আকাশের মাঝখানে কোথাও
রাত নিঝুম, চাঁদের আলোর বান ডেকেছে
আকাশের সীমানা কীভাবে ভাগ করে জানি না। প্লেনের সিটে
লাগানো ছোট টেলিভিশনের মত যন্ত্রটাতে দেখতে পাচ্ছি প্লেন অস্ট্রেলিয়ার সীমান্তে
ঢুকছে। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না কোথায় আছি। ভূমি থেকে সাঁয়ত্রিশ হাজার ফুট
উচ্চতায় আছি। বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্কুলে ফিজিক্সের
একটি অংক খুব মজা করে করতাম। কোন্ তাপমাত্রায় সেন্টিগ্রেড ও ফারেনহাইট স্কেল
সমান? উত্তরটা মনে পড়লো মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রি দেখে। এত ঠান্ডা আকাশ! আজ মনে হয়
পূর্ণিমা। আকাশ ভরা চাঁদের আলো। কেমন যেন কুয়াশা মাখা। অথচ এত উঁচুতে কুয়াশা থাকার
কথা নয়। বাতাসের ঘনত্ব তো খুবই কম হবার কথা এখানে। সারা প্লেন ঘুমাচ্ছে। আমার পাশের
দুটো সিট খালি। বেশ আরাম করে একটা ঘুম দিয়ে উঠেছি। আমার কব্জিতে এখনো তোমার সময়- রাত
১২টা পঞ্চাশ। অনেক ঘটনা ঘটে গেছে গত কয়েক ঘন্টায়। বলছি তোমাকে।
আটটার
দিকে বোর্ডিং কার্ড হাতে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। সামনের ভদ্রলোক হঠাৎ পেছনে
তাকিয়ে বললেন, “গরম জামা-কাপড় কিছু আনোনি? কেউ বলে
দেয়নি যে অস্ট্রেলিয়াতে খুব ঠান্ডা এখন?”
অস্ট্রেলিয়াতে
এখন যে খুব ঠান্ডা তা আমাকে কে বলবে? ব্যাগে একটা সোয়েটার আছে। উদয়দা নিজের
ব্যবহারের জন্য এনেছিলেন ইন্ডিয়া থেকে। আমাকে দিয়ে দিয়েছেন। ওটা বের করে পরে নিলেই
হবে। বললাম, “খুব বেশি ঠান্ডা পড়ে নাকি স্যার?”
ভদ্রলোকের
বয়স খুব একটা বেশি হবে না। তাঁর স্যুট-কোট দেখেই হোক, কিংবা আমাকে তুমি-তুমি করছেন
দেখেই হোক মুখ দিয়ে ‘স্যার’ বেরিয়ে গেল। মনে হলো তাতে ‘স্যার’ খুশিই
হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “পড়াশোনা
করতে যাচ্ছো? সিডনিতে?”
“জ্বি। সিডনিতে না, মেলবোর্নে”।
একটু সমস্যায় পড়ে গেলাম। এই প্লেন কি সিডনি যাচ্ছে?
আমি তো মেলবোর্নে যাচ্ছি। সিডনিতে কি আমাকে প্লেন বদলাতে হবে? টিকেটে এবং বোর্ডিং কার্ডে তো মেলবোর্নই লেখা
আছে।
“স্যার, আমি তো
মেলবোর্নে যাচ্ছি। এই প্লেন কি সিডনি যাবে? তাহলে মেলবোর্নে যাবো কীভাবে?”
“আই ডোন্ট নো।
তুমি কাউন্টারে জিজ্ঞেস করো”।
ভদ্রলোকের
সামনে দু’জন শ্বেতাঙ্গ। তাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন বিরক্তি বেগম। বার দুয়েক পেছন
ফিরে তাকালেন। আমাকে দেখলেই তাঁর মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে- অথচ বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে
দেখছেন এটাই আশ্চর্যের। হয়তো আমাদের কথোপকথন তাঁর কানে গেছে। তিনি নিশ্চয়
মেলবোর্নে যাচ্ছেন না। গেলে আমার প্রশ্ন শুনে নির্বিকার থাকতেন না। লাইন থেকে
বেরিয়ে কাউন্টারে গিয়ে থাই মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম- সিডনিতে গিয়ে প্লেন চেঞ্জ করতে
হবে কি না। জানা গেলো প্লেন চেঞ্জ করতে হবে না। সিডনিতে গিয়ে প্লেন থামবে, তারপর
একই প্লেন আবার মেলবোর্নে যাবে। যাক্, ভালোই হলো। সিডনি এয়ারপোর্টটাও দেখা হয়ে
যাবে।
প্লেনে
উঠে আমার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার জোগাড়। প্লেন যে এত বড় হতে পারে ভাবিনি। বোয়িং
৭৪৭। প্রায় সাড়ে চারশ’ মানুষ নিয়ে উড়তে পারে। আমার সিট নাম্বার 60K। একটু পেছনের
দিকে জানালার পাশে। পাশের দুটো সিট 60I ও 60J খালি। চোখের
সামনে ছোট্ট টেলিভিশন স্ত্রিন। সব মিলিয়ে কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। যথাসময়ে
প্লেন ছাড়লো। শূন্যে উঠে যাবার একটু পরেই খাবার দেয়া হলো। থাই পোশাক পরা এয়ার
হোস্টেজরা যাত্রীদের প্রয়োজন মেটাতে ব্যস্ত। পাশের দুটো সিট খালি হওয়াতে বেশ আরাম
হলো আমার। পেটভর্তি করে খেলাম। চকলেট, কেক কতকিছু দিয়েছে। সব শেষ করতে পারলাম না।
কিছু ব্যাগে নিয়ে নিয়েছি। পরে কাজে লাগবে। টিভিতে বিশ্বকাপ ফুটবলের কিছু অংশ
দেখাচ্ছে। খেলার দিকে মনযোগ নেই আমার। আরেকটি চ্যানেলে ‘দি নিউ
এডভেঞ্চার অব সুপারম্যান’ দেখাচ্ছে। কোন প্রোগ্রামেই মন দিতে পারছি না।
কম্বল মুড়ি দিয়ে তিনটি সিটে লম্বা হয়ে দিলাম ঘুম।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। চোখ বন্ধ করতেই স্বপ্নের
মত ভেসে এসেছে ফেলে আসা কত ঘটনা কত স্মৃতি। আমার প্রিয় সব মানুষেরা। হাত বাড়াতেই
স্বপ্নভাঙা ছন্দপতন। চোখ মেলে দেখি আবছা আলোয় প্রায় সবাই ঘুমুচ্ছে। জানালার আবরণ
একটু তুলতেই জোছনার প্লাবন। সাঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উঁচুতে বায়ুযানে ভেসে যাচ্ছি
ঘন্টায় নয়শো কিলোমিটার স্পিডে। অনেক নিচে মেঘের আস্তরণ জোছনার আলোতে শাদা। কত
গ্রাম কত নদী কত পাহাড় পেরিয়ে যাচ্ছে আমাদের থাই এয়ার-ওয়েজের ফ্লাইট TG981।
আস্তে
আস্তে ভোর হয়ে যাচ্ছে। অথচ ঘড়িতে এখনো মধ্যরাত্রি। রোদ উঠলো। কী চমৎকার সোনালী আলো
- সাদা মেঘের উপর পিছলে পড়ছে। প্লেন অনেক নিচে নেমে এসেছে। মেঘের নিচে নীল রেখার
মতো একটি নদী। কী নদী কে জানে।
কেবিন ক্রুরা একটি ফরম দিল পূরণ করার জন্য।
কাস্টম্স ডিক্লারেশান ফরম। টিভিতে দেখানো হচ্ছে ফরমটি কীভাবে পূরণ করতে হবে।
অস্ট্রেলিয়া খাদ্যদ্রব্য সম্পর্কে খুবই স্পর্শকাতর। কোন ধরণের খাবার সাথে থাকলে তা
ডিক্লেয়ার করার কথা বলা হচ্ছে। দুগ্ধজাত বা ফলমূল হলে তা ফেলে দিতে বলা হচ্ছে।
প্লেনের কোন খাবার যেন সাথে না থাকে। আমি প্লেনে দেয়া যে খাবারগুলো ব্যাগে ভরে নিয়েছিলাম - বের করে নিলাম। দু’ডলারের খাবারের
জন্য একশ ডলার ফাইন দেয়ার সামর্থ্য আমার নেই।
প্লেন আরো নিচে নেমে এলো। মনে
হচ্ছে ঘাসের উপর দিয়ে উড়ে চলেছি। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম- ঘাস নয়। ঘন সবুজ বিরাট
বিরাট গাছ। একটু পরেই সবুজ ঘাসের চাদর। আর যেন সেই চাদরের ওপর মসৃণভাবে নেমে এলো
আমাদের বায়ুযান। প্লেন সিডনি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলো। এখানে
সবাইকে নেমে যেতে হবে। আবার এই প্লেনেই উঠবো। রাখছি এখন।
No comments:
Post a Comment