২৪ জুলাই ১৯৯৮ শুক্রবার
সারা সকাল চারতলার কম্পিউটার রুমে
কাটিয়ে দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে অফিসে ঢুকতেই ম্যান্ডি বললো, “ইওর ফাদার কল্ড”। আমার বাবা ফোন করেছিলেন! অসম্ভব। বাবার টেলিফোন
ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। তবে কি কেউ টেলিফোন করে বাবার ব্যাপারে কিছু বলেছে? দুর্বল
মনের স্বভাবই হলো দুঃসংবাদের আশঙ্কা করা। বাবার শরীর ভালো নেই দেখে এসেছি। আতঙ্কে অস্থিরতায়
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। কোন রকমে জিজ্ঞেস করলাম, “এনি ম্যাসেজ?”
“হি সেড হি উইল কল ইউ এগেন”
কে
ফোন করতে পারে? অজিত ফোন করলে তো নাম বলবে।
ফোনের কাছে বসে রইলাম। সময় যেন থেমে গেছে। মন বসছে না কিছুতেই। একটার দিকে
ফোন বেজে উঠলো। প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ফোন ধরলাম। “হ্যালো”-
“ইজ ম্যান্ডি দেয়ার?” একটা পুরুষ কন্ঠ ম্যান্ডিকে চাইছে। তারপর পুরো একঘন্টা
ফোন ছাড়লো না ম্যান্ডি। আমি যে একটা জরুরী ফোনের জন্য অপেক্ষা করছি তা কি
ম্যান্ডির বোঝা উচিত নয়? অবশেষে দুটোর দিকে ফোন রেখে “বাই বাই, হ্যাভ এ নাইস উইকএন্ড” বলে চলে গেলো ম্যান্ডি। রুমে আর কেউ নেই। অস্থির হয়ে
অপেক্ষা করছি তো করছিই। ফোনটা এলো আড়াইটার দিকে।
“হ্যালো”
“প্রদীপ, ভালো আছো?”
“জ্বি স্যার, ভালো আছি”
“সকালে একবার ফোন করেছিলাম। তুমি ছিলে না।
একটা মেয়ে ফোন ধরেছিল। তোমার কলিগ মনে হয়”
এতক্ষণে
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আলী সাহেবই ফোন করেছিলেন। কিন্তু ম্যান্ডি যে কেন তাঁকে
আমার বাবা ভেবে বসলো জানি না।
“আচ্ছা তোমার বাসার ঠিকানাটা বল তো”- আলী সাহেব আমার বাসার ঠিকানা জানতে
চাচ্ছেন! ব্যাপার কী? বাসায় ওঠার আগে তাঁকে জানিয়েছিলাম ঠিকানা। নিশ্চয় হারিয়ে
ফেলেছেন। ঠিকানা লিখতে লিখতে জিজ্ঞেস করলেন, “পার্কিং এর কী ব্যবস্থা ওখানে?”
“বিল্ডিং এর সামনে অনেকগুলো গাড়ি রাখার জায়গা
আছে”
“সন্ধ্যাবেলা একবার আসবো তোমার বাসায়- ছ’টা সাড়ে ছ’টার দিকে। বাসায় থেকো ওই সময়”
ফোন রেখে দিলেন আলী সাহেব। এক ধরনের মিশ্র
অনুভূতি নিয়ে বাসায় চলে এলাম। আমি কীভাবে থাকছি দেখতে আসছেন আলী সাহেব। আমার তো
খুশি হবার কথা। কিন্তু কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার আবাসনের দৈন্যদশা
দেখে করুণা হবে তাঁর। জানি এ ধরণের হীনমন্যতাকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়। কিন্তু কী
করবো, ভাবনার ডালপালা যে গজাতে শুরু করেছে। ফিল আর ফিলের অস্থায়ী গার্লফ্রেন্ডকে
দেখলে কী ভাববেন আলী সাহেব? বাসার পরিবেশ সম্পর্কে কী ধারণা হবে তাঁর?
আলী
সাহেব নিশ্চয় বুঝতে পারবেন এ বাসার পরিবেশ গঠনে আমার কোন ভূমিকা নেই। অস্ট্রেলিয়ার
ফিল-জাতীয় সামাজিক বোঝা সম্পর্কে আলী সাহেব নিশ্চয় সচেতন। কিন্তু ভাবনা হচ্ছে তাঁকে
দেখে ফিল কেমন ব্যবহার করেন। বাসায় কেউ আসুক এটা মনে হয় ফিলের পছন্দ নয়। নইলে কেউ
কি দরজার বাইরে নোটিশ টাঙিয়ে রাখে “নো বডি ইজ
এলাউড ইন মাই এপার্টমেন্ট, এক্সেপ্ট গার্লফ্রেন্ডস”?
পাঁচটা
বাজতে না বাজতেই হৈ চৈ শুরু হয়ে গেছে ফিলের লাউঞ্জরুমে। শুক্রবার বিকেল থেকেই মদের
হুল্লোড় শুরু হয়ে যায় এদের সভ্যতায়। ফিলের শুক্রবারের সন্ধ্যার রুটিন সম্পর্কে
এখনো কোন ধারণা নেই আমার। মনে হচ্ছে হুল্লোড়টা মাত্রা ছাড়াবে।
ফিলের
বান্ধবী ছাড়াও আরো কয়েকজন মহিলার হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। অদ্ভুত জীবন-যাপন এদের।
এটা কি স্বাধীনতা নাকি স্বেচ্ছাচারিতা নাকি অন্যকিছু ঠিক বুঝতে পারছি না। এদের জীবনের
কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে বলেও তো মনে হয় না। গতকাল সন্ধ্যায় যখন রান্না করছিলাম-
ফিল এসে কিছুক্ষণ বক বক করেছেন। মাতাল হয়ে গেলে মানুষের কথার কোন লাগাম থাকে না।
অনেকে বলে থাকেন তখন নাকি মুখ দিয়ে সত্যি কথাই বেরোয়। জানি না কথাটা কতটুকু
বিশ্বাসযোগ্য। ফিল বলেছেন এ পর্যন্ত তিনজনকে বিয়ে করেছেন তিনি, ছাড়াছাড়িও হয়ে
গেছে। ডেভিড ছাড়াও আরো সন্তান আছে তার। ঠিক কতজন মনে করতে পারলেন না। এমনকি তারা
কোথায় আছে তাও জানেন না। জানার দরকার বোধও করেন না মনে হয়।
ফিলের
বর্তমান বান্ধবীর নাম ক্যাথি, থাকে সামনের বিল্ডিং-এ। ক্যাথিরও নিশ্চয় বিয়ে হয়েছিল
অনেক বার, ছেলেমেয়েও আছে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থার সাথে এদের কত পার্থক্য। আমাদের
মা-বাবারা নিজেদের জীবন সাজিয়ে নেন সন্তানদের কেন্দ্র করে। সন্তানরা বড় হয়ে গেলে
মা-বাবারা নিজেদের জীবন নিয়ে আলাদা করে কখনোই ভাবেন না। আর এখানে জীবন কত অন্যরকম।
রুম
গোছানোর তেমন কোন দরকার হলো না। আমার জিনিসপত্র এত কম যে অগোছালো হবার কোন সুযোগই
নেই। বাথরুমের আয়নায় মুখ দেখে নিজেকে কেমন যেন হতাশাগ্রস্তের মত মনে হলো। দু’দিন শেভ না করার ফল। খুব অনাগ্রহের সাথে যে
সমস্ত কাজ আমাকে করতে হয়- শেভ করা তাদের একটি। দাড়ি রেখে দিতে পারলে ভালো হতো।
কিন্তু মামামের কড়া হুকুম- দাড়ি রাখা চলবে না, প্রতিদিন শেভ করতে হবে। প্রতিদিন
শেভ করলে নাকি আত্মবিশ্বাস বাড়ে। প্রতিদিন শেভ না করলে আত্মবিশ্বাস কতটুকু কমে
জানি না, কিন্তু আলসেমির কারণে প্রতিদিন শেভ করা হয় না।
আলী
সাহেবের আগমন উপলক্ষে শেভ-টেভ করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি সব চুপচাপ হয়ে গেছে।
লাউঞ্জ রুমে কারো কোন সাড়াশব্দ নেই। রুমে ঢোকার আগে লাউঞ্জে উঁকি দিলাম। কোথাও কেউ
নেই। আবছা অন্ধকার ঘরে এক জোড়া চোখ জ্বল-জ্বল করছে, ফ্লপির। আমার পায়ের শব্দ শুনে
ফ্লপি বললো “মিয়াঁও”।
ফিলরা
কেউ না থাকাতে খুব হালকা লাগছে। তারা ফিরে আসার আগেই যদি আলী সাহেব চলে আসেন খুব
ভালো হয়। ছ’টার দিকে নিচে নেমে এলাম। সিঁড়ির
কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম আলী সাহেবের গাড়ির জন্য।
সূর্য
ডুবে গেছে কত আগে। আজ সকালে সামান্য বৃষ্টি হয়েছিল, তারপর সারাদিন রোদ ছিল।
ঠান্ডাও কিছুটা কম মনে হচ্ছে এখন। আসলেই কম নাকি আস্তে আস্তে অভিযোজিত হয়ে যাচ্ছি
ঠিক জানি না। বেশ কয়েকটা গাড়ি এসে
পার্কিং লটের বিভিন্ন জায়গায় থেমে গেলো। আলী সাহেবের ফোর্ড ফ্যালকন এলো আরো
কিছুক্ষণ পর, সাড়ে ছ’টার দিকে। গাড়ি থেকে তিনি বেরোতেই
আমি এগিয়ে গেলাম।
“বেশ বড় পার্কিং এরিয়া দেখছি। অস্ট্রেলিয়ান
গভমেন্ট লো-ইনকাম আর্নারদের জন্য কত সুযোগ সুবিধে দিচ্ছে দেখেছো? এগুলো সব গভমেন্ট
হাউজিং”
“জ্বি স্যার। আসেন”
“দোতলায় না?”
“জ্বি স্যার”
সিঁড়ি
দিয়ে উঠার সময় আলী সাহেব পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চাপা দিলেন। সিঁড়িতে
প্রশ্রাবের গন্ধটা কি আজো আছে? আমি টের পাচ্ছি না। তবে কি গন্ধটাও আমার নাক-সহা
হয়ে যাচ্ছে?
“হুমায়রা ভাবী চিঠি লিখেছেন তোমার ভাবীকে।
তোমার সম্পর্কে অনেক প্রশংসা করেছেন চিঠিতে”- বাসায় ঢুকতে ঢুকতে বললেন আলী সাহেব।
“চিঠি পেয়ে তোমার ভাবী বললেন আমি যেন নিজের
চোখে দেখে যাই তুমি কেমন আছো। ব্যবস্থা ভালো না হলে যেন সাথে করে নিয়ে যাই আমাদের
বাসায়। আমাদের অত বড় বাড়ি”
“আমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না স্যার। এখানে সব
কিছু আছে”
“তাই তো দেখছি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে
ইউনিভার্সিটির এত কাছে। বিট্টুর তো আর-এম-আই-টি’তে আসতে যেতেই দু’ঘন্টা চলে যায়”।
আলী
সাহেব আমার রুম দেখলেন, লাউঞ্জরুম দেখলেন, রান্নাঘর দেখলেন। দেখে সন্তুষ্ট হলেন।
ফিল না থাকাতে আমার কী যে সুবিধা হয়েছে।
“ও-কে দ্যান। আমাকে যেতে হবে। ফ্রাইডে
ট্রাফিক যে কী বস্তু গাড়ি না চালালে বুঝবে না”। বের হতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন আলী সাহেব- “তোমার টয়লেটটা কোন্ দিকে?”
মনে
হলো চারশ চল্লিশ ভোল্টের একটা ইলেকট্রিক শক খেলাম। টয়লেটের কথা আমার মনেও ছিল না।
এখন আলী সাহেব যদি টয়লেটে ঢোকেন আর টয়লেটের দেয়ালে লাগানো পর্নো পোস্টারগুলো
দেখেন- আমাকে আর মুখ দেখাতে হবে না। আমাকে
সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, কিন্তু মনে মনে যা ভাববেন তা ভালো কিছু নয়। আমি তো
আগ বাড়িয়ে বলতে পারবো না যে পোস্টারগুলোতে আমার কোন হাত নেই। হুমায়রা আপার দেয়া
আমার ভালোত্বের সার্টিফিকেট এক মুহূর্তে ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে যাবে। আলী সাহেবকে
কিছুতেই টয়লেট দেখানো যাবে না। কিন্তু কোন্ অজুহাতে?
প্রয়োজনই
আবিষ্কারের প্রসূতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে কত কম সময়ের মধ্যে কত বেশি
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয়েছে। আমারও এখন হঠাৎ যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
সম্মান বাঁচানোর যুদ্ধ। এ যুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে- বিশ্বাসযোগ্য ভাবে
মিথ্যা বলা। তাই করতে হলো। বললাম- “ওদিকে। আমি
দেখে আসছি ফ্রি আছে কি না”।
টয়লেটের
সামনে এসে দরজায় টোকা দিয়েই বেশ জোরে বললাম, “ওহ্, সরি”। এমন ভাব করলাম যেন ভেতরে কেউ আছে। আলী সাহেবকে এসে বললাম- “একটু অপেক্ষা করতে হবে, টয়লেট এনগেজ্ড”।
শুক্রবারের
সন্ধ্যা। আলী সাহেবকে যেতে হবে অনেক দূর। অপেক্ষা করার সময় তাঁর না থাকারই কথা। আর
অপেক্ষা করতে চাইলেও করতে পারেন। যতই অপেক্ষা করুন টয়লেট এনগেজড্ই থাকবে।
আলী
সাহেব অপেক্ষা করলেন না। বেরিয়ে গেলেন। আমিও দরজায় তালা লাগিয়ে তাঁর পিছু নিলাম।
“এবার একটা পার্ট-টাইম কাজ জোগাড় করতে পারো
কি না দেখো। যে কোন ধরনের কাজ। এদেশে কোন কাজই অসম্মানের নয়। বিট্টুতো
রেস্টুরেন্টের কিচেনে কাজ করে। আমি তাকে বলেছি তোমার জন্য কাজ দেখতে। তুমিও তাকে
ফোন করে বলো”
“জ্বি স্যার, বলবো”
“সুপার
মার্কেটগুলোতে দেখতে পারো। কালতো স্যাটারডে। কালকের পেপারে অনেক এড থাকবে
পার্ট-টাইম জবের। ক্লিনিং টাইপের জবগুলোতে ফোন করে দেখো। একটা না একটা হয়ে যাবে”
“জ্বি স্যার”
“ও-কে দ্যান।
টেক কেয়ার”
আলী সাহেবের গাড়ি পার্কিং লট থেকে
বেরিয়ে রাস্তায় নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারপর চলে এলাম রুমে।
মানুষ মানুষের জন্য এরকম
নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছে দেখলে একটা প্রশ্নই মনে আসে বার বার- আমি কি কখনো কারো
জন্য কিছু করতে পারবো? এরকম নিঃস্বার্থভাবে? আমি এদেশে ভালো থাকি কি মন্দ থাকি
তাতে হুমায়রা আপা বা আলী সাহেবদের কী আসে যায়? অথচ আমার জন্য তাঁরা কত ভাবছেন। ভালোবাসার
এত ঋণ আমি কীভাবে শোধ করবো?
No comments:
Post a Comment