২৫ জুলাই ১৯৯৮ শনিবার
স্কুল অব ফিজিক্স বিল্ডিং এর বাইরের
রঙটা কেমন যেন ম্লান ধূসর। তার ওপর একটা অংশে ঘন লাল রঙের ইট লাগানো। ধূসর শাড়ির
লাল পাড়ের মত উঠে গেছে সাত তলার কার্নিশ পর্যন্ত। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের আলো পড়েছে
সেই লাল পাড়ে। আলোর অনিয়মিত প্রতিফলনের সূত্র মেনে কিছুটা উপচে পড়া লাল আলো এখন
আমার অফিসের জানালায়। শনিবারের ছুটির দিনেও যারা কাজের নেশায় ছুটে আসে তাদেরও
অনেকেই চলে গেছে এর মধ্যে। আমি বসে আছি আমার ডেস্কে। মনটা কেমন যেন অনুভূতিহীন
ভোঁতা হয়ে আছে। তুমি আমার এই অনুভূতিহীন অনুভূতিটার নাম দিয়েছো রাইনো-সাইকোসিস। গণ্ডার-মানসিকতা,
নাকি গন্ডার-প্রবণতা?
তুমি
যে মাঝে মাঝে আমাকে গণ্ডারের সাথে তুলনা করো তার সঠিক কারণ কখনো ব্যাখ্যা করোনি।
মাথার সামনের দিকে বেরিয়ে আসা শিং-টা বাদ দিলে গণ্ডারের যে চেহারা হয় তার সাথে
আমার মুখের অনেক সাদৃশ্য আছে ঠিকই, কিন্তু শুধুমাত্র সেজন্যই আমাকে গণ্ডার বলে
ডাকবে অতটা ছেলেমানুষী যুক্তি তোমার নয়। মান-অপমান-অভিমান জাতীয় আবেগ অনুভূতি
গুলোর ব্যাপারে আমার প্রতিক্রিয়ার অতিধীর গতির কারণেই যে আমার ‘গণ্ডার’ উপাধি প্রাপ্তি তা আমি জানি। কিন্তু গণ্ডারের চামড়া ঠিক
কতটা পুরু তা কি তুমি জানো? ‘গণ্ডারের
চামড়া’ বাক্যাংশটা ছাড়া গন্ডারের আর কোন
ব্যবহার আমাদের জীবনে নেই। গণ্ডার তো আর আমাদের দেশের প্রাণী নয় যে আমরা তাদের পুষবো,
আর মাঝে মাঝে কোন না কোন অলৌকিক কৃপা প্রাপ্তির আশায় একটা দুটো বলি দেবো, তারপর
তাদের মাংস খাবো আর চামড়ার পুরুত্বের সদ্ব্যবহার করবো। গণ্ডার প্রসঙ্গটা মনে পড়ার
কারণ হলো আজ নিজেকে সত্যি সত্যিই গন্ডার মনে হচ্ছে। ছোটখাট একটা কাজের জন্য এতদিন
এতভাবে ব্যর্থ হয়েও আমার শিক্ষা হলো না। আজকেও আরো কয়েকটা ‘পিলার অব সাকসেস’ অর্জন করলাম।
সকাল
থেকেই শুরু করি। ঘুম ভাঙতেই জানলায় ঝকঝকে রোদ। ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি, আজ আমাদের ছুটি,
ও-ভাই আজ আমাদের ছুটি’। কত প্রিয় কত মিষ্টি একটা শব্দ- ‘ছুটি’। ক’দিন আগেও দিনগুলো
কত অন্যরকম ছিল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হতো বন্ধুদের সাথে আড্ডা। তারপর
মামামের সাথে গল্প, দিদিভাইর সাথে নতুন কোন বই বা কলেজের কোন ঘটনা নিয়ে মজার মজার
তর্ক বাধিয়ে ভরপেট খেয়ে মাঝরাতে বাসায় ফেরা। শুক্রবার এগারোটা পর্যন্ত পড়ে পড়ে
ঘুমানো। তারপর দিদির বাসায় গিয়ে সোজা খাবারের টেবিলে বসে যাওয়া। ছোট ছোট দস্যি
দুটোর সাথে সারা দুপুর বিকেল হুল্লোড় করা। মনে হচ্ছে এক যুগ কেটে গেছে প্রবাসের
নির্বাসনে এসেছি। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ছুটির দিন এখানে কত অন্যরকম।
ন’টা বাজার আগে থেকেই প্রচন্ড জোরে শব্দ
হচ্ছিলো দরজার বাইরে। কাঠে পেরেক ঠোকার শব্দ, ড্রিল মেশিনের শব্দ। ঘর থেকে বেরিয়ে
দেখলাম ফিল লাউঞ্জ আর কিচেনে যাবার মাঝখানে একটা পার্টিশান দিচ্ছেন। নিজেই
মিস্ত্রি। চক্ষুলজ্জা হয়েছে তাহলে? কাল রাতে কিচেন থেকে বেরিয়ে কী যে একটা
অস্বস্তিকর দৃশ্যের সামনে পড়েছিলাম। ফিল মনে হয় মাতাল হয়েই ফিরেছিল ক্যাথিকে নিয়ে।
নইলে এতটা নির্লজ্জ হতে পারতো না। ফিলের সাথে আমার চোখাচোখি হয়েছে, হাত তুলে ‘হাই’ও বলেছেন আমাকে। আমি দেখেও না দেখার ভান করে চলে এসেছি। নিজের
এপার্টমেন্টে সঙ্গিনীর সামনে নিরাবরণ ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা ফিলের নিশ্চয় আছে।
তবে সেটা লাউঞ্জে না করে বেডরুমে করলে হয় না?
নেশা
কেটে যাবার পর ফিল যে কিছুটা লজ্জিত হয়েছে তা বুঝতে পারলাম সকালের একটা ঘটনায়। এ
বাসায় প্রথম শনিবার আজ। ময়লা জামাকাপড় জমে গেছে অনেক। ধোয়া দরকার। প্লাস্টিকের একটা
বালতি কিনে এনেছিলাম, কাজে লেগে গেলো। বাথটাবে বসে উদয়দার দেয়া হুইল সাবানে প্রচুর
ফেনা তুলে কাপড় কাচতে গিয়ে হয়তো একটু বেশি শব্দ করে ফেলেছিলাম। বাথরুমের দরজায়
ধুম-ধুম শব্দ আর ফিলের চিৎকার এক সাথে শোনা গেল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বাথরুমে কি
কাপড়-কাচা নিষেধ? নিষেধ থাকলে দেয়ালে নোটিশ লাগানো থাকতো। যেমন রান্নাঘরের দেয়াল
এখন হরেক রকমের নোটিশে ভর্তি। কিন্তু বাথরুমে কাপড়-কাচা সংক্রান্ত কোন নোটিশ চোখে
পড়ে নি। বাথরুমের আয়নায় যে স্টিকারটা দেখা যাচ্ছে তাতে লেখা আছে “হোয়াট ইউ ক্যান ডু টুমরো, নেভার ডু ইট টু-ডে”- যে কাজ কাল করলেও চলবে তা কিছুতেই আজকে
করো না। কিন্তু তার সাথে কাপড়-কাচার কোন সম্পর্ক নেই।
বাথরুমের
দরজা খুললাম।
“হোয়াট ইউ ডুয়িং?” হাসিমুখে জানতে চাইলেন ফিল। ভয়ের কিছু নেই তাহলে।
“ওয়াশিং ক্লথ্স”
“কাম উইথ মি। আই উইল শো ইউ সামথিং”
আমার
পরনে ভেজা লুঙ্গি, নিজেও আধভেজা। এ অবস্থায় বেরোতে ইতস্তত করছি দেখে ফিল বললেন, “তোমাকে লন্ড্রি রুম দেখাতে চেয়েছিলাম। ওয়াশিং
মেশিন, ড্রায়ার সব আছে সেখানে”
“প্লিজ গিভ মি ফাইভ মিনিট্স”
পাঁচ
মিনিটের মধ্যে জামাকাপড় বদলে, কাচা কাপড়গুলো বালতিতে ভরে ফিলের সাথে বেরোলাম
এপার্টমেন্টের বাইরে। বিল্ডিং এর মাঝখানে যেখানে লিফ্ট- তার অপরদিকে কমন
লন্ড্রিরুম। দু’দিকের দুটো দরজা তালাবদ্ধ থাকে
সবসময়। প্রত্যেক এপার্টমেন্টেই চাবি আছে। ফিল দরজা খুলে দিলেন। কমার্শিয়াল সাইজের
দুটো ওয়াশিং মেশিন আর দুটো ড্রায়ার- বিশটা ফ্যামিলির জন্য যথেষ্ঠ। বিল্ডিং এর
প্রত্যেক ফ্লোরেই একটা করে আছে। একেবারে বিনামূল্যে এমন সুবিধা আর কোথায় পাওয়া
যায়? কিন্তু ফ্রি জিনিসের যে যত্ন থাকে না তার প্রমাণ পেয়ে গেলাম প্রথম দিনেই।
একটা ড্রায়ার খুলে দেখা গেলো ভেতরে একজোড়া কাপড়ের জুতা আর একটি পাপোষ। সুযোগের
অপব্যবহার তো দেখছি ইউনিভার্সাল।
ফিল
খুব উৎসাহ নিয়ে আমাকে শেখাচ্ছেন কীভাবে ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে কাপড়
শুকাতে হয়, ড্রায়ার এনগেজ্ড থাকলে কী করতে হবে। লন্ড্রি রুমের পাশে আরেকটি রুম
আছে। লন্ড্রির চাবিতেই খোলা যায়। সেখানে কাপড় মেলে দেয়ার ব্যবস্থা আছে। ফিলের এরকম
হাসিখুশি আন্তরিক ব্যবহার আগে কখনো দেখিনি। মানুষ যখন অপরাধবোধে ভোগে- তখন হঠাৎ
এরকম ‘ভালো’ ব্যবহার শুরু করে।
সাড়ে
দশটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। জুলাই মাসের রোদ কতক্ষণ থাকবে কেউ জানে না। সেফ-ওয়েতে
গেলাম। কাল রাতে একটা ফরম নিয়ে এসেছিলাম। আজ জমা দিয়ে এলাম। খন্ডকালীন কাজের দরখাস্ত।
কাউন্টারের মেয়েটি বলেছে- স্টোর ম্যানেজার ফোন করে জানাবেন কখন ইন্টারভিউ ইত্যাদি।
দরখাস্তে ফিলের ফোন নম্বর দিয়েছি। সন্ধ্যাবেলা ফোন করলে ফিল আমাকে নিশ্চয় ডেকে
দেবেন।
শনিবারের
‘এজ’ পত্রিকা কেনা ছেড়ে দিয়েছি। পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন
দেখে কাজ জোগাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না বলে মেনে নিয়েছি। গতকাল স্টুডেন্ট
সেন্টার থেকে আরো কিছু কাজের খবর টুকে এনেছি। ভিন্ন ভিন্ন রকমের কাজ। পার্ট-টাইম
একটা কাজের জন্য ছটফট করার পেছনে কেমন যেন একটা জেদ কাজ করছে বুঝতে পারছি। কাজ না
করলে যে একেবারে না খেয়ে মরতে হবে তা কিন্তু নয়। বাস্তব হিসেব করে দেখেছি
স্কলারশিপের টাকা দিয়ে টিউশন ফি কভার হয়ে যাবে। আর ডিপার্টমেন্টে পড়িয়ে যা পাওয়া
যাবে তাতে থাকা-খাওয়া চলবে। কিন্তু কথা সেটা নয়। কথা হলো সবাই কাজ পাচ্ছে, আমি
পাবো না কেন। যে কোন একটা কাজ পেয়ে গেলেই দেখা যাবে কাজ খোঁজার ইচ্ছেটাই চলে গেছে
আমার।
প্রথম
ফোনটা করলাম ঠিক এগারোটা পাঁচ মিনিটে। কী কী বলবো আগে থেকে ঠিক করে রেখেছি। কিন্তু
শুধুমাত্র মুখস্ত করা সংলাপে যে হবে না তাও জানি।
“গুড মর্নিং। ক্যান আই স্পিক টু মিস স্কাইলা
প্লিজ”
“ইয়েস, স্পিকিং”
পরবর্তী
সংলাপগুলো বাংলায় বললে এরকম শোনাতোঃ
“আমার নাম প্রদীপ। শুনেছি আপনাদের কোম্পানিতে
নাকি ক্লিনার নিচ্ছেন? আমি ওই কাজের জন্য আগ্রহী”
“আপনার গাড়ি আছে?”
একটু
অবাক হলাম। গাড়ি থাকলে আমি ক্লিনারের চাকরি খুঁজি? কিন্তু প্রশ্নের বদলে প্রশ্ন
করা যায় ইন্টারভিউ নেবার সময়, দেবার সময় নয়। বললাম- “না ম্যাডাম, আমার গাড়ি নেই”
“সরি। গাড়ি না থাকলে এ কাজ আপনি করতে পারবেন
না”
“আমি বুঝতে পারছি না ম্যাডাম। গাড়ির সাথে এ
কাজের কী সম্পর্ক?”
“হাঃ হাঃ হাঃ” ওপ্রান্তে জোরে হাসির শব্দ। মনে হচ্ছে স্কাইলা ম্যাডাম এরকম
প্রশ্ন আগে কখনো শোনেন নি। স্কাইলার কথায় একটা অদ্ভুত টান আছে- ঠিক কোন্ অঞ্চলের
টান বুঝতে পারছি না। তবে তিনি যে অস্ট্রেলিয়ান নন তাতে কোন ভুল নেই। বললাম, “সরি ম্যাডাম। আমি আসলে নতুন এসেছি এই দেশে।
ঠিক জানি না ক্লিনিং এর জন্য কেন গাড়ি লাগবে”
“সব সময় যে লাগবে তা নয়। তবে আমাদের
কোম্পানিতে লাগবে। কারণ আমাদের বেশির ভাগ কাজ থাকে এয়ারপোর্টে। ভোর চারটা থেকে
শুরু হয়। তখন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট থাকে না। নিজের গাড়ি না থাকলে কাজে আসবেন
কীভাবে?”
“থ্যাংক ইউ ম্যাডাম। থ্যাংক ইউ ফর ইওর টাইম”
“ও-কে। বাই”
যে
সমস্ত কাজকে আমি খুব বেশি সহজ বলে ভেবেছিলাম- সেগুলোই দেখছি সবচেয়ে কঠিন। আরেকটা
সহজ কাজের খবর হাতে আছে-গার্ডেনিং।
বাগান
করার ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা মারাত্মক। গ্রামের ছেলে হলেও বাগান করার প্রতি তেমন
উৎসাহ আমার কোন কালেই ছিল না। কারণ আমাদের বাড়িতে বাগান করার জায়গা তো দূরের কথা,
ঠিকমত একটা উঠোনও নেই। বাড়ির জায়গাটাও বাবাকে কত পরিশ্রম করে অন্যের কাছ থেকে চড়া
সূদে টাকা ধার করে কিনতে হয়েছে। তাই ‘নেই’ বলে কোন অভিযোগ আমাদের পক্ষ থেকে
ছিল না কোন দিনই। তবুও মাঝে মাঝে দাদাকে দেখতাম কোথা থেকে জবা ফুলের একটা ডাল কেটে
এনে যেন তেন ভাবে একটা কোণে পুঁতে দিচ্ছে। কিছুদিন পরে দেখা গেলো ওটাতেই নতুন পাতা
গজাচ্ছে, ফুল ফুটছে। তার দেখাদেখি আমিও মাঝে মাঝে ওরকম করতাম। একবার কাঠ-গোলাপের
একটা ডাল পুঁতেছিলাম। একটা-দুটো নতুন পাতাও গজিয়েছিল, কিন্তু বাঁচেনি। আম খেয়ে
আমের আঁটি পুঁতে রাখতাম মাটিতে। কিছুদিন পর গাছ জন্মালে আনন্দ হতো খুব। কিন্তু ওই
পর্যন্তই। এগুলোকে নিশ্চয় বাগান-করা বোঝায় না। বড় হবার পর ছোটবেলায় যেটুকু উৎসাহ
ছিল তাও গেছে। দাদার বিয়ের পর বৌদিকে দেখলাম সিরিয়াসলি বাগান করতে। সে বড় হয়েছে
বাগানময় পরিবেশে। কত রকমের গোলাপ যে আছে তাদের বাগানে। আমাদের বাড়িতে আসার সময় তার
সাথে এলো অনেকগুলো গোলাপের টব। ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে তার সাধের ছাদের গোলাপ বাগানে
কাজ করলাম একদিন। টবের মাটি কুপিয়ে দেয়া, কিছুটা গোবর মেশানো, আর পানি দেয়া। এগুলো
নিশ্চয় কঠিন কোন কাজ নয়। খুব আন্তরিক ভাবেই করলাম। পরদিন ছুটি শেষ, চলে এসেছি।
পরের সপ্তাহে খবর পেলাম যে ক’টা গোলাপ
গাছের সেবা আমি করেছিলাম তার সবগুলোই জীবনের মায়া ত্যাগ করেছে। বুঝতেই পারছো আমার
গার্ডেনিং-এর অভিজ্ঞতা কতটা মারাত্মক। কিন্তু এসব কথা বলা যাবে না মিসেস অনিতা
রুথকে।
অনিতা
রুথ- ভারতীয় নাম মনে হচ্ছে। ফোন করলাম। খুব মিষ্টি গলা অনিতা রুথের। গার্ডেনিং এর
ব্যাপারে ফোন করেছি শুনে বললেন, “আমি সেই
সকাল থেকে অপেক্ষা করছি। ওরা বলেছিল দশটায় আসবে। এখনো তো দেখা নেই। কোথায় থাকো
তুমি?”
“কার্লটন”
“তাহলে তো খুব কাছে। এখন আসতে পারবে?”
“ইয়েস ম্যাডাম। এখুনি আসতে পারবো। ঠিকানাটা
যদি আবার বলতেন”
ব্রাঞ্চউইকের
ঠিকানা। বাসা খোঁজার সময়ের এরিয়া ম্যাপটা কাজে লেগে গেলো। আধঘন্টা লাগলো ০১ নম্বর
ট্রামে যেতে। কোবার্গে যে বাসা খুঁজতে গিয়েছিলাম সেদিকেই অনিতা ম্যাডামের বাসা।
সুন্দর ঝকঝকে সাবার্ব। প্রায় সব বাড়ির সামনেই বাগান। বাসা খুঁজে পেতে দেরি হলো না।
লাল
ইট আর টালির ছাদের ছোট ছিমছাম সুন্দর বাড়ি। বাড়ির সামনেই লোহার রেলিং ঘেরা বাগান।
অনেক রকম ফুল। হলুদ কুমড়ো ফুলের মত দেখতে ফুলগুলোই যে ড্যাফোডিল তা জেনেছি মাত্র ক’দিন আগে। অথচ ড্যাফোডিলের নাম শুনছি ছোটবেলা
থেকে। গোলাপের সিজন নয় এটা। গাছগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছে সাইজ করতে হবে ওদের। ডাল
কাটতে হবে, মাটি কোপাতে হবে, তৈরি করে রাখতে হবে আগামী সিজনের জন্য। শীত শেষ হতে
না হতেই তো মৌসুম শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু গোলাপ সম্পর্কিত পূর্ব-অভিজ্ঞতার কারণে
কিছুটা ভয়ও লাগছে। বৌদির অতগুলো গোলাপ গাছ হত্যা করেও বেঁচে গেছি তার স্বামীর
ছোটভাই হবার সুবাদে। কিন্তু অনিতা ম্যাডামের সাধের গোলাপের কিছু হলে আমাকে আস্ত
রাখবেন? তাছাড়া গার্ডেনিং এর জন্য কোন লাইসেন্স লাগে কি না তাও তো জানি না। এদেশে
তো শুনি বড়শি দিয়ে মাছ ধরার জন্যও লাইসেন্স লাগে।
লোহার
ছোট্ট গেটটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই বাড়ির বারান্দা থেকে বাগানে নেমে এলেন একজন বয়স্ক
মহিলা। পরনে একটা লম্বা ওভারকোট। পায়ে নরম তুলোর জুতো।
“গুড ডে ম্যাম”
“গুড ডে”
গলার
স্বর শুনে বুঝলাম ইনিই মিসেস অনিতা রুথ। আমার কল্পনার সাথে যার একটুও মিল নেই।
যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি বয়স্ক এই মহিলা। গায়ের রঙ ধবধবে সাদা। চেহারা,
উচ্চতা, গড়ন সব মিলিয়ে স্নিগ্ধ একটা ভাব। ভারতীয় হবার কোন সম্ভাবনা নেই।
একটু
আগে আমিই ফোন করেছিলাম জেনে বললেন, “খুব ভালো হয়েছে তুমি এসেছো। এই হলো বাগান। আজকের মধ্যে ঠিক করে ফেলতে পারবে
না?”
“কী কী করতে হবে?”
“তুমি নিশ্চয় জানো কী কী করতে হবে।
গোলাপগুলোকে ঠিক করে দিতে হবে। আর ওদিকে ছয়টা নতুন বেড হবে। কী রকম চার্জ করো
তোমরা?”
“জ্বি ম্যাডাম?”
“তুমি কি ইন্ডিপেন্ডেন্টলি কাজ করো, নাকি কোন
কোম্পানির হয়ে কাজ করছো? তোমার এসিস্ট্যান্ট নেই কেউ?”
“জ্বি না ম্যাডাম, আমি একা”
“নট এ প্রোব্লেম। কত নেবে পুরোটা করতে?”
“আপনি যা দেন ম্যাডাম”
“ঠিক আছে। পুরোটার জন্য পঞ্চাশ ডলার পাবে।
রাজী হলে কাজে লেগে যাও”
“ও-কে ম্যাডাম”
“বাম দিকের কোণা থেকে শুরু করো”
“ও-কে ম্যাডাম। যন্ত্রপাতি কোথায়?”
“ইন ইওর কার, আই বিলিভ”
আমার
গাড়ির মধ্যে যন্ত্রপাতি! বিপদের গন্ধ পাচ্ছি। অনিতা ম্যাডাম আমাকে পেশাদার
গার্ডেনার মনে করেছেন। বোকার মত তখনো দাঁড়িয়ে আছি দেখে অনিতা বুঝে গেলেন আমার
অবস্থা।
“ইউ আর নট প্রফেশনাল”
“সরি ম্যাডাম”
“তোমার গার্ডেনিং ইকুইপমেন্ট কিছুই নেই”
“না ম্যাডাম”
“দেশ কোথায়?”
“বাংলাদেশ”
“অস্ট্রেলিয়ায় কত দিন?”
“সতের দিন”
মিসেস
অনিতা রুথ কয়েক সেকেন্ড আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ঘরের ভেতর চলে গেলেন।
পালিয়ে আসার এই সুযোগ। কিন্তু কিছু না বলে চলে আসাটা অভদ্রতা। তাছাড়া হয়তো তিনি
যন্ত্রপাতি আনতে গেছেন।
একটু
পরেই বেরিয়ে এলেন অনিতা। হাতে কোন যন্ত্রপাতি নেই। সামনে এসে মুখটা হাসি হাসি করে
বললেন, “তোমার অবস্থা আমি বুঝতে পারছি।
কিন্তু দুঃখিত, পেশাদারী দক্ষতা ছাড়া এ জাতীয় কাজ তুমি করতে পারবে না। করা উচিতও
নয়। এই নাও দশ ডলার।”
কাজ
দিতে পারছেন না বলে টাকা দিতে চাইছেন। মিসেস রুথের উদারতায় আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
কিন্তু কাজ না করে টাকা নেয়া আর ভিক্ষা নেয়ার মধ্যে পার্থক্য কী? বললাম, “অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম। আমাকে টাকা দেয়ার
দরকার নেই।”
“না, না। রাখো এটা। আমি তোমাকে আসতে বলেছি। আমার
উচিত ছিল তোমাকে সব জিজ্ঞেস করা”
“ঠিক আছে ম্যাডাম। টাকা লাগবে না। আপনার সময়
নষ্ট করার জন্য দুঃখিত”।
চলে
এলাম। ট্রামের টিকেটের মেয়াদ আছে আরো ঘন্টাখানেক। ইউনিভার্সিটির স্টপে না নেমে চলে
গেলাম ফ্লিন্ডার স্ট্রিট পর্যন্ত। ট্রাম থেকে নেমে এগোলাম ইয়ারার দিকে। অনেকগুলো
ঘোড়ার গাড়ি আজ সোয়ান্সটন স্ট্রিট আর ফ্লিন্ডার স্ট্রিট স্টেশনের সামনে।
ট্যুরিস্টদের অনেকেই চড়ছে ঘোড়ার গাড়িতে।
ইয়ারার
দুই তীরে অনেক ভীড় আজ। শনিবারের দুপুরে এরকম ভীড় স্বাভাবিক। আকাশে একটু একটু মেঘ
জমতে শুরু করেছে। সন্ধ্যার আগেই হয়তো বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ লক্ষ্যহীন
হাঁটলাম ইয়ারার তীর ধরে। ঠান্ডা দমকা
হাওয়ায় বেশিক্ষণ হাঁটা গেলো না, ফিরে এলাম। ট্রামে চড়ার মানে হয় না। দশ মিনিটের
মধ্যে চলে এলাম মেলবোর্ন সেন্ট্রালের সামনে।
দুটো
বাজতে মিনিট পাঁচেক বাকি। সেন্ট্রালের বড় ঘড়িটার বাজনা শুরু হবে দুটো বাজলেই। দেখা
যেতে পারে। নিউজ এজেন্টের পাশ দিয়ে যাবার সময় কাচের দরজায় লাগানো বিজ্ঞাপ্তিটা
চোখে পড়লো- “পার্ট-টাইম সেল্স পজিশান এভয়েলেভল,
আস্ক এট দি কাউন্টার”।
জাপান
সরকারের দেয়া বিশাল ঘড়িটায় গান বাজনা শুরু হয়ে গেলো একটু পরেই। অনেকে ছবি তুলছে,
ভিডিও করছে। আমার মাথায় ঘুরছে পার্ট-টাইম সেল্স পজিশান। পেপার, ম্যাগাজিন,
স্টেশনারির বিরাট ব্যস্ত দোকানের সেল্স পার্সন। সহজ কাজ- কাউন্টারে দাঁড়িয়ে
স্ক্যান করো আর ক্যাশ রেজিস্ট্রারের হিসেব মত টাকা নাও। কিন্তু প্রধান সমস্যা তো
কমিউনিকেশান। অনেক চেষ্টায় কয়েকটা ইংরেজি বাক্য বলতে পারি ঠিকই, কিন্তু অন্যের
বাক্য তো বুঝতে পারি না। তবে চেষ্টা করে দেখতে তো অসুবিধে নেই। আরো একটা ব্যর্থতার
অভিজ্ঞতা হবে।
পাশাপাশি তিনটি ক্যাশ রেজিস্ট্রার। দু’জন তরুণী আর
একজন মধ্যবয়সী পুরুষ কাজ করছেন সেখানে। মোটামুটি ভীড়। পুরুষটার পরনে কোট-টাই।
গম্ভীর চাউনিতে প্রবল ম্যানেজারিয়্যাল ভাব। সামনে যেতেই মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে
জিজ্ঞেস করলেন, “হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”
পার্ট-টাইম সেল্স পজিশানের জন্য
আগ্রহী শুনে আমার আপাদমস্তক দেখলেন কয়েক বার। শেভ করিনি, জামাকাপড়ের যা অবস্থা-
ইচ্ছে করছে এক ছুটে পালিয়ে যাই। কিন্তু উপায় নেই। বল এখন ম্যানেজারের কোর্টে। তাঁর
ঠোঁটের কোণায় বিদ্রুপের হাসি ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
“ডু ইউ নো
এনিথিং এবাউট সেলিং?”
“নাথিং মাচ, বাট
আই থিংক আই ক্যান”
“ইউ থিংক সো?
ও-কে। ফিল-আপ দিস ফর্ম। উই উইল লেট ইউ নো”।
সাথে
কলম নিয়ে বেরোই নি। ফর্ম হাতে নিয়ে ম্যানেজারের দিকে তাকাতেই তিনি একটা বলপয়েন্ট
এগিয়ে দিলেন। নাম, ঠিকানা, ইমেইল, ফোন নাম্বার আর সপ্তাহের কোন্ কোন্ দিনের কোন্
কোন্ সময়ে কাজ করতে আগ্রহী- জানতে চাওয়া হয়েছে ফর্মে।
ম্যানেজারের
হাতে ফরম আর কলম ফেরত দেয়ার সময়ও দেখলাম তাচ্ছিল্যের ভাবটা যায়নি তাঁর চাউনি থেকে।
কী জানি, হয়তো তাঁর চেহারাটাই এরকম। আমারই আত্মবিশ্বাসের অভাবে মনে হচ্ছে আমাকে
তিনি তুচ্ছ করছেন। সে যাই হোক। আমার মন বলছে এখান থেকে কখনোই ফোন করা হবে না
আমাকে।
বেরিয়ে
দ্রুত হেঁটে চলে এসেছি অফিসে। হাঁটতে হাঁটতে ভেবেছি- যথেষ্ঠ হয়েছে। চাকরি খোঁজায়
ক্ষান্ত দেয়া দরকার এবার। এভাবে চলতে থাকলে তো আত্মবিশ্বাস মাথা থেকে হাঁটুতে নেমে
আসবে।
সকাল
থেকে খাওয়া হয়নি কিছুই। সকালে সেফওয়ে থেকে বিস্কুট কিনেছিলাম দু’প্যাকেট। সাত তলায় উঠে দেখলাম- স্টাফ-রুম
খোলা। কাবার্ড থেকে মগ নিয়ে চা বানালাম। টেবিলে কিছু ডোনাট্স দেখা যাচ্ছে।
প্রতিদিনই কোন না কোন গ্রুপের মিটিং সেমিনার থাকে। সে উপলক্ষে খাবারও থাকে। ডোনাট্সগুলো
হয়তো কালকের কোন মিটিং এর অবশিষ্ট। দুটো ডোনাটেই পেট ভর্তি হয়ে গেলো। স্টাফ রুমের
চার পাশের তাকে রাখা সাম্প্রতিক রিসার্চ জার্নালগুলোতে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে ফিরে
এসেছি নিজের ডেস্কে। তারপর এই তো এতক্ষণ বক বক করলাম তোমার সাথে। একটা ফোন করতে
পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু উপায় তো নেই।
No comments:
Post a Comment