২৩ জুলাই ১৯৯৮ বৃহস্পতিবার
“গুডামাইট, হাউ ইউ ডুইং?”
ডক্টর জেফ সুইটের পরনে আজও
হাফ-প্যান্ট আর হাফ শার্ট। ল্যাবোরেটরির নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় এরকম পোশাক আরামদায়ক,
কিন্তু বাইরে বেরোলেই তো ঠান্ডায় জমে যাবার কথা। অনুভূতির ব্যাপারটা মনে হয় সময়ের
সাথে বিপরীতানুপাতিক। সময় যত কাটতে থাকে, অনুভূতির তীব্রতা কমতে থাকে। মেলবোর্নের
এই সকালে চার-পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা আমার কাছে যতটা হাড়-কাঁপানো, জেফের
কাছে ততটা নয়। কারণ এই ঠান্ডার সাথে জেফের বসবাস কমপক্ষে ষাট বছর আর আমার কাটছে
মাত্র ষোল দিন।
‘গুডামাইট’ শব্দটা আরো অনেকবার শুনেছি। গতকাল জেফ কেন্কে বলেছিলেন
‘গুডাকেন্’। একটু ভাবতেই পরিষ্কার হয়ে গেলো শব্দটা। ‘গুডা’ মানে গুড ডে। ‘গুডাকেন্’- গুড ডে কেন্। আর ‘গুডামাইট’- গুড ডে মেইট। শুধুমাত্র উচ্চারণের কারণে
শব্দ কীভাবে বদলে যায়।
ভদ্রতার
দায় অনেক রকম। এই যে জেফ জানতে চাইলেন আমার দিনকাল কেমন যাচ্ছে তা শুধু ভদ্রতার
দায়ে। নইলে আমার জবাব শোনার জন্য অপেক্ষা করতেন। কিন্তু তিনি এখন একটা
স্পেকট্রোমিটারের কলকব্জা খোলায় ব্যস্ত। আমার অনেক কষ্টে তৈরি করা উত্তর “আই এম ফাইন, হাউ আর ইউ জেফ?” বৃথা গেলো।
ফার্স্ট
ইয়ার ফিজিক্স ল্যাবে এসেছি নিকের সাথে দেখা করতে। আসার আগে কম্পিউটার ল্যাবে গিয়ে মার্কের
কাছ থেকে ল্যাবের ইলেকট্রনিক এক্সেস সেট করে নিয়ে এসেছি। এখন থেকে যে কোন সময় এই
ল্যাবে ঢুকতে পারবো। নিকের সাথে দেখা করে জেনে নিতে হবে আমাকে কোন্ কোন্
এক্সপেরিমেন্ট দেয়া হয়েছে।
জেফের
কাছ থেকে জেনে নিয়ে চারতলায় উঠলাম। নিকের অফিস চারতলায় সেকেন্ড ইয়ার ফিজিক্স
ল্যাবের একদম শেষ প্রান্তে। ল্যাবের সারি সারি যন্ত্রপাতি সজ্জিত ডেস্কের মাঝখান
দিয়ে হেঁটে যাবার সময় অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল। এরকম সুসজ্জিত ল্যাবোরেটরি আগে
কখনো দেখিনি। এখন হঠাৎ একেবারে হাতের নাগালে চলে এসেছে বলেই উত্তেজনার প্রাথমিক
ধাক্কাটা এমন জোরে লাগছে।
নিক
নিকোলা- ল্যাবোরেটরি টেকনিশিয়ান। ফার্স্ট ইয়ার আর সেকেন্ড ইয়ারের ল্যাব দেখাশোনা
করেন। কলিনের অফিসের মতই হলুদ দেয়াল ঘেরা নিকের অফিস। আমাকে দেখে বেরিয়ে এলেন নিক।
সাদা এপ্রোন পরা পৌনে পাঁচ ফুট উচ্চতার নিক নিকোলার ভাবভঙ্গি ব্যস্ত ডাক্তারের মত।
“হাউ কেন আই হেল্প ইউ?”
এক্সপেরিমেন্ট
সম্পর্কে জানতে এসেছি শুনে বললেন, “ডোন্ট বি সো
সিরিয়াস মাই ফ্রেন্ড”। এত সিরিয়াস হবার কিছু নেই। আগামী
সপ্তাহের মধ্যে এক্সপেরিমেন্ট সেট হয়ে যাবে। তার পরের সপ্তাহ থেকে ল্যাব শুরু। তার
আগে যে কোন সময়ে এসে এক্সপেরিমেন্টগুলো নিজে নিজে একবার করে নিলেই হবে।
তিন
তলায় এসে ল্যাবের পাশের স্টাফ রুম দেখালেন নিক। এখানে ল্যাব-প্ল্যান আছে। দেখলাম
আমাকে ইলেকট্রিসিটি এণ্ড ম্যাগনেটিজম ল্যাব দেয়া হয়েছে চার সপ্তাহের জন্য। প্রথম
ক্লাস আগস্টের ছয় তারিখ। এখনো দু’সপ্তাহ
বাকি। নিকের কথাই ঠিক- এত সিরিয়াস হবার কিছু নেই। তবে কম্পিউটারের কিছু ব্যাপার
শিখে নেয়া দরকার। কারণ ল্যাবে স্টুডেন্টদের প্রত্যেকের জন্যই একটা করে কম্পিউটার
আছে এবং তারা ডাটা এনালাইসিসের জন্য কম্পিউটার ব্যবহার করে। নিজে না জেনে অন্যকে
শেখাতে যাবার মত দুঃসাহস আমার নেই।
কম্পিউটার
ল্যাবে তিনটা পর্যন্ত কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একটা কান ঢাকা টুপি কিনেছি দু’ডলারের দোকান থেকে। বেশ ভালো কাজ দিচ্ছে।
লাইগন স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে কুইন্সবারি স্ট্রিটে এসে বামে মোড় নিলাম। হাঁটতে
হাঁটতে রয়েল এক্সিবিশান সেন্টার। মেলবোর্ন শহরের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান।
১৮৮০
সালে তৈরি এই বিল্ডিংটা মেলবোর্নের অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। ১৮৮১ সালে মেলবোর্ন ইন্টারন্যাশনাল
এক্সিবিশান অনুষ্ঠানের জন্য এই ভবন তৈরি করা হয়েছিল। এর প্রধান ভবনটির ক্ষেত্রফল
বারো হাজার বর্গমিটারেরও বেশি। ১৯০১ সালে অস্ট্রেলিয়া যখন সবগুলো স্টেট নিয়ে
অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেশান গঠন করে, মেলবোর্ন থেকেই শুরু হয় তার কার্যক্রম।
অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেশানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল এই রয়েল এক্সিবিশান বিল্ডিং-এ।
পরে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত ভিক্টোরিয়ান স্টেট গভর্নমেন্টের কার্যক্রম চলে এখানে।
বিরাট
গম্বুজ ওয়ালা বিল্ডিংটার চারপাশে বাগান আর খালি জায়গা মিলিয়ে বিশাল কার্লটন
গার্ডেন। ঘাসে ঢাকা লন আর বড় বড় গাছ চারদিকে। বেশির ভাগ গাছের পাতা ঝরে গেছে। নতুন
বসন্তে নতুন পাতা গজাবে কয়েক মাস পর। ছোট্ট একটা ঝিলে বেশ কিছু হাঁস ভেসে
বেড়াচ্ছে। আমাদের দেশের হাঁসের মতই অতি সাধারণ হাঁস। বেশ কিছু কুকুর দেখা যাচ্ছে।
তাদের গলায় লাগানো লম্বা বেল্ট ধরে দ্রুত হাঁটছেন তাদের মালিকেরা। খুব মনযোগ দিয়ে
ব্যাপারটা দেখলাম কিছুক্ষণ। বুঝতে চেষ্টা করলাম কুকুর চরানোর ব্যাপারটা কত কঠিন। দেখে
মনে হচ্ছে খুব একটা কঠিন কাজ নয়। তবে কুকুর যখন পার্কে পায়খানা করে তখন পকেট থেকে
প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করে কুকুর-কর্ম সংগ্রহ করে পার্কের রাবিশ বিনে ফেলতে হয়। এই
ব্যাপারটা একটু অস্বস্তিকর।
কুকুরেরা
যে আমাকে বিশেষ পছন্দ করে না তার প্রমাণ ছোটবেলা থেকে অনেকবার পেয়েছি। মেলবোর্নে
এসেও যে কুকুর কর্তৃক তাড়িত হয়েছি তা তো তুমি জানো। তারপরও কুকুরের প্রতি আজ একটু
মনযোগ দিচ্ছি কারণ একটু পরে একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবো যেখানে কুকুরের একটা
ভূমিকা আছে।
বিজ্ঞপ্তিটা
চোখে পড়েছে আজ সকালে পাউরুটি কেনার জন্য সেফওয়েতে যাবার পথে। কার্লটন কোর্টে ঢোকার
সময় বাম পাশের দেয়ালে বেশ বড় একটা বোর্ড আছে হরেক রকমের লোকাল বিজ্ঞাপনে ভর্তি। “ডগ-ওয়াকার ওয়ান্টেড”। ডগ-ওয়াকিং মানে কুকুর হাঁটানো! গরু-ছাগল চরানোর মত
কুকুর চরানো। ঘন্টায় ছয় ডলার। প্রতিদিন বিকেলে দু’ঘন্টা। চাকরিটার প্রতি প্রয়োজনের চেয়েও কৌতূহল বেশি
অনুভব করছি। একটা বিচিত্র রকমের কাজের অভিজ্ঞতা হলে মন্দ কী।
বাসা
খুঁজে পেতে সমস্যা হলো না। পার্কের ওপারেই টাউন হাউজের নিচের তলায় ৬৭ নম্বর বাসা। ঠিক
চারটায় দরজায় নক করলাম। দুপুরে ফোন করেছিলাম মিসেস হাডসনকে। বিজ্ঞপ্তিতে ওই নামটাই
ছিল। গলা শুনে বুঝেছি বেশ বয়স হয়েছে ভদ্রমহিলার। কিন্তু দরজা খোলার পর যাঁকে
দেখলাম- মনে হচ্ছে তাঁর বয়স আরো অনেক বেশি।
হুইল
চেয়ারে বসে আছেন বিশাল মোটা একজন মানুষ। হঠাৎ দেখে মানুষ বলে বোঝা যায় না। তালতাল থলথলে
মাংসের স্তূপ। নিজের শরীরের কাছে মানুষ যে কত অসহায়!
“মিসেস হাডসন?”
“ইয়েস”- কন্ঠস্বরে যথেষ্ঠ জোর আছে মিসেস হাডসনের।
“গুড আফটারনুন মিসেস হাডসন। আই এম হিয়ার ফর
ডগ-ওয়াকিং”
কুকুর
চরানোর জন্য এসেছি শুনে মিসেস হাডসন তাঁর যন্ত্রচালিত হুইল চেয়ার পেছনে সরিয়ে বললেন,
“প্লিজ কাম ইন। হ্যাভ এ সিট”।
ছোট্ট
বসার ঘর। একপাশের দেয়ালে লাগানো একটা থ্রি-সিটার সোফা। সোফার গদি বেশ পুরনো
বিবর্ণ। ঘরের কোণায় একটা পুরনো টিভি চলছে, শব্দ কমানো। অন্যদিকের দেয়ালে রুম-হিটার
জ্বলছে। হিটারের সামনে মেঝের কার্পেটে শুয়ে আছে একটা প্রাণী।
মিসেস হাডসন গলা উঁচিয়ে
ডাকলেন “জনি, জনি”। জনি নামের
কেউ কোন সাড়াশব্দ করলো না। এবার বিরক্ত হয়ে উঠলেন মিসেস হাডসন। হুইল চেয়ার চালিয়ে
নিয়ে হিটারের সামনে শুয়ে থাকা প্রাণীটার গায়ের ওপর তুলে দিলেন প্রায়। এবার ধীরে
সুস্থে উঠে দাঁড়ালো প্রাণীটা। এরকম বিশ্রি কুকুর আমি জীবনেও দেখিনি। কুকুরটা মনে
হচ্ছে তার মালিকের সাথে মোটা হবার প্রতিযোগিতায় নেমে ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। হনুমানের
মত কুচকুচে কালো মুখের দু’পাশ থেকে
লালা গড়িয়ে পড়ছে।
“এই হলো জনি। আগে খুব করিৎকর্মা ছিল। এখন
আমার হাঁটা-চলা বন্ধ হবার পর থেকে জনির হাঁটা-চলাও বন্ধ হয়ে গেছে। তাই এই অবস্থা
তার”- বর্ণনা করছেন মিসেস হাডসন।
এদেশের
ছেলে-মেয়েরা আঠারো বছর হতে না হতেই মা-বাবাকে ছেড়ে যে যার মতো চলে যায়। মা-বাবা
তখন কুকুর পোষেন। অপত্য স্নেহ ঝরে পড়ে পোষা প্রাণীর ওপর। অনেক সময় পোষা কুকুর তার
প্রভুর উপকার করে, বোঝা টানে। কিন্তু মিসেস হাডসনের পোষা কুকুর জনি নিজেই বোঝা হয়ে
দাঁড়িয়েছে।
“তোমার নিজের কোন কুকুর আছে?”
“জ্বি না ম্যাডাম”
“কুকুর হাঁটানোর অভিজ্ঞতা আছে?”
কুকুর
হটানোর অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু হাঁটানোর তো নেই। বললাম, “জ্বি না ম্যাডাম”
“জনিকে হাঁটাতে পারবে? প্রতিদিন দু’ঘন্টা করে না হাঁটালে জনির মেদ কমবে না।
চেষ্টা করে দেখো তোমার সাথে জনির ভাব হয় কি না। এই নাও তার বেল্ট। পরাতে পারো কি
না দেখো”।
মিসেস
হাডসন স্টিলের কাঁটা লাগানো একটা বেল্ট ছুঁড়ে দিলেন আমার দিকে। জনির দিকে তাকালাম,
ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে আছে। মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে এখনো। এটার গলায় বেল্ট পরানো
আমার কম্মো নয়। কিন্তু চেষ্টা না করেই ছেড়ে দেবো? বেল্টটা নিয়ে জনির গলার দিকে হাত
বাড়ালাম। জনি নড়লো না একটুও, কিন্তু জিভ বের করে আমার হাতটা চেটে দিলো। বেল্ট
লাগাতে লাগাতে থিকথিকে ঘন লালায় হাত ভরে গেলো আমার।
মিসেস হাডসন বুঝতে পারছেন আমার অবস্থা। বললেন, “ইউ নেভার
হ্যান্ডেল এ ডগ বিফোর। লিভ ইট এলোন ইফ ইউ কান্ট”। অপমানে আমার
কান গরম হয়ে গেলো। সামান্য একটা কুকুরের গলায় বেল্ট বাঁধতে পারছি না বলেই কি অপমান
লাগছে? সবাই সব কাজ করতে পারবে এমন তো কথা নেই। অপ্রিয় সত্য কথা যত সহজভাবে হজম
করা যায় ততই ভালো। তবুও একবার শেষ চেষ্টা করলাম। জনির গলার বেল্ট ধরে হ্যাঁচকা টান
দিলাম। টানটা একটু জোরে হয়ে গেলো। জনি হঠাৎ এমন ভয়ংকর চিৎকার করে তেড়ে এলো আমার
দিকে- আমি সবকিছু ভুলে খোলা দরজা দিয়ে এক লাফে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। তারপর দৌড় আর
দৌড়। জনি আমার পিছু নিলে একদিনেই তার মেদ অনেক ঝরে যেতো।
বইটি পড়েছি। অনেক ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ লেখককে। এরকম আরো বই চাই।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ। চেষ্টা করবো আরো লিখতে।
Delete