কনফারেন্স: তৃতীয় দিন
সকালের একটা সেশানের নাম “দি রোল
অব ফিজিসিস্ট ইন অ্যান্টি-টেররিজম”- সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পদার্থবিজ্ঞানীদের ভূমিকা। লরেন্স বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাবের প্রফেসর অ্যান্ড্রু সেসলারের সভাপতিত্বে বেশ আকর্ষণীয়
অধিবেশন। টেররিজম অ্যান্টি-টেররিজম এখন আমেরিকার
বিলিয়ন ডলার ইস্যু। আমেরিকান উচ্চারণে ‘এন্টাই-টেরোরিজম’ শুনতে মজাই লাগছে। আই-বি-এম এর বিজ্ঞানী রিচার্ড গারউইন বলছিলেন কম্পিউটার সফটওয়ার কীভাবে অ্যান্টি-টেররিজমে ভূমিকা রাখতে পারে।
অ্যান্টি-টেররিজম ইস্যুতে এখন আমেরিকানদের যত খরচ হচ্ছে তা দিয়ে অনেকগুলো টুইন টাওয়ার বানানো সম্ভব। সন্ত্রাসীরা হয়তো এটাই চেয়েছিলো। যদি তাই হয়, তাহলে তারা জিতে গেছে তা স্বীকার করতেই হবে।
ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্টিভিটিজ-এ ফিজিসিস্টরা কীভাবে অবদান রাখতে পারেন সে বিষয়ে বক্তৃতা শুরু করেছেন ক্যালটেক এর প্রফেসর স্টিভেন কুনিন। ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা ক্যালটেক হলো নোবেল পুরষ্কারের খনি। ক্যালটেকের প্রফেসর মানেই স্পেশাল।
আগ্রহ নিয়ে শুনছিলাম প্রফেসর স্টিভেন কুনিনের বক্তৃতা। ঠিক এসময়ে আমার পাশে বসা ডক্টর স্টিভেন কারাটাগলিদিস কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো, "চলো একটা মজার ব্যাপার দেখে আসি।"
মজা আমি প্রফেসর কুনিনের বক্তৃতাতেও পেতে শুরু করেছি। কিন্তু স্টিভেনের মজার ব্যাপারটা নিশ্চয় আরো বড় স্কেলের কিছু হবে। হল থেকে বেরিয়ে স্টিভেনের পিছু পিছু গিয়ে ঢুকলাম ওয়েস্ট কমপ্লেক্সের আন্ডারগ্রাউন্ড লেভেলে। হলের নাম পিকিউরিস (Pecuris)। পিকিউলিয়ার স্প্যানিশ নাম। স্টিভেনও জানে না পিকিউরিস শব্দের অর্থ কী। শব্দার্থ নিয়ে এরা আমাদের মত এত মাথা ঘামায় না।
এই পিকিউরিস রুমেই আমাদের বক্তৃতা কাল সকালে। এখন চলছে নিউক্লিয়ার থিওরি বিষয়ক বক্তৃতা। এই অধিবেশনে মোট পনের জনের বক্তৃতা দেবার কথা। কিন্তু আমি আর স্টিভেনসহ এখন রুমে আছি মাত্র আট জন। যাদের বক্তৃতা শেষ হয়েছে তারা হয়তো বক্তৃতা দিয়েই প্রস্থান করেছে। এমন একটি আন্তর্জাতিক মানের অধিবেশনের এই অবস্থা? মজা বলতে কি স্টিভেন এই অবস্থাটাই বুঝিয়েছে? আসলে না।
মিনিট সাতেক পরেই দেখলাম সাত আটজনের একটি টিম ঢুকলো রুমে। তাদের সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরা, বইপত্র, ব্যাগ। পোশাক দেখে কিছু বিচার করা উচিত নয় জানি, কিন্তু এই আগন্তুকদের দেখে ঠিক বিজ্ঞানী মনে হচ্ছে না। সন্ত্রাসীও নয় নিঃসন্দেহে।
অধিবেশনের চৌদ্দ নম্বর বক্তা থিওডর লেছ। অ্যাবস্ট্রাক্ট বুলেটিনে দেখলাম তাঁর অ্যাফিলিয়েশন উল্লেখ নেই। আগন্তুকদেরই একজন এই থিওডর লেছ। তাঁর সঙ্গীদের একজন ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত। অন্য একজন ভিডিও ক্যামেরা চালু করে দিয়েছে এর মধ্যেই। অধিবেশনের সভাপতি কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পিটার ট্যান্ডির মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি কী ভাবছেন।
থিওডর লেছ কোয়ার্ক বিষয়ক সম্পূর্ণ নতুন এক তত্ত্বের অবতারণা করছেন। কোয়ার্কের গঠন এবং ভর নিয়ে তাঁর প্রস্তাবিত মডেলকে সঠিক ধরতে হলে পদার্থনিজ্ঞানের অনেক প্রতিষ্ঠিত সূত্রকেই ভুল বলতে হবে। প্রোটনের স্পিন ইফেক্টকে তিনি স্বীকারই করছেন না। এমনকি স্বীকার করছেন না হাইজেনবার্গের আনসার্টিনিটি প্রিন্সিপলও। এটা স্বীকার না করা মানে তো কোয়ান্টাম মেকানিক্সকেও অস্বীকার করা।
সবাই উশখুশ করছেন, কিন্তু কেউ কিছু বলছেন না। স্টিভেন আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো, "কোন প্রশ্ন করো না, চুপচাপ বসে থাকো।" প্রশ্ন আমি এমনিতেও করতাম না। থিওডর লেছ সাহেব বারো মিনিট ধরে তাঁর তত্ত্ব উপস্থাপন করলেন। প্রশ্নোত্তর পর্বে কেউ কোন প্রশ্ন করলো না, কোন মন্তব্যও নয়। তার মানে কি সবাই তাঁর তত্ত্ব মেনে নিলো? মোটেই না। আসলে এখানে কোন প্রশ্ন না করার অর্থ হলো ‘তোমাকে প্রশ্ন করা আর সময় নষ্ট করা সমান কথা’।
থিওডর লেছ যেন জানতেনই যে তিনি আবারো বলার সুযোগ পাবেন। তিনি একটা সাপ্লিমেন্টারি অ্যাবস্ট্রাক্ট সাবমিট করেছিলেন। যদি কোন বক্তা অনুপস্থিত থাকে তাহলে ঐ সময়টাতে সাপ্লিমেন্টারি প্রবন্ধ পড়ার সুযোগ দেয়া হয়। এবার থিওডর লেছ অভিযোগ করছেন লস আলামোস ন্যাশনাল ল্যাবের নিউক্লিয়ার থিওরি গ্রুপের বিরুদ্ধে। স্টিভেন সেই গ্রুপের মানুষ। তারা নাকি লেছ সাহেবের প্রবন্ধ রিজেক্ট করে দিয়েছে। খুব মজাই লাগলো পুরো সময়টা। সবাই ভাবছে থিওডর লেছ বিকারগ্রস্থ। কি জানি! কোন একদিন হয়তো এরাই তাঁকে বলবে ‘জিনিয়াস’।
বিকেলে হোটেলরুম থেকে বেরোলাম না আর। স্টিভেনও চলে গেছে। কাল সকালে আমাদের বক্তৃতা। স্টিভেন বলে দিয়েছে প্রচুর লোক আসবে আমাদের বক্তৃতা শুনতে। আজকের অভিজ্ঞতার আলোকে হাসি পেলো স্টিভেনের কথা শুনে। স্টিভেন সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো, “হাসি নয়, কালকে দেখবে।”
বইপত্র খুলে বসতে হলো একটু। সময় হাতে থাকলে বলা যায় অনেককিছু। কিন্তু এখানে যে মাপা সময়। একটা শব্দ দু’বার উচ্চারণ করতে হলেও সময়ের টান পড়বে। চারদিনে প্রায় চারশোটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হচ্ছে এই কনফারেন্সে, সময়ের ধরাবাঁধা সীমা তো থাকবেই।
সন্ধ্যা সাতটায় নিচে নেমে এলাম। সাড়ে সাতটায় কিভা অডিটোরিয়ামে পাবলিক লেকচার। শিকাগো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর সন ক্যারোল (Sean Carroll) বলবেন আমাদের বিশ্বব্রহ্মান্ড নিয়ে। “Our Preposterous Universe”- ‘অকল্পনীয় বিশ্বব্রহ্মান্ড’ বললেও ঠিক অর্থটা প্রকাশ পায় না। পনেরো মিনিট আগেই হলের হাজারখানেক সিট ভর্তি হতে গেছে। কেউ এ লেকচার মিস করছে না আজ। পাবলিক লেকচার আর সায়েন্টিফিক লেকচারের পার্থক্য এখানেই।
সন ক্যারোল |
সন ক্যারোল একজন প্রথম সারির বৈজ্ঞানিক এবং ক্যারিশম্যাটিক বক্তা। এই দুটো গুণ একসাথে খুব কম বিজ্ঞানীরই থাকে। সাড়ে সাতটা থেকে ন’টা- দেড়ঘন্টা জুড়ে অডিটোরিয়ামে একটা ঝড় বয়ে গেলো। হাজার খানেক দর্শক শ্রোতা মুগ্ধ হয়ে দেখলো কীভাবে বিগ ব্যাং (Big Bang) থেকে শুরু করে বর্তমান গ্যালাক্সি, পালসার, ব্ল্যাকহোল ইত্যাদি সব অজানাকে জানছে মানুষ, কীভাবে খুলে যাচ্ছে প্রকৃতির সব গোপন রহস্য।
অডিও ভিজুয়াল মাধ্যম এখনকার বক্তৃতার সবচেয়ে বড় সাপোর্ট। সন ক্যারোলের ল্যাপটপ থেকে শক্তিশালী ভিডিও প্রজেক্টারের মাধ্যমে দুটো বিশাল বিশাল পর্দায় প্রতিফলিত হচ্ছে মহাকাশের অদ্ভুত সব মডেল। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আমরাও ঢুকে যাচ্ছি কৃষ্ণ গহ্বরের অসীম টানে কোন এক অজানা রাজ্যে।
দশ বিলিয়ন বছর মানে এক হাজার কোটি বছরের পুরনো এই বিশ্বব্রহ্মান্ড এখনো রহস্যময়। তারকা, গ্রহ, উপগ্রহ সবকিছু মিলিয়ে এই রহস্যময় বিশ্বব্রহ্মান্ডের মাত্র পাঁচ ভাগ জায়গা দখল করেছে। বাকী পঁচানব্বই ভাগ জুড়ে এখনো অন্ধকার। সেখানে আছে নানারকম মিথ, মিরর ওয়ার্লড, নানারকম কল্পনা আর অসীম শূন্যতা। বিজ্ঞানীরা এই শূন্যতার নাম দিয়েছেন নাথিংনেস (nothingness)।
হল থেকে বেরিয়েই খাবারের লাইন। এখানে রিসেপশান মানেই হলো ফ্রি ফুড অ্যান্ড ড্রিংকস। কোলকাতার তরুণ দত্ত এগিয়ে এলেন। তিনি এখনো ইংরেজিই চালাচ্ছেন আমার সাথে।
পরিচয় হলো প্রফেসর অঞ্জলি ওঝার সাথে। কোলকাতার বাগবাজারের অঞ্জলি চ্যাটার্জি এখানে এসে প্রফেসর ওঝাকে বিয়ে করে নিজেও ওঝা হয়েছেন। ওঝা শুনে একবার ইচ্ছে হলো জ্ঞিজ্ঞেস করি তাঁরা সাপ ধরেন কিনা। কিন্তু ইচ্ছে করলেও ছেলেমানুষী করা যায় না এখানে।
অঞ্জলি এখনো বেশ বাংলা বলেন। কিছুক্ষণ কথা বললাম তাঁর সাথে। আমাদের বাংলা কথোপকথন তরুণ বাবুকে একটুও প্রলুব্ধ করতে পারলো না। তিনি তাঁর নিজস্ব ইন্ডিয়ান ইংরেজিতেই কথা বলছেন কথার মাঝখানে যখন খুশি।
দু'জন চায়নিজ তরুণী হাই আর ঝিং এর সাথে কথা হলো। ‘হাই’ কারো নাম হতে পারে ভাবিনি। চায়নিজরা অন্যের সুবিধার্থে একটা করে ইংরেজি নাম ধারণ করে। হাইও সম্ভবত সেরকম কিছু করেছে। হাই আর ঝিং-ও এসেছে কানেকটিকাট থেকে। হাই-এর পি-এইচ-ডি শেষ হয়নি এখনো। আর ঝিং থিসিস জমা দিয়েছে সম্প্রতি। এখন চাকরির বাজারে সাঁতার দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কথা বলতে বলতে ডিনারটা বেশ ভালোই হলো। তরুণবাবু আর অঞ্জলি ওঝা উঠেছেন মোটেল ইন-এ। এখান থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে সেই মোটেল। মোটেলের গাড়ি এসে নিয়ে যাবে তাঁদের এখান থেকে। তরুণবাবু মোটেলে ফোন করলেন। কতক্ষণ লাগবে কে জানে। আমি গুডনাইট বলে চলে এলাম।
আসার পথে দেখি প্রফেসর সন ক্যারোল একা একা হেঁটে চলেছেন হোটেলের দিকে। এত বিখ্যাত প্রফেসর আর পাবলিক লেকচারারকে কেউ এগিয়েও দিতে এলো না একটু? সত্যিকারের বড় বলেই হয়তো বাড়াবাড়িটা নেই।
কাল খুব ভোরে উঠতে হবে। সকাল আটটায় আমাদের অধিবেশন শুরু। সুতরাং ঘুমানো দরকার। কিন্তু ঘুমানো কি এতই সহজ? বক্তৃতা মুখে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ঘুমিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পড়াশোনা করতে চাইলাম একটু। মন বসে না। টেলিভিশন খুলে বারো সেকেন্ডও টিকতে পারলাম না। আমেরিকার টিভি প্রোগ্রামগুলোর মান অস্ট্রেলিয়ার টিভির চেয়েও কম বলে মনে হচ্ছে। টিভি অফ করে টেলিফোন রিসিভারটা তুলে আবার রেখে দিলাম। খুব ইচ্ছে করছে একটু কথা বলি। ওদেশে কটা বাজে এখন? বিছানায় শুয়েই আকাশ দেখা যাচ্ছে। তারা ভরা আকাশ। তার উপরে, আরো আরো উপরে শুধুই শূন্যতা, নাথিং, নাথিংনেস। মানুষ কেন তবে এত অস্থির উপরে ওঠার জন্য? হাতের মুঠোয় শূন্যতাকে ধরার জন্য?
No comments:
Post a Comment