লস্
অ্যাঞ্জেলেস
আলবুকারকি ইন্টারন্যাশনাল সানপোর্ট থেকে আমার ফ্লাইট
বিকেল চারটায়। কিন্তু আমাকে হোটেল রুম ছেড়ে
দিতে হবে সকাল
এগারোটার মধ্যে। এয়ারপোর্টে গিয়ে বসে
থাকতে হবে বাকিটা
সময়। রুমে বসেই
চেক-আউট করার
ব্যবস্থা আছে এখানে। ভিডিও চেকিং আউট সিস্টেম। টেলিভিশনের ৬১ নম্বর
চ্যানেলে নিজের হোটেল একাউন্ট চেক করা
যায়। হোটেলে চেক-ইন করার
সময় ক্রেডিট কার্ড নাম্বার দিতে হয়েছে। সেখান থেকেই তারা আমার
বিল নিয়ে নেবে।
হোটেলের বিল দেখে চক্ষু ছানাবড়া হওয়া উচিত আমার। কিন্তু তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। মনে হচ্ছে নির্বাণ লাভ করতে খুব বেশি দেরী নেই আমার। প্রথমদিন রুমে ঢুকেই এক বোতল মিনারেল ওয়াটার দেখেছিলাম। এদেশের মিনারেল ওয়াটারের মত বিস্বাদ বস্তু খুব কমই আছে। ঝর্ণার পানি সরাসরি বোতলে ভরে রাখে। একবার খেয়ে আমার মনে হয়েছিল পানিতে গোবরের গন্ধ। তাই এ বোতলটি আমি খুলিইনি। কিন্তু তার দামও নিয়েছে পাঁচ ডলার। রিমোটের বোতাম টিপে বিল ও-কে করে দিলাম।
দশ মিনিট পরেই লিফ্ট। কাউন্টারে রুমের অ্যাক্সেস-কার্ড জমা দিয়ে রসিদটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম হোটেল থেকে। একজন বেলবয় জানতে চাইলো আমার জন্য ট্যাক্সি ডেকে দেবে কিনা। ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, তার দরকার হবে না। আমার ট্যাক্সি আমাকেই ডেকে নিতে হবে এখন থেকে। কারণ ইউনিভার্সিটির টাকায় বিলাসিতা করার দিন একটু আগেই শেষ হয়ে গেছে।
ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে অনেক ট্যাক্সি এখন। উঠে পড়লাম একটি ইয়েলো ক্যাবে। সোজা এয়ারপোর্ট। ড্রাইভারের বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের বেশি হবে না। লম্বা চুলে একটি ঝুঁটি বাঁধা। বেশি কথা বলা তাঁর অভ্যাস। এটা ওটা প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন আমাকে। আমার গাত্রবর্ণই হয়তো তাঁর এত কৌতূহলের উদ্রেক করেছে।
কনফারেন্সে এসেছিলাম শুনে মনে হলো বেশ খুশি হলেন। কনফারেন্স সম্পর্কে বেশ খবর রাখেন তিনি। গবেষকদের প্রতি বেশ শ্রদ্ধা আছে তাঁর। আমেরিকার সাধারণ মানুষ সাধারণত ইউনিভার্সিটির প্রফেসরদের খুব একটা দাম দেন না। তাঁদের কাছে একজন বেসবল প্লেয়ার বা পপ সিঙ্গারের কদর একজন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীর চেয়েও অনেক বেশি। কিন্তু এই ট্যাক্সিচালক অন্যরকম।
একটু পরেই বোঝা গেলো কেন তিনি অন্যরকম। তাঁর স্ত্রী ইউনিভার্সিটি অব নিউ মেক্সিকোর প্রফেসর। ফোক মিউজিক অ্যান্ড ড্যান্স ডিপার্টমেন্টের ফুল প্রফেসর। ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফ্লেমিংকো’ নামে তাঁদের নিজেদের একটা প্রতিষ্ঠানও আছে। নাচ শেখানোর প্রতিষ্ঠান।
ফ্লেমিংকো একধরনের জিপসি নাচ। পৃথিবীর অনেক দেশে যেতে হয় তাঁদের। স্ত্রীর সাথে জনও যান। জনের কথা বিশ্বাস করছি না ভেবে একটি কার্ড এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। কার্ডের একদিকে ‘ইনস্টিটিউট অব ফ্লেমিংকো’- অন্যদিকে তাঁর নাম লেখা; জন সানডোভাল।
ট্যাক্সি চালানোর দরকার হয় না জনের। শখ করে চালান। যাত্রীদের কাছ থেকে নানারকম তথ্য সংগ্রহ করেন তিনি। কথায় কথায় জানালেন অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের কাছেও তাঁরা গেছেন কয়েকবার।
জনের এক ভাই সায়েন্টিস্ট, কাজ করেন লস আলামোস ন্যাশনাল ল্যাবোরেটরিতে। জন আমাকে পরামর্শ দিলেন লস আলামোসে দরখাস্ত করতে। কীভাবে দরখাস্ত করতে হয় বললেন। বুঝলাম আসলেই খবর রাখেন জন।
আলাপ আরো দীর্ঘ হতে পারতো। কিন্তু এয়ারপোর্ট সিটি থেকে খুব একটা দূরে নয়। আলবুকারকিতে এসে এখানকার বিখ্যাত ‘ইন্টারন্যাশনাল বেলুন ফেস্টিভ্যাল’ দেখতে পারলাম না বলে খুব দুঃখ প্রকাশ করলেন জন। অক্টোবর মাসের প্রথম শনিবারে হয় আন্তর্জাতিক বেলুন উৎসব। তখন হাজার রঙের বেলুনে ছেয়ে যায় আলবুকারকির আকাশ। কখনো যদি সুযোগ পাই- যেন অক্টোবর মাসে আসি। মনে হলো ট্যাক্সি চালানোর পাশাপাশি আলবুকারকি শহরের দূতের ভূমিকাও পালন করছেন জন।
এয়ারপোর্টের ট্যাক্সিপার্কে ট্যাক্সি থামালেন জন। মিটারের ওপরে লেখা আছে ‘টুয়েন্টি পারসেন্ট টিপ্স,অ্যাপ্রিসিয়েটেড’। শখের ট্যাক্সিওয়ালা বলেই হয়তো শতকরা বিশ ভাগের কম টিপসে তাঁর মন ভরে না। ভাড়া গুনে নিতে নিতে হঠাৎ কী যেন মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন, “আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুব ধার্মিক লোক। আপনাকে কিছু জিনিস দিচ্ছি। প্লেনে বসে পড়তে খুব ভালো লাগবে।”
অবাক হবার পালা আমার। আমাকে ধার্মিক মনে করার কী এমন কারণ ঘটলো বুঝতে পারছি না। জন কেন ভাবছেন যে আমি ঈশ্বরের প্রেমে দেওয়ানা! বাইবেলের বাণী সম্বলিত কিছু প্রচারপত্র ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে।
‘ধন্যবাদ’ বলে ঢুকে গেলাম এয়ারপোর্টের চেক-ইন এরিয়ায়। ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে খুব একটা ভীড় নেই এখন। তরুণ অফিসার হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন। টিকেট দেখে বললেন, “এত আগে তো চেকিং-ইন সম্ভব নয়।”
আমাকে ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হবে। তবে আমি যদি চাই- তাহলে অন্য ফ্লাইটে আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে। তাতে কমপক্ষে তিন ঘন্টা আগে আমি লস অ্যাঞ্জেলেস পৌঁছে যাবো। এটাই তো চাচ্ছিলাম আমি। আমার ফ্লাইট বদলে গেলো। ডেনভারে গিয়েও এখন আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না।
কাউন্টারে চেকিং-ইন একটু জটিল আকার ধারণ করেছে এখানে। প্রত্যেকটি ব্যাগই খুলে দেখা হচ্ছে। আমার স্যুটকেস খোলা হলো। সিকিউরিটি অফিসারের কথামত তালাটি খুলে দেয়া ছাড়া আমার আর কোন ভূমিকা নেই আপাতত। অফিসারটি স্যুটকেস থেকে একটি একটি করে সবকিছু বের করে টেবিলে রাখলেন। স্যুটকেসের তলাসহ চারপাশে টিপেটিপে দেখলেন যদি কোন গোপন সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করা যায়। আমার যত্নে প্যাক করা জিনিসগুলো মনে হচ্ছে সব দলা পাকিয়ে ফেলবেন এই ভদ্রলোক। তাঁকে সাহায্য করার ইচ্ছায় আমি একটু হাত লাগাতে গেলাম তাঁর কাজে। তিনি যান্ত্রিক গলায় বললেন, “আই হ্যাভ টু ডু ইট মাইসেলফ স্যার।” তার মানে এখন আমার ব্যাগ আমি আর ধরেও দেখতে পারবো না লস অ্যাঞ্জেলেস এয়ারপোর্টে পৌঁছার আগ পর্যন্ত।
সারা আমেরিকার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে হাজার খানেক ছোট বড় এয়ারপোর্ট। সবগুলো এয়ারপোর্টেই কত রকমের কাজ বাড়িয়ে দিয়েছে এই একটি মাত্র নাইন-ইলেভেন।
ব্যাগ চেক করা হয়ে গেলে একটি একটি করে সবগুলো জিনিস আবার ঢুকে গেলো সুটকেসের পেটে। আমি সামনে দাঁড়িয়েই দেখলাম ইনস্পেক্টরের দক্ষতা ও ধৈর্য। যে জিনিস যেভাবে ছিলো- ঠিক সেভাবেই ঢুকে গেলো ব্যাগের ভেতর। আমি যখন প্যাক করছিলাম কনফারেন্সে পাওয়া একটি কলম ভুলে থেকে গিয়েছিল ভাঁজকরা প্যান্টের পকেটে। ইন্সপেক্টর সেই কলমটি আবার সেই প্যান্টের পকেটেই রেখে দিলেন। তাঁর দক্ষতায় আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তিনি তো সবজিনিস জগাখিঁচুড়ি করে ফেললেও আমি কিছু বলতে পারতাম না। নাকি পারতাম?
ছোট্ট এয়ারপোর্ট- আলবুকার্কি। ছিমছাম। দোকানপাট খুব বেশি নেই। তেমন ভীড়ও নেই এসময়। যাত্রীদের বেশিরভাগই কনফারেন্স ডেলিগেট। ফিরে যাচ্ছেন যে যেখান থেকে এসেছিলেন। মুখচেনা কয়েকজনের সাথে ‘হাই’ ‘হ্যালো’ বিনিময় হলো আবার।
বেলা একটা ত্রিশ মিনিটে চড়ে বসলাম ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ৩৫২ নম্বর ফ্লাইটে। ছোট্ট বোয়িং ৭৭৭। অনেক সিট খালি পড়ে আছে। বাইরের ঝকঝকে নীল আকাশে দেখার মত তেমন কিছু নেই। মাটিতে বসে আকাশ দেখে যে কাব্য জাগে, আকাশের অনেক কাছে এসে আকাশ দেখে কেমন যেন অন্যরকম লাগে।
কিছু কিছু জিনিস দূর থেকে দেখতেই বেশি ভালো লাগে। আকাশও কি সেরকম একটি? এই যে আকাশের কোল বেয়ে উড়ে যাচ্ছি আমরা- তাতে কি আমাদের সৌন্দর্যবোধ কমে গেছে? নাকি সৌন্দর্যের প্রাবল্যে কমে গেছে আমাদের অনুভবের ক্ষমতা? এজন্যই কি ‘পারস্য যাত্রী’তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “এতদিন পরে মানুষ পৃথিবী থেকে ভারটাকে নিয়ে গেল আকাশে। তাই তার ওড়ার যে চেহারা বেরোল সে জোরের চেহারা। তার চলা বাতাসের সঙ্গে মিল করে নয়, বাতাসকে পীড়িত করে। এই পীড়া ভ্যুলোক থেকে আজ গেলো দ্যুলোকে। এই পীড়ায় পাখির গান নেই, জন্তুর গর্জন আছে।”
কিন্তু এটাও তো সত্যি যে ভার
বইতে হয় না বলেই
পাখি গান করতে
পারে। জন্তুর মত ভার
বইতে হলে পাখির
গলা দিয়ে আর গান বেরোত না।
ব্যাগ খুলে জনের দেয়া কাগজগুলো বের করলাম। আমার পড়তে ভালো লাগবে বলে এতটা নিশ্চিত ছিলেন জন! কিন্তু আমার ভালো লাগছে না। সেই একই কথা- মানুষ পাপী! পৃথিবীতে আমরা জন্মেছি, কারণ আমরা পাপী। যীশুই আমাদের পাপ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র ত্রাণকর্তা। এ যেন বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু ঋণের মতোই। সেখানে যে শিশু এইমাত্র জন্মালো সেও নাকি হাজার হাজার ডলার ঋণগ্রস্ত। এরকম জবরদস্তি হিসেব যেমন আমি মেনে নিতে পারি না- অন্যের পাপের বোঝা আমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে আমাকে পাপী বলা হবে- এটাও আমি মেনে নিতে পারি না। আর মানুষ হিসেবে জন্ম নেয়াটা পাপ হতে যাবে কেন? মানুষের জন্ম না হলে যে ঈশ্বর নামক ধারণারই জন্ম হতো না তা কেন বোঝে না এসব ধর্মান্ধরা? মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর ভেতর তো ঈশ্বর কনসেপ্ট নেই। জনের দেয়া কাগজপত্র চলে গেলো প্লেনের রিসাইক্লিং ব্যাগে।
দেখতে দেখতে প্লেন নেমে এলো ডেনভার এয়ারপোর্টের রানওয়েতে। এই এয়ারপোর্টটির এরিয়া আমেরিকার এয়ারপোর্টগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। এখানে আবার ট্রানজিট নিতে হবে। লস অ্যাঞ্জেলেসগামী ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ইউ এ ৩৩৫। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। প্লেন থেকে বেরিয়ে বোর্ডিং ব্রিজ পার হয়ে কানেক্টিং ফ্লাইটের গেটে যেতে যেতেই বোর্ডিং শুরু হয়ে গেছে সেখানে। নির্দিষ্ট সময়েই আকাশে উড়লো বোয়িং ৭৩৭।
পাইলট জানালেন তিনি গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের খুব কাছ দিয়ে প্লেন উড়িয়ে নিয়ে যাবেন যাতে আমরা গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সৌন্দর্য দেখতে পাই।
তিনি কথা রাখলেন। চমৎকার ঝকঝকে রোদেলা দুপুর। আমাদের প্লেনের খুব কাছ দিয়েই চলেছে আরো কয়েকটি প্রাইভেট ট্যুর প্লেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই প্রকৃতির নিজের হাতে তৈরি সব বিস্ময়কর শিল্পসম্ভার থরে থরে সাজানো। চোখ ফেরানো দায়।
আরিজোনার বিখ্যাত গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন।। পাশেই বয়ে চলেছে ৪৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ কলোরাডো নদী। এপার থেকে ওপারের দূরত্ব ঊনত্রিশ কিলোমিটার। অথচ এখান থেকে সরু একটা রাস্তার মত লাগছে। সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে আসে এখানে এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখতে।
সময় বেশ দ্রুত কেটে গেলো। পাইলট ঘোষণা দিচ্ছেন আমরা চলে এসেছি লস অ্যাঞ্জেলেসে। রানওয়েতে ঘুরছি এখন। পাইলট দুঃখ প্রকাশ করে বলছেন আমাদের লাগেজ আসতে কিছুক্ষণ দেরি হতে পারে।
প্লেন থেকে বেরিয়ে চলে এলাম লস অ্যাঞ্জেলেস এয়ারপোর্টের ব্যাগেজ এরিয়ায়। পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে হলো ব্যাগেজ এরিয়ায়। লস অ্যাঞ্জেলেস এয়ারপোর্টে নাকি ব্যাগেজচোর গিজগিজ করছে। চোর ঠেকাতে গেটে ব্যাগেজ-ট্যাগ পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
এয়ারপোর্টের বাইরে এসেই বুঝতে পারলাম ব্যস্ততা কাকে বলে। সবাই ছুটছে এখানে। অফিস ছুটির সময়ে এসে পড়েছি বলেই কি?
আমি যাবো হলিউড সিটিতে। স্টুডেন্টস ইন্ হোস্টেলে আমার রুম রিজার্ভেশান দেয়া আছে। লস অ্যাঞ্জেলেস এয়ারপোর্ট থেকে বিভিন্ন জায়গায় যাবার জন্য বাস-ট্রেনের পাশাপাশি অনেকগুলো প্রাইভেট কোম্পানির শাটল সার্ভিস চালু আছে। হোস্টেলে কর্তৃপক্ষ আমাকে ই-মেইলে জানিয়েছিলো ‘প্রাইম শাটল’ ধরার জন্য।
‘প্রাইম শাটল’ লেখা প্লাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন লাল জ্যাকেট পরা কালো মানুষ। তার কাছে গিয়ে হলিউড সিটিতে যাবো বলতেই সে মোবাইলে কাকে যেন ফোন করলো। একটু পর জানালো, "দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।"
নীল, সাদা, হলুদ জ্যাকেট পরা অনেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে। বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন কোম্পানির শাটল সার্ভিস। দশ মিনিটের জায়গায় প্রায় পনেরো মিনিট পরে গাড়ি এলো। একটি লাল রঙের মাইক্রোবাস।
এখান থেকে যাত্রী শুধু আমি এবং অন্য দু'জন মহিলা। একজন বারবার ঘড়ি দেখছেন আর হ্যান্ডব্যাগ থেকে আয়না বের করে নিজেকে দেখছেন। ব্যস্ততার কারণেই হয়তো রূপচর্চাটা এখন অনেক প্রকাশ্য ব্যাপার হয়ে গেছে। ভদ্রমহিলা আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে অদ্ভুত দক্ষতায় লিপস্টিক লাগালেন। টকটকে লাল ঠোঁটে তাঁকে দেখতে এখন ড্রাকুলার মত লাগছে। মিনিট খানেক পরেই কথোপকথন শুরু হলো মহিলাদের মধ্যে।
বয়স বেঁধে রাখার প্রচন্ড চেষ্টা সত্বেও মনে হচ্ছে দু'জনই পঞ্চাশ পেরিয়েছেন বেশ ক’বছর আগে। তাঁদের কথায় মনযোগ না দিলেও কথা কান এড়াচ্ছে না। আয়না দেখা মহিলা উড়ে এসেছেন সানফ্রান্সিসকো থেকে। যাচ্ছেন হলিউডের কোডাক থিয়েটারে একটি প্রোগ্রামে অংশ নিতে। প্রোগ্রাম শুরু হবে সাড়ে ছ’টায়। তাই এত অস্থিরতা তাঁর। তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী সেখানে আজ অতিথিদের মদ পরিবেশন করবেন। সে উপলক্ষেই আজ তাঁর নিমন্ত্রণ সেখানে। তাঁর বান্ধবীটি কি হোস্ট নাকি হোস্টের কাজের লোক- জানা গেলো না। তাঁদের সিরিয়াসনেস দেখে আমার হাসি পাচ্ছে। কিন্তু এখানে হেসে ফেলা বোমা ফেলার মতই বিপজ্জনক হতে পারে।
মহিলা বলেই চলেছেন আজকের অনুষ্ঠানের জন্য তাঁর নখের ত্বকের চুলের চোখের কীভাবে যত্ন নেয়া হয়েছে। গয়নাগুলো কোত্থেকে আনা হয়েছে। ড্রেস সেলাই করেছে কোন্ বিখ্যাত দর্জি। ঘাড় ফিরিয়ে আবার দেখলাম তাঁর দিকে। তিনি বসেছেন আমার পাশেই। ঘাড় ফিরিয়ে কথা বলছেন পেছনের সিটে বসা অন্য মহিলার সাথে।
বিখ্যাত দর্জির তৈরি পোশাকে কোন ধরনের বিশেষত্ব খুঁজে পেলাম না আমি। কালো রঙের লম্বা গাউন টাইপের ঢলঢলে পোশাক। গাড়ির সিটে বসার কারণেই হয়তো, মনে হচ্ছে কালো রঙের একটি লুঙ্গি পরে আছেন তিনি। পেছন ফিরে কথা বলার কারণে তাঁর পিঠের দিকটি দেখতে পাচ্ছি আমি। পিঠের দিকে গাউনের দুটো পাতলা ফিতে ছাড়া আর কিছুই নেই। পিঠের কুঁচকানো ত্বক দেখে একটু মায়াই লাগছে এই বয়স মানতে না চাওয়া মহিলাটির জন্য।
এয়ারপোর্ট থেকে হলিউড সিটির দূরত্ব তেইশ মাইল। গাড়িতে এক ঘন্টারও কম সময় লাগার কথা। কিন্তু সারা রাস্তা ভর্তি গাড়ির সারি। ট্রাফিক জ্যাম দেখে মনে হচ্ছে লস অ্যাঞ্জেলেস নয়- বসে আছি ঢাকা শহরের কোন রাস্তায়।
অবশ্য ঢাকা শহরের সাথে লস অ্যাঞ্জেলেসের তুলনা করাটা কিছুটা শিশুতোষ হয়ে যাচ্ছে। মোটরগাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমেরিকা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বিশ কোটি গাড়ি চলে আমেরিকার রাস্তায়। প্রতি আঠারো জন আমেরিকানের জন্য দশটি গাড়ি আছে এদেশে। ট্রাফিক জ্যাম এখানে হতেই পারে। অ্যাঞ্জেলেসের শতকরা নব্বই ভাগ গাড়িই আবার বেশ পুরনো। প্রাইম শাটলের এই মাইক্রোবাসটির অবস্থা দেখেই তা বুঝতে পারছি।
রাস্তার অবস্থা দেখে বেশ হতাশ হলাম। অস্ট্রেলিয়ার রাস্তা যেরকম ঝকঝকে মসৃণ, এখানকার রাস্তা সে তুলনায় একেবারে ঝরঝরে। অযত্নের ছাপ সর্বত্র। তবে অস্ট্রেলিয়ার রাস্তার তুলনায় লস অ্যাঞ্জেলেসের রাস্তা হাজারগুণ ব্যস্ত। জনসংখ্যার দিক থেকে নিউইয়র্ক সিটির পরেই লস অ্যাঞ্জেলেস, ব্যস্ত তো হবেই।
তাড়া থাকলে দেরি হয় বেশি। রাস্তার সবগুলো ইন্টারসেকশানেই লালবাতি পাচ্ছি আমরা। ফলে থামতে হচ্ছে। ড্রাইভার যতবারই ব্রেক কষছে- কোডাক থিয়েটারযাত্রী ‘শিট’ ‘শিট’ করে উঠছেন। অন্য মহিলা ‘ইউ উইল বি রাইট দেয়ার’ বলে শুকনো সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
অবশেষে পাহাড়ের বুক থেকে সাদা ‘হলিউড’ সাইন উঁকি মারলো। পৌঁছে গেছি হলিউড! কোডাক থিয়েটার দেখা যাচ্ছে দূর থেকেই। এই সেই বিখ্যাত থিয়েটার। যেখানে অনুষ্ঠিত হয় অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড অস্কার পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান।
কোডাক থিয়েটারের সামনে ছোটখাট ভীড়। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে দিতেই ভদ্রমহিলা দিলেন ছুট। তাঁর পেছনে ছুটলো আমাদের ড্রাইভার। মহিলা ভাড়া না দিয়েই চলে যাচ্ছিলেন।
No comments:
Post a Comment