০৯ জুলাই ১৯৯৮ বৃহস্পতিবার
ভিক্টোরিয়া ভিস্তা হোটেল
ঢং ঢং ঢং। খুব কাছেই কোন গীর্জার ঘন্টাধ্বনি। রাত বারোটা
বাজলো মেলবোর্নে। তোমার সাথে এখন আমার সময়ের দূরত্ব চার ঘন্টা, আর ভৌগোলিক দূরত্ব
এক মহাদেশ। আজ একদিনেই যেন সবকিছু অন্যরকম হয়ে গেছে। সকালে সিডনি এয়ারপোর্টে যখন
নামলাম তখন আমার ঘড়িতে রাত ৩টা ২০ আর সিডনিতে সকাল ৭টা ২০। সময় হঠাৎ করেই এগিয়ে
গেলো চার ঘন্টা। প্লেন থেকে নামার সময় শুধুমাত্র পাসপোর্ট আর টিকেট হাতে নিয়েই
নেমে পড়েছি। কেবিন ব্যাগ কেবিনেই রয়ে গেছে। নামার সময় মেলবোর্নের ট্রানজিট কার্ড
দিয়েছে একটি। সুন্দর প্লাস্টিকের কার্ড।
সিডনি
এয়ারপোর্টটা বেশ বড়। এয়ারপোর্টের বিভিন্ন
জায়গায় সুন্দর বুক-স্ট্যান্ডে সিডনির সিটিগাইড সাজিয়ে রাখা আছে। স্ট্যান্ডের মাথায়
বড় করে লেখা- প্লিজ টেক ওয়ান। নিলাম একটা। সিডনি শহরের ম্যাপ সহ যাবতীয় তথ্য আছে
এই গাইডে। ট্যুরিস্টদের জন্য কত সুন্দর ব্যবস্থা। ৫৩ নম্বর গেট দিয়ে প্লেনে উঠতে
হবে আমাকে। শুরুতেই গেটটা খুঁজে বের করলাম। ট্রানজিট কার্ড হাতে গেটের কাছে ঘোরাঘুরি
করছি দেখে থাই এয়ারলাইন্সের একজন বললেন- বোর্ডিং শুরু হবে ন’টায়। তার মানে দেড় ঘন্টার মত সময় হাতে আছে।
একটু ঘুরে দেখা যাক।
এত
সকালেও প্রচন্ড ব্যস্ত এই এয়ারপোর্ট। এয়ারপোর্টের ভেতর ঝলমলে সব দোকানপাট। বিশাল
বইয়ের দোকান দেখে অবাক হয়ে গেলাম। প্লেনে পড়ার জন্য অনেকেই বই কিনছেন। দোকানে যত
খুশি যতক্ষণ খুশি বই নাড়াচাড়া করা যায়। আমার দৃষ্টি ঘুরছে এখান থেকে ওখানে। প্রচুর
চায়নিজ দেখা যাচ্ছে এখানে। হবে নাই বা কেন। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ছয় ভাগের এক ভাগ
চায়নিজ। সে হিসেবে অবশ্য সমান সংখ্যক ইন্ডিয়ান থাকারও দরকার ছিল। কিন্তু ভারতীয়রা
মনে হয় এখনো সেভাবে আসতে শুরু করে নি।
অনেক
ডিউটি ফ্রি শপ এখানে। এদিক সেদিক ঘুরে দোকান পাটে ঢু মেরে বই ম্যাগাজিন উল্টিয়ে
সময় কাটালাম। বই এর দোকানে বেস্টসেলার বইগুলো সাজানো আছে একটা শেল্ফে। সেখানে
আমার পাশে দাঁড়িয়ে বই দেখছে একজোড়া তরুণ-তরুণী। হঠাৎ তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে চুমু
খেতে শুরু করলো। আমার প্রথম সাংস্কৃতিক
ধাক্কা।
ন’টা বেজে গেছে। আস্তে আস্তে ৫৩ নম্বর গেটের
দিকে এগিয়ে গেলাম। গেটে দাঁড়িয়ে একজন পেটমোটা অফিসার যাত্রীদের নামের তালিকা মিলিয়ে
নিচ্ছেন। কম্পিউটার প্রিন্ট-আউটে নিজের নাম দেখে ভালো লাগলো। এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ
প্লেন ছাড়ার আগেই যাত্রীদের নামের তালিকা পাঠিয়ে দেয় সংশ্লিষ্ট এয়ারপোর্টে। একটা
রুটিন কাজ। তবুও আনন্দ হলো। শিশুতোষ ভালো লাগা।
আবার একই প্লেন, একই সিট। তেমন কিছুই বদলায়নি। আমার
ব্যাগদুটো যেখানে রেখে গিয়েছিলাম সেখানেই আছে। শুধু পাশের খালি সিটে একজন নতুন
যাত্রী উঠেছেন। আর এয়ার হোস্টেজরা সব বদলে গেছে। আরেক ঝাঁক নতুন মুখ। আবার আকাশে
ওড়া। একটু পরেই আবার খাদ্য সরবরাহ। প্রাতঃরাশ। এখানে দশটা বেজে গেলেও আমার
বায়োলজিক্যাল ক্লকে এখনো সকাল ছ’টা। খেতে পারলাম না
কিছুই। হয়তো একটু টেনশানও হচ্ছে। মনে হচ্ছে- মেলবোর্ন তো এসে গেলাম। এবার যে কাজে
এসেছি পারবো তো তা শেষ করতে? আমি পারবো তো?
১১টা ১৫ মিনিটে প্লেন এসে নামলো
মেলবোর্ন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে নেমে এলাম
প্লেন থেকে। ইমিগ্রেশানের দিকে এগোবার পথে জমজমাট ডিউটি ফ্রি শপ। আর একটু পর পরই ‘ওয়েলকাম টু
মেলবোর্ন’ লেখা নিয়ন সাইনের পাশে সাজিয়ে রাখা মেলবোর্ন ভিজিটর্স গাইড।
হাতে পাসপোর্ট আর কাস্টম্স
ডিক্লারেশান ফরম, কাঁধে দুটো ব্যাগ আর হৃৎপিন্ডের কিছুটা দ্রুত স্পন্দন নিয়ে
ইমিগ্রেশানের লাইনে এসে দাঁড়ালাম। অনেকগুলো কাউন্টার। আমি যে লাইনে দাঁড়িয়েছি সে
অফিসারটি দাড়িওয়ালা অস্ট্রেলিয়ান। সবাইকে বেশ জেরা করছেন। এত জেরা করছে কেন?
আমাকেও কি এতগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে? অন্য লাইনে চলে যাবো কিনা ভাবছি- এসময়
ডাক পড়লো আমার। পাসপোর্ট আর কাস্টম্স ফরম এগিয়ে দিলাম।
“এনিথিং টু
ডিক্লেয়ার?”
“নো”
“এনি ফুড আইটেম?”
“নো”
আমার পাসপোর্ট খুলে ভিসাটা একটা
মেশিনের সামনে ধরলেন, তারপর কম্পিউটারের কয়েকটা বোতাম টিপলেন। ধাম করে একটা সিল
লাগালেন পাসপোর্টে।
“ওয়েলকাম টু
অস্ট্রেলিয়া”
“থ্যাংক ইউ”
এবার
ব্যাগেজ। কনভেয়ার বেল্টের কাছে এসে দাঁড়ালাম। কয়েক শ’ সুটকেস
বেল্টের উপর ঘুরছে। মনে হচ্ছে মাটির নিচ থেকে উঠে আসছে একের পর এক নানারকম সুটকেস।
যেদিকে চোখ যাচ্ছে কাস্টমস্-এর বিরাট বিরাট নোটিশ চোখে পড়ছে “ডিক্লেয়ার ইট,
অর ডেস্ট্রয় ইট”। ইংরেজি লেখার পাশাপাশি ছবির মাধ্যমেও দেখানো হচ্ছে যে এখানে খাদ্যদ্রব্য
নিয়ে আসা যাবে না। একজন কাস্টম্স অফিসার একটা কুকুর নিয়ে ঘুরছেন। কুকুরটি সবার
ব্যাগ শুঁকে দেখছে। আমার ব্যাগগুলো শুঁকে নাক ফিরিয়ে নিতেই স্বস্তি পেলাম। ততক্ষণে
আমার সুটকেস এসে গেছে বেল্টে। সুটকেসটা টেনে নেয়ার সময় দেখলাম বেল্টের অন্যপাশে
দাঁড়িয়ে আছেন ‘বিরক্তি বেগম’। চোখে চোখ পড়তেই তার শ্যামলা মুখটা একেবারে কালো
হয়ে গেল। কেন যে তিনি এত বিরক্ত হচ্ছেন কিছুতেই বুঝতে পারছি না।
একটা
ট্রলিতে সবগুলো ব্যাগ চাপিয়ে এগিয়ে গেলাম কাস্টমস এর দিকে। কোন কিছু ডিক্লেয়ার
করার নেই। চটপটে মহিলা অফিসার হাতের ফরমটি নিয়ে ব্যাগগুলো স্ক্যানারে চালান করে
দিলেন। ছোট ব্যাগগুলো বেরিয়ে এল। বড়টা মেশিনে রেখেই মনিটরে চোখ রাখা দশাসই পুরুষ
অফিসার জিজ্ঞেস করলেন ব্যাগে কোন সাবান আছে কিনা। আছে, ছয়টি লাক্স সাবান নিয়ে এসেছি
উদয়দা’র পরামর্শে। দাদা সহ কত কসরত করে
সুটকেসটি গুছিয়েছি সোমবার রাতে। একজোড়া জুতা ঢুকানো হয়েছে- আর জুতার ভেতর
সাবানগুলো। স্ক্যানারে আমার জুতাজোড়াও দেখা যাচ্ছে নিশ্চয়। অফিসারটির পুরু লাল গোঁফের ফাঁক দিয়ে হাসি দেখা
গেলো একটু।
সুটকেস
বেরিয়ে এলো। ট্রলি নিয়ে একটু এগোতেই হঠাৎ যেন দেয়াল ফাঁক হয়ে দরজা হয়ে গেলো। চমকে
উঠলাম আমি। এরকম কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আলিবাবা’র সিসেম ফাঁক এর মতো মেলবোর্ন এয়ারপোর্টের অটোম্যাটিক দরজা খুলে গেলো
আমার জন্য। আমি মেলবোর্নে পা রাখলাম।
ট্রলি নিয়ে একটু এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলাম
অনেক মানুষের ভীড়। কারো কারো হাতে নাম লেখা বোর্ড। আমাকেও রিসিভ করতে আসার কথা
ইউনিভার্সিটি থেকে। একটু দূরেই হলুদ একটা বোর্ডে TOGOTO লেখা দেখে
বুঝতে পারলাম আমার জন্যই এসেছেন তাঁরা। দু’জন বয়স্ক
মহিলা। পরিপাটি দাঁত বের করে অভ্যর্থনার হাসি হাসছেন দু’জনই। কাছে
যেতেই দু’জন একসাথে হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে।
দু’জনের বয়সই
ষাটের কাছাকাছি হবে। চুলের লাল রঙ দেখে বোঝার উপায় নেই চুল পেকেছে কিনা। মুখের
চামড়া কুঁচকে গেছে, ঠোঁটে গাঢ় লিপিস্টিক, কানে আর গলায় জমকালো গয়না। পুরু ওভারকোট
দেখে বোঝা যাচ্ছে এখন শীতকাল। তবে ঠান্ডা লাগছে না একটুও।
“হ্যাড এ নাইস
ফ্লাইট?” হ্যান্ডশেক করতে করতে প্রশ্ন করলেন একজন।
“ইয়েস, ইয়েস”। আমার
সংক্ষিপ্ত উত্তর।
“ইউ আর মিস্টার
ডেব, রাইট?”
“ইয়েস, ইয়েস”। মনে হচ্ছে ‘ইয়েস’ শব্দটি ছাড়া আর
কোন শব্দ আমার জানা নেই।
“আই এম সুজান,
এন্ড সি ইজ লিয়ানা”।
সুজান হাতে ধরা লিস্টে আমার নামের
পাশে একটা টিক চিহ্ন দিয়ে জানালেন আরো দু’জনের আসার কথা
ইন্দোনেশিয়া থেকে। তাদের জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে। তাদের প্লেন এসে গেছে, মিনিট
দশেকের মধ্যেই তারা এসে পড়বে।
দশ মিনিট সময় হাতে পাওয়া গেলো।
একটা টেলিফোন করা দরকার বাংলাদেশে। এসে পৌঁছানোর খবর না পাওয়া পর্যন্ত দিদিরা
উৎকন্ঠায় থাকবে। টেলিফোন কার্ড কেনার কথা মনে হওয়াতে মনে পড়লো অস্ট্রেলিয়ান ডলার
নেই আমার কাছে। আসার সময় দিদি একটা আমেরিকান একশ’ ডলারের নোট
পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। জাপানে পাওয়া তার স্কলারশিপ থেকে অনেক কষ্টে বাচানো এই
ডলার। মানি এক্সচেঞ্জ থেকে নোটটা ভাঙিয়ে নিলাম। ১৫৪ অস্ট্রেলিয়ান ডলার পাওয়া গেলো।
বিশ ডলার দিয়ে একটা ফোন কার্ড কিনলাম। টেলেস্ট্রা ফোন এওয়ে কার্ড।
ইন্দোনেশিয়ান দু’জন চলে এসেছে।
একজন ছেলে ও একজন মেয়ে। কারো বয়সই আঠারো উনিশের বেশি হবে বলে মনে হচ্ছে না। সুজান
আর লিয়ানার পিছু পিছু বেরোলাম এয়ারপোর্ট থেকে। কাচের দরজার বাইরে পা রাখতেই কনকনে ঠান্ডা
বাতাসের ঝাপটা এসে কুঁচকে দিলো আমাকে। এমন ঝকঝকে রোদ অথচ এমন বিদ্ঘুটে ঠান্ডা!
ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে চলেছি
গাড়ি পার্কে। বিশাল এক সাদা গাড়ি নিয়ে এসেছেন সুজান আর লিয়ানা। লিয়ানা ড্রাইভিং
সিটে গিয়ে বসলেন। সুজান গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে পেছনে সুটকেস উঠাতে লাগলেন।
ইন্দোনেশিয়ান ছেলে-মেয়ে দুটো গাড়িতে উঠে বসলো। তাদের সুটকেস দুটোর সাইজ আমার
সুটকেসের দ্বিগুণ হবে। এত বড় সুটকেস গাড়িতে উঠানো সুজানের পক্ষে সম্ভব নয়। হাত
লাগালাম। আমার হ্যান্ডব্যাগটা দেখে সুজান জানতে চাইলেন ওটার ভেতর কম্পিঊটার আছে কি
না। অবাক হয়ে গেলাম আমি। কম্পিঊটার কি এখন ব্যাগে নিয়ে ঘোরা যায়?
গাড়িতে
বসে সহযাত্রীদের সাথে আলাপ জমাতে চেষ্টা করলাম। তাদের কথ্য-ইংরেজি আমার ইংরেজির
চেয়েও খারাপ। ওরা একই দেশ থেকে এলেও কেউ কাউকে চেনে না। দু’জন একই ভাষায় কথা বলে- অথচ এখানে কেউ কারো
সাথে কথা বলছে না। আমি আলাদা আলাদা ভাবে কথা বললাম তাদের সাথে। ছেলেটা এসেছে ইংলিশ
কোর্স করতে। সুমাত্রা থেকে। থাকবে একটি অস্ট্রেলিয়ান পরিবারের সাথে। পেয়িং গেস্ট।
এটাকে নাকি ‘হোম স্টে’ বলা হয় এখানে। মেয়েটি এসেছে জাকার্তা থেকে। ট্রিনিটি
কলেজে ফাউন্ডেশান কোর্স করতে। ট্রিনিটি কলেজ কোথায় আমি জানি না। সে থাকবে
হোস্টেলে। দু’জনের চেহারাতেই একটু চায়নিজ চায়নিজ
ভাব আছে। নাক বোঁচা, রঙ হলুদ।
গাড়ি
চলছে প্রচন্ড গতিতে। বিশাল মসৃণ রাস্তা। সারি সারি গাড়ি দ্রুত বেগে ছুটে চলেছে।
দেখতে দেখতে পার হয়ে যাচ্ছে কত দোকান-পাট। একটু পরেই ট্রাম চোখে পড়লো।
ইন্দোনেশিয়ান ছেলে-মেয়ে দুটো জানে তারা কোথায় থাকবে। আমি কিন্তু জানিও না আমাকে
কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শুধু জানি ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ আমার দু’সপ্তাহ থাকার ব্যবস্থা করেছে।
একটু
পরে মূল রাস্তা ছেড়ে একটা ছোট রাস্তায় ঢুকে পড়লো গাড়ি। সুন্দর ছিমছাম একতলা সব
বাড়ি রাস্তার দু’পাশে। বেশির ভাগ বাড়ির ছাদই টালির।
সামনে সুন্দর বাগান, রাস্তার দু’পাশে সারি
সারি গাছ। সবকিছু পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি। একটা বাড়ির সামনে গাড়ি থামলো। বাড়ি থেকে
বেরিয়ে এলেন লাল সোয়েটার পরা একজন সাদা বুড়ি। ‘সাদা বুড়ি’ বলেছি বলে রেগে যাচ্ছো তুমি। ঠিক আছে- শ্বেত বৃদ্ধা। মাথার চুল ধবধবে সাদা।
সুজান গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে দিলেন। ইন্দোনেশিয়ান ছেলেটিকে বললেন এখানেই তার
থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছেলেটি চুপচাপ নেমে গেলো। সুটকেস নামানোর দিকে কোন
খেয়াল নেই তার। মনে হচ্ছে বড়লোক মা-বাবার সন্তান। নিজের কাজ নিজে করতে অভ্যস্ত
হয়নি এখনো। সুজানকে সাহায্য করলাম- সুটকেসটি
নামিয়ে দিলাম। গাড়িতে উঠে জানালা দিয়ে দেখলাম শ্বেত বৃদ্ধা প্রাণপনে টেনে নিয়ে
যাচ্ছে বিশাল সুটকেস আর তার পেছন পেছন চলেছে সুমাত্রা থেকে আসা ইন্দোনেশিয়ান তরুণ।
গাড়ি
আবার চলতে শুরু করেছে। একটু আগেও আকাশ নীল ছিলো, ঝলমলে রোদ ছিলো। এখন হঠাৎ আকাশের
মুখ গোমড়া হতে হতে কুচকুচে কালো হয়ে গেলো। মিনিট খানেকের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়ে
গেলো। প্রথমে টিপটিপ- একটু পরেই ঝুম ঝুম।
মেলবোর্ন
শহরে এসে গেছি। বিশাল বিশাল বিল্ডিং রাস্তার দু’পাশে। শহরের রাস্তা যে এত বড় হতে পারে ধারণা ছিল না।
একটু পরে একটা বাড়ির সামনে থামলো গাড়ি। রাস্তার নাম চোখে পড়ল- ব্যুভেরি স্ট্রিট।
বৃষ্টি কিছুটা কমেছে, কিন্তু থামেনি এখনো। গাড়ির দরজা আবার খুলে গেলো। এখানেই কি
থাকার ব্যবস্থা আমার? না, সুজান তার হাসিমুখ বাড়িয়ে বললেন, “ইট্স ইওর হোস্টেল জুন”। মেয়েটির নাম তাহলে জুন। জুন নেমে গেলো।
গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। চোখে পড়লো সোয়ান্সটন স্ট্রিট, কিছুদূর গিয়ে রাস্তার
বামপাশে রয়েল মেলবোর্ন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’র বিশাল বিল্ডিং। বিল্ডিং এর গায়ে জ্বলজ্বল করছে ‘আর-এম-আই-টি’।
খুব
আস্তে আস্তে চলছে গাড়ি। ট্রাম চলছে পাশাপাশি। ট্রাম থামলে গাড়িও থেমে যাচ্ছে।
কিছুদূর গিয়ে গাড়ি কলিন স্ট্রিটে ঢুকে গেলো। আমি রাস্তার নাম পড়ছি। একটু পরেই
রাসেল স্ট্রিটে ডানে মোড় নিলো। আবার ডানে ঢুকে গেলো। লিটল কলিন স্ট্রিট। ছোট্ট
একটা গলি। ওয়ান ওয়ে বলে রক্ষা। গাড়ি থেমে গেলো একটা দালানের বারান্দায়- ‘ভিক্টোরিয়া ভিস্তা হোটেল’।
সুটকেস
আর ব্যাগ নিয়ে নেমে গেলাম। হোটেলের কাচের দরজা খুলে গেল আপনা-আপনি। আবার বিস্ময়ের
পালা আমার। স্বয়ংক্রিয় দরজার সুবিধা অনেক। দু’হাতে ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে কোন সমস্যা হয় না। সুজান
কাউন্টারে গিয়ে রিসেপশানিস্টকে বললেন, “ইট্স প্রাডিব ফ্রম ব্যাংলাডেশ। উই হ্যাভ আ রিজার্ভেশান ফর হিম”। চটপটে মেয়েটি কম্পিউটারের পর্দায় খুঁজতে
লাগলো আমাকে। সুজান আমার দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন, “দে উইল টেক কেয়ার অব ইউ। হ্যাভ আ নাইস টাইম”। দ্রুত চলে গেলেন সুজান।
“ক্যান আই সি ইওর পাসপোর্ট প্লিজ”
হোটেলে
পাসপোর্ট কী কারণে দেখাতে হবে বুঝতে পারলাম না। কিন্তু জিজ্ঞেস করে দেখার মত
ইংরেজি আমার ঘটে নেই। পাসপোর্ট এগিয়ে দিলাম। মেয়েটি পাসপোর্ট খুলে দেখলো আমি আসলেই
আমি কিনা। সন্তুষ্ট হয়ে পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে বললো, “তোমার নামে একটি রুম বুক করা হয়েছে দু’সপ্তাহের জন্য। দু’সপ্তাহের ভাড়া ৪২২ ডলার। তুমি কি ক্যাশ দেবে নাকি
ক্রেডিট কার্ড?”
বিরাট
একটা ধাক্কা খেলাম আবার। ভেবেছিলাম ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ আমার দু’সপ্তাহের থাকার ব্যবস্থা করবে- মানে আমাকে
কোন টাকা-পয়সা দিতে হবে না। এখনতো হোটেল ভাড়া দিতেই ফতুর হয়ে যাব আমি। প্রতিরাতের
ভাড়া ৩০ ডলার করে হলে ৪২০ ডলার হয়। আরো দু’ডলার কী কারণে দিতে হচ্ছে জানি না। ট্রাভেলার্স
চেক ভাঙাতে হলো। কিছু অস্ট্রেলিয়ান নোট আর কয়েন ফেরৎ পাওয়া গেল। এবার একটা ফরমে
সাইন করতে হলো। রুমের চাবি এগিয়ে দিয়ে মেয়েটি হাসিমুখে বললো, “রুম নাম্বার টু হান্ড্রেড এন্ড সিক্সটি ফাইভ-
টেক দি এলিভেটর অন ইওর রাইট। ডায়াল নাইন ইফ ইউ নিড এনিথিং”।
ব্যাগ
টানতে টানতে কাহিল হয়ে গেছি। ঢাকা চট্টগ্রামের হোটেলে দেখেছি ব্যাগ নিয়ে কাড়াকাড়ি
শুরু করে হোটেলের কর্মচারীরা, কার আগে কে নিয়ে যাবে। আর এখানে- রিসেপশানের মেয়েটি
ছাড়া দ্বিতীয় কোন কর্মচারী চোখে পড়ল না। লিফ্টেও কোন লিফ্টস-ম্যান নেই। একটু
নার্ভাস লাগলেও কোন সমস্যা হলো না। সেকেন্ড ফ্লোরের বোতাম টিপতেই লিফ্টের দরজা
বন্ধ হয়ে গেল- একটু পরেই দোতলায়। রুম খুঁজে পেতে দেরি হলো না।
ছোট্ট
একটা রুম। একটা সিংগেল বিছানা। একপাশে টেবিল-চেয়ার। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে
তাকালাম। বৃষ্টি হচ্ছে এখনো। জানালার পাশে একটা বেসিনও আছে। ঘরের একটা কোণ জুড়ে
ওয়াড্রোব। নিচু টেবিলের উপর ইলেকট্রিক কেতলি, চা-কফি ও চিনির অনেকগুলো ছোট ছোট
প্যাকেট। এক প্যাকেট দুধও আছে। সবকিছু আছে কিন্তু বাথরুম নেই। বাংলাদেশে
ফকিরাপুলের একশ’ টাকা ভাড়ার একেবারে নিম্নমানের
হোটেলেও এটাস্টড বাথরুম থাকে। অথচ এখানে রাত প্রতি প্রায় নয়শ’ টাকা ভাড়া দিয়েও রুমের ভেতর বাথরুম নেই!
হতাশ হয়ে গেলাম। রুমের চাবির সাথে দেয়া অন্য চাবির গায়ে লেখা আছে ‘বাথরুম’।
রুমের
বাইরে লম্বা করিডোর পেরিয়ে ডানদিকে গেলে তালাবদ্ধ বাথরুম। ভেতরে দুটো টয়লেট আর
দুটো শাওয়ার। কতজন মানুষের জন্য এ ব্যবস্থা জানি না। টয়লেটে পানির ব্যবস্থা নেই।
শুধু টয়লেট পেপার। যস্মিন দেশে যদাচার।
রুমে
এসে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে মনে হলো সারাঘর দুলছে। ভূমিকম্প নাকি?
দ্রুত উঠে বসলাম। ভূমিকম্প নয়। শোয়ার সাথে সাথে আবার দুলুনি। প্লেনের গতিজড়তা
মাথার ভেতর রয়ে গেছে। রয়ে গেছে আরো সব স্মৃতি- যা এক এক করে আসতে শুরু করেছে।
বুকের ভেতরটা কেমন যেন খালি খালি লাগছে। এই বিশাল শহরে আমি এখনো কাউকে চিনিনা।
কতক্ষণ
ঘুমিয়েছি জানি না, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো টেলিফোনের শব্দে। বিছানার পাশেই টেলিফোন।
আমাকে কে টেলিফোন করবে এখানে? আমার হোটেলের নম্বারতো কারো জানার কথা নয়। ধরবো কি
ধরবো না করতে করতে রিসিভার তুলে ‘হ্যালো’ বলতেই শোনা গেল- “ক্যান আই স্পিক টু মিস্টার প্র্যাডিব কিউমার ড্যাব?”
আমি
অবাক হয়ে গেলাম। আমার নামের যে এরকম উচ্চারণও হতে পারে কখনো ভাবিনি। আমাকে কে
চাইতে পারে? উচ্চারণ শুনে মনে হচ্ছে অবাঙালি কেউ। ভাঙা ভাঙা উচ্চারণ। সুতরাং
ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ইংরেজি নয়। বললাম, “ইয়েস। প্রদীপ স্পিকিং”
তার
নাম পিটার। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি তাকে দায়িত্ব দিয়েছে আমাকে ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে
দেখানোর জন্য। জানতে চাচ্ছে আমি তাকে আগামীকাল সময় দিতে পারবো কি না। না পারার কোন
কারণ নেই। কথা হলো কাল দুপুর দুটোয় দেখা হবে তার সাথে- ইউনিভার্সিটিতে।
ক্যাম্পাসটি
কোথায় আমি এখনো জানি না। কীভাবে যাবো- কতদূরে- পিটারকে আমি কীভাবে চিনবো এসব কিছুই
বলেনি পিটার। ফোন রেখে দিলো। আমার উঠে বসার শক্তি নেই। চব্বিশ ঘন্টার জার্নিতে
কাহিল হয়ে গেছি। আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
যখন
জেগে উঠলাম- ঘুটঘুটে অন্ধকার। লাইট জ্বেলে ঘড়ি দেখে চমকে উঠলাম। এগারোটা বেজে
গেছে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছি! বাংলাদেশে এখন সন্ধ্যা সাতটা। দু’দিন আগেও এই সময়টাতে আমি মামামের কাছে থাকতাম। মনে হচ্ছে
কতদিন কথা হয় না কারো সাথে। অথচ মাত্র ছত্রিশ ঘন্টা কেটেছে।
ফোন
করা দরকার। ফোন কার্ড কীভাবে ব্যবহার করতে হয় জানি না। তবে শিখে নিতে দেরি হলো না।
কার্ডে একটা ফোন নাম্বার দেয়া আছে। রুমের ফোন থেকে ওই নম্বরে ফোন করলাম। ওপাশে
ইলেকট্রনিক নারী কন্ঠঃ
“ফর ইংলিশ প্রেস ওয়ান”। বলেই অন্য কয়েকটি ভাষায় ইনস্ট্রাকশান শুরু
হলো। বাংলা আছে কিনা দেখার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। না, বাংলা নেই। একটু পরে
আবার ইংরেজি শোনা গেল। তাড়াতাড়ি ‘1’ টেপার পর বলা হলো বারো ডিজিটের পিন নাম্বার
প্রেস করতে। করার পর বললো কার্ডে বিশ ডলার ব্যালেন্স আছে।
দিদিভাইরা
এখনো ঢাকা থেকে ফিরেনি। তার বাসায় ফোন করে কাউকে পাবো না। অজিতের নাম্বারে ডায়াল
করলাম। যান্ত্রিক নারীকন্ঠ জানালো- যে ব্যালেন্স আমার আছে তাতে পনের মিনিট কথা
বলতে পারবো। একটু পরেই ওপ্রান্তে অজিত। সে হোটেলের নম্বরটা জেনে নিয়েই লাইন কেটে
দিলো।
একটু
পরে সে-ই ফোন করলো। অনেকক্ষণ কথা হলো। আমি কেমন আছি কোথায় আছি জেনে নিয়ে দিদিদের
জানাবে। অজিতের কাছে আমার ঋণ বাড়ছে তো বাড়ছেই।
সকালে
প্লেন থেকে নামার পর আর কিছুই খাওয়া হয়নি। কিন্তু এতরাতে খাবার কোথায় পাবো? পেটে
প্রচন্ড ক্ষুধা। পরশু রাতে এসময় কস্তুরী রেস্তোঁরায় ডিনারের আয়োজন করেছিল অজিত।
মাছ মাংস পোলাওয়ের সমারোহ আর তার আতিথেয়তায় অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। অথচ এখন খাদ্যের
মধ্যে আছে মাত্র একশ মিলিলিটার দুধ। তুমি জানো দুধ খেতে আমার ভালো লাগে না। কিন্তু
আর কিছুই যে নেই।
_____________
' ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন 'এর পরবর্তী পর্যায়ের লেখা পড়তে চাই। পাবো কি?
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ। দ্বিতীয় পর্ব লেখায় হাত দেবো শীঘ্রই।
Deleteখুবই আনন্দের কথা! আগাম অভিনন্দন!
ReplyDeleteকিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
Delete