আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল রে দিন
বয়ে
বাঁধন-হারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে
বাঁধন-হারা
বৃষ্টিধারা ঝরছে ঠিকই- কিন্তু এখন আষাঢ়সন্ধ্যা নয়, আষাঢ়-রাত। রাত একটা বেজে গেছে। সন্ধ্যাবেলা
যখন তোমাকে লিখছিলাম- তখন আলী সাহেব ফোন করেছিলেন। কী করছি, হোস্টেল দেখেছি কি না
খবর নিলেন। আমি গতকাল রিচমন্ডে যে হোস্টেল দেখে এসেছি তার বর্ণনা দিলাম। তিনি
বললেন ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি কোন হোস্টেল আছে কি না খবর নিতে।
“জাস্ট টেলিফোন
দেম এন্ড আস্ক ইফ দেয়ার ইজ এনি রুম এভয়লেভল”
“কিন্তু স্যার
আমি তো কোন হোস্টেলেরই টেলিফোন নাম্বার জানি না”
“ইয়েলো পেইজ থেকে সব হোস্টেলের টেলিফোন
নাম্বার পাবে। ও- না, হ্যাং অন। আমি তো ভুলে গিয়েছিলাম যে তুমি হোটেলে আছো।
হোটেলের টেলিফোন ব্যবহার করবে না, ওরা অনেক বেশি চার্জ করে। দাঁড়াও, আমি খোঁজ নিয়ে
জানাচ্ছি একটু পরে”।
আলী
সাহেব আমার জন্য কত কষ্ট করছেন। যারা বলেন- বাঙালী স্বার্থপর- তাঁরা নিশ্চয় আলী
সাহেবের মত বাঙালীদের দেখেননি।
মিনিট
দশেক পরেই আবার আলী সাহেব ফোন করলেন।
“শোন, তোমার জন্য একটা হোস্টেল ঠিক করে
ফেলেছি। নর্থ মেলবোর্নে- ইয়ারা ইয়থ হোস্টেল। তোমার ইউনিভার্সিটির কাছেই। সাড়ে
সতেরো ডলার ভাড়া। কাল বিকেল তিনটার মধ্যে যেতে হবে”
“জ্বি স্যার। ঠিকানাটা?”
“ঠিকানা বললেও তো তুমি নিজে নিজে যেতে পারবে
না জিনিস-পত্র নিয়ে। আমি দুপুরে এসে তোমাকে দিয়ে আসবো সেখানে। তুমি হোটেলের সামনে
থাকবে। আমি একটা থেকে দেড়টার মধ্যে আসবো”
লাইন
কেটে গেল। আলী সাহেবকে ঠিকমত একটা ধন্যবাদও দিতে পারলাম না। এই হোটেলের পাট চুকলো
আমার। আজকের রাতটাই এখানে শেষ রাত। হয়তো আর কখনোই আসা হবে না এই হোটেলে। বাংলাদেশে
একটা ফোন করা দরকার। টেলেস্ট্রা ফোন কার্ডটা শেষ হয়ে গেছে। আলী সাহেব বলেছেন দেশে
ফোন করার জন্য অনেক সস্তা ফোন কার্ড পাওয়া যায়। সেরকম একটা কার্ড কেনার জন্য
বেরোলাম।
বৃষ্টি
হচ্ছে খুব। মেলবোর্নে মনে হয় শীত আর বর্ষা একসাথে থাকে। সেভেন-ইলেভেন নামের দোকান
দেখছি মেলবোর্নের সব রাস্তাতেই আছে। অনেকটা বাংলাদেশের পাড়ার মোড়ের ঠেকার দোকানের
মত। এরা বলেন- কনভেনিয়েন্ট স্টোর। চব্বিশ ঘন্টা খোলা থাকে। দরজার বাইরে ওভারসিজ
ফোন-কার্ডের “৭০% ফ্রি টক-টাইম” বিজ্ঞাপন দেখে ঢুকলাম ভেতরে। একজন চায়নিজ
যুবক কাউন্টারে। এত বড় দোকান সে একাই সামলাচ্ছে। দেয়ালে লাগানো টিভি-মনিটরে চোখ
গেল। ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন। কাউন্টারে দাঁড়িয়েই দোকানের সব কাস্টমারের দিকে নজর
দেয়া যায়। যার যা লাগে শেল্ফ থেকে নিয়ে কাউন্টারে এসে দাম দিয়ে চলে যাচ্ছে।
“ক্যান আই গেট এ ওভারসিজ ফোন কার্ড প্লিজ”
শ্বেতাঙ্গ অস্ট্রেলিয়ানদের সাথে কথা
বলার সময় আমার এক ধরণের টেনশান হয়। সারাক্ষণই মনে হয় এই বুঝি উচ্চারণে ভুল করলাম,
ক্রিয়াপদে ভুল করলাম। কিন্তু চায়নিজ বা অন্যদের সাথে কথা বলতে সেরকম টেনশান হয় না।
ইংরেজি তাদেরও মাতৃভাষা নয় বলেই হয়তো। বেশির ভাগ চায়নিজের ইংরেজি উচ্চারণ খুব একটা
ভালো নয়। কিন্তু সেভেন-ইলেভেনের এই চৈনিক ছেলেটার ইংরেজি উচ্চারণ একেবারে
অস্ট্রেলিয়ানদের মত।
“এনি পার্টিকুলার ফোন-কার্ড ইউ লুকিং ফর?”
“ফোন-কার্ড টু কল বাংলাদেশ?”
“বাংলাদেশ, বাংলা-দেশ, লেট মি সি”
মনে
হচ্ছে বাংলাদেশ সম্পর্কে এই ছেলেটার কোন ধারণাই নাই। সে একটা এলবামের মত বড় খাতা
বের করে বিভিন্ন রকমের ফোন কার্ড খুঁজে দেখছে আর বিড়বিড় করে “বাংলাদেশ” “বাংলাদেশ” করছে। আমার পেছনে জিনিসপত্র হাতে আরো কয়েকজন দাঁড়িয়ে
আছে। ছেলেটি এবার বেশ তাড়াহুড়ো করে বললো, “নাথিং পার্টিকুলার ফর বাংলাদেশ। বাট দিস ওয়ান ইজ ভেরি
গুড ফর ইন্ডিয়া। সেভেন্টি পার্সেন্ট ফ্রি টক-টাইম। সেভেন্টি ফাইভ মিনিটস্ ফর টেন
ডলার্স”
দশ
ডলারে পঁচাত্তর মিনিট! বাংলাদেশে এর অর্ধেক মিনিট পাওয়া গেলেও তো অনেক সস্তা।
টেলেস্ট্রা কার্ডে বিশ ডলারে মাত্র পনের মিনিট কথা বলা যায়। দশ ডলারে হয়তো সাত
মিনিট কথা বলা যাবে। সে হিসেবে এই কার্ড তো দারুণ। কমপক্ষে পঁয়ত্রিশ মিনিট।
কার্ড-তো নয় যেন পকেটভর্তি আনন্দ নিয়ে হোটেলের পথ ধরলাম। কত্তোদিন পর আজ মনখুলে
কথা বলবো আমার মামামের সাথে। ক’টা বাজে এখন
ওখানে? এখানে সোয়া সাতটা- ওখানে সোয়া তিনটা। তারা হয়তো ঘুমাচ্ছে। আর ঘন্টা দুয়েক
পর ফোন করবো। ভাবলাম কিছুক্ষণ ইয়ারার পাড়ে হেঁটে আসা যাক। কাল থেকে যেখানে থাকবো-
সেখান থেকে ইয়ারার দূরত্ব কত আমি জানি না। ‘ইয়ারা ইয়থ হোস্টেল’- হয়তো ইয়ারার কাছেই হবে।
বৃষ্টিভেজা
ইয়ারাকে বড় স্নিগ্ধ লাগলো আজ। নদীর পাড়ে দামাল বাতাস। দমকে দমকে বৃষ্টি। বৃষ্টির
পানি বরফ ঠান্ডা। এমন ঠান্ডায়ও মানুষের কমতি নেই ইয়ারার তীরে। ফুটব্রিজের উপর দিয়ে
নদী পার হয়ে ফ্লিন্ডার স্ট্রিট স্টেশনের পাশ দিয়ে সোজা এলিজাবেথ স্ট্রিট।
মেলবোর্ন
সি-বি-ডি বা সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট এর ম্যাপ দেখেই বোঝা যায় কতটা
পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে এই শহর। উত্তর থেকে দক্ষিণে পর পর পাঁচটি বড় বড় সমান্তরাল
স্ট্রিটঃ লা-ট্রোব, লন্সডেল, বার্ক,
কলিন্স আর ফ্লিন্ডার্স। এর সবগুলো দিয়েই ট্রাম চলে। লন্সডেল, বার্ক আর কলিন্স
স্ট্রিটের সমান্তরালে ছোট ছোট আরো তিনটি রাস্তা আছে। লন্সডেলের আগে লিটল লন্সডেল,
বার্কের আগে লিটল বার্ক, এবং কলিন্সের আগে লিটল কলিন্স স্ট্রিট। আর পশ্চিম থেকে
পূর্বে নয়টি সমান্তরাল স্ট্রিটঃ স্পেন্সার, কিং, উইলিয়াম, কুইন, এলিজাবেথ,
সোয়ান্সটন, রাসেল ও স্প্রিং। সব মিলিয়ে একটি চমৎকার আয়তক্ষেত্র। এই আয়তক্ষেত্রটি
যদি মেলবোর্নের হৃৎপিন্ড হয়, তাকে ঘিরে সারা শরীর- বৃহত্তর মেলবোর্ন- ওয়ান অব দি
মোস্ট লিভেবল সিটিজ ইন দি ওয়ার্ল্ড।
এলিজাবেথ
স্ট্রিটের ম্যাকডোনাল্ডস্-এ ঢুকেছিলাম আজ। কাল থেকে থাকার খরচ কমে যাবে ভেবে পুরো
একটা বিগ-ম্যাক মিলের অর্ডার দিলাম- কোকাকোলা, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর স্যান্ডুইচ- মামাম
যার বাংলা করেছে- ‘বালু ডাইনি’।
রুমে
ফেরার সময় রিসেপশানে খোঁজ নিলাম হোটেলের চেকিং আউট টাইম কখন। একটা মজার হিসেব দিলো
রিসেপশানিস্ট ক্যারোলিন। কী মজা বলছি- তার আগে দেখি তোমার গাণিতিক বুদ্ধি কেমন। বলতো
দেখি- এই হোটেলে ছয় রাত থাকলে যত ভাড়া দিতে হবে- সাত রাত থাকলে ভাড়া তার চেয়ে বেশি
দিতে হবে, নাকি কম দিতে হবে? তুমি নিশ্চয় ভাবছো আমার বুদ্ধির স্তর আরো কয়েক ধাপ
নেমে গেছে এই ক’দিনে। নইলে এ জাতীয় প্রশ্ন করছি কেন?
প্রশ্ন করছি কি আর সাধে! এটাই মজা। ক্যারোলিন বললো- এই হোটেলে ছয় রাত থাকার চেয়ে
সাত রাত থাকা লাভজনক। ব্যাপারটা গোলমেলে ঠেকছে না?
ক্যারোলিন
বললো, “ইফ ইউ চেক আউট টুমরো- ইট উইল বি
সিক্স নাইট্স- ইন দ্যাট কেস- ইউ উইল বি চার্জড এট নাইটলি রেট- থার্টি সেভেন ডলার্স
পার নাইট”। ক্যালকুলেটর হাতে দ্রুত হিসেব করে
বললো, “টু হান্ড্রেড এন্ড টুয়েন্টি টু। বাট
ইফ ইউ চেক আউট ডে আফটার টুমরো- ইট উইল বি সেভেন নাইট্স- সো উই হ্যাভ স্পেশাল উইক্লি
রেট- থার্টি ডলার্স পার নাইট- টোটাল টু হান্ড্রেডস এন্ড টেন”। কী মজা না? আরো মজা হলো কাল সকাল দশটার
মধ্যে চেক-আউট না করলে কাল রাতের ভাড়াও দিতে হবে। এই তো চাই। কাল দুপুরে আলী সাহেব
আসবেন, তখনই চেক-আউট করবো। হিসেবে সাত রাত
হবে, বারো ডলার বাচবে।
ন’টা বাজতে না বাজতেই যে ক’টা কয়েন ছিল সব নিয়ে দৌড়ে নেমে গেলাম
লাউঞ্জে। কোণার দিকের পাবলিক টেলিফোন দখল করলাম। অনেকক্ষণ কথা বলবো আজ। দিদিভাই
অবাক হয়ে যাবে।
এই
কার্ডটির সিস্টেমও টেলেস্ট্রা কার্ডের মতই। চল্লিশ সেন্ট কয়েন বক্সে ফেলে ডায়াল
করলাম কার্ডে উল্লেখিত লোকাল নাম্বারে। রিং হলো, পিন নাম্বার ডায়াল করলাম,
দিদিভাইর নাম্বার ডায়াল করলাম, “ইউ হ্যাভ
সেভেনটি ফাইভ মিনিট্স ফর দিস কল”- পুরো এক
ঘন্টা পনের মিনিট! কী আনন্দ! রিং হচ্ছে রিং হচ্ছে- পিক আপ দি ফোন- আধমিনিট, এক
মিনিট- রিং বদলে যাচ্ছে- কেউ ধরছে না। কী হলো? বাসায় কেউ নেই? দিদিভাই, মামাম,
রাকামণি সবাই বাইরে গেছে? নাকি টেলিফোন ডেড হয়ে গেছে! টি-এন্ড-টি’র ফোন বিনা নোটিশেই মারা যেতে পারে। সামথিং
রং। রিং বন্ধ হয়ে গেলো। যান্ত্রিক পুরুষ কন্ঠ- “দি নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়াল্ড, ক্যান নট বি রিচ্ড,
প্লিজ ট্রাই এগেন লেইটার”। লাইন কেটে
গেলো।
অজিতের
মোবাইল ফোন আছে। আমি আসার কিছুদিন আগে তার কোম্পানি থেকে দেয়া হয়েছে। লাখ টাকা
নাকি দাম। পুলিশের ওয়াকিটকির মত সাইজের একটা জিনিস, রেডিও’র মত লম্বা এন্টেনা তুলে দিয়ে কথা বলা যায়। এই বস্তুটা সে
যেখানে যায়- সাথে রাখে। তাকে ফোন করলে নিশ্চয় পাবো। এবার পঞ্চাশ সেন্টের একটা কয়েন
দিয়ে আবার ডায়াল করলাম। এই পে-ফোন কোন রিফান্ড দেয় না। এবারো একই অবস্থা। অজিতের
মোবাইল নাম্বারেও রিং হচ্ছে, কিন্তু ধরছে না। ফল্স রিং। রিং এর মাঝে মাঝে টুং টাং
বাজনা। কিছুক্ষণ পর আবার যান্ত্রিক কন্ঠ- “দি নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়াল্ড ক্যান নট বি রিচ্ড। প্লিজ
ট্রাই এগেইন লেইটার”। ট্রাই এগেইন- এগেইন- এগেইন! হায়রে
আমার সেভেনটি পার্সেন্ট ফ্রি টক-টাইমের ফোন কার্ড! বাংলাদেশে যে ক’টা নাম্বার আমার জানা ছিল- প্রায় সবগুলোতেই
ট্রাই করলাম। সব টেলিফোনই কি এক সাথে মরে গেলো! আসলে সস্তার যে কতরকম অবস্থা হয় তা
দেখলাম। চার ডলার সত্তর সেন্ট আর আড়াই
ঘন্টা সময় খরচ করেও একটা লাইন কথা বলতে পারলাম না কারো সাথে। ৭০% ফ্রি টক-টাইম তো নয়,
১০০% টক-ফ্রি টাইম।
অনেক
আশা করেছিলাম বলেই একটু বেশি হতাশ লাগছে। ইচ্ছে করছে টেলেস্ট্রা ফোন কার্ড কিনে
আনি, ইচ্ছে করছে হোটেলের ফোন থেকেই সরাসরি ইন্টারন্যাশনাল কল করি। কিন্তু বিল দেয়ার
সামর্থ্য যে নেই এই মুহূর্তে।
গত মঙ্গলবার রাতে সুটকেস গুছিয়েছিলাম দেশ ছাড়ার জন্য।
আজ ঠিক একসপ্তাহ পরে প্রায় একই সময়ে সুটকেস গোছালাম হোটেল ছাড়ার জন্য। গোছাতে খুব
একটা সময় লাগলো না। কারণ একটা শার্ট আর সোয়েটার ছাড়া আর কিছুই বের করা হয়নি সুটকেস
থেকে।
ঘুম আসছে না। রাত দুটো বাজলো একটু
আগে। লাইট নিভিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়েছি। একটু যদি আকাশ দেখা যায়। কিন্তু না,
স্কাই-স্ক্র্যাপারের উজ্জ্বল আলোয় আকাশ দেখা সম্ভব না। বৃষ্টি হচ্ছে খুব।
“এমন দিনে মন
খোলা যায় -
এমন মেঘ-স্বরে বাদল ঝরো-ঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়”
কিন্তু তুমিই বলো, মন খোলার কি উপায়
আছে?
__________________
PART 10
PART 10
No comments:
Post a Comment