Saturday, 13 April 2019

ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন - ত্রয়োদশ পর্ব



১৮ জুলাই ১৯৯৮ শনিবার

            আর ইউ ইন্ডিয়ান?
            নো
            পাকিস্‌টানি?
            নো
            দেন্‌ ইউ মাস্ট বি ব্যাংলাডেশি
            সাথে সাথে লোকটাকে ভালো লেগে গেলো। এ পর্যন্ত যতজন শ্বেতাঙ্গ অস্ট্রেলিয়ানের সাথে কথা হয়েছে তারা এমন ভাব করেছে যেন বাংলাদেশের নামই শোনেনি আগে। হাসিমুখে বললাম, ইয়েস। বাট হাউ- আই মিন হাউ ডু ইউ নো?
            শোয়া থেকে উঠে বসলেন ভদ্রলোক। রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে যতটা আন্দাজ করেছিলাম তার চেয়েও বিশাল শরীর। ফুটবলের মত গোল মুখে লাল চাপদাড়ি। মাথায় উলের টুপি। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসতে বসতে বললেন, হাউ ডু আই নো? জাস্ট গেসিং বাই ইওর ড্রেস। হোয়াট ইউ কল ইট- লাউঙ্গি?
            আমার পরনে লুঙ্গি দেখেই বুঝে ফেললেন আমি ইন্ডিয়ান বা পাকিস্তানী বা বাংলাদেশী? আর কোন দেশের মানুষ বুঝি লুঙ্গি পরে না? ভদ্রলোক ইচ্ছে করেই আমার চেহারা আর গায়ের রঙের কথা বললেন না। তার লাউঙ্গি শুধরে দেয়া দরকার। বললাম, লুঙ্গি
            ইয়েস। লুঙ্গি, লুঙ্গি। ভেরি নাইস ড্রেস।
            লুঙ্গি নাকি নাইস ড্রেস! ভদ্রতার খাতিরে কত কিছুই যে বলতে হয়!
            কাল রাতে অনেক দেরিতে ঘুমালেও বেশ সকালেই উঠেছি আজ। শেভ-টেভ করে মুখ-হাত ধুয়ে রুমে আসার পরপরই জেগে গেছেন ভদ্রলোক। মনে হচ্ছে বেশ মিশুক প্রকৃতির মানুষ। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, উইল, উইল ড্রিংক ওয়াটার।
            ড্রিংক ওয়াটার? পানি চাচ্ছে আমার কাছে? অদ্ভুত তো! উনাকে এখন পানি খেতে দিতে হবে? কোকাকোলার খালি বোতলে পানি ভরে এনে রেখেছিলাম বাথরুম থেকে। অস্ট্রেলিয়ার ট্যাপের পানিও পরিশোধিত- নিশ্চিন্তমনে খাওয়া যায়। বোতলটা এগিয়ে দিতেই তিনি বললেন, নো নো। হাঃ হাঃ হাঃ  আই ডোন্ট ওয়ান্ট ওয়াটার। আই এম টেলিং মাই নেম। উইলিয়াম ড্রিংকওয়াটার। হাঃ হাঃ হাঃ
            ড্রিংক-ওয়াটার! কী অদ্ভুত ফ্যামিলি-নেম। হা হা করে গলা ফাটিয়ে হাসছেন এখনো। লাল লাল দাঁত। ব্রাশ করেন না কতদিন কে জানে।
            নিজের নাম বলে হাত বাড়াতেই হাতটা ধরে প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিলেন। মস্ত বড়, ভীষণ শক্ত রুক্ষ থাবা তাঁর। দেশে-বিদেশের আগা আবদুর রহমানের মত আঙুলগুলো মর্তমান কলার সাইজ। কিন্তু লম্বা লম্বা নখ, নখের ফাঁকে পুরু ময়লার স্তর। মনে হয় ঠিকমত হাতও ধোন না।
            কথা বলতে পছন্দ করেন উইল। অনবরত বকবক করেই যাচ্ছেন। বাংলাদেশে কখনো যান নি তিনি। তবে শুনেছেন সেখানে প্রতিবছর বন্যা হয় আর সেখানকার পুলিশ খুব ঘুষ খায়। বন্যার খবর না হয় আন্তর্জাতিক মিডিয়া থেকে পেয়েছেন, কিন্তু পুলিশের ঘুষ খাওয়ার খবর কোত্থেকে পেলেন? আমাদের দেশের ভালো কিছু বুঝি জানতে নেই? নিজের দেশের খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে আমরা নিজেরা কত কঠিন সমালোচনা করি। কিন্তু অন্যদেশের কারো মুখে নিজের দেশের সামান্য সমালোচনাও যে কত খারাপ লাগে তা বুঝলাম। বাংলাদেশের নাম জানে দেখে এই লোকটাকে একটু আগে খুব ভাল লেগেছিল, কিন্তু এখন আর লাগছে না।
            তাঁর কথাবার্তায় শুরুতে যে উৎসাহ দেখিয়েছিলাম তা উধাও হয়ে গেছে। আমি তাঁর দিকে আর তাকাচ্ছিও না। কিন্তু তাতে তাঁর কিছু আসে যায় বলে মনে হলো না। তিনি সমানে বকবক করে চলেছেন।
            কোন চাকরি করেন না তিনি। মানে চাকরি করতে হয় না তাঁকে। মহান অস্ট্রেলিয়ায় খেয়ে পরে আরামে বেঁচে থাকার জন্য চাকরি না করলেও চলে! তিনি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান অর্থাৎ সরকার থেকে ভাতা নিয়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে গাছ লাগান আর গাছের পরিচর্যা করেন। গাছ লাগাও পরিবেশ বাঁচাও টাইপের একটা সংগঠনের সাথে জড়িত। ওই সংগঠনের একটা সম্মেলনে এসেছেন এখানে ব্রিসবেন থেকে। কাল চলে যাবেন। এগুলো বলার পর পরিবেশের ওপর গাছের প্রভাব সম্পর্কিত বক্তৃতা শুরু করলেন।
            ভদ্রতার খাতিরে হ্যাঁ-হুঁ-ইয়েস-ইয়েস করেছি অনেকক্ষণ। কিন্তু ভদ্রতা রক্ষার দায় শুধুমাত্র একপক্ষের উপর এসে পড়লে ভদ্রতার বাঁধ ভেঙে যায়। আমিও আর পারলাম না। বললাম, সরি, আই হ্যাভ টু গো নাউ       
            বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আর শীতে কাঁপতে কাঁপতে যখন ফিজিক্স বিল্ডিং এর দরজায় এসে পৌঁছলাম তখন দশটা বেজে গেছে। উইলিয়াম ড্রিংকওয়াটারের বৃক্ষ-বন্দনা এড়াতে গিয়ে ছাতা না নিয়েই বেরিয়ে পড়েছি। অবশ্য বেরোনোর সময় রোদ ছিল। শীতকালেই এত বৃষ্টি এখানে, জানি না বর্ষাকালে কী হবে। অবশ্য এদেশে বর্ষাকাল আছে কি-না তাও জানি না।
            দেয়ালে লাগানো অদ্ভুত একটা তালায় চাবি ঘুরাতেই দরজা খুলে গেল। এক ধরনের উত্তেজনা হচ্ছে বুকের ভেতর। এই বিল্ডিং-এ এখন থেকে যখন খুশি আসা-যাওয়া করতে পারবো। কী আনন্দ! লিফ্‌টে উঠে সোজা ছতলায়। সবগুলো দরজাই বন্ধ। কোথাও কেউ নেই আজ। ৬১২ নম্বর রুমে ঢুকে নিজের ডেস্কে বসলাম। এখন থেকে এই রুমেই আমার বেশির ভাগ সময় কাটবে। বলতে পারো এটাই আমার নতুন ঠিকানা। 
            ব্যাগ খুলে আজকের এজ পত্রিকাটি বের করলাম। আসার পথে গ্র্যাটান স্ট্রিটের একটা নিউজ-এজেন্ট থেকে কিনে এনেছি। চাকরি আর বাসা খোঁজার জন্য শনিবারের এজ খুবই তথ্যবহুল বা বলা চলে বিজ্ঞাপনবহুল। পাতার পর পাতা-ভর্তি বিজ্ঞাপন- নানারকম বাসা, নানারকম চাকরি। শেয়ার একোমোডেশানের পাতায় চোখ বুলাচ্ছি- সাপ্তাহিক আশি ডলারের নিচে কোন বাসাই নেই।
            হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো।
            হ্যালো
            গুডমর্নিং, ইট্‌স ক্যারোলিন ফ্রম হকিং স্টুয়ার্ট রিয়েল এস্টেট। ইজ মিস্টার ডেব দেয়ার?
            মিস্টার ডেব!
            ইয়েস, মিস্টার প্রাডিব ডেব?
            আমাকেই খুঁজছে। ঘরভাড়ার দরখাস্তে এই নাম্বারটাই দিয়েছিলাম।
            ইয়েস, আই এম প্রদীপ
            মিস্টার ডেব, উই আর সরি টু ইনফর্ম ইউ দ্যাট ইওর রেন্টাল এপ্লিকেশান ফর ডেভিড স্ট্রিট এপার্টমেন্ট হ্যাজ বিন আন্‌সাক্‌সেসফুল। উই আর রিয়েলি সরি
            লাইন কেটে গেলো। বাসাটাও হলো না। আমার ব্যার্থতার পাল্লা এখানে এসেও কত ভারী হচ্ছে দেখেছো? কথায় আছে না- তুমি যাবে বঙ্গে, কপাল যাবে সঙ্গে। কপালের কথা বললাম বলে আবার ভেবে বসো না যে আমি কপালে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি।
            শেয়ার একোমোডেশানের বিজ্ঞাপন থেকে কয়েকটা টেলিফোন নাম্বার টুকে নিলাম। ফোন করে দেখতে হবে খালি আছে কি না। আলী সাহেব বলছিলেন খন্ডকালীন চাকরি আর খন্ডকালীন বাসা নাকি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হবার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ফিল-আপ হয়ে যায়।
            ইউনিভার্সিটির আশেপাশের সাবার্ব হলো পার্কভিল, কার্লটন, নর্থ-মেলবোর্ন। এই সাবার্বে মাত্র চারটা বাসার বিজ্ঞাপন দেখলাম যাদের ভাড়া আমার সাধ্যের মধ্যে।
            অফিসের টেলিফোনটা থাকাতে বেশ সুবিধা হলো। লোকাল নাম্বারে যত খুশি ফ্রি ফোন করা যাবে। কার্লটনের একটা বাসায় ফোন করলাম। বিজ্ঞাপনে নাম দেয়া আছে লি। হবে কোন চাইনিজ- ব্রুসলির আত্মীয়স্বজন। তিন রুমের বাসায় একটা রুম খালি আছে। ভাড়া সপ্তাহে আশি ডলার। ফ্রি ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা আছে।
            রিং হচ্ছে। আগেই কাগজে লিখে নিয়েছি কী কী বলবো। ও প্রান্তে হ্যালো বলতেই আমি যথাসম্ভব দ্রুত বললাম, হাই, ক্যান আই স্পিক টু মিজ্‌ লি প্লিজ
            মিজ্‌ লি দু নত লিভ হিয়ার। আই এম মিস্তার লি
            এটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। মিস্টার লি না বলে মিজ লি কেন বলেছি তাও জানি না। বললাম, সরি মিস্টার লি, আই উড লাইক টু নো ইফ দি রুম ইন ইওর হাউজ ইজ স্টিল এভয়েলেবল
            রুম? ফর হু? ফর ইউ?
            ইয়েস। ফর মি
            সরি, ফর ইউ- নো রুম। ফর ম্যান- নো রুম। ফর ওম্যান- ইয়েস রুম
            ফোন রেখে দেয়ার শব্দ হলো। অদ্ভুত ব্যাপার তো! বাংলাদেশে ব্যাচেলর হবার কারণে বাসা পায় না অনেকে। মেয়েদের বাসা পাওয়া আরো কষ্টের। কিন্তু মিস্টার লি আমাকে সরাসরি না করে দিলেন মেয়ে নই দেখে।
            আরেকটা নাম্বারে ফোন করলাম। ব্রাঞ্চউইক সাবার্বে চার বেডরুমের একটা বাসার একটা রুম খালি আছে। সপ্তাহে আশি ডলার। জেসিকে ফোন করতে বলা হয়েছে বিজ্ঞাপনে।
                হ্যালো- জড়ানো পুরুষ কন্ঠ। মনে হচ্ছে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ফোন ধরেছে। কাগজ দেখে দেখে বললাম, ক্যান আই স্পিক টু জেসি প্লিজ
                জেসি- জেসি-, হ্যাং অন এ মিনিট- জেসি- জেসি- এভ্‌রিবডি ওয়ান্টস টু স্পিক টু জেসিজড়ানো গলায় জেসিকে ডাকার শব্দ হচ্ছে। জেসিও কি ঘুম থেকে উঠেনি এখনো? সাড়ে দশটা বাজে। ছুটির দিনের সাড়ে দশটা কি খুব বেশি সকাল?
            অনেকক্ষণ ধরে শোঁ শোঁ আওয়াজ ছাড়া আর কোন সাড়া-শব্দ নেই ওপ্রান্তে। লোকটা কি জেসিকে ডেকে না দিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো আবার? বাসাটা যদি পাই তাহলে এই লোক আমার হাউজমেট হবে! ভাবনার ডাল-পালা কীভাবে যে গজায় দেখেছো! এখনো বাসার কথা বলাই হয়নি- অথচ হাউজমেটের কথা ভাবছি।
            হাই, জেসি স্পিকিং
            অদ্ভুত মিষ্টি গলা জেসির। মিতা হক যদি ইংরেজিতে কথা বলতেন এরকমই শোনাতো।
            হাই, আই ওয়াজ ওয়ান্ডারিং ইফ দি রুম ইজ স্টিল এভয়েলেবল ইন ইওর হাউজ
            হোয়াট্‌স ইওর নেম?
            প্রদীপ দেব
            ইন্ডিয়ান?
            নো
            হোয়ার ইউ ফ্রম?
            বাংলাদেশ
            হাউ ফার ভাংলাডেশ ফ্রম ইন্ডিয়া?
            বাংলাদেশ উচ্চারণ করার সময় এদের কী হয় কে জানে। বাংলাদেশ শব্দটি কি এতই কঠিন? জানতে চাচ্ছে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া থেকে কত দূরে। এই ভৌগোলিক দূরত্বের সাথে আমার বাসা পাওয়ার সম্পর্ক কী বুঝতে পারছি না। বললাম- নট ভেরি ফার। নেইবারিং কান্ট্রি
            ডু ইউ ঈট ইন্ডিয়ান ফুড?
            এই মেয়ে কি আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছে? আমাকে রুম-ভাড়া দেবে কি না নির্ভর করছে এই ইন্টারভিউর উপর! বললাম, ইয়েস। আই ঈট ইন্ডিয়ান ফুড
            ডু ইউ কুক?
            ইয়েস
            স্পাইসি ফুড?
            মেয়েটি এমন আগ্রহ ভরে জানতে চাইছে- মনে হচ্ছে মসলা দেয়া খাবার খাওয়ার জন্য সে উদ্গ্রীব হয়ে বসে আছে। মহা উৎসাহে বললাম, ইয়েস। আই এম এ গুড কুক
            ইন দ্যাট কেস- দি রুম ইজ নট এভয়েলেবল, সরি
            লাইন কেটে গেল। মনে হচ্ছে একটা চড় খেলাম জোরে। কিন্তু আমার অযোগ্যতাটা ঠিক কী বুঝতে পারছি না। অন্য দুটো নম্বরে ফোন করার সাহস পাচ্ছি না আর। কী করবো ভাবছি এমন সময় রুমের দরজা খুলে গেল।
            হাই প্রাডিব, ইউ আর হিয়ার
            হাই পিটার। ইউ আর হিয়ার টু
            আই নিড টু গেট এ ফাইল- কম্পিউটারের সামনে বসতে বসতে বললেন ডক্টর পিটার ডর্টস্‌ম্যান। জানতে চাইলেন আমি কী করছি। বললাম, বাসা খুঁজছি। সকাল থেকে তিনবার ব্যর্থ হয়েছি
            ইউনিয়ন হাউজের নোটিশ বোর্ড দেখেছো?
            না। কোথায় সেটা?
            ইউনিয়ন হাউজ তো চেনো। স্টুডেন্ট এডমিনিস্ট্রেশানের সামনে। এস-টি-এর গেট দিয়ে ঢুকে সোজা চলে যাবে ফুড-কোর্টের দিকে। ফুড-কোর্টে ঢোকার সময় বাম দিকের দেয়ালে দেখবে নোটিশ বোর্ড। ওখানে অনেক বাসার খবর পাবে
            স্টুডেন্ট ইউনিয়ন আজ বন্ধ না?
            শনিবার পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকে
            থ্যাংক ইউ পিটার। আমি এখনি যাচ্ছি
            পিটারের সামনে এমনিতেই টেলিফোন করতে পারতাম না। দেখে দেখে ইংরেজি বলছি দেখলে পিটার নির্ঘাৎ হাসতেন।
            পিটারের কথামতো এস-টি-এ ট্রাভেল এজেন্সির পাশ দিয়ে ঢুকলাম ইউনিয়ন হাউজে। অনেক ছেলেমেয়ের ভীড়। ফুডকোর্টের অনেক স্টল খোলা। নোটিশবোর্ড পেয়ে গেলাম। নানারকম ছোটবড় বিজ্ঞাপনে ভর্তি। ছোট ছোট হলুদ কাগজে শেয়ার একোমোডেশানের অনেক বিজ্ঞাপন। বেশির ভাগই কম্পিউটারে কম্পোজ করা, কিছু কিছু হাতে লেখাও আছে। কয়েকটি বিজ্ঞাপন দেখলাম চায়নিজে লেখা। সুন্দর বুদ্ধি। শুধুমাত্র চায়নিজরাই যোগাযোগ করতে পারবে।
            কাগজ কলম বের করে কয়েকটা নম্বর টুকে নিলাম। একটা নাম দেখা যাচ্ছে- সুরেশ দাস। সম্ভবত বাঙালি। সাপ্তাহিক পঁচাত্তর ডলার ভাড়ায় একটা রুম খালি আছে। এখুনি টেলিফোন করা দরকার। দ্রুত ফিরে এলাম অফিসে।
            পিটার রুমে নেই। কম্পিউটার অফ। মনে হচ্ছে চলে গেছেন। ভালোই হলো। নিঃসংকোচে কথা বলা যাবে। সুরেশ দাস - বাঙালি নাম। বাংলায় কথা বললে কেমন হয়?
            হ্যালো
            হ্যালো, ক্যান আই স্পিক টু মিস্টার সুরেশ দাস প্লিজ?
            স্পিকিং। হু ইজ ইট?উচ্চারণে ইন্ডিয়ান টান। আমি বাংলায় বললাম, নমষ্কার। আমি আপনার বাসার বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করছি
            হোয়াট! হোয়াট ইজ ইট?
            বুঝতে পারছি ভুল হয়ে গেছে। সুরেশ দাস নিশ্চয় বাঙালি নন। তাড়াতাড়ি বললাম সেই গৎবাঁধা সংলাপ, আই ওয়াজ ওয়ান্ডারিং- ইত্যাদি ইত্যাদি।
            রুম এখনো খালি আছে। সুরেশ দাস এখন বাসায় নেই। বিকেল তিনটা নাগাদ বাসায় ফিরবেন। একটু আশ্চর্য হলাম- তিনি বাসায় নেই- অথচ আমি তাঁর সাথে কথা বলছি। নম্বরটা কি বাসার নয়?
            নো। আই এম এট ওয়ার্ক নাউ
            জানা গেলো টেলিফোন নম্বরটা ইউনিভার্সিটি অফিসের। সুরেশ দাস মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির এডুকেশান ডিপার্টমেন্টে পিএইচডি করছেন। দুপুর দুটোয় তাঁর সাথে দেখা করতে হবে তাঁর অফিসের সামনে। তখন তিনি আমাকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে বাসা দেখাবেন।
                যা অবস্থা দেখছি- বাসা পাওয়ার আগ পর্যন্ত কোন বিশ্বাস নেই। আরেকটা নাম্বারে ফোন করলাম। রবিন অগাস্টিন-ই ফোন ধরলেন। নাম শুনে ভেবেছিলাম অস্ট্রেলিয়ান বা ইউরোপিয়ান হবেন। কিন্তু রবিনের ইংরেজির অবস্থা আমার চেয়েও খারাপ। বললেন- এখুনি গিয়ে বাসা দেখে আসতে পারি। পছন্দ হলে চার সপ্তাহের এডভান্স দিয়ে কালকেই বাসায় উঠে যেতে পারি।  
                ফিজিক্স বিল্ডিং থেকে সোয়ান্সটন স্ট্রিটের গেট দিয়ে বেরোলেই ট্রাম স্টপ। রবিনের কথা মত ১নং ট্রামে উঠে বসলাম। যতটা কাছে ভেবেছিলাম ততটা কাছে নয় মুরল্যান্ড রোড। ঠিক আধঘন্টা লাগলো পৌঁছাতে। ১২৯ নম্বর স্টপে নেমে রাস্তার ডান দিকে সামান্য কিছুদূর গিয়েই বাড়িটা পেয়ে গেলাম।
                বৃষ্টি থেকে গেছে অনেকক্ষণ, কিন্তু রাস্তা এখনো ভেজা। বাড়ির সামনে বড় বড় ঘাস- মনে হয় অনেকদিন কাটা হয় না। বাড়িটা অনেক বড়। মনে হচ্ছে কাঠের তৈরি। টালির ছাদ। বাড়িটার রঙ কোন এক কালে হয়তো সাদা ছিল, এখন কেমন যেন ময়লা ছাই এর রঙ নিয়েছে।          বাড়ির সামনে ঘাসের উপর দুটো গাড়ি পার্ক করা আছে। বারান্দায় অনেক জামাকাপড় এলোমেলোভাবে ঝুলছে একটা তার থেকে। মনে হচ্ছে ওগুলো ওখানেই থাকে। কেমন যেন অগোছালো চারদিক। দরজায় শব্দ করতেই বেরিয়ে এলেন একজন কালো সোয়েটার পরা পেটমোটা ভদ্রলোক। গায়ের রং কুচকুচে কালো। গোল মুখে পুরু গোঁফ।
            হাই, আই এম লুকিং ফর রবিন অগাস্টিন
            আই এম রবিন
            রবিন অগাস্টিন কেরালা থেকে এসেছেন। এই বাসায় বাকি যারা থাকেন সবাই কেরালার। বাসা দেখলাম। চারটা বেডরুম, একটা বাথরুম। ময়লা জামাকাপড় তোয়ালে পড়ে আছে বাথরুমের ভেজা ফ্লোরে। একটা অস্বস্তিকর দুর্গন্ধ বাথরুম ঘিরে।  
            যে বেডরুমটা খালি আছে- সে রুমের ফ্লোরে পাতা দুটো ম্যাট্রেসে দুজন ঘুমাচ্ছেন। অন্য তিনটা রুমের কোনটাতেই ঢুকিনি- কিন্তু মনে হলো অনেক মানুষ সেখানে। কিচেন আর লাউঞ্জ একসাথে- ভীষণ অগোছালো। সিংক ভর্তি ময়লা ডিশ, ডেক্‌চি-কড়াই। কিচেনের একটা কেবিনেটের পাল্লা ভাঙা। একটা টু-সিটার সোফা লাউঞ্জের দেয়াল ঘেঁষে। তার পাশেই দুটো জুতোর তাক। অনেক জোড়া জুতো সেখানে এলোমেলোভাবে রাখা।
            কয় জন থাকে এ বাসায়? জানতে চাইলাম রবিনের কাছে। রবিন কিছুক্ষণ সময় নিয়ে হিসেব করে বললেন- চার রুমে আটজন থাকতে পারে বেশ আরামে। এখন আছে মাত্র ছজন। একটা রুম খালি আছে। আমি যদি রুমটা নিই- ইচ্ছে করলে একাই থাকতে পারি- নয়তো আরেকজনের সাথে শেয়ার করতে পারি। একা থাকলে সপ্তাহে আশি ডলার দিতে হবে- আর দুজন থাকলে সপ্তাহে পঞ্চাশ ডলার দিলেই চলবে।
            রবিনের সাথে কথা বলার সময়েই আরো দুজন ছেলে এসে ঢুকলো বাইরে থেকে। তামিল বা মালায়লাম ভাষায় কথা বলতে বলতে রান্নাঘর কাম লাউঞ্জের কোণায় জুতা খুলে অদৃশ্য হয়ে গেলো ঘরের কোন একটা রুমে। কজন থাকে এখানে! রবিন সরাসরি কোন উত্তর দেননি এ প্রশ্নের। অস্বস্তি লাগছে খুব। কোনভাবে বেরিয়ে আসতে পারলেই বাঁচি। বললাম, আজ বিকেলে আরো একটা বাসা দেখার কথা আছে। ওটা দেখার পর জানাবো
            রবিন বললেন, বেশি দেরি করলে কিন্তু এই বাসা থাকবে না। এত সস্তায় আর কোথাও থাকার জায়গা পাবে না
            সস্তার যে কী অবস্থা- নিজের চোখেই তো দেখলাম। শুনেছি কেরালার বেশির ভাগ মানুষ শিক্ষিত এবং সচ্ছল। তাহলে এখানে এভাবে গাদাগাদি করে থাকার অর্থ কী?
            ট্রাম স্টপে এসেই ট্রাম পেয়ে গেলাম। আধঘন্টার মধ্যেই ফিরে এলাম অফিসে। রবিন অগাস্টিনের বাসায় আর যাচ্ছি না। দেখা যাক সুরেশ দাসের বাসাটা কেমন।
            দুটো বাজার দশ মিনিট আগেই গিয়ে হাজির হলাম এডুকেশান বিল্ডিং এর সামনে। সুরেশ দাসের কথা মত গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে সিঁড়ি দিয়ে আন্ডার-গ্রাউন্ড ফ্লোরে চলে এলাম। রিসার্চ স্টুডেন্টদের অফিস এখানে। কাচের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দরজায় টোকা দেয়ার পর যে ছেলেটা এসে দরজা খুললো- সে কিছুতেই সুরেশ দাস হতে পারে না। একজন চায়নিজ। বললাম, আই এম লুকিং ফর মিস্টার সুরেশ দাস
                ইয়েস, ইয়েস, হিয়ার
                ভেতরে ঢুকলাম। আমার অফিসের মতই অফিস। তবে জায়গা আরো কম। ডেস্কের গায়ে ডেস্ক লাগানো। চায়নিজ ছেলেটা চুপচাপ বসে আছে একটা চেয়ারে। বুঝতে পারছি সেও আমার মত আগন্তুক।
                কয়েক মিনিট পরেই বেশ মোটা বেঁটে একজন মানুষ ব্যস্তভাবে এসে ঢুকলেন। মনে হচ্ছে ইনিই সুরেশ দাস। গায়ের রঙ আমার মতই কালো। মাথায় বেশ বড় টাক, গলায় বৈষ্ণবদের মত একটা মালা।
                হাই, আই এম ওয়েটিং ফর সুরেশ দাস
                হ্যালো, আই এম ছুরেচ। আর ইউ প্রদীপ? হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন সুরেশ। ডান হাতে বড় বড় পাথর বসানো তিনটি আংটি। আড়চোখে তাঁর বাম হাতটাও দেখে নিলাম। সেখানেও দুটো আছে। ভাগ্যের গ্রহ-নক্ষত্র একেবারে দুহাতের আঙুলবন্দী করে রেখে দিয়েছেন দাস মহাশয়।
            চায়নিজ ছেলেটাও বাসা দেখতে এসেছে। আমাদের দুজনকে সাথে নিয়ে বেরোলেন সুরেশ দাস। অনবরত কথা বলছেন সুরেশ। ইন্ডিয়ান ইংলিশ আর আসল ইংলিশে অনেক পার্থক্য। বিশেষ করে উচ্চারণে। উচ্চারণ করতে পারেন না তিনি। উচ্চারণ করতেও সমস্যা হয়। যেমন উনার বাসা সম্পর্কে বলছেন, ইউ উইল লাউ ইট
            টু-ডোরের ছোট্ট একটা গাড়ি আছে সুরেশ দাসের। গ্র্যাটান স্ট্রিটে পার্ক করেছেন। সুরেশ দাসের নির্দেশ মত চায়নিজ ছেলেটা পেছনে বসলো। আমি সামনে সুরেশ দাসের পাশে। গাড়ি চালাতে চালাতে অনেক জ্ঞান দিলেন সুরেশ বাবু। এডুকেশানে পিএইচডি করছেন- আর জ্ঞান দেবেন না তা কি হয়? জেনে আশ্চর্য হলাম- তিনি পশ্চিমবঙ্গের সন্তান। চৌদ্দপুরুষ বাঙালি, কিন্তু তিনি বাংলা ভুলে গেছেন। কারণ মাধ্যমিকের পর থেকেই তাঁরা দিল্লিতে। বোঝো এবার দিল্লির কী গুণ!
            জায়গাটার নাম কোবার্গ। বাসার সামনে রাস্তার ওপরেই পার্কিং। গাড়ি থেকে নেমে মনে হলো- জায়গাটা সুন্দর। কিন্তু সুরেশ দাসের সঙ্গ খুব একটা আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে না।
            সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এলাম সুরেশের পিছু পিছু। তিন তলা বাড়ির দোতলায় এপার্টমেন্টটা। একটা রুম খালি আছে বলেছেন- কিন্তু এপার্টমেন্টে রুম-ই আছে মাত্র একটা। ওয়ান বেডরুম এপার্টমেন্ট। থাকেন দুজন। একজন ভিয়েতনামী ছেলে থাকে রুমের ভেতর, আর সুরেশ দাস থাকেন লাউঞ্জে। ভিয়েতনামী ছেলেটা নাকি চলে যাবে এ সপ্তাহে। তাই রুমটা ভাড়া দেয়ার ব্যবস্থা করছেন সুরেশ দাস।
            রিয়েল এস্টেট থেকে এপার্টমেন্টটা কার নামে লিজ নেয়া হয়েছে জানি না। এরকম সাবলেট দেয়া বৈধ কি না তাও জানি না। সুরেশ দাস এ বাসার সুযোগ-সুবিধে দেখাচ্ছেন। বাথরুমটা বেডরুম সংলগ্ন- যেতে হয় বেডরুমের ভেতর দিয়ে। এরকম হলে বেডরুম আর লাউঞ্জরুমের মধ্যে পার্থক্য আর থাকে কী? ভিয়েতনামীটা মনে হয় এ কারণেই চলে যাচ্ছে বাসা ছেড়ে।
            সুরেশ দাসের কথা বিনা-তর্কে শুনে যাচ্ছি বলে তিনি ভেবে নিয়েছেন আমি তাঁর গুণে মুগ্ধ হয়ে গেছি। তাই তিনি আমাকেই রুমটা ভাড়া দিতে চাচ্ছেন। চায়নিজ ছেলেটা নিঃশব্দে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। চেহারা দেখে তার পছন্দ-অপছন্দ বোঝার কোন উপায় নেই।
            লাউঞ্জরুমে একটা ম্যাট্রেস আর দুটো চেয়ার ছাড়া আর কোন আসবাব নেই। ম্যাট্রেসের ওপর একগাদা জামা-কাপড়। ফ্লোরের কার্পেটের ওপর অনেক বইপত্র।
            ইউ ডোন্ট নিড টু বাই এনি থিং ফর কুকিং- পট্‌চ, প্যান্‌চ, আই হ্যাভ এভ্‌রিথিং। ইউ ক্যান ইউজ ইট ফর ফ্রি। লুক এট দি ফ্রিজ- হাউ বিগ, লুক এট দিস মাইক্রোওয়েভ- হাউ বিগ
            এত কথা বলছে কেন লোকটা? বিগ ফ্রিজ- বিগ মাইক্রোওয়েভ দেখলাম, দেখলাম তাদের গায়ে পুরু ময়লার আস্তরণ। আমাদের উপমহাদেশের মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-বিত্তের ছেলে-মেয়েরা বাড়িতে নিজের কাজ নিজে করতে অভ্যস্ত নয়। তারই প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি এখানে। এক্ষেত্রে রবিন অগাস্টিন আর সুরেশ দাস এক। এই লোকের সাথে বাসা শেয়ার করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ইউনিভার্সিটিও অনেক দূরে এখান থেকে। ট্রামে যেতে অনেকক্ষণ লাগবে।
            সুরেশ দাসকে পরে জানাবো বলে বেরিয়ে এলাম। চায়নিজ ছেলেটাও বেরিয়ে এলো আমার সাথে। দুজনে পাশাপাশি হেঁটে ট্রাম স্টপ পর্যন্ত এলাম, কিন্তু কোন কথাবার্তা হলো না। ছেলেটি মনে হয় আমাকে বাসার ব্যাপারে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে। ট্রামে উঠে সে সামনের দিকে চলে গেলো। আমি পেছনে জানালার পাশে বসে তাকিয়ে রইলাম বাইরে। আবার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে- রাবীন্দ্রিক বৃষ্টি। এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে, উদ্ভ্রান্ত মেঘে, মন চায়- মন চায় ওই বলাকার পথখানি নিতে চিনে
            ১৯ নম্বর ট্রামে আজ প্রথম চড়লাম। কোবার্গ থেকে অনেক দূর ঘুরে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির মেডিকেল বিল্ডিং এর পাশে ট্রাম এসে ডান দিকে মোড় নিচ্ছে দেখে পরের স্টপেই নেমে গেলাম। রাস্তা পার হয়ে ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে একপ্রকার ভিজতে ভিজতে চলে এলাম সোয়ান্সটন স্ট্রিটে। দুপুরে একটা মাফিন ছাড়া আর কিছুই খাওয়া হয়নি। রাতের জন্য কিছু কেনা দরকার।
            ডিপার্টমেন্ট থেকে সেফওয়েতে যাবার একটা শর্টকাট রাস্তা আবিষ্কার করে ফেলেছি। ফিজিক্স বিল্ডিং থেকে ওভারব্রিজ পেরিয়ে আর্থ-সায়েন্স বিল্ডিং। সেখান থেকে নিচে নেমে একটা গলি পেরোলে আরেকটা উপগলি। সেটা ধরে সোজা এগোলেই লাইগন স্ট্রিট। এই উপগলির মাথায় একটা বড় বইয়ের দোকান আছে। এদেশের বেশির ভাগ বইয়ের দোকান আকার-আকৃতিতে বিশাল।
            এই দোকানটার বিশেষত্ব হচ্ছে একপাশের বিরাট কাচের দেয়ালজুড়ে ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন। হাতে লেখা ছোট ছোট বিজ্ঞাপন। বন্ধু চাই, গার্লফ্রেন্ড চাই, বিড়াল পাওয়া গেছে বা কুকুর হারিয়েছে, কম্পিউটার বিক্রি হবে, হাউজমেট চাই- কতরকম হাতে লেখা বিজ্ঞাপন। রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েই এসব বিজ্ঞাপন পড়তে হয়। বেশ কয়েকটি হাউজমেট চাই, বা শেয়ার একোমোডেশান চোখে পড়ল। কিন্তু সকাল থেকে এ পর্যন্ত যে অভিজ্ঞতা হয়েছে- তাতে খুব একটা উৎসাহ পাচ্ছি না। বাংলাদেশে ইউনিভার্সিটি লাইফের প্রায় পুরোটাই মেসে থেকেছি- তখন তো তেমন অসুবিধা হয় নি। তবে এখন কেন এরকম মনে হচ্ছে?
            সেফওয়ে থেকে ডিম আর পাউরুটি কিনে ফিরে আসার সময় চোখ গেলো গেটের কাছের নোটিশ বোর্ডে। ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন দেয়ার জন্য এরকম নির্দিষ্ট জায়গা থাকার কত সুবিধা। পুরনো গাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখলাম অনেকগুলো। আর কয়েকটা ঘরভাড়ার বিজ্ঞাপন। ছোট্ট একটা বিজ্ঞাপনে চোখ পড়লো। একটা রুম ভাড়া দেয়া হবে। ভাড়া সপ্তাহে মাত্র পঞ্চাশ ডলার। আর কোন বিল দিতে হবে না। কার্লটন হাউজিং এস্টেটের ১৯/১৪০ নেইল স্ট্রিট। বিজ্ঞাপনদাতার নাম ফিল্‌।
            ইউনিভার্সিটির এত কাছে এত কম ভাড়ায় একটা রুম! দেখা দরকার। টেলিফোন নম্বর লিখে নিয়ে এলাম। কাল সকালে অফিসে গিয়েই ফোন করতে হবে।
            কাকভেজা হয়ে হোস্টেলে ফিরেছি। কী যে ঠান্ডা তুমি ভাবতেও পারবে না। রুম হিটারটাও কাজ করছে না। ড্রিংকওয়াটার রুমে নেই। ইচ্ছে করছে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু ক্ষুধায় পেট চোঁ-চোঁ করছে। ডিম সিদ্ধ করা দরকার। নিচে নেমে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি অনেক ভীড় সেখানে। উইল ড্রিংকওয়াটারকে দেখলাম হাঃহাঃ করে হাসছেন তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে। সবাই মনে হয় গাছ লাগাও সমিতির সদস্য।
            ড্রিংকওয়াটারকে এড়াতে চাইলেও পারা গেল না। আমাকে দেখে তিনি এত জোরে হ্যাল্লো বললেন যে বাকিরাও ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো আমাকে। আমি একটু ভদ্রতার হাসি হাসলাম। ড্রিংকওয়াটারের এক বুড়ো সঙ্গি এসে আমার ডেক্‌চিতে উঁকি দিলো।
            হ্যান ফ্রুট্‌স মাইট। হি হি হি। হেই উইলি- ইওর রুম-মেটজ বয়েলিং হ্যান-ফ্রুট্‌স হি হি হি
            লোকটার মাথায় চকচকে টাক। মুখে একটা দাঁতও নেই। পুরু পাকা গোঁফ ঝুলে আছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে সুকুমার রায়ের হ-য-ব-র-লর পাতা থেকে উঠে এসেছে। ডিমের নাম ভালোই দিয়েছে- হ্যান ফ্রুট্‌স- মুরগির ফল। আমিও হা হা করে হাসলাম বুড়োটার সাথে। মনে হলো কতদিন পরে হাসলাম এত জোরে। কিন্তু ঠান্ডা লাগছে খুব। গায়ে কাঁপুনি দিচ্ছে। মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা। বৃষ্টিতে ভেজার মজা এত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে! আধাসিদ্ধ ডিমগুলো নিয়ে রুমে চলে এলাম। কিন্তু খাবার ইচ্ছে বা শক্তি কোনটাই আর নেই। ঘুম দরকার এখন- লম্বা একটা গুটিসুটি মারা ঘুম।
_____________
PART 14



No comments:

Post a Comment

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts