১৩ জুলাই ১৯৯৮ সোমবার
মনে হচ্ছে আমার জেটল্যাগ একেবারেই
কেটে গেছে। আজ ক’টায় উঠেছি জানো? সোয়া ছ’টায়। জানি মানতে চাইছো না যে কাজটা কঠিন।
এরকম বরফ-জমা সকালে সোয়া ছ’টায় উঠে
দেখাও দেখি!
প্রফেসর
কেন্ আমোসের সাথে এপয়ন্টমেন্ট ছিল সকাল দশটায়। ‘বাঙালি সময়-সচেতন নয়’ কথাটা মিথ্যে প্রমাণ করার কিছুটা দায়িত্বতো আমারও। দশটার আগেই ফিজিক্স বিল্ডিং-এ পৌঁছেছি।
দিদির কাছে শুনেছি জাপানীদের যদি কারো বাড়িতে এপয়েন্টমেন্ট থাকে তারা নাকি নির্দিষ্ট
সময়ের কিছুটা আগে পৌঁছে যায়, এবং সময় হওয়া পর্যন্ত বাড়ির আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করতে
থাকে। তারপর ঠিক কাঁটায় কাঁটায় কলিং বেল বাজায়। এখানেও ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম। দশ মিনিট আগে এসে পড়েছি। এই দশ
মিনিট ছয় তলার করিডোরের নোটিশ বোর্ডের নোটিশগুলো পড়ে কাটালাম। প্রতি মঙ্গলবার
দুপুরে ডিপার্টমেন্টাল সেমিনার হয়, প্রতি শুক্রবার বিকেলে স্টুডেন্টস রিসার্চ
প্রেজেন্টেশান, প্রতি বুধবার সকাল এগারোটায় হয় কলোকুইয়াম। কলোকুইয়াম শব্দের সঠিক
বাংলা যে কী তা অক্সফোর্ড ডিক্শনারি দেখেও বুঝতে পারছি না। ইনফরমাল আলোচনা টাইপের
কিছু। সে যাই হোক।
কাঁটায়
কাঁটায় দশটা বাজার সাথে সাথে প্রফেসর এমোসের অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
“গুড মর্নিং স্যার”।
“মর্নিং প্রাডিব। এগেইন- ডোন্ট কল মি স্যার,
ওকে? ইন অস্ট্রেলিয়া নোবডি কল এনিবডি স্যার”। হাসিমুখে বললেন কেন্। অস্ট্রেলিয়ায় সবাই সবাইকে এমনকি
শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষককেও নাম ধরে ডাকে। যে দেশে যে নিয়ম। আমিও নিয়ম মেনে
চলবো।
“হাউ ওয়াজ ইওর উইক-এন্ড?”
“গুড”। এর চেয়ে বেশি ইংরেজি বলার সাহস আমার এখনো হয়নি।
“দ্যাট্স গুড”।
কেন্ উঠে দাঁড়ালেন। বললেন- “চলো তোমার অফিস
দেখাই আগে”। কেনের অফিসের সামনেই ৬১২ নম্বর রুম। কেন্ দরজা নক্ করলেন। কোন সাড়া না
পেয়ে পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুললেন। ভেতরে চার কোণায় চারটি ডেস্ক। ডানদিকের
একটি ছাড়া বাকি তিনটিতে বইখাতা উপচে পড়ছে। দরজার সোজাসুজি দেয়াল ঘেঁষে আরো একটি
টেবিল। একটা বিরাট সাইজের কম্পিউটার সেখানে। টেবিলে ছড়ানো কাগজপত্র দেখে বোঝা
যাচ্ছে কেউ একজন এতক্ষণ কাজ করছিল। হয়তো কোথাও গেছে- এখনি ফিরে এসে আবার কাজে লেগে
যাবে।
“দিস ইজ ইওর
ডেস্ক। ইউ উইল বি ওয়ার্কিং হিয়ার”- কোণার খালি ডেস্ক দেখিয়ে বললেন কেন্। অফিস দেখে
খুব একটা উচ্ছসিত হলাম না। কেমন যেন অগোছালো আর নিষ্প্রভ অফিস। এডমিনিস্ট্রেশান
অফিসগুলো যতটা ঝকঝকে হয়- রিসার্চ অফিস ততটা গোছানো হবে না এটাই স্বাভাবিক।
“ইউ ক্যান স্যাটেল
ইন এজ সুন এজ ইউ গেট আ কী। মিকি উইল এরেঞ্জ ইট। লেটস মিট হার ফার্স্ট”।
কেনের পিছু পিছু সিঁড়ি বেয়ে সাত
তলায় উঠে এলাম। হাতের ডান দিকে হেড অব দি ডিপার্টমেন্টের অফিস। দরজায় লেখা আছে-
প্রফেসর কিথ নুজেন্ট বা নুগেন্ট। ইংরেজির ‘জি’ অক্ষরটা
উচ্চারণের সময় বড় ঝামেলা করে মাঝে মাঝে।
“হাই মেরি, ইউ
গেটিং ইয়ংগার এভরি ডে! হোয়াট্স দ্য সিক্রেট?” বলতে বলতে
অফিসে ঢুকলেন কেন্। মেরি নামক মহিলাটির বয়স পঞ্চাশের ওদিকে হবে। মুখে অসংখ্য
ভাঁজ। দিনে দিনে বয়স কমার কোন লক্ষণ আমি দেখছি না। কেন্ যে ফ্লার্ট করছেন তা
মেরিও জানেন। তিনি হেসে বললেন, “কাট ইট কেন্। হোয়াট্স আপ?”
“ইজ কিথ ইন?” বুঝতে পারছি
মেরি হলেন কিথের সেক্রেটারি। কিথের অফিসে ঢুকতে হলে মেরির সামনে দিয়ে যেতে হয়।
সেদিকের দরজা বন্ধ।
“ইজ হি
এক্সপেক্টিং ইউ?”
“নো, নো। আই
ওয়াজ জাস্ট পাসিং বাই। এনি ওয়ে দিস ইজ প্রাডিব। আওয়ার নিউ পোস্ট গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট।
এন্ড প্রাডিব, দিস ইজ মেরি- ইফ ইউ হ্যাভ এনি প্রোবলেম, সি উইল সল্ভ ইট”।
মেরির সাথে হ্যান্ডশেক করলাম।
তারপর আবার কেনের পিছু পিছু অন্যদিকের করিডোর। দু’পাশে
প্রফেসরদের অফিস। প্রায় সব দরজাই বন্ধ। করিডোরের দু’পাশের দেয়ালে
লাগানো বড় বড় অনেক ছবি। আইনস্টাইন, নিউটন, গ্যালিলিও, আর রাদারফোর্ডকে চিনতে
পারলাম। করিডোরের মাঝামাঝি একটা রুমের দরজা খোলা। কেন্ দরজায় দাঁড়িয়েই ডাক দিলেন,
“হ্যালো মিকি”
“হাই কেন্”
“মিট প্রাডিব। হি ইজ ফ্রম ব্যাংলাডেশ”
ডেস্ক
ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মিকি। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “হ্যালো প্রদীপ”
“হ্যালো মিকি”
মিকির উচ্চতা চারফুট আট ইঞ্চির বেশি হবে না। বয়স মনে
হচ্ছে কেনের চেয়েও বেশি হবে। মাথার চুল টকটকে লাল। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। মিকিকে
দেখে এয়ারপোর্টের সুজান আর লিয়ানার কথা মনে পড়লো আবার। একই রকমের জমকালো প্রসাধন।
কালো প্যান্টের সাথে টকটকে লাল একটা সোয়েটার। গলায় কালো একটা সুতায় বাঁধা পিংপং
বলের সাইজের একটা পাথর বা পাথরের মত দেখতে কিছু একটা।
“মিকি ক্যান ইউ
এরেঞ্জ ফর হিজ অফিস কী এন্ড আদার নিড্স। হি উইল বি ইন সিক্স ওয়ান টু”। মনযোগ দিয়ে
শুনলে কেনের কথা আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি আমি। যতই শুনবো ততই কান তৈরি হবে। মিকির
উচ্চারণে কিছুটা ইন্ডিয়ান টান আসে। তবে দেখতে তাঁকে ঠিক ভারতীয় মনে হচ্ছে ন “হ্যাভ ইউ
এনরোল্ড?” মিকির প্রশ্ন আমাকে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না এন্রোল্ড মানে কী। আমি তো
এডমিশান কনফার্ম করেই এসেছি এখানে। কাগজপত্র দেখালাম মিকিকে। তিনি বললেন, “ইট্স ও-কে।
এডমিশান ইজ ও-কে। বাট এনরোলমেন্ট ইজ দি কনফার্মেশান - দ্যাট ইউ হ্যাভ স্টার্টেড
ইওর কোর্স। সেকেন্ড সেমিস্টার এনরোলমেন্ট ইজ অন ওয়েন্সডে দি ফিফ্টিন্থ”। ১৫ তারিখ
এনরোলমেন্ট হবার পর অফিসের চাবি পাওয়া যাবে।
মিকিকে
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসার পথে কেন্ বললেন, “ঠিক আছে। এনরোলমেন্টের পর মিকির সাথে দেখা করো। মিকি
তোমাকে চাবি দিয়ে দেবে। ইতিমধ্যে তুমি আমার চাবি ব্যবহার করতে পারো। এখন চলো তোমার
ই-মেইল একাউন্ট সেট করার ব্যবস্থা করি”।
লিফ্ট
থামলো চারতলায়। একটু সামনে গেলেই ফিজিক্স কম্পিউটার ল্যাব। বেশ বড় একটা রুম। সারি
সারি কম্পিঊটার। অনেকেই কাজ করছেন এক মনে। আমাদের আসা যাওয়ায় কারো কোন ভ্রুক্ষেপ
নেই। রুমের ভেতর কাচের দেয়াল ঘেরা আরেকটি ছোট রুম- সার্ভার রুম। কাচের দরজা বন্ধ।
ভেতরে কাজ করছেন একজন। দরজার বাইরে লেখা আছে- ডঃ মার্ক মনরো, আই-টি ম্যানেজার।
দরজায়
নক করতেই মার্ক নিজে এসে দরজা খুলে দিলেন।
“মার্ক, দিস ইজ প্রাডিব। মাই নিউ স্টুডেন্ট।
ক্যান ইউ সেট-আপ হিজ একাউন্ট প্লিজ”
“সিওর। কাম অন ইন”
সার্ভার
রুমটা খুবই ছোট। সারা দেয়াল জুড়ে স্টিলের তাক- আর তাকের উপর অসংখ্য ছোট ছোট
বাক্সের মত জিনিস। লাল সবুজ আলো জ্বলছে সেখানে। নীল রঙের মোটা মোটা তার বেরিয়ে
এসেছে সেখান থেকে। এগুলোই সম্ভবত ডাটা ক্যাবল। ধরতে গেলে কম্পিউটারের ক-ও জানি না
আমি। এখানে কাজ করবো কীভাবে? কনফিডেন্স লেভেল আবার কমে যাচ্ছে।
মার্ক
দু’মিনিটের মধ্যেই আমার অনলাইন একাউন্ট
সেট করে দিলেন। একাউন্ট আই-ডি, পাসওয়ার্ড এই শব্দগুলোও আমার কাছে নতুন। কত কিছু যে
শিখতে হবে। মার্ক বললেন, এই ল্যাবে আফটার আওয়ার্স এন্ট্রেন্সের জন্য কার্ড ব্যবহার
করতে। যে কোন ম্যাগনেটিক কার্ডে তিনি আমার একাউন্ট সেট করে দিতে পারেন। কিন্তু আমি
ম্যাগনেটিক কার্ড পাবো কোথায়?
“ড্রাইভার্স লাইসেন্স? ব্যাংক কার্ড? ক্রেডিট
কার্ড?”
আমার
কিচ্ছু নেই। কেন্ বললেন, “ডোন্ট ওয়ারি
প্রাডিব”। ওয়ালেট থেকে নীল একটা প্লাস্টিক
কার্ড বের করে মার্কের হাতে দিয়ে বললেন, “সেট আপ হিয়ার। দিস ইজ হিজ ফটো-কপি কার্ড”। কেন্ নিজের ফটো-কপি কার্ড আমাকে দিয়ে
দিলেন। ওটার ম্যাগনেটিক স্ট্রিপে আমার তথ্য ঢোকালেন মার্ক। ল্যাবের বাইরে রাখা
ছোট্ট মেশিনে কার্ডটা স্ক্যান করে দেখলেন কাজ করে কিনা। কার্ডটা স্ক্যান করলেই
ল্যাবের দরজা খুলে যাচ্ছে। রূপকথার আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের ‘সিসিম’ এখন অনেকের মত আমারও হাতের মুঠোয়। কেনের প্রতি আমার
শ্রদ্ধা ভালোবাসা অনেকগুণ বেড়ে গেলো। মনে হচ্ছে আমার ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। একজন
সত্যিকারের গাইড আমাকে পথ দেখাবেন যে কোন সময়।
“আই হ্যাভ সেট ইট ফর রিসার্চ লাইব্রেরি টু”- মার্ক বললেন। তার মানে ফিজিক্স রিসার্চ
লাইব্রেরির দরজাও আমার জন্য সবসময় খোলা! যখন খুশি লাইব্রেরিতে ঢুকতে পারবো! কী যে
খুশি লাগছে আমার।
আবার
ছ’তলায় উঠলাম। কেনের পিছু পিছু ঢুকলাম
রিসার্চ লাইব্রেরিতে। কেন্কে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন ডেস্কে বসা মহিলা।
“হ্যালো কেন্”
“হ্যালো খাম্লা, মিট প্রাডিব। মাই নিউ
রিসার্চ স্টুডেন্ট”
“হ্যালো প্রদীপ। ইউ আর ফ্রম বাংলাদেশ, রাইট?”
“ইয়েস, ইয়েস আই এম ফ্রম বাংলাদেশ। হাউ ডু ইউ
নো?” একটা পুরো বাক্য বলতে পেরে নিজেকে
ধন্য মনে করছি।
“মিকি হ্যাজ টোল্ড মি”। মনে হচ্ছে এদের নেটওয়ার্ক বড় শক্তিশালী।
তথ্য প্রবাহে সময় লাগে না। খাম্লা কোন দেশী নাম ভাবতে ভাবতে চোখ গেলো তার
নেম-ট্যাগের দিকে। কমলা লিকাম্জি। কেনের হাতে পড়ে ‘কমলা’ হয়ে গেছে ‘খাম্লা’।
কেন্
লাইব্রেরি কার্ডের ব্যাপারে জানতে চাইলেন কমলার কাছে। কমলা বললেন এনরোলমেন্টের পরে
স্টুডেন্ট কার্ড পাওয়া যাবে এবং ওটাই হবে লাইব্রেরি কার্ড। একটা কার্ডেই সবগুলো
লাইব্রেরি থেকে বই নেয়া যাবে।
কেনের
অফিসে ফিরে এলাম। কেন্ একটা বই আর কিছু রিসার্চ পেপার দিয়ে বললেন, “ও-কে প্রাডিব। নাউ ইউ নো সাম পিপল ইন দ্য
স্কুল। স্টার্ট রিডিং দিস বুক। আস্ক মি ইফ ইউ হ্যাভ এনি প্রোবলেম”।
আত্মবিশ্বাস
ফিরে আসছে আমার। এখানে সবার যে আন্তরিকতা দেখলাম প্রথম দিনেই- মনে হচ্ছে চেষ্টা
করলে নিশ্চয় পারবো।
ফিজিক্স
বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে মনে পড়লো আজ আলী সাহেবের সাথে দেখা করার কথা। তিনি আমাকে ফোন
করে সময় ও স্থান জানাবেন বলেছিলেন। কিন্তু ফোন করবেন কোথায়? তবে কি কাল রাতে
হোটেলে করেছিলেন? আমি জ্বরের ঘোরে ঘুমুচ্ছিলাম বলে টের পাইনি! তাঁর মোবাইলে ফোন
করতে হবে। ফিজিক্স বিল্ডিং এর বাইরে একটা পাবলিক ফোনবুথ আছে। লোকাল কল-এর জন্য
চল্লিশ সেন্ট লাগে। বিশ সেন্টের দুটো কয়েন ঢুকিয়ে নাম্বার ডায়াল করতেই লাইন পাওয়া
গেলো। অনেকক্ষণ রিং হবার পর ফোন ধরলেন তিনি। কিন্তু “হ্যালো” বলতে না
বলতেই লাইন কেটে গেলো। ভুলে গিয়েছিলাম যে মোবাইল ফোন লোকাল নয়। এবার দুই ডলারের
কয়েন ঢুকিয়ে মিনিট খানেক কথা বলা গেলো। আলী সাহেব বললেন দুটো থেকে সোয়া দুটোর
মধ্যে হোটেলের সামনে রাস্তায় থাকতে। তিনি একটা ফোর্ড ফ্যাল্কনে চড়ে আসবেন হোটেলের
সামনে। লাইন কেটে গেলো। আবার ফোন করার মত কয়েন নেই আমার কাছে।
বারোটায়
পিটারের সাথে দেখা করার কথা ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের সামনে। মিনিট দশেক বাকি
বারোটা বাজার। পিটারের সাথে দেখা করে দুটোর মধ্যে হোটেলের সামনে যাওয়া যাবে সহজেই।
ইন্টারন্যাশনাল
সেন্টারের সামনে বেশ কয়েকজন চায়নিজ ছেলে মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছে। এদের
মধ্যে কি পিটার আছে? জিজ্ঞেস করা যায়। কিন্তু ইংরেজি বলতে হবে ভেবে চুপ করে গেলাম।
সে-ই আমাকে খুঁজে বের করবে। এখানে আমার মত দেখতে আর কেউ নেই।
ঠিক
বারোটায় ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার থেকে বেরিয়ে এলো ব্যাকপ্যাক কাঁধে একটা লম্বা
পাতলা চায়নিজ ছেলে। সোজা আমার কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, “আর ইউ প্রাডিব?”
“ইয়েস। ইউ পিটার?”
“ইয়েস। নাইস তু মিত ইউ”। টেলিফোনে পিটারের কথা শুনে যতটা ভেবেছিলাম-
পিটারের ইংরেজি উচ্চারণ তার চেয়েও খারাপ। সে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর থার্ড
ইয়ারে পড়ছে। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে আছে মেলবোর্নে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার আগে এক
বছর ফাউন্ডেশান স্টাডিজ করেছে। কিন্তু ইংরেজিতে মনে হচ্ছে খুব একটা সুবিধা করতে
পারে নি। ক্যাম্পাসেরও খুব বেশি কিছু চেনে না সে। ইউনিয়ন হাউজ ছাড়া আমাকে আর নতুন
কিছুই দেখাতে পারলো না। ইউনিয়ন হাউজ হলো স্টুডেন্টদের একটা কমন সেন্টার। অনেক
দোকানপাট, ফার্মেসি, ফুড-কোর্ট, সিনেমা হল, ফ্লাইট সেন্টার সবকিছু আছে সেখানে।
বিশাল তিনতলা বিল্ডিং এর তিনতলায় একটা লাইব্রেরিও আছে। এই বিল্ডিংটা সে চেনে ভালোই-
কারণ ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের বিভিন্ন দেশ-ভিত্তিক সংগঠনের অফিসও এখানে।
কোরিয়ান, মালয়েশিয়ান, জাপানিজ, শ্রীলংকান, ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টদের আলাদা আলাদা সংগঠন আছে দেখলাম। বাংলাদেশী
শিক্ষার্থীদের কোন অফিস দেখলাম না। মনে হয় খুব বেশি বাংলাদেশী স্টুডেন্ট নেই
এখানে।
আধঘন্টার
মধ্যেই পিটারের সঙ্গ আমার কাছে অর্থহীন মনে হতে শুরু করলো। সে এত বছরেও
ক্যাম্পাসের তেমন কিছুই চেনে না। আমি গত দু’দিনে ক্যাম্পাসের যতটুকু ঘুরে দেখেছি সে তা-ও করে
নি। জিজ্ঞেস করলাম আমাকে ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে
দেখার জন্য সে কী পাবে? জানালো সে বিশ ডলার পাবে এক ঘন্টার জন্য। আশ্চর্য হলাম এই
ভেবে যে- একটা কাজ ভালো করে না জেনেই সে কীভাবে হাতে নেয়? নিজে ক্যাম্পাস চেনে না
ঠিক মত- অথচ আরেকজনকে ক্যাম্পাস দেখানোর দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে।
বললাম,
“থ্যাংক ইউ পিটার। আই হ্যাভ টু গো”। খেয়াল করে দেখলাম পিটারের সাথে ইংরেজিতে
কথা বলতে আমার তেমন কোন অসুবিধা হচ্ছে না। পিটার বললো, “গোয়িং তু চিতি? আই গো তু”।
ফিজিক্স
বিল্ডিং এর কাছেই ট্রাম স্টপ। ট্রামে উঠলাম দু’জন। ট্রামে খুব একটা ভীড় নেই। আমি একটা শর্ট ট্রিপের
টিকেট কিনলাম টিকেট মেশিন থেকে। পিটার হেসে হেসে বললো, “ইউ দোন্ত নিদ্ তু বাই এ তিকেত হিয়ার”। টিকেট লাগে না? আমার তো অবাক হবার পালা।
স্টুডেন্টদের জন্য কি তবে ট্রাম ফ্রি? জিজ্ঞেস করতেই সে বললো, ঠিক তা নয়। টিকেট
কেউ চেক করে না এখানে।
কেউ
চেক করে না বলে টিকেট করবে না? পিটারকে হঠাৎ কেমন যেন চোর চোর মনে হচ্ছে আমার। সে
কোথায় যাচ্ছে আমি জানি না। আমি নেমে গেলাম কলিন স্ট্রিট স্টপে। সোজা হোটেল। করিডোরে
দেখা হয়ে গেল লুসির সাথে। সে তার মালকিনের কোলে চড়ে যাচ্ছিলো কোথাও। আমাকে দেখেই
ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। আমি দ্রুত রুমে ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পেলাম- “শাট আপ লুসি”।
দুটো
বাজার অনেক আগে থেকেই হোটেলের সামনে লিটল কলিন স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে আছি। ওয়ানওয়ে
স্ট্রিট। সুতরাং কোন্ দিক থেকে আসবেন আলী সাহেব তা জানি। তবে আমাকে চিনবেন কীভাবে
তা জানি না। অবশ্য আমার মত বাদামী চামড়ার আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না আশে- পাশে। ফোর্ড
ফ্যালকন গাড়ি সম্পর্কে আমার কোন ধারণা না থাকায় যে কোন গাড়িকেই ফোর্ড ফ্যালকন, আর
যে কোন বাদামী চামড়ার মানুষকেই আলী সাহেব বলে
মনে হতে লাগলো। অবশেষে আড়াইটার দিকে এলেন তিনি। হোটেলের সামনে গাড়ি থামিয়ে জানালার
কাচ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “প্রদীপ?”
“জ্বি স্যার”
“উঠে আসেন”
গাড়িতে
উঠে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো। আলী সাহেব বললেন, “সিট বেল্ট বেঁধে নাও। এখানে সিল্ট বেল্ট না বাঁধলে
হানড্রেড এন্ড সিক্সটি ফাইভ ডলার ফাইন”
আমাকে
তুমি করে বলছেন বলে ভালো লাগছে। অনভ্যস্ত হাতে সিটবেল্ট বাঁধলাম।
“আমি তো তোমাকে আরো বয়স্ক মনে করেছিলাম। লং
টাইম ওয়েট করছো না?”
“না, জ্বি, এই তো”
“লাঞ্চ করোনি নিশ্চয়? আমরা কোথাও বসে লাঞ্চ
করতে করতে কথা বলবো। তারপর আমাকে আবার অফিসে যেতে হবে। ভেরি বিজি লাইফ হিয়ার।”
সিটিতে
গাড়ির স্পিড লিমিট ঘন্টায় চল্লিশ কিলোমিটার। কিন্তু মনে হচ্ছে গাড়ি চলছে আরো অনেক
কম গতিতে।
“হু গেইভ ইউ মাই নাম্বার?”
“জ্বি, আপনার ঠিকানা দিয়েছিলেন হুমায়রা আপা।
নম্বরটা আমি টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে নিয়েছি”
“হু ইজ হুমায়রা আপা?”
“শাহীন কলেজের টিচার”
“ওহ্ লোহানী ভাইয়ের ওয়াইফ। ইউ নো লোহানী
ভাই। মেরিন একাডেমির ডিরেক্টর ছিলেন। এখন শিপিং কর্পোরেশনে”
“জ্বি”
“ভেরি গুড। কেমন আছেন উনারা? খুব ভালো মানুষ
লোহানী ভাই। আমার মেরিন লাইফে এত ভালো মানুষ আর দেখি নাই। আমার সিনিয়র ছিলেন। আই
এম গ্ল্যাড দ্যাট দে স্টিল রিমেম্বার মি”
“জ্বি, উনারাও আমাকে বলেছেন যে আপনার মত
ভালোমানুষ খুব বেশি দেখা যায় না”
“তাই নাকি? আর কী কী শুনেছো আমার সম্পর্কে?”
“আপনি মেলবোর্নে খুব সাকসেসফুল মানুষ”
“আই হ্যাড টু ওয়ার্ক ভেরি হার্ড ফর দিস
সাকসেস। এদেশে পরিশ্রমের দাম আছে কিন্তু। এবার তোমার কথা বল। মেলবোর্ন
ইউনিভার্সিটির কোন কোর্সে এসেছো তুমি?”
“ফিজিক্সে পিএইচডি”
“চান্স পেলে কীভাবে? মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি
হলো ওয়ান অব দি বেস্ট ইউনিভার্সিটিজ ইন অস্ট্রেলিয়া। ভেরি প্রেস্টিজিয়াস”
শুনে
ভালো লাগছে। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির আগে আমার আলাদা করে কোন আইডিয়া ছিলো
না এই ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে। মাস্টার্স থিসিস করার সময় কিছু রিসার্চ পেপারে এই
ইউনিভার্সিটির নাম দেখেছিলাম। তারপর ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে কমওয়েলথ ইউনিভার্সিটি বুক
থেকে ইউনিভার্সিটির ঠিকানা নিয়ে দরখাস্ত পাঠিয়েছিলাম। তারা পরে প্রস্পেক্টাস
পাঠিয়েছিল। হাতের কাছে তেমন কোন তথ্যই আমার ছিল না। এখন খুব ভালো লাগছে জেনে যে
আমি ভুল জায়গায় আসিনি।
“বাট টিউশন ফি ইজ ভেরি হাই দেয়ার। তোমরা
নিশ্চয় খুব ধনী”
“জ্বি না স্যার। আমি খুব গরীব পরিবারের ছেলে।
ইউনিভার্সিটি থেকে একটা স্কলারশিপ দিয়েছে। কোন রকমে চালিয়ে নিতে হবে”
“ইউ গট আ স্কলারশিপ। কনগ্রাচুলেশান্স। বাট
ইউ হ্যাভ টু ওয়ার্ক ভেরি হার্ড। এভরিবডি ওয়ার্কস হিয়ার। ভিসা কতদিনের দিয়েছে? ছ’মাসের নিশ্চয়?”
“জ্বি- দু’বছরের ভিসা দিয়েছে”
“ভেরি গুড। এখন মনে হয় ভিসা দিচ্ছে কিছু।
কয়েক বছর আগে ছ’মাসের বেশি ভিসা দিতে চাইতো না।
বিট্টু- আমার শালা- কয়েক বছর আগে মনাশ ইউনিভার্সিটিতে এডমিশান নিয়েও ভিসা পায়নি।
পরে হাঙ্গেরিতে গিয়ে পড়াশোনা করেছে। ওখান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে এখন এখানে
এসেছে আর-এম-আই-টিতে মাস্টার্স করতে”
“ভিসা অফিস মনে হয় ব্যাংক একাউন্ট দেখে”
“শুধু ব্যাংক একাউন্ট দেখলে তো কথাই ছিল না।
তার দুই ভাই আমেরিকায়, একজন মিডল ইস্টে, আমরা আছি এখানে, তার কি টাকা-পয়সা কম আছে
নাকি? ইমিগ্রেশান যে কী চায় তা কেউ জানে না। আমার কথাই ধরো না। এখানে পি-আর এর
জন্য এপ্লাই করে টু টাইম্স রিজেক্টেড হয়েছি। প্রথমবার করলাম ইংল্যান্ড থেকে-
ফেইলিওর। সেকেন্ড টাইম করলাম সিঙ্গাপুর থেকে- নট সাকসেস্ফুল। থার্ড টাইম করলাম এইটি
নাইনে ব্রুনেই থেকে- ভিসা পেয়ে গেলাম। এরকম আরো অনেকেই পেয়েছে। পনের ষোল জন
বাংলাদেশী মেরিন ইঞ্জিনিয়ার আছে মেলবোর্নে”।
ঠিক
কোথায় এলাম বুঝতে পারছি না। বেশ বড় একটা ম্যাকডোনাল্ডস দেখা যাচ্ছে। আলী সাহেব
পার্কিং খুঁজছেন।
“পার্কিং ইজ আ বিগ প্রোবলেম ইন দি সিটি। ফ্রি
পার্কিং তো নাই কোথাও। আমি তো সিটিতে আসার সময় গাড়ি রেখে আসি ট্রেন স্টেশানে।
তারপর ট্রেনে সিটিতে আসি। নইলে সিটিতে এত গাড়ির জায়গা হবে না তো”।
ম্যাকডোনাল্ডস-এর
পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করলেন আলী সাহেব। গাড়ি থেকে নেমে তাঁর পিছু পিছু ঢুকলাম
ম্যাকডোনাল্ডসে। খাবারের অর্ডার দিলেন আলী সাহেব। বিগ-ম্যাক মিল। আমার ধারণা ছিল
ম্যাকডোনাল্ডসের খাবারের দাম অনেক বেশি। কিন্তু দেখলাম আমার ধারণা ভুল। বলা চলে তৈরি
খাবারের মধ্যে ম্যাকডোনাল্ডসের খাবারই সবচেয়ে সস্তা। বিগ-ম্যাক স্যান্ডুইচ, পটেটো
ফ্রাই আর কোক- সব মিলিয়ে চার ডলার। গোপাল্স এর নিরামিষের চেয়ে অনেক অনেক ভাল।
খেতে
খেতে কথা হচ্ছিলো আলী সাহেবের সাথে।
“হোটেলে কত চার্জ নিচ্ছে?”
“ত্রিশ ডলার”
“টু মাচ। এর চেয়ে অনেক কমে হোস্টেল পাওয়া
যায়। হয়তো রুম শেয়ার করতে হবে। বাট ইউ উইল সেইভ এ লট”
“হোটেলে চৌদ্দ দিনের এডভান্স দিয়ে ফেলেছি”
“ওটা কোন সমস্যা না। চাইলে ফেরৎ দেবে। তুমি
ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টস সেন্টারে খবর নাও। সেখানে বিভিন্ন হোস্টেলের খবর পাবে।
পনেরো ডলারের মধ্যে হোস্টেল পেয়ে যাবে। আমিও খবর নেবো। আপাততঃ একটা থাকার জায়গা।
তারপর একটা পার্ট-টাইম জব। এদেশে সবাই সব কাজ করে। ইংলিশ স্কিল যতদিন ডেভেলপ না
করছে ততদিন অড জব করতে হবে। কিচেন হ্যান্ড, ক্লিনিং ইত্যাদি। বিট্টুতো একটা
ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে কাজ করে। আমি বলবো তাকে তোমার জন্য জব দেখতে।”
“তাকেও কাজ করতে হয়?”
“এদেশে সবাইকে কাজ করতে হয়। দেয়ার ইজ নো ফ্রি
লাঞ্চ ইন দিস কান্ট্রি”
আমি
যে আজ ফ্রি লাঞ্চ পেয়ে গেলাম! হয়তো প্রথম দিন বলেই। “চলো, তোমাকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে
আমাকে আবার অফিসে যেতে হবে”।
আমাকে
হোটেল গেটে নামিয়ে দিয়ে আলী সাহেব চলে গেলেন। হোটেল রিসেপশানে জিজ্ঞেস করলাম ভাড়া
ফেরৎ পাবো কি না। বললো- কোন সমস্যা নাই। যতদিন থাকবো ততদিনের ভাড়া রেখে বাকিটা
ফেরৎ দেবে।
মেলবোর্ন
ইউনিভার্সিটির সামনে সোয়ান্সটন স্ট্রিটে একটা হোস্টেল আছে। গেলাম সেখানে। সিটি
এপার্টমেন্ট হোস্টেল। এটা পরিচালনা করে ‘ওয়াই-এম-সি-এ’
ইয়ং ম্যান ক্রিশ্চিয়ান্স এসোসিয়েশান। খ্রিস্টানদের রামকৃষ্ণ মিশন টাইপের
কিছু হবে ভেবেছিলাম। তবে ঠিক সে রকম কিছু নয়। ফার্নিশ্ড এপার্টমেন্ট টাইপের।
কয়েকটা রুম এখনো খালি আছে। ওয়ান বেডরুমের সাপ্তাহিক ভাড়া দু’শ বিশ ডলার। এত ভাড়ায় পোষাবে না। এখান থেকে
আরেকটি হোস্টেলের ঠিকানা পেলাম। রিচমন্ড ইয়থ হোস্টেল, ৩৫৩ চার্চ স্ট্রিট, রিচমন্ড।
ইন্টারন্যাশনাল
সেন্টার থেকে জেনে নিলাম কীভাবে যেতে হবে। ইউনিভার্সিটির সামনে থেকে ১নং ট্রামে
চড়ে ফ্লিন্ডার স্ট্রিট। সেখান থেকে ৭০ নং ট্রাম। ১১নং স্টপে নামলেই চার্চ স্ট্রিট।
ট্রাম থেকে নেমেই মনটা জুড়িয়ে গেল। মেলবোর্নের আবাসিক এলাকা। ঘরবাড়িগুলো সব ছবির
মত। এখানে থাকতে পারলে ভালোই হতো। তবে ইউনিভার্সিটি থেকে অনেক দূরে।
বাড়িটা
খুঁজে পেতে দেরি হলো না। জোড় নম্বরের বাড়িগুলো রাস্তার এক পাশে আর অন্যপাশের
বাড়িগুলো বেজোড় নম্বরের। হোস্টেলটি দোতলা। কাচের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট
টানছে একজন যুবক। তার দিকে তাকিয়ে একটু ভয় পেয়ে গেলাম। তার দুই কানে বড় বড় দুল,
ডান চোখের ভ্রুতেও একটা দুল। ঘাড়ের এক পাশে একটা মেয়ের মুখ আঁকা। হাতের কব্জিতেও
উল্কি।
“হাই”- হাসিমুখে বললো সে। দেখতে যতটা ভয়ংকর মনে হচ্ছে, আসলে
হয়তো ততটা ভয় পাবার কিছু নেই তাকে।
“হাই, আই এম লুকিং ফর একোমোডেশান”
সিগারেটের
শেষ অংশ একটা বিনে ফেলে ব্যস্তভাবে বললো সে, “কাম ইনসাইড। উই হ্যাভ ডিফারেন্ট টাইপ্স অব রুম্স”
রুম
দেখলাম। কেমন যেন অন্ধকার ভেতরে। তিনজনের একটা রুমে থাকলে সপ্তাহে ১০৫ ডলার। প্রতি
রাতে ১৫ ডলার। তুলনামূলক ভাবে সস্তা। কিন্তু সস্তার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।
ছোট্ট রুম। একদিকের দেয়াল ঘেঁষে একটা সিংগেল খাট, অন্যদিকের দেয়ালে একটি দোতলা
খাট। সেখানে দু’জন ঘুমাবে- একজন নিচে, অন্যজন উপরে।
দেয়ালে একটা বড় খোপের মত আছে- যেটাতে দরজা লাগিয়ে একটা দেয়াল আলমিরার মত করা
হয়েছে। এটার নাম- বিল্ট ইন ওয়ার্ড্রোব। ঘরে আর কোন আসবাব নেই, অবশ্য জায়গাও নেই।
“উই হ্যাভ কমন কিচেন, বাথ এন্ড লাউঞ্জ উইথ
টিভি”
রুম
পছন্দ হয়নি, তাই কিচেন বাথরুম দেখার আগ্রহ দেখালাম না। বললাম- পরে জানাবো। ছেলেটিকে
ধন্যবাদ দিয়ে চলে এলাম।
আবার
ট্রাম। ফ্লিন্ডার স্ট্রিটে নেমে সিটি-সার্কেল ট্রামে উঠলাম। এটা মেলবোর্ন সিটির
ফ্রি ট্রাম। মেলবোর্নের একদম প্রথম প্রজন্মের ট্রাম এটা। কাঠের বডি, কাঠের দরজা।
কিন্তু অত্যাধুনিক সব ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা আছে এই ট্রামেও। ট্যুরিস্ট ট্রাম বলে
মেলবোর্ন সিটির প্রতিটি দ্রষ্টব্য স্থানের ইতিহাস, কীভাবে যেতে হয় ইত্যাদি তথ্যের
ধারাবিবরণী চলছে ট্রামে। ফ্লিন্ডার স্ট্রিট ধরে এসে নিকলসন স্ট্রিটে ভিক্টোরিয়ান
পার্লামেন্ট দেখলাম। বেশ সুন্দর বিল্ডিং। তবে বাংলাদেশের সংসদ ভবনের মত অতটা
সুন্দর নয়। ট্রাম থেকে দেখলাম মেলবোর্ন মিউজিয়াম আর রয়েল এক্সিবিশান সেন্টারের
সুন্দর বিল্ডিং। সিটির একেবারে সেন্টারেই এসব। আরো অনেকবার নিশ্চয় আসা হবে এখানে।
ট্রাম
মূল সিটির চারপাশে ঘুরে ইয়ারা নদীর পাড় ঘেঁষে ক্রাউন কমপ্লেক্স ডানে রেখে আবার
ফ্লিন্ডার স্ট্রিট স্টেশনের সামনে এসে থামলে আমি নেমে গেলাম। এখান থেকে আমার হোটেল
একদম কাছে। এই ক’দিনে শহরের অনেক রাস্তা আমার চেনা
হয়ে গেছে।
স্টেশনের
বাইরে নিউজ এজেন্সির সামনে ঝোলানো পত্রিকায় বড় বড় অক্ষরে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ের
খবর। একটা ব্যাপার খুব অবাক লাগছে। অস্ট্রেলিয়া ক্রীড়ামোদী জাতি হিসেবে এত পরিচিত-
অথচ বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে এখানে কোন উত্তেজনা নেই। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এ সময়
নানাদেশের পতাকা ওড়ে। মানুষ রাত জেগে খেলা দেখে, পরদিন অফিসে গিয়ে সেই খেলার
খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করে। বুয়েটের মত সিরিয়াস ইউনিভার্সিটিও বিশ্বকাপ উপলক্ষে দীর্ঘ
দিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। অথচ একেবারে নীরবে চলে গেলো এবারের বিশ্বকাপ।
সোয়ান্সটন স্ট্রিটের ম্যাকডোনাল্ডসে ঢুকলাম। দুই ডলার
পঁয়ষট্টি সেন্ট দিয়ে একটা বিগম্যাক কিনে হোটেলে চলে এলাম। আজকের ডিনার বিগম্যাক-
নরম পাউরুটির মাঝখানে মাংসের চপ, পাতলা করে কাটা লেটুস, টমেটো আর চিজ। সাথে স্বরচিত
এক কাপ গরম কফি। আর লাগে কী?
No comments:
Post a Comment