৩১ জুলাই ১৯৯৮ শুক্রবার
‘প্লাটিনাম ব্লন্ড’ কথাটা প্রথম শুনেছিলাম ফারুকের কাছে।
মাস্টার্সে ‘ইলেকট্রনিক্স ও ডিজিটাল
ইনস্ট্রুমেন্টেশান’ পড়াতেন ভুঁইয়া স্যার। তিনি ফ্রান্সে
পি-এইচ-ডি করতে গিয়েছিলেন কোট-টাই পরে, ফিরেছেন মোল্লাদের মত মানসিকতা আর লম্বা
আলখেল্লা নিয়ে। তখন তিনি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান, সুতরাং তাঁর কথার বাইরে আর
কোন কথা থাকতে পারে না বলেই তাঁর ধারণা। ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্সের আমেরিকান বই পড়াতে
গিয়ে ব্লন্ড আর ব্রুনেটের উদাহরণ পাওয়া গেল। ভুঁইয়া স্যার বললেন ‘ব্লন্ড’ মানে ‘বেঁটে মেয়ে’ আর ‘ব্রুনেট’ মানে ‘লম্বা মেয়ে’। আর যায় কোথায়! ফারুক উঠে দাঁড়িয়ে স্যারের মুখের উপর
বলে দিলো- ‘ব্লন্ড মানে সোনালি রঙের চুল। ছেলে
বা মেয়ে যে কেউ ব্লন্ড হতে পারে’। ফারুকের
এরকম পান্ডিত্যপূর্ণ বোকামীর পরিচয় আমরা আগেও পেয়েছি। কিন্তু এরকম সরাসরি বোমা
ফাটানোর নাম আত্মহত্যা। অনেক ভুগতে হয়েছে তাকে এর জন্য। সে অন্য প্রসঙ্গ। আমরা
বন্ধুরা ফারুকের কাছ থেকে অনেক ইংরেজি শব্দ শিখেছি, জেনেছি অনেক ধরনের সংস্কৃতির
কথা। আজ সকালে ‘প্লাটিনাম ব্লন্ড’ জিনেটের মুখোমুখি হয়েই মনে পড়লো ফারুকের
কথা।
সোয়া
ন’টার দিকে ডিপার্টমেন্টে গিয়ে দেখি
আমার রুমের দরজা হাট করে খোলা। দরজা যেন বন্ধ হয়ে না যায় সে জন্য কাঠের একটা
প্রতিবন্ধকও দেয়া হয়েছে। রুমটা কেন যেন একটু অন্যরকম লাগছে। মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে
বেড়াচ্ছে রুমের ভেতর। ম্যান্ডি বা ইমাজিন কেউই এরকম গন্ধ ব্যবহার করে না। তার মানে
নতুন কেউ। ফেলুদা হবার চেষ্টা করলাম। ইমাজিনের পাশের ডেস্কের দিকে তাকিয়েই বুঝতে
পারলাম- তিনি এসেছেন। ডেস্ক পরিপাটি করে সাজানো। বুক শেল্ফের ধার ঘেঁষে অনেকগুলো
খেলনা গাড়ি, ছোট ছোট লাল-নীল-হলুদ। পদার্থবিজ্ঞানীদের এরকম শখও যে থাকে তা জানতাম
না।
মিনিট
পাঁচেক পরেই খট্ খট্ জুতোর শব্দে ফিরে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। ঘরে ঢুকছে
পাঁচ-ফুট আট ইঞ্চি উচ্চতার পারফেক্ট প্লাটিনাম ব্লন্ড। কালো পোশাকের ছিপছিপে
মানুষটার সবকিছু এতটাই পরিপাটি যে মনে হচ্ছে সিনেমার পর্দায় কোন হলিউডের নায়িকাকে
দেখছি।
“হাই, আই এম জিনেট, জিনেট ফাইফ। ইউ মাস্ট বি প্রাডিব” হ্যান্ডশেক করতে করতে বললো জিনেট। ঝাঁঝালো
কন্ঠস্বর জিনেটের। তার কন্ঠ মিষ্টি হলে সব কিছু বড় বেশি নিখুঁত হয়ে যেতো। জিনেটের
চোখ ঘন নীল। এরকম চোখের দিকে সরাসরি তাকানো যায় না।
“তুমি এসেছো বাংলাদেশ থেকে, তাই না?”
“হ্যাঁ, তোমাকে কে বললো?”
“ইমাজিন। কেমন লাগছে এখানে?”
জিনেটের
ভেতর একটা সহজাত নেতৃত্বের ভাব আছে। কী জানি হয়তো সে স্টুডেন্ট-লিডার টাইপের কিছু।
অবশ্য এখানে স্টুডেন্ট পলিটিক্সের ছিঁটেফোঁটাও তো চোখে পড়েনি কোথাও। সে যাই হোক।
জিনেট যে স্টুডেন্ট মহলে খুব জনপ্রিয় তা বুঝতে পারলাম একটু পরেই।
এতদিন
আছি এখানে- কাউকে দেখিনি ম্যান্ডি বা ইমাজিনকে খুঁজতে এসেছে। অথচ আজ আধঘন্টার
মধ্যে পাঁচ-ছ’জন এসে দেখা করে গেলো জিনেটের সাথে।
জিনেট তাদের সাথে আমাকেও পরিচয় করিয়ে দিলো। অনার্সের রোল্যান্ড ছাড়া বাকিরা সবাই
পি-এইচ-ডি স্টুডেন্ট। পার্টিক্যাল থিওরি গ্রুপের নিকোল আর স্টেফি, এক্স-রে
ডিফ্রাকশান গ্রুপের ট্রেসি। ভয়াবহ রকমের মোটা এই ট্রেসিকেই দেখেছি নিচের রিসেপশানে
কাজ করতে। তখন তাকে খুব গম্ভীর মনে হয়েছিল। আজ দেখছি জিনেটের সাথে খুব হেসে হেসে
কথা বলছে। আমাকেও হাসিমুখে “হাই” বললো। দৈত্যাকৃতি মার্ক যখন ঘরে ঢুকলো- তখন
দশটা বাজতে পাঁচ। কোন রকমে হাই- বাই করে চলে গেলাম লেসের ক্লাসে।
লেস
একটা এসাইনমেন্ট ধরিয়ে দিলেন সবাইকে। তিনটা প্রোবলেম সল্ভ করে জমা দিতে হবে তিন
সপ্তাহের মধ্যে। চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলাম এগুলো সল্ভ করতে হলে কোয়ান্টাম ফিল্ড
থিওরির অনেক গভীরে ঢুকতে হবে। শখ করে এই কোর্সে এসে তো দেখছি বিপদে পড়ে গেলাম।
ক্লাস
শেষে অফিসে এসে দেখি হলুদ স্টিকারে ঝকঝকে হাতের লেখায় আমার জন্য ম্যাসেজ অপেক্ষা
করছে আমার ডেস্কের ওপর- “Ali Called@11:15am 31.08.1998” জিনেটের কাজও বেশ পরিপাটি। অফিসে এখন
কেউ নেই। ফোন করলাম আলী সাহেবের অফিসের নম্বরে।
“স্যার, আমি প্রদীপ। আপনি যখন ফোন করেছিলেন
আমি তখন ক্লাসে ছিলাম”
“হ্যাঁ, যে জন্য ফোন করেছিলাম। আমি বাংলাদেশে
যাচ্ছি সোমবার। তুমি যদি চিঠিপত্র কিছু দাও- আমি নিয়ে যেতে পারি। সানডেতে বাসায়
ফোন করো। তখন বলে দেবো ডিটেল্স”
“ও-কে স্যার”
“আরেকটি কথা। তুমি কি বিট্টুর সাথে কথা
বলেছো?”
“জ্বি না স্যার”
“তুমি তো আর-এম-আই-টিতে গিয়ে তার সাথে দেখা
করতে পারো। তার মোবাইল নাম্বার না থাকলে লিখে নাও”
অফিসের
ফোন থেকে মোবাইলে ফোন করা যায় না। নিচে নেমে পাবলিক ফোনে এক ডলার দিয়ে দেড় মিনিটের
মত কথা বলতে পারলাম বিট্টুর সাথে। তিনটার দিকে আর-এম-আই-টির কার্ডিগান স্ট্রিটের
বিল্ডিং-এ যেতে বললো সে।
কার্লটন
এরিয়া ম্যাপ থেকে কার্ডিগান স্ট্রিট খুঁজে বের করলাম। খুব বেশি দূরে নয় এখান থেকে।
আড়াইটার দিকে বেরিয়ে পড়লাম। সোয়ান্সটন স্ট্রিটের ওপর আর-এম-আই-টি ইউনিভার্সিটির
বিশাল বিল্ডিং-টার কাছে গিয়ে বামে মোড় নিলাম। সোয়ান্সটন স্ট্রিটের সমান্তরাল
রাস্তাটিই কার্ডিগান স্ট্রিট। এখানে বেশির ভাগই টাউন-হাউজ। ইউনিভার্সিটির কোন বড়
বিল্ডিং-তো চোখে পড়লো না। কার্ডিগান স্ট্রিটের আগাগোড়া হেঁটে একটা ছোট্ট ঘরের
সামনে আর-এম-আই-টির একটা সাইনবোর্ড দেখলাম। কোন অফিস বলে মনে হচ্ছে।
কাছে
গিয়ে দেখি ঠিক পাশের ঘরের সামনে লাল নিয়ন
সাইন জ্বলছে- “ইউটোপিয়া”। নীল রঙের “ওপেন” সাইনটা জ্বলছে আর নিভছে। বন্ধ দরজার
ওপর একটা মেয়ের ছবি যে ভঙ্গিতে আঁকা তাতে ভীষণ খটকা লাগছে। দ্রুতগামী একটা
ট্যাক্সি এসে থামলো ইউটোপিয়ার সামনে। দু’জন মেয়ে দ্রুত নেমে প্রায় ছুটে ঢুকে গেলো
ইউটোপিয়ার বন্ধ দরজা ঠেলে। তাদের পোশাক পরিচ্ছদ সাজ-গোজ দেখে বুঝলাম আমার সন্দেহ
ঠিক। একটা ইউনিভার্সিটির অফিসের পাশের রুমেই কিনা চলছে নিষিদ্ধ জগতের আয়োজন!
সভ্যতার
নানারকম অসুখও থাকে। ক’দিন আগে
লোকাল ফ্রি পেপারে একটা জমকালো বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। বিজ্ঞাপনের ভাষ্য এরকমঃ একজন
স্কুল শিক্ষিকার বেতন ঘন্টায় তেইশ ডলার, একজন নার্সের বেতন ঘন্টায় পঁচিশ ডলার, একজন
বিমান-বালার বেতন ঘন্টায় তিরিশ ডলার, একজন ডাক্তারের বেতন ঘন্টায় একশ’ ডলার। কিন্তু তুমি যদি আঠারো থেকে পঁচিশ
বছরের মেয়ে হও- ইচ্ছে করলে ঘন্টায় পাঁচশ’ থেকে হাজার ডলার উপার্জন করতে পারো। যোগাযোগের ঠিকানা ইত্যাদি। এরকমই কোন
কর্মক্ষেত্র ‘ইউটোপিয়া’ যেখানে কেউ কেউ ঘন্টায় হাজার ডলার উপার্জন করে।
আর-এম-আই-টি’র অফিসে উঁকি দিলাম। বিট্টুর চিহ্নও
নেই কোথাও। তবে কি ভুল জায়গায় এসেছি? এখানে
অপেক্ষা করার কোন মানে হয় না। ফিরে এলাম নিজের অফিসে।
রাত
আটটায় লেবি থিয়েটারে ফিজিক্স পাবলিক লেকচার। শুক্রবারের সন্ধ্যায় নানারকম বিনোদনের
উপাদান উপেক্ষা করে প্রায় শ’তিনেক মানুষ
বসে বসে বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা শুনলেন। আজকের বিষয় ছিলোঃ New Eyes on Mars: Physics of the
Pathfinder Mission. মঙ্গলগ্রহ অভিযানের নানারকম
খুঁটিনাটি। বক্তা এসোসিয়েট প্রফেসর ডেভিড জেমাইসন। দাড়িওয়ালা প্রফেসর জেমাইসনকে
দেখতে অনেকটা নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালামের মত লাগে। চমৎকার উপস্থাপনা
তাঁর। বিজ্ঞানের খটমটে জিনিস যে এত আকর্ষণীয় হতে পারে চোখের সামনে না দেখলে
বিশ্বাস করতাম না। দুটো বিরাট বিরাট পর্দায় প্রতিফলিত হলো মঙ্গল গ্রহের ঘূর্ণন,
পাথফাইন্ডার মিশনের বৈজ্ঞানিক কাজ-কর্ম। দেড়-ঘন্টার প্রতিটি সেকেন্ড উপভোগ করলাম।
ইউনিভার্সিটিগুলোর সাথে জনগণের এরকম সরাসরি যোগাযোগ আমাদের দেশে খুব একটা দেখা যায়
না। বক্তৃতা শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বটা আরো আকর্ষণীয়। দারুণ ভালো লাগা নিয়ে বাসায়
ফিরলাম রাত দশটার দিকে। ফিলের লাউঞ্জরুমের উইক-এন্ড পার্টি তখন তুঙ্গে।