১৯ জুলাই ১৯৯৮ রবিবার
সফদার ডাক্তার যেভাবে ‘পড়ে বই আলোটারে নিভিয়ে’ অনেকটা সেভাবে তোমাকে লিখতে বসেছি। তেমন
অসুবিধে হচ্ছে না। ল্যাম্প-পোস্টের যেটুকু আলো জানালা দিয়ে বিছানায় এসে পড়েছে-
তাতে পড়তে একটু অসুবিধে হচ্ছে ঠিক, কিন্তু দিব্যি লেখা যাচ্ছে। বাড়িতে লোডশেডিং এর
সময় কত লিখেছি এভাবে।
পূর্ণেন্দু
পত্রীর কথোপকথনের লাইনগুলো মনে আছে? ওই যে- “তোমাদের ওখানে লোডশেডিং কী রকম? বলো না। দিন নেই রাত নেই
জ্বালিয়ে মারছে”? কতদিন লোডশেডিং দেখি না! হয়তো ভাবছো
হঠাৎ লোডশেডিং এর জন্য এত শোক হচ্ছে কেন। হবে না? জীবনের এতগুলো বছর দিন রাত যার
সাথে এত বার দেখা হতো- সে হঠাৎ উধাও হয়ে গেলে শোক হবে না? সেই শোকে লাইট অফ করে
লোডশেডিং এর আবহ তৈরি করেছি বললে ব্যাপারটা একটু বেশি কাব্যিক হয়ে যায়। সুতরাং
বুঝতেই পারছো এর পেছনে অন্য কারণও আছে।
আজ
রাত কাটছে ওয়াইনের সাথে। ‘ওয়াইন’ শুনে আবার ভেবো না যে মদ ধরেছি। পাশের
বিছানায় যে লিকলিকে ছেলেটা মড়ার মত ঘুমোচ্ছে- তার নাম ওয়াইন। বলতে পারো তার ভয়েই
লাইট জ্বালাচ্ছি না। তার সাথে দেখা হবার পর থেকেই একটা তরল ভয় আমাকে ঘিরে ধরেছে।
এখন কোন রকমে রাতটা কাটাতে পারলেই বাঁচি। ভয়ের কারণটা বলছি। তার আগে শোন আজ কী কী
করলাম।
সকালে ঘুম ভাঙার পরও চুপচাপ
শুয়েছিলাম অনেকক্ষণ। ব্রিসবেনের বুড়ো বৃক্ষপ্রেমিক তাঁর জিনিসপত্র গুছিয়ে “গুডবাই মাই ফ্রেন্ড” বলে চলে গেলেন। আমি আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর শরীরের
সব শক্তি জড়ো করে উঠে বসলাম। বিছানায় বসে বসে আকাশ দেখলাম কিছুক্ষণ। সূর্যের দেখা
নেই, কেবল মেঘ আর মেঘ। বৃষ্টি শুরু হয়নি- তবে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ছুটির দিন, গায়ে
জ্বর, বাইরে বৃষ্টি- বাড়িতে থাকলে এ অবস্থায় যা করতাম এখানে তা চিন্তাও করা যাচ্ছে
না। আমাকে বেরোতে হলো নেইল স্ট্রিটের রুমটার ব্যাপারে খোঁজ নিতে।
ইউনিভার্সিটিতে
পৌঁছার আগেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। বৃষ্টির চেয়েও বাতাস বেশি। এমন ঠান্ডা বাতাস
মনে হয় যেন হাড়মাংস সব জমে যাবে। ফিজিক্স বিল্ডিং এ ঢুকে কিছুটা শান্তি। পুরো
বিল্ডিং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, করিডোরের হাওয়াও উষ্ণ। এমন শীতে এর চেয়ে আরাম আর কী
হতে পারে।
অফিসে
ঢুকেই ফোন করলাম ফিলের নাম্বারে। অনেকক্ষণ রিং হবার পর ফোন ধরলো কেউ। ধরেই এমন
দ্রুত কিছু একটা বললো যার একটা শব্দও আমি বুঝতে পারলাম না। অস্ট্রেলিয়ান ইংরেজির
কি কোন আঞ্চলিক সংস্করণ আছে? হয়তো আছে।
“হালিউউউ”- গলার স্বর শুনে বুঝতে পারছি না পুরুষ না মহিলা। ‘হ্যালো’র এমন অদ্ভুত উচ্চারণ আগে শুনিনি কখনো।
“হ্যালো- ক্যান আই স্পিক টু মিস্টার ফিল
প্লিজ”
“হ্যাংঅনাসেক্ আই”- এর পরের শব্দগুলো এতটাই দুর্বোধ্য যে ভয় পেয়ে গেলাম।
একটু পরেই চিৎকার শোনা গেল- “ফিইইইল্
ফিইইইইল্ ইওফোওন”। এত জোরে চিৎকার করে কথা বলে এ
বাড়ির সবাই? জানি না।
“হালোও”
মনে
হয় ফিল্। রুমভাড়ার বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করছি জাতীয় অনেক কথাবার্তা গতকাল অনেকের
সাথে হয়েছে। তাই আজ ফিল্কে একই রকম কথা বলতে সমস্যা হলো না। ফিল্ বললেন রুম এখনো
খালি আছে। চাইলে এখুনি গিয়ে দেখে আসতে পারি। ইউনিভার্সিটি থেকে তার বাসায় কীভাবে
যাবো জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, “টাইকাট্রাম”।
টাইকাট্রাম
শুনে প্রথমে ভেবেছি টাইকা নামের কোন ট্রামের কথা বলেছেন। একটু পরেই বুঝতে পারলাম
ফিল আসলে বলেছেন, “টেইক এ ট্রাম”।
ট্রাম
নিতে হলো না। স্টুডেন্ট ডায়েরির পেছনে পার্কভিল ক্যাম্পাসের আশেপাশের এলাকার একটা
ম্যাপ দেয়া আছে। সেখান থেকে নেইল স্ট্রিট খুঁজে বের করলাম। মনে হচ্ছে খুব একটা
দূরে নয়।
কিন্তু
রাস্তায় নেমে বুঝতে পারলাম ম্যাপে রাস্তা খোঁজা আর ম্যাপ দেখে রাস্তা খুঁজে বের
করা দুটো ভিন্ন জিনিস। কার্লটন এলাকায় অনেকক্ষণ হাঁটার পরেও নেইল স্ট্রিট খুঁজে
পেলাম না। মোড়ে মোড়ে রাস্তার নাম লেখা আছে। বৃষ্টির মধ্যে একহাতে ছাতা ধরে
অন্যহাতে ম্যাপের ওপর রাস্তার নাম মিলিয়ে দেখতে কী যে কষ্ট। তার ওপর একটু পরপর
দমকা বাতাসে হয় ছাতা নয়তো ম্যাপ উল্টে যেতে চায়। সাহস করে কয়েকজনকে জিজ্ঞেসও
করলাম। কিন্তু কেউই জানে না নেইল স্ট্রিট কোথায়।
একটা
বিশাল শ্মশানের চারপাশে ঘুরলাম অনেকক্ষণ। কার্লটন ইউনাইটেড সেমেট্রি। এর আশে পাশে
কোথাও হবে নেইল স্ট্রিট। ম্যাপে তো সেরকমই দেখা যাচ্ছে। লাইগন স্ট্রিট আর
প্রিন্সেস স্ট্রিটের কোণায় বেশ কয়েকটি উঁচু উঁচু বিল্ডিং। মনে হচ্ছে আবাসিক ভবন।
নেইল স্ট্রিট কি এদিকে কোথাও? একটা কিশোরী মেয়েকে দেখলাম হাতে একটা প্লাস্টিকের
ব্যাগ নিয়ে ভিজতে ভিজতে আসছে। দূর থেকে দেখে হঠাৎ পথের পাঁচালির দুর্গার কথা মনে
পড়লো। গায়ের রঙ, মাথার চুল সব একই রকম। কেবল পোশাকটা ছাড়া।
“এক্সকিউজ মি, ডু ইউ নো হোয়ার নেইল স্ট্রিট
ইজ?”- কাছাকাছি আসতেই জিজ্ঞেস করলাম তাকে।
মুখের ওপর লেপ্টে থাকা এক গোছা ভেজা চুল সরাতে সরাতে মেয়েটি বললো, “ইয়েস। কাম উইথ মি”।
“থ্যাংক ইউ” বলে মেয়েটির পিছু নিলাম। কিন্তু মেয়েটি বিশাল বিল্ডিংগুলোর
দিকে এগোচ্ছে। নেইল স্ট্রিট কি এদিকে? দেখা যাক সে কোথায় নিয়ে যায়। আমি ছাতা মাথায়
আর সে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছে। আমার একটু খারাপ লাগছে। কিন্তু তাকে তো আর আমার ছাতাটা
দিয়ে দিতে পারি না, বা বলতে পারি না যে ‘তুমি না ভিজে আমার ছাতায় এসো’।
“হুইচ নাম্বার ইন নেইল স্ট্রিট ইউ গোইং?”
৫৩০
লাইগন স্ট্রিট লেখা বিল্ডিংটার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো মেয়েটা। বললাম, “ওয়ান ফরটি”
“ইউ মিন হান্ড্রেড এন্ড ফরটি? দ্যাট্স হিয়ার”
“হোয়ার?”
“আই শো ইউ। কাম উইথ মি”
বিল্ডিংটার
পেছনে বেরিয়ে এলাম। বেশ বড় খোলা জায়গা এদিকে। সবুজ ঘাসের মাঝে মাঝে বড় বড় গাছ।
বাঁধানো রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে বসার
বেঞ্চ। বাচ্চাদের খেলার জন্য দোলনাসহ নানা রকমের আয়োজন। আরো কয়েকটা বড় বড় বিল্ডিং এদিকে।
“হিয়ার ইজ ইওর বিল্ডিং”- বললো মেয়েটা। দেখলাম সামনের বিশাল বহুতল
ভবনের গায়ে লেখা আছে ১৪০ নেইল স্ট্রিট।
“থ্যাংক ইউ সো মাচ”
“ইট্স ওকে” বলে যেদিক দিয়ে এসেছিলাম- সেদিকে ফিরে চললো মেয়েটি।
এত
বড় বিল্ডিং-এ ১৯ নম্বর ফ্ল্যাট কোন্টি? নিচের তলায় রিসেপশান টাইপের কিছু একটা
থাকার কথা। কিন্তু অনেক হাঁটাহাঁটি করেও সেরকম কিছু চোখে পড়লো না। মাঝামাঝি জায়গায়
পাশাপাশি দুটো লিফ্ট। কয়েকজন আফ্রিকান ছেলেকে দেখলাম উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে লিফ্টে
ঢুকে গেল। বিল্ডিং এর অন্যপাশে গিয়ে একটা দোকান চোখে পড়লো। এরকম বিশাল একটা
বিল্ডিং এর নিচের তলায় এরকম একটা সবকিছুর দোকান থাকাটাই স্বাভাবিক। এরা নিশ্চয়
বলতে পারবে ১৯ নম্বর ফ্ল্যাট কোন্টা। যা ভেবেছিলাম তাই। একজন বয়স্ক চায়নিজ দোকান
চালাচ্ছেন।
“এক্সকিউজ মি, ক্যান ইউ হেল্প মি ফাইন্ডিং
এপার্টমেন্ট নাইন্টিন?”
“হোয়াত? নাইন্তিন? হু- হু”
কান
চুলকাতে চুলকাতে কিছুক্ষণ হু হু করলেন ভদ্রলোক। দোকানে ক্রেতা নেই একজনও। আমিও
কিছু কিনতে আসিনি দেখে মেজাজ খারাপ করছেন কিনা বুঝতে পারছি না। আরো কয়েকবার হু হু
করে বললেন, “তার্ন রাইত, দেন তার্ন লেপ্ত, তেক্
স্তেয়ার তু লেভেল তু”।
মিনিটখানেকও
লাগলো না সিঁড়ি খুঁজে পেতে। এত বড় বিল্ডিং- অথচ সিঁড়িটা কত ছোট। কেমন যেন ময়লা
সিঁড়ি, বিশ্রি একটা গন্ধও আসছে কোথা থেকে। দোতলায় করিডোরের প্রথম এপার্টমেন্টটাই
ঊনিশ নম্বর।
কলিং
বেল খুঁজে পেলাম না কোথাও। দরজায় টোকা দিলাম। অনেকক্ষণ কোন সাড়াশব্দ নেই। ফিল্ তো
বলেছিলেন বাসায় থাকবেন। মনে হচ্ছে মৃদুটোকায় কাজ হবে না। এবার একটু জোরে শব্দ
করতেই দরজা খুলে গেল।
ফিলের
বয়স পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মধ্যে হবে। গড়পড়তা অস্ট্রেলিয়ানদের তুলনায় বেঁটেই বলা
চলে। হালকা পাতলা শরীর। দেখেই মনে হচ্ছে রগচটা টাইপের মানুষ। ঘরভাড়ার ব্যাপারে
একটু আগে আমিই ফোন করেছিলাম শোনার পর বললেন, “কাম ইন। আই শো ইউ দি রুম”।
ভেতরে
দরজার পরেই ছোট্ট কমন স্পেস। সামনে একটা রুমের দরজা খোলা, তার ডানদিকে বেশ বড়
লাউঞ্জরুমের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। আমার ছাতা থেকে কয়েক ফোঁটা পানি পড়লো মেঝের
কার্পেটে। ফিলের দৃষ্টি এড়ালো না সেটা। অনেকটা ঝাঁঝালো স্বরে বললেন, “পুট দি আমব্রেলা আউটসাইড”।
সাধারণত
অস্ট্রেলিয়ানরা অনেক ভদ্রভাবে কথা বলে। ফিল যে কথাটি বললেন, তা অন্য কেউ হলে বলতেন
“কুড ইউ প্লিজ পুট দি আমব্রেলা
আউটসাইড”। ফিলের ভেতর এরকম ভদ্রতার লেশমাত্র
নাই। এমন চাঁছাছোলা মানুষ আমার ভালই লাগে। তাড়াতাড়ি ছাতাটা বাইরে বারান্দায় রেখে
এলাম।
ফিল্
রুম দেখালেন। সামনের যে রুমের দরজা খোলা- সেটাই। প্রায় ১০ ফুট বাই ১২ ফুট সাইজের
রুম। ঝকঝকে পরিষ্কার। ফ্লোরে হাল্কা নীল রঙের কার্পেট। একপাশের দেয়ালে বিরাট
কাচের জানালা। অন্য দেয়াল ঘেঁষে একটা লোহার খাট। বিছানায় ম্যাট্রেস, চাদর, কম্বল
সব আছে। একটা টেবিল আর চেয়ার। দেয়ালের ভেতর একটা বড় ওয়াড্রোব। এর চেয়ে বেশি আর কী
চাই? রুম পছন্দ হয়ে গেল।
ফিল
এবার লাউঞ্জের ভেতর দিয়ে কিচেনে নিয়ে গেলেন। ডেক্চি- পাতিল গ্লাস-প্লেট ফ্রিজ-ওভেন
সব কিছুই আছে। ফিল বললেন, “এর সবকিছুই
ব্যবহার করা যাবে। সপ্তাহে পঞ্চাশ ডলারের মধ্যেই সব। আলাদা কোন বিল দিতে হবে না।
বাথরুম আর টয়লেট অন্যদিকে”। ফিল্কে বললাম, “কাল সকালেই চলে আসবো আমি। তখন দু’সপ্তাহের ভাড়া নগদ দিয়ে দেবো”। ফিল্ রাজী হয়ে গেলেন। জানালেন এই
এপার্টমেন্টে তিনটা বেডরুম। এক রুমে ফ্লপি আর তিনি থাকেন, অন্যরুমে তাঁর ছেলে
থাকে। যে রুমটা খালি ছিল- কাল থেকে সেখানে আমি থাকবো। একটু পরেই তিনি উচ্চস্বরে “ফ্লপি- ফ্লপি” বলে ডাকতে শুরু করলেন। ফ্লপি হয়তো তাঁর
স্ত্রীর নাম। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ডাকছেন। কিন্তু ফ্লপির কোন
সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। এ বাসায় যখন উঠছি- পরিচয় তো হবেই। এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই।
কাল সকালে আসবো বলে বেরিয়ে এলাম।
ফেরার
পথে যেন উড়ে চলে এলাম ডিপার্টমেন্টে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছোট্ট বাঁধানো রাস্তা ধরে
কিছুদূর এগোনোর পর একটা চার্চ। তার পাশ দিয়ে একটু সামনে আসার পরই ফিজিক্স বিল্ডিং
দেখা গেলো। আমার অফিস থেকে এত কাছে এই বাসাটি। খুব বেশি হলে পাঁচ মিনিট হাঁটতে হবে
বাসা থেকে অফিসে যেতে।
অফিসে
এসে আলী সাহেবকে ফোন করলাম। তিনি বাড়িতেই আছেন। বাসার কথা বললাম। খুব খুশি হলেন
আমি বাসা পেয়েছি জেনে। বললেন, “ভেরি গুড,
ভেরি গুড। ভেরি হ্যাপি টু নো দিস। কখন উঠবে বাসায়?”
“কাল সকালে। ন’টার দিকে যাবো বলেছি”
“গুড। সকালে যাওয়াই ভালো। তাতে হোস্টেলে আর
ভাড়া দিতে হবে না। বাট, আই এম সরি প্রদীপ, আই হ্যাভ এ মিটিং ইন দি মর্নিং। নইলে
তোমাকে লিফ্ট দিতে পারতাম”।
আলী
সাহেবের কথা শুনে সংকোচ লাগছিলো খুব। আমার জন্য তিনি ইতোমধ্যেই এত বেশি করেছেন যে
কীভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো বুঝতে পারছি না। বললাম, “কোন অসুবিধা হবে না স্যার। আমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে
যেতে পারবো”।
“কোন অসুবিধে হলে ফোন করো। কেমন? বেস্ট অব
লাক”
বাসা
পাওয়ার খবরটা দিদিদের জানানো দরকার। দিদিভাইকে ফোন করলেই হয়। এখন বাজে সোয়া দুটো-
তার মানে ওখানে সোয়া দশটা। দিদিভাই কলেজে, দিদি অফিসে, মামাম হয়তো বাসায় আছে। ফোন
কার্ড কিনতে যেতে হবে। হঠাৎ মনে হলো সেভেন্টি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট কার্ডটা তো এখনো
আছে। আবার চেষ্টা করে দেখবো নাকি? লোকাল কলের জন্য তো আর সমস্যা নেই।
কয়েকবার
চেষ্টা করেও লাইন পেলাম না। অস্ট্রেলিয়ার অন্য স্টেটে চেষ্টা করা যাক। আনিস ভাইয়ের
ঠিকানা আর ফোন নাম্বার নিয়ে এসেছিলাম। সেভেন্টি পার্সেন্ট কার্ড বেশ ভালো কাজ দিলো
এবার। ডায়াল করতেই লাইন পেয়ে গেলাম। আনিস ভাই থাকেন ব্রিসবেনে। আমি মেলবোর্নে
এসেছি শুনে খুব খুশি হলেন। সময় করে ব্রিসবেনে বেড়াতে যেতে বললেন।
খুব
ভালো লাগলো আনিস ভাইয়ের সাথে কথা বলে। তিনি উদয়দার সহকর্মী ছিলেন বাংলাদেশে।
ইমিগ্রেশান ভিসা নিয়ে চলে এসেছেন এ দেশে কয়েক বছর আগে। গতবছর তিনি যখন দেশে
গিয়েছিলেন উদয়দার সাথে গিয়েছিলাম তাঁদের আগ্রাবাদের বাসায়। অস্ট্রেলিয়ার জীবনযাপন
সম্পর্কে অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি।
এরপর
সিডনিতে স্বপনদাকে ফোন করলাম। তিনি ছিলেন দিদির সহকর্মী। নীলিমা বৌদি আর স্বপনদা
সিডনিতে চলে এসেছেন কয়েক বছর হলো। দিদি বলেছিলো এখানে এসেই যেন স্বপনদাকে ফোন করি।
ফোন ধরেই স্বপনদা একটা সস্নেহ ঝাড়ি দিলেন- “এতদিন পরে মনে হলো ফোন করার কথা? দিদি ফোন করে তোমার কথা
বলেছে বারোদিন আগে। আমি মেলবোর্নে অনেককে ফোন করেছি এর মধ্যে। কেউই জানে না তুমি
কোথায় আছ। কোত্থেকে ফোন করছো এখন?”
“ইউনিভার্সিটির অফিস থেকে। ফোন কার্ড দিয়ে
করছি”
“অফিসের ফোন নাম্বারটা দাও”
“৯৩৪৪৫০৯৪”
“ভিক্টোরিয়ার কোড হলো জিরো থ্রি- ও-কে। তুমি
ফোন রাখো। আমি করছি-”
লাইন
কেটে গেলো। রিসিভার রাখতে না রাখতেই স্বপনদা ফোন করলেন। তারপর বেশ কিছুক্ষণ কথা
হলো। মনাশ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডক্টর পালিতের ফোন নাম্বার দিয়ে বললেন যেন
যোগাযোগ করি। একটু গুছিয়ে নিয়েই যেন সিডনি বেড়াতে যাই।
দেখেছো
প্রবাসে বাঙালীরা কত আন্তরিক। সবাই হাত বাড়িয়ে আছেন সাহায্য করার জন্য। কেবল মুখ
ফুটে বলতে পারলেই হলো। কিন্তু মুখ ফুটে বলাটাই তো মুশকিল।
স্বপনদার
কথামত ডক্টর পালিতের নম্বরে ফোন করলাম। যান্ত্রিক কন্ঠ জানালো, “দিস কল্ ক্যান নট বি কানেক্টেড। প্লিজ
ট্রাই এগেন লেইটার। দিস হ্যাজ বিন এ ফ্রি কল”। আরো দু’বার চেষ্টা
করলাম। প্রতিবারই একই ব্যাপার। নিশ্চয় কোন সমস্যা আছে নম্বরে। তবে কি আমি নম্বর
ভুল লিখলাম? হতে পারে। ডক্টর পালিতকে পরে ফোন করলেও চলবে।
এরপর
মনে হলো অজিতকে একটা ইমেইল করে জানিয়ে দিই আমার নতুন বাসার কথা। হাতের কাছেই তো
আছে কম্পিউটার- হিগ্স যার নাম। লগ অন করে আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা। যে ধরণের কম্পিউটারের
সাথে আমার সামান্য পরিচয় আছে- এই কম্পিউটারের আচার আচরণের সাথে তার কোন মিল নেই।
এই কম্পিউটারের ভাষা আমার জানা নেই। এটার অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ নয়। আসার সময় “সহজ ই-মেইল পদ্ধতি” নামে একটা বই কিনে এনেছিলাম। বইটার পুরো পদ্ধতি
উইন্ডোজ-এর ভিত্তিতে লেখা। কাল পিটারের কাছ থেকে শিখে নিতে হবে ইমেইল করার পদ্ধতি।
আমি যে কম্পিউটার-অশিক্ষিত তা জেনে পিটার হাসবে হয়তো। হাসুক- তাতে কী। লজ্জা করলে
তো শিখতেই পারবো না কিছু।
অনেকক্ষণ
ধরে অন্ধের মত এটা ওটা নেড়ে কিছু করতে না পেরে কম্পিউটার অফ করে দিলাম। কাল সকাল
সকাল হোস্টেল ছাড়তে হবে। ব্যাগটা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলাম। প্রায় ছুটতে ছুটতে ফিরে
এলাম হোস্টেলে।
তালা
খুলে রুমে ঢুকেই চমকে উঠলাম রুমের ভেতর মোমের আলো দেখে। কী যে ভালো লাগলো হঠাৎ।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো লোডশেডিং চলছে। সাত তারিখ রাতে ঢাকার হোটেলে এরকম
মোমের আলোয় বসে গল্প করেছিলাম আমরা সবাই। তারপর মাত্র বারো দিন কেটেছে, অথচ মনে
হচ্ছে বারো বছর।
কিন্তু
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কেটে গেলো মোমের আলোর ভালো লাগা। আলোর উৎসের দিকে চোখ গেলো।
মোমবাতি ঠিকই- কিন্তু অন্যরকম। ছোট্ট একটা এলুমিনিয়ামের কৌটোতে মোমের সলতে জ্বলছে।
হঠাৎ একটা হাড্ডিসার হাত আলোর দিকে এগিয়ে আসতেই একটা ঠান্ডা ভয়ের স্রোত বয়ে গেল
আমার সারা শরীরে। লিকলিকে একটা তরুণ ঘরের কোণায় বসে আছে। মোমের শিখার দিকে হাত
বাড়িয়ে এলুমিনিয়াম ফয়েলে কিছু একটা গরম করছে। ধবধবে সাদা শরীরের সবগুলো হাড় মনে হয়
গোনা যাবে। গায়ে বিদ্ঘুটে একটা টি-শার্ট ছাড়া আর কিছুই নেই। দুই কানের লতি ছিদ্র
করে বড় বড় দুটো রিং ঢুকিয়ে রেখেছে। হাতের কব্জি থেকে বাহু পর্যন্ত নানারকমের
উল্কিতে ভর্তি। চুলের অবস্থা আরো ভয়ংকর। মাথার দু’পাশ কামানো- শুধু মাঝখানের চুলগুলো আছে- এবং কোন এক
অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় সেগুলো মোরগের ঝুঁটির মত খাড়া হয়ে আছে।
এরকম
একটা মূর্তিমান বিপদের হাতে সেদিন পড়েছিলাম রাসেল স্ট্রিটে। আজ দেখি একেবারে রুমের
ভেতর! আমাকে দেখে মেঝেতে ছড়ানো পা-দুটো সামান্য সরিয়ে জড়ানো গলায় বললো- “হাই দেয়ার”। আমি কোন রকমে “হ্যালো” বলতে বলতে
দেখলাম তার গর্তে ঢোকা চোখ দুটো মোমের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। একটু পরেই এলুমিনিয়াম
ফয়েল নাকের কাছে এনে চোখ বুজে জোরে দম নিলো। ড্রাগ নিচ্ছে ছেলেটা! এরকম একটা
মাদকাসক্ত লোকের সাথে এক রুমে থাকতে হবে আজ!
ভয়ে
হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাবার অবস্থা। কিন্তু করার কিছু নেই। হোস্টেলের ভেতরে ধূমপান
নিষিদ্ধ অথচ রুমে বসে ড্রাগ নিচ্ছে এই লোক। হোস্টেল কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় জানে না ব্যাপারটা।
জানার উপায়ও নেই। ধূমপান করলে স্মোক এলার্ম বাজবে- কিন্তু ড্রাগের ক্ষেত্রে সেরকম
কিছু নেই। আমার এখন কী করা উচিত? যারা ড্রাগ নেয় তারা বেশির ভাগ সময় দলবেঁধে থাকে।
এই ছেলেটার দলবলও কি আছে আশেপাশে? এ কী বিপদে পড়লাম!
বিছানার
ওপর ব্যাগটা রেখে রুমের বাইরে চলে এলাম। নিচের রিসেপশান বন্ধ হয়ে গেছে। রান্নাঘরের
ফ্রিজে ছয়টা ডিম রেখেছিলাম কাল। প্যাকেট খুলে দেখি মাত্র একটা আছে। প্যাকেটের গায়ে
নাম লিখে রেখেছিলাম- তারপরও পাঁচটা ডিম উধাও হয়ে গেছে। ‘পরদ্রব্যেষু আত্মবৎ’ ভাবার লোক এদেশেও আছে দেখছি। ডিমটা সিদ্ধ করে লাউঞ্জে
বসে খেলাম।
রোববারের
রাত- একেবারে সুনশান। লাউঞ্জেও কাউকে দেখছি না। রুমের ছেলেটা এতক্ষণে নিশ্চয় অচেতন
হয়ে গেছে। ড্রাগ নিয়ে এতক্ষণ জেগে থাকার শক্তি থাকবে না হয়তো। আবার উল্টোটাও হতে
পারে। লাউঞ্জের হিটিং সিস্টেম কাজ করলে এখানে শুয়েই রাতটা কাটিয়ে দেয়া যেতো।
কিন্তু যা ঠান্ডা- জমে বরফ হয়ে যাবো এখানে বেশিক্ষণ থাকলে। প্রায় নিঃশব্দে রুমের
দরজা খুললাম। ভেতরে অন্ধকার দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। ড্রাগ-পর্ব শেষ হয়েছে আশা
করি।
লাইট
জ্বালালাম। ছেলেটা বিছানায় নেই। ঘরের কোণে চোখ গেল। ওখানেই পড়ে আছে সে। মোম শেষ
হয়ে বাতিটা নিভে গেছে। তখন আবছা আলো-আঁধারে যতটা ভয়ংকর লাগছিলো- এখন আর সেরকম মনে
হচ্ছে না। বরং খুব অসহায় দেখাচ্ছে তাকে। মাদকের বিষে জর্জরিত এই তরুণ ক্রমাগত
আত্মহত্যা করছে দিনের পর দিন। কেন এমন করে এরা? এদেশে এদের কীসের অভাব?
“সরি ম্যান- আই ওয়াজ সো টায়ার্ড” বলতে বলতে হঠাৎ উঠে বসলো ছেলেটা। “আই এম ওয়াইন”।
ওয়াইন!
ড্রাগ যার নেশা- নাম তার ওয়াইন হতেই পারে। নিজের বিছানায় শুতে শুতে বিড়বিড় করে যা
বললো তার যেটুকু বুঝতে পেরেছি তা বাংলায় বললে এরকম শোনাবে- “তোমার সাথে হাত মেলাতে পারছি না। দেখতেই
পাচ্ছো আমার হাতে ব্যান্ডেজ। রুমের লাইট-টা নিভিয়ে দাও। চোখে আলো পড়লে আমি ঘুমোতে
পারি না। আমি ঘুমোতে চাই, অনেক ঘুম, অনেক ঘুম, অনেক ঘুম”।
তার
ডান হাতে মোটা ব্যান্ডেজ দেখতে পাচ্ছি। কেটে গেছে বা পুড়ে গেছে। বেচারা- নেশার কাছে
পরাস্ত পর্যুদস্ত শক্তিহীন। তাড়াতাড়ি লাইট নিভিয়ে দিলাম। লাইটের কারণে যদি ঘুমাতে
না পারে- বলা যায় না আবার কোন্ ঝামেলা শুরু করে।
সে
এখন ঘুমোচ্ছে। নেশা কেটে গেলেই হয়তো জেগে উঠবে। কী যে অস্বস্তি লাগছে আমার। শরীরটাও
ভাল যাচ্ছে না। গায়ের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে বেশ কয়েক ডিগ্রি। কিন্তু তাকে প্রশ্রয়
দিয়ে শুয়ে শুয়ে আরাম করার সুযোগ নেই। “ইউ কান্ট এফোর্ড টু বি সিক্ ইন এ ফরেন কান্ট্রি” কথাটা কার কাছে শুনেছিলাম ঠিক মনে নেই- তবে বুঝতে পারছি
বড় কঠিন সত্যি।
ভেবেছিলাম
হোস্টেলে ফিরে গোছগাছ করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বো। কী ভাবলাম আর কী হলো। তাড়াতাড়ি
ঘুমানো তো দূরের কথা আদৌ ঘুমাতে পারি কি না জানি না। গোছগাছ যে করবো তারও উপায়
নেই। লাইট জ্বালালেই ওয়াইন জেগে উঠবে। মাদকাসক্তদের বিশ্বাস নেই। নেশার ঘোরে যা
কিছু করে বসতে পারে।
আচ্ছা,
একটা কাজ করলে কেমন হয়? চুপি চুপি অফিসে চলে যাবো নাকি? অফিসের ফ্লোরে শুয়ে একটা
রাত আরামে কাটিয়ে দেয়া যায়। সকালে উঠে চলে এলেই হলো। কিন্তু বাইরে যেরকম ঝড়-বৃষ্টি
হচ্ছে আর শরীরের তাপমাত্রাও যেভাবে বাড়ছে- ঠিক সাহস পাচ্ছি না বাইরে যেতে।
দাঁড়াও,
দরজায় কে যেন শব্দ করছে। মনে হচ্ছে আমার নাম ধরে ডাকছে কেউ। আলী সাহেব এলেন নাকি?
চার-পাঁচ ঘন্টা পর
কী যে ঝামেলায় পড়েছিলাম তুমি ভাবতেও
পারবে না। হোস্টেলের শেষ রাতেই কেন যে এত ঘটনা ঘটছে বুঝতে পারছি না। তখন দরজার
বাইরে থেকে আমার নাম ধরে ডাকতে শুনে সেই যে বেরোলাম- চার-পাঁচ ঘন্টা পরে রুমে
ঢুকতে পারলাম। তাও কত যন্ত্রণার পর।
দরজার
বাইরে “ডেব, ডেব, সামওয়ান ইজ লুকিং ফর ইউ”- শুনে বেরিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো আলী
সাহেব এসেছেন। দ্রুত দরজা খুলে দেখি একজন মোটাসোটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই
বললো- “আর ইউ ডেব? এ গাই ইজ ওয়েটিং
ডাউনস্টেয়ার্স ফর ইউ” বলেই করিডোরের অন্যদিকে রওনা দিলো সে।
“থ্যাংক ইউ” বলে আমি প্রায় দৌড় দিলাম সিঁড়ির দিকে। নিচে
নেমে সোজা লাউঞ্জরুমে ঢুকলাম। কেউ নেই। ফিরে আসার সময় হোস্টেলের মূল দরজায় শব্দ
শুনে তাকিয়ে দেখি বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ একজন হাত দেখাচ্ছেন আমাকে। হঠাৎ দেখে চিনতে
পারলাম না তাকে। কাছে গিয়ে বেশ আশ্চর্য হলাম- ভিনু! তাড়াতাড়ি দেয়ালে লাগানো বোতামে
চাপ দিতেই দরজা খুলে গেলো।
“ইট্স ফ্রিজিং কোল্ড ম্যান” বলতে বলতে ভেতরে ঢুকলো ভিনু। মনে পড়লো
ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট হাউজের প্রোগ্রামে গিয়ে ভিনুকে এই হোস্টেলে থাকার কথা
বলেছিলাম। ইন্টারন্যাশনাল পোস্টগ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট ইউনিয়নের ভিপি ঠিকানা মনে রেখে
রাত পৌনে দশটায় আমার সাথে দেখা করতে এসেছে- এর চেয়ে আশ্চর্যজনক আর কী হতে পারে। আমি
কীভাবে ভিনুকে আপ্যায়ন করবো বুঝতে পারছি না।
“সো দিস ইজ ইওর হোস্টেল। নট ব্যাড” বলতে বলতে লাউঞ্জ রুমে এসে বসলো ভিনু। আমি
বসলাম তার মুখোমুখি। কালো পুরু চামড়ার জ্যাকেট পরে আছে সে। বাম হাতটা যথারীতি
জ্যাকেটের পকেটে।
“সো ইউ আর ফ্রম বাংলাদেশ। ঢাকা?”
“নো, চিটাগং। হ্যাভ ইউ বীন টু বাংলাদেশ?”
“নো, আই গট এ ফ্রেন্ড ফ্রম ঢাকা”
“হুইচ স্টেট ইউ ফ্রম ইন ইন্ডিয়া?”
“কেরালা, ইট্স ইন দি সাউথ”
তারপর
টুকটাক নানা বিষয়ে কথা হলো। আমি বাসা পেয়ে গেছি শুনে বেশ অবাক হলো ভিনু।
ইউনিভার্সিটির এত কাছে এত কম ভাড়ায়। বললো, “আনবিলিভেবল! দেয়ার মাস্ট বি সামথিং রং ইন দ্যাট হাউজ। বি
কেয়ারফুল”।
আমার
খুব একটা ভালো লাগলো না তার কথা শুনে। সে হয়তো তার অভিজ্ঞতা থেকে বলছে। কিন্তু
সবকিছুতেই নৈরাশ্যবাদীতা পছন্দ নয় আমার। একটু পরেই অবশ্য বুঝতে পারলাম ভিনুর
নৈরাশ্যবাদীতার কারণ। সে একটা বাড়ি ভাড়া নেবার প্ল্যান করছে। তার স্ত্রী আসবে
আগামী মাসে। দুই বেডরুমের একটা বাড়ি নিলে সেখান থেকে একটা রুম আমি নিতে পারি। সে
আর আমি দু’জনে মিলে দরখাস্ত করলে বাড়ি পেয়ে
যাবো। আমার যেহেতু স্কলারশিপ আছে বাড়ি পেতে অসুবিধা হবে না।
হায়রে
ভিনু। আমার স্কলারশিপকে যে রিয়েল এস্টেট থোড়াই কেয়ার করে তার প্রমাণ তো পেয়ে গেছি
গতকাল। ভিনুকে এসব বলার কোন মানে হয় না। আমি শুধু একটু হাসলাম। ভিনু বুঝে গেল যে
আমার ইচ্ছে নেই তার সাথে শেয়ারে বাড়ি ভাড়া করার। একটু অবাক হলাম এই ভেবে যে এত
ইন্ডিয়ান ছেলে-মেয়ে থাকতে ভিনু আমার কথা ভাবলো কেন।
একটু
পরেই “ইট্স গেটিং লেট” বলে উঠে দাঁড়ালো ভিনু। তাকে এগিয়ে দেয়ার
জন্য রাস্তা পর্যন্ত গেলাম। বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু তাপমাত্রা মনে হচ্ছে শূন্যের
কাছাকাছি চলে গেছে। গেটে একটা ট্যাক্সি দাঁড়ানো-হোয়াইট ক্যাব। ভিনু পকেট থেকে চাবি
বের করে ট্যাক্সির দরজা খুললো। হঠাৎ মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল আমার। ভিনু ট্যাক্সি
চালায় সে কারণে নয়। ট্যাক্সিতে ওঠার সময় জ্যাকেটের পকেট থেকে ভিনুর বাম হাতটা বের
হয়েছে। ওটাতে একটা আঙুলও নেই। তুমি বিশ্বাস করো- আমার হঠাৎ মনে হলো ভিনু যত
সংগ্রাম করছে তার একাংশও করতে হচ্ছে না আমাকে। বাসা কেমন হবে, কাজ পাবো কি না
ইত্যাদি বিষয়কে এখন তুচ্ছ মনে হচ্ছে।
ভিনুর
ট্যাক্সি অদৃশ্য হয়ে যাবার সাথে সাথে দ্রুত ফিরে এলাম। স্বয়ংক্রিয় দরজা বন্ধ হয়ে
গেছে। কোড নাম্বারের জন্য পকেটে হাত দিয়ে বুঝতে পারলাম বিরাট ভুল করে ফেলেছি। না,
কোড নাম্বার আছে পকেটে, কিন্তু রুমের চাবি নেই। ওটা রুমেই ফেলে এসেছি। রুমের দরজা
অটোম্যাটিক লক হয়ে যায়। ওয়াইন ড্রাগ নিয়ে ঘুমোচ্ছে, দরজা ভেঙে ফেললেও সে জাগবে না।
কী
যে করি! সারা হোস্টেল নিস্তব্ধ, কোথাও কেউ নেই। থাকলেও কী লাভ। তাদের চাবি দিয়ে তো
আর আমার রুমের দরজা খুলবে না। রুমের দরজার হাতল ধরে অনেক টানাটানি করলাম- কোন লাভ
হলো না। সাড়া পাবো না জেনেও ওয়াইনকে ডাকলাম কয়েকবার। এমনিতেই ঠান্ডা- তার ওপর
হতাশায় হাত-পা জমে যাবার অবস্থা। রিসেপশান কাউন্টারের সামনে কিছুক্ষণ ঘুরঘুর
করলাম- যদি কোন ক্লু পাওয়া যায়। একটা ফোন-নম্বর আছে সেখানে জরুরি প্রয়োজনে করার
জন্য। কিন্তু একটা কয়েনও সাথে নেই, ফোন করবো কীভাবে। কাল সকাল সাতটা পর্যন্ত এই
ঠান্ডায় বসে থাকতে হবে?
লাউঞ্জের
টিভি অন করে কিছুক্ষণ দেখার চেষ্টা করলাম। কী একটা সিনেমা চলছে। কিন্তু মন দিতে
পারলাম না। কী যে ঠান্ডা! ভিনুর কথা চিন্তা করে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা
করলাম। ভিনু এই শীতের রাতে ট্যাক্সি চালাচ্ছে, আক্ষরিক অর্থেই এক হাতে সামলাচ্ছে
সব রকম ঝামেলা। আর আমি রুমে ঢুকতে পারছি না বলে হতাশ হয়ে যাচ্ছি! কিন্তু এরকম
সান্ত্বনা কয়েক সেকেন্ডের বেশি স্থায়ী হলো না। শরীর এত কাহিল হয়ে পড়েছে যে ইচ্ছে
করছিলো রুমের বাইরে কার্পেটের ওপর শুয়ে থাকি। কোন কারণে বাথরুমে যাবার জন্য হলেও
যদি ওয়াইন বের হয়। দরজায় হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ বসেও থাকলাম। কিন্তু যা ঠান্ডা।
শীতকালে আমাদের দেশে কত মানুষকে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ফুটপাতে খোলাবাতাসে রাত
কাটাতে হয়। এরকম দার্শনিকতাও খুব একটা কাজ দিলো না। হঠাৎ একটা বুদ্ধি এলো মাথায়।
কিচেনে গিয়ে পেছনের সারির সবগুলো ওভেন জ্বালিয়ে দিলাম। লাউঞ্জ থেকে ঠেলে ঠেলে একটা
ছোট সোফা নিয়ে গেলাম সেখানে। একটু পরেই গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ
ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ গায়ে কারো ধাক্কা লেগে ঘুম ভাঙলো। ধড়পড় করে উঠে দেখি একজন
আধবুড়ো লোক দাঁড়িয়ে আছেন সোফার কাছে।
“হোয়াই ইউ স্লিপিং হিয়ার?”
বললাম
আমার চাবি রুমের ভেতর রয়ে গেছে। লোকটি জিজ্ঞেস করলো- কোন্ রুম? আমি রুম নম্বর
বললাম। দেখলাম একই রকম হলুদ জ্যাকেট পরা আরো কয়েকজন মানুষ রান্নাঘর পরিষ্কার করছে।
এরা নিশ্চয় ক্লিনার। চুলা মনে হয় তারাই বন্ধ করে দিয়েছে। আর ঘুমানো সম্ভব না
এখানে। সোফাটা ঠেলে ঠেলে আবার লাউঞ্জে নিয়ে এলাম। সেখানে একটা ইলেকট্রিক মেশিনে
কার্পেট পরিষ্কার করছে একজন যুবক। আমার সাথে যিনি কথা বলেছিলেন তিনি এসে কিছু একটা
বলতেই মেশিন থেমে গেল। আধবুড়ো লোকটি যুবকটিকে কিছু বললেন আমাকে দেখিয়ে। কী ভাষায়
তারা কথা বলছে বুঝতে পারলাম না। দু’জনই
শ্বেতাঙ্গ। ইউরোপের কোন দেশ থেকে এসেছেন হয়তো।
মেশিন-ওয়ালা প্যান্টের পকেট থেকে এক গোছা চাবি বের করে আধবুড়ো লোকটার হাতে
দিলেন। লোকটা এবার আমাকে বললেন “লেট মি ওপেন
ইওর ডোর”
ক্লিনারদের
হাতে যে রুমের চাবি থাকে জানতাম না। বললাম, “ইউ হ্যাভ গট দি কি”
“উই হ্যাভ মাস্টার কি”- রুমের দরজা খুলে গেল।
“থ্যাংক ইউ সো মাচ”
“মাই প্লেজার”
রাত
আর কত বাকি জানি না। ওয়াইন এখনো গভীর ঘুমে অচেতন। তার নিঃশ্বাসের শব্দ ভারী থাকতে
থাকতেই একটু ঘুমিয়ে নেয়া যাক- এ হোস্টেলে আমার শেষ ঘুম।
No comments:
Post a Comment