২১ জুলাই ১৯৯৮ মঙ্গলবার
উইলির ফ্ল্যাট
তোমাকে লিখতে বসে জানালার বাইরে চোখ
গেলো। সামনের পাঁচতলা ভবনের কয়েকটা ঘরের আলো এখনো নিভেনি। আমার সোজাসুজি ঘরটার জানালার
স্বচ্ছ পর্দা ভেদ করে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে ঘরের ভেতর। কারো শোবার ঘর- ভেতরের প্রায়
সবকিছুই দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। সামনের প্রশস্ত মাঠের ডানপাশে পাতাঝরে যাওয়া কিছু
গাছের কংকাল বৃষ্টিতে ভিজছে। ল্যাম্পপোস্টের ঝাপসা আলোতে গাছ-কংকালের ছায়া দেখে ‘মায়ার খেলা’র একটা গান মনে পড়লোঃ “যেন শরতের মেঘখানি ভেসে, চাঁদের সভাতে দাঁড়ায়েছে এসে,
এখনি মিলাবে ম্লান হাসি হেসে- কাঁদিয়া পড়িবে ঝরি”।
চাঁদের
সভায় শরতের মেঘ! কেন মনে হলো জানি না। তোমার ওখানে বর্ষা আর আমার এখানে শীত, শরৎ
কাল তো নেই কোথাও। আর চাঁদ? পূর্ণিমা গেছে দু’সপ্তাহ আগে, চাঁদের দেখা পাওয়া যাবে না এখন। কিন্তু তাতে
কী? আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই তো চাঁদ আছে,
ঘুরছে যার যার গ্রহের চার পাশে।
মানুষ
প্রথম চাঁদে নেমেছিল কখন মনে আছে? উনত্রিশ বছর আগে ঠিক আজকের দিনে। ১৯৬৯ এর ২০
জুলাই নাকি ২১ জুলাই- তা নিয়ে একটু ঝামেলায় পড়তে হয় মাঝে মাঝে। ইউনিভার্সিটি থেকে
ফেরার পথে ‘ইউনি-নিউজ’ নামে যে ফ্রি পেপারটা নিয়ে এসেছি তাতে মানুষের চাঁদে
নামার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে একটা বড় প্রতিবেদন আছে। এপোলো-১১ যখন চাঁদে নেমেছিল তখন
গ্রিনিচ মান সময় ২০ জুলাই রাত আটটা ১৭ মিনিট চল্লিশ সেকেন্ড। বাংলাদেশ গ্রিনিচ সময়
থেকে ছয় ঘন্টা এগিয়ে, আর অস্ট্রেলিয়া দশ ঘন্টা। সে হিসেবে আমাদের জন্য চাঁদে নামার
তারিখ হয় ২১ জুলাই।
সময়
নিয়ে এরকম সমস্যায় আগে পড়িনি। ভিন্ন টাইম-জোনে থাকে এমন কারো সাথে তো কথা বলার
দরকার হয়নি আগে। এখন দেখো কীভাবে আমি একই সাথে দুটো সময়ের জগতে থাকছি। আজ তাই একটা
টেবিল ঘড়ি কিনে নিয়ে এলাম। দু’ডলারের
চায়নিজ ঘড়ি। ওটাতে এখন তোমার সময়। মাত্র ছ’টা বাজে। অথচ এ বাসা নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।
দোকানে
একটা কম্পাস দেখে খুব পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু দামটা নাগালের বাইরে থাকায় হঠাৎ বোধোদয়
হলো- কম্পাস দেখে দিক নির্ণয়ের তো দরকার নেই আমার। সকাল হবার আগেই সূর্য এসে ঊঁকি
দেয় জানালায়। ওটাতো পূর্বদিক থেকেই আসে, তাই না?
আজ
সকালে চোখে রোদের আলো পড়তেই উঠে পড়েছি। তাতে বেশ লাভ হয়েছে। ফিল, ডেভিড, বা ফ্লপি
ওঠার আগেই টয়লেট বাথরুম সেরে ফেলেছি। ছিটকিনিবিহীন টয়লেটে বসে সারাক্ষণই মনে
হয়েছে এই বুঝি কেউ ঢুকে গেলো। তাছাড়া ভেতরের নগ্ন পোস্টারগুলোতো আছেই। এরা
পিতাপুত্র এই ছবিগুলো দেখতে দেখতে টয়লেট ব্যবহার করে। এটা কি সংস্কৃতির প্রশ্ন,
নাকি রুচির প্রশ্ন? আমার কি এ ব্যাপারে কিছু বলা উচিত? বুঝতে পারছি না। কোন একটা
চলমান ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে পায়ের নিচে একটা শক্ত ভিত্তি লাগে। আমার
অবস্থাতো এখনো নড়বড়ে।
আটটার
আগেই অফিসে পৌঁছে গেলাম। কেনের অফিস খোলা দেখে ভীষণ অবাক হলাম। এত সকালে তিনি
অফিসে চলে আসেন! কড়া কফির গন্ধ আসছে তাঁর ডেস্কের পাশে রাখা কফি মেশিন থেকে।
“গুড মর্নিং কেন্”
“গুড মর্নিং প্রাডিব। ইউ আর সো আর্লি টুডে”
কেন্
যে কী হাসিখুশি মানুষ তুমি না দেখলে বুঝতে পারবে না। কয়েক মিনিট কথা হলো অফিসের
সামনে দাঁড়িয়ে।
“নতুন বাসা কেমন?”
“এই তো খুব কাছে। মাত্র কয়েক মিনিট লাগে।”
“ভেরি গুড। আমার কতক্ষণ লাগে জানো? তিরিশ
থেকে চল্লিশ মিনিট ড্রাইভ। এখান থেকে তিরিশ কিলোমিটার”
এত
দূর থেকে প্রতিদিন এত সকালে চলে আসেন? উঠেন ক’টায়? মনে পড়লো ক’দিন আগেও তো আমি কাকভোরে উঠে কলেজে যাবার বাস ধরতাম। কেনের
কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে ভাবছি সকালে ওঠার অভ্যাসটা আবার চালু করতে হবে।
দরজা
বন্ধ করে ডেস্কে বসে কিছুক্ষণ লেখাপড়া করার চেষ্টা করলাম। কেন্ আর পিটারের কিছু
পেপার আর স্ক্যাটারিং থিওরির কিছু বেসিক জিনিস। কিন্তু এই বেসিক জিনিস আয়ত্ব করতেই
জান বেরিয়ে যাবার জোগাড়। কতক্ষণ কাটলো জানি না, হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠলাম।
ব্যস্ত
পায়ে রুমে ঢুকলো টকটকে লাল জ্যাকেট পরা লম্বা পাতলা একজন মানুষ। আমার পাশের ডেস্কে
ব্যাকপ্যাকটা রাখতে রাখতে আমার দিকে পূর্ণচোখে তাকালো। এরকম সুন্দর মুখ অনেকদিন
দেখিনি। নীল চোখ, প্রশস্ত কপাল, লম্বাটে মুখ, কাঁধ সমান লম্বা লাল চুল। আমি মনে হয়
স্বাভাবিকের চেয়েও একটু বেশি সময় ধরে তাকিয়েছিলাম তার দিকে।
হাসিমুখে
হাত বাড়িয়ে দিলো সে। কী সুন্দর ঝকঝকে দাঁত, মিষ্টি হাসি। এতক্ষণ ধরে নিউক্লিয়ার
স্ক্যাটারিং-এর যেটুকু পড়েছিলাম সব ভুলে গেলাম তার দিকে তাকিয়ে।
“হাই, ইট্স ম্যান্ডি”
ম্যান্ডি! এই কি তবে কেনের ছাত্রী ম্যান্ডি
মানে এমেন্ডা ল্যাভেল?
“হাই, আই এম প্রদীপ”
ম্যান্ডির
হাতটা বেশ শক্ত। চোখ বন্ধ করে ধরলে মেয়েদের হাত বলে মনেই হবে না।
“হ্যাভ ইউ কাম টু ডাই?”
কাম
টু ডাই!! মানে মরতে এসেছি? সেন্স অব হিউমার তো বেশ ভালো! কিছু না বলে মৃদু হাসলাম।
ম্যান্ডি
বেশ চটপটে মেয়ে। কেনের কাছে পিএইচডি শুরু করেছে আড়াই বছর আগে। তার মানে আর এক
বছরের মধ্যে তার পিএইচডি কমপ্লিট হয়ে যাবার কথা। এই ডিপার্টমেন্ট থেকেই সে অনার্স
করেছে।
ঝড়ের
বেগে কথা বলে ম্যান্ডি। তার অস্ট্রেলিয়ান উচ্চারণ বুঝতে আমার ক’বছর লাগবে কে জানে। একটু পরেই বেরিয়ে গেল
সে।
দশটার
দিকে গেলাম কলিনের সাথে দেখা করতে। কাল ইমেইলে এপয়েন্টমেন্ট করে রেখেছিলাম। হয়তো
সে কারণেই আজ দেখলাম তিনতলার ফার্স্ট ইয়ার ল্যাবোরেটরির দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকলাম।
সারি সারি যন্ত্রপাতি আর ওয়ার্কিং ডেস্ক- সমৃদ্ধ পরীক্ষাগার। বিশ্বের প্রথম সারির
একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স ল্যাবের সাথে আমার বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটিতে দেখা
ল্যাবের পার্থক্যতো থাকবেই। এই ল্যাবে আমি পড়াবো ভাবতেই একটু ভয় ভয় লাগছে। ঠিকমত
পারবো তো?
কলিনের
অফিস ল্যাবের পেছনে একটা ছোট্ট ঘরে। টকটকে হলুদ রঙের দরজায় তার নাম লেখাঃ কলিন
এন্টউইজল।
দরজায়
নক করার পর ভেতর থেকে ফ্যাসফ্যাসে গলায় কেউ একজন কিছু একটা বললো। কিন্তু আমি কিছুই
বুঝতে পারলাম না। একটু পরে দরজা খুললেন একজন খর্বাকৃতি মানুষ। গায়ের রঙ সাদা,
চুলের রং লাল, মুখে খোঁচা খোঁচা লাল দাড়ি, গলার স্বর অনেকটা হাঁসের মত
ফ্যাসফ্যাসে।
“হাই, প্রাডিব?”
“ইয়েস”
কলিনের
কথা বোঝা দুঃসাধ্য। কথার বেশিরভাগই মুখের ভেতর থেকে যায়। পাঁচ মিনিটের কথোপকথনে
আমি কতবার যে ‘পার্ডন মি’ ‘পার্ডন মি’ বলেছি। এরপরও যে কলিন আমাকে সপ্তাহে একটা
করে ডেমোনেস্ট্রেশান ক্লাস দিয়েছেন সেটাই আশ্চর্যের। বেশ কিছু ফরম আর কাগজপত্র
ধরিয়ে দিলেন। ডিপার্টমেন্টে কাজ করার ফর্মালিটি।
ডেস্কে
এসে ফরমগুলো ফিল-আপ করলাম। ক্যাজুয়েল স্টাফ হিসেবে নিয়োগ ফর্ম, রেজিস্ট্রেশান
ফর্ম, ট্যাক্স ফর্ম, ব্যাংক-ফর্ম। সব ফিল-আপ করে আবার কলিনের অফিসে গিয়ে তার হাতে
হাতে দিয়ে এলাম। কলিন এবার একটা ল্যাব-ম্যানুয়েল ধরিয়ে দিলেন। ফ্যাস-ফ্যাস করে যা
বললেন সেখান থেকে এটুকু বুঝতে পারলাম যে নিক্ নামের কেউ একজন আমাকে বুঝিয়ে দেবেন
ল্যাবের কাজ-কর্ম। নিক্ সম্পর্কে কলিনকে কিছু জিজ্ঞেস করার কোন মানে হয় না। কারণ
তাঁর কথা আমি বুঝতে পারি না। আমার কথাও হয়তো তিনি পুরোটা বুঝতে পারবেন না। জানি না
স্টুডেন্টদের কীভাবে বোঝাবো।
দুপুর
বারোটার পর থেকেই এখানে লাঞ্চ টাইম শুরু হয়ে যায়। কেন্কে দেখলাম হাতে একটা মদের
বোতল নিয়ে লম্বা গরমকোট পরে বেরিয়ে যাচ্ছেন। পিটার কম্পিউটারের সামনে বসে তাঁর
লাঞ্চ-প্যাকেট খুললেন। আমি বাসায় চলে এলাম।
‘মর্নিং শোজ দ্যা ডে’ বলে একটা কথা আছে না? ওটা কিন্তু মেলবোর্নে চলে না। আজ
সকালে ঝকঝকে রোদ ছিল। অথচ এখন আকাশ মেঘে ঢাকা, তবে বৃষ্টি নেই। বাসার সিঁড়ি দিয়ে
ওঠার সময় দেখলাম নিচের তলায় তিন-চারজন কিশোরী মেয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে।
তাদের পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে স্কুলছাত্রী। আশেপাশের স্কুলেই পড়ে হয়তো। টিফিন
ছুটিতে বাসায় এসেছে। আমারও স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ছে। এরকম দূরত্বেই আমার গ্রামের
বাড়ি আর স্কুল। টিফিনের ছুটিকে আমরা বলতাম ‘দুপুর-ছুটি’। সেই দুপুর-ছুটিতে বাড়িতে এসে ভাত খেয়ে আবার ছুটতাম স্কুলে।
বাসায়
ঢুকে ফিল, ডেভিড বা ফ্লপি কাউকেই দেখলাম না। এরা মনে হয় দুপুরে কেউ থাকে না। কাজ
করে নিশ্চয় কোথাও। ফ্লপি নামের বিড়ালটিকেও
কি সাথে নিয়ে যায়? নাকি বিড়ালদের জন্যও ডে-কেয়ার সেন্টার আছে?
রান্নাঘরে
ঢুকে ফ্রিজ থেকে কালকের অবশিষ্ট ভাত-তরকারির কন্টেইনারটা বের করলাম। বরফ ঠান্ডা।
গরম করতে হবে। চুলা জ্বালাতে গিয়ে দেখি ম্যাচ নেই কোথাও। কাল যেখানে বেশ কয়েকটা
ম্যাচ দেখেছিলাম আজ একটাও নেই। খুব ঠান্ডা খাবারগুলো খেতে খুব কষ্ট হয়েছে। আঙুল অসাড়
হয়ে গেছে। মুখের ভেতর থেকে শুরু করে পাকস্থলী পর্যন্ত মনে হচ্ছে জমে গেছে ঠান্ডায়।
এরকম ঠান্ডা আইসক্রিম খাওয়া চলে, কিন্তু ভাত নয়।
বেরোবার
সময় দরজা বন্ধ করতে গিয়ে খেয়াল করলাম পাশের বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন দু’জন চায়নিজ। বিল্ডিং এ নতুন ভাড়াটে এলে পুরনো
ভাড়াটেরা যেরকম কৌতূহলী চোখে তাকায় সেরকম চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন দু’জনই। আমি দরজায় তালাবন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াতেই শুনলাম,
“হ্যালো”।
“হ্যালো দেয়ার”
“হ্যালো, হ্যালো”- এগিয়ে এলেন মধ্যবয়সী চায়নিজ ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা।
সম্ভবত স্বামী-স্ত্রী।
“নিউ হিয়ার?”
“ইয়েস”
“স্তুদেন্ত?”
“ইয়েস”
ভদ্রলোকটির
মাথায় টাক পড়ে গেছে। কথা বলছিলেন আস্তে আস্তে। জানতে চাইলেন আমি কোন্ দেশ থেকে
এসেছি। বাংলাদেশ বলার পর স্বাভাবিক ভাবেই চিনতে পারলেন না। বললাম “মইন জালা”। এবার চিনতে পারলেন। জানতে চাইলেন আমি উইলির ফ্ল্যাটের
খবর কীভাবে পেলাম।
জিজ্ঞেস করলাম, “হু ইজ উইলি?”
“উইলি, উইলি, ফিলিপ উইলি, ফিল উইলি। এভরি বডি
কল হিম ক্রেজি উইলি, হি হি হি”
ফিলের
পুরো নাম যে ফিলিপ উইলি তা জানতাম না। কিন্তু তাকে ক্রেজি উইলি ডাকবে কেন সবাই।
মনে হচ্ছে ফিলের পাশের ফ্ল্যাটের এই চায়নিজরা ফিলকে খুব একটা পছন্দ করেন না।
প্রতিবেশীদের সাথে ঝগড়া কি এদেশেও হয়? আস্তে আস্তে জানা যাবে কী হয়, না হয়।
অফিসে
ফিরে এসে দেখি পিটার, ক্যামরুন, ইমাজিন এবং আরেকটা ছেলে মিলে বেশ গল্প জমিয়েছে।
ক্যামরুন নতুন ছেলেটার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। অনার্সের ছাত্র, নাম রোনাল্ড।
বুঝতে পারলাম ইমাজিনের ক্লাসমেট।
ক্যামরুন
জিজ্ঞেস করলো কেনের সাথে লাঞ্চে গিয়েছিলাম কি না। “স্পেশাল টুইসডে লাঞ্চ”। এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না দেখে আমাকে বিস্তারিত
জানানো হলো।
কেনের
একটা গ্রুপ আছে। প্রফেসর ব্রুস ম্যাক্কেলাম, প্রফেসর ম্যাক্স, প্রফেসর কেন্
হাইন্স, ডঃ মার্ক মন্রো সহ আরো অনেকে। সবাই মিলে প্রতি মঙ্গলবার দুপুরে লাঞ্চে
যান। বারোটায় শুরু হয়ে সে লাঞ্চ নাকি অনেক সময় তিনটা চারটাতেও শেষ হয় না। এই
লাঞ্চে জনপ্রতি খরচ পড়ে গড়ে পঁচিশ থেকে ত্রিশ ডলার। মদের দাম ওখানে অতিরিক্ত বেশি
বলেই কেন্কে দেখলাম মদের বোতল নিয়ে যেতে। বাইরে থেকে মদ নিয়ে গেলে বোতল খোলার
জন্য দশ ডলার দিতে হয়। পিটার জানালো “টুইসডে লাঞ্চ” ছাড়াও আরেকটি লাঞ্চ আছে- “থার্সডে লাঞ্চ”। তবে ওটা টুইসডে লাঞ্চের মত অতটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
বিশেষ করে সেমিস্টার চলাকালীন। কারণ বৃহস্পতিবার বিকেলে কেনের একটা ক্লাস থাকে।
অন্য প্রফেসরদেরও নিশ্চয় থাকে।
এরপর
আমার বাসা প্রসঙ্গে জানা গেলো অনেক নতুন তথ্য। আমি এখানে থাকি শুনে অবাক হয়ে গেল
ক্যামরুন। বললো, “হাউ? দোজ বিল্ডিংস আর গভর্নমেন্ট
বিল্ডিংস”।
জানলাম
এই যে বিশাল বিশাল বহুতল ভবন- এগুলো সব সরকারি গৃহায়ন প্রকল্পের অধীনে। নিম্ন আয়ের
অস্ট্রেলিয়ান ও রিফিউজিদেরকে এ ফ্ল্যাটগুলো নামমাত্র ভাড়ায় দেয়া হয়। তিনটা বেডরুম,
বিশাল লাউঞ্জ, কিচেন, বাথরুম, টয়লেট সব মিলিয়ে ফিলের এই যে বিশাল ফ্ল্যাট- এর ভাড়া
সপ্তাহে মাত্র পঁচাশি ডলার। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল ইত্যাদিতে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ
ছাড় পাওয়া যায়, কারণ এখানের বাসিন্দাদের আয় কম।
এবার
বুঝতে পারছি এই রুমের ভাড়া এত কম কেন। ফিল আমাকে একটা রুম ভাড়া দিয়ে সপ্তাহে
পঞ্চাশ ডলার পাচ্ছেন। নিজের আর ছেলের থাকার জন্য দিতে হচ্ছে মাত্র পয়ঁত্রিশ ডলার। ফিলের
মত আরো অনেকেই মনে হয় এরকম করছেন।
সন্ধ্যাবেলা
বাসায় ফেরার পথে সেফওয়েতে গেলাম। ম্যাচ কিনলাম। ফ্রিজে রাখার জন্য দুটো
প্লাস্টিকের কন্টেইনার কিনলাম সাড়ে ছ’ডলার দিয়ে। বাংলাদেশে এর সর্বোচ্চ দাম হতে পারে দশ টাকা। বাসায় ফিরে দেখি
লাউঞ্জরুমে কালকের মতই হৈ চৈ। এই মহিলা মনে হয় প্রতিদিনই আসে ফিলের সাথে সময়
কাটাতে। হয়তো বান্ধবী।
সাতটা
বাজে রান্নাঘরে ঢোকার সময় দেখলাম ভদ্রমহিলা সোফায় শুয়ে একটা পা তুলে দিয়েছেন
অন্যপ্রান্তে বসা ফিলের কাঁধের ওপর। দৃশ্যটা অস্বস্তিকর। রান্নাঘরের দরজা ভেতর
থেকে বন্ধ করে দিলাম। চুলা জ্বালাতে গিয়ে দেখলাম দেয়ালে একটা হাতে লেখা নোটিশ
ঝুলছে- “ডু নট ইউজ কিচেন মোর দ্যান ফরটি ফাইভ
মিনিট্স- ফিল”। ফিলের হাতের লেখা ক্লাস থ্রির
বাচ্চাদের মতো। তার মধ্যে কিচেন বানান ভুল। লেখাপড়া যে খুব একটা করেনি তা বোঝা
যাচ্ছে।
পয়ঁতাল্লিশ
মিনিটের মধ্যে রান্নাবান্না সহ কিচেনের সব কাজ শেষ করতে হলে আমাকে কী পদ্ধতি অবলম্বন
করতে হবে? ভাত আর তরকারি আলাদা আলাদা রান্না করার দরকার নেই, একসাথে এক পাত্রে
বসিয়ে দিলেই চলবে। আধাসিদ্ধ করে নামিয়ে রাখলে ডেকসির ভেতর নিজের তাপেই খাবার সিদ্ধ
হয়ে যাবে। কিন্তু তা করতে হলে ঢাকনা যুক্ত ভালো ডেকচি কিনতে হবে। তা কাল করা যাবে।
আজ চাল, ডিম, আলু, পেয়াঁজ, ক্যাপসিকাম এক সাথে এক পাত্রে বসিয়ে দিলাম। আধঘন্টার
মধ্যেই হয়ে গেলো। সেফওয়ে থেকে যে প্লাস্টিকের পাত্রদুটো কিনেছি- বেশ কাজ দিলো।
তাতে খাবারটা ঢেলে রেখে ডেক্চিটা ধুচ্ছি- এসময় সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ পেলাম।
কিচেনের
দরজা ফাঁক করে গলা বাড়িয়ে দিলো ফিল।
“হাই, হোয়াট ইউ কুকিং?”
বুঝলাম
এটা হচ্ছে অন্যকিছু বলার ভূমিকা। কিছু না বলে মুখটা হাসি হাসি করে তাকালাম তার
দিকে।
“ফিনিশ ইওর কুকিং ইন ফর্টি ফাইভ মিনিট্স”
কিছুটা
অপমানিত মনে হলো নিজেকে। পরবর্তী প্রতিক্রিয়া হলো রাগ। কিন্তু প্রতিকুল সময়ে আবেগ
নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললাম, “আমার কাজ হয়ে গেছে। এখনো পয়ঁত্রিশ মিনিটও হয়নি”
“গুড, ভেরি গুড। এনজয় ইওর মিল।”
ফিল
চলে গেলো। রান্নাঘরের আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম ফিল ফিরে গেলো সোফায় শোয়া
মহিলার ঘনিষ্ঠতায়। টিভিতে উৎকট শব্দে বিজ্ঞাপন চলছে। টিভির সামনে কার্পেটে গোল হয়ে
শুয়ে আছে ফ্লপি।
খাবার
নিয়ে রুমে চলে এলাম। এত কম সময়ে এত ভালো রান্না আগে কখনো করিনি। রান্না করার সময়
তোমরা হলুদ মরিচ সহ কত রকমের মসলা যে কী কারণে দাও বুঝি না। ওসব ছাড়াও শুধু একটু
তেল আর নুন দিয়ে সিদ্ধ করে নিলেও যে খাবার কী সুস্বাদু হয়- তা আমার আজকের রান্না
খেলে বুঝতে।
একটু
পরেই দরজায় টোকা। “প্রাডিব, প্রাডিব, ইওর ফোন”। ফিলের চিৎকার বাইরে। লোকটার স্বভাবই কি
এরকম চিৎকার করে কথা বলা? নাকি তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তে আমাকে ডাকতে হচ্ছে বলে
বিরক্তি? কিন্তু কে ফোন করতে পারে এ সময়? দ্রুত গিয়ে ফোন ধরলাম। লাউঞ্জরুমের কোণায়
টিভির পাশে ফোন।
“হ্যালো”
“হ্যালো প্রদীপ কেমন আছো?” আলী সাহেবের গলা।
“জ্বি স্যার, ভালো আছি”
“তুমি মনে হয় দুপুরে ফোন করেছিলে। সরি, আমি
তখন ব্যস্ত ছিলাম। তোমার বাসায় সবকিছু সেট করে নিয়েছো তো? ফিল কেমন মানুষ?”
“জ্বি স্যার, ভালো মানুষ। এখানে সব কিছু ঠিক
আছে”
“কোন অসুবিধা হলে বলবে, ঠিক আছে?
“জ্বি স্যার”
“পার্ট-টাইম জবের কী হলো? চেষ্টা করছো?”
“জ্বি স্যার”
“শোন, তোমার ইংরেজি তো ভাল না। ইংলিশ
কমিউনিকেশান করতে হয় এরকম জব তুমি পাবে না। তোমার জন্য উপযুক্ত হবে কিচেন হ্যান্ড,
ক্লিনিং এরকম ম্যানুয়েল জব”
“জ্বি স্যার, চেষ্টা করছি”
“ওকে দ্যান। গুডনাইট”
“গুডনাইট স্যার”
ফোন
রেখে চলে আসার সময় দেখলাম ফিল সোফায় শোয়া মহিলাকে আদর করার চেষ্টা করছে। আমার ধারণা ছিল আদরের দৃশ্য সবসময়ই সুন্দর।
কিন্তু ফিল আর মহিলার প্রকাশ্য ঘনিষ্ঠতার দৃশ্য আমার একটুও সুন্দর লাগলো না। হয়তো
আমার সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতাই এর কারণ। কোথায় যেন পড়েছিলাম- ঘৃণা প্রকাশ করার জন্য
আড়াল লাগে না, কিন্তু ভালবাসা প্রকাশ করার জন্য আড়ালের দরকার হয়। আড়াল থাকে বলেই
হয়তো কিছু কিছু ভালবাসা এত্তো সুন্দর।
No comments:
Post a Comment