১৪ জুলাই ১৯৯৮
মঙ্গলবার
ভর্তির
কাগজপত্রের সাথে সুন্দর একটা প্রস্পেক্টাস পাঠিয়েছিল মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি।
সেখানে একটা সেকশান আছে ‘ইন্টারন্যাশনাল
স্টুডেন্ট’স সার্ভাইভ্যল গাইড’। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের যে কোন প্রয়োজনে
সাহায্য করাই ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের কাজ। ভিসা থেকে শুরু করে বাসা ও পার্ট-টাইম
চাকরি খুঁজে দেয়ার ব্যাপারেও সাহায্য করে এই সেন্টার। এই সাহায্যগুলো আমার খুব
দরকার। সকালে গিয়েছিলাম সেখানে।
সোয়ান্সটন স্ট্রিট ধরে হেঁটেই চলে
যাওয়া যায় ইউনিভার্সিটিতে। খুব বেশি হলে এক কিলোমিটার; শুধু শুধু ট্রামে চড়ার মানে হয় না। ভেবো না যে
পয়সা বাঁচাচ্ছি। আসলে শরীর বাঁচাচ্ছি। হাঁটা শরীরের জন্য খুব ভালো।
অফিস
আওয়ারে বেরিয়েছি বলেই হয়তো- ফুটপাতে লোক গিজগিজ করছে। প্রায় সবাই যে অফিসযাত্রী তা
তাদের ফর্মাল পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আলী সাহেব ঠিকই বলেছেন। এখানে বেশির ভাগ
অফিস-যাত্রী সিটির বাইরে সাবার্বের ট্রেন-স্টেশানে গাড়ি পার্ক করে ট্রেনে
করে সিটিতে আসেন। তাতে পিক-আওয়ারে সিটিতে ট্রাফিক জ্যাম হয় না। সকাল সাতটা থেকে
দশটার মধ্যে সিটির কোন রাস্তার পাশেই গাড়ি পার্ক করা যায় না। আবার অফিস ছুটির
সময়টাতে মানে বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্তও একই নিয়ম। অন্য সময়ে রাস্তার পাশে সুনির্দিষ্ট
জায়গায় গাড়ি পার্ক করা যায়- তার জন্য যে পার্কিং টিকেট কিনতে হয়- তার দাম
ট্রাম-ট্রেনের টিকেটের দামের চেয়ে বেশি।
মেলবোর্ন সেন্ট্রালের কাছে এসে দেখলাম স্রোতের মত মানুষ
বেরোচ্ছে একটা গলি থেকে। গলির মুখে লেখা আছে মেলবোর্ন সেন্ট্রাল স্টেশান। পায়ে
পায়ে এগিয়ে দেখলাম বিশাল শপিং মলের একটা অংশ থেকে ভূগর্ভে নেমে গেছে অনেকগুলো
চলমান সিঁড়ি। সিঁড়িতে পা রেখে চলে এলাম
একেবারে নিচে ভূ-গর্ভস্থ ট্রেন-স্টেশনে। টিকেট ছাড়া প্লাটফরমে ঢোকা যায় না। দেখলাম
যাত্রীরা মেশিনের মধ্যে টিকেট ঢোকাচ্ছে- আর সাথে সাথে প্লাটফরমের দরজা খুলে
যাচ্ছে। পাশাপাশি দশ-বারোটি দরজা। যাত্রীদের প্রচুর ভীড়, কিন্তু কেউ কারো গায়েও লাগছে
না। কত বছরের অনুশীলনে একটা জাতি এরকম সুশৃঙ্খল হয়?
চলমান
সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম সারফেস লেভেলে। ওঠার সময় উপরের দিকে চোখ গেলো। বিশাল একটা
কোণাকৃতি গম্বুজ উঠে গেছে প্রায় দশ তলার সমান উঁচুতে। সলিড জিওমেট্রিতে এটাকেই
সলিড এঙ্গেল বলে। এক পাশের দেয়ালে ঝুলছে বিশাল একটা সিকো ঘড়ি। ডায়ালের ব্যাস প্রায়
দু’মিটার। এত বড় ঘড়ি আমি আগে দেখিনি
কখনো। সাইজ দেখেই অবাক হয়ে গেছি- তবে আসল ব্যাপার শুরু হলো মিনিট খানেক পরে ঠিক
দশটা বাজার সাথে সাথে। ঘড়ির নিচের অংশ আস্তে আস্তে খুলে নিচের দিকে নামতে শুরু
করলো। সেখান থেকে বেরিয়ে এলো বেশ কয়েকটা যান্ত্রিক পাখি আর নানারকম বাদ্যযন্ত্র।
মিনিট দুয়েক ধরে চললো মিষ্টি একটা বাজনা। তারপর আস্তে আস্তে ডায়ালের বর্ধিত অংশ
ঢুকে গেলো ঘড়ির পেটে। দেখলাম এই সময়টাতে ঘড়ির আশেপাশে বেশ ভীড় জমে গেছে। ঘন্টায়
ঘন্টায় এরকম চলে।
মেলবোর্ন সেন্ট্রাল থেকে বেরিয়ে আবার
সোয়ান্সটন স্ট্রিট। রাস্তার ওপারে ভিক্টোরিয়ান স্টেট লাইব্রেরি। আকাশে আজ মেঘ
অনেকটা হালকা। ঝাপসা ঘঁষা কাচের মত ঠান্ডা রোদ পড়েছে লাইব্রেরির সামনে স্যার
রেমন্ড বেরির বিশাল মূর্তিটির গায়ে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন তিনি। মেলবোর্ন
ইউনিভার্সিটিতে তাঁর নামে একটা বিল্ডিং-ও আছে। মেলবোর্ন শহরের বিভিন্ন রাস্তার
মোড়ে মোড়ে এরকম বিখ্যাত ব্যক্তিদের অনেক মূর্তি। সোয়ান্সটন স্ট্রিট আর লা-ট্রোব
স্ট্রিট যেখানে ক্রস করেছে সেখানে ফুটপাতের ওপর একটা স্থাপত্য দেখে খুব ভালো
লাগলো। মনে হচ্ছে একটা পুরো লাইব্রেরি মাটির নিচে ঢুকে গেছে কেবল একটা কোণের
সামান্য অংশ বেরিয়ে আছে মাটির ওপর।
লা-ট্রোব
স্ট্রিট ক্রস করলেই আর-এম-আই-টি’র বিশাল
ক্যাম্পাস। সোয়ান্সটন স্ট্রিটের ওপর একটা বিল্ডিং-ই মনে হচ্ছে কয়েকশ’ মিটার লম্বা। গতকাল আলী সাহেব বলছিলেন এই
ইউনিভার্সিটিও অস্ট্রেলিয়ার একটা প্রথম সারির ইউনিভার্সিটি। মেলবোর্ন
ইউনিভার্সিটির দিকে আরো কিছুদূর হাঁটার পর চোখে পড়ল লা-ট্রোব ইউনিভার্সিটির একটা
বিল্ডিং। মেলবোর্ন মনে হচ্ছে ইউনিভার্সিটির শহর। মাত্র কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই
পাঁচটি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস দেখলাম। আরো কয়টা আছে জানি না এখনো।
সাড়ে
দশটার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে। অনেক ভীড় আজকে। বেশির ভাগ
স্টুডেন্ট মনে হচ্ছে চায়নিজ। তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলছে। কাউন্টারে কয়েকজন
চায়নিজ ছেলে-মেয়েও কাজ করছে দেখলাম। কাউন্টারের সামনে যেতেই এগিয়ে এলো একজন চায়নিজ
ছেলে- “হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”
আমার
তো অনেক রকমের সাহায্য দরকার। মেডিকেল ইনস্যুরেন্স কার্ড এসেছে কি-না, স্কলারশিপের
টাকা কখন পাবো, বাসা খোঁজার ব্যাপারে কীরকম সাহায্য পাওয়া যাবে, পার্ট-টাইম চাকরি
কীভাবে পেতে পারি। এতগুলো বিষয় ইংরেজিতে বলতে গিয়ে আমার ঘাম বেরিয়ে যাবার অবস্থা। কিন্তু
যে শুনলো- তার অবস্থা মনে হলো আমার চেয়েও খারাপ। সে আমাকে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে
চলে গেলো এবং একটু পরে ফিরে এলো একজন আফ্রিকান মহিলাকে সাথে নিয়ে। ভীষণ মোটা এই
মহিলার মাথার চুলের দিকেই চোখ পড়লো প্রথমে। মাথা-ভর্তি দড়ির মত অসংখ্য বেণী- বেণীগুলোর
আগায় ছোটছোট কড়ি বাঁধা। হাঁটার সময় টুং টাং শব্দ হয়। বাচ্চা মেয়েদের এরকম সাজে
মানিয়ে যায়- কিন্তু এই মহিলার বয়স চল্লিশের কম নয়।
“হাই, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”
আমি
একটু আগে চায়নিজ ছেলেটিকে যা যা বলেছিলাম- আবার বললাম। মহিলার বুকে লাগানো
নেম-ট্যাগের দিকে চোখ গেলো- আইডা।
আমার
কথাগুলো চুপচাপ শুনে আইডা বললেন, “ফর ইওর
মেডিব্যাংক নাম্বার - ইউ হ্যাভ টু গো টু মেডিব্যাংক প্রাইভেট’স অফিস ইন দি সিটি”। একেকটা কাজের জন্য একেকটা অফিসে যেতে হবে। মেডিকেল
ইন্সুরেন্সের ব্যাপারে যেতে হবে বার্ক স্ট্রিটে মেডিব্যাংক এর অফিসে। আমার হোটেল
থেকে বেশি দূরে নয়। স্কলারশিপের ব্যাপারে যেতে হবে ১৮৮৮ বিল্ডিং এর স্কলারশিপ
অফিসে। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের জন্য ১৮৮৮ বিল্ডিং-এই অনেক কিছু। বাসা আর
চাকরি খোঁজার জন্য যেতে হবে স্টুডেন্টস সাপোর্ট বিল্ডিং-এ। ফিজিক্স বিল্ডিং এর
কাছে ওল্ড ল বিল্ডিং এর সাথে লাগানো। গত শুক্রবারে একবার গিয়েছিলাম সেখানে।
আপাতত
১৮৮৮ বিল্ডিং এ যাওয়া যাক। গ্রাটান স্ট্রিট দিয়ে ঢোকার দুটো রাস্তা ছাড়াও
সোয়ান্সটন স্ট্রিট থেকেও ঢোকা যায় ১৮৮৮ বিল্ডিং-এ। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার থেকে
বেরিয়ে ডান দিকে একটু গেলেই আর্টস বিল্ডিং। পাশ দিয়ে ছোট্ট একটা রাস্তা আছে।
১১০
বছরের পুরনো এই বিল্ডিং-এ ঢুকেই মনে হলো বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের কোন
জমিদারবাড়িতে ঢুকে পড়েছি। অনেক উঁচু সিলিং, কাঠের সিঁড়ি, বিরাট বিরাট জানালা।
রিসেপশানে
কেউ নেই। চোখে পড়লো একটা ছোট ঘন্টা রাখা আছে সেখানে। ছোট্ট একটা নোট লেখা আছে
ঘন্টার পাশে। কারো কিছু দরকার হলে ঘন্টাটি বাজাতে বলা হচ্ছে। বেশ মজা লাগলো
ব্যাপারটা। ঘন্টায় সামান্য একটু শব্দ হতেই পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এলো একজন তরুণী। বাড়াবাড়ি
রকমের সুন্দরী।
“হাউ ক্যান আই
হেল্প ইউ?” কেমন যেন একটু কর্কশ গলার স্বর। মনে হচ্ছে যেন অসময়ে এসে তাকে বিরক্ত
করলাম। খুব সুন্দরী তরুণীদের একধরণের অতি-আত্মবিশ্বাস থাকে। সে কারণেই তারা অতি-অল্পতেই
বিরক্ত হয়ে যায়। এও হয়তো সেরকম। তবুও ভালো যে কাউন্টার সার্ভিসে যারা কাজ করে
তাদের নেমট্যাগ থাকে। দুর্ব্যবহার করলে অন্তঃত রিপোর্ট করা যাবে। এই মেয়েটির নাম লরেন।
বিড়ালের চোখের মত চোখ তুলে তাকিয়ে আছে সোনালী চুলের লরেন। কোন রকমে জানতে চাইলাম-
স্কলারশিপ মানি তোলার জন্য কী কী ফর্মালিটিজ আছে, কখন পাওয়া যাবে।
“জাস্ট এ মিনিট” বলে ভেতরে চলে
গেল লরেন। মিনিট যেন শেষ হতে চায় না। কী বিপদে পড়লাম! লরেনও কি কাউকে ডেকে আনতে
গেল আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য? সব কাজে যদি অন্য কাউকে ডেকে আনতে হয় তবে কাউন্টারে
যারা থাকে তারা নিজেরা কী কাজ করতে পারে?
আমার অনুমান ঠিক। একটু পরে ভেতরের
রুম থেকে বেরিয়ে এলেন একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক। স্মিত হেসে বললেন, “ইউ নিড টু ফিল
আপ দিস স্কলারশিপ পেমেন্ট এডভাইজ ফরম”। একটা ফরম এগিয়ে
দিলেন আমার দিকে।
“ডু ইউ হ্যাভ এন
অস্ট্রেলিয়ান ব্যাংক একাউন্ট?”
“নো”
“ইউ নিড ওয়ান”।
জানা
গেলো আগামীকাল এনরোলমেন্ট হয়ে গেলে ২৪ তারিখে স্কলারশিপ মানি আমার ব্যাংক একাউন্টে
জমা হবে। প্রতি দু’সপ্তাহ পর পর স্কলারশিপের টাকা ব্যাংক
একাউন্টে জমা হয়ে যাবে। পেমেন্ট এডভাইজ ফরমে মূলত ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার চাওয়া
হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার
প্রধান দুটো ব্যাংকের শাখা আছে এই ক্যাম্পাসে। ইউনিয়ন হাউজের কাছে ওল্ড ফিজিক্স
বিল্ডিং এর নিচের তলায় ন্যাশনাল অস্ট্রেলিয়া ব্যাংক। আর কমনওয়েলথ ব্যাংক হলো
আর্কিটেকচার বিল্ডিং এর নিচের তলায়। আমাদের ফিজিক্স বিল্ডিং থেকে এটাই কাছে।
রিসেপশান
ডেস্কে অল্পবয়সী এক চায়নিজ মেয়ে কাজ করছে দেখে একটু ইতস্তত করছিলাম। এই মেয়েটিও
নিশ্চয় আর কাউকে ডেকে নিয়ে আসবে আমার কাজ করে দেবার জন্য।
“নেক্সট্ প্লিজ”
লাইনে
আমার সামনে আর কেউ নেই। এগিয়ে গেলাম। একাউন্ট খুলতে চাই শুনে বললো, “জাস্ট এ মিনিট”। বুঝে গেলাম এই মেয়েও সিনিয়র কাউকে ডেকে নিয়ে আসবে এখন।
কিন্তু না, সে নিচু হয়ে ডেস্ক থেকে একটা ফরম নিলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমার একটা
সেভিংস একাউন্ট হয়ে গেল। বর্তমানে আমার কোন ঠিকানা নেই তাই পাসপোর্টের স্থায়ী
ঠিকানাই ব্যবহার করা হলো। বললো বাসা পেলে যেন ঠিকানাটা এদের জানিয়ে দিয়ে যাই।
টেলিফোন নাম্বার নেই, তাও পরে জানালে হবে। সবকিছু এত সোজা এখানে! মাত্র পাঁচ ডলার
জমা দিলাম আমার সঞ্চয়ী হিসাবে।
মেয়েটির
নাম লী। উচ্চারণে একটুও চায়নিজ টান নেই। মনে হচ্ছে এদেশেই জন্মেছে সে। ব্যাংকের
নিয়ম-কানুন সম্পর্কে অনেক কিছুই বলে গেল লী। কিন্তু আমার লিসেনিং স্কিল এখনো অনেক
পেছনে। তাই অনেক কিছু না বুঝেই ‘ইয়েস’ ‘ইয়েস’ করলাম। যেটুকু বুঝলাম- স্টুডেন্টদের জন্য কোন ব্যাংক ফি
দিতে হয় না। মাসে চার ডলার করে বেঁচে যাবে। চারদিন পরে এসে ব্যাংক কার্ড নিয়ে যেতে
বললো লী।
ব্যাংক
একাউন্ট নাম্বার সহ স্কলারশিপ পেমেন্ট এডভাইজ ফরম জমা দিয়ে এলাম স্কলারশিপ অফিসে।
১৮৮৮ বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে গ্রাটান স্ট্রিট। ওটা ক্রস করে লেইচেস্টার স্ট্রিট ধরে
একটু সামনে এলেই ছোট্ট একটা পার্ক- ইউনিভার্সিটি স্কয়ার।
বেশ
ঠান্ডা বাতাস। পার্কের বেঞ্চিতে আঁকা দাবার বোর্ড ঘিরে ছোটখাট ভীড় জমেছে। দু’জন মধ্যবয়স্ক লোক দাবা খেলছেন। বারোটা বেজে
গেছে। মনে হচ্ছে এদেশে বারোটার পরপরই লাঞ্চ টাইম শুরু হয়ে যায়। পার্কের বিভিন্ন
জায়গায় বসে লাঞ্চ করছেন অনেকে।
রাস্তার
ওপারেই মেলবোর্ন বিজনেস স্কুল। এখানকার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম নাকি পৃথিবীর প্রথম
পাঁচটি ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের একটি। বিজনেস স্কুলের পাশে কয়েকটা দোতলা
টাউন-হাউজ। মনে হচ্ছে অনেক বছরের পুরনো। একটাতে লেখা আছে ‘মেলবোর্ন গ্র্যাজুয়েট হাউজ’। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের হোস্টেল টাইপের কিছু।
কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলাম। খোঁজ নিতে তো দোষ নেই।
দরজা
বন্ধ। রাস্তার ওপর একটা ছোট্ট লোহার গেট আছে। ওটা খোলা। ভেতরে ঢুকবো কি ঢুকবো না
ভাবছি- এসময় দরজা খুলে ব্যস্ত ভাবে বেরিয়ে এলো একজন। শীতের বিরুদ্ধে তার প্রস্তুতি
চোখে পড়ার মত। মাথায় কান-ঢাকা মোটা টুপি, বেশ মোটা জ্যাকেট গায়ে, হাতে চামড়ার
মোজা। শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে তার। সাহস করে বললাম, “এক্সকিউজ মি”
“ইয়েস”
“ইজ দিস আ হোস্টেল?”
“ইয়া, ফর পোস্টগ্র্যাড্স। আর ইউ ফ্রম
ইন্ডিয়া?”
“নো, আই এম ফ্রম বাংলাদেশ”
“ওহ্ বাংলাদেশ। ইউ লুক লাইক ইন্ডিয়ান। লুকিং
ফর একোমোডেশান?”
“ইয়েস। ডু ইউ লিভ হিয়ার?”
যার
সঙ্গে কথা বলছি তার ইংরেজি উচ্চারণ শুনে মনে হচ্ছে সে ইন্ডিয়ান। কিন্তু ঠিক বুঝতে
পারছি না সে ছেলে কি মেয়ে। গোলগাল মুখটার যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে গোঁফদাড়ির চিহ্ন
নেই। সারা শরীর এতই মোটা জ্যাকেটে ঢাকা যে দেখে বোঝার উপায় নেই। গলার স্বর শুনেও
বুঝতে পারছি না। বসে যাওয়া গলা- মনে হচ্ছে ঠান্ডা লেগেছে। সরাসরি তার জেন্ডার
সম্পর্কে প্রশ্ন করলে সে নির্ঘাত অপমানিত বোধ করবে। যদি ছেলে হয় ভাববে আমি তার
ছেলেত্বকে অপমান করেছি। আর মেয়ে হলে ভাববে আমি তাকে যথেষ্ঠ মেয়েলী মনে করছি না।
আমরা যতই নারী-পুরুষের সাম্যতা কামনা করি না কেন- শারীরিক ভাবে আমাদের
স্বাভাবিকতাকে কেউ অস্বীকার করলে ভীষণ আহত হই। সুতরাং সে ছেলে-মেয়ে যাই হোক- আমার
শুধু জানা দরকার এই হোস্টেলে থাকার খরচ কেমন।
“ইয়েস। বাট ইট্স ভেরি এক্সপেন্সিভ। আই এম
মুভিং আউট সুন।”
জানা
গেলো একটা ফার্নিস্ড রুমের জন্য এখানে সপ্তাহে ২২০ ডলার ভাড়া দিতে হয়।
ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে থাকার জন্যই এত ভাড়া দিতে হয়! বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটির
হলগুলোতে তো আমরা প্রায় বিনে পয়সায় থাকি। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।
পার্ক পেরিয়ে কিছুদুর এসে সামনে পড়লো মেলবোর্ন
ইউনিভার্সিটির আরো কয়েকটা বড় বড় বিল্ডিং। কম্পিঊটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং
বিল্ডিং-টি কেমন যেন একটু কালচে রঙের। তার সামনে রাস্তার ওপারে আরো একটি পার্ক।
লিংকন স্কয়ার। পার্কের ওপাশেই সোয়ান্সটন স্ট্রিট। পার্কে এখন অনেক মানুষ বেঞ্চে
বসে লাঞ্চ করছে। একটা ফোয়ারা আছে পার্কের মাঝামাঝি। তার চারপাশে সিমেন্টের বেদিতে
বসে আছে অনেকে। অফিসের লাঞ্চ টাইমে বেরিয়ে এসে পার্কে বসে খাচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে।
একটু পরেই আবার ফিরে যাবে যে যার কাজে।
সোয়ান্সটন স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে
এলাম সিটি সেন্টারে। বার্ক স্ট্রিটে এসে খুঁজে বের করলাম মেডিব্যাংক প্রাইভেট এর
অফিস। সোয়ান্সটন আর বার্ক স্ট্রিটের কর্নারে বিশাল এক শপিং কমপ্লেক্সের দোতলায় এই
অফিস। পাশেই মেডিকেয়ার অফিস। অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের জন্য সরকার বিনামূল্যে
চিকিৎসা সেবা দেয়। মেডিকেয়ার হলো অস্ট্রেলিয়ার স্থায়ী অধিবাসীদের জন্য। আর যারা
অস্থায়ীভাবে আসেন- তাদের জন্য প্রাইভেট হেলথ ইনস্যুরেন্স বাধ্যতামূলক। ওভারসিজ
স্টুডেন্টস হেল্থ ইনস্যুরেন্স এর জন্য আমাকে ২৭৪ ডলার পাঠিয়ে দিতে হয়েছে বাংলাদেশ
থেকেই। ওটা ছাড়া ভিসা দেয়া হয় না।
‘মেডিব্যাংক-প্রাইভেট’ অফিসের রিসেপশানে গিয়ে দু’মিনিটের মধ্যেই আমার কার্ড নাম্বার পেয়ে
গেলাম। তারা আমার অস্ট্রেলিয়ান ঠিকানা জানতে চাইলো যেখানে ডাকযোগে পাঠাবে আমার
মেডিব্যাংক কার্ড। কিন্তু আমার ঠিকানাতো এখনো হয়নি। বললো এক সপ্তাহ পরে এই অফিসে
এসে কার্ড নিয়ে যেতে। এর মধ্যে ডাক্তারের কাছে যেতে হলে মেডিব্যাংকের রসিদ দেখালেই
হবে- কোন ফি লাগবে না।
বার্ক
স্ট্রিট মলে হাঁটলাম কিছুক্ষণ। মায়আর নামক বিশাল পাঁচতলা ডিপার্টমেন্ট স্টোরে ঢুকে
কিছুটা দার্শনিক হয়ে গেলাম। এই যে এতসব জিনিসপত্র- জীবনের আরামের এতসব আয়োজন- আমার
কিছুরই দরকার নেই। এরকম কথা প্লেটো বা এরিস্টটল- কেউ একজন বলেছিলেন। তুমি নিশ্চয়
হাসছো আমার এই ধার করা দার্শনিকতায়। আসলে সামর্থ্য না থাকলে দার্শনিকতাই সম্বল।
সাড়ে চারটা বাজতে না বাজতেই দিনের আলো নিভে আসে
এখানে। ইয়ারার তীর থেকে সূর্যাস্ত দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আকাশ এত মেঘলা-
ডুবন্ত সূর্যের কয়েকটা রেখা মেঘের আড়াল থেকে একটূ ঊঁকি দিয়েই হারিয়ে গেল। টুপ্টাপ
বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার। ঠান্ডা বাতাস। হোটেলে ফিরে এসে এই তো এতক্ষণ বকবক করলাম
তোমার সাথে। টেলিফোন বাজছে।
____________________
PART 9
PART 9
No comments:
Post a Comment