হলিউড-৩
ঘুম থেকে উঠেই দেখি জিম
যাবার জন্য রেডি। কয়েক সপ্তাহ তাকে থাকতে
হবে সাইটে। রাতের বেলাও কাজ করতে
হবে। তারপর সেখান থেকেই চলে যাবে
জার্মানি।
"গুডবাই।"
হাত ঝাঁকিয়ে
চলে গেলো জিম।
রুমের অবস্থা গতকালের মতোই এলোমেলো। ডেফিনরা কাল রাতে কখন ফিরেছে জানি না। তিনজনই গভীর ঘুমে কাদা এখন। ফ্লোরজুড়ে তাদের জামাকাপড়। একপাশে একটি খোলা সুটকেস- ভেতরের জিনিসপত্র যেন ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছিলো। মেয়েদের স্বাভাবিক যে একটা সামলে রাখার প্রবণতা থাকে- এদের মধ্যে তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
জানালা খুলে বাইরে মাথা বের করলাম। জেগে উঠেছে হলিউড। রাস্তার ওপারে যেসব ছেলেমেয়ে শিশুদের জন্য খোলা আকাশের নিচে ঘুমাচ্ছে তাদের অনেকেই এখনো স্লিপিং ব্যাগের ভেতর। কয়েকজন উঠেছে। হঠাৎ মনে হলো, তাদের বাথরুমের ব্যবস্থা কোথায় হয়েছে?
"গুডমর্নিং..."
ডেফিন জেগে উঠে দোতলা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। চোখমুখ ফোলাফোলা, দেখে মনে হচ্ছে একটি সাদা মোমের পুতুল।
"আজ কোনদিকে যাচ্ছি আমরা?"
ডেফিন ধরেই রেখেছে আজও আমরা একসাথে বেরোচ্ছি। কোনদিকে যাবো এখনো ঠিক করিনি আমি। বললাম, "আজ ভাবছি হাঁটবো সারাদিন।"
"দ্যাটস আ ভেরি
গুড আইডিয়া।" একটুও না ভেবে
উত্তর দিলো ডেফিন। আমি যদি বলতাম,
‘আজ সারাদিন রুমে বসে
থাকবো’ তাহলেও হয়তো একই
জবাব দিতো এই প্রায়-নিরাবরণ স্বর্ণকেশী বালিকা।
ঘন্টাখানেক পরে তিন ফরাসিনীর সাথে বের হলাম। রাস্তায় ট্যুরিস্টের মেলা বসে গেছে এই সকালেই। শিশুদের জন্য ক্যাম্পেনরত ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে ঢুকছে রুজভেল্ট হোটেলে। রুজভেল্ট হোটেল আমাদের হোস্টেলের কাছেই বেশ অভিজাত হোটেল। প্রাচীন স্থাপত্য আর ইন্টেরিয়র ডিজাইনের জন্য এই হোটেলটিও হলিউডের একটি দর্শনীয় স্থান। হোটেলের বাইরের দেয়াল জুড়ে চিত্রতারকাদের বড় বড় ফটোগ্রাফ; স্থায়ী ফটো গ্যালারি। জনশ্রুতি আছে এই হোটেলের একটি রুমে এখনো মেরিলিন মনরোর ভূত দেখা যায়। ঐ রুমে কোন টেলিফোন নেই, অথচ টেলিফোনের শব্দ শোনা যায়। খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানো ছেলেমেয়েরা এখানেই হয়তো রুমভাড়া করেছে। সারাদিন কাটাবে এখানে, আর রাতে ঘুমাতে যাবে রাস্তায়।
হলিউড অ্যান্ড হাইল্যান্ড- কোডাক থিয়েটার সংলগ্ন পুরো কমপ্লেক্স। কোডাক থিয়েটার গেটের পরেই এই কমপ্লেক্সের মূল গেট। প্রশস্ত সিঁড়ি একটু একটু করে উঠে গেছে অনেক উপরে। সিঁড়ির ধাপে ধাপে পাথর বসিয়ে লেখা হয়েছে হলিউডের বিভিন্ন ঘটনা, তারকাদের জীবন কাহিনি, ছোট থেকে বড় হবার কাহিনি, ব্যর্থতা থেকে সাফল্যের শীর্ষে ওঠার কাহিনি।
হলিউড হাইল্যান্ড |
হাইল্যান্ডের পাশে ফ্রাঙ্কলিন অ্যাভেনিউ। এখানে হলিউড ইউনাইটেড মেথডিস্ট চার্চ। সিলিনের প্রচন্ড আগ্রহ এই চার্চের ভেতরে যাবে। শুক্রবার চার্চ বন্ধ। কিন্তু সে জানে চার্চে যারা কাজ করে তারা সারাদিনই থাকে চার্চের অফিসে।
চার্চের পেছন দিকে ছোট্ট গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই একজন নান বেরিয়ে এলেন। আমাদের চারজনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন ভেতরে। নিজের হাতে খুলে দিলেন মূল ভবনের তালা।
চার্চের স্থাপত্য দেখার মত। সিলিং উঠে গেছে অনেক অনেক উপরে। যীশুর সাথে ঈশ্বরের নৈকট্য বোঝাতেই চার্চের এই গগনচুম্বী ছাদ। এই নান চার্চের ম্যানেজার। তিনি বলে যাচ্ছিলেন এই চার্চের অভিনবত্ব। এই চার্চ সবার চার্চ। যে কেউ আসতে পারে এখানে। প্রোটেস্ট্যান্ট, ক্যাথলিক, অ্যাংলিকান সবাই। বেশির ভাগ চার্চ সমকামিতাকে সমর্থন করে না। ঈশ্বরের অপছন্দের কাজ মনে করে সমকামীদের ঢুকতে দেয়া হয় না বেশির ভাগ চার্চেই। কিন্তু এই চার্চ সমকামীদেরকেও ঈশ্বরের সৃষ্টি বলে মনে করে। এইডস রোগীরাও আসতে পারে এখানে।
সিলিন আগ্রহ ভরে অনেক প্রশ্ন করলো। ভদ্রমহিলা হাসিমুখে তার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। এরপর আমাদের নিয়ে গেলেন প্রশাসনিক ভবনে। পরিচয় করিয়ে দিলেন কয়েকজন ফাদারের সাথে। বেরোবার সময় দেখলাম বেশ কিছু ছোট ছোট ছেলেমেয়ে প্রাচীন রোমানদের পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ফ্রান্সের মানুষ চার্চ দেখে দেখে বড় হয়। একশ' বছরের পুরনো এই আমেরিকান চার্চটি সিলিনের দেশের চার্চের তুলনায় এখনো শিশু। আমাদের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন সিস্টার। বিদায়ের সময় স্মিত হেসে বললেন, "ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন।"
"আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না।"
সিলিন! সিলিন বললো কথাটা! একটা বোমা ফাটলেও মনে হয় এতটা অবাক হতাম না আমি। চার্চের প্রতি যার এত আগ্রহ সেই সিলিন কিনা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না!
পরবর্তী দেড়ঘন্টা আমরা হাঁটলাম সানসেট বুলেভার্ডের ফুটপাত ধরে। হাঁটতে হাঁটতে সিলিনের সাথে কথা বললাম ধর্ম, বিজ্ঞান আর দর্শন বিষয়ে। সিলিন- তারুণ্যে দীপ্ত এই ফরাসি বালিকা তার রূপের মতই ভাস্বর তার অর্জিত জ্ঞানেও। এই বয়সেই মেটাফিজিক্স, ন্যাচারাল ফিলোসফি গুলে খেয়েছে সে। ধর্ম-দর্শন বিষয়ে তার পড়াশোনা ব্যাপক। জানার আগ্রহ তার এখনো শিশুর মতই নির্মল। খুব ভালো লাগছিলো তার সাথে কথা বলতে।
ফ্রান্সের এক গোঁড়া ক্যাথলিক পরিবারে জন্ম সিলিনের। স্কুল জীবনের পুরোটাই কেটেছে ক্যাথলিক মিশনারি বোর্ডিং স্কুলে। সেখানে পান থেকে চুন খসার জো নেই। সিলিন সেখানেই দেখেছে ধর্মের নামে ভন্ডামি। মিশনারি স্কুলের হোস্টেলে কৈশোরেই তাকে হতে হয়েছে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন। স্কুলের যে সিস্টার দিনের মধ্যে হাজার বার বুকে ক্রুশচিহ্ন আঁকেন মেরিমাতার নামে- সেই প্রবল ধার্মিক, প্রবল প্রতাপান্বিত সিস্টারই কিশোরী সিলিনকে ব্যবহার করেছেন তাঁর বিকৃত যৌন লালসায়।
সিলিনের কথা বিশ্বাস করেনি তার বাবা-মা কেউই। বিশ্বাস করলেও তাঁদের হয়তো করার কিছুই ছিলো না চার্চের বিরুদ্ধে। এই চার্চই একদিন পুড়িয়ে মেরেছে ব্রুনোকে, নিগৃহীত করেছে গ্যালিলিওকে। মানুষ নিজের প্রয়োজনে ধর্মের সৃষ্টি করেছে এবং নিজের স্বার্থেই তাকে ব্যবহার করেছে সবসময়।
অনেক কথার পরে সিলিন এই প্রথমবারের মত জানতে চাইলো আমি কী করি এবং আমার ভাবনাগুলো আমি কীভাবে পেলাম।
"চলো গেটি সেন্টারে যাই"
ডেফিন বললো।
"গেটি সেন্টার কী?"
"গেলেই দেখতে পাবে।"
গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। শীতশীত লাগছে একটু। গেটি সেন্টারে যাবার রাস্তা চিনি না আমরা। এখানকার পাবলিক ট্রান্সপোর্ট মোটেই ভালো নয়। কয়েকজনকে জ্ঞিজ্ঞেস করেও সঠিক উত্তর পাওয়া গেলো না। মনে হচ্ছে আমার কথার পুরোটা শোনার ধৈর্যও তাদের নেই। বুঝতে পারলাম এখানে আমাকে দিয়ে কাজ হবে না।
এবার মাঠে নামলো সিলিন। প্রথম চেষ্টাতেই কাজ হলো। একজন গাড়ি থামিয়ে রোডম্যাপ বের করে নিজের প্যাডে এঁকে দিলেন কীভাবে যেতে হবে সেখানে।
গেটি সেন্টারে যেতে হলে দু’বার বাস বদল করতে হবে। মেট্রোবাস আসার সাথে সাথে উঠে পড়লাম। বাস ভাড়া এক ডলার পঁয়ত্রিশ সেন্ট। গন্তব্যের সাথে ভাড়ার কোন সম্পর্ক নেই এখানে। যেখানেই যাও- বাসে উঠলেই এক ডলার পঁয়ত্রিশ সেন্ট। যদি এক বাস থেকে নেমে অন্যবাসে উঠতে হয় বা বাস থেকে ট্রেনে উঠতে হয়, তাহলে এক ডলার ষাট সেন্টের টিকেট কাটতে হবে। তাহলে আর কানেক্টিং বাসে বা ট্রেনে টিকেট লাগবে না। মেট্রো ছাড়াও আছে ব্লু লাইন ও গ্রিন লাইন। মেট্রো লাইনকে রেড লাইনও বলা হয়।
বাসে ওঠার সময় ঠিক ঠিক পরিমাণ কয়েন ও নোট না থাকলে অসুবিধায় পড়তে হয়। কারণ বাসের টিকেট মেশিন ভাড়া নেয়, কিন্তু কোন কিছু ফেরত দেয় না। এক ডলার পঁয়ত্রিশ সেন্টের জন্য দশ ডলারের নোট দিলেও মেশিন ফেরত দেবে না কিছুই।
হ্যানেন ছিলো সামনে। সে পাঁচ ডলারের নোট মেশিনে ঢোকানোর পরে একটি টিকেট পেলো ঠিকই, কিন্তু কোন পয়সা ফেরত পেলো না। এ যে দেখি লোক ঠকানো ব্যবসা।
বাসে বেশ ভীড়। একঘন্টারও বেশি সময় পরপর এক একটি বাস। তাও সময়মত আসে না। বাসস্টপ বলতে রাস্তার ধারে একটি খুঁটিতে জাস্ট একটি সাইনবোর্ড, যেখানে শুধু বাস-নম্বর লেখা থাকে। বাস যে এখানে নিম্নবিত্তের বাহন তা কাউকে বলে দিতে হবে না, এমনিতেই বোঝা যাচ্ছে।
চারজনের বসার জায়গা একসাথে পাওয়া গেলো না। আমি বসলাম একজন আফ্রিকান-আমেরিকানের পাশে। ভদ্রলোক আধমিনিটের মধ্যেই গল্প জুড়ে দিলেন। স্যুট পরা কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা এই ভদ্রলোক মনে হচ্ছে বিদেশী দেখলেই জ্ঞানবিতরণ শুরু করেন। গেটি সেন্টারে যাচ্ছি শুনে বললেন, "ইউ সি এল-এ বাসস্টপে নেমে অন্য বাসে উঠবে।"
এবার অতি
উৎসাহী হয়ে জ্ঞিজ্ঞেস
করলেন,
"হোয়ার ইউ ফ্রম?"
"অস্ট্রেলিয়া।"
"অস্ট্রেলিয়া! হাউ কাম?"
আমি প্রায় বলেই ফেলছিলাম
"বাই প্লেন"।
"তুমি তো সাদা অস্ট্রেলিয়ানদের চেয়ে কালো,
আবার অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের চেয়ে ফর্সা। তুমি তো অস্ট্রেলিয়ান নও।"
"আমি বাংলাদেশি।"
"বাংলাদেশ? হোয়ার ইজ ইট?"
সেই পুরনো
প্রশ্ন। তাঁকে বললাম বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদি। তিনি এবার
আসল প্রশ্ন করলেন, "তোমার সাথের সুন্দরী মেয়েদের জোটালে কোত্থেকে?"
তার চোখ
মেয়েদের দিকে। তার চোখের দৃষ্টি ভালো
লাগলো না। ভালো লাগছে না এই মানুষটির সাথে আর কথা বলতে।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস এঞ্জেলেস বা ইউ-সি-এল-এ’র একটি বাসস্টপে নেমে গেলাম আমরা। এখানে রাস্তা পার হয়ে অন্যদিকের বাস ধরতে হবে। চারপাশে গাছগাছালির ঘন বন। নানারকম পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে।
শান্ত এবং নির্জন চারপাশ। ইউনিভার্সিটি এলাকার বাইরের দিকের এক কোণায় এই বাসস্টপ। ক্যাম্পাসের কিছুই দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে।
কয়েকজন চায়নিজ আর ভারতীয় ছাত্রছাত্রীকে দেখা গেলো বাসের জন্য দাঁড়িয়েছে। বাসস্টপে কোন টাইমটেবল নেই। মনে হচ্ছে বাস যখনই আসবে, তখনই তার টাইম। বসারও কোন ব্যবস্থা নেই এখানে। অনেকের দেখাদেখি ফুটপাতের উপর বসে পড়লাম।
প্রায় একঘন্টা পরে এলো ৫৬১ নম্বর বাস। পুরনো ঝরঝরে না হলেও বিলাসী বাস বলা যাবে না কিছুতেই। গেটি সেন্টার এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। নামলাম গেটি সেন্টারের গেটে।
গেটি সেন্টার (Getty Center) স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি সাম্রাজ্য। আরো নির্দিষ্টভাবে বলা যায় চিত্রকলার বিশ্বমানের সংগ্রহশালা। গেট থেকে একটু ভেতরের দিকে ঢোকার পরে সংক্ষিপ্ত সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে হলো।
সেখানে গেটি সেন্টার ট্রেন স্টেশন। ড্রাইভারহীন রিমোট-কন্ট্রোল্ড ট্রেনে চড়ে বসলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের অনেক উপরে মূল গেটি সেন্টারে।
গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি এখন একটু জোরেই পড়ছে। ট্রেন থামতেই দেখা গেলো হালকা সবুজ রঙের গাউন পরা গেটি সেন্টারের অনেক কর্মী সবুজ ছাতা হাতে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। শত শত ছাতা। সব দর্শনার্থীর জন্যই বৃষ্টি হলে ছাতার ব্যবস্থা আছে এখানে। অভ্যর্থনার আয়োজন দেখে শুরুতে মনে হলো কোন বিখ্যাত ব্যক্তি হয়তো আসছেন আজ। তাঁর বা তাঁদের জন্যই দাঁড়িয়ে আছেন গেটি সেন্টারের কর্মীরা। কিন্তু দেখা গেলো তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের জন্যই। ট্রেন এসে স্টেশনে থামলেই গেটি সেন্টারের অভ্যর্থনা-কর্মীরা এভাবে অভ্যর্থনা জানায় সবাইকে।
আধুনিক স্থাপত্যের আশ্চর্য নিদর্শন এই গেটি সেন্টার। অফ হোয়াইট রঙের অনেকগুলো বিল্ডিং ঘেরা বিলিয়ন ডলারের এই আর্ট কমপ্লেক্স। চৌদ্দ বছর সময় লেগেছে এই সেন্টার নির্মাণে। এটা চালু হয়েছে ১৯৯৮’র ডিসেম্বরে। তেল ব্যবসায়ী জ়ে পল গেটি (Jean Paul Getty, ১৮৯২-১৯৭৬) তাঁর বিলিয়ন ডলার দিয়ে গেটি ট্রাস্ট গঠন করেছেন এবং এই গেটি ট্রাস্টই চালাচ্ছে একশ' দশ একর জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠা এই বিশাল কমপ্লেক্স। এখানে কোন প্রবেশ মূল্য লাগে না।
নর্থ-সাউথ-ইস্ট-ওয়েস্ট চারটি আলাদা আলাদা কমপ্লেক্স বিল্ডিং-এ স্থায়ী প্রদর্শনী। দোতলা বিল্ডিংগুলোর প্রত্যেকটিই একই স্থাপত্যের, একই মাপের। নিচের তলায় রাখা আছে বিখ্যাত ভাস্কর্য, দুষ্প্রাপ্য পান্ডুলিপি, ড্রয়িং, পুরনো আসবাবপত্র। আর দোতলায় সব পেইন্টিংস। এখানে আছে অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি ডেকোরেটিভ আর্টস, ইটালিয়ান রেনেসাঁর অনেকগুলো মাস্টারপিস, পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর ডাচ শিল্পকলা আর অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি চিত্রকর্ম। ভ্যানগগ ও গোয়ার বেশ কিছু অরিজিনাল মাস্টারপিস এখন রাখা আছে এই গেটি সেন্টারে।
আলাদা একটি বিল্ডিং-এ অস্থায়ী প্রদর্শনীর ব্যবস্থা। এখন চলছে ইটালিয়ান স্থাপত্য ও চিত্র প্রদর্শনী। আমরা যারা শিল্পকলা ঠিকমতো বুঝতে পারি না তাদের জন্য আছে তথ্যবহুল লাইব্রেরি। প্রত্যেক বিল্ডিং-এই আছে এই সমৃদ্ধ তথ্যভান্ডার। যে কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য বোদ্ধা শিক্ষকবৃন্দ অপেক্ষা করছেন সেখানে। গেটি সেন্টার প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই কনজারভেশান অব আর্টস, আর্কিটেকচার আর আর্কিওলজির গবেষকদের কাছে হয়ে ওঠেছে অমূল্য তথ্যভান্ডার।
দোতলায় উঠে বাইরে তাকাতেই পুরো লস
অ্যাঞ্জেলেসের গুচ্ছ গুচ্ছ শহর একেবারে চোখের সামনে। প্রায় তিনশ' ষাট ডিগ্রি
কোণ থেকে দেখা যায়
লস
অ্যাঞ্জেলেস সিটি। গেটি সেন্টার
সংলগ্ন মেইন রোডের
নাম এখন গেটি
ড্রাইভ। সেখান দিয়ে
ছুটে যাচ্ছে হাজার হাজার গাড়ি। এত উপর থেকে গাড়িগুলোকে
বিন্দু বিন্দু পিঁপড়ের মত লাগছে।
গেটি সেন্টারের আরেকটি বড় আকর্ষণ হলো এর পরিকল্পিত বাগান। বৃত্তাকার এই বিশাল বাগানে হাজার রকম মৌসুমী ফুলের পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে দুষ্প্রাপ্য সব অর্কিড।
কখন পাঁচটা বেজে গেছে টেরই পাইনি। একটা পুরোদিনও যথেষ্ট নয় এই গেটি সেন্টার ঘুরে দেখার জন্য। সোমবার ছাড়া অন্যান্য সবদিন খোলা থাকে সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। শুক্র-শনিবার রাত ন’টা পর্যন্ত খোলা থাকে। আজ রাত ন’টা পর্যন্ত এখানে কাটানোর ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হলো না। ডেফিনদের হলিউডে ফিরতে হবে সাতটার মধ্যে। কাল রাতে তারা সানফ্রান্সিসকো চলে যাবে। তার জন্য টিকেট করতে হবে।
গেটি সেন্টারের গেটে এসে বাসের জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। ইউ-সি-এল-এ'র কাছে আসার পরে মনে হলো এত বিখ্যাত ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসটি না দেখেই চলে যাবো? তা হয় না। আমি নেমে গেলাম এখানে। ফরাসিনীরা চলে গেলো হলিউড সিটিতে।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেস বা ইউ-সি-এল-এ পৃথিবীবিখ্যাত ইউনিভার্সিটি। ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ইউনিভার্সিটি থেকে এ পর্যন্ত ছয় জন নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। ১৯৬৯ সালে এই ইউনিভার্সিটিতেই জন্ম হয়েছে ইন্টারনেটের। যা এখন সারা পৃথিবীকে আটকে ফেলেছে তার জালে। ইন্টারনেট ছাড়া পৃথিবীর অনেক সিস্টেমই আজ এক সেকেন্ডও চলতে পারে না।
চারশো উনিশ একর জায়গা জুড়ে বেশ বড় ক্যাম্পাস। ছায়াঘেরা শান্ত সবুজ ক্যাম্পাস। অনেকদূর হাঁটলাম ক্যাম্পাসের ভেতর। এখানে হারিয়ে যাবার মধ্যেও সুখ আছে। লস অ্যাঞ্জেলেসের রাস্তা, ট্রান্সপোর্ট ইত্যাদি দেখে খুব একটা ভালো লাগেনি, কিন্তু ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে এসে মনটা ভরে গেলো। ইউনিভার্সকে ধারণ করে রাখতে পারার ক্ষমতা আছে বলেই এর নাম ইউনিভার্সিটি।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের নির্জনতা আততায়ীকে উৎসাহিত করে এখানে। ভয় থেকেই সন্দেহের সৃষ্টি হয়, সৃষ্টি হয় অবিশ্বাসের। এখন পথে যাকে দেখছি তাকেই মনে হচ্ছে সম্ভাব্য ছিনতাইকারী। ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যে বাসস্টপ পেলাম সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলাম। আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন মানুষ দেখছি না আশেপাশে। বাস কখন আসবে ঠিক নেই।
আমেরিকার পাবলিক
ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম পৃথিবীর নিকৃষ্টতম সিস্টেমগুলোর একটি। ব্যক্তিগত
গাড়ি না থাকা
মানে পঙ্গুর মত চলাফেরা
করা এখানে। গাড়ি প্রস্তুতকারক
কোম্পানিগুলোর জন্যই নাকি পাবলিক
ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমের উন্নতি করা যাচ্ছে
না। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট উন্নত হলে গাড়িক্রেতার
সংখ্যা অনেক কমে
যাবে। যেমন অস্ত্রপ্রস্তুতকারী দেশগুলো যখন কাউকে অস্ত্র সরবরাহ করে, তখন নাকি
অস্ত্রের সাথে শত্রুও
সরবরাহ করে অস্ত্র
ব্যবহারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য।
প্রায় চল্লিশ মিনিট দাঁড়িয়ে আছি এখানে। একজন আধবয়সী মহিলা এসে দাঁড়িয়েছেন বাসস্টপে। কয়েকবার চোখাচোখি হলো তাঁর সাথে। তাঁর চোখে ভয় স্পষ্ট। আমাকে ভয় পাচ্ছেন এই শ্বেতাঙ্গিনী। তিনিও হয়তো আমাকে সম্ভাব্য আততায়ী ভাবছেন। একঘন্টা পনের মিনিট পরে বাস এলো। কানায় কানায় ভর্তি বাস। কোনরকমে দাঁড়াবার জায়গা করে নিলাম। এই বাসযাত্রার সাথে বাংলাদেশের শহর এলাকার বাসযাত্রার কোন গুণগত পার্থক্য নেই।
সানসেট বুলেভার্ডে নেমে হেঁটে আসতে হলো হলিউড বুলেভার্ডের হোস্টেলে। হোস্টেলের সামনের রাস্তায় এখন প্রচন্ড ভীড়। শিশুদের জন্য ক্যাম্পেন প্রোগ্রাম জমে উঠেছে। খোলা আকাশের নিচে ঘুমাতে এসেছে আরো অনেক ছেলেমেয়ে। নানারকম প্লাকার্ড বহন করছে তারা। বিচিত্র সব দাবি তাদের। একটি প্লাকার্ডে লেখা আছে, ‘If you can’t make a safe world, Don’t have a child.’ ‘নিরাপত্তা যদি দিতে না পারো, জন্ম দিও না।’
No comments:
Post a Comment