Saturday, 9 February 2019

প্রথম দেখা আমেরিকা - ত্রয়োদশ পর্ব


শহরের নাম হলিউড

আমার হোস্টেলটি যে কোডাক থিয়েটারের একেবারে একশ' মিটারের মধ্যেই হবে তা আমি চিন্তাও করিনি গাড়ি আমাকে হোস্টেল গেটেই নামিয়ে দিলো হোস্টেলের ঠিকানাটি প্রথম দেখার পর অদ্ভুত লেগেছিলো আমার কাছে ৭০৩৮১/২ হলিউড বুলেভার্ড এরকম অর্ধেক নাম্বারও হয় নাকি? এখন হোস্টেলের গেটে এসে আর অদ্ভুত মনে হচ্ছে না
          
একই হোল্ডিং নম্বরের দুটো অংশ অন্য অংশে একটি পিৎজার দোকান হোস্টেলের গেট বলতে ছোট্ট একটি কাচের দরজা দরজার গায়ে কয়েকটি দেশের ছোটছোট পতাকা লাগানো আন্তর্জাতিক ভাব আনার জন্য বড় বড় হোটেলে পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর পতাকা উড়তে দেখা যায় এখানেও সেরকম প্রয়াস গেট বন্ধ দরজার কাচের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে এটি একটি সিঁড়ির মুখের দরজা
            
হোস্টেলটি দোতলায় কলিং বেল টিপতেই বেশ দ্রুত নেমে এলো বেঁটে মতন এক তরুণ, চৈনিক চেহারা
            "হাই, আই হ্যাভ রিজার্ভেশান"
            "ওয়েলকাম, ওয়েলকাম"
            
ছেলেটার ওয়েলকাম উচ্চারণ ঘনঘন মাথা নোয়ানো দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটি জাপানিজ
            
কার্পেট মোড়া কাঠের সিঁড়ি এরকমই হয় বেশিরভাগ দোতলা তিনতলা বাড়ির সিঁড়ি সিঁড়ি দিয়ে পরে ঠার পরে ঠিক পাশের ঘরটাই অফিসঘর অফিস কাম টিভি রুম টেবিলে কম্পিউটার, প্রিন্টার, খাতাপত্র ইত্যাদি সব প্রয়োজনীয় জিনিস খুব এলোমেলো করে রাখা অফিস বলে মনেই হচ্ছে না মনে হচ্ছে কোন বাড়ির অগোছালো ছেলের পড়ার ঘর
            
জাপানী ছেলেটির নাম তাকাহিরো তার ইংরেজি উচ্চারণ শুনে মনে হচ্ছে বেশিদিন হয়নি এদেশে আমার পাসপোর্ট দেখতে চাইলো সে অবৈধ কাউকে বা স্থানীয় কাউকে এরা থাকতে দেয় না এখানে ব্যবস্থাটি ভালোই মনে হলো পাঁচ রাতের ভাড়া আর চাবির জন্য সিকিরিউটি ডিপোজিট জমা দিয়ে চাবি নিয়ে চললাম তাকাহিরোর পিছু পিছু
            
অফিসঘর থেকে বেরোলেই লম্বা সরু প্যাসেজ প্যাসেজের দু'পাশে পরপর রুম দেয়ালে নানারকম ম্যাপ, ট্যুর কোম্পানির চিত্তাকর্ষক বিজ্ঞাপন লাগানো বেশ ছিমছাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আলবুকার্‌কির হায়াত রিজেন্সির একরাতের ভাড়া দিয়ে এখানে দুই সপ্তাহ থাকা যাবে তাকাহিরো জানালো এখানে ব্রেকফাস্টও ফ্রি, তবে সকাল টার আগে
            
তেইশ নম্বর রুমে ঢুকলাম ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ এসে নাকে লাগলো নাক কুঁচকে গেলো আমার গত কয়েকদিনেই নাক উঁচু হয়ে গেছে বলে নিজেকে ধমক দিলাম মনে মনে
            
রুমে ঢুকেই ডানপাশে টয়লেট আর বাথরুম আমেরিকায় অবশ্য টয়লেট শব্দটি কেউ উচ্চারণ করে না, বলে রেস্টরুম রেস্টরুমের পরেই বেডরুম দু'দিকের দেয়াল ঘেঁষে দুটো দোতলা খাট দুটি বিছানা ভূমিতে, দুটি খাটের দোতলায়। এক রুমে চারজনের শোবার ব্যবস্থা। বিছানার গায়ে ছোট ছোট কাগজে লেখা: এ, বি, সি, ডি।


হলিউড হোস্টেল

            
রুমে আপাতত আমি একা -বি-সি-ডি যে কোন বিছানা আমি বেছে নিতে পারি ভূমির কাছাকাছি থাকাটাই পছন্দ করলাম; ডি বেডটি নিলাম ম্যাট্রেসের ওপর এলোমেলো ভাবে রাখা একটি তেলচিটচিটে লেপ দেখা যাচ্ছে মনে হচ্ছে একটু আগেও কেউ ঘুমিয়েছিলো এখানে
            
সব বিছানারই একই রকম এলোমেলো অবস্থা মেঝের কার্পেট পুরনো হলেও পরিষ্কার মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই ভ্যাকুয়াম ক্লিন করা হয়েছে রুমের একমাত্র জানালা দিয়ে নিচের রাস্তায় তাকাতেই চার্লি চ্যাপলিনের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো রাস্তার ওপারেই চ্যাপলিনের পূর্ণাঙ্গ মূর্তি


চায়নিজ থিয়েটার

চায়নিজ মান থিয়েটার

হলিউডের রাস্তায় চার্লি চ্যাপলিন


জানালায় একটু ঝুঁকে ডানদিকে তাকালে কোডাক থিয়েটার এত অভিজাত এলাকায় এত সস্তা একটি হোস্টেল কীভাবে আছে এখনো! সীমাহীন বিত্তবৈভব আর সীমিত সম্পদের মধ্যে একটা ভারসাম্য রাখার জন্যই হয়তো এই ব্যবস্থাটি রাখা হয়েছে
            
ঘরের ভেতর জানালার পাশে দেয়াল ঘেঁষে একটি তাকের মতো আছে একজোড়া জুতা, ব্যবহার্য কিছু জামাকাপড় এলোমেলো করে রাখা আছে তাকের ওপর তাকাহিরো জানালো আমার জামাকাপড়ও ইচ্ছে করলে রাখতে পারি সেখানে আমার ইচ্ছে করবে বলে মনে হচ্ছে না
            "হ্যাভ আ নাইস স্তে" বলে তাকাহিরো চলে গেলো হঠাৎ মনে পড়লো সে তো আমাকে রুমের চাবি দিয়ে যায়নি চাবি যেটি দিয়েছে সেটি নিচের গেটের চাবি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ধরলাম তাকে
            "রুমের চাবি তো দাওনি"
            "চাবি লাগে না রুমে তালা লাগানোর কোন ব্যবস্থা নেই"
            খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে তাকাহিরো তাকালো আমার মুখের দিকে আমি যে অবাক হয়েছি তা সে বুঝতে পেরেছে এরকম ব্যবস্থা আমি আগে কোথাও দেখিনি
            
দেখা যাচ্ছে এই হোস্টেলের একটি মাত্র দরজায় তালা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে- তা ওই সিঁড়ির মুখের দরজায় কারো কাছে মূল্যবান থেকে অতিমূল্যবান কিছু থাকলে তা লকারে রাখা যেতে পারে প্যাসেজের একদম শেষ প্রান্তের দেয়াল ঘেঁষে কিছু লকার রাখা আছে খুব ছোট ছোট খোপের লকার সোনামণিমুক্তা রাখার জন্যই হয়তো এই খোপ এই খোপগুলোতে কোন তালা নেই তালা লাগাতে চাইলে সে ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে
            
তালাচাবি নিয়ে খুঁতখুঁত করা উচিত নয় আর এতসব লোকজন থাকছে না এখানে? আমার তো হারানোর কিছু নেই আমি সোনাদানামণিমুক্তামুক্ত বলে আবারো ভালো লাগলো
            
দরজা বাইরে থেকে লক করা যায় না বুঝলাম- ভেতর থেকে বন্ধ করা যায় তো? আমার সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হলো দরজায় কোন ছিটকিনি নেই নিজেকে বেশ সাধু সাধু লাগছে মনে হচ্ছে একটি সত্যিকারের মুক্তস্থানে এসেছি- যেখানে দরজা বন্ধ করা যায় না।
            
বাথরুমের দরজা খুলেই এক পা পিছিয়ে আসতে হলো গন্ধটা একটু বেশিমাত্রায় কড়া মনে হচ্ছে এই বাথরুম তৈরি হবার পর থেকে আর কখনো পরিষ্কার করা হয়নি বেসিনটি কোন একসময় হয়তো সাদা ছিলো বেসিনের সামনে দেয়ালে একটি আয়না লাগানো আছে সেদিকে তাকালে ঝাপসা মত যে ছায়া পড়ছে সেটাকেই আমার প্রতিবিম্ব ধরে নিতে হচ্ছে কমোডের ঢাকনা বন্ধ ঢাকনা তোলার মতো মনোবল আপাতত নেই
            
বাথরুমের এককোণায় একটি শাওয়ার তিন ফুট বাই তিন ফুট জায়গায় কোনরকমে দাঁড়ানো যায় কারো উচ্চতা ছয় ফুটের বেশি হলে তাকে অনেকটা গুঁটিয়ে দাঁড়াতে হবে শাওয়ারের নিচে রবীন্দ্রনাথের বাঁশি কবিতার নোনাধরা দেয়াল আর খসেপড়া বালির সাথে মিলে যাচ্ছে, কেবল দেয়ালের টিকটিকিটা অনুপস্থিত শাওয়ারের পর্দাটি ভেজা বিদঘুটে গন্ধ বেরোচ্ছে সেখান থেকে আমার মনে হচ্ছে অ্যাঞ্জেলেসের হলিউড নয়, ঢুকে পড়েছি ঢাকার ফকিরাপুলের কোন জঘন্য হোটেলে এক বোতল এয়ার ফ্রেসনার কিনে আনতে হবে দেখছি
            
গায়ের কোটটি খুলে রাখবো কোথায় বুঝতে পারছি না আমার একমাত্র কোট বিদেশে পোশাকের কারণে যেন আমাকে কোথাও ছোট হতে না হয় সেচিন্তায় দিদিভাই বানিয়ে দিয়েছে এই কোট নিজের চেয়েও এই কোটের যত্ন করি আমি বেশি কিন্তু কোথায় রাখি একে? ওয়াড্রোবের আশা করা বাতুলতা এখানে ভাঁজ করে বিছানার ওপরই রাখতে হলো
            
এবার বেরোনো যাক থাকার জায়গা নিয়ে ভেবে আর সময় নষ্ট করা উচিত হবে না এখানে তো আমি থাকতে আসিনি, এসেছি বেড়াতে টিকেট পাসপোর্ট ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় বস্তুগুলো সাথের ছোট ব্যাগে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম
            
একটু পরেই আমি হলিউডের রাস্তায় দু'পাশের ফুটপাত মোজাইক করা একটু পরপরই ফুটপাতে হলিউডের বিখ্যাত সব ব্যক্তিদের নামাঙ্কিত স্টার স্টার অব দ্য ফেইম হাজারো আকর্ষণ এখানে কিন্তু সেসবের দিকে মনোযোগী হবার আগে দরকার খাবারের দোকান খুঁজে বের করা দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি প্লেনের দু'প্যাকেট বাদাম আর দুটো কোকাকোলা হজম হয়ে গেছে কত আগে
            
রাস্তার দু'পাশের প্রায় সবগুলো দোকানই স্যুভেনির শপ কোডাক থিয়েটার ঘিরে বিশাল শপিং কমপ্লেক্স নতুন ছবির বই পেলে যেমন আগে একবার দ্রুত পৃষ্ঠা উল্টিয়ে যাই, আমার অবস্থা এখন অনেকটা সেরকম দ্রুত হাঁটছি আর চোখ বুলাচ্ছি কোন্‌টা নতুন, কোন্‌টা ব্যতিক্রম
            
অনেকদূর পর্যন্ত হাঁটার পরে একটি ম্যাকডোনাল্ডস দেখা গেলো এখানে ঢোকা ছাড়া আপাতত আর কোন উপায় নেই পারতপক্ষে আমি ম্যাকডোনাল্ডসের জাংক ফুড খাই না কিন্তু অপরিচিত শহরে আপাতত ম্যাকডোনাল্ডসের পরিচিত খাবারেই ভরসা রাখতে হচ্ছে
            
বিগম্যা বার্গার আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নামের আলুভাজি নিয়ে টেবিলে এসে বসতেই চোখ গেলো বাইরে ফুটপাতে একদল মানুষ ইতস্তত বসে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছে তাদের বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ, কয়েকজন শ্বেতাঙ্গও আছে সাথে প্রায় সবারই ময়লা ছেঁড়া পোশাক, চোখ তাদের টকটকে লাল প্রত্যেকের হাতে আর কাধে ময়লা ঢাউস ব্যাগ রেস্টুরেন্টের ভেতরেও একটা কোণ তারা দখল করে রেখেছে তাদের সবার দৃষ্টি খাবার টেবিলের দিকে আমি বোঝার চেষ্টা করছি- তাদের টকটকে লাল চোখের দৃষ্টিতে কী আছে- ক্ষুধা, নাকি ঘৃণা?
            
এরা গৃহহীন ভিক্ষুক আমেরিকায় ভিক্ষুক দেখছি বলে অবাক লাগছে প্রচুর ভিখারি এখানে এরা শুধু ভিখারি নয়, অনেক রকম অপরাধের সাথেও যুক্ত এরা এরা সারাদিন ঘুমায় কোন পার্কের বেঞ্চিতে বা গাছের নিচে রাতের বেলা পার্কে ঘুমালে পুলিশ এসে ধরে িয়ে যায় কোন আশ্রয়কেন্দ্রে পুর্বাসন সম্ভবত পছন্দ নয় এদের তাই রাতের বেলা এরকম ফুটপাতে, দোকানের সামনে ঘুরে ফিরে কাটিয়ে দেয় লোকের কাছে ভিক্ষা চায়, আর সুযোগ পেলে কেড়ে নেয় যা কিছু পায় দরকার পড়লে নাকি এরা খুনটুনও করে ফেলে যারা মরতে ভয় পায় না, তারা হয়তো মারতেও ভয় পায় না
            



রাতের বেলার লস অ্যাঞ্জেলেস ভীষণ বিপজ্জনক লস অ্যাঞ্জেলেসের অপরাধ অপরাধীদের নিয়ে হলিউডে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য সিনেমা, টেলিভিশন সিরিয়াল লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশ ডিপার্টমেন্ট বা এল--পি-ডি একটি জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল
            
প্রতিবছর গড়ে পৃথিবীতে যতজন মানুষ খুন হয় তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় আমেরিকায় প্রতি দশ লাখ মানুষের মধ্যে ছিয়াশি জন মানুষ খুন হয়ে যায় আমেরিকায় এগারোই সেপ্টেম্বর টাইপের বড় মাত্রার দুর্ঘটনা বা হামলা করে খুন করার ঘটনাকে এই হিসেবে ধরা হয়নি অন্যান্য দেশের মধ্যে এই সংখ্যার কাছাকাছি আছে ইথিওপিয়া সেখানে প্রতি দশ লাখে খুন হয় চুয়াত্তর জন আমেরিকার পঞ্চাশটি রাজ্যের মধ্যে বাৎসরিক খুনের সংখ্যার দিক থেকে নিউইয়র্ক আর মায়ামির পরেই লস অ্যাঞ্জেলেসের অবস্থান এখানে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে বছরে আঠারো জন মানুষ মারা যান আততায়ীর হাতে
            
আশি লাখ মানুষের বাস এই লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে তাদের মধ্য থেকে প্রতিবছর দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন খুনিদের হাতে কিছু কিছু খুনের ক্ষেত্রে খুনির পরিচয় পাওয়া যায় এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে আমেরিকায় বছরে যতজন পুরুষ খুন হন, তাদের শতকরা ছয় ভাগ খুন হন তাদের স্ত্রী বা প্রেমিকার হাতে বেশির ভাগ খুনের ক্ষেত্রেই দেখা যায় খুনের কারণ গোপন প্রণয় শতকরা কতজন মহিলা তাদের স্বামী বা প্রেমিকের হাতে খুন হন, তার পরিসংখ্যান অবশ্য জানা যায়নি এত খুনোখুনির পরেও কিন্তু আমেরিকানরা সভ্যতার খুব বড়াই করে হয়তো খুনের দামেই তারা সভ্যতা কিনে নেয়
            
অস্বস্তি লাগছে এখানে বসে থাকতে খাবারের ঠোঙাটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম ম্যাকডোনাল্ড থেকেএক্সকিউজ মি, এক্সকিউজ মিবলে পেছনে চিৎকার করছে অনেকে তাদের এক্সকিউজ করার কোন কারণ আমি দেখছি না ভিখারিদের প্রতি দয়া দেখানো উচিত যখন ভিক্ষার কোন বিকল্প থাকে না আমাদের মত দেশে ভিক্ষাবৃত্তি অনেক সহজ বলে অনেকেই সহজে ভিক্ষুক বনে যান কিন্তু এদেশে? এখানে যারা ভিক্ষা করছে? পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্রদেশ থেকেও যারা এদেশে আসেন- তাঁরা কোন না কোন সৎ কাজ করে বেঁচে থাকার সুযোগ পান আর এরা- জন্মগত ভাবে আমেরিকান হয়েও কেন ভিক্ষে করছে পথে পথে?
            
আসলে তারা অপরাধী অন্য কাজ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভিক্ষে করাটা নিশ্চয় অপরাধ শুধু তাই নয়, এরা আক্ষরিক অর্থেও অপরাধী অনেক ক্ষেত্রে নিজের জন্য একটা নিকেল বা ডাইম ভিক্ষা চাইবে, পরে বন্ধুর জন্য চাইবে একশ' ডলার না দিলে পেটে ছুরি চালাবে অনেকে বলেন সমাজ থাকলে সামাজিক সমস্যাও থাকবে আশ্চর্য লাগে, এই ক্যালিফোর্নিয়াতেই যেমন আছেন বিল গেটস, তেমনি আছেন এই ড্রাগসেবী ভিখারির দল
            
রাতের শোভায় বিকশিত হতে শুরু করেছে হলিউড ম্যাকডোনাল্ডসের কোকাকোলার ঢাউস পেপার-কাপে চুমুক দিতে দিতে ফিরে এলাম হোস্টেলে রুমে ঢুকে দেখি আলো জ্বলছে এবং আমার বিছানার কোণাকোণি দোতলারসিটে বসে আছে একজন লিকলিকে পাতলা শ্বেতাঙ্গ যুবক
            "হ্যালো"
            "হ্যালো, আই অ্যা জিম"
ফ্লোরে জিমের জিনিসপত্র ছড়ানো এক জোড়া রোলারব্লেডও দেখা যাচ্ছে কয়েক মিনিটেই ভাব হয়ে গেলো জিমের সাথে বেশ হাসিখুশি ছেলেটা
            
জিমের বাড়ি জার্মানিতে আমেরিকায় নাকি সে প্রতিবছরই আসে সে একজন শিল্পী, পাথর খোদাই করে জার্মানরা এদেশে ট্যুরিস্ট হিসেবে বছরে নব্বই দিন কাটাতে পারে কোন ভিসা ছাড়াই জিম ট্যুরিস্ট হিসেবে এসে গোপনে কাজ করে এখানে এটা বে-আইনী কিন্তু জিম কেয়ার করে না সে কাজ করে পাহাড়ের ভেতর সেখানে পাথরের ইন্ডাস্ট্রি চালায় আমেরিকান মালিক বেশির ভাগই বিদেশী শ্রমিক, অবৈধ ভাবে আছে এদেশে নামমাত্র মজুরিতে তারা পাথর টানে, পাথর ভাঙে জিমের অবস্থা তাদের চেয়ে সামান্য একটু ভালো, কারণ তার জার্মান পাসপোর্ট
            
কথাসাহিত্যিক শংকর বলেছেন, প্রত্যেক মানুষের ভেতরই আছে আলাদা আলাদা গল্পের খনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনছি জিমের কাহিনি জিমের বয়স সাতাশ, জার্মানিতে স্ত্রী আর বছরের একটি কন্যা আছে তার জিমের বিয়ে হয়েছে তাও প্রায় বছর হলো
            
স্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে জিম কেমন যেন একটু আনমনা হয়ে গেলো যেখানে কিছু জ্ঞিজ্ঞেস না করতেই সে এত কথা বলছে- সেখানে কিছু জ্ঞিজ্ঞেস করার দরকার নেই যা বলার সে নিজেই বলবে
            আমার অনুমান ঠিক জিমের হয়তো কথা বলাটা দরকার হয়তো খুব বেশি মিস করছে সে তার স্ত্রী-কন্যাকে
            
জিমের স্ত্রী পুলিশ অফিসার, জিমের চেয়ে সাত বছরের বড় তাদের পরিচয় পর্বটা সিনেমার গল্পের মতো জিম তখন সদ্য একুশ পেরিয়েছে লেখাপড়া ভালো লাগে না বলে স্কুল ছেড়ে দিয়েছে সে কাজও কিছু করে না একদিন রাস্তা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় জাঁদরেল পুলিশ অফিসার ইলিন চুরির অভিযোগে পুলিশের খাতায় নাম ছিলো জিমের আদালতে শাস্তি হতে পারতো, কিন্তু ইনস্পেক্টর ইলিন জিমের নামে কোন কেস করলো না কিন্তু তার বদলে যে শাস্তিটি দিলো তা জিমের ভাষায়আরো মারাত্মক
            
ইলিন জিমকে নিয়ে গেলো তার বাড়িতে শরীর বিনিময়ে বাধ্য করলো তাকে জিম তখন এক রকম ঘোরের মধ্যে মনের ভেতর ভালোবাসার কোন অস্তিত্ব নেই, আছে কেবল শরীর পশুর মত জীবন যাপন মাসখানেক পরে ইলিন জানালো সে মা হতে যাচ্ছে কয়েক মাস পরেই তাদের বিয়ে হলো এর কয়েক মাস পরে তাদের কন্যা ইমা জন্ম
            
জিমের ধারণা সে ইমার বাবা নয় ইলিন এখন আর জিমের ওপর জবরদস্তি করে না কিন্তু ইমা প্রচন্ড ভালোবাসে তার বাবা জিমকে বেচারা জিম
            
একটু পরেইগুডনাইটবলে শুয়ে পড়লো জিম লাইট জ্বালানো থাকলেও তার কোন সমস্যা নেই বাথরুমের বিশ্রি গন্ধটা একটুও কমেনি রুম ফ্রেশনার আনার কথা ভুলে গেছি কোনরকমে নাক-মুখ-চোখ বন্ধ করে এখনকার মত বাথরুমের কাজ সারলাম অন্যকোন ব্যবস্থা তো আপাতত নেই আমেরিকায় তো আবার পাবলিক টয়লেটও নেই শহরে কোথাওটয়লেটশব্দটিও এখানে অচল বলতে হয়রেস্টরুম। যেন এই রুম ছাড়া আর কোথাও আমেরিকানরা রেস্ট নেয়ার সুযোগ পায় না।
            
আশির দশক থেকেই আমেরিকান শহরগুলোর পাবলিক টয়লেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কারণ ড্রাগসেবী আর অপরাধীদের আড্ডাখানা হয়ে উঠেছিলো পাবলিক টয়লেটগুলো এখন শহরের কোথাও রেস্টরুমের দরকার হলে ম্যাকডোনাল্ড বা এরকম খাবারের দোকানে যেতে হবে, কোন খাবার কিনতে হবে, তারপর রেস্টরুমের চাবি চাইতে হবে তার মানে রেস্টরুমের দরকারটা মাঝামাঝি পর্যায়ে পৌঁছানোর সময় থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে গৃহহীনদের কল্যাণে এখন আমেরিকার ফুটপাতেও প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয় অনেকে
            
বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম রুমে আবছা আলো জানালা দিয়ে স্ট্রিটলাইটের কিছুটা আলো রুমে ঢুকে পড়েছে ঘুম আসছে না রাত সাড়ে টা বাজে মাত্র এসময় ঘুম আসার কথাও নয় জিমের কথা ভেবে একটু কষ্টও লাগছে কষ্টের চেয়েও বেশি লাগছে অস্বস্তি ছেলেটি চুরি করতো আগে স্ত্রী-কন্যার কথাগুলো সে বানিয়েও বলতে পারে যদি সত্যিই চুরির অভ্যাস থাকে তার- এখনো নিশ্চয় আছে একবার পাগল হওয়া মানুষকে সুস্থ হয়ে যাবার পরেও যেমন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ভাবতে কষ্ট হয়, একজন ভূতপূর্ব চোরকেও নিশ্চয় সেরকম সন্দেহের চোখেই দেখে মানুষ স্যুটকেসটা টেনে বিছানার ওপর উঠিয়ে রাখলাম তা পর আমার কোটটি রাখলাম ভাঁজ করে এবার একটু ঘুমাতে চেষ্টা করলাম
            
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না চোখ না খুলেই টের পেলাম রুমের ভেতর কিছু একটা হচ্ছে ফিসফিস করে কথা বলছে কেউ মেয়েলী গলা শুনছি বলে মনে হলো মেয়েলী সৌরভও যেন পাচ্ছি একটু
            
চোখ খুলতেই দেখি একটি মেয়ে বসে আছে আমার বিছানার পাশে মেঝের অন্যদিকের বিছানায় আরো দু'জন তারমানে রুমে এখন আরো তিনজন এসে গেছে কিন্তু এখানে সিট তো মাত্র চারটি সে যাই হোক, জিম সংক্রান্ত অস্বস্তিটা কেটে গেছে আধ ঘন্টা পরেই দেখা গেলো আমরা পাঁচজন মিলে বেশ আড্ডা দিচ্ছি রুমে
            
তিন আগন্তুক ফরাসিনী, আসছে মেক্সিকো থেকে সেখানে গিয়েছিলো পড়াশোনা করতে পড়াশোনার শেষ পর্যায়ে এখন আমেরিকা ভ্রমণে বেরিয়েছে ভ্রমণ শেষে মেক্সিকো হয়ে চলে যাবে নিজের দেশে
            
আমার সিটের দোতলায় উঠেছে ডেফিন সে- বসেছিলো আমার বিছানার প্রান্তে জিমের নিচের সিটে ডাবলিং করছে সিলিন আর হ্যানেন তিনজনই ইন্টেরিয়ার ডিজাইন নিয়ে পড়াশোনা করছে মেক্সিকোতে মানুষ এসব বিষয়ে ফ্রান্সকে গুরু মানে- আর তারা কিনা ফ্রান্স থেকে চলে গেলো মেক্সিকোতে!
            
সিলিন জানালো ওখানে যাবার মূল কারণ হলো ভাষা তারা তিনজনই স্প্যানিশ বলতে লিখতে পারে ফরাসি ভাষার সমান দক্ষতায় কিন্তু তাদের ইংরেজি কোন রকমে টেনেটুনে চালিয়ে নেবার মত তবে আমি নিশ্চিত, শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষার জন্য কোনরকমের অসুবিধায় পড়তে হবে না তাদের রূপ এবং বয়স তাদের অনুকূলে যে কোন আমেরিকান দরকার হলে ফরাসি ভাষা শিখে নেবে তাদের সাহায্য করার জন্য তারা নিজেরাও ব্যাপারটা জানে জানে বলেই তাদের আত্মবিশ্বাসটা বেশি একটু বেশি পরিমাণেই বেশি
            
কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে একজন একজন করে বাথরুমে যাচ্ছিলো স্নান সারার জন্য জামাকাপড় বদলানোর সময় তারা একটু রক্ষণশীল হলেই ভালো লাগতো আমার কিন্তু তাদের ভেতর অন্যের সামনে শরীর উন্মোচনে কোন ধরনে লজ্জা বা জড়তার বোধ কাজ করে বলে মনে হলো না
            
ঘুমানোর আগে বাথরুমে গিয়ে দেখি খাঁটি ফরাসি সৌরভে করছে রুমেও ভেসে বেড়াচ্ছে তিন ফরাসিনীর অ্যারোমা আর দুর্বোধ্য ফরাসি শব্দতরঙ্গ



No comments:

Post a Comment

Latest Post

Doesn't Rachi's death make us guilty?

  Afsana Karim Rachi began her university life with a heart full of dreams after passing a rigorous entrance exam. She was a student of the ...

Popular Posts