুতরাং সিকিউরিটির চৌদ্দগোষ্ঠী এখন ডোমেস্টিক
টার্মিনালে।
হাতের ব্যাগ চলে গেলো
এক্স-রে স্ক্যানারের
ভেতর। আমাকে যেতে হলো
মেটাল ডিটেক্টরের ভেতর দিয়ে। সহজেই পার হয়ে
গেলাম এখানে। ব্যাগটাও ছাড়া পেয়ে
গেলো কোনরকম প্রশ্ন ছাড়াই। বেঁচে গেলাম এযাত্রা। বেশির ভাগ ব্যাগই
খুলে দেখা হচ্ছে
এখানে। সন্দেহজনক চেহারা বা ব্যাগ
দেখলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে
সিকিউরিটির লোকজন। ব্যাগ খুলে দেখার
সাথে নানারকম গা জ্বালা
করা প্রশ্ন তো আছেই।
আমার ফ্লাইট
নাম্বার ইউ-এ ওয়ান ওয়ান
সেভেন এইট (UA1178)। বোর্ডিং গেট নাম্বার
সেভেনটি টু। গেটের
কাউন্টারে সাদা-কালোর সহাবস্থান- সাদা মহিলা,
কালো পুরুষ অফিসার। দুটো বোর্ডিং
কার্ড দেয়া হলো
আমাকে। একটা লস অ্যাঞ্জেলেস টু ডেনভার,
অন্যটা ডেনভার টু আলবুকার্কি।
হাতে কিছুটা
সময় পাওয়া গেলো এতক্ষণে। নানারকম গিফ্ট শপ, খাবারের দোকান সাজানো এখানে। পিপাসায় গলা শুকিয়ে
গেছে অনেকক্ষণ। ম্যাকডোনাল্ডসের কাউন্টারে উঁকি মারলাম
একটু। দাম দেখে
আঁৎকে ওঠার মতো
অবস্থা। ম্যাকডোনাল্ডসের মাতৃভূমি এই আমেরিকা। অথচ এখানেই মনে হচ্ছে
তাদের খাবারের দাম অন্যান্য
দেশের তুলনায় বেশি। অস্ট্রেলিয়ায়
যে বিগম্যাক স্যান্ডুইচের দাম আড়াই
ডলার, এখানে তার দাম
প্রায় চার আমেরিকান
ডলার। তার মানে
বর্তমান এক্সচেঞ্জ রেট অনুযায়ী
অস্ট্রেলিয়ান ডলারে প্রায় আট ডলার। এত পার্থক্য কীভাবে হয়!
আমেরিকায় আসার সাথে
সাথেই দেখি আমেরিকান
ডলারকে অস্ট্রেলিয়ান ডলারে হিসেব করে দেখার
মানসিক প্রক্রিয়া শুরু হয়ে
গেছে নিজের অজান্তেই। একটা ডিপার্টমেন্ট
স্টোরে ঢুকে এক বোতল
ফলের রস কিনলাম। বোতলের গায়ে দাম
লেখা আছে ২ ডলার ১৫ সেন্ট। কিন্তু কাউন্টারের মেয়েটি তার মেশিনে
বোতলটা স্ক্যান করে বললো
দু'ডলার সাইত্রিশ সেন্ট। কারণ কী?
সেলস ট্যাক্স। পাঁচ ডলারের
একটা নোট এগিয়ে
দিলাম।
ডলার নোটকে
এরা বলে ডলার
বিল। এক সেন্টকে
বলে পেনি। এখানে
পেনির ব্যবহার চলে, অস্ট্রেলিয়ার মত রাউন্ডিং
হয় না। অস্ট্রেলিয়ার এক সেন্টের
মুদ্রা বাতিল হয়ে গেছে
১৯৮১ সালে। সেখানে
৮২ সেন্ট হলে ৮০ সেন্ট বা ৮৩ সেন্ট হলে ৮৫ সেন্ট ধরা হয়। এখানে আরো যেটা
নতুন আমার কাছে
সেটা হলো সেল ট্যাক্স। অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডে সেল ট্যাক্স যোগ করেই
দাম লেখা হয়। এখানে ব্যাপারটা অন্যরকম। দাম দিতে
গিয়ে কনফিউজড হয়ে যেতে
হয়। মুল্যতালিকার ট্যাক্সের হার বা পরিমাণ লেখা নেই
বলে নিজেকে কেমন যেন
প্রতারিত মনে হয়। এটাই এখানে আমার প্রথম
কালচারাল শক বা ইকোনমিক্যাল শক।
আমেরিকান কয়েন আগে
দেখিনি কখনো। ফেরত
পাওয়া পয়সাগুলো দেখে চেনার
চেষ্টা করছি কোনটা
কী। সবচেয়ে ছোট আকারের
সাদা কয়েনটাকে ভেবেছিলাম পেনি। কিন্তু
না, লেখা আছে
ডাইম (Dime)। ডাইমটা কী বস্তু?
এক সেন্টের কয়েনটা ডাইমের চেয়ে আকারে
সামান্য বড়। কিন্তু
তামাটে মুদ্রাটাকে সহজেই চেনা যায়। তার ডাক নাম
পেনি হলেও লেখা
আছে ওয়ান সেন্ট। পাঁচ সেন্টের কয়েন পেনি
বা ডাইমের চেয়ে আকারে
বড়। আর সবচেয়ে
বড় কয়েনটির গায়ে লেখা
আছে কোয়ার্টার ডলার। মানে
আমাদের সিকি। তাহলে
ডাইম হলো দশ সেন্ট। দশ সেন্টের
কয়েনের সাইজ কেন
সবচেয়ে ছোট হলো
বুঝতে পারছি না। এ সম্পর্কে কাউকে প্রশ্ন করার কোন
মানে হয় না। “ডাইম কেন ছোট?”- এরকম প্রশ্নের
কোন গুরুত্ব কি আছে
আমেরিকানদের কাছে?
ফলের রস একটুখানি মুখে যেতেই
কেমন জানি গা গুলিয়ে উঠলো। এমন
কেন? ক্লোরিনের তীব্র ঝাঁঝ। অতিকষ্টে
কয়েক ঢোক গিললাম। কিন্তু এ বস্তু
হজম করা আমার
পক্ষে অসম্ভব। বোতলটাকে বিসর্জন দিতে হলো। এদেশের সব পানীয়ই
কি এরকম?
প্লেনে ওঠার তোড়জোড়
শুরু হয়েছে। বাহাত্তর নম্বর গেট খুলে
দেয়া হয়েছে। লাইনে দাঁড়ালাম। লাইনের গতি অসম্ভব
মন্থর। সবাইকে আবার চেক
করা হচ্ছে ম্যানুয়েলি। পাসপোর্ট, টিকেট, বোর্ডিং পাস, ছবি সব দেখলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
ডোমেস্টিক ফ্লাইটে এখন সব যাত্রীকেই ফটো আই-ডি সাথে রাখতে
হয়। স্টেট আই-ডি, ড্রাইভার্স লাইসেন্স বা পাসপোর্ট
গ্রহণযোগ্য। আমেরিকার সোশাল সিকিরিউটি কার্ডে ছবি থাকে
না বলে তা ব্যবহার করা যায়
না এখানে। আই-ডির সাথে
বোর্ডিং কার্ডের নাম মিলিয়ে
দেখা হচ্ছে বার বার। আরবী
নাম দেখলেই মনে হচ্ছে
সিকিরিউটি ডিপার্টমেন্টের কাজ বেড়ে
যাচ্ছে। আশেপাশে কয়েকজন আমেরিকান কালো ছাড়া
আমার মতো বাদামী
চামড়ার আর কাউকেই
দেখতে পাচ্ছি না এখানে।
"আপনার অনুমতি সাপেক্ষে ব্যাগটা খুলে দেখছি
স্যার।" বলেই আমার
হাতের ব্যাগ খুলতে শুরু করলো
একজন তরুণী অফিসার। আমার অনুমতির
কোন দরকার এখানে আছে বলেই
মনে হলো না। ব্যাগের সব জিনিসই
হাতড়াচ্ছে এই শ্বেতাঙ্গিনী
অফিসার। আমেরিকায় পুলিশ বা নিরাপত্তাকর্মীদের নাকি অফিসার বলে সম্বোধন
করতে হয়।
এবার একজন
কালো পালোয়ান আমার গায়ে
হাত দেবার অনুমতি চাইলো। আইনে আছে
বলেই অনুমতি চাচ্ছে, নইলে অনুমতি
না দিলে ঘাড়ে
হাত দিবে- এমন ভাব
তার। শরীরের মোটামুটি সব জায়গাতেই
টিপেটুপে দেখলো কোনকিছু লুকিয়ে রেখেছি কিনা। দর্জির
দোকানে মাপ দেয়ার
ভঙ্গিতে মাঝে মাঝে
হাত তুলতে ও পা ফাঁক করে দাঁড়াতে
হচ্ছিলো। আমার পেছনের
অনেক যাত্রীই চলে যাচ্ছে
কোনরকম চেকিং ছাড়াই। কিন্তু আমি জানি
সারা প্লেনে শুধু একজন
যাত্রীকে তারা চেক
করে দেখবে ঠিক করলে-
সেই একজন হবো
আমি। আমাদের গায়ের রঙ আর দেশের নাম মিলিয়ে
আমরা এরকম যোগ্যতা
অর্জন করেছি এখানে।
"স্যার, জুতাজোড়া একটু খুলবেন?"
মুখের বাক্যাটা এরকম হলেও
বলার ভঙ্গিটার অনুক্ত ভাষা হলো
‘এই ব্যাটা, জুতা খোল। দেখি জুতার ভেতর কী মশলা লুকিয়ে রেখেছিস!’
জুতা খুলে
দিলাম। গ্লাভস পরা হাত
দিয়ে জুতাজোড়া উল্টে
পাল্টে দেখলো। এদিকে আমার ব্যাগ
চেক করছে যে মেয়েটি- সে আমার
ক্যামেরা হাতে নিয়ে
কিছুতেই অন করতে
পারছে না। এরকম
মডেলের ক্যামেরা হয়তো সে দেখেনি আগে। আমাকে
বললো ক্যামেরা অন করে
দিতে। ক্যামেরা অন করার
সময় চার-পাঁচজোড়া চোখ আমার
হাতের ক্যামেরার দিকে। যেন
ক্যামেরা দেখেনি কোনদিন। মেয়েটি এবার ক্যামেরার
ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে
নিশ্চিত হলো যে এটা আসলেই ক্যামেরা - ক্যামেরা আকৃতির কোন বোমা
নয়।
মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে
আমার। রাগ হচ্ছে
প্রচন্ড। কিন্তু আমি ভালো
করেই জানি মেজাজ
খারাপ করার বা রাগ করার অধিকার
অর্জন করতে হলে
ধনী ও ক্ষমতাশালী
দেশের নাগরিক হতে হয়। দেশের সব নাগরিকেরও
আবার সমান ক্ষমতা
থাকে না। যেমন
আমার শরীর তল্লাশি
করলো যে কালো-আমেরিকান আর আমার
ব্যাগ ঘাটছে যে সাদা-আমেরিকান- সংবিধান অনুযায়ী তাদের দু'জনের নাগরিক অধিকার সমান হলেও
সামাজিক ভাবে তারা
তাদের নিজের দেশেও সমান নয়।
"ও কে স্যার। ইউ মে গো নাউ।"
কথাগুলো হাসিমুখে মোলায়েম ভাবে বললেও
ভালো লাগলো না। জুতাজোড়া
কোনরকমে পায়ে গলিয়ে
ছুটলাম বোর্ডিং ব্রিজের সুড়ঙ্গ পথে। প্লেনের
দরজায় হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে একজন
কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী, ‘ওয়েলকাম অ্যাবোর্ড স্যার’।
আমার সিট
জানালার পাশে। ছোট্ট
বোয়িং ৭৭৭ প্লেন। আমেরিকার বোয়িং কোম্পানির প্লেনগুলোর মডেল নম্বর
কেন ৭৩৭, ৭৪৭, ৭৭৭ –এরকম হয় আমি জানি না। যাত্রীর সংখ্যা শ’খানেকের
বেশি হবে না এখানে। প্লেনটাকে একটা বড় ধরনের বাসের মত লাগছে। এ প্লেনের পাইলট একজন মহিলা। কেবিন ক্রুদের মধ্যে চায়নিজ-আমেরিকান, আফ্রিকান-আমেরিকান আর স্প্যানিশ-আমেরিকানদের মিশ্রণ দেখে ভালো
লাগলো। এতক্ষণে মনে হচ্ছে
আমেরিকা আসলেই বহুজাতিক দেশ।
সামান্য একটু ঘোষণা
দিয়েই ছুটতে শুরু করলো
প্লেন। রানওয়ের দৌড় শেষ
করে ঘুড়ির মতো উঠে
গেলো আকাশে। এত ছোট
বিমানে এর আগে
আমি আর চড়িনি। ভীষণ বাম্পিং হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপরই ভয়াবহ রকমের ঝাঁকুনিতে মনে হচ্ছে
প্লেনে নয়, চড়েছি বর্ষাকালের কর্ণফুলিতে কোন ডিঙি
নৌকায়।
আমার পাশের
সিটে একজন ষাটোর্ধা
মহিলা। যতবারই পাশ ফিরে
তাকাই, দেখি তিনি
তাকিয়ে আছেন আমার
দিকে। আমার আগে
আর কোন বাদামী
চামড়ার দেখা পাননি?
নাকি আমার সাথে
আলাপ জমিয়ে পরে নিজেদের
মাঝে এ নিয়ে
সরস হাস্যরস তৈরি করার
মতলব! আবার চোখাচোখি
হতেই মুখ খুললেন
তিনি, "গোয়িং হোম?"
"না ম্যাডাম। বাড়িতে যাচ্ছি না, বেড়াতে যাচ্ছি।"
"আমি বাড়িতে যাচ্ছি। গিয়েছিলাম নিউজিল্যান্ডে। সেখানে আমার বড় মেয়ে থাকে তার
হাজবেন্ডের সাথে। তার
হাজবেন্ড হ্যানরি ..."
বুঝতে পারলাম আমি কোথায়
যাচ্ছি তাতে তাঁর
কিছু যায় আসে
না। তাঁর কথা
বলার দরকার। বাড়িতে হয়তো তাঁর
কুকুর বা বিড়াল ছাড়া আর কেউ নেই। স্বামী যে নেই
তা তো দেখতেই
পাচ্ছি। আমেরিকান বৃদ্ধারা তাদের স্বামীকে কখনোই বাড়িতে একলা রেখে
যাবেন না কোথাও। স্বামীর প্রতি ভালোবাসার চেয়েও অবিশ্বাস বেশি কাজ
করে এক্ষেত্রে। আমেরিকান বুড়োরা নাকি সুযোগ
পেলেই অন্য রমণীর
প্রতি হাত বাড়ান। ধনী বুড়ো হলে
তো কথাই নেই,
তরুণীরাই তখন উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভীড় জমায়।
আমি হ্যাঁ
হুঁ কিছুই বলছি না বৃদ্ধার কথায়। তাতেও
কিছু যায় আসে
না তাঁর। তিনি
বলেই চলেছেন তাঁর নিউজিল্যান্ড
ভ্রমণের গল্প। অকল্যান্ডে
কী কী করেছেন,
লস অ্যাঞ্জেলেসে কতক্ষণ বসে থাকতে
হলো, তাঁর মেয়ে
তাঁকে কিছুতেই ছাড়তে চাচ্ছিলো না অথচ
তাঁকে চলে আসতেই
হয়েছে- ইত্যাদি। এ গল্প
শোনার জন্য আমার
আমেরিকা আসার কোন
দরকার ছিলো না,
বাংলাদেশেও এরকম গল্প
পাওয়া যায়।
এক প্যাকেট
বাদাম আর এক ক্যান কোকাকোলা দিয়ে গেলো
হাস্যময়ী কেবিন ক্রু। এদের
মুখের হাসিটা তাদের আই-ল্যাসের মতোই মন-ভোলানো কৃত্রিম। দু’ঘন্টার জার্নিতে এক প্যাকেট
বাদামের বেশি কিছু
আশা করা বোকামী। কিন্তু আমার ক্ষুধা
লেগে গেছে।
এক দিনে বেশ
কয়েকটা টাইমজোন পেরিয়ে এসে এমনিতেই
ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ঘড়িতে লস অ্যাঞ্জেলেস সময় এখন
পৌনে বারোটা। ডেনভারে নেমে আবার
সময় বদলাতে হবে। ডেনভার
অ্যাঞ্জেলেসের চেয়ে একঘন্টা
এগিয়ে আছে।
জানালায় চোখ রাখলাম। প্লেন খুব বেশি উঁচুতে
ওঠেনি। নিচের গাছপালা দেখা যাচ্ছে। আমেরিকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ
হয়ে যচ্ছি আমি। কিছু
কিছু জায়গা মনে হচ্ছে
শিল্পীর রঙ-তুলিতে আঁকা।
"ডেনভারে কোথায় যাবে তুমি?"
ভদ্রমহিলা সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন যে আমি
তাঁর নিউজিল্যান্ডের গল্পে মনযোগ দিচ্ছি না আর। তাই প্রসঙ্গ বদলেছেন।
বললাম, "আসলে ডেনভারে কোথাও থাকবো না। কানেক্টিং
ফ্লাইট ধরে আলবুকারকি চলে যাবো।"
"ওহ, আলবুকারকি যাবে। দারুণ
সুন্দর শহর ওটা। বেশ ভালো শহর। আমি গিয়েছিলাম গত বছর। তুমি তা জানো না ..."
গতবছর তিনি আলবুকারকি
গিয়ে কী করেছিলেন
তা আমি যেহেতু
জানি না, সেহেতু তিনি তার
বিস্তারিত বিবরণ দিতে শুরু
করলেন। তাঁর বর্ণনার
প্রতি আমার কোন
আকর্ষণ না থাকলেও
মাঝে মাঝে ‘হাউ নাইস’,
‘হোয়াট হ্যাপেন্ড দ্যান’ ইত্যাদি বলছি। কেন
বলছি আসলে? ভদ্রতার খাতিরে ভদ্রমহিলাকে উৎসাহ দেবার জন্য? শুধুই কি তাই?
অবচেতন মনে হয়তো
তাঁকে বোঝাতে চাচ্ছিলাম যে আমার
ইংরেজির দৌড় ইয়েস-নো-ভেরি গুডের চেয়ে সামান্য
হলেও
বেশি।
“একটু
পরেই আমরা ডেনভার
এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করছি”- ঘোষণা শেষ হবার
আগেই প্লেন নামতে শুরু করেছে। ল্যান্ডিংটাকে হ্যাপি ল্যান্ডিং বলা যাবে
না কিছুতেই। বাংলাদেশে বাসের হেল্পাররা যখন বাস
চালায় তখন যেভাবে
হঠাৎ ব্রেক কষে- সেরকম ভাবে ঝাঁকুনি
দিয়ে থেমে গেলো
আমাদের প্লেন। আমেরিকার ডোমেস্টিক প্লেনগুলো কি এভাবে
চলতেই অভ্যস্ত?
ডেনভার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। ডোমেস্টিক টার্মিনালে অপেক্ষা করছি আলবুকার্কির
কানেক্টিং ফ্লাইটের জন্য। ফ্লাইট
পাঁচটায়। বোর্ডিং টাইম সাড়ে
চারটায়। এখনো দু'ঘন্টার
মতো সময় হাতে
আছে। গেট নাম্বার
ফিফটি টু থেকে
প্লেনে উঠতে হবে। হঠাৎ মনে হলো
আমার লাগেজ ঠিক মতো
এসেছে তো? ঠিক ফ্লাইটে
উঠলো তো? নাকি লস অ্যাঞ্জেলেসের মত এখানেও
আমার লাগেজ আমাকেই তুলে দিতে
হবে আলবুকার্কির বেল্টে? লাগেজ বেল্ট কোথায় এখানে?
দিকনির্দেশনা অনুযায়ী কিছুদূর হেঁটে, কিছুদূর ফ্লোর অ্যাস্কেলেটরে চেপে, কিছুদূর সিঁড়ি দিয়ে নেমে
এলাম নিচের তলায়। এখানে
লেখা আছে ব্যাগেজের
জন্য যেতে হলে
একটা ট্রেন চাপতে হবে। এয়ারপোর্টের
ভেতর ট্রেন! কত বিরাট
এই এয়ারপোর্টের এরিয়া যে ট্রেনে
চেপে যেতে হয় ব্যাগেজ ক্লেইম এরিয়ায়!
কয়েক সেকেন্ডের
ভেতর ইলেকট্রনিক ট্রেন এসে দরজা
খুলে দাঁড়ালো। অনেকের সাথে আমিও
উঠে পড়লাম ট্রেনে। কোথায় যাচ্ছি জানি না। এক জায়গায় ট্রেন থামলে দেখা গেলো
‘কনকোর্স বি’।
এখানে নেমে আবার
দোতলায় উঠতে হলো। দোতলার ডানদিকে ব্যাগেজ বেল্ট। সেখানে আমার ব্যাগেজ
নেই। গেলো কোথায়?
অন্যদিকে উঁকি মারতে
গিয়ে চোখে পড়লাম
একজন সিকিরিউটি অফিসারের। সন্দেহজনক কিছু করে
ফেললাম না তো?
অফিসার ইঙ্গিতে লাইন দেখিয়ে
দিলো। স্নায়ুর ওপর চাপ
পড়তে শুরু করেছে।
ব্যাগেজ খুঁজতে এসে আসলে
চলে এসেছি এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি এরিয়ার বাইরে। এখন আবার
সিকিউরিটি চেকিং পেরিয়ে যেতে হবে
ভেতরে। আবার সিকিউরিটির
পুরো প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে
যেতে হবে ভাবতেই
কেমন যেন লাগছে।
আজ সারাদিনে
এপর্যন্ত অনেকবার অনেকরকম সিকিউরিটির ভেতর দিয়ে
যেতে হয়েছে আমাকে। আরো কতবার
যেতে হবে এখনো
জানি না। এতক্ষণে
অবশ্য আমি অনেক
দক্ষ হয়ে গেছি
এই অবস্থায়।
বড় প্লাস্টিকের
ঝুড়িতে ব্যাগ, কোট, কয়েন, চাবি, বেল্ট, ঘড়ি, চশমা সব ধরনের ধাতব বস্তু
রেখে ঝুড়িটা স্ক্যানিং মেশিনের ভেতর পাঠিয়ে
দিয়ে সহজেই পেরিয়ে গেলাম মেটাল ডিটেক্টরের বেড়া। বেশ
আত্মবিশ্বাসের সাথে জিনিসপত্র
নিলাম স্ক্যানিং মেশিনের টেবিল থেকে। কিন্তু
আমাকে কি এত সহজে যেতে দেয়া
যায়? আমার গায়ের
রঙ বা পাসপোর্টের
একটা আবেদন আছে না?
সুতরাং- “দয়া করে
জুতাজোড়া খুলে টেবিলের
ওপর রাখেন, স্যার।”
সিকিউরিটি অফিসার যেভাবে ‘স্যার’ শব্দটি উচ্চারণ করলো সেটাই
হয়তো স্বাভাবিক উচ্চারণ এখানে। কিন্তু আমার কানে
তা বিদ্রুপের মত শোনালো।
জুতা খুলে
টেবিলের ওপর রাখলাম। এবার আমার জুতা
নিয়ে শুরু হলো
তাদের রাসায়নিক পরীক্ষা। ফোরসেপের মাথায় এক টুকরো
কাগজ লাগিয়ে কী একটা
তরল পদার্থে কাগজটা ডুবিয়ে জুতার ভেতর এদিক
ওদিক ঘুরিয়ে আনলো। মনযোগ
দিয়ে দেখলো কাগজের রঙের কোন
পরিবর্তন হয়েছে কিনা। শেষে
কোন সিদ্ধান্তে আসতে না পেরে বললো, ‘থ্যাংক ইউ স্যার’!
জুতা পায়ে
দিতে গিয়ে মনে
পড়লো প্রেসিডেন্ট রিগানের কথা। রিগান
নাকি সাতাত্তর বছর বয়সেও
দাঁড়িয়ে মোজা পরতেন। তাঁকেও কি কখনো
এরকম দাঁড়িয়ে জুতা পরতে
হয়েছিলো কোন এয়ারপোর্টে? নিশ্চয়
নয়। এখানে কোন বুড়ো
মানুষ যদি দাঁড়িয়ে
জুতা পরতে না পারেন তবে? এরা এখানে কোন
চেয়ার টুল কিছু রাখেনি যেখানে বসে জুতা পরতে পারে কেউ।
রাগ উঠে
যাচ্ছে আমার। কিন্তু
নিজেই নিজেকে সাবধান করলাম,- হাই ম্যান,
বি কেয়ারফুল! ইউ আর লেস দ্যান নো বডি।
এত বিড়ম্বনা
পেরিয়ে যেখানে এসে পৌঁছালাম
সেখানে আমি প্লেন
থেকে নেমে সরাসরিই
এসেছিলাম। শুধু শুধু
এত হাঙ্গামা পোহানোর কোন দরকারই
ছিল না। অবশ্য
ওদিকে না গেলে
বুঝতে পারতাম না এখানকার
সিকিরিউটির চেহারা কেমন। সবখানেই
দেখি সমান ভয়ঙ্কর।
সাড়ে চারটায়
বোর্ডিং শুরু হলো। পাসপোর্ট, বোর্ডিং পাস চেক
করার পাশাপাশি মাঝে মাঝে
কয়েক জনের হাতের ব্যাগও চেক করে
দেখছে এখানে। আমি তো জানি আমার কেবিন
ব্যাগ অবশ্যই চেক করা
হবে। তারা বলার
আগেই আমি আমার
ব্যাগ রাখলাম তাদের সামনে চেকিং টেবিলে। আমাকে অবাক করে
দিয়ে তরুণী অফিসার বললো, "ইটস ওকে স্যার। ইউ আর গুড
টু গো।"
সারাদিনে এই প্রথম
মনে হলো কেউ
একজন সত্যিকারের সম্মান দেখালো আমাকে। বোর্ডিং গেট দিয়ে
ঢুকতে গিয়ে পেছন
ফিরে আরেকবার দেখলাম অফিসারটির মুখ। বড় মায়াবী। মানুষের ব্যবহারেই কেমন বদলে
যায় মানুষের মুখ। আমার
সাথে দুর্ব্যবহার করলে এই মায়াবী মুখটাই মনে হতো
জঘন্য শয়তানের মুখ।
এবারের প্লেনটা আরো ছোট। বোয়িং ৭৩৭। এই প্লেনের পাইলটও একজন মহিলা। এক ঘন্টার মত লাগবে
আলবুকার্কি পৌঁছাতে। ক্ষিধেয় পেট চোঁ
চোঁ করছে। এই প্লেনেও লাঞ্চ জুটবে না। ডেনভারে
কিছু খেয়ে নেয়া
উচিত ছিলো। কিন্তু
তখন নতুন এয়ারপোর্ট
দেখার উত্তেজনায় খাবারের কথা মনে
হয়নি।
এক প্যাকেট
বাদাম আর এক ক্যান কোকাকোলা রেখে গেলো
একজন মোটা কেবিন
ক্রু। প্লেনের ছোট প্যাসেজ
দিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে
এই স্থূলাঙ্গ মানুষটির। তার মুখে
কোন হাসি নেই। থলথলে গোমড়া মুখে ট্রে
হাতে টলতে টলতে
একবার সামনে যাচ্ছে আবার পেছনে
আসছে। একটু পরে
প্লেনের ঝাঁকুনি এত বেড়ে
গেলো যে কেবিনে
হাঁটা অসম্ভব হয়ে পড়লো। পেছনের অনেক যাত্রী
কোন খাবারই পেলো না আর।
ঝাঁকুনির কারণে বাইরের দৃশ্য খুব একটা
উপভোগ করতে পারছি
না। যতদূর চোখ যাচ্ছে
কেবল ধু ধু মরুভূমি। অ্যারিজোনার মরুভূমি পার হয়ে
এখন নিউ মেক্সিকোর
দিকে এগোচ্ছি আমরা।
কিছুক্ষণ পরেই
প্লেন নেমে এলো
আলবুকার্কি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। ভুল বললাম। এখানে লেখা আছে
“আলবুকারকি ইন্টারন্যাশনাল সানপোর্ট।" এয়ারপোর্টের বদলে সানপোর্ট
শব্দটা নতুন আমার
কাছে।
লস অ্যাঞ্জেলেস এয়ারপোর্টের তুলনায় আলবুকার্কি সানপোর্টকে শিশু বলা
যায়। ছোট্ট ছিমছাম বেশ খোলামেলা। প্লেন থেকে নেমে
খুব একটা হাঁটতে
হলো না। দেখলাম
স্টিভেন দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। স্টিভেনকে হাসলে অনেকটা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের
মত লাগে।
No comments:
Post a Comment